তারকারাজি- (২০)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
রাতের অপ্রসন্নতা কাবু করতে পারেনি ব্যস্ত রাজধানীকে। বিস্তীর্ণ রাস্তার দু’পাশ দিয়ে নিয়ন আলোর অক্লান্ত উপস্থিতিও আমাদের শহুরে জীবনের সৌন্দর্যের অন্তর্ভুক্ত। বলা চলে, সন্ধ্যা নামতেই ঢাকা শহরে উৎসব শুরু হয়। নিয়ন বাতির উৎসব।
বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েই বাবার থেকে বিদায় নিয়ে নিল নীলাশা ও বান্ধবী পিহু। ইয়াসিন চৌধুরী নিজের কাজের ব্যস্ততায় আর দেরি করেননি সেখানে। যদিও তিনি ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন মেয়ের নতুন বান্ধবী সানামের সাথে দেখা করে যাবার। কারণ তাদের সাথে সানামের আসার কথা থাকলেও সে আসেনি। কোনো এক গুরুতর কারণে সে আসবে তার চাচার বাসা থেকেই। তাই আর দেরি না করে, নীলাশারা দুজন বাসে উঠে ঠিক সোজা পিছনের দিকে চলে যায়। বাসের সর্বশেষের সীটে বসে থাকতে দেখা যায় সাহেল, রোহান, তনয় ও নিশানকে। তাদের ঠিক সামনে ফাঁকা, চলাচলের জায়গাটায় দাঁড়িয়ে গল্প করতে দেখা যায় মিশমি এবং রিশানকে। নীলাশারাও আগে সেখানে দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎ করে নিল সকলের সাথে। তবে এখানেও যে সীটে বসা নিয়ে ছোটমোটো একটা হাঙ্গামা সৃষ্টি হবে তা কেই-বা উপলব্ধি করতে পেরেছিল? তাদের লিপিবদ্ধ দ্বি-সারির সীটগুলো ছিল ইংরেজি বর্ণ এইচ-লাইন ও আই-লাইনের মোট আটটি সীট এবং পাঁচ সদস্যের জন্য অনুবিদ্ধ জে-লাইনের পুরোটাই, যা ছিল বাসের সর্বশেষের সীটসমূহ। মূলত টিকিটে গড়মিল হওয়ায় সেখান থেকে দুটো সীট চলে গেছে অজানা দুজন যুবকের দখলে, যা ছিল বাম সারির এইচ-লাইনের জোড়া সীট। সেই দুজন যুবকের সাথে কথা বললেও তারা জানায় যে, সীট দুটো তারা ছাড়বে না। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বখাটে, নেশাখোর যুবক তারা। তাই বুদ্ধিমান সাহেল তাদের সাথে কথা না বলে, তাদেরই ঠিক সামনের জি-লাইনের জোড়া সীটটা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন আসে যে, কে কোন সীটে বসবে? এইক্ষেত্রে সাহেল সিদ্ধান্ত দিয়েছিল, ডান সারির এইচ-লাইন ও আই-লাইনের জোড়া সীটে বসবে চারজন মেয়ে। ছেলেরা বসবে বাম সারির দখলকৃত দুই জোড়া সীটসহ সর্বশেষের জে-লাইনের অনুবিদ্ধ সীটটায়। সীট নিয়ে হাঙ্গামাটা এখানে কেটে গেলেই পারত! কিন্তু না, তা হতে দিল না নিশান-রিশান। সাহেলদের কানে ফিসফিসিয়ে নিজেদের পরিকল্পনা উন্মুক্ত করে, ছলচাতুরীটা বেশ করল তারা দুই ভাই। সাহেল এমন কিছুতে প্রথমে সায় না দিলেও নিজের বন্ধুসুলভ অনুভূতিটা আড়াল করতে পারল না। ফলস্বরূপ নিশানদের পরিকল্পনা মেনেই নীলাশাকে বসতে দেওয়া হলো ডান সারির আই-লাইনের সীটে যেখানে বসানো হবে আরাভকে। নিশানের এই বুদ্ধিতে যোগ দিতে গিয়ে তনয়ও কম ছলনা করল না! সে নিশানদের আড়ালে রেখেই সায়ান ও মিশমিকে পাশাপাশি বসানোর তীব্র বাসনা প্রকাশ করে বসল। সাহেল এখানে ঘোর আপত্তি জানালেও রোহান কিন্তু উৎসাহই দিয়েছিল তনয়কে। তবে ব্যাপারটা আরাভ-নীলাশার ক্ষেত্রে যতটা সহজতর ছিল, ততটাই যে জটিলতর হতে যাচ্ছে সায়ান ও মিশমির ক্ষেত্রে তা তনয়দের তিন বন্ধুর মস্তিষ্কে খুব ভালো করেই খেলেছে।
তারা আটজন নিজেদের অবস্থান থেকেই নিজেদের মতো করে আড্ডা দিতে লাগল। এখানে নীলাশা জোর-জবরদস্তি নিজের পাশে মিশমিকে বসাতে চাইলেও মিশমি বসতে চায়নি। তাকে এবং পিহুকে নিশানদের পরিকল্পনাটা জানানো হয়েছে ইতোমধ্যেই। তাই ক্ষণকালের জন্য নীলাশার পাশে অবস্থান করছে মিশমি। বলা যায় না, অভিমানী নীলাশা এই মুহূর্তে পাশে কোনো বন্ধুকে না পেয়েও হৈচৈ বাঁধিয়ে দিতে পারে! অন্যদিকে রোহান তনয়কে এদিকটা ব্যস্ত রাখতে বলে, আলতো ইশারায় বাসের প্রথমার্ধেকে ডেকে নিল মিশমিকে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক ছিল সহজ-সরল মিশমির কাছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভেবেই সকলকে আড়াল করে, রোহানের ইশারায় সাড়া দিল সে,
“ কিছু বলবেন ভাইয়া? ”
রোহান লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের তৃপ্তি প্রকাশ করল। অতঃপর ফিসফিসিয়ে বলল,
“ হ্যাঁ, তোমাকে একটা হেল্প করতে হবে। করবা প্লিজ? ”
“ কী হেল্প? ” মিশমির সোজা প্রশ্নের পর রোহান আগের থেকেও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করে বলল,
“ আসলে পরশু… মানে কাল রাত বারোটায় সায়ানের বার্থডে পড়বে। আমরা কক্সবাজারে গিয়ে ওর বার্থডেটা কীভাবে সেলিব্র্যাট করব তা বন্ধুরা সবাই প্ল্যান করব ভাবছি। ওখানে গিয়ে তো ও সব-সময় আমাদের সাথেই থাকবে তাই পৌঁছে প্ল্যান করা সম্ভব না। আর তাই তোমার ওকে নিয়ে একটু আলাদা করে বসতে হবে ওই জি-ওয়ান, জি-টু সীটে। ”
রোহানের বলা মিথ্যেগুলোকে সত্যি ভেবেই মিশমি চমকে উঠল। নিশান বা রিশান না বরং যে ছেলের সাথে তার কথাটাও হয়নি খুব, তার পাশে বসে গোটা রাত কাটাবে সে? মিশমির মন সায় দিল না। মনে ভীষণ অস্থিরতার দোলাচালে নখ কামড়াতে লাগল সে। অতঃপর আশেপাশে তাকিয়ে উত্তর দিল,
“ ভাইয়া, আমি বোধহয় পারব না। আপনি নিশান-রিশান… না, খুব ভালো হয় পিহু বা সানামকে কাজটা করতে বললে। ওরা এইসবে খুবই এক্সপার্ট। আমি পারব না ভাইয়া। ”
রোহান মুখ কালো করে অনুনয়-বিনয় করে বলল,
“ ওরা এক্সপার্ট দেখেই তো ওদের নিয়ে প্ল্যানটা করব। আর পিহু, সানাম দুই জনই তো বকবক করে বেশি! দেখা যাবে সায়ান নিজেই উঠে চলে আসবে আমাদের কাছে। ওর শান্তশিষ্ট মানুষই পছন্দ। এই পিহু, সানামের মতো বাচালদের সাথে বসলে তুলকালাম লেগে যাবে। দেখলা না, সানাম আর ওরা মিলে পুরা ভার্সিটিতেই তুলকালাম বাঁধিয়ে ফেলল? আমরা ঘুরতে গিয়েও ঝগড়া করলে কী ঘুরতে যাওয়ার মজা থাকে, বলো? ”
“ ওইটা তো তনয় ভাই-ই গণ্ডগোল করছে, সায়ান ভাই তো না। আর সায়ান ভাইয়া শান্তশিষ্ট মানুষ পছন্দ করলে আপনাদের বন্ধু হলো ক্যামনে, ভাইয়া? ”
মিশমির প্রশ্ন শুনে রোহানের আষাঢ় কালো মুখটা যেন একদম আঁধারেই তলিয়ে যেতে চাইলো। এই বোকা মেয়েটা বোকামি করতে গিয়েও দেখা যাচ্ছে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে তাকে! তবে রোহান হার মানলো না। আপু-বোন ডেকে অনুরোধ করল মিশমিকে যেন সে সায়ানকে তার ‘বার্থডে সারপ্রাইজ’ বিষয়ক কোনো কথা না বলে এবং তাদের থেকে দূরবর্তী জোড়া সীটটায় বসে। আর এই নিয়ে আগেই নিজের বন্ধুমহলে কিছু না বলারও অনুরোধ করে সে। এই ক্ষেত্রে নানান ভিত্তিহীন যুক্তি দাঁড় করালেও মিশমিকে ঠিকি রাজি করিয়ে নিতে সক্ষম হলো রোহান। বন্ধুর প্রতি বন্ধুদের এই আবেগের উপর আর প্রশ্ন করতে পারেনি মেয়েটি। তাই মিশমি বন্ধুদের কাছে ফিরে এসে বলল,
“ দোস্ত, আমি সামনের সীটটায় বসবো। বাস জার্নি করলে আমার এমনিতেও শরীর খারাপ লাগে। আর তাছাড়া পিছনের সীটগুলায় তো ঝাঁকি… ”
মিশমির কথা সমাপ্ত হওয়ার আগেই রিশান ধমকে উঠল,
“ হাঁপ্! এই গপ্পো তো আগেই শুনছি। নতুন করে শুনায়ে আবার মাথা ধরাইতাছোস ক্যান? তোরে শখে কি আর ঝাণ্ডুবাম ডাকি? যা, বসিস সামনে যার সঙ্গে বসার কিন্তু আমি তোর পাশে বসব না। তুই বমি করে আমার গা ভাসাইবি আর তা আমি মানবো না-কি? ”
এই কথা শুনে মিশমি ক্ষিপ্ত রূপে জানায় যে, সে আজ পর্যন্তও বাসে কখনো বমি করেনি। তবে তার বলার উদ্দেশ্য অন্যকিছু হলেও কথাটা কিন্তু মিথ্যে ছিল না। আরেক দিকে মিশমিকে রাজি করিয়ে ফেলেছে বলে রোহানদের খুশি যেন বাঁধ মানছে না আর! কিন্তু পরবর্তীতে মিশমিকে কী বলে বুঝ দিবে সায়ানের জন্মদিনের মিথ্যে কথাটা নিয়ে? বিষয়টা আরও জটিল হয়ে দাঁড়ালো তাদের কাছে। তবে পরেরটা পরে ভাবা যাবে বলেই চিন্তা ঝেড়ে ফেলল তারা তিনবন্ধু। তাদের পুনরায় হাসি-ঠাট্টার মাঝেই আগমন ঘটল সানামের। গলায় ক্যামেরা ঝুলানো হন্তদন্ত সানাম বন্ধুদের সমীপে এসে পছন্দ করল ডান সারির এইচ-লাইনের জানালার ধারের সীটটা। কিন্তু যখন সানাম তার পাশের সীটে ফোনালাপে ব্যস্ত পিহুকে খেয়াল করল তখন অনুরূপভাবেই নিজের ব্যাগ উঠিয়ে পিছনের দিকে ছুটে গেল সে। দাঁত কিড়মিড় করে বলতে লাগল,
“ এই ছ্যাড়ির পাশে বসা মানে নিজের কান পঁচানো। শালা, আর মানুষে কি প্রেম-টেম করে না? মেসেঞ্জার আছে, ইন্সটাগ্রাম আছে, হোয়াটসঅ্যাপ আছে… সেখানে চ্যাটিং চালা না রে ভাই! হুদাই-হুদাই টাকা খরচ করে হ্যালো-ফ্যালো করার দরকার আছে? তুই আর রিশান হইলি জাত খারাপ পোলাপান। একটা বউ-পাগলা তো আরেকটা জামাই-পাগলা। ”
সানামের কথা শুনে পিহু কটমট করে তাকালেও উত্তর বিশেষ দিল না। ওদিকে রিশানের তীব্র প্রতিবাদ! রিশান দাবি করল যে, সে তার প্রেমিকা সোহার সাথে ঠিক করে কথা বলার সুযোগ পায় না। কিন্তু এই দাবির সমর্থকের সংখ্যা হলো কেবলমাত্রই শূন্য! সানামকে দেখা গেল বাম সারির আই-লাইনের সীটে নিজের ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলতে। বোধহয় জানালার ধারেই ব্যাগটা রাখতে চেয়েছিল সে! কিন্তু সানামের এতো তাড়াহুড়ো স্পষ্ট হলো না কারো কাছেই। তাই নিশান-ই সর্বপ্রথম প্রশ্ন করল,
“ কী রে মামা, তুই হঠাৎ তোর চাচার বাসাত্ দৌড় মারছিলি ক্যান? ”
সানাম প্রথমেই উত্তর না দিয়ে টাকা ভাঙতি করার জন্য হুলুস্থুল আয়োজন শুরু করল। অতঃপর রোহানের সাথে ভাঙতি টাকার হিসাব-নিকাশ করতে করতেই উত্তর দিল,
“ আজকে আমাকে দেখতে আসছিল ছেলেপক্ষ। তাই চাচি ডেকে নিয়ে গেছিল। ”
এই কথা শুনে মিশমি আর নীলাশার বিস্ময় আকাশচুম্বী হলেও বিস্ময়ের কারণ মিলল না কোনো। মিশমিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করতে শোনা গেল,
“ কী বলিস দোস্ত! তোরে এখনি বিয়ে দিয়ে দিবে? ফাইনাল হয়ে গেল না-কি সব? ”
সানাম টাকা নিয়েই হুড়োহুড়ি করে বেরিয়ে গেল। অবশ্য তার হুলুস্থুল করার কারণের স্পষ্টতা হিসেবে উত্তরে বলেও গিয়েছিল যে, অটো চালকের ভাড়া মিটিয়ে এসে পুরো ঘটনা বলবে তাদের। তবে ফিরে এসেই সেই ঘটনা আর বলা হলো না তার। সানাম বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্ত গড়াতেই সাইফের আগমন ঘটল। সে এসে যে সানামের সীটটা-ই পছন্দ করেছে তা কারো খেয়ালে এলো না। বরং সেই সীটেই অবস্থান করা সাইফের সাথে গল্পে মশগুল হলো সবাই। এদিকে সানাম যখন বাসে উঠে নিজের সীটটা অন্যের দখলে দেখল, তখনই যেন বিরাট বিস্ফোরণে মস্তিষ্ক কেঁপে উঠল তার। সে সাইফের দিকে এগিয়ে গিয়ে, পেটের উপর হাত গুটিয়ে দাঁড়াল। দাঁত কিড়মিড় করে সাইফের উদ্দেশ্যে বলল,
“ আপনি কি জন্ম কানা? একবার মানুষ দেখেন না তো একবার মানুষের ব্যাগ দেখেন না। সমস্যাটা কী আপনার? আমি সীটে ব্যাগ রেখে যাওয়া সত্ত্বেও আপনি সেখানে বসলেন কেন? কোন সাহসে আমার ব্যাগ পাশের সীটে রাখলেন? ”
বিষয়টা এতক্ষণে খেয়াল করল সবাই। তবে সাইফকে বলেও কোনো বিশেষ লাভ হলো না কারোর। সাইফের স্পষ্ট উত্তর,
“ আমি যখন আসছি তখন ব্যাগটা দুই সীটের মাঝে রাখা ছিল। আমি কীভাবে জানব যে, এটা কোন পশুর ব্যাগ আর কোন সীটে রাখছে? ”
“ ওহ। সবার কাছে সবার ব্যাগ থাকার পরেও আপনি বুঝতে পারেন নাই যে, ব্যাগটা অন্যকারো হতে পারে? ন্যাকামি করেন? ”
সাইফ নিজের কণ্ঠের আয়ত্তে রাগ এনে উত্তর দিল,
“ না, আমি সিরিয়াসলি ভাবছি এটা মিশমির ব্যাগ। কারণ ওর কাছে কোনো ব্যাগ নাই আর এখানে একমাত্র ও-ই দাঁড়ায় আছে ব্যাগ ছাড়া। ”
“ তো ওকে জিজ্ঞাসা করে ব্যাগটা সরাইছিলেন? তা করলে নিশ্চয়ই ও বলতো যে, এটা আমার ব্যাগ? একটু ভদ্রতাও তো দেখাতে পারতেন সাইফ ভাই? ”
“ শোনো, আমি তোমার ব্যাগ লুকায়ে-চুরায়ে সরাই নাই। সবার সামনেই সরাইছি। ওরা দেখার পরেও কেন বলে নাই যে, এইটা তোমার ব্যাগ? আর আমি যেহেতু মিশমির সামনেই মিশমির ব্যাগ মনে করে সরাইছি তখন নিশ্চয় আমি মিশমির থেকেই কোনো কথা এক্সপেক্ট করব? সে যখন দেখার পরেও কিছু বলে নাই তখন দ্বিতীয়বার কোনোকিছু বলার প্রয়োজন আমি মনে করি নাই। আর তোমার যখন সীটটা লাগবেই ত… ”
সাইফের কথা সমাপ্ত হওয়ার আগেই সানাম বিড়বিড়িয়ে সুন্দর মেয়েদের প্রতি সাইফের অতিরিক্ত আকর্ষণের মন্তব্য করে বসল, যেখানে ‘সুন্দর মেয়ে’ হিসেবে কেন্দ্র করা হলো মিশমিকে। সেই কথা যে সাইফের কানে পৌঁছায়নি এটা ভাবাটাও ভুল হবে সকলের। তবে সে কিছু বলার আগেই সানামকে পুনরায় বলতে শোনা গেল,
“ যখন মিশমিই ভাবছেন তখন মিশমির পাশে গিয়ে বসেন-না সাইফ ভাই! আমার সীটটা এইবার দয়া করে ছাড়েন। আমি জানালার ধারে বসি সব-সময়। সো আপনার জন্য সেই নিয়ম আমি ব্রেক করতে পারব না। ”
সাইফ তো উঠেই যেত। কিন্তু সানাম সেই ধৈর্য্যটুকুও ধরে রাখতে পারল না দেখে সাইফও আর নিজের সহানুভূতি প্রকাশ করার প্রয়োজন মনে করল না। আচ্ছা, মিশমি তার জুনিয়র ভাইয়ের প্রেমিকা এবং সেই সাথেই নিজের বন্ধুর মনকাড়া এক রমণী হওয়ার পরও কি তাকে নিয়ে সাইফের মাঝে ভিন্ন আকর্ষণ কাজ করতে পারে? এছাড়াও মিশমি সুন্দর বলেই যে তার প্রতি সাইফের কোনো ভিন্ন অনুভূতি ছিল তা নয়। পৃথিবীতে যত জন সুন্দর মেয়ে আছে ততো জনের প্রতিই সব ছেলেদের আকর্ষণ থাকতে হবে না-কি? সাইফের মেজাজ চোটে গেল। বিন্দুমাত্র নড়াচড়া না করে উত্তর দিল,
“ ওহ রিয়েলি? সুন্দরী মেয়েদের পাশে বসার জন্য আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি, রাইট? তো নাও প্রমাণ; মিশমি মিশমির লাইনে বসবে আর আমি আমার লাইন মানে এখানেই বসব। তুমি এক কাজ করো। ব্যাগটা নিয়ে মিশমির পাশে চলে যাও। তাও যদি সুন্দরী ও সুমনা মেয়ের পাশে বসে নিজেও একটু সুমনা হতে পারো! মিশমি, ওরে একটু থেরাপি দিতে পারো না তুমি? ”
মিশমি বোকার মতো একবার সানাম তো আরেকবার সাইফের দিকে তাকাল। সেই সময় সামনে থেকে সায়ান আর শিহাবকে আসতে দেখা যেতেই মিশমিকে ইশারায় সায়ানের কাছে যেতে বলল রোহান। ওদিকে সাইফের অবস্থানরত সীটের বিপরীত সীট থেকে প্রস্তাব আঁটল নীলাশা যে, এতো ঝগড়াঝাঁটি না করে সানাম যেন তার পাশের, জানালার ধারের সীটটায় বসে। সানাম সেই প্রস্তাবে রাজি হতেই নিশান আর রিশান আকারে-ইঙ্গিতে ঠিকই বুঝিয়ে দিল তাকে যে, সেখানে আরাভ বসবে। উপায় না পেয়ে পিহুর কাছেই ফিরে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিল তেজস্বী মেয়েটি। কিন্তু সানামের সিদ্ধান্ত আবার এতো সহজ হতে পারে না-কি? সে কোনো কথা না বলে সোজা সাইফের পাশে বসে পড়ল। বসার সময় নিজের কনুই দিয়ে সাইফকে আঘাত করতেও ভুলেনি সানাম। ক্রোধে ভস্মীভূত সানাম খুব ভালোভাবে অনুমান করতে পারল যে, তার জীবনের ঝঞ্জাটতুল্য একটি মানব হচ্ছে সাইফ। এদিকে সানামের করা আকস্মিক আঘাতে ব্যথা না পেলেও মৃদু ব্যথিত স্বরে নিরর্থক কোনো শব্দ উচ্চারণ করল সাইফ। অতঃপর কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“ আচ্ছা গায়ে পড়া মেয়ে তো তুমি! ”
সানাম নিজের তর্জনী তুলে ধরল সাইফের সামনে। তুড়ি বাজিয়ে, শাসিয়ে উঠে বলল,
“ একদম চুপ! এইটা আপনার ভার্সিটি না আর আপনিও এখানে আমার কোনো সিনিয়র ভাই-টাই না। নিজের ভুলের জন্য যখন সীট হারাইছি তখন নিজেই নিজের সীট নিয়ে নিতে পারব। ”
উত্তরে সাইফও উল্টো শাসিয়ে উঠল,
“ এই সীট এখন আমার। দেখি তুমি ক্যামনে বসতে পারো এখানে। ”
সাইফের কথাতেও থমকে গেল না সানাম। চাপা স্বরে যখন তারা ঝগড়া করতেই ব্যস্ত তখন মিশমি একদম ক্ষিপ্রগামী প্রাণীর মতো গিয়ে দাঁড়াল ঠিক সায়ানের সামনে। মিশমির আচরণে সায়ান আর শিহাব হকচকিয়ে গেল বেশ। সে পাশ কাটিয়ে শিহাবকে চলে যেতে দিলেও সায়ানকে থামতে বলল ক্ষণকালের জন্য। অতঃপর তরঙ্গায়িত কণ্ঠে মিশমি বলল,
“ সায়ান ভাইয়া শুনেন, আপনি আর আমি এই সীটে বসব। ”
কথাটা বলার সময় নির্দিষ্ট জোড়া আসনের দিকে ইশারা করেছিল মিশমি। তবে সেই ইশারাতেও যেন ঢের খানিক অস্বস্তি! এখানে এসে মিশমির মুখোমুখি হতে হবেনা তা চিন্তা করা হাস্যোদ্দীপক বিষয় ছিল সায়ানের কাছে। মনে-মনে অনুভূতি লুকায়িত রাখার যে বীরত্ব নিয়ে এসেছিল তা যেন মিশমি এক লহমায় শুষে নিয়েছে নিজের মাঝে। সায়ান বিস্ময় নিয়েই প্রশ্ন করল,
“ তুমি আর আমি বসব মানে? ওইযে নীলাশা একা বসে আছে। ওর সাথে গিয়ে বসো? ”
মিশমি মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালো। অস্বস্তির দোলাচালে আরও অস্বস্তি যোগ করে ফেলল লাজুক মেয়েটি। মাথা নিচু করে মিনমিনে গলায় বলল,
“ ওই সীটে বসতে নিষেধ করছে নিশানরা। ওখানে আরাভ ভাইয়াকে বসানো হবে। ”
সায়ান মুহূর্তেই বুঝে নিল ব্যাপারটা আর সেই সাথে লক্ষ্য করল সানাম এবং সাইফকে। তাদের দুজনের চাপা ঝগড়ার আওয়াজ অস্পষ্ট হলেও শুনতে পাচ্ছে সায়ান। তাই সে ভাবল, সানাম হয়তো সাইফের সাথে বসবে না। সানামকে নিয়ে বসার কথা বলতেই সে জানালো সানাম ওই সীট থেকে এক পা-ও নড়বে না বলে দাবি করেছে। এইবার পিহুর নাম তুলতেই মিশমি ক্লান্ত নয়নে সায়ানের দিকে তাকাল। সায়ান জানে মিশমি কোনো এক কারণে বাহানা করছে তাকে তার পাশের সীটে বসানোর জন্য। কিন্তু কেন? আচ্ছা, বন্ধুরা কি তবে আরাভ-নীলাশার মতোই..? প্রশ্নটা আসতেই সে বন্ধুদের দিকে তাকায়। বন্ধুরা তখন সানাম আর সাইফের ঝগড়াতেই মেতে আছে। কারো কোনো খেয়াল নেই তাদের দিকে। সায়ান এইবার একটু দ্বিধা নিয়েই বলল,
“ সত্যি করে বলো তো, কে কী বলছে তোমাকে? তুমি কিন্তু মিথ্যা বলতে একদমই অপটু। ”
মিশমি মুখ কালো করে উত্তর দিল,
“ যখন বুঝেছেন-ই মিথ্যা বলছি তখন এটা তো বোঝা উচিত যে, কাউকে প্রমিস করছি দেখেই আপনাকে সত্যি কথাটা বলতে পারছি না? আর আপনি আমার সাথে এমন করছেন কেন? আমার পাশে বসলে কি আপনার খুব প্রবলেম হবে? তো বলে দেন আমাকে। আমি অন্য কাউকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু আপনি পিছনের দিকে বসতে পারবেন না। এখানেই বসতে হবে আপনাকে সেটা আমি-ই পাশে থাকি বা অন্যকেউ-ই থাকুক। ”
মিশমির অভিমানী স্বরে যেন খানিকটা নিভতে বাধ্যই হলো সায়ান। অবাধ্য, চঞ্চল মনটা ভুলেই বসলো তিহাম ও মিশমির সম্পর্কের কথা। তার আর ইচ্ছা করল না মেয়েটাকে মানা করে তার মন দুঃখী করতে। নিজের ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে অত্যন্ত আদুরে স্বরে মিশমিকে শুধালো,
“ কোথায় বসবা? জানালার ধারে না-কি তার পাশেরটায়? ”
মিশমি মৌন থেকেই জানালার ধারের সীটটায় বসে পড়ল। সায়ান তার পাশের আসনে ব্যাগটা রেখে, মিশমির থেকে কিছুক্ষণ সময় চেয়ে নিচে নেমে গেল। বাসস্ট্যান্ড থেকে বেশ দূরে দাঁড়িয়েই ইংরেজি বর্ণে তনয়কে বার্তা পাঠালো সে,
“ মিশমিকে কী বলছিস তোরা? ”
প্রায় সাথে সাথেই জবাব এলো,
“ আমি? আমি ক্যান কিছু বলমু? রোহান বলছে। ”
অতঃপর নিজের করা পরিকল্পনা রোহানকে দিয়ে বাস্তবায়ন করানো থেকে শুরু করে যাবতীয় ঘটনা লিখে পাঠালো তনয়। সবশেষে সায়ান বার্তা পাঠালো,
“ হাত বাড়ালেই কি চাঁদ ছোঁয়া যায়? মিশমি চাঁদ। আর তুই তো জানিস, আমি আমার প্রিয় জিনিসে আবর্জনা একদম পছন্দ করি না। ঠিক যেইরকম চাঁদের গায়ে তার কলঙ্ক একটা আবর্জনা। আমি মিশমিকে বলে দিচ্ছি সবকিছু। ”
এই বার্তা পড়তে না পড়তেই তনয় বাস থেকে নেমে যায়। আশেপাশে অল্প-বিস্তর খুঁজতেই দেখতে পায় সায়ানকে। সে সেখানে উপস্থিত হয়। সায়ানকে বোঝায় যে, এখন বললে মিশমি ওদের নিয়ে সন্দেহ করবে। এটা ঠিক মিশমি সহজ-সরল, বোকা প্রকৃতির মানুষ। তবে সে কিন্তু এতোটাও বোকা না যে, তাদের ছলচাতুরী ধরতে পারবে না। আর তার বন্ধুমহলের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন কিছু সদস্য তো আরো বেশি বুঝে নিবে ব্যাপারটা। মাঝে থেকে অহেতুক একটা অশান্তি সৃষ্টি হবে দুই বন্ধুদলে যেখানে বয়সের ভিন্নতা থাকলেও দুই পক্ষ কিন্তু বেশ মানিয়ে নিয়েছে একে-অপরের সাথে। এই সুসম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলেও সায়ানকে চুপ থাকতে অনুরোধ করল তনয়। সেই সময় শিহাব এসেও সায়ানকে বোঝালো যে, বিনা কৌশলে কাজটা করলে হিতে বিপরীত হবেই হবে! অন্যের প্রেমিকা জেনেও নিজের বন্ধুর পাশে বসানোর উদ্দেশ্যটা একবার কারো সন্দেহে পৌঁছালে তাদের পুরো বন্ধুদল সারাজীবনের মতো অসম্মানে ভুগবে বলে দাবি করল শিহাব। মূলত তনয় তাদের একসাথে বসানোর উদ্দেশ্যে সায়ানকে বোঝাতে লাগলেও শিহাব সায়ানকে বোঝাচ্ছে নিজেদের মান রক্ষার্থে। সে সাহেলের মতোই বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করেছে ব্যাপারটা। তাই সায়ান আর দ্বিরুক্তি করল না। তবে সে কঠোর সতর্কতা জারি করল যে, মিশমি বা ওর বন্ধুরা তো দূর, মিশমির প্রতি যে তার বিন্দুমাত্রও প্রেমানুভূতি আছে তা যেন অন্যকেউ জানতে না পারে। এই একটা বাক্যেই ইতি টেনে তারা বাসে উঠে পড়ল। সীট নিয়ে এই হাঙ্গামার সমাপ্তিটা ঘটল যখন বাসের দ্বারে আরাভকে পৌঁছাতে দেখা গেল। সানাম এবং সাইফও থামালো তাদের বিতণ্ডা। যে যার যার আসনে বসলেও আরাভের উপস্থিতি সকলের মাঝেই তীব্র কর্মচঞ্চলতা এনে দিল। আরাভ দেখতে পেল, ওই দূরে একটা মাত্র সীট শূন্য সদস্যে অপেক্ষা করছে তার জন্য। তার পাশের সীটে নিজেকে পশমি কাপড়ে মুড়িয়ে, কোনো এক সাহিত্যের বইয়ে ডুবে থাকা নীলাশাকেও স্পষ্ট দেখতে পেল আরাভ। তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কে খুব ভালোই আওয়াজটা ওঠে যে, বন্ধুদের এই কর্মচঞ্চলতা আসলে তাদের ব্যস্ত হবার নিদারুণ বাহানা। সবকিছুই ইচ্ছাকৃতভাবে করা। আরাভ মনে-মনেই খুব হাসল সকলের ছেলেমানুষী দেখে। সে এটাও ভাবল যে, নীলাশাকে চমকে দেওয়ার জন্য দুই দলের বন্ধুদের কৃত আয়োজন ও অভিনয়টা মোটেও তুচ্ছতুল্য না। কিন্তু সাহিত্যে ডুবে থাকা নীলাশা কি অনুভব করতে পেরেছে যে, তার দিবাস্বপ্নের পুরুষটি পৌঁছে গিয়েছে তার পানে?
#চলবে ইন শা আল্লাহ!