তারকারাজি- (১০)

0
474

তারকারাজি- (১০)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী

শরৎ পেরোতে না-পেরোতেই প্রকৃতি সেজে উঠেছে কুসুম-হলুদ হৈমন্তিকা বেশে।
সেই সময় ভোরের প্রথম রৌদ্রের বর্ণচ্ছটায় প্রৌঢ় বৃক্ষপত্রে অল্প-স্বল্প শিশিরবিন্দু চিকচিক করে উঠছিল। অমত্ত বাতাসের চাঞ্চল্যে একটি হলুদ পাতা এসে পড়েছিল পিচঢালা অর্ধভঙ্গ রাস্তায়। সেই হলুদ পাতার ঠিক উপরে বসে জিড়িয়ে নিচ্ছিল একটি নীল প্রজাপতি। প্রেক্ষিত চিত্রটি ততটাও সুন্দর ছিল না যতটা স্নিগ্ধ রূপদানে সানাম ছবিটি সুন্দর করে তুলেছিল। বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন দিক থেকে বেশ কয়েকটি ছবি তুলেছিল সানাম। বর্তমানে নিজের ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়েই ছবিগুলো খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছে সে। বেলা এখন দশটার ঘর ছাড়িয়ে গেছে। হাতে ক্যামেরা নিয়ে বসে থাকা মেয়েটির কপালে পাশাপাশি দুটো ভাঁজ পড়েছে। আরেকটু চিন্তা মাখিয়ে দিলেই যেন ভাঁজ দুটোর গভীরতা বৃদ্ধি পেয়ে দরদর করে রক্ত বেরিয়ে আসবে৷ চোখ দুটো গেঁথে যাচ্ছে ক্যামেরার পর্দায়। মনে হচ্ছে যে, ছবিতে কিছু একটা অনুপস্থিত। কী নেই, কী নেই করে-করে সানাম অনুভব করে ছবিটিতে সতেজতা নেই। কৃত্রিম কারুকার্যে সেই চাহিদাটা পূরণ করতে হবে। সে ক্যামেরা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। তখনই তার নজরে আসে ক্ষিপ্ত সাইফের এগিয়ে আসাটা। সে সাইফকে শার্টের আস্তিন গোটাতে-গোটাতে এমনভাবে এগিয়ে আসতে দেখে যেন সাইফ এসে বিনা বাক্য ব্যয়ে তাকে মারতে শুরু করবে। সানাম সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের ব্যাগপত্র গোছাতে থাকে। তখনই সাইফ এসে তার হাতটা টেনে ধরে, দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

“ অতিরিক্ত সাহস দেখিয়ে ফেলছো তুমি। মিথ্যে অপবাদ দেওয়ার-ও একটা লিমিট থাকে মিস সানাম্… সুমনা ইয়াসমিন! ”

সানাম এতে বিন্দুমাত্রও অবাক হয়নি। তার আসল নাম যে সুমনা তা জানতে সাইফদের কাঠখড় পোড়ানোর মতো তুচ্ছ কল্পনা সানাম করেনি। সাইফদের কাছে এটা দুধভাত! সে আলতো করে সাইফের থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সাইফ ছাড়ে না।

সাইফ ও সাইফের বন্ধুদের অপদস্ত করার জন্য সানাম যে নিখুঁত পরিকল্পনা এঁটেছিল, তার ঊর্ধ্বে নিজেদের ক্ষমতাও যেন হাওয়ায় মিশে গিয়েছিল সাইফদের। অবশ্য এই ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হয়েই সানাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানের কাছে একটি দরখাস্ত লিখেছিল। তাতে নিশানদের সাহায্যে জোগাড় করা সাইফ ও সেদিন উপস্থিত থাকা সাইফের বন্ধুদের নাম উল্লেখ করেছিল সে। তাকে একা পেয়ে বিশ্রীভাবে অসম্মান করার অভিযোগ জানিয়ে এবং এর যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে মেজিস্ট্রেটের সাথে যোগাযোগের হুমকিস্বরুপ সানামের সেই দরখাস্তটা যেন উপাচার্যসহ শিক্ষকদের কাছেও অবিশ্বাস্যকর ব্যাপার ছিল যেখানে, প্রফেসরের ছেলে আরাভ জড়িত। বাকিদের কথা বাদ, আরাভ থাকতেও এমন কিছু কী-করে হতে পারে? ছেলেগুলো মারপিটে যুক্ত থাকে বেশি। তবে একটি মেয়েকে অসম্মান করেছিল তা বিশ্বাস করতে সিসিটিভি ফুটেজ চেক করার আদেশ জানানো হলো। সিসিটিভির অবস্থান অনুযায়ী আলোর রেশ ধরে হাঁটতে সানামকে দেখা গেলেও সাইফদের দেখা যাচ্ছিল না। সানামের উপর সাইফের পড়ে যাওয়া, অতঃপর সানামের গায়ে স্পর্শ করার চিত্রটা বেশ ভালো করেই পরিলক্ষিত হয়েছিল ফুটেজে। তারপর তাদের বাক-বিতণ্ডা ও সানামের চলে যাওয়ার পর বন্ধুদের হেসে চলে যাওয়া দেখে অভিযোগটি খুঁটিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ ডাকা হয় প্রফেসর আহসান চৌধুরী ও আরাভকে। তারপর সাইফ, সায়ান ও তনয়কে-ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সকলের উত্তর ছিল একটা-ই, একে-অপরের সাথে কথা বলার সময় তনয়ের অহেতুক ধাক্কা সামলাতে না পেরে সানামের উপর পড়ে গিয়েছিল সাইফ৷ ঘটনাস্থলে পর্যাপ্ত আলো না-থাকায় কোনো মেয়ের উপস্থিতি টের পায়নি তারা। এটা এক্সিডেন্ট বৈ অন্য কিছু নয়। কিন্তু সানামের তীব্র প্রতিবাদ, এক্সিডেন্ট হলে তারা কেন ক্ষমা চায়নি? নিজেদের ভুল বুঝেও কেন তারা এমন ভাব করে এড়িয়ে গেল যেন কিছুই হয়নি? সানামের অভিযোগ আংশিক গুরুত্ব পেয়েছিল। সেই সাথে পুরো ভার্সিটিতে নাম ঘোলা হলো আরাভ, সায়ান ও তনয়ের-ও। যদি ‘যে রাঁধে, সে চুল-ও বাঁধতে পারে’ তবে যারা সকল ঝামেলায় উপস্থিত থাকতে পারে তারা কেন নিজেরা ঝামেলা তৈরি করতে পারে না? এক যোগ একে দুই করা হলো। সাইফের বাবা-মাকে খবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। আর তাতেই সাইফের যত রাগ উথলে পড়ল সানামের উপর। চাইলে, ব্যাপারটা তারা-ই সুন্দর করে মিটিয়ে নিতে পারত। কিন্তু এখানে পুরো ভার্সিটিতে তার বদনাম করার পরও যখন বাবা-মাকে খবর দেওয়ার কথা আসলো, তখন নিজের রাগ সামলে নিতে পারল না সাইফ। চোখ দুটো অস্বাভাবিক লাল। ছেলেটির ছলছলে চোখ দেখেই সানাম বুঝে নিয়েছে যে, নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে আনতে না-পেরে সাইফ কাঁদতে বাধ্য হয়েছে। সানাম আর দ্বিতীয় বার তাকায় না সেই ক্রন্দনরত ক্ষিপ্ত চোখে৷ সে নিজের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে উল্টো পথে পা বাড়াতেই সাইফ তার ব্যাগ খামচে ধরে। আচমকাই পুরুষালি হাতের দানবীয় এক থাপ্পড়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সানাম। সাইফ যে তার গায়ে এভবে হাত তুলবে তা জানা ছিল না সানামের। আশেপাশের পরিবেশ থমথমে ও গুরুগম্ভীর। কেউ কেউ লুকিয়ে-চুরিয়ে ফোনের ক্যামেরা অন করেছে। সানাম একবার আশেপাশে তাকিয়েই অস্বাভাবিক একটা কাজ করে বসে। সাইফের কলার চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠে বলে,

“ আমার তো বাপ-মা নাই। আপনাদের বাপ-মায়েরা কি মেয়েদের গা হাতানোর শিক্ষা দিছে? সানামের সাথে লাগতে আসতে বারণ করেছিলাম আমি। লাগল তো মুখে চুনকালি? আর সত্যি কথা কী জানেন? ইউ ডিজার্ভ ইট, মিস্টার সাইফ খান! নোংরামির শখ মিটে যাবে এইবার। এই আপনার না-কি ছোট বোন আছে? ছলেবলে কৌশলে নিজের বোনের সাথে এমন বিহেভ করেন না… ”

সানাম নিজের কথা শেষ করতে পারে না। তার আগেই সাইফ তার নাম ধরে হুঙ্কার দিয়ে যে কাজটি করে বসে, তা যেন সানামের হৃদস্পন্দন-ই থামিয়ে দেয়। সাইফ চট করেই সানামের গলা থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে রাস্তায় ছুঁড়ে মারে। একের পর একেক পদাঘাতে চুরমার করে দেয় সানামের শখের ক্যামেরাটা। সেখান থেকে কেড়ে নেয় মেমোরি কার্ডটাও। এই দৃশ্য দেখে সানামের চোখে পানি চলে আসে মুহূর্তেই। কোনো বাঁধা মানে না সেই নোনাজল। এই ক্যামেরা টাকা দিয়ে কিনেছে ঠিকি। তবে তার কাছে ক্যামেরাটার মূল্য যেন কোটি কোটি হীরার সমান। বহুত কষ্টে কেনা এই ক্যামেরাটা ছিল তার একমাত্র প্রকৃত বন্ধু। অথচ তার এমন অবস্থা করা হচ্ছে যেখানে, নিজের শরীরটাই যেন ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে কেউ। সানাম দু’হাতে মাথা চেপে ধরল। দীর্ঘক্ষণ বাকহীনতায় ভুগে কাঁদতে-কাঁদতেই বলে উঠল সে,

“ সাইফ ভাই, বন্ধ করেন। ওইটা নষ্ট করবেন আপনি। প্লিজ সাইফ ভাই। ”

সাইফ কথা শোনে না। ফিরে তাকায় না সানামের দিকে। সে সানামকে ইচ্ছামতো কথা শোনাতে-শোনাতে ক্যামেরাটার করুণ অবস্থা করে দেয়। সাইফের খুব আফসোস হয়। সানাম মেয়ে না-হয়ে যদি ছেলে হতো তো সাইফ তাকে নিশ্চিত দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থায় রাখতো না। তার প্রতি সাইফ নিজের সব ক্ষোভ ঝাড়ে তার ক্যামেরার উপর। ওদিকে সানাম রেগে গিয়ে সাইফকে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দেয়। সানামের প্রয়োগকৃত শক্তিতে সাইফ পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সে দেখে, মেয়েটি ক্যামেরার খণ্ডগুলো আঁকড়ে ধরে চোখের পানি ফেলছে। মুখে কথা নেই। অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো একদম সাইফের চোখের মণিতে৷ কিন্তু সানামের সেই অসহায় চাহনিতেও সাইফের করুণা হয় না। সে ত্রস্তব্যস্ত পায়ে সানামের দিকে এদিয়ে এসে সানামের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

“ তোর দামী ক্যামেরাটা ভাঙছি দেখে তোর কষ্টের সীমা নাই। অথচ তুই আমার সবচেয়ে দামি, আমার মান-সম্মান নিয়ে খেলতে আসার সাহস করিস কী-করে? আমার বাবা-মার সামনে আমাকে এমন বিশ্রী অপবাদ দিতে চাওয়ার চেষ্টা করিস কী-করে? একবারও ভাবছিস আমার কথা? ”

বলেই সাইফ হাতটা উঠায় সানামকে মারার জন্য। মুহূর্তেই বিবেক নড়েচড়ে উঠে সাইফের। তবে সানামের কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখে না এই নিয়ে। সাইফ নিজের হাত নামিয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। আঙুল নাড়িয়ে শাসিয়ে উঠে বলে,

“ মেয়ে দেখে তোমাকে ছেড়ে দিলাম, সানাম। তবে এই ভার্সিটিতে টিকে থাকা হবে না তোমার আর। সেই ব্যবস্থা করার ক্ষমতাটা আমি এখনও হারাই নাই। তোমার একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং-এর জন্য আমাদের এন্ড আহসান স্যার… আরাভের বাবাকে পর্যন্ত যে পরিমাণ অপদস্ত হতে হয়েছে, তা তোমার উপর দ্বিগুণ প্রয়োগ করব আমি৷ দেখে নিও! ”

শহরের বহিঃপার্শ্বের তৃণাবৃত মাঠটির নাম জানা নেই নীলাশার। গত বছর থেকেই বন্ধুদের সাথে এখানে আসা-যাওয়া শুরু হয় তার। মাঠটির নাম খুঁজেছিল একবার। তখন একজন বলেছিল যে, এটা এই এলাকার ‘বড়মাঠ’ নামেই পরিচিত। নীলাশা প্রথমেই ভ্রু কুঁচকেছিল নামটি শুনে। এত সুন্দর প্রাঙ্গণের নাম এমন নিরামিষ কেন হবে? প্রথম ক’দিন এসেই এই প্রাঙ্গণে আসা মানুষদের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছিল নীলাশা। এখানে মেয়েদের থেকে ছেলেদের-ই আসা-যাওয়া বেশি। একদল যুবক এখানে কালোচিত খেলা খেলে। কখনো ফুটবল, কখনো ক্রিকেট আবার শীতকালে ব্যাডমিন্টনও খেলতে দেখা যায় তাদের। আর এদের সবার সাধারণ বৈশিষ্ট্যটা হলো- এই প্রাঙ্গণে কেউই একাকী সময় কাটাতে আসে না। সকলের সাথেই একজন, দু’জন বা ততোধিক সঙ্গী থাকে। নীলাশা এই প্রাঙ্গণের একটি নাম দিয়েছে, মিত্রাঙ্গন। বন্ধু ও প্রাঙ্গণের সমার্থকের মিলনে গঠিত শব্দটি নীলাশা বরাদ্দ করেছিল শুধুমাত্র এই প্রাঙ্গণটির জন্য।

শান্ত হেমন্তের প্রাণোচ্ছল বিকেলে আবারও বন্ধুদল এসেছে মিত্রাঙ্গনে। পশ্চিমাকাশের স্বর্ণাভ ছায়ায় অরুণের চাকচিক্য নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। নীলাশা কপালে আড়াআড়িভাবে হাত রেখে সেই পানে তাকানোর চেষ্টা করে। স্বর্ণালি ছায়ায় কে যেন শুভ্রতার প্রলেপ বুলিয়ে দিয়েছে কয়েক খণ্ড মেঘের রূপে। সানাম থাকলে নিশ্চয় এই দৃশ্যের ছবি তুলতে উঠেপড়ে লাগতো? নীলাশার মনটা হঠাৎই কেমন করে উঠল। একটা পাখি উড়লেও মেয়েটা ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যেত যে, কখন ছবি তুলতে পারবে সে। আজ ভার্সিটি থেকে জলদিই বাসায় ফিরেছিল সবাই। পিহুর মুখে যতটুকু শুনেছিল ঠিক ততটুকুই তাদের জানা, এর বেশি কিছু নয়।

“ মশার প্যানপ্যানানি ভ্যানভ্যানানি ভালো লাগে না,
মশার জ্বালায় আমার ঘুম আসে না।
ও মশার প্যানপ্যানানি ভ্যানভ্যানানি ভালো লাগে না,
মশার জ্বালায় আমার ঘুম আসে না। ”

নিশানের গান শুনে থম মেরে তাকিয়ে থাকে নীলাশা। ছেলেটা হাত-পা নেড়ে মশা তাড়াচ্ছে আর এমন উদ্ভট সব গান গাইছে। অদ্ভুত! সে এখানে ঘুমাচ্ছিল কখন যে, এমন ছন্দ গাইলো? নিশানের গান থামছে না। বেসুরো গলায় এমন তিক্ত স্বরটা মিশমির সহ্য হলো না। সে বলে উঠল,

“ উফ নিশান, একটু থাম না? মন-মেজাজ এমনিই ভালো না। ”

“ তোর জন্য গাইতাছি? আমার কষ্টে আমি গাই। তুই চুপ থাক। ”

নিশান থামল না। আরও দুই-তিনটা ছন্দ মিলানোর পর ক্লান্ত হয়েই থামল সে। তৃষ্ণা লেগেছে। ঢকঢক করে পানি গিলে নেয় নিশান। বন্ধুরা গুরুগম্ভীর হয়ে বসে থাকলে সে এমন উদ্ভট গান গাইবে না তো আর কীই-বা করবে? কিছু মুহূর্ত অতিক্রম হয়। মিশমির কণ্ঠে সান্ত্বনা জমা হয়,

“ আর যাইহোক, সানামের সাথে এটা ঠিক হয়নি। চড় মারছে তো মারছেই। তাই বলে ক্যামেরাটার কেউ এই অবস্থা করে? এইটাকে ভাঙা বলা যায় না। ভেঙে গুঁড়া-গুঁড়া করে ফেলছে বলা যায়। ”

মিশমির কথায় নীলাশার নিঃশ্বাসে বেদনার উপস্থিত টের পাওয়া যায়। সানামের ব্যবহারে সে বিরক্ত হয়, এটা ঠিক। তবে সানামের জন্য মনটাও কেমন যেন করছে তার। এদিকে নিশানের তীব্র প্রতিবাদ,

“ এটা ঠিক সাইফ ভাই ক্যামেরাটার ওই অবস্থা করে ঠিক করে নাই। কিন্তু সাইফ ভাইয়ের দোষ কী? ও যদি সাইফ ভাইয়ের সম্মান গুঁড়া-গুঁড়া করে দিতে পারে তাহলে সাইফ ভাইয়ের কাজটা কি খুব দোষের? আমরা বুঝতেছি সানামের কেমন লাগছে ক্যামেরা ভাঙার পর। কিন্তু সাইফ ভাইরে যে সবাই ছিঃ-ছিঃ করতাছে, ওইটা কয়জন ভাবছি? আর শুধুই কি সাইফ ভাই এর জন্য অপমানিত হইছে? সাইফ ভাই, আরাভ ভাই, সায়ান ভাই, তনয় ভাই এমনকি আহসান স্যারকেও অপমানিত হতে হইছে। আবার সাইফ ভাইয়ের গার্জেন কল-ও তো করা হইছে শুনলাম। ”

পিহু দু’পাশে মাথা নাড়ায়,

“ আরেহ না, গার্জেনকে কল করা হয় নাই। তার আগেই তো সানাম বলে দিছে যে, এটা একটা এক্সিডেন্ট-ই ছিল আর ওর তরফ থেকে মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হইছে। এইসব বুঝায়ে-টুঝায়ে অভিযোগ তুলে নিছে ও। আমি তো ওর সাথেই ছিলাম তখন! ”

সবাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পিহুর দিকে তাকাল। ব্যাপারটা বুঝতে দারুণ বেগ পেতে হলো তাদের। নীলাশা বিস্ময় নিয়ে বলল, “ কী বলিস কী! কমপ্লেইন-ই তুলে নিয়েছে সানাম? বাট হুয়াই? সত্যিই কি তাহলে মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল এটা? ”

পিহু দুই কাঁধ উঁচিয়ে মাথা নাড়ায় কয়েকবার। যার অর্থ, ‘সে জানে না’। তবে সে জানায় যে, সানাম স্বীকার করেছে এটা ভুল বোঝাবুঝি বৈ অন্য কিছু নয়। না কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে এমন অভিযোগ, না কোনো হুমকির জন্য তার অভিযোগ তুলে নেওয়া। বরং বিষয়টা ঘটেছিল ঠিকি। তবে কোনোকিছুই পরিকল্পনা মাফিক বা তাকে অসম্মান করার জন্য কিছু করা হয়েছে, এমন নয়। বরং এটি একটি দুর্ঘটনা। এইসব শুনে এতক্ষণ ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করতে থাকা রিশান বলল,

“ এমনকিছু হওয়ার-ও কথা না। কারণ শোন, আমরা ভাইদের স্কুল লাইফে পাইছিলাম। তনয় ভাইয়ের কথা ঠিক বলতে পারলাম না। তবে আরাভ ভাই, সায়ান ভাই আর সাইফ ভাইয়ের কোনো মেয়েলি ঝামেলার রেকর্ড ছিল না। ওরা এমন করবে তা বিশ্বাসযোগ্য না। সানামের-ই ভুল হইছে। দেখিস-না ওই কেমন চটপটা? ভুল বুঝেই কমপ্লেইনটা করে দিছে মেইবি। ”

নিশান এবারও ক্ষেপে উঠে বলে,

“ আরে ধুর, ওর কথা তারপরও বিশ্বাস করতাম যদি ও অভিযোগ না তুলত। ও তো ভণ্ডামি করল। তোরাই বল, তোদের সাথে এমন কিছু হলে তোরা এর শেষ না দেখে ছাড়তি? আর ও তো সানাম, তোদেরও বাপ! ও তো মরে গেলেও অভিযোগ তুলত না। অভিযোগ তুলছে কারণ ওর অভিযোগের কোন ভিত্তি নাই। সেইদিন রাতে বোধহয় ভাইদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হইছিল আর ও সেই সুযোগে প্রতিশোধ নিতে গেছিল। ওর এমন কাম-কাজের কথা কি আমরা নতুন শুনতাছি? কিন্তু ওর লাভটা কী হলো? নিজের কষ্টের টাকা দিয়ে কেনা ক্যামেরাটাই গায়েব! ওর একটা শিক্ষা পাওয়া প্রয়োজন ছিল। সবার সঙ্গেই এতো লাগালাগি কীসের ওর? ”

একেক জনের একেক মতামতে নিজেদের মনটাও আফসোসে পূর্ণ হয়ে যায়। যখন অভিযোগ করেই ফেলেছে তখন অভিযোগ তুলে নেওয়ার কী এমন প্রয়োজন ছিল? আর তুলবেই যখন, তখন সত্যতা যাচাই না করে অভিযোগ কেন করল? নীলাশারা বুঝে না সানামের কীর্তিকলাপের উদ্দেশ্য। মনে শুধু প্রশ্নই জাগে যে, “ মেয়েটা এমন কেন? ”

চলবে ইন শা আল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here