তারকারাজি-০৬,০৭

0
646

তারকারাজি-০৬,০৭
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
পর্ব:০৬

সেই মধ্যযুগীয় বঙ্গ ডাকের সাড়ায় চকিতেই এক জোড়া আশ্চর্যান্বিত চোখ ফিরে তাকাল নীলাশার দিকে। সুগভীর কৃষ্ণাভ মণির দ্ব্যর্থহীন চাহনিতে জমে থাকা প্রশ্নগুলো যেন দেখতে পাচ্ছে নীলাশা। মনেহয়, আরাভ এখন এবং এখানে উপস্থিত নীলাশাকে কোনোমতেই আশা করেনি। অবশ্য এমন আশা করার কোনো কথাও ছিল না। আরাভকে দেখা গেল হেসে পাল্টা প্রশ্ন করতে,

“ আমাকে ডাকছিলে না-কি? বাহ্, তোমার কণ্ঠে ইংলিশের পাশাপাশি ওপার বাংলার ডাকটা তো বেশ মানায়! আচ্ছা, তুমি রিশানদের বন্ধু নীলাশা না? ”

আরাভের দ্বিতীয় প্রশ্নেই মনঃক্ষুণ্ন হলো নীলাশা। আচ্ছা, তাকে বিষাদকন্যা ডাকা পুরুষটা কি এত সহজেই সেই বিষাদকন্যাকে ভুলে যেতে পারে? নীলাশা উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে তাকাল। একটু আগে যে হাসির রেখাটা সব থেকে বেশি চোখে লাগছিল, সেই হাসিটা যেন নীলাশার ঠোঁটে অনুপস্থিত। সে কেন এখানে এলো? নিজের মনে প্রশ্নটা জাগতেই উত্তরহীনতায় ঝুঁকে পড়ল সে। সত্যি বলতে এখানে আসার কোনো কারণ-ই ছিল না। তবুও এখানে এসে সূক্ষ্মভাবে অপমানিত হওয়ার ক্ষতিপূরণ এখন কে মিটাবে? আরাভের সাথে কথা বলতে চাওয়া নীলাশার সেই বেহায়া ইচ্ছে কি এই ক্ষতিপূরণ মিটিয়ে দিতে পারবে? পারবে না। নীলাশা লজ্জিত মনেই সুদূরে চোখ রাখল। তখনই অতি পরিচিত ভরাট কণ্ঠের পুরুষটি বলে উঠল,

“ নীলাশা, নীলাম্বরীতে কোনো নারীকেই বিষণ্ণ থাকা মানায় না। ”

নীলাশা ফিরে তাকাল৷ তখনই দেখা গেল, আরাভ একমনে নীলাকাশে কাদম্বিনীর খেলা দেখছে। সেই গভীর দৃষ্টির আনমনা ভাব নীলাশার মনে খুব করে আঁচড় কাটল। আচ্ছা, এই কবি-কবি ভাবওয়ালা পুরুষের প্রেমে পড়া যায় কি? নীলাশার প্রশ্নটা নভস্বানেই মিলিয়ে গেল। কিন্তু উত্তর ফিরে এলো না তার কাছে। যখন আরাভ চোখের ইশারায় নীলাশার বিষণ্ণ মুখের কারণ জানতে চাইল, তখন নীলাশার কী-যে হলো! আচমকাই ঠোঁটে হাসির ডালা উপুড় করে দিল সে। পরমুহূর্তেই শারদীয় কোমল হাওয়ায় তার উড়ন্ত চুলে শুষ্ক এক পাতার অহেতুক উপস্থিতি লক্ষ্য করল আরাভ। সে বলল,

“ নীলাশা, তোমার চুলে…। ”

বলেই মাথায় ইশারা করল আরাভ। নীলাশা বুঝেনি বিষয়টা। সে চুল হাতড়ে পাতাটি পেতেই আরাভ বলল,

“ দেখছো, তুমি বিষাদপ্রিয়া দেখেই যত বিষণ্নতা এসে তোমার কাছে আশ্রয় নেয়। নয়তো পাতা থাকবে সবুজ। ঘুরেফিরে বিষণ্ণ পাতাটাই তোমার কাছে আসতে হলো? ”

নীলাশা হাসে, “ গায়কবাবু, নিউটনের আপেল পড়ার মতো বিষণ্ণ পাতার সূত্র মিলাতে চাচ্ছেন না তো? ”

“ না, আমার এতো ধৈর্য্য নেই। তবে আমাদের জীবনের কিছু কিছু সূত্র মিলানো ভালো। ”

“ যেমন? ”

নীলাশার প্রশ্নের উত্তর দিল না আরাভ। কবজির উপর বাঁধা ঘড়িটায় চোখ বুলিয়ে হঠাৎই কোথাও যাবার প্রস্তুতি নিতে লাগল সে। নীলাশা ভাবল প্রশ্ন করবে আরাভকে৷ কিন্তু তার আগেই আরাভ বলে উঠল,

“ আমার পারফরম্যান্স আছে। যেতে হবে। ”

বলেই সে ত্রস্তব্যস্ত পায়ে হেঁটে চলল অন্যদিকে৷ নীলাশা সেই পানে তাকিয়ে দেখে তাকে এড়িয়ে চলা মানুষটির ব্যস্ততা। এটা সত্যিই নীলাশার অসময়ে আগমন ছিল? না-কি এটা আরাভের তাকে এড়িয়ে যাবার নিখুঁত কোনো কৌশল? পথের বাঁকে আরাভ হারিয়ে যায় ঠিকি। কিন্তু নীলাশা সেদিক থেকে চোখ সরাতে পারে না। এইযে হন্তদন্ত পুরুষটি গিটার কাঁধে ছুটল ওদিকে, সেদিকেই ছুটে গেল নীলাশার মন। যে পথের বাঁকে হারিয়ে গেল দিবাস্বপ্নের পুরুষ, সে পথের বাঁকেই হারিয়ে গেল দিবাস্বপ্ন দেখা যুবতীর প্রেমে পড়ার মতো সাধারণ কিছু অনুভূতি। আচ্ছা, সত্যিই কি সেগুলো সাধারণ কিছু অনুভূতি ছিল?

রাতের গভীরতাও নীলাশার অস্থিরতা দূর করতে পারল না। ওইযে পথ হারালো যুবতীর মন, সে মন আর ফিরে এলো না তার নীড়ে। মধ্যরাতে হঠাৎই নিদ্রাবিহীন নীলাশার খুব অভিমান হলো। স্বপ্ন নামক বিস্তৃত প্রাঙ্গণ জুড়ে শুধু আরাভের রাজত্বই উপলব্ধি করতে পারছে সে। নীলাশা ক্ষুব্ধ হলো। তখন আরাভের সাথে সেই কথোপকথন মনে হতেই লজ্জায় নিমজ্জিত নীলাশা অভিমানের বিশাল সমুদ্র তৈরি করে ফেলল। তখন আরাভ চলে গেলেও তার প্রমোদানুষ্ঠান শুরু হয়েছিল বেশ দেরিতে। নীলাশা খেয়াল করেছিল, আরাভ গান গাওয়ার আগে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মজেছিল। নীলাশা বেশ অপমানিত বোধ করেছিল তখন। সে তো অপরিচিত কোনো মানুষের সাথে কথা বলবার পাত্রী নয়! আর না প্রিয়তাহীন কারো সাথেও ভদ্রতার খাতিরে কথা বলার মতো মেয়ে সে। হুট করেই অন্তর্মুখী নীলাশা অর্ধপরিচিত মানুষটির জন্য আত্মমর্যাদা কোথায় হারিয়েছিল তখন? সে শুনেছে, বাঙালিদের প্রেমিক-প্রেমিকার কাছে না-কি আত্মমর্যাদা বা আত্মসম্মান রক্ষার প্রবণতা খুব কম-ই থাকে। নীলাশা তো আর পাঁচটা বাঙালিদের মতো নয়। তাহলে সে কেন এমন হ্যাংলামি করে বসল? না-কি এটা নিয়ম যে, প্রেমে পড়লে কিছুটা হ্যাংলামি করতেই হয়? উত্তর খোঁজে নীলাশা। খুঁজতে খুঁজতেই বিনিদ্র গোটা রাতটা কেটে যায় তার। ঘুম যেন আসে না এই দু’চোখে!

নিদ্রিত রাত্রির স্তব্ধকালে আজ মিশমিও নির্ঘুম চোখে চেয়ে আছে ঘূর্ণন পাখার দিকে। কেমন বিশ্রী ক্যাটকেটে শব্দ তার! মিশমি তমসাচ্ছন্ন ঘরটির এক দেয়ালে হাতড়ে সুইচবোর্ড খুঁজতে লাগে। অতঃপর গুনে-গুনে তিন নম্বর সুইচটি চেপে ঘূর্ণায়মান পাখাটিকেও স্তব্ধ করে দেয় সে। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে সে, শরতকাল চৌকাঠে এসে দাঁড়ালেই ঝুমুর বেগম তাদের অহেতুক বৈদ্যুতিক পাখা না-ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে এসেছেন। খুব ছোট্ট মেয়ে মিশমি তখন প্রশ্ন করেছিল মাকে,

“ আম্মু, আমরা কি গরীব? ”

“ কেন বলো তো? ”

“ আগে তুমি বলো না, আমরা কি গরীব? ”

“ না। আমরা গরীবও না আবার ধনীও না৷ ”

“ তাহলে তুমি শীত না আসতেই কেন ফ্যান বন্ধ করে দাও? এগুলা তো গরীবরা করে। আমরা কেন গরীবদের মতো কাজ করব আম্মু? ”

“ ফ্যান অফ করে দিলে তোমার গরম করে, মিশমি? ”

“ না তো! ”

“ যখন ফ্যানগুলোই কেনা হয়েছে যাতে আমাদের গরম না-করে, তখন অযথা ফ্যান ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ নষ্ট করার কী লাভ? ”

তখন ঝুমুর বেগম আরও বলেছিলেন, “ আমাদের অবশ্যই আয়ের দিকে খেয়াল রেখে ব্যয় করা উচিত। সেইটা আমরা ধনী হই কি গরীব। হিসাব করে ব্যয় করাটা আমাদের মানবজাতির জন্য অত্যন্ত জরুরি। নয়তো আয়ের থেকে অতিরিক্ত ব্যয় করতে করতে একদিন গোটা মানবজাতিকেই গরীব হয়ে বাঁচতে হবে নিজেদের ভুলের জন্য। ”

“ কিন্তু সবাই তো ওই ভুলটাই করে, আম্মু৷ আমরা না-করে কী করব? সবাই গরীব হলে আমরাও না-হয় গরীব হবো ওদের সাথে! ”

“ আমরা এর জন্যই করব না যাতে তাদের ও আমাদের মাঝে পার্থক্যটা বহাল থাকে ভুলকে সঠিক করার মাধ্যমে। হতে পারে তারাও আমাদের মতো ভাববে! আর যদি তা না-ও ভাবে তো আমাদের ব্যয় না-করার মাধ্যমে বাঁচানো কিছু দিয়ে হলেও তো আমরা সেইসব অভাগীদের সাহায্য করতে পারব, মিশমি! যদি জেনে-বুঝে আমরাও ওদের মতো ভুল করে গরীব হয়ে যাই তো এতো-এতো শিক্ষা গ্রহণ করে আমাদের হবেটা কী বলো তো? ”

সেদিন মিশমি কতটা কী বুঝেছিল তা জানা না-থাকলেও আর বিনাকারণে বৈদ্যুতিক পাখাটা ঘুরায়নি সে। আজও অপ্রয়োজনে ঘুরতে থাকা ফ্যানকে একদম স্তব্ধ করে দিল সে, যেমনটা স্তব্ধ তার মন। এই স্তব্ধতার কারণটা যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেই বার্তা পাঠানো মানবটি তা আর খুঁটিয়ে দেখতে হয়নি মিশমির৷ নিজের মনকে বোঝে সে! ছোটবেলা থেকেই প্রেমের প্রস্তাব পেলে মিশমির মাঝে একপ্রকার নারীসুলভ ভালোলাগা কাজ করে। মুখে-মুখে প্রেমে বহুত পড়েছে সে। কিন্তু প্রেমের প্রস্তাব পাওয়ার আনন্দটা আজও কৈশোরের মতোই তাজা রয়ে গেছে। অপরিচিত এই মানবটি যে খুব শীঘ্রই তাকে প্রেমের নয়, বরং ভালোবাসার প্রস্তাব দিতে চলেছে তা আর বুঝতে দেরি হয়নি মিশমির৷ একটু আগেই বার্তা এসেছে,

“ ধন্যবাদ। ”

ছোট্ট শব্দটির পাশে এক ভালোবাসাময় চিহ্নও ছিল৷ মিশমি উপলব্ধি করে যে, ছেলেটি অন্যরকম। তার মাঝে তথাকথিত প্রেমিকের মতো খামখেয়ালীপনা নেই। বরং সে নিজেকে আড়ালে রেখে মিশমিকে এক নজর দেখতে ব্যস্ত। এমন ধৈর্য্যশীল পুরুষকে আর যাইহোক প্রেমিক বলা যায় না। ভালোনাসার মানুষ বলা যায়। কিন্তু মিশমি মনে-মনে স্বীকার করে নিলেও মস্তিষ্ক মানতে চায় না কথাটা। মস্তিষ্ক বলে,

“ কাউকে ভালোবাসা সহজ। কিন্তু কারো প্রতি ভালোবাসাটা মৃত্যু পর্যন্ত দৃঢ় বন্ধনে বেঁধে রাখা বেশ কঠিন। ”

বুঝদার মিশমি এত সহজেই ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মেয়ে নয়। আর না প্রেমের বাঁধনে জড়িয়ে পড়ার মতো মেয়ে সে৷ তবে সে দেখতে চায়… জানতে চায় সেই মানুষটিকে, যে এখনো তাকে প্রেমের প্রস্তাব না দিয়ে নিজের বিশদ অনুভূতির যত্ন নিচ্ছে। মিশমি সত্যিই জানতে চায় তাকে!

বাঙালি আরামপ্রিয় মানুষ। তবে নিশান যেন মাত্রাতিরিক্ত আরামপ্রিয়! নিশান ও রিশানের জন্ম সময় দেড় মিনিটের পার্থক্য হলেও তাদের স্বভাব-বৈশিষ্ট্যের মাঝের পার্থক্যটা যে সুবিশাল রূপ ধারণ করবে, তা হয়তো নিশানদের মা মিলা রহমানও বুঝতে পারেন নি। নবীন বরণ অনুষ্ঠান থেকে ফিরেই একঘুম সেরে ফেলেছে নিশান। যখন রিশানের আকস্মিক কথায় অপ্রস্তুত হয়ে, হন্তদন্ত স্বভাবে উঠে বসল নিশান। তখন প্রায় মধ্যরাত। নিশান রগচটা, বেপরোয়া ধরণের ছেলে। যেকোনো কথায় হুড়মুড়িয়ে রেগে যাওয়াটা নিশানের ক্ষেত্রে নতুন নয়। কিন্তু এবার অন্যকিছুই ঘটল তার ক্ষেত্রে। আচমকা নিদ্রাভঙ্গ ঝিমঝিমে মাথায় রিশানের বলা কথাটা শুনে নিশানের স্নায়ুতন্ত্র যেন অকেজো হয়ে পড়ল। রিশান যখন বলল তাদের দুঃসম্পর্কের এক চাচা বলেছেন যে, তাদের বাবা এক্সিডেন্ট করেননি। বরং আত্মহত্যা করে ইহকালের জীবনের সমাপ্তি টেনেছেন৷ তখন আধঘুমন্ত নিশানের গায়ের ঝাঁকুনিটা রিশান স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল। রিশান অল্পতে না-রাগলেও রাগটা কিন্তু তার কম নেই! তবে নিশানের চেয়ে রিশান খুবই ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। পরিস্থিতি বুঝে নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কথা বলার দারুণ কৌশল নিয়েই যেন জন্ম হয়েছে তার! রিশানের বলা কথাটা শুনে যখন নিশান তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে হেসে উঠল। তখন রিশান বলল,

“ নিশান শোন, ব্যাটা কিন্তু অনেক জোর দিয়ে কথাটা বলছে। আমাকে চ্যালেঞ্জও করছে, জানিস? একবার খুঁটিয়ে দেখলে হয় না? ”

নিশান তখন ছোট ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল,

“ দেখ ভাই, আমাদের বাবা যখন মারা গেছেন তখন আমরা অনেক ছোট। আর ঈশা তো তখন হয়-ই নাই। তাই আমাদের এতদূর আসা নিয়ে বাইরের মানুষের সমালোচনা করারও কোনো শেষ নাই। বাবা ছাড়া মা আমাদের তিন ভাই-বোনকে মানুষ করছে, এটা যেন ওদের কাছে সব থেকে খারাপ কোনো ব্যাপার হয়ে দাঁড়াইছে। এইসব নিয়ে মাথা ঘামাস না। মিছাই মানুষের কথায় নাচার প্রয়োজন কী? আমাদের পরিবারের মানুষরা পর্যন্ত জানে যে বাবা এক্সিডেন্ট করছে। সেখানে কোন চাচা না মামা এসে বলল একটা আর তা ধরে বসে থাকলে তো চলবে না, তাই না? এইসব ফালতু কথা বাদ দে। আর আমাদের বাবার লাইফে এমন কিছু কোনোদিনও কি ছিল যে আত্মহত্যা করবে? মানুষের কাম নাই খালি অন্যের নামে একটা বলে দেওয়া। ফাউল লোকজন! ”

নিশানের কথায় রিশানও বুঝে নিল ব্যাপারটা। এইযে তারা পনেরো বছর থেকে পিতৃহীন সংসারেও সুখে জীবন-যাপন করছে, তার পিছনে সব থেকে বেশি অবদানটা কিন্তু তাদের মায়ের-ই ছিল। মিলা রহমান যখন দ্বিতীয় বারের মতো দু’মাসের অন্তঃসত্ত্বা, তখনই এক রোড এক্সিডেন্টে তাদের বাবার মৃত্যু হয়। ওনার মৃত্যুর পর নড়বড়ে সংসারের হাল ধরতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল মিলা রহমানের। তখন থেকেই বাহিরের মানুষের তিক্ত বাক্য কম শুনতে হইনি তাদের পরিবারের চারজনকে। তবুও একপ্রকার সংগ্রাম করেই তাদের বেঁচে থাকা। এইসব নিশানদের জানা কথা, বোঝা কথা। এর উপর আর কীই-বা জানার থাকতে পারে?

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

তারকারাজি- (০৭)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী

যখন দুঃসংবাদটা এলো, তখন রৌদ্রপোড়া দুপুর। জ্বালাময়ী পিহু বন্ধুমহলের আড্ডা ভঙ্গ করে, নিজ হলের দিকে দৌড় লাগায়। মুখের দমফাটা হাসিটা নেই। কাঁধের ব্যাগটিতে কোনোরকম মুচড়িয়ে প্রয়োজনীয় কিছু জামা-কাপড় তুলে, ছুটে আছে ভার্সিটির প্রধান গেটের সামনে। তার মা প্রথমবারের মতো স্ট্রোক করেছে। ময়মনসিংহের পথে ছুটতে হবে তাকে। সেই সময় নিশান ও রিশান অনেকবার বলেছে যে, এমন হুট করেই পিহুর একা যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ সে মানসিকভাবে প্রচুর অস্থির হয়ে পড়েছে। তাদের একজন সাথে থাকলে পিহুর অনেকটাই সুবিধা হবে। পিহু প্রথমে মানা করলেও পরে রাজি হয় তাদের কথায়। নিশানের ভরসা নেই। ব্যাটার একটু গরম করলেই পুরো যান মাথায় তুলে নিবে! পিহু বুদ্ধি খাটিয়ে রিশানকেই সাথে নিয়ে চলল ময়মনসিংহের পথে। ঢাকা থেকে সেখানে পৌঁছাতে খুব একটা সময় লাগে না। যত দ্রুত পৌঁছানো যায় ততই যেন মঙ্গল!

যে-পথে বার-বার, বহুবার ছুটে যাওয়া হয়। সে-পথে না-ফেরার অনুমতি পাওয়া কি এতই সহজ? নীলাশা ক’দিন অতন্দ্র রাত্রি কাটিয়ে বুঝেছে যে, দিবাস্বপ্নের পুরুষকে একবার দেখতে পাওয়ার তৃষ্ণায় কতটা ধুঁকতে হয় একজন প্রণয়িনীকে। নীলাশা যে কত ঘর্মস্রাবী দুপুরে খুঁজেছে আরাভকে, কত বৃষ্টির প্রেমের প্রস্তাবে নিমরাজি হয়ে ছুটেছে তাকে দেখতে। কত সন্ধ্যা ফোন ঘেঁটে আরাভের সাথে যোগাযোগের একটা মাধ্যম খুঁজেছে কেবল, তা হয়তো নীলাশা ব্যতীত মানুষ বলতে আর কেউ জানে না। নীলাশা ইনিয়ে-বিনিয়ে একবার নিশানদের জিজ্ঞাসাও করেছিল। তারা তো আবার বড়ভাই বলতে অজ্ঞান! ন্যাকামোর শেষ নেই তাদের তথাকথিত বড়ভাইদের নিয়ে। তখনই নীলাশা শুনেছিল, আরাভ এই শহরে নেই। সে চট্টগ্রামে, ভবিষ্যতে নিজেদের বসবাসের উদ্দেশ্যে তৈরিকার্যে আবিষ্ট বাড়িটি পরিদর্শন করতে গিয়েছে। সে কবে ফিরবে তা জানা নেই কারোর। কাটে আরও দুটো দিন। এই মহলে দু’জন বন্ধুর অনুপস্থিতির আজ মাত্র পঞ্চাশ ঘণ্টা পেরিয়েছে। পিহু ও রিশানের অনুপস্থিতিতে যখন তারকারাজির দম না-ফেলা আড্ডার বৈশিষ্ট্য ছাড়া-ছাড়া, তখন হুট করেই সেই দলে আগমন ঘটল আরাভের। আনমনা নীলাশা মুখে আষাঢ় ছেপে তাকিয়ে আছে সুদূরে। তখনই তার অতিপ্রিয় কোনো পুরুষের কণ্ঠ কানে এলো,

“ কী-রে নিশান, তোর ফটোকপি কই? দেখতাছি না যে? ”

নীলাশা বুকের উপর হাত রেখে সামনে তাকাতেই বসে থাকা আরাভকে দেখা যায়। বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠল না? খুব বিশ্রী স্বভাবে প্রকাশ পেয়ে গেল কি নীলাশার অন্তঃকাঁপন? নীলাশা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার সামনে বসে থাকা আরাভ, সাইফ ও নিশান কেমন বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে তার পানে। যেন খুবই তুচ্ছ কোনো ঘটনায় নীলাশাকে আঁতকে উঠতে দেখেছে তারা! নীলাশা বুকের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিচের দিকে তাকায়। চোখের দৃষ্টি অস্থির। তখনই নিশান মুখটা তেতো করে বলে উঠল,

“ ওই ছেড়ি, ওইরকম খিঁচন মাইরা উঠলি ক্যান? ”

“ হুয়াট এন অকওয়ার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ইউ হ্যাভ! ঘটিরাম একটা! ”

নীলাশা কথাটা বলেই একপলক আরাভের দিকে তাকাল। ছেলেটি এখনও তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নীলাশা অপ্রস্তুত হয়। তখনই নিশান হেসে বলে,

“ ওররে ব্রিটিইশ্শা! তুই তো ইংলিশ বলতে বলতে দারুণ বাংলা শিখে গেছিস। একদম বিশুদ্ধ বাংলা ঘটিরাম! ”

বলেই সে হেসে কুটিকুটি হলো। বন্ধুর এহেন কথার উত্তরে কোনো যুক্তিযুক্ত বাক্যই খুঁজে পেল না নীলাশা। তার মনের কোণের গাঢ় অন্ধকারে জ্যোৎস্নাময় দীপ্তি উঁকি দিয়েছে। সে দেখেছে তার দিবাস্বপ্নের পুরুষকে। এখন কি আর অন্য কোনো কথায় তার খেয়াল থাকে? এই বেখেয়ালি নীলাশা তখন হুট করেই একটা কাজ করে বসল। অভিমানিনীর ন্যায় প্রশ্ন ছুঁড়ল আরাভের দিকে,

“ এতদিন পর আপনার দেখা মিলল যে? ”

প্রশ্নটা করা মাত্রই নীলাশার মনে হলো যে, এমন প্রশ্ন করার সঠিক সময় বা সঠিক স্থান এটি নয়৷ ভুলস্থানে সব-সময় ভুল করতে হয়, এটাই নিয়ম। নীলাশা অপ্রস্তুত হয়। আরাভসহ আরাভের ও তার বন্ধুরা কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে ফড়িঙের চোখের মতো তাদের চোখ জোড়াও বেড়িয়ে আসবে এবার। নীলাশা তার হাতটা গলায় আলতো করে ছুঁয়ে নেয়। ঘেমে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদেই যেন দরদর করে ঘাম ঝরতে শুরু করবে। এমন সময় আরাভ বলে,

“ তোমাকে নবীন বরণের দিন বললাম না জরুরি দরকার ছিল? ওর জন্যেই তো এতদিন পর আমার দেখা পেলে। ”

নীলাশার বন্ধুরা এতক্ষণে স্বাভাবিক হলো। তারা দেখেছিল নীলাশা ও আরাভকে একসাথে কথা বলতে। তাই এই নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। তবে বিস্মিত হলো নীলাশা। ব্রহ্মাণ্ডের বিশাল বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলো সে। আরাভ মিথ্যে বলল কেন? নীলাশা আজও সেদিনকার কথোপকথনের প্রত্যেকটি শব্দ গুনে-গুনে বলে দিতে পারবে। তাহলে এই মিথ্যে বলার অর্থ কী? নীলাশার প্রশ্নবিদ্ধ চোখ যখন আরাভের মুখ-মণ্ডলে, তখন আরাভ নির্বিকারে নিজের ফোনের স্ক্রিনে আঙুল নাড়াতে ব্যস্ত। লজ্জায় নীলাশার চন্দনরঙা গড়নে নিষ্প্রভতা ছেয়ে গেল। আঁধারি লাজে পাংশু মুখটা লুকাতে নীলাশার কতই-না আয়োজন! সে বুঝতে পেরেছে যে, তার অনুভূতির নগ্নতাকে বন্ধুদের রসিকতার বান থেকে ঢাকতেই আরাভের এমন মিথ্যে বলা। এর মানে সুবুদ্ধিপূর্ণ আরাভ, তার জন্য দিবা-রাত্রি এক করে ফেলা প্রণয়িনীকে ধরে ফেলেছে। দেখে ফেলেছে অন্তর্মুখী নীলাশার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অবাধ্য, বেহায়া সেই প্রণয়িনীকে। নীলাশা কোনো কথা না বলেই চট করে উঠে দাঁড়ায়। ইতোমধ্যে ভরে আসা চোখ দুটো যে সবাই-ই দেখে ফেলেছে, তা-ও নীলাশার বুঝতে বাকি নেই। সে নিজের ব্যাগটা নিয়ে ছুটে যায় ভার্সিটির প্রধান গেটের দিকে। নিজের নির্লজ্জতায় নিজেও বাকহারা হয়ে পড়েছে এখন। সে শতকোটি নিন্দা জানায় নিজের বেহায়াপনাকে!

বিকালের কোমলতা ছড়িয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। মেঘমেদুর আকাশের পশ্চিমকোণে এক আলৌকিক আলোকরশ্মি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নীলাশা মাথা উঁচিয়ে সেদিকে তাকায়। যেন সেখানকার খণ্ডিত দু’মেঘের আলিঙ্গনে সংযোগচ্যুত ঘটলেই সৃষ্টিকর্তার দানস্বরূপ কোনো উপহারের দেখা মিলবে। নীলাশা মাথা নামিয়ে ছুটে চলে রোকেয়া হলের দিকে। দুপুরে আরাভের সামনে গোমূর্খ বনে এখন আর এমুখো হওয়ার ইচ্ছে ছিল না তার। তবুও একপ্রকার লুকিয়ে-চুরিয়ে, পিহুর অনুরোধে নীলাশার ভার্সিটিতে ফিরে আসা। পিহু যখন ফোন করেছিল তখন বেলা তিনটে। তার আরেকটি ব্যাগে কী-সব দরকারি জিনিসপত্র রাখা। সেগুলো তার নিকট পৌঁছানো এখন অত্যন্ত জরুরি। পিহু না-কি সানামকেই ফোন করেছিল বেশ কয়েকবার। কিন্তু ছন্নছাড়া সানামের হুটহাট কী হয়… ফোন বন্ধ করে রেখে দেয় সে। তাই পিহু সানামের সাথে যোগাযোগ করতে না-পেরে নীলাশাকেই ছুটতে বলল হলের দিকে। আরাভের মুখোমুখি হবে না বলে সে পিহুকে মানা করে দিলেও পরবর্তীতে রাজি হতে হলো নীলাশাকে। বন্ধুপ্রাণ নীলাশা বন্ধুর উপকারে আসবে না, তা আবার কী-করে হয়? এই সময়টায় আরাভরা ভার্সিটিতেই থাকে বলে নীলাশার জানা। সে যথাসম্ভব দ্রুত হলে ঢুকে পিহুদের ঘরে চলে যায়। একি, সানাম তো দিব্যি নিজের ল্যাপটপ নিয়ে ছবিতে কারুকার্য যোগদানে ব্যস্ত! নীলাশা ক্ষুব্ধ হয়। হুড়মুড়িয়ে পিহুর বলা ব্যাগটি বের করতেই সানাম আর দিকে ফিরে তাকাল একবার। তারপর পুনরায় নিজের ব্যস্ত দুটো চোখ আঁটকে ফেলল ল্যাপটপের স্ক্রিনে। নীলাশা খেয়াল করেছে ব্যাপারটা। সানামের কোনো প্রতিক্রিয়া না-দেখে নীলাশা হঠাৎই রেগেমেগে অস্থির হয়ে ওঠে। এই মেয়েটাকে তার সহ্য হয় না একটুও। সে এমন ভাব করছে যেন নীলাশার আগমনের বার্তা সে জানত। সানামের এহেন আচরণ মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। নির্বোধের মতো আজকের সকল বিরক্তি, রাগ, অপমান সানামের উপর ঝেড়ে ফেলল নীলাশা,

“ এমন ভাব করছো যেন এই রুমে তুমি ছাড়া কোনো মানুষ-ই নেই! কাকে ভাব দেখাও তুমি? তোমার ভাব দেখার জন্য বসে আছি না-কি আমি? ভদ্রতা বলতে কিছুই শেখোনি, তাই না? রিডিকিউলাস! ”

সানাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার নীলাশার দিকে তাকাল। ঠোঁট চেপে নিজের হাসি আঁটকে আবারও নিজের কাজে গুরুগম্ভীর হয়ে উঠল সে। আঁড় চোখে দেখল, নীলাশা এখনো রেগে টগবগিয়ে উঠছে। মেয়েটার পিছে লাগতে সানামের দারুণ লাগে! তার অযথাই রাগাতে ইচ্ছা করে নীলাশাকে। নীলাশার রাগী মুখটা দেখেই যেন সানামের একটা বিষণ্ণ দিন আনন্দের দিনে পরিণত হতে পারে। তবে সানামের এমন ব্যবহারে একশত নীতিবাক্য শুনিয়েও যখন লাভ বিশেষ হলো না। তখন নীলাশা হাতের কাছে থাকা পানি ভর্তি জগটি নিয়ে উপুড় করে দিল সানামের উপর। আকস্মিক নীলাশার কর্মে তৎক্ষনাৎ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারল না সানাম। রোবটের মতো বসে বসে দেখতে লাগল নীলাশার চলে যাওয়া। নীলাশা তখন এমন হন্তদন্ত পায়ে বেড়িয়ে গেল যেন তার করা কাজটি তুচ্ছসম!

তখন সানাম কিছু না-করতে পারলেও নীলাশার কাজটায় যে সে ভীষণ ক্ষিপ্ত, তা আজ নীলাশার ডিপার্টমেন্টে সানামের উপস্থিতিই বুঝিয়ে দিয়েছে। শার্টের আস্তিন গুটিয়ে সে যখন অমর্ষিত ষাঁড়ের মতো ছুটল নীলাশার কাছে, তখন নীলাশা বেশ ভারপ্রাপ্ত সাহিত্যের বইয়ে মগ্ন হয়েছিল। বোধহয় ‘রবীন্দ্রসমগ্র’ পড়ছে সে। সানাম নীলাশার ব্রেঞ্চের উপর লাফিয়ে বসে, নীলাশার থেকে বইটি কেঁড়ে নিল। একের পর একেক পৃষ্ঠা টেনে, ছিঁড়ে, কুটিকুটি করে ফেলতে লাগল বইটি। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তখন নীলাশার দিকে। নীলাশাকে দেখা গেল প্রথমে অবাক হতে এবং পরে সেও সটান দাঁড়িয়ে সানামের দু’কাঁধে আঘাত করল। চেঁচিয়ে উঠে বলল,

“ হাও রূড ইউ আর, সানাম! ফাজলামোর একটা লিমিট থাকে। ”

“ ওহ্ রিয়েলি? আর তুই কালকে খুব ভালো আচরণ করছিস, তাই না? শালা বিদেশী কুত্তা! ”

শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত সকল শিক্ষার্থীর চোখ-ই তখন নীলাশা ও সানামের উপর। হুট করেই কীভাবে তাদের ঝগড়া বেঁধে গেল তা বুঝে আসলো না কারোরই। এদিকে মিশমি ও নিশান-ও শ্রেণিকক্ষে নেই যে কিছু একটা করবে। শিক্ষার্থীরা পড়ল এবার বিপাকে! এদিকে সবার এই বিস্ময়ের চাহনিকে উপেক্ষা করেও নীলাশা সর্বদেশীয় ভাষায় শ্রুতিকটু গালি দিয়ে বসল। তা থেকে সানামেরও মুখ তিক্ত হয়ে এলো। দুজনের কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি লেগে যাবে, এমন অবস্থা। সবাই-ই তখন প্রস্তুতি নিচ্ছে যে, এমন কিছু হলে তৎক্ষনাৎ তাদের বাঁধা দিতে হবে। কিন্তু সবার প্রস্তুতি মাটিতে পিষে নীলাশা তার সেল-ফোন হাতে তুলে নিল। কখন থেকে নৌশিন আহমেদ কল করে যাচ্ছেন তাকে। নীলাশা অবশ্য একবার রিসিভ করেছিল। কিন্তু মায়ের কথাটা তার সহ্য হয়নি। তারপরও পাঁচ-ছ’বার কল করে ফেলেছেন তিনি। সানামকে ইশারায় থামতে বলে কলটা রিসিভ করল নীলাশা। রাজ্যসম বিরক্তি নিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

“ তুমি গাড়ি পাঠাবে না, মম। আজকে আমাকে যদি সেখানে যেতে হয় তো আমি কোনোদিনও বাড়িতে ফিরব না। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? ”

বলেই সে সংযোগ কেটে মেঝেতে ছুঁড়ে মারল ফোনটা। নৌশিন আহমেদ বোধহয় কিছু বলার সুযোগটাও পাননি। ফোনের অবস্থা কেমন তা বোঝা না-গেলেও এটা খুব বোঝা যাচ্ছে যে, নীলাশার বাবার উপার্জন আবারও মাটিতে মিশে গেল। মুহূর্তেই ধরে নিল সবাই যে, নীলাশারা ধনী বলেই জিনিসপত্রের এমন অপব্যবহার করতে পারে। কিন্তু নীলাশার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার খবর রাখে ক’জন? নীলাশা ফোনটা ছুঁড়ে মেরেই সিটব্রেঞ্চে বসে পড়ল। এত চেঁচামেচি করে মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। ওদিকে নৌশিন আহমেদ-ও ডাক্তারের সাথে দেখা করার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছেন অনবরত। নীলাশা মাথা চেপে ধরে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে তার। নীলাশার এহেন আচরণ দেখে সানাম নিজেও স্তব্ধ হয়ে যায়। তখনই নীলাশাকে বিড়বিড় করে বলতে শোনা যায়,

“ মম এখন নিশানকে ফোন করলে তো গাড়ি কেন, ও আমাকে ধরে-বেঁধেই নিয়ে যাবে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। যাব না আমি, কিছুতেই যাব না। কেন আমাকে পাগল প্রমাণ করতে চাইছে ওরা সবাই? কেন? ”

নীলাশা ও সানামের মাঝে ঝামেলা হওয়ায় সবাই-ই তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে। তাই নীলাশার কথাটা সানাম ব্যতীত কারোরই শ্রবণেন্দ্রিয় হলো না। সানাম ব্যাপারটা বুঝেছে। পিহু তো সেদিনই তাকে বলল সবটা! সে একনজর সবাইকে দেখে নিয়ে, খুব সাবধানে ও ফিসফিসিয়ে বলল,

“ ওই, তুই কি ওই ‘পাগলা ভালো করা’ ডক্টরের কাছে যেতে চাইতেছিস না? ”

সানামের কথা বলার ভঙ্গিমায় নীলাশার রাগ এবার আকাশ ছুঁলো। এখনো তুই-তোকারি করছে মেয়েটা! সে রেগে কিছু বলার আগেই সানাম নীলাশার সেল-ফোনটা মেঝে থেকে তুলে নিল। নীলাশার ব্যাগ নিজের কাঁধে ঝুলিয়ে, তার হাত টেনে ধরে বলল,

“ তুই চল আমার সাথে। ”

নীলাশা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! সে বলে উঠে,

“ আর ইউ ক্রেইজি, সানাম? কোথায় যাব আমি তোমার সাথে? ”

সানাম জোর-জবরদস্তি নীলাশার হাত ধরে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,

“ আবাল ছেড়ি! চোখ কি চাঁন্দে উঠাইছোস? কই যাব তুই কি দেখতে পারবি না? বেশি রকম ন্যাকা তুই, নীলাশা! চোখ থাকতে চোখের মর্যাদা দিতে জানোস না৷ ”

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here