তারকারাজি-০৮,০৯

0
582

তারকারাজি-০৮,০৯
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
পর্ব:০৮

উত্তপ্ত ঢাকা শহরের প্রতি বোধহয় সূর্য মহাশয়ের খুব দয়া হয়েছে আজ! স্বর্ণকমলের ন্যায় সূর্যের নরম আলোয় ঝিলের পানির থৈ-থৈ নৃত্যে মন হারিয়েছে নীলাশা। সত্যি বলতে, সরোবরের নাম শুনলেও এখানে কখনোই আসা হয়নি তার। আজ-ই প্রথম এখানে এলো, তা-ও আবার সানামের হাত ধরে। কোলাহল আছে বটে! তবে এই সরোবরে বয়ে যাওয়া পবনে যেন ভিন্নরকম শান্তি ছড়িয়ে আছে। শেষ শারদের বিশুদ্ধ হাওয়ায় এলোমেলো উড়ন্ত চুলে যখন নীলাশা হাত চালিয়ে তা বাঁধার চেষ্টা করতে লাগল, তখনই পরিচিত এক তেজস্বী নারীকণ্ঠের ধমকে কেঁপে উঠল তার দেহ,

“ ওই লাল-নীল! নড়িস না। আগের মতো চ্যাগাইয়া দাঁড়া তো। ”

“ অ্যাহ, লাল-নীল? কী বললা? কীভাবে দাঁড়াব? ”

তিনটে প্রশ্ন একসাথে করতে করতেই পিছনে ঘুরে তাকাল নীলাশা। দেখল, সানাম তাকে ক্যামেরাবন্দী করতে একবার ডানে হেলে পড়ছে তো একবার বামে। আবার মাঝে মাঝে নীচেও বসে পড়ছে মেয়েটা। নীলাশা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

“ আরেহ্! তুমি আমার ছবি তুলছো কেন? ”

“ ধ্যাত! কত সুন্দর ভিউ আসছিল আর তুই একটা খচ্চর, নষ্ট করে দিলি ভিউটা। তুলতে পারলে এক্কেরে ঝাক্কাস পিকচার হতো! ”

নীলাশা বিড়বিড় করে সানামের শেষ কথাটি আওড়াতে লাগল। কথাটা তো সুন্দর করেও বলা যায় যে, অত্যন্ত সুন্দর একটা ছবি হতে পারতো। অথচ মেয়ের ভাষা দেখো? নীলাশা ভ্রু কুঁচকে সানামের দিকে তাকায়। পালিয়ে আসার বুদ্ধিটা এঁটে সানাম যে ভুল কিছু করেছে তা মনে হচ্ছে না নীলাশার। নইলে এইতো গত বছরের কথা। তার বাবা ইয়াসিন চৌধুরীর জন্য নিশানরা এমন এক অধিকার পেয়ে বসেছিল যে, তাকে জোর-জবরদস্তি করে হলেও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়ার দারুণ হৃদয়হীনতা দেখা দিল বন্ধুত্বে। এই নিয়ে বন্ধুমহলে ঝামেলাটা কম হয়নি। তখন থেকেই ইয়াসিন চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণাধীনতা খাটতে লাগল তাদের বন্ধুত্বে। বন্ধুরা হবে বন্ধুদের মতোই দায়িত্ববান। তারা কেন হবে বন্ধু নামে কারো নিয়ন্ত্রণাধীন যান্ত্রিক দায়িত্ববান? এদের বন্ধু বলা যায় না, রোবট বলতে হয়। অবশ্য এক সময় নীলাশা খেয়াল করেছিল, কিছুদিন পর থেকেই তার বন্ধুরা ইয়াসিন চৌধুরীকে তেমন একটা গুরুত্ব দিত না। তারাও বেশ বিরক্ত হয়েছিল তখন। নীলাশার সাথে এরূপ আচরণ করার তীব্র প্রতিবাদে মিশমির সঙ্গ দিয়েছিল নিশান ও রিশান-ও। কিন্তু লাভ হয়নি। আমাদের সমাজ বিজ্ঞানে গুরুজনের কথা মান্য করা যে বাধ্যতামূলক! সেখানে ইয়াসিন চৌধুরীর অনুরোধকে উপেক্ষা করে চলা সম্ভব হয়নি বন্ধুদের ক্ষেত্রে। তিনি জানতেন যে, বন্ধুদের জোরেই বন্ধুপ্রাণ নীলাশাকে স্বাভাবিক করা যাবে৷ বলে না, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা? কিন্তু তাদের কেই-বা বোঝাতে পারবে যে, নীলাশা আর পাঁচজনের মতোই স্বাভাবিক আছে? সে কোনো মানসিক রোগী নয়?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুদূরে চোখ রাখে নীলাশা। দৃষ্টির উদাসীনতায় মুহূর্তেই সুগভীর টকটকে রূপ ধারণ করে ফেলে সূর্য। তারপর ধীরস্থিরে লুকিয়ে পড়ে নিজের গুপ্ত ঠিকানায়। আকাশটা এখনও লালচে। বোঝা যাচ্ছে, সন্ধ্যার ফিরে আসার খুব তাড়া আজ!

সানাম ভার্সিটির ফটক পেরিয়ে এসেছে৷ নীলরঙা গাঢ় সন্ধ্যার আকাশের বিশালতায় বঙ্কিম চাঁদটা উঁকি দিয়েছে মাত্রই। সারাটা দিন নীলাশার সাথে ঘুরাঘুরি করেছে সে। এখন ক্লান্তশ্রান্ত দেহটা যেন এগিয়ে যেতে খুবই অনিচ্ছুক! সানাম কিছু একটা ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে চলে হলের দিকে। বাতাসে কোনো উষ্ণতা নেই। তবে তাতে শরীর জ্বালা করার মতো কোনোকিছুর আভাস পাচ্ছে সানাম। সে বিরক্ত হয়ে আকাশের দিকে মাথা উঁচিয়ে তাকায়। হাঁটতে থাকে আনমনে। কাল তাকে তার চাচার বাসায় ফিরতে হবে। মা-বাবার মৃত্যু বার্ষিকী কাল। কতগুলো বছর হয়ে গেল বাবা-মার আদুরে ডাক না শোনার। ‘সুমনা’ নামটা বাবার দেওয়া। মেয়ের মন হবে সুন্দর। সেই ইচ্ছাতেই আকিকা হয়েছিল সানামের। কিন্তু বুদ্ধিজ্ঞান হওয়ার পর সানাম এটা লক্ষ্য করেছিল যে, বাবা-মা খুব কমই তাকে সুমনা বলে ডাকত। তাদের ডাকা একটা আদুরে নাম ছিল সানামের, ‘সুমো’। এখন বাবা-মার সাথে নামটাও হারিয়ে গিয়েছে বহুদূর। কেউ আর ডাকে না তাকে এই নামে। চকিতেই সানামের চোখের কার্নিশে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। ধীরে-ধীরে জমা হয় নোনাজল। এই বুঝি গড়িয়ে পড়ল তা! ঠিক এমন সময়ে সানাম যে বিশ্রী ঘটনার সম্মুখীন হলো তা যেন এই মুহূর্তে কল্পনাতীত ছিল তার কাছে। তার মনে হলো, কোনো এক বেহায়া হাত এসে থামল তার বক্ষস্থলের এক পাশে। সানামের শরীর কেঁপে উঠল সেই স্পর্শে। সে সামনের মানুষটির দিকে তাকাতেই এক পরিচিত যুবকের মুখশ্রী দেখতে পেল। গা শিরশির করতে থাকলেও সানাম এগিয়ে যায় ছেলেটির দিকে। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ছেলেটির গালে থাপ্পড় বসিয়ে বলে উঠল,

“ ছিঃ সাইফ ভাই! আপনারা ভার্সিটিজুড়ে রাজনীতি করে বেড়ান বলে জানতাম। কিন্তু এমন নোংরা মানসিকতার মানুষ কী-করে হতে পারেন আপনি? ”

সাইফকে নিজের কথা শুনে যেন খুব অবাক হতে দেখল সানাম। ভাবটা দেখে মনে হচ্ছে যে, সে যেন কিচ্ছুটি করেনি। সানাম একবার সাইফের পিছনের দিকে উঁকি দিল। আরাভ, সায়ান ও তনয় দাঁড়িয়ে আছে। ঘৃণায় শিরা-উপশিরায় কম্পন সৃষ্টি হলো তার। সে চেঁচিয়ে বলে উঠল,

“ চরিত্রহীন সবগুলা! আপনাদের মতো নোংরা ছেলেরা কেন শিক্ষার নাম করে এখানে আসে বলেন তো? নোংরামি করবেন পতিতালয়ে গিয়ে করেন। মেয়েদের অভাব পাবেন না-কি? ”

কথাটা বলেই সে শ্রুতিকটু গালি দিয়ে বসল সাইফকে। যে শব্দটি সানাম উচ্চারণ করেছে তা শ্রবণেন্দ্রিয় হতেই সাইফদের রক্ত মাথায় উঠে গেল। সানামের কথার উত্তরে ভেসে এলো কারো হুঙ্কার,

“ জাস্ট শাট আপ! তুমি না-জেনে, না-বুঝে এত বড় কথা বলো কীভাবে? এই তুমি চেনো আমাদের? বেয়াদবি করার আর মানুষ পাও নাই, না? সাইফ কিছুই… ”

সায়ান নামের ছেলেটি তার কথা সম্পন্ন করতে পারে না। তার আগেই সানাম সায়ানের সামনে পেটের উপর হাত গুটিয়ে দাঁড়ায়। ঘাড় বাঁকিয়ে অত্যন্ত নিচুস্বরে হুমকি দেয় সে,

“ সেইটা তো পরেই দেখতে পাবেন, সায়ান ভাই। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ! ”

সানাম আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না সেখানে। ক্রুদ্ধ মনে তেজস্বী নারী এগিয়ে চলে চোখের বাহিরে। সানাম জানে, সাইফের আচরণের জবাব কীভাবে দিতে হবে তাকে। তাই তাদের সাথে তর্কে লিপ্ত হয়ে নিজের সময় নষ্ট করার মানেই খুঁজে পায় না সে। চলতে চলতে অনেকটা পথ-ই পেরিয়ে যায় সানামের। তখনই পিছন থেকে কারো কথা শোনা যায়,

“ আরে বাদ দে। মেয়েরা মুখে অনেক কথাই বলে। ও তোকে ভুল বুঝছে মানে তোকেও ওর ভুল ভাঙানোর জন্য উঠেপড়ে লাগা লাগবে না-কি? মেয়েটারে হুদাই এত দাম দেওয়ার দরকার তো নাই! নিজে ভুল বুঝছে, নিজে-ই ঠিকটা বুঝবে। যতসব আজাইরা ঝামেলা! ”

কথাটা শুনে সানাম একবার থামে। কিছু মুহূর্ত ব্যয়ে আবারও চলতে শুরু করে সে। বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়ে বিড়বিড় করে বলে, “ সানামকে এতটাও সোজাভাবে নিও না, সাইফ সোনা! আমি সানাম, সুমনা নই। ”

সেদিনের পর ভার্সিটিতে এসে সানামকে বহুবার খুঁজেছিল নীলাশা। কিন্তু খুঁজে পাওয়া হলো না তাকে। নিশানের থেকে শোনা গেল তার বাবা-মার মৃত্যু বার্ষিকীর কথা। শুনেছে নিশান-ও গিয়েছিল। অথচ সেদিন মেয়েটা একবারও জানালো না যে, তার পরের দিন-ই তার জন্য একটা বিশেষ দিন ছিল? অভিমানী নীলাশার এবার আর কোনো অভিমান হলো না। সানাম যে নিজের সকল কষ্ট-দুঃখ নিজের মাঝেই যত্ন করে আড়াল করতে জানে তা নীলাশার বোঝা হয়ে গেছে। দুই দিন গত হতেই নীলাশা সানামের কথা ভুলে গেল। খোঁজ নেওয়া হলো না মেয়েটির। রিশান ফিরে এসেছে। তার পরের দিন পিহুও ফিরে এসেছে। মহলের বিবর্ণতা কেটে গিয়ে আবারও ঝলমলিয়ে উঠেছে বন্ধুদের প্রাণ। হাসি, আড্ডা, একে-অপরকে বিদ্রুপ করে কথা বলা… যেন কানায়-কানায় পরিপূর্ণ হলো বন্ধুমহল। এদিকে মিশমিরও খুঁজে পাওয়া হচ্ছে না সেই প্রেরকের ঠিকানা। এইযে গত কয়েক দিনের তীব্র প্রণয়ের কল্পনায় ভয়ঙ্কর তৃষ্ণায় তৃষ্ণাদগ্ধ মিশমি অপেক্ষায় কাতরাচ্ছে, তা কি সেই বার্তা প্রেরক অনুভব করতে পারছে না? যে তীব্র প্রণয়ে মিশমিকে তৃষ্ণার্ত হতে বাধ্য করল সেই মানব… সে কি সত্যিই বুঝতে অক্ষম যে, কোনো এক প্রণয়িনী তার জন্য ব্যাকুল?

বাহিরের হরিদ্বর্ণ তরুর শীর্ষ শাখায় যখন জমাট বাঁধা অন্ধকার, তখনও মিশমি রাত্রির আকাশে চেয়ে তারা গুনতে ব্যস্ত। প্রোজ্জ্বল তারাগুলো মিশমিকে যেন খুব গভীরভাবে আলিঙ্গন করে যাচ্ছে। মিশমি সুদূর আকাশে চেয়ে ভাবে, আকাশ আমাদের থেকে কত দূর? বৈজ্ঞানিক ভাষায় হয়তো এর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক ভাষায় এর ব্যাখ্যা কী? বা আছে কি কোনো উদাহরণ? তখনই কেউ যেন বলে উঠল,

“ যতটা দূরে তোমার সে আছে! ”

মিশমি চমকে উঠে তার দু’পাশে তাকায়। অতঃপর চারদিকে একবার ঘুরে নিয়ে ভাবে সে, কে দিল এমন ধারা উত্তর? কোথাও তো কেউ নেই! কিন্তু সে স্পষ্ট শুনেছে সেই উত্তর, যতটা দূরে তার সে আছে ঠিক ততটা দূরেই আকাশ। আচ্ছা, এটা কি সত্যিই? তবে কে সেই ‘সে’? বার্তা প্রেরক? ফোনের মেসেজ টুনের আওয়াজে ভাবনার বিচ্ছিন্ন ঘটে মিশমির। সে তাড়াহুড়ো করে ফোনের পর্দায় তাকাতেই বার্তা পড়তে সক্ষম হয়,

“ পারুলতা মিশমি, পারুল বেশে এসো রবীন্দ্র সরোবরে, বিকেল ৫টায়। আমি এক মুঠো বেলির মালা নিয়ে অপেক্ষা করব তোমার জন্য। ”

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

তারকারাজি- (০৯)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী

হৈমন্তিক হলুদ বিকেলে রৌদ্রদীপ্তি মাখো-মাখো সরু রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে আছে মিশমি। গায়ে নীলাশার মা নৌশিন আহমেদের একটি বেগুনিরঙা শাড়ি। মিশমি খুব সকালেই নীলাশাকে কল করে অনুরোধ করেছিল যে, সে যেন আজ ভার্সিটিতে না যায়। মিশমি পিহুকে সাথে নিয়ে নীলাশাদের বাসায় যাবে। এমন পেঁচানো কথা নীলাশার বোধগম্য হয়নি। যেহেতু মাকে ভার্সিটি যাওয়ার কথা বলেছিল মিশমি, তাই বন্ধু দু’জনের থেকে কারণটা আর গোপন রাখতে পারেনি। মিশমির অধীরতা দেখে পিহু খুশিতে বাক-বাকুম হলেও নীলাশা স্তব্ধ ছিল দীর্ঘক্ষণ। মিশমিও কারো প্রণয়ে এতটা ছটফট করতে পারে? এই নিয়ে মেয়েটিকে খোঁচা দিয়ে কথা বলাটাও কম করেনি নীলাশা। মিশমি লাজুক স্বভাবের মেয়ে৷ ফোনে বার্তা পেয়েই যে কীভাবে অদেখা ছেলেটির প্রেমে পড়ল তা নীলাশা সহজভাবে নিতে পারছে না। তবে পিহু সমর্থন করেছে বেশ! তার মতে প্রেম কখনো বলে-কয়ে, ভালোবাসার বিশাল ও যোগ্য কোনো প্রমাণ প্রস্তুত করে আসে না। নীলাশাও পরে তাল মিলিয়ে মিশমিকে তৈরি করল আজ বিকেলের জন্য। মিশমি বাঁধা দেয়নি। নীলাশার সাজানোর হাত ভালো। আজ একটু সাজলে মন্দ হবে না ব্যাপারটা। দুই বান্ধবীর খোঁচা দেওয়া কথাগুলো সে হাসিমুখেই গিলে নিয়েছিল বেশ! মিশমির সে কী লজ্জা…! বান্ধবীদের সামনে এত লজ্জা মানায় না-কি? তবুও তার লাজুকতা তখন বাঁধ মানেনি একটুকুও। সারাটা দিনের কথা ভেবেই মিশমির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। সে পিছনে ঘুরে উঁকি দেয় সূদুরের বটগাছের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে তাকে নজরে-নজরে রাখছে নীলাশা ও পিহু। পিহু বাচ্চাদের মতো জেদ করছিল, মিশমির সেই প্রেমিককে সে আজ-ই দেখবে। কিন্তু নীলাশা তাতে বাঁধা দিলেও লাভ বিশেষ হয়নি। নীলাশা আধুনিক মেয়ে। অন্যের একান্ত সময়ে মাথা ঘামানোর মতো স্বভাব তার তেমন একটা নেই। তবে মিশমি ঠিক-ই বুঝতে পেরেছিল যে, নীলাশাও যেতে চায়। সে আর দ্বিরুক্তি করেনি। তবে শর্ত ছিল কঠোর, তাদের কোনো কথা শোনা যাবে না ও বেশ দূরে অবস্থান করতে হবে। নীলাশারাও শর্তে রাজি ছিল। তাদের মনেও যেন কৈশোরের অধীর হাওয়া লেগেছে! আজ মিশমির প্রেমিক মিশমির জন্য বেলিফুল নিয়ে অপেক্ষা করবে৷ তাকে না দেখলে কি হয়? কিন্তু বর্তমানে অভিমানেরা যেন আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে মিশমিকে। বেলিফুল নিয়ে তো সেই মানবের অপেক্ষা করার কথা। অথচ বরাবরের মতোই অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাকে। মিশমি একবার ফোনের পর্দায় সময় দেখে নেয়। হৈমন্তিক বিকেলটা এবার সত্যিই ফুরিয়ে যাবে। কোথায় সে? প্রশ্নটা মনে জাগতেই চোখটা ধরে আসে তার। খুব অভিমান হয় মিশমির, খুবই। তখনই যেন এক ঝলক খুশির সংবাদ হাতে করে, কেউ একজন তার খুব কাছে এসে ডাকল,

“ মিশমি? ”

চমকে উঠে অপেক্ষাময়ী যুবতী। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো বুকটাও কেমন চঞ্চল হয়ে উঠে তার। সে কি এসেছে? সে-ই কি ডাকল তাকে? মিশমি ঘুরে দাঁড়ায় না। হাত দু’খানা মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের কম্পন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে যায়। তখনই মিশমি সেই কণ্ঠের পুরুষের প্রণয়ী হাত দুটোর স্পর্শ অনুভব করে তার খোঁপায়। হৈমন্তিক হাওয়ায় বেলি ফুলের সুবাস পাওয়া যাচ্ছে না? মুহূর্তেই মিশমি বুঝে নেয় যে, বেলিফুলের মালাটা তার খোঁপায় বাঁধা হয়েছে। লজ্জায় হৃষ্টপুষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। এতদিনের অপেক্ষা ছিল যাকে দেখার… মিশমি কী-করে তার লজ্জামাখা মুখ ফিরিয়ে সেই মানবকে দেখবে? নিজের লজ্জামাখা মুখটা দেখাতেও যেন মিশমির সুগভীর লজ্জা! অতঃপর তার-ই কণ্ঠ ফিরে আসে মিশমির কানে,

“ এইযে এতদিন বাদে আমাদের দেখা হওয়ার সুযোগ হলো… তুমি কি আমার মুখ দেখতে চাইছো না? তাহলে কি ফিরে যাব আমি? ”

চকিতেই মিশমি ঘুরে তাকায়। আবেদনময়ী নারীর চোখে তৃষ্ণা মিটানোর দারুণ অধীরতা! যখন মিশমি তার প্রেমিকের দিকে তাকিয়ে কোনো এক চেনা ব্যক্তির চেহারার গঠন উপলব্ধি করল, তখন বিস্ময়ের স্তূপে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ল তার মস্তিষ্ক। দীর্ঘক্ষণ নিস্তব্ধতায় তাকিয়ে প্রশ্ন করল মিশমি,

“ আপনি? ”

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন যুবক মুচকি হেসে বলে,

“ চমকে দিলাম না-কি? ”

মিশমির চোখের পলক পড়ে না। এ-ই সেই আগন্তুক যাকে নিয়ে মিশমি সেদিন ঘাবড়ে গিয়েছিল। নীলাশাকে খুঁজতে গিয়ে যে নিজের প্রেমিককেই সেদিন খুঁজে নিয়েছিল তা মিশমির খেয়ালে আসেনি। মিশমি চোখ নামিয়ে ছেলেটির পায়ের দিকে তাকায়। তখনই ছেলেটি বলে উঠে,

“ আরে, তুমি তো দেখি সত্যিই আমাকে জন্ম-খোড়া ভেবে নিছো! আমি মোটেও তা নই। একদম ফিট! ”

মিশমির মনে পড়ে একটি ঘটনা। এক সহপাঠীর থেকে শুনেছিল, কোনো এক ব্যক্তিগত কারণে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের সামনে তুমুল মারামারি হয়েছিল দুই জন অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ুয়া যুবকের মাঝে। তাদের মাঝে তিহাম নামের একটি ছেলে পায়ে গুরুতর আঘাত পায়। মিশমি দুইয়ে-দুইয়ে চার করে ফেলে মুহূর্তেই। সে এখানো কোনো এক অজানা ঘোরে নিবদ্ধ রয়েছে। কথা যেন দু’ঠোঁট চিড়ে বেরুচ্ছে না। তাকে এমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিহাম-ই বলে উঠে,

“ কী ব্যাপার বলো তো? তোমার কি আমাকে শুধু ফোনেই ভালো লেগেছে? না মানে, দেখে তো মনে হচ্ছে আমার জন্যই এসেছো। তাহলে এমন ভূত দেখার মতো তাকিয়ে আছো যে? সামনে থেকে দেখতে খুবই বাজে লাগি না-কি? ”

মিশমি অপ্রস্তুত হয়ে আশেপাশে তাকায়। অত্যন্ত ধীর কণ্ঠে বলে, “ আপনি খুব সুন্দর, তিহাম। ”

তিহাম যেন একটু অবাক-ই হলো, “ নাম জানলে কী-করে? অবশ্য জানতে পারাটাও অস্বাভাবিক কিছু না। চলো হাঁটি। এখানে অনেক রোদ। ”

মিশমি এক পলক তাকায়। ঠোঁটে লেপ্টে থাকা হাসিটা সূর্যের কিরণের মতোই উজ্জ্বল দেখায়। তারা সরু পথটি ধরে হাঁটতে লাগে। কথার প্যাঁচে কথা বলে তিহাম,

“ তোমার ফ্রেন্ডসদের-ও তো দেখলাম আসছে। ডাকলা না ওদের? ”

“ উহু, থাকুক ওরা। ”

উত্তর দিয়েই বিশাল আকাশে চোখ রাখে মিশমি। আকাশে তখন লাল-নীলের শেষ অপরাহ্নের খেলা। তার উত্তরে উত্তর ফিরে আসে মুহূর্তেই,

“ একটা কথা জানার আছে। ”

মিশমি চকিতেই তিহামের দিকে ঘুরে তাকায়, “ বলেন? ”

“ আমি ডাকলাম আর তুমি চলে আসলে। আমি কি তবে ধরে নিব উত্তরটা পজেটিভ? ”

মিশমি চোখ সরিয়ে মাথা নত করল। ওষ্ঠদ্বয়ে হাসি নেই। কাটতে লাগল দীর্ঘক্ষণ। বাহ্যজগৎ সন্ধ্যার শুদ্ধাচারে সাজতে একদম-ই প্রস্তুত। তখনই মিশমি জবাব দিল, “ আমাকে একটু ভাবতে দেন, তিহাম। ”

তিহামের স্বল্প বিস্মিত স্বর, “ এখানে আসার পরও তোমার সময়ের প্রয়োজন? ”

“ হ্যাঁ, প্রয়োজন। অবশ্যই আমি আপনার কোনো অপ্রকাশিত প্রশ্নের উত্তরস্বরূপ এখানে আসিনি৷ আশা করি আপনি বুঝবেন। ”

মিশমির জন্য গোটা দিনটা কর্মহীনতা কাটলেও এখন এসে পড়ালেখা গুছিয়ে নিতে হচ্ছে পিহুকে। রাত খুব বেশি হয়নি। সুদূরের মসজিদ থেকে এশার আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। করুণ, নমনীয় স্বরে স্রষ্টার ডাক দিচ্ছেন মুয়াজ্জিন। কণ্ঠে তার কতই-না ব্যাকুলতা! পিহু উদাস চোখে তাকায় বদ্ধ জানালার ওপাড়ে। জানালার ওপাড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মনে হচ্ছে, আকাশে মেঘ করেছে ভীষণ! পিহু ক্লান্ত মাথাটা হেলিয়ে দেয় টেবিলের উপর। মুখের উপর আছড়ে পড়া টেবিল-ল্যাম্পের বাতিটা নিভিয়ে চোখ বুজে নেয় সে। কেটে যায় কয়েক মুহূর্তে, সেকেণ্ড ও সময়। অতঃপর কারো ডাকে তন্দ্রা ভঙ্গ হয় তার। পিহু চোখ কচলে উঠে বসে। ঘড়িতে তখন রাত সাতটা বেজে ত্রিশ মিনিট। পিহু আঁজলা ভরে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে জানালা খুলে দাঁড়ায়। দমকা হাওয়ায় এলোমেলো হয় চুল। তখনই কেউ প্রশ্ন করে,

“ কী-রে পিহু, তোর মায়ের কী অবস্থা রে? ”

পিহু পিছন ফিরে তাকায়। খিলখিল করে হেসে বলে,

“ আম্মুর শরীর এখন ভালো আছে, সুইটি আপু। এইসব ভাবধরা অসুখ কি বেশি দিন টিকে না-কি? ”

পিহুর কথা শুনে প্রবীণ শিক্ষার্থী সুইটি ভ্রু কুঁচকায়। মেয়েটি যেদিন থেকে হলে এসেছে সেদিন থেকেই তাকে হাসতে দেখছে সুইটি। এটা অবশ্য স্বাভাবিক! তবে কারণে-অকারণে হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো কী হলো? এইতো এখন, মায়ের সুস্থতা নিয়েও তার হাসি থামছে না। সুইটি নামের মেয়েটা আর কথা বাড়ালো না। রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে বিছানা নিতেই পিহুর কাণ্ডে রাজ্যসম বিস্ময় নিয়ে বসে রইল সুইটি ও ঘরে অবস্থানরত আরেকটি মেয়ে। বন্ধুমহলের মেসেঞ্জার গ্রুপে মিশমিকে আকারে-ইঙ্গিতে খোঁচা দেওয়া নিয়ে দমফাটা হাসিতে নিমজ্জিত হলো পিহু। সেই হাসির দাপটে ঘরময় সবকিছুই যেন খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। ইশ, কী মাথাধরা হাসি এটা! থালা-বাসনের ঝনঝন শব্দও সহ্য করা যাবে। তবে পিহুর এই হাসি যেন অসহনীয়। রাগে সুইটি ধমকে উঠে,

“ থামবি তুই পিহু? রাত-বিরেতে ভূত শরছে তোরে? নিজে ঘুমাচ্ছিস না আর আমাদেরও দিচ্ছিস না। ”

পিহু মুখ চেপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। নিজের এরূপ হাসির জন্য এ’পর্যন্ত কম কথা শুনেনি সে। আজ তার কপালে যে ঘোর শনি আছে তা আর তার বুঝের বাহিরে নেই। কিন্তু পিহুর ভাগ্য এইবারও সহায় হলো না। সে আরো জোরে হাসতে লাগল এইবার। তখনই আরেকজন রুমমেট বলে উঠল,

“ আপু, এই মেয়েটা চরম মাপের ফাজিল! একে মুরগী বানায়ে রাখো সারারাত। তাহলে এমন রাক্ষসীদের মতো হাসার শখ মিটে যাবে। ”

পিহু এবারও নিজের হাসি থামাতে পারে না। উলটে হেসে লুটোপুটি খেতে-খেতে বলে,

“ প্রিয়ন্তী আপু, তোমাকে রাগলে সেই রকম ফানি লাগে। জোকারও এত… ”

শেষ কথাটা আর সমাপ্ত করা হলো না তার। সে বুঝতে পেরেছে যে, ভুল জায়গায় ভুল কথা বলতে যাচ্ছিল সে। পিহু অনেক কষ্টে এবার নিজেকে দমিয়ে রাখতে সক্ষম হলো। কিন্তু শনি মহাশয় ভাগ্যে ঘুরপাক খেতে বিরত থাকল না। সানাম নেই। তাই পক্ষে কথা বলার মানুষটাও নেই তার কাছে।

সেই রাতে পিহুর আর জায়গা হলো না ঘরে। বড় আপুরা দয়া দেখিয়ে শুধুমাত্র ঘর থেকে বের করে দিতে পারতেন। কিন্তু সেই সৌভাগ্য হয়নি পিহুর। সারাটা রাত অন্ধকার বাথরুমে বন্দী থেকেই কাটিয়ে দিয়েছিল সে। সে কী যন্ত্রণার কথা! পিহু হাসিমুখে সেই শাস্তি গ্রহণ করলেও পরে অবশ্য বুঝেছিল যে, অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালো না। সানাম থাকলে হয়তো কোনো একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারত। কিন্তু পিহু কি আর সানাম হতে পারে? বন্ধুরা বুদ্ধি দিয়েছিল অনেক। কিন্তু লাভ বিশেষ হয়নি! বালতি উপুড় করে, তাতে বসে-বসে বন্ধুদের সাথে কথা বলেই রাত কাটিয়েছিল সে। হলের অন্য একটি মেয়ে দরজা খুলেছিল ঠিক ভোর সাড়ে চারটায়। বোধহয় ওযু করার উদ্দেশ্যেই এসেছিল মেয়েটি! তখন ছাড়া পেয়ে পিহু হেসেছিল ঠিকি। তবে বন্ধুরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা করতে ছাড়েনি। এই নিয়ে একটি স্লোগান-ও তৈরি করেছিল তারা,

“ পিহুর ঐতিহাসিক টয়লেটময় রাত্রিযাপন! ”

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here