তারকারাজি- (২৩ বর্ধিতাংশ)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
সমুদ্রজলের জোয়ার-ভাটায় পরিবর্তন এলো প্রদোষকালে। খরখরে, উষ্কখুষ্ক মৃদুমন্দ হাওয়ায় উড়ন্ত বালি মেখে যাচ্ছে সৈকতবিলাসী জীবদের গায়ে। জাঁকজমকপূর্ণ সন্ধ্যায় সৈকতের এক বালুকাময় স্থানে আগুন জ্বালিয়ে, তার চারপাশ ঘিরে বসে আছে আরাভরা সকলেই। নিগূঢ় কারণবশত নীলাশাদের আসতে দেরি হওয়ায় নিশান-রিশানদেরও হোটেলে থাকতে হয়েছে। এসে পড়বে খুব শীঘ্রই। তাই সেই নিয়ে কোনো চিন্তা নেই বাকিদের। সুদৃশ্য কণ্ঠমণির ঝাঁকড়া চুলো শ্যামবর্ণের পুরুষটি গিটারে টুংটাং শব্দ তুলে বিনা কারণে। উত্তাল কল্লোলের সাথে নিমিষেই ছন্দ বনে যায় সেই গিটারের আওয়াজ। কিন্তু কোনো কিছুতেই যেন আরাভের মনোযোগ থাকছে না। বন্ধুদের তালে-তালে শুধু হ্যাঁ-হু করেই স্বাভাবিক থাকার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে সে। তবে আরাভের এই আচরণ কি বন্ধুদের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে? জমজমাট আড্ডাখানায় অমনোযোগী আরাভকে লক্ষ্য করে সাইফ সোজা প্রশ্ন করল,
“ আরাভ, তুই নীলের সাথে ওইরকম করিস ক্যান? ”
গিটারের সুরশলাকায় চালানো আরাভের অঙ্গুলিসমূহ টাল হারালো সাইফের প্রশ্নে। তার স্পষ্ট উত্তর,
“ আমি কই কী করি? ”
শিহাব ধমকালো,“ ওই ব্যাটা! ভাব দেখানির মানুষ পাস নাই আর? ভালোবাসিস না নীলাশারে? ”
আরাভ উত্তর না দিয়ে গিটার বাজানোতে মনোনিবেশ করার চেষ্টা চালালো। না, হচ্ছে না কিছুতেই। সুর যেন বেসুরের থেকেও বিশ্রী রূপ ধারণ করছে। এই দেখে সায়ান বলল,
“ ওইটা এখন বাজবে না আর। হুদাই ভাব না দেখায়ে উত্তর দে। ”
আরাভ তখনও কিছু বলল না। তবে কয়েক মুহূর্ত ধরে এই-সেই করতে করতেই আরাভ নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে বলল,
“ আরে ভাই থামবি তোরা? আর কেস খাওয়াইস না আমারে। আমার দ্বারা ওগুলা কিছু… অন্তত নীলার সাথে হচ্ছে না। ”
তনয়ের তিক্ত প্রশ্ন, “ ক্যান, তোমার কি তোমার নীলা বাদেও রাসলীলার সঙ্গী আছে? ”
আরাভ একই সাথে তাচ্ছিল্যপূর্ণ ও নঞর্থক উত্তর দিল। অতঃপর আরও বলল,
“ ভালোবাসলে ভালো রাখতেও জানতে হয়। আর আমি মনে করি না আমি কোনোদিনও ওকে ভালো রাখতে পারব। ”
সাইফের বিস্ময়াভিভূত প্রশ্ন,
“ ক্যান, তুই মানুষ খারাপ? তোর বাপ-ভাইয়ের কি কম আছে? না-কি তুই সারাজীবন এমন বেকার ছাত্র থাকবি? একটা চান্স নিলে কী হয়? বিয়েই তো করবি। তোরে খায়ে-দায়ে ছাড়তে কইছে কেউ? ”
“ আজ পর্যন্ত তো কম মেয়ে পটাইলি না। আমাকে দেখছিস কখনো কোনো মেয়ের পিছনে চিপকায় থাকতে? ”
সাইফ নঞর্থক উত্তর দিল। স্কুল জীবনে প্রথম একটি মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিল আরাভ। বড় ভাই অভ্র ব্যাপারটা জেনে গেলে আরাভ নিজেই আর এগোতে দেয়নি সম্পর্কটি। অতঃপর সেই আরাভ এখন অবধি কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ায়নি বলেই জানে তারা। তার না-কি সব মেয়েকে একই রকম লাগে। তাই কারো প্রতিই ভালোবাসা জন্মায় না তার। কিন্তু নীলাশার ক্ষেত্রে যখন ব্যাপারটা আপনা-আপনিই ঘটে গেল তখন আরাভের পিছিয়ে পড়ার মতো যুক্তি খুঁজে পেল না কেউই। অতঃপর আরাভ-ই প্রকাশ করল,
“ দেখ, পড়াশোনা শেষ করলে আমি যে ভালো কিছু করতে পারব তা আমি নিজেও মানি। কিন্তু যতই ভালো কিছু করি না-কেন আমার আর ওর লেভেল কখনোই সমান হবে না। তোরা তো জানিস, ও টুঁ শব্দ করার আগেই আঙ্কেল ওর চাওয়া জিনিস এনে দেয়। যদি ধরেও নিই যে, ও আমার থেকে তেমন কিছুই চাইলো না। বাট আমার কি কিছু দেওয়া লাগবে না আমার ওয়াইফকে? ও আর পাঁচটা রিচ ফ্যামিলির মেয়েদের মতো বড় হয় নাই। ওর বাবার কাছে একশটা পেয়ে যদি আমার কাছে নিরানব্বইটাও না পায় তাহলে ওর কেমন লাগবে? ওর কথা বাদ দিলাম। আমার কি কোনো আত্মসম্মান নাই যে, বিয়ের পর ওর ফ্যামিলির মতোও ওকে সুখে রাখতে পারব না আমি? ”
তরান্বিত রোহান বলে উঠল,
“ ভাই, ভাই, ভাই, কুল ডাউন। আমরা এখনো মাস্টার্স এক্সামটাও দিই নাই আর তুই সেখানে বিয়ের আলাপ করতাছোস? বিয়ে এখনো অনেক দেরি আছে। ওইটা নিয়ে এখনি চিন্তা করতাছিস কেন? ”
“ তো তোর কী মনেহয় আমি নীলা বা অন্য কোনো মেয়ের সাথে জাস্ট রিলেশনশিপে যাব? তা করার হলে এতোদিন করতাম না? ”
সাহেল বলল, “ এতো ভাবলে কি জীবন চলে? শোন, বিয়ের পর বউ-জামাইরে অনেক কিছু মেনে চলা লাগে। এই যে এখন বসে আড্ডা দিতাছিস কিন্তু বিয়ের পর দেখবি তুই তোর গিটার ধরারও সময় পাবি না। ওগুলা অনেক ব্যাপার! নীলরে-ও বিয়ের পর বোঝা লাগবে যে, ওর জামাই যত ইনকাম করবে ততোর মধ্যেই বরং আরও কম কিছুই ওর এক্সপেক্ট করা লাগবে। ও বিদেশের সংস্কৃতি মেনে আসছে হিসেবে ওর বয়স মাত্র বিশ। ওর বাপ তো আর ওরে এখনি বিয়ে দিবে না? সো বড় হতে দে। নিজেই বুঝতে পারবে সব কিছু। নাহলে ওকেই দেখ আর মিশমিকেই দেখ। বলা যায়, একটা মানুষের স্বভাব কেমন হবে সেইটার অর্ধেকটাই ডিপেন্ড করবে তার ফ্যামিলিতে তাকে ট্রিট করার পদ্ধতির উপর। এখানে নীলের কোনো দোষ নাই। ওরে টাইম দে একটু। যতই পাঁচ বছর ধরে দেশে আসুক না-কেন, ও থাকছে তো বিদেশেই। এতো সবকিছু একসাথে বুঝে নেওয়া সম্ভব না-কি? এখন আদিকালের দাদা-নানাদের মতো ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে বর্তমানটা দেখ। পরে সায়ানের মতো হারাইলে কিন্তু বুঝবি ঠেলা কারে কয়! ”
সাহেলের কথা শেষ হতেই তনয় তাড়া দিল,
“ হইছে এখন থাম তোরা৷ ওরা আসতাছে। ”
সবাই স্বাভাবিক প্রস্তুতি নিয়েই বালুকাবৎ স্থান ঘেঁষে যাওয়া দূরবর্তী সেই রাস্তার দিকে তাকাল। নীলাশা, সানাম ও মিশমি বাদে বাকি তিনজনকে দেখতে পাচ্ছে তারা। নিশানরা সেখানে পৌঁছে যোগদান করতেই সাইফ প্রশ্ন করল,
“ বাকি তিনজন কই? ”
রিশানের উত্তর, “ নীল আর সানাম আসতাছে। কী জানি জঙ্গল-ফঙ্গলের ছবি তুলতাছে সানাম। আর মিশমি আসবে কি-না জানি না। তিহাম ভাই আসছে একটু আগে। ”
তিহামের নামটা শুনে সকলের মাঝেই চাপা বিরক্তি কাজ করল। এই ছেলে এখানে কেন? প্রশ্নটা মনে জাগতেই শিহাব বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল,
“ ও আসলো ক্যামনে? ও না ওর মামার বাসাত্ গেছিল? ”
নিশান উত্তর দিল, “ হু, মামার বাসা চট্টগ্রামেই। এর জন্যেই আসতে পারছে। শুনলাম আমাদের সাথে থেকে যাবে আজকে। কালকে সন্ধ্যার বাসে সরাসরি ঢাকায় চলে যাবে। ”
সায়ানের চোয়াল শক্ত করে রাগ নিবারণের দৃশ্যটি নজর এড়িয়ে যায়নি বন্ধুদের। ছেলেটা যতই নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চায় এই ধরণী যেন ততোটাই উঠেপড়ে লাগে তাকে অস্বাভাবিক করতে। আরাভ সায়ানের কাঁধে হাত রেখে ইশারা করে যেন সে একটু শান্ত হয়। অতঃপর জিজ্ঞাসা করে,
“ মিশমিরা কই? ”
রিশান উত্তর দিল, “ হোটেলেই আছে দুইজন। ”
কথাটা বলতে না বলতে মিশমি এসে উপস্থিত হলো তাদের মাঝে। সাথে থাকল সানাম ও নীলাশা। মিশমির চোখ জোড়া ছলছল করছে। বিড়ালাক্ষীর চকচকে চোখে পানিটা মন্দ লাগছে না। কিন্তু চোখের পরিধি জুড়ে লাল বর্ণের ছিটা হঠাৎই সায়ানের মনে চুম্বকশলাকা বিঁধিয়ে দিল যেন। সায়ান প্রশ্ন করে বসল,
“ কী হইছে মিশমি? ”
মিশমি চমকে উঠে পাশে বসে থাকা সায়ানের দিকে তাকাল। যেন সে জানত এমন ভীতিকর প্রশ্নটা তাকে করা হবেই! মিশমি কথা ঘুরিয়ে হাসার চেষ্টা করল। নাধর্মী মাথা নেড়ে চুপচাপ নিচের দিকে তাকাতেই ক্ষীপ্ত সানামের কণ্ঠ শোনা গেল,
“ কী আর হবে? খাল কেটে কুমির আনছে। বুঝলাম না, তোমার জামাই না খুব বড়-বড় ডায়ালগ দেয় যে, সে তোমার জন্য মরতেও পারবে? অথচ তোর একটা থাপ্পড় খেয়েই… ”
কথা সম্পূর্ণ করার আগেই মিশমি ও নীলাশা দুজন দু’পাশ থেকে চোখ রাঙিয়ে তাকাল সানামের দিকে। সানাম সরল মনে হেসে নিজের ক্যামেরার পর্দায় ছবি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু বলা কথা কি আর ফিরিয়ে নেওয়া যায়? বিষয়টা সবারই বোঝা হয়ে গেছে যে, নম্র মিশমি কোনো এক কারণে নিজের প্রেমিক তিহামের গায়ে হাত তুলেছে। কিন্তু কেন? বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেলেও সায়ানরা কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করল না এই নিয়ে। ওদিকে বাকি তিনজন খোঁচাচ্ছে তো খোঁচাচ্ছেই! নীলাশা ওদের পরে বলবে বলতেই সানাম দূরে কোথাও একটা ইশারা করে মিশমিকে বলল,
“ ওই যে তোর অতি ভালোবাসার তিহাম দাঁড়িয়ে আছে। গিয়ে কথা বলে মিটমাট করে নে না-হলে ওরে বল সমুদ্রে ডুবে মরতে। দেখি কেমন তোর জন্য জান দিতে পারে সে! ”
মিশমি নড়ল না একটুকুও। লজ্জায় মরমর অবস্থা হলো তার। বন্ধুদের অতিরিক্ত নাটকীয়তা তার একদমই পছন্দ নয়। এতগুলো বয়োজ্যেষ্ঠ ছেলের সামনে কেউ এভাবে কথা বলে? সে চুপচাপ বসে থাকতে থাকতেই হঠাৎ সায়ানকে বলতে শোনা গেল,
“ দেখ মিশমি, তিহামের সাথে কিছু হয়ে থাকলে তা মিটিয়ে নাও নয়তো ভুলে যাও সবকিছুই। তুমি তিহামের সাথে কথা বললেই এখানে এমন কেউ নাই যে, তোমাকে নিয়ে কিছু বলবে। কিন্তু হ্যাঁ, তোমার এই মনখারাপের জন্য আমরা মনও খারাপ করতে পারছি না আবার আনন্দও করতে পারছি না। কী করবা করো জলদি। আমাদের আরও কিছুটা সময় এখানে কাটানোর আছে। ”
মিশমি ছলছলে চোখেই সায়ানের দিকে তাকাল। কী ধার তার কণ্ঠে! যেন সে সত্যিই মিশমির মনমরা হয়ে বসে থাকায় খুব বিরক্ত। কিন্তু আদৌ কি সায়ান বিরক্ত? একজন পুরুষের নিজ কষ্টে কম্পিত বক্ষটার হাহাকার ক’জন অনুভব করতে পারে? সে তো ভুলতে চাচ্ছে মিশমিকে। তবুও কেন এই ধরণী সহায় হচ্ছে না? সায়ান ভেবেছিল মিশমি এতোটাই লাজুক স্বভাবের যে, সে পিছনে ফেলে আসা ঘটনা ভুলে গিয়ে তাদের সাথে আনন্দ করতেই ব্যস্ত হবে। কিন্তু না, মিশমি দাঁড়াতে দাঁড়াতেই বলে উঠল,
“ আমি একটু আসছি। ”
কেউ কোনো প্রশ্ন করল না। শুধু প্রশ্ন আসল সায়ানের বুকেই যে, কেন মিশমি তার হলো না? সায়ান তাকাল না মিশমির দিকে। কিন্তু মিশমি তো মিশমিই…! হোঁচট খেয়ে সায়ানের জ্যাকেটের আস্তিন খামচে ধরেই পড়ে গেল আগুনের খুব কাছাকাছি। সেই কী ভয়ানক কাণ্ড! সায়ান এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে হুড়মুড়িয়ে সেখান থেকে সরিয়ে আনল মিশমিকে। তখন মিশমির হাত স্বল্পতার জন্য সায়ানের বক্ষস্থল স্পর্শ করলেও সেই কম্পন বুঝতে অসুবিধা হয়নি মিশমির। বান্ধবীর হুটহাট করে পড়ে যাওয়ার ভয়াবহ ফলাফলকে কেন্দ্র করে বন্ধুগণ বকাঝকা করলেও ভীত রমণীর চোখ জোড়া তখন তাম্রাভ পুরুষের ভীত চোখেমুখেই জায়গা করে নিয়েছে। মিশমি সায়ানের হাত ছেড়ে দূরে সরে বসল ঝটপট। ছিঃ! সে কতটা লজ্জাবহ কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল যে, সব-সময় তার হাত ধরে সামলানোর মানুষটাকে আজ তাকে ঝাপটে ধরেই সামলাতে হলো? মিশমি চোখ নত করে নিল। মিনমিনে গলায় বলল, “ কতটুকু ধন্যবাদ দিলে খুশি হবেন? ”
সায়ান ক্ষীণ হাসল এ-কথা শুনে, “ তুমি যতটা দিলে নিজে শান্তি পাবে! ”
মিশমি তাকাল। উপস্থিত প্রত্যেকটি মানুষকে অবাক করে দিয়ে এ-ই বলে তিহামের কাছে চলে গেল যে,
“ যে বুকটা আমার জন্য ভয়ে কাঁপছিল সেই এক বুক ধন্যবাদ জানালাম আপনাকে, সায়ান ভাই। ”
#চলবে ইন শা আল্লাহ!