তারকারাজি-১৩,১৪
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
পর্ব:১৩
পিহুর ফোনের পর্দায় চোখ রেখে অবিচলে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেল সাইফকে। অত্যন্ত গোপনে বক্ষস্থলে ভার অনুভব করতে লাগল সে। দীর্ঘ কয়েক দিনের আক্রোশ মুহূর্তেই কেমন সংক্ষিপ্ত হতে লাগল তার কাছে। পিহুর দেখানো ছবিটা ছিল একটা ডায়েরির পাতার। যাতে লেখা,
‘ আব্বু? আম্মু? যখন বাবা-মা হিসেবে দায়িত্বই পালন করার সুযোগ পাবে না তখন জন্ম কেন দিছো? এখন তোমরা তো মৃত। তাহলে কেন এখনো আমার তোমাদের দেওয়া দায়িত্ব পালন করতে হয়? এটা কেমন জঘন্য নিয়ম বলতে পারবা কি তোমরা? তোমরা শিখায়ছো, কখনো মা-বাবাদের কষ্ট দিতে হয় না সেইটা নিজের হোক কি অন্যের। আমি সেই দায়িত্ব পালন করেছি। তাহলে সাইফ কেন আমার ক্যামেরা ভাঙলো? আমার প্রিয় জিনিসগুলা কেন আমার থেকে কেড়ে নেওয়া হয় বলো তো? আমি তো পারলাম না তোমাদের দেওয়া শিক্ষা ভঙ্গ করে সাইফের সাথে বিবাদটা চালিয়ে যেতে। তাহলে ওই ছেলেটা কেন সাহস করল আমার প্রিয় জিনিসটাকে ভেঙে, আস্ত আমিটাকেই ভেঙে দেওয়ার? Revenge of nature বলে একটা কথা আছে। তাহলে কি চুরির টাকায় ক্যামেরা কিনছিলাম দেখে এমন শাস্তি হলো আমার? নিষ্ঠুর সাইফ না, নিষ্ঠুর তোমরা। জন্ম দিয়ে কেন আমার পাশে থাকলা না? আমি কেন অনাথ হলাম বলো? তোমরা আমাকে জন্ম না-দিলে হয়তো কোনোদিনও হারাতে হতো না আমার নিজের বাবা-মাকে। টাকা চুরি করে ক্যামেরা কিনতে হতো না, হারাতে হতো না সেই ক্যামেরাটাকে। কোথাও কারো দোষ নেই। দোষটা আমার আর তোমাদের। তোমরা তো সেই কবেই ভুলে গেছ আমাকে। আমি কেন ভুলি না? তোমরা জানো তোমাদের মেয়ে এখন viral girl? তাকে নিয়ে ট্রোল করা হচ্ছে ভার্সিটিতে? প্রতিশোধ নিতে গিয়েও থেমে গেছি শুধু তোমাদের শিক্ষার জন্য। নিজেকে একদম নিঃস্ব করে দিছি শুধু তোমাদের জন্য। কেন করলা আমার সাথে এটা? জন্ম না দিলে কি হতো না তোমাদের? দিয়েছ যখন তখন আমিও কেন মরে গেলাম না? কেন এত নিষ্ঠুরতার শিকার হলাম আমি? সব তোমাদের দোষ, সব তোমাদের। আমি কী-করে আবার সবকিছু ফিরে পাব বলতে পারো তোমরা? অবশ্য পারবে কী-করে? তোমরা তো মরে গিয়ে দায়মুক্ত হয়ে গেছ। আর আমি? নিজের মান-সম্মান, শখের ক্যামেরা, বন্ধুত্ব, আত্মমর্যাদা এভরিথিং বিলিয়ে দিয়ে কি-না অন্যের মা-বাবাকে অসম্মানের হাত থেকে বাঁচিয়ে সমাজ সেবা করছি। খুব খুশি তো এবার তোমরা? ’
সানামের ব্যক্তিগত ডায়েরির এই পাতার ছবি তোলার উদ্দেশ্য-ই ছিল সাইফকে একটা শক্তপোক্ত ধাক্কা দেওয়া। রাগের উত্তাপে এই সমাজের মানুষ ও মানুষের মানসিকতাকে ভুলে বসেছে সাইফ। পিহু জানে যে, এই ডায়েরির পৃষ্ঠা কোনো কিছুর সমাধান হতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, সানামের অভিযোগ তুলে নেওয়া নিয়ে মশকরা করাটা তো বন্ধ করানো যাবে? তা-ই ঘটল অবশ্য। ফোনটা সরিয়ে নিয়ে পিহু খুব গুরুগম্ভীর গলায় বলে উঠল,
“ আশা করা যায় আপনি এতটাও মূর্খ না যে, লেখাটা পড়তে পারবেন না। আপনারা তো গোটা ভার্সিটিতে রাজনীতি করে বেড়ান। তাই বলে কোনো মেয়ের মন-মানসিকতা, ফিলিংস এমনকি তাদের গায়ের উপর দিয়েও নিজেদের রাজনীতি চালা… ”
পিহু নিজের কথা শেষ করার আগেই কে যেন তার হাতটা খপ করে ধরে ফেলল। মিশমি বাঁধা দিচ্ছে তাকে। মিশমিকে ফিসফিসিয়ে বলতে শোনা গেল,
“ ছিঃ পিহু! এইসব কী ধরণের ব্যবহার করছিস ভাইয়াদের সাথে? মানুষ নাই, জায়গা নাই… এমন সব কথা বলিস কেন যাতে লজ্জায় মাথা কাটা যায়? ”
বান্ধবীর এই বাঁধায় পিহুর রাগ এবার তুঙ্গে উঠে গেল। সে আবারও কিছু কড়া কথা বলবে বলে প্রস্তুতি নিতেই মিশমি দৃষ্টি নত করে বলল,
“ মাফ করবেন সাইফ ভাই। তবে এটা সত্য যে, সানামের এতে যতটা না দোষ আছে তার থেকেও বেশি দোষ আপনাদের আছে। আচ্ছা, আপনার তো বোন আছে। নিজের বোনকে গিয়ে একটা বার জিজ্ঞাসা করবেন তো যে, সানামের সাথে যা ঘটছে তা তার সাথে ঘটলে সে কী করতো? বিশ্বাস করতো কয়েকটা অচেনা-অজানা ছেলের কথা? আমার মনে হয় না কোনো মেয়ের পক্ষে এই যুগে এসেও এটা বিশ্বাস করা সম্ভব যে, এটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। কিন্তু সানাম শেষে বিশ্বাস করছিল আপনাদের৷ কারণ আপনাদের ব্যাকগ্রাউণ্ড সম্পর্কে এই ভার্সিটির কার কতটা জানা আছে তা আমার জানা না থাকলেও সানাম যে আগে থেকেই আপনাদের সম্পর্কে… স্পেশালি আপনাদের ক্যারেকটার সম্পর্কে জানত, তা আমাদের জানা। এইটা ও নিজের মুখেই স্বীকার করছে পিহুর কাছে। তাও ও এমন কেন করল জানেন, সাইফ ভাই? ”
কথা বলার মাঝে এই প্রথম মিশমি সাইফ, আরাভ, তনয় ও সায়ানের চোখে চোখ রাখল। তরুণীর প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি গিয়ে স্থির হলো আরও কয়েক জোড়া প্রশ্নবিদ্ধ চোখে। সেই চোখের চাহনিতে উপুড় করে দিল এই চার যুবকের প্রতি অশেষ ঘৃণা। পাল্টা কোনো প্রশ্ন না পেয়ে মিশমি আবারও দৃষ্টি নত করল। সে বলল,
“ সেদিনকার সেই ঘটনার পর, সানাম কি আপনাদের থেকে একটা ছোট্ট সরি-ও উইশ করতে পারে না? ভুল হলে সরি বলাটা কি দোষের? আচ্ছা, সানামের ভাষ্যমতে সানাম এর জন্যেও কমপ্লেইন করে নাই। সবাই ভুল করতে জানে। কিন্তু ক্ষমা চাইতে জানে কয়জন? সেদিন আপনারা সানামকে সরি বলেন তো নাই-ই, উল্টে কী বলছিলেন? মেয়েদের এতো দাম দিস না, রাইট? কতটা নিচু মন-মানসিকতার মানুষ হলে এমন চিন্তা-ভাবনা করা যায়? যেখানে তখনই আপনারা মাত্র দুইটা মিনিট নষ্ট করে সানামকে বিষয়টা বুঝাতে পারতেন, সানামকে সৌজন্যের খাতিরে-ও সরিটুকু বলতে পারতেন। সেখানে আপনারা কী করেছেন? ওকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। এরপরও কিন্তু ও পিহুকে বলে নাই এই সবটাই আপনাদের প্ল্যান ছিল ওকে কৌশলে হ্যারাস করার বৈ কোনো এক্সিডেন্ট না, এটাই কি বেশি না? ভাইয়া, জন্ম কিন্তু আপনার এমনি এমনিই দশমাস ব্যয়ে হয় নাই। মেয়েদের নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার আগে একবার নিজের বাড়ির দিকে ঘুরে দেখবেন। সরি টু স্যা, ও আমার কেউ না হলেও একটা মেয়ে হিসেবে কথাটা কিন্তু কম গায়ে লাগেনি! আমি সানামের মতো এতটাও সাহসী না যে, এমন অপমানের প্রতিশোধ নিতে আপনাদের নামে অভিযোগ করার মতো দুঃসাহসিকতা দেখাব। বাট আমি যদি ভুলবশতও এমন অভিযোগ করতাম তো জীবনেও অভিযোগ তুলে নিতাম না। সানামের বাবা-মা নাই দেখে ও সেই মর্ম বোঝে। নয়তো আপনি ওকে সবার সামনে থাপ্পড় মেরে ওর শখের ক্যামেরাটার বিশ্রী অবস্থা করে দেওয়ার পরও ও আপনার উপর থেকে অভিযোগ তুলে নিত না-কি? সেইদিন যেই মেয়েটাকে ভ্যালুলেস বলছিলেন, সেই মেয়েটাই কিন্তু আপনার মা-বাবাকে এদিককার কোনো খবর জানাতে দেয় নাই। এরপরও ওকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করার আগে একটু চিন্তা-ভাবনা করে নিয়েন। যাই আমরা। ”
মিশমি সাইফদের দিকে আর একবারও তাকায় না। পিহুর হাত ধরে ক্ষিপ্রগতিতে দূর থেকেও সুদূরে হাঁটতে থাকে সে। কথায় কথা বাড়ে। এমনিই বহুত কথা বলে ফেলেছে সে। তাই বোধহয় আর কথা বাড়ানোর ইচ্ছা থাকেনি তরুণীর মনে। এদিকে অপমানে, অপরাধবোধে, রাগে বুদবুদ করছে সাইফের রক্ত। টগবগে যুবকের সফেদচূর্ণ মুখে ক্ষিপ্ততা প্রকাশ পাচ্ছে। ফুলে উঠেছে নাকের পাটাতন। মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যর্থ চেষ্টাকারী সাইফের মনে পড়ে সেই রাতের কথা। সানামের ভুল ভাঙাতে যখন সে কথা বলতে চেয়েছিল তখন তনয়-ই বলেছিল,
“ ও তোকে ভুল বুঝছে মানে তোকেও ওর ভুল ভাঙানোর জন্য উঠেপড়ে লাগা লাগবে না-কি? মেয়েটারে হুদাই এত দাম দেওয়ার দরকার তো নাই! ”
সাইফ আগুন চোখে তনয়ের দিকে তাকালেও তনয় ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। সেখানে দাঁড়িয়েই তনয়কে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করে সাইফ। মাথা থেকে ঘামের নহর বয়ে যায় গৌরবর্ণের ত্বক ছুঁয়ে৷ কিন্তু সাইফ থামে না। দুই বন্ধুও তাকে বাঁধা দেয় না। আরাভ সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে-উড়াতেই চলে যায় সেখান থেকে। তখনই তনয় আকুতি করে বলল,
“ আরে ভাই আমি কি মেয়ে মানুষরে দাম না-দেওয়ার কথা বলছিলাম? আমি তো শুধু সানামের কথা বলছিলাম। হুদাই ভুল বুঝে আমারে মারিস ক্যান? ”
সাইফের গর্জন, “ শালার ব্যাটা! সানাম হিজরা? তোর জন্য এত বড় ব্লেন্ডারটা হইলো। তোরে যদি আধমরা না করছি আজকে তাহলে আমিও সাইফ না! ”
“ আরে ভাই, তাহলে তুই নিজের নামটা পাল্টায় ফেল না! তোরে সেদিন আমি বলছিলাম যে, আমার কথা শুনতে? এমন একটা ভাব করতাছোস যেন আমার কথায় উঠোস আর বসোস? আর মারিস না ভাই এমনিই আমি মোটা মানুষ! ”
সাইফ থামে না। লাথি, কিল, ঘুষি… যতভাবে মারা যায় ঠিক ততভাবেই মারছে তনয়কে। এদের মারামারি দেখে কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে থাকল সায়ান। অতঃপর আরাভের মতো সে-ও প্রস্থান করতে-করতে বলল,
“ শালার কি প্যারাটাই-না গেল এই কয়দিন! এতদিন ধরে কোনো মেয়েলি ঝামেলায় ঝুলতে হয় না-কি? হুদাই-হুদাই এতো ডিগবাজি খাইলাম সবাই। এর থেকে তো বাচ্চা পোলাপাইনদের ঝগড়া-ও অনেক মিনিংফুল হয় বা*। ”
মিশমি আর পিহু যখন পার্কে এসে পৌঁছাল তখন মধ্যাহ্নের সমাপ্তি ঘটেছে। সীসেরঙা নীল আকাশের তলে মানুষের কর্মচঞ্চল জীবনের যান্ত্রিকতা লক্ষ্য করে যাচ্ছে। তারা দুজন ঘাড়ের উপর থেকে ব্যস্ততা ঝেড়ে নিয়ে বন্ধুদলে যোগদান করল। ভ্রমণ বিষয়ক বৈঠক বসার কথা আজ। কিন্তু বান্ধবী দুজন এসে দেখল, এখানে বাকি তিনজনের মধ্যে ভয়াবহ বাক-বিতণ্ডার আগুন লেগে গেছে ইতোমধ্যেই। নীলাশা ও নিশান-রিশানের কথপোকথন থেকে জানা গেল যে, ইয়াসিন চৌধুরী বন্ধুদের সাথে মেয়ের ভ্রমণে যাওয়া নিয়ে নিমরাজি। ভ্রমণে যাওয়া থেকে শুরু করে ফিরে আসা পর্যন্ত যদি সবকিছুই তার নির্দেশনা মতো হয়, তবেই তিনি রাজি হবেন এই ভ্রমণে। এ-কথা নীলাশার থেকে জানার পর বন্ধুরা চোটে গেলেও নীলাশার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাটা মলিন হয়েছিল ঠিক গতরাতে বাবার প্রস্তাবটা শোনা মুহূর্তেই। নৌশিন আহমেদ অবশ্য প্রতিবাদ করেছিলেন এ-ই বলে যে,
“ নিজের মেয়েকে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যেতে দিবে না, ভালো কথা। কথাটা তো এখানেই শেষ করতে পারতে? সেখানে নতুন করে শর্ত অ্যাড করার কী প্রয়োজন যে, তোমার ডাইরেকশন্স মেনে তাদের ঘুরতে যেতে হবে? এইবার কী আমিও সো-কল্ড মানুষের মতো ভেবে নিব যে, তুমি নিজের টাকার গিয়ার দেখাও? শোনো, তোমার মেয়ে তোমার কথা শুনতে পারে। কিন্তু মেয়ের বন্ধুদের উপর এমন তদারকি করা বাদ দাও। নয়তো তোমাদের এই নাটকের জন্য আমিই একদিন নাজিফকে নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যাব। ”
ইয়াসিন চৌধুরী ঠাণ্ডা মাথার মানুষ বলে নৌশিন আহমেদের এই সাময়িক রাগটাও ঢেকে ফেলতে পেরেছেন বোধশক্তির জোরে। মেয়ের বন্ধুরা বুঝদার। কিন্তু নিজের মেয়ে-ই তো ভালো না! দেখা যাবে বন্ধুদের সাথে নূন্যতম কথা কাটাকাটি হয়েছে আর নিজে ওস্তাদি করে ফিরে আসতে গিয়ে বিপদে পড়েছে। তখন সবটা সামলাবে কে? কিন্তু নীলাশার বাবার এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি নিশানরা। নিশান তো স্পষ্ট বলেই ফেলল,
“ দেখ ভাই, এত রঙঢঙ করে ঘুরতে যাইতে পারমু না আমি। নীল, তোর যাওয়া লাগবে না কোথাও। তোরে নিয়ে গেলে যখন এতো অশান্তিই হবে তখন তুই থাক। আমরা চারজন গিয়ে ঘুরে আসি। তারপর না-হয় কাছে কোথাও ঘুরতে যাব সবাই মিলে। আমি এই ট্র্যাভেলিং-এ কোনো ঝামেলা মানতে পারব না। ”
এই কথা শুনে নীলাশার রাগটা খুব ভালো করেই চেপে বসল মস্তিষ্কে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ সমুদ্রের লোভ দেখিয়ে এখন নদী দেখানোর কথা বলছিস আমাকে? ”
“ শোন, সমুদ্র দেখার জন্যও সমুদ্রের মতো বিরাট স্বপ্ন দেখা লাগে। আর তুই কীসের জন্যে ভুলে যাস যে, তোর সমুদ্রের মতো স্বপ্ন দেখা নিষেধ? তুই নিজের লিমিটেশন ভুলে গিয়ে স্বপ্ন দেখিস ক্যান? কক্সবাজারে যাওয়ার কথা ছিল রিশান আর আমার। তুই নিজেই দুই বছর থেকে আমাদের আটকিয়ে রেখে এই প্ল্যান বানাস নাই? তোর কথা আমরা মানছি, তোরে রেখে কক্সবাজারে যাই নাই। এইদিক দিয়ে মিশমির মা-ও এতদিনের জন্য বাসার বাইরে থাকে না। আবার কবে এমন সুযোগ আসবে তা-ও জানি না। তাহলে তুই কি বলতে চাচ্ছিস যে, এইবারও তোর জন্য না-যাই আমরা? দেন সরি, পারব না। তোরা তিনজন থাকলে থাকিস। বাট আমি আর রিশান যাচ্ছি আর এটাই ফাইনাল! ”
সবাই খেয়াল করল নীলাশার নত মুখটা। বোধহয় ঘাসের দিকে তাকিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু নীলাশার পক্ষে নিজের রাগ, জেদ, অভিমান নিয়ন্ত্রণে রাখা কি এতটাই সহজ? নীলাশা নিজের বাবা-মা এমনকি ইংল্যান্ডে থাকাকালীন নিজের চাচা-চাচি, পরিবারের বড় ভাই-বোনের কাছে যে আদরে-আহ্লাদে বড় হয়েছে… তাতে করে হঠাৎই শুরু হওয়া এমন কড়া শাসন মেনে নিতে পারে না সে। এই মুহূর্তে বন্ধুদের প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই তার। যেখানে নিজের বাবা-ই এমন বেঁকে বসেছে সেখানে বন্ধুকে দোষারোপ করে কী লাভ? নীলাশার দুঃখ, সে পিহুর মতো বন্ধুসুলভ পারিবারিক পরিবেশ পায়নি। কেন সে সবার মতো প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন হতে পারে না? রাগে-দুঃখে মুখটা আষাঢ়কালো হয়ে যায় তার। বন্ধুরা দেখছে তাকে। কিন্তু স্বান্তনা কী দিবে তাকে? বুদ্ধিমান রিশান-ও নিজের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। আর কত মেনে নেওয়া যায়? আর কোনো উপায় নেই এই আদুরে কন্যাকে সামলানোর। আর তখনই মিশমির ডাক শোনা যায়,
“ গাইজ, একটা নিউজ ছিল। ”
মিশমির কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে নিশানরা ভ্রু কুঁচকায়। নিশ্চয়ই কোনো রাগিয়ে তোলার মতো বার্তা জানাতে চলেছে সে! তখন মিশমি সরল মনে হেসে বলে,
“ কিছু মনে করিস না নিশান। আসলে আম্মুর নানুর বাসায় যাওয়ার ডেট পিছায়ছে। মানে যাবে, কিন্তু আরও দুই সপ্তাহ পর। ”
নিশান ধমকে উঠে, “ বাহ্, খুবই ভালো খবর জানাইলা তুমি মিশমির বাচ্চা! তোরা থাক। আমরা একলাই গিয়ে ঘুরে আসমু। ”
মিশমি কিছু একটা বলতে চায়। তখনই রিশান বাঁধা দিয়ে বলে,
“ আহ্ নিশান! ব্যাপারটা আরেকটু ভেবে দেখ। আমাদের নীলকে কিন্তু ওর বাপ কম ভালোবাসে না। ও যদি এই কয়েকদিনে আঙ্কেলকে রাজি করায় ফেলে তাহলেই কিন্তু ঝামেলা শ্যাষ! না-হয় ডেটটা কিছুদিনের জন্য পিছায়ে দিলাম। কিন্তু একসাথে ঘুরতে যাওয়াটা তো হবে? তুই আর একটা বার দেখ। নীলের পক্ষে ওর বাপরে রাজি করানো কিন্তু অতটাও কঠিন কিছু না। ব্যাটা একবার রাজি হয়ে গেলেই কিন্তু আমাদের প্ল্যান সাকসেসফুল! ”
নীলাশার মুখটা জ্বলজ্বল করে ওঠে এই কথা শুনে। তাকে বুঝ দেওয়ার জন্য এমন নিখুঁত একটা যুক্তি ছাড়া আর কী থাকতে পারে রিশানের কাছে? কিন্তু নিশান প্রথমেই রাজি হলো না। না-না করতে করতেই সে কিছু একটা ভেবে দেখল। রাজি হওয়ার লক্ষ্যণ দেখা যাচ্ছে তার মাঝে। অতঃপর সবার এই উত্তেজনাকে দমিয়ে নিশান বলে উঠল,
“ ওকে, ডেট পিছানো হবে। বাট এইবার যদি তোরা কেউ বেঁকে বসিস তাহলে কিন্তু আর ছাড় পাবি না। এটাই তোর এন্ড তোদের সবার লাস্ট চান্স, নীলু! ”
চলবে ইন শা আল্লাহ!
তারকারাজি- (১৪)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
এক সপ্তাহের মধ্যে আরও তিনটে মধ্যরাত কেটে গেল মিশমি আর তিহামের লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখা করবার। কথা হলো ফোনে অনবরত। কিন্তু প্রথম দিনে করা তিহামের সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়নি মিশমির। উত্তর জানা থাকলে তো দিবে সে? মাঝে মাঝে খুব ভয় হয় মিশমির, তার মতো শান্ত-শিষ্ট, সহজ-সরল মেয়েটার সাথে অমন একটা চঞ্চল ছেলের বনবে না বোধহয়। আবার মনে হয়, এইযে মিশমির তিহামের ডাকে সাড়া দেওয়ার তীব্র বাসনা… এটা শুধুই কি নিজের ভদ্রতা কাউকে ফিরিয়ে না দেওয়ার? হাজার অমিলেও না-কি অলৌকিকতার মধ্য দিয়ে দুটো মানুষের মনস্তাত্ত্বিক মিলন সম্ভব হয়। আচ্ছা, এটাও কি তবে তার আর তিহামের জন্য অলৌকিক কিছু?
গত রাতে তিহামের সাথে দেখা করার পর আর ঘুমায়নি মিশমি। সারা রাত জেগে ফোনালাপ শেষ করতেই সূর্যের উপস্থিতি ঘটে গিয়েছিল। অল্প-বিস্তর ঘুম সেরে নিয়ে ভার্সিটিতে এসেছে সে। সকালে পানিটাও মুখে দেওয়া হয়েছিল কি-না তার তা মনে পড়ছে না। বাহ্যজগতে আজ সূর্যের তেজ ভীষণ! গা গুলিয়ে আসছে মিশমির। ঘুম না হওয়ায় মাথাতেও রাজ্যের ভার জমেছে। ঝিমঝিম করছে মাঝে মাঝেই। ঘামে মাখো-মাখো শরীরটা ঢুলছে বলে মনে হচ্ছে তার। মিশমি শ্রেণিকক্ষ থেকে বাইরে এসেছিল চোখেমুখে পানি দিতে। কিন্তু ওয়াশরুম অবধি পা দুটো যেন চলতে চাইছে না আর। চলতে চলতে হঠাৎই সে ঢলে পড়ে পাশের দেয়ালে। আঘাত না-পেতেও ওষ্ঠদ্বয়ে আঁটে ব্যথিত আর্তনাদ। মাথা ঘুরছে তার। আরেকটু হলেই বোধহয় শরীরটা মাটিতে নুইয়ে পড়বে। ঠিক তখনই দুটো দায়িত্বশীল হাত তরুণীর বাহু জোড়া আঁকড়ে ধরে দাঁড় করিয়ে দিল মুহূর্ত ব্যয়ে। ব্যস্ত পুরুষের চিন্তিত কণ্ঠ এলো,
“ মিশমি? তোমার শরীর খারাপ লাগছে না-কি? ”
চোখ জোড়ায় ঘন ধোঁয়াশা আবদ্ধ হওয়ায় মিশমি দেখতে পারছে না মানুষটিকে। মনে প্রশ্ন জাগে৷ নিশান বা রিশান কখনোই তুমি বলে সম্বোধন করবে না তাকে। তাহলে কি তিহাম এলো? না, এটা তিহামের কণ্ঠস্বর না। কিছুক্ষণ ধরে সামনের মানুষটিকে দেখার চেষ্টা চালালো সে। অতঃপর সফল হতেই দেখা মিলল অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত যুবক সায়ানের। তার চোখে নিজেকে নিয়ে অস্থিরতা দেখতে পাচ্ছে মিশমি। ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তার থেকে দু’হাত দূরে। মিশমি চোখে মেপেই বলে দিতে পারে সেই দূরত্ব! সে ভাবে, সায়ানকে বলে নীলাশা বা পিহুকে ডেকে পাঠাবে। কিন্তু ওষ্ঠদ্বয় এসে এখানেই সহায় হলো না তার। পা দুটোও কেমন কাঁপতে লাগল। এই বুঝি পড়ে যাবে! মিশমি ইচ্ছাকৃতভাবেই দেয়ালে মাথা ঠেকায়। দাঁড়িয়ে থাকার মতো ভরসা খুঁজে পাচ্ছে না সে। তবুও সহসা সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে, অত্যন্ত অসহায় তরুণীকে বিচার-বুদ্ধিহীনতায় বলতে শোনা গেল,
“ আপনি একটু শক্ত করে আমার হাতটা ধরবেন? ”
মিশমি দেখতে পায় না সামনের মানুষটির ভাবমূর্তি। বুঝতে পারে না তরুণের প্রতিক্রিয়া। মস্তিষ্ক অচল হয়ে আসতে থাকে তার। দুনিয়াকে পুরোপুরি ভুলতে হয়তো আর মাত্র কয়েক মুহূর্ত বাকি। ঠিক সেই সময় নিজের হাতটা কারো মুঠোয় অনুভব করতে পারে সে। অত্যন্ত যত্নে তার হাত ধরা মানবের কোনো কথা শুনতে পাওয়া যায় না। দুনিয়া আঁধারে তলিয়ে আসতেই শরীরটা লুটিয়ে পড়তে চায় মেঝেতে। কিন্তু সেই শক্ত করে ধরে রাখা মানব যেন পড়তে দিতে চায় না অচেতন মিশমিকে। ভীষণ শক্ত করে রমণীর দুই বাহু আঁকড়ে ধরে, দাঁড় করিয়ে রাখে সে। যেন নিখুঁত অঙ্গনার হাত দুটো ছেড়ে লুটিয়ে পড়তে দিলেই অঙ্গনার অসম্মান করা হবে, সেইটা মাটির বুকেই হোক কি নিজের বুকে। কে জানে, এই শক্ত করে আগলে রাখাটাই তরুণের অনিদ্রার কারণ হয় কি-না!
কাচতুল্য ঝকঝকে সোনা রোদ তখন রাস্তার বাঁকে লুটোপুটি খাচ্ছে। অথচ আকাশ যেন ঘন শীতের নিষ্প্রভতার ও পাণ্ডুবর্ণের এক বিশাল বিস্ময়! সানাম আকাশের দিকে তাকায়। হেঁটে চলে আনমনে। পাশ থেকে মিশমি আর নীলাশার গল্প-গুজব শোনা যায়। সব কিছুই চলছে তার নিজস্বতায়। শুধু সানাম-ই যেন তার নিজস্বতা হারিয়ে উদাসীনতায় ডুবে আছে। সামনে থেকে সহসা এক যুবকের ত্রস্তব্যস্ত, নাজেহাল অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। সানাম ভ্রু কুঁচকায় তাকে দেখে। ছেলেটির চালচলন দেখে আন্দাজ করে নেয় যে, সে এদিকেই আসছে। সানাম বেশ ব্যগ্রতার সাথে বুঝতে চায় ব্যাপারটা। আর তখনই দেখা যায়, ছেলেটি কোনো কথাবার্তা না বলেই মিশমির দু’হাত নিজের মুঠোয় পুড়ে নেয়। অত্যন্ত অধীরতার সাথে বলতে থাকে,
“ ঠিক আছো এখন তুমি? কী হইছিল তোমার? ”
মিশমিকে খুব ভয়াতুর দেখায়। তিহাম যে এভাবে এসে হাত ধরে নিবে তা কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি মিশমি। শৈত্য শিহরণের স্পর্শ পাওয়ার মতোই কেঁপে ওঠে মিশমির দেহ। হাত সরিয়ে নেয় মুহূর্তেই। কিন্তু তিহাম থামে না। অবিচলে প্রশ্ন করতে থাকে সে। অত্যন্ত চটপটে ছেলেটিকে নিজের অসুস্থতা নিয়ে ব্যস্ত হতে দেখে মনে প্রশান্তির প্রাচীরপত্র ছেপে যায় মিশমির। সেই পত্রের উপর আঁচড় কাটা মোহ-মায়াগুলো যেন ভেদ করতে চায় মিশমির হৃদপিণ্ড। মিশমি লাজুক স্বভাবে হাসে। মাথা নত করে বলে,
“ কিছুই হয় নাই আমার। প্রচুর গরম তো আজকে আর তাই-ই মাথাটা ঘুরে গেছিল। ”
“ তাই বলে এতই গরম লাগল যে, মাথা ঘুরেই পড়ে গেলা? খেয়ে আসো নাই, তাই না? ”
চকিতেই চোখ তুলে তাকায় মিশমি। প্রশ্ন করে,
“ আপনাকে কে বলল? ”
তিহাম নির্বিকারে উত্তর দিল, যেন এইসব বোঝা তার বা’হাতের খেল, “ কমনসেন্স! ”
সেই মুহূর্তে নীলাশা সানামকে নিয়ে তাদের একাকী সময় কাটানোর সুযোগ করে দেয়। মিশমিদের ছাড়িয়ে দুজন হেঁটে আসে বেশ দূরে। হৈমন্তিক শীতলতায় স্বস্তি বোধ করে দুজন-ই। সানাম একবার পিছনে ফিরে মিশমিদের দেখে নেয় সেই সময়। অতঃপর নীলাশার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“ কবে থেকে এই ইটিস-পিটিস চলতাছে, নীলইলিশ? ”
নীলাশা খুঁজছিল আরাভকে। এই সময়টাতে পুরো ভার্সিটি ঘুরে বেড়ানোই যেন মহারাজ ও তার সাঙ্গপাঙ্গের একমাত্র জরুরি কাজ। সানামের প্রশ্নটা যখন কানে বাজে ঠিক তখনই চোখ দুটো গোল-গোল হয়ে যায় তার। সে সানামের দিকে তাকিয়ে, বিস্ময়ের চরম সীমানায় অবস্থিত নিজের মস্তিষ্কের প্রশ্ন ছুঁড়ে বলল,
“ কী বললে তুমি? নীলইলিশ? তুমি তো দেখি আমার নামটা পচানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছো। একটু পর তো বলবে নীলবালিশ, নীলমালিশ এমনকি নীলবিষ-ও বলতে ভাববে না! এটা কেমন বিচার? ”
সানাম তিক্ততার সাথে জবাব দিল, “ শালার বেটি তুই পিহুর সাথে থাকতে থাকতে ড্রামাকুইন হয়ে যাইতাছোস। ওইটারে তো ঘরে সামলাইতে পারি না, আর তুই এখন বাইরে জুটছোস! ”
“ তা তুই ঠিক বলছিস! ওই কিন্তু দারুণ ড্রামা করে। ওর একটা কমেডি বুক লিখে ফেলা উচিত। ”
“ আজগুবি কথা না-বলে উত্তর দে। এই মিশমি আবার সাদা চামড়ার প্রেমে পড়ল না-কি? কবে থেকে চলে এগুলা? ”
“ থ্রি-ফোর্থস অফ মান্থ! আচ্ছা সানাম, আমি যে তোকে তুই বলে ডাকছি তা কি তুই ধরতে পারিস নাই? ”
খুব আগ্রহ নিয়েই প্রশ্নটা করেছে নীলাশা। সানামের অনুভূতিটা উপলব্ধি করতে চায় সে। স্বীকার করা অনিবার্য যে, সেইদিন এক সাথে সময় কাটানোর পর সানামের প্রতি তার দূর্বলতাটা সে নিজেও অনুভব করতে পেরেছিল। মেয়েটার সম্পর্কে আগেও ভালো ধারণা ছিল। কিন্তু সানামের কথা বলার ধরণটাই তার একমাত্র বিরক্তির কারণ। মেয়েটার মুখে কিছুই আঁটকায় না! মেয়েরা চঞ্চল হবে। তাই বলে এমন মাত্রাতিরিক্ত চঞ্চল হতে হবে কেন? খাপছাড়া, বেপরোয়া ভাব কি মেয়েদের সাথে মানায়? সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে সেই আগের ছন্নছাড়া সানাম এখন আর ‘সানাম’ নেই। মিশমির থেকেও শান্ত হয়ে গেছে যেন মেয়েটা! নীলাশা খেয়াল করল সানাম উত্তর দিতে খুব দেরি করছে। পরে অবশ্য নীলাশার অতি কাঙ্ক্ষিত ঘটনাটিই ঘটল। তবে উত্তরটা ছিল বেশ অনাকাঙ্ক্ষিত। সানাম নির্বিকারে বলল,
“ শুনছি কিন্তু ধরি নাই। কারণ পাগলদের কথা ধরতে হয় না। ”
নীলাশা স্থির হলো। নীরস দৃষ্টিতে দেখতে লাগল সানামের উদ্বেগহীনতা। সে এমন উত্তরের আশা করেনি। সানামের উদাসীনতায় নীলাশার-ও কেমন উদাসীন লাগছে সবকিছুকে। ওই যে পলকা মেঘের আড়ালে সূর্য লুকিয়ে ধূসর করছে পরিমণ্ডল! এতেও যেন নীলাশার মনে হাজার খানিক উদাসীনতা। এইযে ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা পাখিগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে! এতেও নীলাশার উদাসীনতার কমতি নেই। যেন মনে হচ্ছে প্রিয় কিছু সানাম নয় বরং সে নিজেই হারিয়ে বসেছে।
নীলাশা তার ব্যাগ হাতড়ে একটা চকোলেটের প্যাকেট বের করে নেয়। তা সানামের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ হেসে বলে,
“ তোর জন্য। ”
সানাম ভ্রু কুঁচকে একবার আপাদমস্তক দেখে নেয় নীলাশাকে। ভাব-সাব মোটে ঠিক নেই তার! নিগূঢ়ভাবে উপলব্ধি করে নেয় নীলাশার উদ্দেশ্য। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটে যাচ্ছে বলেই বোধহয় সানামের এভাবে প্রশ্ন করা,
“ আর ইউ সিরিয়াস? তুই আর আমি… লাইক টম এণ্ড জেরি? ”
উত্তরে নীলাশা খিলখিলিয়ে হাসে। প্যাকেটটা সানামের হাতে গুঁজে দিয়ে বলে,
“ উঁহু, তুই আর আমি না। আমরা! আমি, তুই, পিহু, নিশান, রিশান আর মিশা… টোটাল আমরা! ”
সানামকে নিষ্প্রভতায় হাসতে দেখা যায়। নীলাশার কথাটার অর্থ তার কাছে অন্যকিছুই হয়ে দাঁড়ায়। সে বলে,
“ আমাকে সান্ত্বনা দিতে হবে না তোদের। বাপ-মা মরে গেছে আমার। অথচ কিছুই হচ্ছে না আর তোরা আসছিস ওই চুনোপুঁটি সাইফকে নিয়ে সান্ত্বনা দিতে, হাহ্! ”
চকোলেটটা রাস্তার এক ধারে ছুঁড়ে ফেলে সানাম। এই দেখে নীলাশার বিস্ময় যেন বাঁধ মানে না আর। সানাম চলতে লাগে তার হলের দিকে। সেই যান্ত্রিক, ছন্নছাড়া মেয়েটিকে চলন্ত অবস্থায়-ই বলতে শোনা যায়,
“ তোর বাপের না খুব টাকা? কিনে নিয়ে অন্যদের সান্ত্বনা দিস। আমাকে এতো টাকার ফুটানি দেখাতে আসিস না। ”
সানাম চোখের অগোচরে হারিয়ে যেতেই নীলাশা প্যাকেটটা তুলে নেয়। সে বুঝতে পারেনি সানামের কাছে তার অনুভূতি কেবলমাত্র সান্ত্বনা হয়ে দাঁড়াবে। অহেতুক অপমানে বুকটা ভার হয়ে আসে তার। কিন্তু তার পর যা ঘটল তা ছিল মারাত্মকভাবে বিস্ময়ের বিষয়। সানামের একেকটা কাজকর্মই ছিল যেন নীলাশার ভাবনার বাহিরে… এমনকি সবার ভাবনার বাহিরে!
চলবে ইন শা আল্লাহ!