তারকারাজি-২১,২২

0
436

তারকারাজি-২১,২২
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
পর্ব:২১

বাহ্যজগতের হৈ-হুল্লোড় ভুলে গিয়ে মাত্রই বইয়ের পাতায় মন হারিয়েছে নীলাশা। আকাশটা ধূসর মেঘের আলাপনে লুকিয়েছে দৃষ্টির অগোচরে। বৃষ্টি হবে ঢাকা শহরে। এই কার্তিকের স্বল্প শৈত্যের শীতলতা বৃদ্ধিতে রাত্রির বর্ষণটা যে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চলেছে তা নীলাশা বুঝতে পেরেছে ইতোমধ্যেই। সে বইয়ে চোখ রেখেই জানালার দিকে হাত বাড়ায়। আনমনা যুবতী হাতড়ে চলে জানালার কাঁচ কিন্তু তা খুলে দেওয়ার উপায় খুঁজে পায় না কোনো। ঠিক সেই সময় কেউ সযত্নে তার হাতটা নামিয়ে দিয়ে জানালার কাঁচ সরিয়ে দিতেই চমৎকৃত নীলাশা বাহিরে তাকাল। মুহূর্তেই স্নিগ্ধশীতল হাওয়ার স্পর্শে তিরতির করে দুলে উঠল এলোথেলো চুল, পোশাকের রেশমি রোমশ ও নীলাশার কোমল অন্তর। চোখের পাতা বন্ধ করে নিল সে। অনুভব করল বইয়ের পাতার দোলন, প্রেমপরায়ণ বজ্রনাদ ও কড়া পুরুষালি সুগন্ধির ঘ্রাণ। জনম প্রণয়ী যুবতীর সংবিৎ ফিরলো সেই অনুভূত ঘ্রাণে। হঠাৎ মনে হলো এটা কোনো কড়া পুরুষালি সুগন্ধি না বরং সুগন্ধি ব্যবহার করা কোনো পুরুষই তার অতি সামীপ্যে রয়েছে। নীলাশা উড়ন্ত চুলে হাতের বাঁধা সৃষ্টি করে বা’পাশে তাকায়। দেখতে পায় দিবাস্বপ্নের সেই আরাভ নিজের ডান হাঁটু দিয়ে সীটে ভর করে, খানিকটা উবু হয়েই তাকিয়ে আছে তার দিকে। আরাভের মোহাবিষ্ট চোখে চোখ রেখে কেঁপে উঠল নীলাশার চিত্ত। উল্টো হাওয়ায় এলোমেলো হলো চুল। বইটা ছুটে গেল হাত থেকে। এলোমেলো হয়ে গেল নীলাশার স্নায়ুতন্ত্রের কর্মসঞ্চালন। ওষ্ঠদ্বারে পৌঁছায় না বলার মতো কোনো ভাষা। এদিকে আরাভ উবু হয়ে সযত্নে সেই বই তুলে দিয়ে পাশের সীটটায় বসে পড়ল। মুখে গাম্ভীর্যের ছাপেও ক্ষীণ কোমলতা থাকল। আশপাশ থেকে দুই দলের বন্ধুদের চাপা জয়ধ্বনি শ্রবণেন্দ্রিয় হতেই ফোন বেজে উঠল নীলাশার। সে স্বাভাবিকভাবেই তাকাল ফোনের পর্দায়। ইয়াসিন চৌধুরীর কল এসেছে দেখেই তা রিসিভ করে নিল ভীষণ তড়বড় করে,

“ হ্যালো, ড্যাড? ”

অপরপক্ষের আওয়াজ কেউ শুনতে না পেলেও নিশান মন্তব্য করে বসল,

“ এই দেশের মাইয়ারা কত সুন্দর আব্বা, বাবা, আব্বু বলে ডাকে। আর হেতিরে পদে-পদে প্রমাণ করা লাগবে যে, হেতি বিদেশ থেকে আসছে। মানে কী কমু! কুত্তার লেজ আরএফএল পাইপের মধ্যে ঢুকালেও সোজা হয় না। এই ব্রিটিশ ছেড়ি ব্রিটিশই থাকল। এক্কেরে কুত্তার লেঙ্গুড়! ”

হাসির রোল পড়ল সেখানে। নীলাশার বিশ্রীভাবে কুঁচকানো মুখশ্রী দেখে সেই হাসির মাত্রা যেন ধাপে ধাপে বৃদ্ধিই পেল সবার। ফোনে কথা বলতে বলতেই নীলাশা খেয়াল করল কোনো এক কারণে আরাভকে বাস থেকে নেমে যেতে। সে তড়িঘড়ি করে কল কেটে তার আশেপাশে তাকাল। বেশ অর্থোদ্ধার করে নিল সকলের মিটমিটিয়ে হাসার পিছনের কারণটি। নীলাশা নিজের মাঝে কৃত্রিম রাগ ফুটিয়ে তুলে খানিকটা চেঁচিয়েই বলল,

“ দরকার ছিল এই হাঙ্গাটা করার? ”

বাসের শেষাংশের সদস্যদের থতমত মুখটা ভেসে উঠল নীলাশার এরূপ প্রশ্ন শুনে। এমনকি অবিদিত ছেলে দুজনও তাকিয়ে থাকল নীলাশার দিকে।কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হলো। সর্বপ্রথম সানামই প্রশ্ন করল,

“ হাঙ্গা? কার হাঙ্গা? ”

নীলাশা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ভাবটা এমন করল যেন সকলের ন্যাকাবোকা মুখশ্রী দেখে সে অত্যন্ত বিরক্ত। অতঃপর সাহেলের কণ্ঠ এলো,

“ আই থিঙ্ক নীল ‘হাঙ্গামা’ বুঝাতে চাইছিল। ”

নীলাশা তড়িঘড়ি করে সহমত পোষণ করল,

“ হ্যাঁ, ওই হাঙ্গামা-ই বলছি। শুধু ‘মা’ বাদ পড়ে গিয়েছিল। ”

এই কথা শুনে সকলে আরও কয়েক মুহূর্ত নীরবতা পালন করল। অতঃপর পরিবেশকে অতিমাত্রায় চাঞ্চল্যকর করে তুলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল তারা। নীলাশা বিরক্ত হয়ে জানায় যে, একটা শব্দ ভুল করে বলে ফেলেছে বলেই কি এভাবে রাক্ষুসে হাসিতে বাস কাঁপিয়ে ফেলতে হবে সবার? ‘হাঙ্গামা’ শব্দটাকে কি সংক্ষিপ্ত আকারে ‘হাঙ্গা’ বলা যায় না? নীলাশার বিরক্তি প্রকাশ হতে না হতেই আরাভের উপস্থিতি ঘটে সেখানে। তাদের এরূপ দশা দেখে নিজেও কৌতূহলী হয়ে সকলকে জিজ্ঞাসা করতেই সাইফ বিষয়টি জানায় তাকে।আরাভও নীলাশার পাশে বসে নীরবে হাসতে লাগল। এই দেখে নীলাশার আর বোঝার বাকি রইল না যে, শব্দোচ্চারণে নীতিভ্রংশ ঘটিয়েছে সে। তখন রিশানকে বলতে শোনা গেল,

“ ওরে ব্রিটিইশ্শা! তুই বিলেতি পড়ুয়া মাইয়া বিলেতিই বল। হুদাই বাংলা বলতে গিয়ে বাংলার বংশপরিচয় পাল্টায় দিতাছোস ক্যান? তুই জানিস হাঙ্গা মানে কী? হাঙ্গা মানে বিয়ে। তার মানে তোর কথার মিনিং হইছিল… ”

কথা সমাপ্ত করার আগেই সামনে থেকে মিশমি বলে উঠল,

“ একটু আগেই ইংলিশ বলা নিয়ে নিশান খোঁটা দিল আর তুই খোঁটা দিচ্ছিস বাংলা বলা নিয়ে। ওকে কি শান্তিতে কথাটাও বলতে দিবি না? তোরা মানুষের পিছে লাগতেই পারিস যা! মানুষকে বুঝতে জানিস না। ”

নিশান নাটকীয় ভঙ্গিমায় অনুনয়-বিনয় করে বলল,

“ বোইন রে বোইন, দয়া করে তোর টেপরেকর্ডারটা ঘুরতে যাওয়ার সময় চালাইস না। তুই আমার গিলা, তুই আমার কলিজা, খালি আমার কথাটা শোন। আন্টির বাণী আমরা ঘুরে এসে তারপর সবাই মিলে… ”

মিশমি মৃদু নিঃস্বনে ধমকে উঠেল,

“ রাখ তোর গিলা-কলিজা! ভালো কথা গায়ে লাগছে না-কি কোনোদিন? আমি ভালো বললেও আমার মায়ের সুনাম আর আমি খারাপ বললেও আমার মায়ের দুর্নাম। এই পৃথিবীত্ আমার কোনো কদর-ই নাই! ”

রিশান হো হো করে হেসে বলল, “ উচিত কথা বলছোস তো মামা! ”

মিশমিকে নিয়ে হৈহৈ করতে-করতেই বাস তার যাত্রার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। শৈত্য হাওয়ার চঞ্চলতা সহ্য করতে না পেরে নীলাশা জানালার কাঁচ লাগিয়ে দিতেই প্রশ্ন শোনা গেল পিহুর,

“ ওই সানাম! নীলের হাঙ্গা মার্কা টপিক থেকে মনে পড়ল, তোর বিয়ের কী হইলো? ফাইনাল না-কি বিয়ে ভাঙছে? ”

সানাম দাম্ভিক স্বরে বলল,

“ ভাঙছে মানে? বল আমি ভেঙে দিয়ে আসছি। ”

রিশান বলল, “ ক্যামনে ভাঙলি? তোর জ্বালাইন্না চাচি কিছু বলে নাই? ”

সানাম ঠোঁট চেপে হাসল একবার। সোজা হয়ে বসে হাসতে হাসতেই বলতে লাগল,

“ অতো কিছুই করি নাই। ছেলেটার সাথে কথা বলতে পাঠালো যখন তখন খালি বলছিলাম ‘ভাই, আপনারে আমার পছন্দ হয় নাই। দেখেই ভাই-ভাই লাগে আপনারে। বিয়ের পর তো খালি কেলানি-ই খাবেন আমার হাতে! চাচির কাছে শুনছেন নিশ্চয়ই রাগ উঠলেই আমি যারে-তারে ধরে মারা শুরু করি? কিন্তু একটা কাজ করা যায়। যদি আপনি লিখিত দেন যে, আপনারে এমনকি আপনার পরিবারের কারো উপর রেগে গিয়ে যদি ধুপধাপ করে মাইর ফেলাই দুই-একটা; তাহলে আপনি সেই নিয়ে কোনো অভিযোগ তুলতে পারবেন না কোনোদিন। আর বিয়ের পরেও যে আপনারে ভাই ডাকলে কিছু বলবেন না সেইটাও লিখিত দিয়েন। ভাইয়ের সঙ্গে কি আর বউ-বউ টাইপ প্রেম করা যায়, ভাইয়া আপনিই বলেন? বোন-বোন টাইপ প্রেম করব আপনার সাথে। আর বউ-বউ টাইপ প্রেম করার জন্য আলাদা একটা… আচ্ছা সেইটা পরে না-হয় আমি আর আপনি মিলে একটা ছেলে খুঁজে নিব। তাহলে ভাইয়া, যদি এগুলা লিখে সিগনেচার দিয়ে দেন তো আমি এখনি কাজী ডেকে চাচিকে বিয়ের আয়োজন করতে বলব। আপনাকে বিয়ে করেই আমাকে বাসস্ট্যান্ডে যেতে হবে আবার। ’ এগুলা বলে পরে বলছি যে, ফিরে এসে না-হয় ওর সাথে একটা সিঙ্গেল হানিমুনে যাব। সারাদিন ঘুরব আর হোটেলে এসে যে যার-যার রুমে ঢুকে যাব। নো হাসবেন্ড-ওয়াইফ টাইপ হানিমুন। কিসসা শ্যাষ! ”

তুঙ্গে ওঠা বিস্ময় নিয়ে সকলেই তাকিয়ে রইল সানামের দিকে। নিশান তিক্ত মুখে প্রশ্ন করল সেই সময়,

“ এগ্লা তুই সত্যিই বলে আসছোস? ছিঃ, ছিঃ তুই পাগল না-কি পায়জামা? ওই পোলা যদি তোর চাচিরে এগ্লা বলে দেয় তুই বুঝতাছোস কী হবে? আর তাছাড়াও ওই পোলা যদি তোরে তহন-ই এডা থাপ্পড় মারত তাইলে তুই না থ্যাতলে যাইতি গা? ”

সানাম খিলখিল করে হাসল,

“ আরে বিয়ে ভাঙার জন্যে মানুষ কত কিছু করে। তার উপর তুই দেখলেই বলতি যে, হাবাগোবা পোলা। নাহলে এমনিই আমার এগুলা কথা শুনে পলায়ে যায়? চালাক হইলে না মামা! আমারে সত্যিই থ্যাতলে দিয়ে যেত। মানুষ বুঝেই বুলি ছাড়ছি আমি। আমারে দিবে বিয়ে, হাহ্! আমি হইলাম সানাম। মানুষরে নাচানিই আমার কাম। ”

পিহু নিশানের অনুরূপ বলল,

“ তুই এমন ক্যান রে ভাই? বিয়ে করবি না ভালো কথা। তাই এগুলা বাগড়া দিয়ে বিয়ে ভাঙবি? কী করতে চাস তুই বল তো? ”

সানাম সীটে গা এলিয়ে বসল। বাসের সর্বোচ্চ স্তরে তাকিয়ে কাল্পনিক দৃশ্য দেখার ভঙ্গিতে বলল,

“ আই ওয়ান্ট টু নো দ্য মিনিং অফ মাই লাইফ।আমার স্বার্থপর বাপ-মা ভালো এক কাজ করছে বুঝলি? স্বার্থপর দুনিয়া চোখের সামনে রেখে বলে গেছে, ‘সুমনা, তুই দুনিয়া দেখবি। দুনিয়া দেখাবে তোর করণীয়।’ দায়িত্ব দেওয়ার আর মানুষ পায় নাই তারা। আজগুবি চিন্তাভাবনা! এইরকম ‘নো টেনশন ডু মাস্তি’ টাইপ ইচ্ছা নিয়েই কাটায় দিব জীবন। আমার এত প্যারা নাই লাইফে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার, বিয়ে-শাদি করার, বাচ্চা পয়দা করে নিজেরা মরে গিয়ে তাকে অনাথ দেওয়ার। ইট’স আ বিউটিফুল লাইফ এন্ড আই শুড এনজয় ইট। ”

সানামের ছন্নছাড়া কথায় সবাই তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো ব্যতিক্রমী ইচ্ছা প্রকাশ করে উঠতে পারল না। নীরবতা কাটিয়ে রিশান মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে উত্তর দিল,

“ যা ছেড়ি! এইটা কোনো লাইফ হইলো? যত দোষ খালি আঙ্কেল-আন্টির, নাহ্? ”

সানাম খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেও রিশানের উত্তর হলো শূন্য। সে নিজেও নিজেকে নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে যে, তার জীবনের মানে কী? জীবনের মানে জানার যে তার প্রবল উত্তেজনা তা নয়। সে শুধু চায় একটি ছলাকলাশূন্য জীবন। যেখানে নেই কোনো সুখময়ী জীবনের বিষাক্ত আশ্বাস… নেই কোনো দুঃখময়ী অসুখের বিষাক্ত নিঃশ্বাস!

বাসে নীরবতা খেলে গেল বেশ কিছুক্ষণ। বাহিরে এক ফোঁটা, দুই ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টিগুলো এসে জানালার কাঁচে ভীড় করে বসেছে বিন্দু বিন্দু কোলাজের মতো। সেই ঝাপসা কাঁচের দেয়ালটার দিকে নীলাশা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। অতঃপর তাতে আঙুলের মসৃণ ছোঁয়ায় লিখে ফেলল,

“ গায়কবাবু, কোনো নারীর নিবেদিত প্রেমকে প্রত্যাখান করতে নেই। আপনি দেখি ভীষণ অবুঝ! ”

মলিন হাসল নীলাশা। হাসির সেই ক্ষীণ আওয়াজে ফোনের পর্দায় ব্যস্ত থাকা আরাভের চোখ দুটো বিনা মুহূর্ত ব্যয়েই ফিরে তাকাল নীলাশার দিকে। সে দেখতে পায় নীলাশাকে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতে। তাই আরাভ বোঝার চেষ্টা চালালো সেই হাসির কারণ। হয়তো ভেবেছিল নীলাশা বাহিরেই কিছু দেখছে। কিন্তু না, চোখে পড়ল আবছা কাঁচে স্পষ্ট ছাপা অভিমানিনীর কিছু অভিমান। আরাভ নিঃশব্দে হাসির রেখা প্রসারিত করল। উদ্দেশ্যহীন সামনে চোখ রেখে, দারুণ কাব্যিক ভঙ্গিতেই বিড়বিড় করে বলে উঠল আরাভ,

“ নীল… প্রণয় মাখালেই হয় নীলা। সেই কী ভীষণ সুন্দর রঙ! ”

অতঃপর সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ল নীলাশার দিকে,

“ তোমার নীল রঙ কেমন লাগে, নীলা? ”

নীলাশা চমকে উঠে পাশে তাকায়। দেখে ফেলল না-কি লেখাটা? সে অপ্রস্তুত হলো বেশ। আবার পরক্ষণেই মনে হলো যে, এমন চলন্ত বাসে পাশে বসা মানুষটি কী করছে তা খেয়াল করার মতো সময় আরাভের কেন থাকবে? নীলাশা নিজের পোশাকের আস্তিন দিয়েই মুছে ফেলল কাঁচে লেখা অভিমানখানা। বেশ এলোমেলো স্বভাবে বিশুদ্ধ বাংলায় উত্তর দিল,

“ স্বল্পপ্রিয়। তা যে বিষাক্ত রঙ! ”

তৎক্ষনাৎ-ই কোনো উত্তর দিল না আরাভ৷ চোখ বুজে নিয়ে সীটে মাথা ঠেকাতেই ভেসে উঠল নীলাম্বরীতে এক প্রণয়িনীর প্রতিচ্ছবি। ও যে নীলাশা! অবাধ্য অনুভূতি মুহূর্তেই বিড়বিড়িয়ে উঠল শ্যামপুরুষের ওষ্ঠদ্বারে,

“ সেই নীল বিষেই কি এলোমেলো হয়ে গেলাম আমি? ”

নীলাশা অস্পষ্ট শুনে সেই কথা, “ কী বলছেন? ”

আরাভ তাকাল। হালকা হেসে আচমকাই নীলাশার গাল টেনে দিয়ে বলল,

“ কুমিল্লা এসে গেছি। চলো, কিছু খেয়ে নেওয়া যাবে এখন। ”

সকলকে ডেকে বাসের প্রথমার্ধেকে চলে গেল আরাভ। নীলাশা সেথায় ঠাই তাকিয়ে, থম মেরে বসে রইল শুধু। আরাভের ওইটুকু আদুরে স্পর্শেই যেন শুরু হয়ে গেল তার গায়ের কাঁপুনি। সে কি আদৌ তাকে প্রত্যাখ্যান করছে না-কি করছে না, তা নিয়ে বিভ্রান্তই হলো নীলাশা। সেই সাথে তিরতির করে কেঁপে উঠল তার ঠোঁট দুটো। গায়ের তাপমাত্রাটা বোধহয় এবার শূন্যতেই পৌঁছাতে চাচ্ছে। অত্যন্ত শীতল শিহরণে প্রণয়িনী বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল। নরম গদির আসনে নিশ্চল হয়ে হেলে পড়ল নীলাশার শিরশিরিয়ে ওঠা দেহ।

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

তারকারাজি- (২২)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী

গা দুলে উঠতেই ঘুমন্ত নীলাশা চমকে তাকাল। স্নায়ুতন্ত্র নিশ্চল। আকস্মিক বিক্ষুদ্ধে নিদ্রাভঙ্গ নীলাশার মস্তিষ্ক সহজেই ধরে উঠতে পারল না কারো কথার টাল। অতি বিলম্বে সোজা হয়ে বসতেই প্রথম যে কথাটা শুনতে পেল সে তা হলো,

“ নীলির বাচ্চা! তোরে কতবার বলছি যে, মরার মতো ঘুমাইবি নাহ্? ”

পিহু বলল না কথাটা? নীলাশার শ্রবণশক্তির অভিজ্ঞতা বলে দিল এই রিনিঝিনি কণ্ঠের রূঢ়ভাষী আসলে পিহু। সে হাই তুলে ভারপ্রাপ্ত মাথাটা জানালায় ঠেকিয়ে রাখল। তখন সানাম বলল,

“ বান্ধবী তুমি জাগছো? আমি তো ভাবলাম রাজপুত্র এসে কিছু-মিছু না দিলে তোমার ঘুম ভাঙবে না আর। একদম স্লিপিং বিউটি টাইপ! ”

সুষুপ্তা নীলাশা গাঢ় কণ্ঠে বলে উঠল এবার,

“ সানাম ডিয়ার, তোমার উচিত রোজ সকালে তোমার চিন্তা-ভাবনাকে হারপিক দিয়ে পরিষ্কার করা। বিকজ ইয়োর থট্স আর ভেরি ডার্টি। ইয়াক! ”

সানাম উত্তর দিতে নিলেও আর উত্তর দিল না। সাইফকে নীলাশার সাথে সহমত হতে শুনতেই সানামের মস্তিষ্কে ঝাঁকে-ঝাঁকে আক্রমণ করল যুবককে থামিয়ে দেওয়ার তীব্র তৃষ্ণা। নীলাশাকে ছেড়ে সাইফের সাথেই বাক-বিতণ্ডায় ব্যস্ত হতে দেখা গেল সানামকে। নীলাশা হাই তুলে আবারও চোখটা বন্ধ করল। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে তার। কিন্তু রেহাই মিললো না রিশানের রূঢ় কণ্ঠ হতে,

“ ওই চুচু ডায়াপার! আর মাত্র দশ মিনিট আছে ব্রেক টাইমের। উঠে খাবি না-কি খাবার কিনে আনা লাগবে তোর জন্যে? ”

নীলাশা চোখ ডলে তাকাল। আবারও একটা নতুন নাম শুনে ভ্রুতে বিরক্তির ডোরাকাটা চিত্র ফুটে উঠল। এদিকে রিশানের দেওয়া নাম শুনে পিহুর ডাকাতিয়া হাসিটা যেন জনশূন্য বাস কাঁপিয়ে তুলতে সক্ষম হবে! সে হাসতে-হাসতেই বলল,

“ কী বললি তুই? আমাদের নীল চুচু ডায়াপার? ”

রিশান হাসল, “ তা নাহলে কী? এই আলালের ঘরের দুলালির জন্য এই নাম-ই পারফেক্ট! ঘুম থেকে তুলে তাকে খেতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা লাগতাছে। তার মানে বুঝছোস ওই কী পরিমাণ নবাবজাদী? ”

নীলাশা শুনল না তাদের কথা। মুহূর্তেই রাজ্যের ঘুমটা সক্রিয় হয়ে বসল তার চোখে। মিশমিকে বলতে শোনা গেল,

“ ও তো আর আমাদের মতো করে বড় হয় নাই। ডেকে খাওয়ার কথা বলাটা কি স্বাভাবিক না? ওরে ঘুমাইতে দে তো তোরা। একবেলা না খেলে কেউ মরে না কিন্তু একবেলা না ঘুমালে মানুষের ব্রেনের সমস্যা হয়। ”

“ এই ঝাণ্ডুবাম, তোর এতো কেন জ্ঞান দেওয়া লাগবে বল তো? চুপ মেরে থাকতে পারিস না না-কি? তুই হাবাগোবা মাইয়া। যত কম কথা বলবি ততো মানুষ কম জানবে যে, তুই রূপে সুন্দরী আর বুদ্ধিতে অগাচণ্ডী। আর তুই কি-না মানুষরে জানিয়ে বেড়াইতে চাস যে, আমাদের সুন্দরী বান্ধবী আসলে একটা অগাচণ্ডী? তুই জানোস এটা আমাদের জন্য কত বড় অপমানের বিষয়? আমার তো বাসের তলে শুয়ে পড়তে মন চাচ্ছে তোর বুদ্ধির স্বল্পতা দেখে। ”

মিশমি নাক ফুলিয়ে তোলে, “ তো শুয়ে পড় না! আমি তোরে আটকাইছি? আমি বুঝতাছি না যে, আমি গাধার মতো কী বললাম? ”

পিহু ফিসফিসিয়ে উঠল,

“ আরেহ আবুইল্লা! আমাদের নীলি যা মরা ঘুম পাড়ে…! ওর এক ঘুমেই দেখবি কক্সবাজার চলে গেছি আমরা। ওই ঘুম পাড়লে আরাভ ভাইয়ের সাথে প্রেমটা হবে ক্যামনে? আর প্রেম না হইলে ওদের একসাথে বসাইলাম কীসের জন্যে? শোন, প্রেম করলে আমাদের নীলাশা এমনিই চাঙ্গা হয়ে যাবে। কিন্তু ঘুমাইলে সেই তো শাক-সবজিই থেকে যাবে ওদের মধ্যে, আমিষ হবে ক্যামনে? এখন বল তুই বুঝছিস যা বুঝাইলাম? ”

মিশমি বেশ ভাবুক স্বভাবে বলল,

“ কিন্তু দোস্ত, প্রেম তো কাল, পরশু, তরশু ইনফেক্ট ছয়টা দিন-ই করতে পারবে। না ঘুমাইলে যে ব্রেনের সমস্যা হবে সেইটা তো আর রিপেয়ার করা যাবে না। এতো বড় মেয়েরে কি আর ব্রেইন শার্প করার জন্য জুনিয়র হরলিক্স খাওয়ানো যাবে, বল? ”

মিশমির কথা শুনে পিহুরা সকলেই বিস্ময়াভিভূত হলো। এমনকি বাসে উপস্থিত সাইফ নিজেও তাজ্জব বনে গেছে। অতঃপর তারা আবারও অট্টহাসিতে বাস মাতিয়ে তুলতেই মিশমি ঠোঁট চেপে নিজের হাসিটা নিয়ন্ত্রণে আনল। বাস্তবিকপক্ষে মিশমির শেষোক্ত কথাগুলো ছিল অভিনয়। পিহু বলার পর বিষয়টা বুঝলেও এমন হাস্যরসিকতা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারল না মিশমি। তবে এটা ঠিক সে বিশ্বাস করে, যেই ভালোবাসা হবার তা এমনিতেই হবে। এতো আয়োজন করে আবার ভালোবাসা হয় না-কি? এই যে সে তিহামকে মনের কোণে জায়গা দিয়ে ফেলেছে… এটা কি কোনো আয়োজনের মাধ্যমে হয়েছে? না, বরং তিহামের লেখা সেই প্রথম সুশোভন বার্তাতেই আটকে পড়েছিল মিশমির মন। তবে যাইহোক, জীবনে প্রথমবারের মতো খানিকটা অভিনয় করে হলেও তো বন্ধুদের হাসাতে পেরেছে মিশমি? এতেই আনন্দ তার। হাসাহাসির তালেই উপস্থিত হতে থাকে বাসের যাত্রীরা। উপস্থিত হয় আরাভরা সককেই। আরাভ এসেই আগে নীলাশার দিকে উঁকি দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

“ উঠল না ও? ”

গাঢ় নিদ্রামগ্ন নীলাশা কি আর সেই খেয়াল রাখে যে, কেউ তার জন্য এতটা অবহিত? আরাভের প্রশ্নে লজ্জায় রক্তকমল রূপে দেখা গেল মিশমিকে। সে মাথা নত করে নিজ আসনে চলে যেতেই সাইফকে দাঁত কেলিয়ে বলতে শোনা গেল,

“ না রে ভাই। তোর ‘ও’ তো উঠল না। ”

সাইফের রসিকতাপূর্ণ কথায় সবাই হৈহৈ করে উঠল। আরাভ অপ্রস্তুত হলেও বুঝতে দিল না কাউকে। সে পাল্টা প্রশ্ন করল,

“ তোরা টম এণ্ড জেরি যে উঠলি না… পরে কি বাস তোদের খাওয়া-দাওয়ার জন্য ভিআইপি সার্ভিস দিবে? ”

নিশান বলল, “ এরা তো প্রতিজ্ঞা করে নিছে যে, আজকে পৃথিবী বীথিপৃ হয়ে গেলেও সীট থুয়ে উঠবে না। ”

উত্তরে আরাভ হেসে তাদের দুজনের দিকে দুটো খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দিল। তার নমস্য কাজে উপকৃত হলেও সানাম বেশ নাটকীয় স্বভাবে বলল,

“ বুঝলেন সাইফ ভাই, জলে-জঙ্গলে যেখানেই যাবেন বন্ধু আর বন্ধুর প্রিয়তমাকে নিয়ে যাবেন। এতে লাভ কী বলেন তো? এইযে ধরেন আমাদের নীলু খায় নাই দেখে আরাভ ভাই খাবার আনছে তার জন্য। আর নীলুর সাথে আমরাও না-খেয়ে আছি দেখে বিষয়টা খারাপ দেখায় না? তাই আমরাও না চাহিতে খাদ্য পেয়ে গেলাম। এর জন্যই কাছের মানুষের প্রেমিক-প্রেমিকাদের এতো ভালো লাগে। আহা্… সোনার ডিম পাড়া হাঁসের বাচ্চাগুলা আমার! ”

সানামের কথা ও বলার ভঙ্গিমা নিয়ে হাসাহাসি হলো ঠিকি তবে আরাভ হাসল না একটুও। সে ফোনে চোখ রেখে নিজেকে স্বাভাবিক প্রমাণ করতেই ব্যস্ত যেন কিছুই হয়নি! তবে সাইফ জবাব দিল,

“ বাহ্ সানাম! এখন দেখি তোমার মাথাটা ছেদ হয়ে ফুরফুর করে জ্ঞানগুল বেরিয়ে আসছে। ঘটনা কী বলো তো? ইদানীং ভালো মানের ঘাস খাচ্ছো না-কি? ”

সানাম নাক সিঁটকে বলল,

“ ধুর মিয়া! কেন যে এই আবাল কোথাকারের সাথে কথা বলতে গেছিলাম। ”

“ আমি তো ঢাকার। তুমি যেন কোথাকার? উমমম… হ্যাঁ, জাতীয় চিরিয়াখানার। তোমার মনে নাই সেখানে গিয়ে যে তোমাকে লতা-পাতা খাওয়ালাম আর তোমার সাথে সেলফি তুলে আসলাম? আমার কিন্তু হেব্বি মনে আছে! ”

সানাম বিরক্তিতে শ্রুতিকটু একটি শব্দ উচ্চারণ করতেই রিশান ধমকে উঠল তাকে,

“ ঠোঁটপালিশ! বাসের মধ্যে তোর সুন্দর ঠোঁট দুইটা না চালাইলে কি ভালো লাগতাছে না? মানুষরে জানাইতে চাস যে, তুই মূর্খ মানুষের মতো গালাইতে পারিস? ”

সানামও উল্টো ধমক দিল তাকে। অতঃপর তিক্ত গলায় সাইফকে বলল,

“ আমাকে আমার সীটটা দিয়ে দিলেই কিন্তু এতো ঝামেলা হয় না। আপদ একটা! আমার আর এক মুহূর্তও আপনাকে সহ্য করতে ইচ্ছা করতাছে না। ”

“ আর তোমারে যেন আমার চুম্মা দিতে ইচ্ছা করছে? যাও, ফুটো এখান থেকে। এই সীট তুমি একটুও পাবা না। ”

“ ছিঃ! আপনি তো দেখি মুখ দিয়েই ইভটিজিং শুরু করে দিছেন। ওই খচ্চর ব্যাটা, মানুষের কেলানি খাওয়াবো আপনারে? ”

সাইফ একবার চোখ পাকিয়ে তাকাল। অতঃপর কানে হ্যাডফোন লাগিয়ে বলল,

“ দেশে মশা-মাছি বেড়ে গেছে। বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে সরকারের দৃষ্টিতে আনার জন্য তোমার নাম-ধাম দিয়ে একটা পোস্ট দেওয়া লাগবে। তাহলে তোমাকে খুঁজে পেতে সুবিধাই হবে সরকারের। ”

এই কথা শুনে সানাম আবারও কনুই দিয়ে আঘাত করল সাইফকে। ফিসফিসিয়ে করতে থাকা ঝগড়াটার মেয়াদ বোধহয় বৃদ্ধিই পাচ্ছে ক্রমশ! সেই সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকল রাতের গভীরতাও। বাসের যাত্রীদের মাঝে বেশিরভাগ সদস্যই ঘুমন্ত। ঘুমন্ত মিশমি ও সায়ানও। মিশমি আর সায়ানের মাঝে দৈনন্দিন জীবনের নানান বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছিল অনেক। কিন্তু তিহামের ফোন আসার পর সায়ান খুব একটা কথা বলেনি মিশমির সাথে। এই নৈঃশব্দ্য বাসটিতে সায়ান স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিল মিশমিকে বলা তিহামের কথাটা,

“ তোমরা চার-চারটা মেয়ে অথচ কেউই কারো সাথে বসো নাই? সায়ান ভাইয়ের সাথে বসার কী প্রয়োজন ছিল মিশমি? আমার এইসব একদম পছন্দ না। ”

মিশমি হয়তো তখন বুঝতে পারেনি যে, সায়ানের কর্ণকুহরে কথাটি পৌঁছেছে। মেয়েটা নানান ছলাকলা করে কথা ঘুরিয়ে নিলেও সায়ান মানতে পারেনি ব্যাপারটা। তবুও ঠাই বসে ছিল শুধু বন্ধুদের উপর ভরসা রেখে। কিন্তু বন্ধুরা কি আদৌ কোনো উপায় খুঁজেছে মিশমিকে মানিয়ে নেওয়ার? জানে না সায়ান। সে তার ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীরটা মিশিয়ে দিল আসনের সাথে। মিশমিকে পাওয়ার আগেই যে এভাবে হারিয়ে ফেলতে হবে তা মেনে নেওয়া খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে সায়ানের কাছে। অবশ্য নিজের জন্য একটা সান্ত্বনামূলক বাণীও খুঁজে নিয়েছে সে,

“ পেয়ে হারানোর কষ্টের থেকে না পাওয়ার কষ্ট হয় ভীষণ হালকা, নরম তুলতুলে। এই তুলতুলে কষ্টকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া একজন যুবকের কাছে কিছুই না। ”

বুক চিড়ে বেদনার ধূসর ধোঁয়া হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসে। সায়ান হাসল। মাথা ঘুরিয়ে পাশের ঘুমন্ত পরীটির দিকে তাকিয়েই সকল যন্ত্রণা ভুলে বসল নিমিষেই। মনের বিস্ময় উন্মুক্ত করল সে, এই সরল মেয়েটার পক্ষেই হয়তো তিহামের মতো একটা ছেলেকে পছন্দ করা স্বাভাবিক ছিল। হয়তো এই মায়াবীর মায়ায় জড়িয়ে তিহাম-ও নিজেকে শুধরে নিতে পারবে একদিন! কথাটা ভেবে সায়ান আবারও হাসল। অত্যন্ত নিভৃতে এই গহীন আঁধারেও ঘুমন্ত মিশমির একখানা ছবি তুলে রাখল মুঠোফোনের এক গোপন কোণে। কিন্তু ভাবেনি মায়াময় মুখশ্রীর জন্য ঠোঁটে থাকা হাসিটা পুনরায় মিলিয়ে যাবে। মিশমি যখন ঘুমের বশেই সায়ানের বা’কাঁধে মাথা রাখল তখন সায়ানের ব্যাখ্যাতীত অনুভূতিগুলো গাঢ় থেকেও প্রচণ্ড গাঢ়তর হতে লাগল। উথাল-পাতাল তরঙ্গ সৃষ্টি হলো তার বক্ষস্থলে। সেই মুহূর্তে সায়ানের মনে হলো সে শূন্যে ভাসছে, তার সুঠাম দেহখানা আত্মাশূন্য হয়ে পড়েছে। সেই সময় ঘুমন্ত মিশমিকে এলোমেলো বুলি আওড়াতে শোনা গেল,

“ আমি তোমাকে ভালোবাসি তিহাম। ”

এই কথা শোনা মাত্রই সায়ানের অনুভূতি অতরল হয়ে এলো। শূন্যে ভাসমান দেহখানা আবার যেন প্রাণ ফিরে পেল! বুঝতে পেল বাস্তবতা। তবে ভীষণ জেদে টগবগিয়ে ওঠা অভিমানী অনুভূতিগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারল না সে। বুকের তোলপাড় নিয়েই ঘুমন্ত মিশমির উদ্দেশ্যে অভিমান উন্মুক্ত করল সে,

“ আমার কাঁধে মাথা রেখে তুমি অন্য কাউকে চাইছো, মিশমি? ”

ঘুমন্ত মিশমি শোনে না সেই অভিমানের, সেই অভিযোগের হৃদয় শীতলকারক কথা। তবুও সায়ান বলেছে মিশমিকে। জাগ্রত মিশমিকে থোড়িই-না বলতে পারবে! সায়ান এখনো বিশ্বাস করে এই নরম কষ্টকে গিলে ফেলা তার কাছে কোনো ব্যাপার-ই না। তবুও যেন দু’চোখ জলে টলমল করে ওঠে। সহ্য হয় না আর! ছেলেরা আবার কাঁদে না-কি? সে মিশমির হেলানো মাথাটা আলতো হাতে সামলে নিয়ে পিছনের দিকে তাকায়। পিহু এখনো ফিসফিসিয়ে কথা বলে চলেছে আদ্রাফের সাথে। সে পিহুকে কাছে ডাকে। অতঃপর মিশমির মাথাটা পিহুর কাঁধে ছেড়েই সে চলে যায় পিহুর সীটে। বন্ধুরা যা ইচ্ছা তাই বলে সামাল দিক কিন্তু তার আর একটুকুও ধৈর্য্য নেই সেই ব্যথা সহ্য করার। সেই ব্যথা যে অত্যন্ত নিষ্ঠুর!

বাসের সহসা ব্রেক কসায় হুমড়ি খেয়ে জেগে উঠল নীলাশা। ক্ষীণ আলোয় পরিপূর্ণ বাসের সকলকেই ঘুমন্ত রূপে আবিষ্কার করল সে। সত্যিই কি সবাইকে? না, সে বিভিন্নভাবে আরাভকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিল যে, সে ঘুমিয়ে আছে না-কি না। নীলাশার মনে হলো আরাভও গভীর নিদ্রায় মগ্ন। চুপিচুপি আরাভের কোল থেকে ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে নিদ্রামগ্ন পুরুষটিকে আরেকটু আরামে নিদ্রা যাপন করার সুযোগ করে দিল সে। মসৃণ স্পর্শে আরাভের অমসৃণ ঝাঁকড়া চুলগুলোয় ছুঁয়ে দিল অকৃত্রিম আদর। চুপিসারে প্রশ্নও করল নীলাশা,

“ কবে ভালোবাসবেন আমায়? ”

আরাভের উত্তর আসলো না। তবুও আনমনে হেসে গেল নীলাশা। এই হাসিতে অনেক তৃষ্ণা, অনেক আকাঙ্ক্ষা ও আছে অনেক অপেক্ষা। কিন্তু আরাভ কি তা বোঝে? নীলাশারা মনে হয় না। ঘুমকাতুরে নীলাশা এপাশ-ওপাশ তাকাতে তাকাতেই ফের ঘুমিয়ে পড়ল আবার। কিন্তু সেই ঘুমন্ত নীলাশা কি বুঝতে পারল যে, এক জোড়া বিনিদ্র পুরুষালি হাত অভিমানিনীর কোল থেকে ব্যাগপত্রগুলো নিজের কাছে নিয়ে অভিমানিনীকে আরামে ঘুমোবার সুযোগ করে দিল?

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here