তারকারাজি- (০৩)

0
730

তারকারাজি- (০৩)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী

প্রিয় মহলে যখন অত্যন্ত অসহ্যকর কারো আগমন ঘটে, তখন আর সেই মহলকে প্রিয় বলতে ইচ্ছা করে না। সেদিন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরেছিল নীলাশা। ভেবেছিল বাড়ি ফিরে ফোন করবে নিশানদের। ভুলে যাবে সানামের বলা সেই কথা। বন্ধু-ই তো বলেছে! বন্ধুর জন্য না-হয় মেনে নিবে সে। কিন্তু সেই অনুভূতি মনের কোনো এক গভীরতাতেই ডুবে রইল। বাড়ি ফিরে বন্ধুদের জন্য নির্ধারিত মেসেঞ্জার গ্রুপে যখন সানামের রাজত্ব দেখতে পেল, তখন তাকে আবারও বিরক্তির ঝাঁক এসে জেঁকে ধরল। এতটুকুও ঠিক ছিল। কিন্তু তাদের মিশুক পিহু আর সবাইকে আপন ভেবে নেওয়া অতিরিক্ত ভদ্র মিশমিকে সানামের সাথে আড্ডায় মজে যেতে দেখেই তার রাগ হলো। এইযে তাদের উপর রেগে নীলাশা একাকী সময় কাটালো, কেউ তো তাকে নিয়ে চিন্তিত-ও হলো না। শুধুমাত্র মিশমি আর পিহু-ই যা ফোন করেছিল কয়েকবার। অথচ সানামকে নিয়ে মাতামাতির শেষ নেই যেন! নীলাশা ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মারে। আজ সকালেই পিহুকে রাজি করিয়েছে মিশমি যে, তার বাসায় পিহুকে এক রাত কাটাতে-ই হবে। পিহু নেই। তাতে অবশ্য নীলাশা দুঃখী নয়। সে বিরক্ত সানামের উপর। এই মেয়েটা কি এখন তাদের মাঝেও নাক গলাবে? নীলাশা আরও একবার ফোনটা হাতে নিয়ে সকল মেসেজ পড়তে থাকে। কী-সব বিশ্রী কথা বলেছে গ্রুপে। অথচ নিশান-রিশানরা তাকে বাহবা জানাতেই ব্যস্ত। মিশমি প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু লাভ বিশেষ হয়নি। নীলাশা ভাবল একবার, এমন বিরক্তিকর গ্রুপ ত্যাগ করে ফেলা উচিত। কিন্তু সে পারল না। সে নিজে এই গ্রুপটার নাম রেখেছিল ‘দ্য স্টার’। পরে অবশ্য মিশমি এর নাম দিয়েছে ‘তারকারাজি’। এইযে তারকারাজি নামক এই গুপ্তমহলে এত-এত স্মৃতি ছড়িয়ে আছে… সেই গুপ্তমহল ত্যাগ করা কি এতই সোজা? নীলাশাও পারল না তা করতে। তবে সেই গ্রুপের আর একটা বার্তাও পড়ল না নীলাশা। সানামকে যে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না তা আর বলে প্রমাণ না-করাই ভালো!

সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর হলো নীলাশার। পড়ালেখায় অংশ নেওয়া হলো না টানা তিনটে দিন। অস্বাভাবিক জ্বরে গা পুড়ে ক্ষুধার্ত হলো তার মন। এই ক্ষুধার্ত রমণী হঠাৎ কীসের ক্ষুধায় মরমর হলো তা নিজেরও জানা নেই। শুধু জানে, ভীষণ ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছে তার মন। ভীষণ ক্ষুধার্ত!

মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা ততটাও বোধহয় কষ্টকর নয় যতটা সমাজকে পদে-পদে গুরুত্ব দিয়ে চলা পরিবারে বেড়ে ওঠা কষ্টকর। বলা হচ্ছে সুধীর রমণী মিশমির কথা। এক সাত-তলা দালানের দ্বিতীয় তলায় তাদের বসবাস। বাসাটা খুব বেশি বড় নয়। আবার খুব বেশিই যে ছোট, তা-ও নয়। ভাদ্র মাসের ভোরের আকাশ তখন হীরের মতো পরিষ্কার। রোদের তাপ ভীষণ। বাহিরে চোখ মেলে তাকানোও তখন খুব মুশকিল। মিশমির বাবা মঈনুল সাহেব হাতে চায়ের কাপ নিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। এইটুকু সময়েই স্ত্রী ঝুমুরের ঝাঁঝালো স্বর পাওয়া বাকি থাকেনি ওনার। মঈনুল সাহেব বসার ঘর থেকেই একবার মিশমির ঘরে উঁকি দিলেন। মেয়ের ঘরে মায়ের শাসনের রাজত্ব চলছে এখন। মিশমির জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় মঈনুল সাহেবের। সব-সময় মায়ের কড়া কথা গিলে ফেলা যে মেয়ের জন্যও খুব বিরক্তিকর বিষয় তা আর বুঝতে বাকি নেই ওনার। ওদিকে মিশমি কালো রঙের জর্জেট কাপড়ের একটি সালোয়ার-কামিজ পরে তৈরি হয়ে নিয়েছে। দুই কাঁধে বেশ সুন্দর করে ওড়নাটা মেলে দিয়েছে সে। মিশমি এই মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র সন্তান। পড়াশোনার শ্রেষ্ঠত্ব ও সৃষ্টিকর্তার দান করা অপরূপ সৌন্দর্য্যের মায়াময় স্নিগ্ধ রূপ যেন মিশমিকে পৃথক করেছে হাজারো মধ্যবিত্ত পরিবারের রমণীদের থেকে। দুধে-আলতা গোলাপি ত্বকের গভীর বিড়ালচোখীতে দুনিয়াময় মায়া। পলক পড়লেই যেন চকচক করে ওঠে চোখের কৃষ্ণ মণি জোড়া৷ মার ভালোবাসা, আদর, সোহাগ পাওয়ার থেকে বেশি মায়ের কড়া শাসনেই দিনাতিপাত হয় মিশমির। সব-সময় মার কাছে সমাজ সম্পর্কিত সতর্কবাণী শুনে মনে হয় যেন পরিবারের বিন্দুমাত্র অসম্মান হতে না দেওয়াটাই মিশমির জীবনের একমাত্র লক্ষ্য এবং দায়িত্ব। এছাড়া সে যেন এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অযোগ্য। কিন্তু মাকে কীভাবে বোঝাবে সে যে, কেউই তার পরিবারের বিন্দুমাত্র অসম্মান চায় না? এইতো এখনও তার মা তাকে হাজারো উপদেশ দিয়ে চলেছে। আর মিশমি তা স্বভাবতই চুপ করে শুনে যাচ্ছে। মায়ের মুখের উপর তর্ক করার অভ্যাস তার নেই। মাঝে মাঝে সেও খুব বিরক্ত হয়। বন্ধুদের মতো প্রশ্নই করে বসে যে, পৃথিবীর একমাত্র মা কি সে একাই? পরক্ষণেই উত্তর দেয়, মা সবার এক হয় না। লুকায়িত দীর্ঘশ্বাস দরদর করে বেরিয়ে আসে বুকের ভেতর থেকে। তখন-ই মাকে বলতে শোনা যায়,

“ ভার্সিটিতে তোমার সাথে র‍্যাগিং-ট্যাগিং করা হয়েছে? কোনো ছেলে-পুলে ডিস্টার্ব করেছে কি? ”

মিশমি তার মার দিকে তাকাল। খুব কষ্ট করে নিজের বিরক্তি দমিয়ে রাখার চেষ্টা করল সে। ভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই তার মা এই এক প্রশ্নই করে যাচ্ছে। প্রত্যেক দিন একবার এই প্রশ্ন না করলে যেন ঝুমুর বেগম স্বস্তি পান না। মিশমি তো ধরেই নিয়েছে যে, ভার্সিটিতে পড়ার ছয়টা বছর মায়ের এই প্রশ্নটা শুনতেই হবে তাকে। সে শান্ত মনে মায়ের প্রশ্নদ্বয়ের উত্তরে বলল,

“ না, এখনো করে নি। সিনিয়র মেয়েরা টুকিটাকি লেখালেখি করিয়ে নিয়েছে… এইটুকুই। আর নিশান রিশান সাথে থাকতে কোনো ছেলে ডিস্টার্ব করবে না আমাকে। ইভেন আমাদের! ”

মিশমির কথা শেষ হতেই ঝুমুর বেগম গমগম করে বললেন,

“ তুমি বলতে চাইছো যে নিশানরা তোমাদের পাহারা দিয়ে রাখে সব-সময়? ওদেরও পড়াশোনা আছে। ওরা তোমাদের পাহারা দিতে ভার্সিটিতে যায় না মিশমি। ”

কথাটা বলে অল্প-বিস্তর বিরতি নিলেন ঝুমুর বেগম৷ মেয়ের ঘরটা গোছগাছ করতে করতে আবারও বললেন,

“ নিশানদের সাথে মিশছো ভালো কথা। ছেলে দুটো ভালো আছে। কিন্তু অতিরিক্ত মিশতে যেও না। মানুষ যাতে চোখ দিয়ে দেখেই বুঝে নেয়, ‘তোমরা শুধুই বন্ধু’। ঠিক সেভাবেই থাকবা সব-সময়। আর যখন তোমাদের ক্লাস থাকবে না তখন সবাই একসাথে থাকবা। একা একা ওই দুই ভাইয়ের সাথে থাকবা না কখনো। আজকালকার ছেলেদের বোঝা মুশকিল। দেখবে অনেক ভালো ছেলেটাও হুট করে খারাপ হয়ে গেছে। এখন তো মেয়েরাও কম যায় না! তুমি নিজে ঠিক থাকবা আর বান্ধবীদেরও ঠিক রাখবা। যদি ওদের বোঝানোর পরও ওরা ইচ্ছা-করে ভুল কিছু করে তো সেই বন্ধুত্ব যেন সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকে। অন্তরে-অন্তরে বোন পাতিয়ে ফেলো না আবার কাউকে! আশেপাশের লোকজনের তো চোখ আছে। তারা খারাপ মানুষের ভালো সঙ্গকেও খারাপ ভেবে নেয়। আর আমার মেয়েকে সুশিক্ষা দেওয়ার পরও সে যদি লোক-চোখে খারাপ হয়, তবে আমি কিন্তু তা মেনে নিব না মিশমি। ”

মিশমি উপদেশ নামক এই যন্ত্রণাসমূহ গিলে নেয় এক নিঃশ্বাসে। মিশমির বলতে ইচ্ছা করে খুব,

“ আম্মু, আমি বড় হয়েছি। এইবার আমায় একটু রেহাই দাও। বাঁচতে দাও একটু। দেখতে দাও এই দুনিয়াটা কেমন। আমি তো মুক্ত হতে চাই পাখিদের মতো। আমায় খাঁচায় পুড়ে জগতটা দেখতে আর বাঁধা দিও না তো আম্মু! ”

কিন্তু মিশমি বলতে পারে না। মায়ের মুখের উপর এই কথাটা বলা-ই যেন তার কাছে বেয়াদবির সীমানায় গিয়ে দাঁড়ানো। কৈশোরের পর মায়ের সাথে শেষ কবে তর্ক-বিতর্ক করেছিল তা আর মনে পরে না মিশমির। শুধু জানে, এই মা’কে সে শ্রদ্ধা করে। ভালোবাসে আকাশসম। মিশমি এত সহজেই মায়ের অবাধ্য হওয়ার মেয়ে না-কি?

নিরস বেলার সূর্যের তেজে তাকানো প্রায় মুশকিল। দরদর করে ঘাম ঝরতে থাকা গায়ে হেঁটে চলে সানাম। পুরো ভার্সিটিতে ঘুরে-ফিরে প্রশান্তিময় জায়গা খুঁজতে লাগে সে। হাতের চাকচিক্যময় ক্যামেরাটায় ফুটিয়ে তুলতে চায় মন-মতো কিছু। এই ভাবনা নিয়েই হাঁটতে লাগে সে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে রসকষহীন কাঠখোট্টা সকল চিত্র। মনে প্রশান্তি আনার মতো কোনো দৃশ্য তো পড়ে না চোখে! খুঁজতে খুঁজতে একসময় ক্লান্ত শরীরটা গাছে হেলিয়ে দাঁড়ায় সে। গাছের বঙ্কিম কাঠামোর সাথে মিশিয়ে ফেলে তার শিরদাঁড়া। তখন-ই কাউকে বলতে শোনা যায়,

“ এই মেয়ে, ভার্সিটিতে পড়তে আসো না-কি ফটোশুট করতে? ”

একই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে সানাম যেন অতিশয় বিরক্ত! সে চোখ ফিরিয়ে তাকাতেই মানুষটাকে চিনতে পারে। থুতনিতে গভীর খাঁজওয়ালা পুরুষটির নাম সাইফ। দু’দিন আগেই ভার্সিটিতে ভিন্ন দুটো ডিপার্টমেন্টের ছাত্ররা মারপিট করেছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিল ভার্সিটির-ই একজন সুপরিচিত প্রফেসরের ছেলে আরাভ। ছাত্রদের মারপিটের কারণের সাথে সম্পর্ক থাকায় এমন পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আনতেই আরাভের সেখানে উপস্থিত হওয়া। সানাম কানাঘুষায় জানতে পেরেছে, প্রফেসরের ছেলে হওয়ায় এই আরাভের যেমন পরিচিতি, সম্মাননা ও ভার্সিটি দাপিয়ে বেড়ানোর মতো অধিকার আছে। তেমন-ই আরাভের সুবাদে তার-ই বন্ধুদের দাপট আছে বেশ! এছাড়াও তাদের বন্ধুদের একজন না-কি রাজনীতির সাথে যুক্ত। তাই-ই পুরো ভার্সিটি জুড়ে শাসনটা বেশ ভালোই চালায় এই দল। আর এই দলের-ই একজন হলো সাইফ। সানাম সাইফের কথার গুরুত্ব দেয় না। ক্যামেরা হাতে অন্যদিকে যেতে নিতেই সাইফের পাশের একজন বলে উঠে,

“ পড়তে আসছো পড়বা। ভাব দেখে তো মনে হচ্ছে বিরাট বড় ফটোগ্রাফার হয়ে গেছ! ”

সানাম ক্যামেরার স্ক্রিনে চোখ রেখেই সুস্থির কণ্ঠে বলল,

“ আপনারাও তো পড়তে এসে পড়েন না। মানুষের চামচামি করেন। তাহলে পার্থক্য কীসের? ও হ্যাঁ, পার্থক্য আছে। আমি ফটোগ্রাফি করি সম্মানের সাথে। আর আপনি আপনার পাশের জনের চামচামি করেন নিজের সম্মান বিসর্জন দিয়ে। ”

প্রথম ধাপে কথাটা শুনেই বিদ্যুতের গতিতে চমকে উঠল সাইফ। সাইফ বলল,

“ এই মেয়ে, মাথা ঠিক আছে? কার সাথে কীভাবে কথা বলছো শুনি? থার্ড ডিগ্রি তো এখনো পড়েনি কপালে…! ”

“ শুনেন ভাই সাইফ, আপনাদের মতো পোলাপানদের পড়ার নামে নাচা-নাচির টাইম বা মেন্টালিটি থাকতে পারে। টো-টো করে ঘুরে বেড়ানোই তো আপনাদের কাজ! তাই আপনারা নিজের কাজে মনোযোগী থাকেন। আমার অন্তত এত টাইম নাই যে আপনাদের সাথে ফাও আলাপ করে তা নষ্ট করব। আর হ্যাঁ, ‘এই মেয়ে’ কোনো ভদ্রতার ডাক না। টো-টো করে ঘুরেও তো কিছু শিখতে পারেন, সাইফ ভাই? আগে অন্যের প্রতি ভদ্রতা ফলান আর তারপর অন্যের থেকে ভদ্রতা আশা করবেন। ”

কথাটা বলে সানাম পা বাড়াল অন্যদিকে। আচমকা এমন কথার আক্রমণে নিজের কথা হারিয়ে ফেলল সাইফ। মস্তিষ্কে বিস্ময়ের স্তূপ নিয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারল না সে। মেয়েটার কথার কী ধার! যেন তলোয়ার ধারী দুই ঠোঁটের মালিকানা নিয়েই জন্মেছে সে। সাইফের মনে প্রশ্ন জাগে, মেয়েটি কি শাসিয়ে গেল তাকে? নিজেকে ‘অভদ্র’ বলার উপায়টাও রাখেনি মেয়েটি। বরং নিজেই বলে দিল সে অভদ্র আচরণ করেছে তার সাথে। সাইফ সানামের যাওয়ার পথেই নিরুদ্দেশ তাকিয়ে বিড়বিড় করে করে বলে,“ মেয়েটা এমন কেন? ”

চলবে ইন শা আল্লাহ!

[বিঃদ্রঃ-নাম দেখে বুঝতেই পারছেন এখানে মূল চরিত্রই হবে অনেকগুলো। বিশেষ কোনো জুটিকে বা ‘ততোধিক প্রেমের কাহিনি নিয়ে উপন্যাসটা লেখা’ তা না-ভাবার অনুরোধ করা হলো]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here