তারকারাজি-০১
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
শরতের বিকেল। পশ্চিমাকাশে সূর্যের লাল বর্ণ তখন নিষ্প্রাণ। একটু পর-ই নেমে আসবে সন্ধ্যা। মুছে যাবে আজকের দিনের অস্তিত্ব।
কোলাহলে পরিপূর্ণ টিএসসিতে বসে আড্ডা জমিয়েছে বন্ধুদল৷ এই বন্ধুদলের মাঝেই নীলাশা অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। কী গভীর চিন্তার আঁচড় তার মস্তিষ্কে! যেন রহস্য উদঘাটন করাটাই এই মস্তিষ্কের অন্যতম কাজ৷ হাতের সাদা কাগজটায় পারলে যেন সে ঢুকেই যাবে! মিশে যাবে এই কাগজে লেখা প্রতিটি অক্ষরের সাথে। রহস্য উদঘাটন করে তবেই যেন শ্বাস নিবে নীলাশা। এমন-ই মনোবল নিয়ে কাগজটি পড়ছে সে৷ তার মন বলে ওঠে, কেউ ইচ্ছা করেই এটা টিএসসিতে রেখে গেছে। হয়তো হারানো কিছু বন্ধুকে মনে করে! যেখানে লেখা,
“ নোটে নোটে চিঠি লেখার গল্পগুলো
আজ পুরনো দিনের গান করে।
বালিকা হলে উঁকিঝুঁকির অভিযোগগুলো
হঠাৎ হঠাৎই খুব মনে পড়ে।
তোদের দেওয়া স্মৃতিগুলো ছড়িয়ে আছে
আমার মন খারাপের প্রাঙ্গণ জুড়ে।
বন্ধু শোন,
আমার তোদের খুব মনে পড়ে।
ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার বিশৃঙ্খল দিনগুলো
আজও তাদের সুখ-দুঃখের গল্প করে।
আমি শুনি, আমি কাঁদি।
আবার হেসে হেসেই সেগুলো উড়িয়ে দেই
তোদের ঠিকানা জুড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হওয়া তোদের গল্পগুলো
আজও বেঁচে আছে আমার বুক জুড়ে।
বন্ধু শোন…
আমার সত্যিই তোদের খুব মনে পড়ে। ”
নীলাশা বিদেশে লেখাপড়া করলেও কোনো এক সূক্ষ্ম কারণবশত বিদেশী সাহিত্যে স্বাদ খুঁজে পায় না সে। মনের সকল প্রকার অনুভূতি প্রকাশের জন্য একমাত্র বাংলা ভাষাটাই তার কাছে সেরা বলে মনে হয়। বিদেশে থাকাকালীন সময়ে খুব একটা বাংলা সাহিত্যের বই-টই পড়তে পারেনি সে। দেশে এসে কিছু পড়েছে… এ-ই যা! একারণেই বাংলা লেখা পড়তে তার অসুবিধা হয় না। আর এই সাদামাটা কাগজটা পড়তে তো একদম-ই হয়নি। কিন্তু ঝামেলা হলো অন্য এক জায়গায় এসে। এটা কোনো ছড়া, কবিতা না-কি কোনো গান তা বুঝতে পারছে না নীলাশা। এই ঝামেলাটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু লেখকের সাথে সহমত হতে না-পারাটাই যেন চিন্তার কারণ হলো তার। এই চিরকুট লেখক কেন শুধু ভার্সিটির বন্ধুদের কথা-ই উল্লেখ করেছে? এই-তো নীলাশার বামে বসে থাকা যমজ দুই ভাই নিশান ও রিশান; যারা নীলাশা ও তাদের-ই বান্ধবী মিশমির কলেজ জীবনের বন্ধু। যমজ হলেও তাদের চেহারার কোনো মিল নেই। তারা বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র হলেও নীলাশা ও মিশমি ছিল বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। এই দুই দলের মাঝে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে কী-করে যে বন্ধুত্বটা হয়ে গিয়েছিল, তা আর বলে বোঝানোর নয়। নীলাশার ডান পাশে বসে থাকা মিশমি, নীলাশার কলেজের বান্ধবী। প্রথম স্বদেশীয় বান্ধবী নিজ দেশের-বাড়িতে পড়তে যাওয়ার পর যে বিষণ্ণতা ও একাকিত্ব নীলাশাকে জেঁকে ধরেছিল, তা ঘুচে দেওয়ার জন্যই হয়তো মিশমি এসেছিল তার জীবনে। মিশমির পাশেই বসে আছে নীলাশার পুরনো ও প্রথম স্বদেশীয় বান্ধবী পিহু। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই ময়মনসিংহে ভর্তি হয়েছিল পিহু। একই ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ হয়েছে বলে আবারো দুই বান্ধবীর সাক্ষাৎ। বলা বাহুল্য, বান্ধবী নীলাশার তাগিদে এই বন্ধুমহলের প্রত্যেকের সাথেই তার যোগাযোগ ছিল মাস খানিক ধরে৷ আজ এই বন্ধুমহলের সাথে তার দেখা হওয়াটা যেমন প্রথম নয়, তেমন-ই তাদের সাথে জম্পেশ আড্ডায় মেতে ওঠাটাও পিহুর কাছে নতুন নয়। বরং বেশ পুরনোই বলা চলে! তাহলে কেন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হওয়া বন্ধুদের কথা বলেছেন এই চিরকুট লেখক? বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ছাড়া কি আর কেউ বন্ধু হওয়ার যোগ্য নয়? এমন কেন চিরকুট লেখকের বিচার-বিবেচনা?
এই উদ্ভট রহস্যের সমাধান খোঁজা আর সম্ভব হচ্ছে না নীলাশার পক্ষে। চিরকুটটা ভাঁজ করে নিজের ব্যাগে রেখে দেয় সে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যার আগমন। চারপাশটা আরও একটু মিইয়ে আসতেই মিশমি বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে উঠে,
“ সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। এখন বাসায় না-গেলে আম্মু মেরেই ফেলবে। জানিস না-তো কত কিছু বলে এখনো বাসার বাইরে আছি। আম্মু তো পারলে এখানে এসেই আমাকে… ”
তাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না বন্ধুগণ। মিশমির এই কথা শুনতে-শুনতে তারা খুব-ই বিরক্ত। তাদের মধ্যে থেকে নিশান ধমকে উঠে বলল,
“ এই ছেড়ি, ঝাণ্ডুবাম! মাথা খাইস না তো। তখন থেকে এক-ই আলাপ করতাছোস বাসাত-যাবি, বাসাত-যাবি… তে যাস না ক্যান? তোরে কেউ বেঁধে রাখছে এখানে? ”
মিশমি ভ্রু কুঁচকে তাকায় বন্ধুর দিকে। তখন নিশান আবারও বলে,
“ দেখ, দেখ। পিহুকে দেখ, কতদূর থেকে পড়তে আসছে আমাদের সাথে। ওর মায়ের কোনো টেনশন আছে? তোর মায়ের এত টেনশন ক্যান? আমাদের কি মা নাই? ”
“ দেখ নিশান, আম্মুকে নিয়ে কিছু বলবি না৷ সব মা-ই এক রকম হয় না৷ পৃথিবীর সব মা এক হলে জন্মদাত্রী-মা, পালনকর্ত্রী-মা কিংবা সৎ-মায়ের মতো কোনো শব্দ থাকত না। মায়েদের অনেক বৈশিষ্ট্য আছে। আর আমার মায়ের বৈশিষ্ট্য হলো তার একমাত্র সন্তানকে সব-সময় ভালো পথ দেখানো। আম্মু আমার একটু বেশিই কেয়ার করে, জানি। তবে তা নিশ্চয় আমার ভালোর জন্যই? ”
“ ভালোর জন্য না-তো ছাই! আমরা যেন তার মেয়েকে বেচে দিচ্ছি কোথাও! ”
মুখ বাঁকিয়ে কথাটা বলল নিশান৷ মিশমি বরাবরই খুব ধীরস্থির স্বভাবের মানুষ। কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদ না-করা, যৌক্তিক কারণ ছাড়া কাউকে কোনো অপবাদ না-দেওয়া এমনকি সকলকে আপন করে নেওয়ার মতো চারিত্রিক গুণ-ও অর্জন করেছে সে। বন্ধুদের মতে, মিশমির বাবার চারিত্রিক গুণের প্রতিচ্ছবিই তার মাঝে লক্ষ্য করা যায়। এদিকে নিশানের কথায় হেসে ফেলল পিহু। সে বলল,
“ আহ্ নিশান! কেন ওকে রাগিয়ে দিচ্ছ বলো তো? এই ধামরি যে আন্টিকে ভয় পায়, তা তো তোমরা ভালো করেই জানো। ”
পিহুর কথা শেষ হতে না হতেই, নীলাশা নিজের মুখভঙ্গিকে বিস্ময়ের রূপ দিয়ে বলল,
“ হাও ম্যানি টাইমস হ্যাভ আই টোল্ড ইউ দিজ, পিহু? এখনো তুই নিশানদের তুই-করে ডাকতে পারছিস না? বন্ধুদের এই সব তুমি-তুমি করলে কেমন বউ-জামাই টাইপ লাগে। হাও অকওয়ার্ড! ”
নীলাশার কথা শুনে পিহু গগন কাঁপানো হাসিতে ঢলে পড়ল মিশমির গায়ে। মেয়েটার হাসি ভীষণ ভয়ঙ্কর! হাসতে-হাসতে তার গা হেলে-দুলে ওঠে। চোখে আসে জল। তার এই হাসির জন্যই যে তাকে কত কথা শুনতে হয়! তার কোনো হিসাব নেই। এতো দ্রুত বান্ধবীর বন্ধুমহলটাকে নিজের বন্ধুমহল বলার অধিকার অর্জন করে নেওয়াটা হয়তো সবার কাছেই সহজ না৷ তবে পিহুর কাছে প্রচলিত বাংলা কথা ডাল-ভাতের মতোই সহজ। কিন্তু সমস্যা হয় নিশান-রিশানদের সাথে কথা বলতে গিয়ে। এই দুই ভাইয়ের ক্ষেত্রে তুই আর তুমি উলোট-পালোট করে ফেলাটা যেন পিহুর নিত্যদিনের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এটা নিয়ে নীলাশা আর মিশমির সেই কী রসিকতা! ‘তুমি’ ডাকাটা না-কি তাদের কাছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের সম্বোধনের মতো লাগে। পিহু অবশ্য এইসব হেসে উড়িয়ে দিতে পারে বেশ! হাজারো গম্ভীর, রূঢ়, অন্তর্মুখী মানুষের সাথে চট করে মিশে যেতে পারাটা যেন পিহুর বা’হাতের খেল! যেমন নীলাশার মতো অন্তর্মুখী মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল তার৷ নিজের এহেন মিশুক স্বভাবের জন্যই হয়তো নীলাশার পাশাপাশি এমন কিছু বন্ধু পেয়েছে সে।
এদিকে নীলাশার নাক সিঁটকানো দেখে নিশান আবারও বেশ বিরক্ত হলো। বান্ধবীটা কী বিশ্রীভাবে মুখ কুঁচকালো! আজ যেন ব্রহ্মাণ্ডময় সকল বিরক্তই নিশানকে গ্রাস করে ফেলেছে। সে নীলাশাকে কিছু বলার আগেই, তার ছোট ভাই তার-ই মুখের কথা কেঁড়ে নিল। রিশান বিরক্ত হয়ে বলল,
“ এই ব্রিটিইশ্শা! ব্রিটিশদের মতো ইংলিশ ঝাড়িস না। তোর এই ইংলিশের জন্যে কবে যে মুখ বরাবর একটা লাত্থি খাবি তুই! ”
কথাটা শুনতেই মাথায় আগুন লেগে যায় নীলাশার। সে স্পষ্ট উত্তর দেয়,
“ শোন, আমি বাঙালি। ইংল্যান্ডে থাকতাম বলেই-যে আমার জাত পাল্টে গেছে, তা না। আমি পুরনো দিনের অনেক বাংলা সাহিত্য পড়েছি। সমাস, কারক, বাগধারা, উপসর্গ পড়েছি। বাংলাটা আমিও বলতে পারি। এইযে, শুনতে পাচ্ছিস না আমি বাংলায় কথা বলছি? ”
“ আণ্ডা করতাছো তুমি! ”
নিশান-রিশানের এহেন ব্যবহার আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। তিক্ততার থেকেও অধিক তিক্ততায় পরিণত হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা। রিশানের সেই কথার উত্তরে মিশমি ক্যাটক্যাট করে বলে উঠল,
“ কী ব্যাপার বল তো, দুই ভাই-ই একসঙ্গে ক্ষেপে আছিস কেন? ছ্যাঁকা খাইছিস না-কি? ”
পিহু মুখে সিঙ্গারা পুড়ে বলে, “ আঁতেল! দুইজনে একসাথে ছ্যাঁকা খায় কীভাবে? তুই কি বলছিস দো মালি এক ফুলের কাণ্ড ঘটে গেছে? ”
মিশমি হাসির রেখা প্রসারিত করতেই নিশান বলল,
“ আর বলিস না বান্ধবী! বড় ভাইয়েরা বলছিল ভার্সিটিতে এসে দেখা করতে। তারা কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের কাছে থাকবে। এইযে দাঁড়ায় থাকলাম… একটা ভাইয়েরও দেখতে পাই নাই। পরে ফোন দিয়ে শুনলাম কোন জানি ক্যাঁচালে গেছে। এখন ফোন দিয়ে বলে রমনা পার্কে দেখা করতে৷ সারাদিন ঘুরে-টুরে, ক্লাস করে এখন আবার দেখা করতে যেতে ইচ্ছা করে না-কি? শরীরডা বিছনা-বিছনা করতাছে। বড় ভাই দেখে না-ও করতে পারছি না! ”
মিশমি বোঝে না এদের এতো ‘বড়-ভাই’ কোত্থেকে আসে৷ কই, তাদের তো নেই? সে মিনমিনে গলায় বলে ওঠে,
“ তুই বল তোদের সাথে তোদের ফ্রেন্ডসরা আছে। কাল দেখা করে নিবি। তাহলেই তো আর যেতে হয় না। সিম্পল! ”
রিশান মিশমিকে ব্যঙ্গ করে উত্তর দেয়,
“ উঁহ্… শিম্পল! কত সোজা, না? ভাইয়েরা এখনি দেখা করতে বলছে। বুঝিস না, স্কুল জীবনের সিনিয়র এখন ভার্সিটি জীবনের সিনিয়র হয়ে গেছে? না গেলেও বেয়াদবি করা হবে। ”
কিছু একটা ভেবে নিয়ে রিশান আবারও বলে, “ এক কাজ কর? তোরা ফইন্নিগুলা চলে যা। আমরা না-হয় দেখা করেই যাই। বুঝছোস? ”
নিশান ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে প্রশ্ন করে, “ নীল, তুই একা যেতে পারবি? না-কি দিয়ে আসব তোকে? ”
নীলাশা জানে, কেন নিশানের এই প্রশ্ন করা। এই কারণটা যে বড্ড জ্বালাময় তার কাছে! মুহূর্তেই বিষাদ হাওয়ায় ভরে উঠে তার মন। রাগে, কষ্টে চোখটা এখন ধরে আসতেও ভুলে গেছে। মানুষ যে অভ্যাসের দাস! এমন নিয়ন্ত্রণাধীন স্বাধীনতা কি সে কখনো চেয়েছিল? এমন স্বাধীনতার থেকে তো পরাধীনতা-ই শ্রেয়তর! নীলাশা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“ পিহু তো আমার সাথেই থাকবে কয়েক দিন। এখনি তো হস্টেলে উঠতে পারবে না। দুজনে একসাথে ঠিকি চলে যেতে পারব। তোদের এত চামচামি করতে হবে না। তোদের নিজেদের কি মান-সম্মান বলতে কিছু নাই যে, অন্যের কামলা খাটিস? আই’ম সারপ্রাইজড দোস্ত! আমার সত্যিই এই রকম নাটকীয় বন্ধুত্বের প্রয়োজন নেই। এই বন্ধুত্বে আমি অভিনয় ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাই না। ”
মিশমির সোজা প্রশ্ন, “ সত্যিই কি তুই অভিনয় ছাড়া আর কিছু দেখতে পারিস না, নীল? ”
নীলাশার আর কিছু বলতে ইচ্ছা করে না। না ইচ্ছা করে কিছু শুনতে। সে পিহুর হাতটা খপ করে টেনে ধরে হাঁটতে থাকে বাসার উদ্দেশ্যে। বন্ধুদের সাথে থাকার এই শান্তিটা মুহূর্তেই তার কাছে অশান্তিময় হয়ে ওঠে। কারো কথায় থামে না নীলাশা। ক্ষিপ্ত নীলাশার রক্ত-গরম শরীরটা হনহনিয়ে হারিয়ে যায় সন্ধ্যা-আঁধারের ভীড়ে। সেই সাথে চোখের বাহিরে চলে যায় অসহায় পিহুর অবয়ব-ও। বন্ধুদের প্রতি নীলাশার অভিমান যে বড়ই অনমনীয়!
অভিমানের শিখা জ্বেলেই সন্ধ্যা কাটিয়ে দিল নীলাশা। খুব কথা বলেনি পিহুর সাথেও। এখন আর কান্না আসে না। আসে না মন-খারাপের ডাকপিয়ন। যে বুকে ক্ষোভের বসবাস, সেখানে কি আদৌ আসে মন-খারাপের ডাক? আসে কি কোনো কান্নাপরীর ঐন্দ্রজালিক আহবান? আসে না। বহুকাল ধরে বন্ধুদের প্রতি তীব্র ক্ষোভে এই দু’চোখেও কান্না আসে না আর। নীলাশা নিজের ফোনের স্ক্রিনে তাকায়। পরপর নব্বইটা মিসড কল। একটা সময় ছিল যখন নিশান, রিশান, মিশমি পাল্লা দিয়ে কল দিতে থাকত। নীলাশাও বন্ধুদের থেকে পাওয়া কষ্টটা নিমিষেই ভুলে যেত। এখন আর এমন হয় না। তিনটা মানুষ ফোন করে অনবরত। কিন্তু তা রিসিভ করতে আর ভালো লাগে না। এখন রাত্রি প্রায় বারোটা। বিছানার একপাশে শুয়ে আছে সে। চোখে ঘুম নেই। পাশে শুয়ে থাকা পিহুর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু বলবে না। কেন কথা বলবে তার সাথে? সে তো কৈশোরকাল থেকেই নীলাশার সাথে ছলনা শুরু করেছে। এই অভিমানের শিখা বন্ধুদের মধুর কথায় আর নিভবে না।
“ আমার সাথে কথা বলবি না বলেই ঠিক করেছিস? তাহলে বাসায় ডেকে আনলি কেন? ”
পিহুর কণ্ঠে চকিতেই চমকে উঠল নীলাশা। সে বলল, “ নাথিং এট অল। ”
“ মিথ্যে কেন বলেছিস? ”
পিহুর গলায় শাসনের অভ্যাগমন। নীলাশার এহেন রাগ তার ভালো লাগে না। মন চিড়ে একটাই শব্দ বেড়িয়ে আসে, ‘মাত্রাতিরিক্ত!’ না-বুঝে, না-জেনে এত রেগে যাবার কী আছে? নীলাশার উত্তর পায় না পিহু। সে বলে,
“ তুই কেন বলেছিস আজ সেশন ছিল না, তোর সাইকিয়াট্রিস্ট ঢাকার বাহিরে গেছে? আমাদের মিথ্যে বলে তোর কী লাভ হয় শুনি? আমরা তো তোর গার্জেন না যে, তোকে আমাদেরকে মিথ্যা বলতে হবে। তাহলে মিথ্যা বলার কারণ কী? নিজের ভালো কি তুই কখনোই বুঝবি না, নীল? ”
“ তোরা তো আমার গার্জেন না। তাহলে কেন আমার ভালো-মন্দ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস? ”
নীলাশার উত্তর শুনে পিহু অবাক হয়। মেয়েটা কী আদৌ সম্পর্কের মানে বোঝে? পিহু প্রশ্ন করে,
“ বন্ধু হয়ে বন্ধুর ভালো চাওয়াটা কি অন্যায়? ”
“ বন্ধু হয়ে বন্ধুকে প্রতিনিয়ত পাগল প্রমাণ করতে চাওয়াটা অন্যায় না? তোরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে নিয়েছিস তো যে, আমি পাগল? আমি মেন্টালি সিক? যখন বিশ্বাস-ই করিস আমি পাগল তখন কেন পাগলকে পাগলের মতো থাকতে দিচ্ছিস না? আমি তো পাগল হয়েই ভালো আছি। আমাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে পাঠিয়ে, তার ডাইরেকশনস্ শুনিয়ে, মানিয়ে আরো পাগল করে ফেলার কী খুব প্রয়োজন? ”
পিহু উত্তর দেয় না। নিমিষেই রাগ উবে গিয়ে মনে জেঁকে বসে এক সূক্ষ্ম অনুতাপ। পিহুর চোখ দুটো আঁটকে যায় সুসজ্জিত কারুকার্যের সিলিঙের দিকে। চোখ মেলে দেখে ইয়াসিন চৌধুরীর টাকার অধঃপতন। মেয়ের জন্য এই বিশাল বৈদেশিক ধাঁচের বাড়ি করেছেন তিনি। ইংল্যান্ডের নামীদামী ব্যবসা ফেলে এসে আশ্রয় নিয়েছেন স্বদেশে। তিনি না-কি বলেছিলেন, কখনো এদেশে ফিরবেন না। অথচ নীলাশা? তার মানসিক অবস্থার জন্য পুরো পরিবারকেই এখানে চলে আসতে হলো। ওনার বিশাল বিজনেস সফল হলো এদেশেও। ইয়াসিন চৌধুরী ও নৌশিন আহমেদ মানুষ দুজন খারাপ না। টাকার প্রতি লোভ নেই তাদের। কিন্তু এত এত টাকা জলে ডুবিয়েও মেয়ের মন বুঝতে পারছেন না তারা। পিহু ভাবে, খুব দরকার কি জীবনটাকে এত নাটকীয় করে তোলার? খুব দরকার কি এত-এত টাকা বিলিয়ে মেয়ের মন কিনতে চাওয়ার? কেউ যেন মুঠোয় মুঠোয় হতাশা এনে ভরিয়ে তুলে পিহুর মাঝে। আসলে টাকা থাকলেই যে সুখী হওয়া যায় না তা নীলাশাকে দেখলেই বোঝা যায়। আর শুধুই কি নীলাশা? নীলাশা, বাবা ইয়াসিন চৌধুরী, মা নৌশিন আহমেদ… এমনকি নীলাশার ছোট ভাই নাজিফ-ও পর্যন্ত সুখে নেই। ইংল্যান্ডের ওই সামান্য ঘটনাটা যে তাদের জীবনে এমন পরিবর্তন, এমন উটকো কষ্ট এনে দিবে। তা জানলে হয়তো ওনারা কখনোই ওমুখো হতেন না। পিহুর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মানুষের জীবন কতই-না বৈচিত্র্যময়! সে আফসোসের স্বরে বলে উঠে,
“ আমি যদি পারতাম তো তোকে এখান থেকে অনেক দূরে কোথাও রেখে আসতাম, নীল! ”
চলবে ইন শা আল্লাহ