তারকারাজি- (২৪,২৫)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
পর্ব:২৪
সানন্দ আড্ডাখানায় এতক্ষণ ধরে সায়ান মিইয়ে থাকলেও এবার এই মিইয়ে থাকার প্রতিযোগিতায় অংশ নিল নীলাশা। নিষ্প্রভ আকাশের কৃষ্ণাভ ছায়া আজ বহুদিন পর খুবই অন্তরঙ্গভাবে গ্রাস করে ফেলেছে নীলাশার অপ্রখর মন।
মিশমির অনুপস্থিতির কয়েক মিনিট বাদেই আরাভের আত্মীয় আবির ও আবিরা এসেছিল তাদের সাথে দেখা করতে। আবির এই এলাকার ছেলে হওয়ায় ওর মাধ্যমেই না-কি ভ্রমণে সুবিধা ভোগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরাভরা। কাছাকাছি কোথাও দাওয়াতে এসেছিল বলেই আজ ছোট বোন আবিরাকে আরাভের সাথে দেখা করাতে নিয়ে এসছিল আবির ছেলেটি। ঘটনাটা মোটেও এমন নয় যে, আরাভ ও আবিরার সুসম্পর্ক দেখে নীলাশা ঈর্ষান্বিত। বরং তখনও নীলাশার মনে ছিল বিশদ প্রশান্তি। কিন্তু তারা চলে যাবার পর নীলাশা খুব ভালো করে খেয়াল করল যে, আরাভ তাদের মধ্যেই সানাম ও পিহুর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করলেও তার সাথে এখনও অবধি টুঁ শব্দটাও করেনি। এ-ই লক্ষ্য করে তীব্র ভর্ৎসনায় দুমড়েমুচড়ে গেল কন্যার কুসুমিত কোমল মন। অন্তর্মুখী নীলাশা যার জন্য নিজের বৈশিষ্ট্যে অনিয়মের রঙ লাগাল, আজ সে-ই নীলাশার দিকে নিয়মের ক্ষারিকা বর্ণ লাগিয়ে দিচ্ছে? নীলাশার মনে হলো এই বয়সে এসেও সে সবে প্রেমে পড়া অবুঝ কিশোরীদের মতো বড্ড বেশিই হ্যাংলামো করে ফেলেছে। না, এই পরোক্ষ অপমান মেয়েটির কাম্য নয়। নীলাশা ধীর স্বভাবেই উঠে দাঁড়াল সেখান থেকে। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তে তাকে উঠতে দেখে রিশান প্রশ্ন করল,
“ কই যাস? ”
নীলাশা শান্ত কণ্ঠেই উত্তর দিল তাকে,
“ আসছি একটু… এখান থেকেই। ”
এতক্ষণের মাঝে এই প্রথম আরাভ নীলাশার উদ্দেশ্যে কিছু বলল,
“ আমি যাব তোমার সাথে? ”
“ না ভাইয়া, আপনাকে আসতে হবে না। চলে আসব এক্ষুনি। ”
বলেই সে হাঁটতে লাগল সায়রের ধারের দিকে। নীলাশার কথা শুনে সকলের চোখের আয়তন যেন বৃদ্ধিই পেল বেশ! এতগুলো দিন… এতোটা মাস বাদে নীলাশা বোধহয় এই প্রথম আরাভকে ভাইয়া বলে সম্বোধন করল। কী নিদারুণ অভিমানটাই-না প্রকাশ করল সে! আরাভ নিশ্চল মস্তিষ্কে তাকিয়ে আছে নীলাশার যাত্রা পথে। যেন সে মোটেও আশা করেনি এটা! সেই সময় সাহেল দাঁতে দাঁত চেপে আরাভকে বলল,
“ দেখছোস, দেখছোস, দেখছোস? আগেই বলছিলাম পরে পস্তানো লাগবে তোর। এখন সায়ানের মতো ঠেলা সামলা। ”
রিশানের গম্ভীর প্রশ্ন, “ সায়ান ভাইয়ের মতো মানে? ”
আরাভদের একটু বিচলিতই দেখালো এই প্রশ্নে। যথা সম্ভব নিজেদের স্বাভাবিক করে নিয়ে দারুণ কৌশলে কথা ঘুরিয়ে নিল তারা। ওদিকে অভিমানিনীর নগ্ন পা দুটো ছুঁয়েছে হিমশীতল জলধির জল। শৈত্যের ছোঁয়া কাবু করতে পারে না নীলাশার দেহকে। কাবু করতে পারে না নীলাশার তপ্ত অন্তরটাকে। বাহ্যিক শীতলতা কি অন্তরের আকুলতাকে হিম করতে পারে? না, কখনোই না। এই নিষ্ঠুরতম অপমান নীলাশা কখনোই ভুলবে না। নিজের মনকে কঠিক চুক্তিতে আবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল সে। মনে মনে হাজার খানিক মিথ্যে প্রতিজ্ঞা করে নিতেই জলধিতে কারো হাঁটার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুনতে পেল নীলাশা। কেউ সমীপে এসে দাঁড়াল না? ঘুরে তাকানোর আগেই শোনা গেল এক আগন্তুকের পরিচিত কণ্ঠ,
“ রেগে আছো? ”
নীলাশা তাকাল। খানিকটা বিস্ময় নিয়েই বলল,
“ সায়ান ভাইয়া আপনি? ”
“ অনেকক্ষণ ধরেই কথা বলতে চাচ্ছিলাম। ফাঁকাই পেলাম না তোমাকে! যদি রেগে না থাকো তো একটা প্রশ্ন করতাম। ”
নীলাশা হাসল। জানালো সে রেগে নেই। অতঃপর সায়ানকে বলতে শোনা গেল,
“ তখন মিথ্যা কথা বলছিলা কেন? ”
বিষয়টি বুঝলেও নীলাশা সহজেই স্বীকার করল না তার মিথ্যা বলা সম্পর্কে। নয়তো মিশমির মতো মেয়েটি একাই এক স্বল্প পরিচিত ছেলের সাথে আলাদাভাবে বসে গেল আর তা নিয়ে বন্ধুমহলে তদন্ত চলবে না, তা কী-করে হয়? নীলাশার বাকি সবাইকে সামলে নেওয়ার দায়িত্বে সানামও ছিল অংশীদার। তাদের বিষয়টি বুঝতে মোটেও অসুবিধে হয়নি। তারা দুজন এ-ও ঠিক করেছিল যে, নিজেরা যা বোঝার বুঝেছে। বাকিদের বুঝতে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাই এই-সেই করে অবুঝ সাজার নাটকীয়তায় সায়ানের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কের প্রভাব পড়তেই নীলাশা বাধ্য হয়ে উত্তর দিল,
“ ইচ্ছে হয়েছিল তাই। কেন, মানুষের অনুভূতিকে সম্মান জানানো কি অন্যায়? ”
সায়ান না-বোঝার ভান করল,
“ অনুভূতি? কার আর কীসের? ”
নীলাশা হাসল, “ ডোন্ট ইউ লাভ মিশমি? এখন নিশ্চয়ই চোরের উপর বাটপারি করবেন না? ”
সায়ান বুঝল যে, এখানে কথা পেঁচিয়ে লাভ নেই কোনো। নীলাশা বুঝে গিয়েছে সবটা। কিন্তু কীভাবে? প্রশ্নটা করতেই নীলাশা দায়সারাভাবে উত্তর দিল,
“ ছাড়ুন, ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে। ”
বলতেই সায়ান খেয়াল করল নীলাশাকে সমুদ্রের গভীরতায় তাকাতে যেখানে জট পাকিয়েছে ধূসর অন্ধকার। সেও সেদিকে তাকিয়ে উদাস কণ্ঠে বলল,
“ যে ভালোবাসতে জানে সে অন্যের ভালোবাসা ধরতেও জানে। ”
নীলাশা প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। বরং সে বলল,
“ আমার কী মনে হয় জানেন? মিশ্শি তিহামের মতো ক্যারেকটারলেস একটা ছেলের কিছুতেই হবে না। মিশ্শি নিখুঁত মনের মানুষ আর সেখানে তিহাম…! নো, দিস ইজ নট অ্যাকসেপ্ট্যাবল অ্যাট অল। আমি তো ওদের ব্রেকআপ করিয়েই ছাড়ব! দেখি ওরা ওদের রিলেশনশিপ ক্যামনে টিকিয়ে রাখে। ”
সায়ান হাসল নীলাশার শেষোক্ত কথায়। বাস্তবতা এতো সহজ না-কি? সম্পর্ক গড়া বা ভাঙার ক্ষমতা কি আদৌ আমাদের হাতে আছে? তবে এই নিয়ে কথা না বাড়িয়ে, সায়ান নীলাশাকে হাতের ইশারায় ডেকে বলল,
“ চলে আসো এখান থেকে। আঙ্কেল একা থাকতে নিষেধ করছিল না? তোমাকে সাথে করে না নিয়ে গেলে আবারও ঘুরে আসতে হবে আমাকে। ”
সায়ান পা বাড়ালো সমুদ্রের বিপরীতে। তাকে চলে যেতে দেখে নীলাশা কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখালো না। কিন্তু সায়ান শেষ কথাটা কেন বলল? নীলাশার কেন যেন খুব খটকা লাগল বিষয়টি নিয়ে। তাই সে পিছু ডেকে বলল,
“ সায়ান ভাই, আপনি শুধুই আমার সাথে কথা বলতে এসেছিলেন তো? ”
নীলাশার প্রশ্নে সায়ানের পা জোড়া থামলেও সে পিছে ফিরে তাকাল না। বরং বিশদ হেসে বলল,
“ না, তোমাকে নিয়ে যেতে পাঠানো হলো বলেই এক ঢিলে দুই পাখি মারতে আসলাম। ”
মুহূর্তেই নীলাশার শরীরটা শিরশির করে উঠল। সৈকতের খ্যাপাটে, সর্বনাশী হাওয়া কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে দিয়ে গেল এক কাঙ্ক্ষিত নাম। কিন্তু সত্যিই কি সে? নিশ্চিত হতে যেই-না সে সায়ানকে সর্বদেশীয় ভাষায় প্রশ্ন করল তখন সায়ান আবারও পাড়ে যেতে যেতেই অত্যন্ত হাস্যোজ্জ্বল মুখে, গলা উঁচিয়ে উত্তর দিল,
“ নামটা বলে দিলে কিন্তু রাগ কমে যাবে! আরেকটু না-হয় রেগে থাকো তোমার গায়কবাবুর উপর? ”
নীলাশা উত্তর দিতে পারল না। মুহূর্তেই কান, মুখ গরম হয়ে এলো তার। বক্ষস্থল ভেদ করে হৃদপিণ্ড ছুঁলো সেই পুরাতন সুড়সুড়িপূর্ণ লাজ। বোনতুল্য মেয়েটিকে আকারে-ইঙ্গিতে এভাবে লজ্জায় ফেলে গেল সায়ান! নীলাশার হঠাৎই মিশমির মতো মনে হলো যে, বয়োজ্যেষ্ঠ ভাইদের সামনে মরণ ঘটলেও হৃদয়ঘটিত অনুভূতি প্রকাশ করা ভয়াবহ অপরাধ! এরা মোটেও সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে ছাড়ে না।
সমুদ্রের উত্তাল কল্লোলের সাথে মিশমির মিনমিনিয়ে গাওয়া গান যে স্নিগ্ধশীতল মূর্ছনা তৈরি করেছে তা নিঃসন্দেহে উপভোগ্য ও পছন্দনীয়। জলধির খুব কাছাকাছি অনুষ্ণ, সিক্ত বালুকাবৎ ভূমিতে বসে অত্যন্ত অপ্রিয়ভাবে তিহামের কাঁধে মাথা রেখেছে মিশমি। না, রেখেছে বললে ভুল হবে৷ তিহাম জোর-জবরদস্তি নিজের কাঁধে তার মাথাটা রাখিয়ে, দু’হাতে জড়িয়ে রেখেছে মিশমিকে। যেন মিশমিকে হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা রয়েছে তার! প্রেক্ষাপটে পরিলক্ষিত, অস্বস্তিতে ভুক্তভোগী মিশমিও এক কোমল অনুভূতি খুঁজে নিতে চাচ্ছে তিহামের কাঁধে মাথা রেখে। চোখের পাতা বদ্ধ। কিন্তু ঠোঁটে লেগে আছে অনুভূতিপ্রবণ কলি,
‘ আমার একলা আকাশ থমকে গেছে
রাতের স্রোতে ভেসে/
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
আমার দিনগুলো সব রং চিনেছে
তোমার কাছে এসে/
শুধু তোমায় ভালোবেসে। ’
“ সত্যিই কি তাই? ” সাবলীলভাবেই প্রশ্ন ছুঁড়ল তিহাম। মিশমি থামল। ওষ্ঠদ্বয়ে মাখলো গাঢ় লাজুক হাসি। সে মাথা উঠিয়ে ওই দূরে তাকায় যেখানে বন্ধুরা সবাই আড্ডা জমিয়েছে। একটু কি দেখা যায় তাদের? মিশমি নঞর্থক উত্তরটা জানার পরও অহেতুক চেষ্টা চালালো। উঠেও দাঁড়াল নিমিষেই। আর যা-ই হোক, সে তিহামের প্রশ্নের উত্তর দিবে না কোনোমতেই। কথা ঘুরিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে মিশমি তার দৃষ্টি নত করে তিহামকে বলল,
“ অনেকক্ষণ তো হলো। এইবার আমাদের যাওয়া উচিত। তুমিও তো ভাইয়াদের সাথে দেখা করোনি। ব্যাপারটা খারাপ দেখায় না? চলো যাই। ”
মিশমি উল্টো দিকে ফিরে যাবার জন্য উদ্যত হতেই তিহাম মিশমির বা’হাতটা ধরে নিল। সযত্নে নিজের বুকের সাথে আগলে ধরে বলল,
“ মিশমি, আই’ম সরি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করার জন্য। ”
একবার না, দু’বার না… তিহাম বহুবার এই একই কথা নানান আয়োজন-বিয়োজনে মিশমির কাছে প্রদর্শন করেছে। সামান্য ধমক দিয়ে যদি সে এতটাই অনুতপ্ত হয় তাহলে মিশমির কেমন অনুভব করা উচিত তার গায়ে হাত তুলে? ভীষণ অপরাধবোধে বিদ্ধ অন্তরটা হুহু করে কেঁপে উঠল রমণীর। হোটেলে অবস্থানরত সময়ে তিহামের আচমকা এতোটা গভীর স্পর্শ কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি মিশমি। তাদের সম্পর্কটা তো এমনিতেও সুন্দর ছিল। তবে প্রয়োজন কী নতুন করে রং লাগানোর? মিশমি তখন তীব্র প্রতিবাদ দেখিয়ে তিহামের গালে আঘাত করেছিল ঠিকি কিন্তু জিততে পারেনি নিজের অনুভূতির সাথে লড়াই করে। সে ভয় পেয়েছিল খুব। ভালোবাসার মানুষ হারালে না-কি সুখে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তিহামকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে অন্তরটা কেঁপে উঠেছিল মিশমির। চোখে এসেছিল জল। তাই-না সে ছুটে এসেছে তিহামের ভুল ক্ষমা করে দিতে! এইসকল কিছু মনে পড়তেই মিশমির হাসিটা মলিন হলো খুব৷ সে অস্বস্তিতে নিজের হাতটি ছাড়িয়ে দৃষ্টি নত করেই বলল,
“ যা হইছে ভুলে যাও। আমি তোমাকে আগেও বলছি আমরা স্কুল পড়ুয়া কোনো স্টুডেন্ট না। ভুল করার বয়সটা আমাদের পেড়িয়ে গেছে তিহাম৷ আমি চাইনা আমাদের ভালো সম্পর্কটা ভুল সম্পর্ক বনে যাক। চলে এসো। ”
মিশমি চলে গেল। তিহাম আটকায়নি একবারও। সৈকতের অবাধ হাওয়া যেখানে শীতলতায় ভরিয়ে তুলে সৈকতবিলাসীদের, সেখানে তিহামের মনে সৃষ্টি করল নিষিদ্ধ এক উষ্ণতা। সে আলতো করে নিজের গালে হাত বুলিয়ে চলল অবিচলে। তখন যে অঙ্গনা এখানটায় আঘাত করেছিল, একটু আগে সেই অঙ্গনা-ই এসে সেখানে তার ক্রন্দনে কম্পিত ঠোঁট জোড়া ছুঁয়ে গিয়েছে। সেই বিস্ময়কর দৃশ্যটা তিহামের চোখে এখনো জ্বলজ্বল করে ভাসছে। মিশমির আকস্মিক কাজে সে অবাক হয়েছিল খুব। কিন্তু রেগে থাকতে পারেনি তার উপর। মিশমি মেয়েটা যে তাকে নিঃশর্ত ভালোবেসে ফেলেছে সেইটা ভেবেই খুশিতে আটখানা হতে দেখা গেল তিহামকে। নৈসর্গিক আনন্দে মাতাল হলো তার মন। অন্তরটা কেঁপে কেঁপে উন্মাদের মতো সেই রমণীর নামই পুনঃপাঠ করতে লাগল, যে রমণী স্বভাবসুলভ ছুটে গেল তার বিপরীতে। কিন্তু তারপর…?
#চলবে ইন শা আল্লাহ!
তারকারাজি- (২৫)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
সেদিনকার মতো আজও বৃষ্টিতে গা ভাসিয়েছিল প্রকৃতি। ভ্রমণের দ্বিতীয় সকালটার আয়োজনকে এভাবে মাটিতে পিষিয়ে ফেলার অপরাধে বৃষ্টিকন্যা কম বকা শোনেনি! তবুও যখন সকাল আটটায় রোদের স্বর্ণাভে বিশ্বব্রহ্মাভকে সবুজে, সতেজে ঝলমলিয়ে উঠতে দেখা গেল তখন আর ইচ্ছে হলো না চার দেয়ালে বন্দী থাকার আয়োজনেই সীমাবদ্ধ থাকতে। তড়িঘড়ি করে আরাভের আত্মীয় আবিরকে দুটো চান্দের গাড়ির খোঁজ দিতে বলেই হন্তদন্ত পায়ে ছুটে চলা হলো সকালের খাবারের উদ্দেশ্যে। খাওয়া-দাওয়া হলো। ফাঁকা পেয়ে সকলেই ইচ্ছা প্রকাশ করল হিমছড়ি জলপ্রপাত থেকে ঘুরে আসার। সেখান থেকেই গাড়ি ভাড়া করে ছুটে চলা হলো বাহারছড়ার দিকে। আবির খোঁজ দিয়েছে, বিকেলের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে সেখানকার শান্ত এলাকায় না গেলেই নয়! ট্রলারে করে স্বল্প সময়ের জন্য সমুদ্র শাসনের সিদ্ধান্ত নিল সকলেই। ওটা আবিরদের এলাকা। তাই কম টাকায় লাভবান হওয়ার সুযোগটাও আছে তাদের হাতে। কিন্তু সেখানে পৌঁছেই যে সানাম এভাবে সকলের আবেগ, উত্তেজনাকে বৃদ্ধি করে দিবে তা বাকিদের ধারণার বাহিরেই ছিল বৈ কী! বাহারছড়া ইউনিয়নে প্রবেশ করার পর, দলে আবিরকে যোগ করার জন্য যখন গাড়ি থামানো হলো তখন সানামকে বলতে শোনা গেল,
“ আবির ভাই? আপনি তো এই এলাকার লোক। একটা উপকার করবেন? ”
আবির অপ্রস্তুত হলো সানামের প্রশ্নে। না জানি কীভাবে উপকার করার আবদার জুড়ে বসবে এই অচেনা মেয়েটি! সে হেসে উত্তর দিল,
“ পারলে অবশ্যই করার চেষ্টা করব। ”
সানাম বিরক্তি প্রকাশক ভঙ্গিমায় বলল,
“ এই ট্রলারে অনেক ঘুরছি। লাইফে একটু অ্যাডভেঞ্চার প্রয়োজন! আমি বিশাল ট্রলারে উঠতে চাই আবির ভাই। ওইযে যেই ট্রলারে করে জেলেরা মাছ ধরে? ওই ট্রলারে। ”
সানাম একটু থামল। অতঃপর আবারও বলল,
“ বাকি সবাই ঘুরে আসুক। আমি একাই একশ ওই ট্রলারে যাওয়ার জন্য। আপনি আমাকে একটু ব্যবস্থা করে দেন না? ”
আবির আরেকটু অপ্রস্তুত হলো এবার। মেয়েটা যে অন্যরকম তা গতকাল সন্ধ্যায় কথা হতেই বুঝেছিল। কিন্তু এমন একটা আবদার সে করে বসবে তা আবির ভাবেনি। এখন এই আয়োজন কীভাবে করবে সে? ভাবতে ভাবতেই নীলাশা মুখ খুললো,
“ আবির ভাইয়া, আই অলসো ওয়ান্ট টু গো উইদ সানাম। ট্রিপে যদি অ্যাডভেঞ্চার-ই না থাকে তবে বন্ধুদের সাথে এসে কী লাভ? সেই তো আমার ড্যাডের সাথে ট্রিপে আসার মতোই হলো ব্যাপারটা! এখানে যাবা না, ওটা করবা, সেইটা ধরবা না… এগুলো ফ্যামিলি ট্রিপেই মানতে ভালো লাগে, আই থিঙ্ক! ”
নীলাশার কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে সকলেই মুচকি হাসল। অতঃপর একে-একে সকলেই তাল মিলালো যে, শুধু ট্রলার না। তারা মাছ ধরার ট্রলারে করে ঘুরবে আজ। এই শুনে মিশমি মুখ কাঁচুমাচু করে দু’হাতে নিজের পেট চেপে ধরল। সে বলল,
“ আমার না পেট ব্যথা করতেছে খুব। আমি না-হয় না গিয়ে সমুদ্রের পাড়েই বসে থাকব। ”
এই শুনে পিহুও সুর দিল,
“ আমারও পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা, পা ব্যথা। আর এই হাবলি একা একা বসে থাকতে পারবে না-কি? আমি আর ও থাকি। তোরা গিয়ে ঘুরে আয়। ”
রিশান সেই ব্যথিত সুরে তরল হলো না একটুও। বরং ধমকে উঠে বলল,
“ যেই শুনছোস মাছ ধরার ট্রলার আর অমনিই তোদের যত ব্যথা শুরু হয়ে গেল, তাই না? তোদের দুইটারে ট্রলারের দুই মাথায় বেঁধে দিমু। তারপর ঝুলে ঝুলে যাবি তোরা। ”
মিশমিরা বেঁকে বসল। তারা দু’জন কিছুতেই যাবে না। নীলাশা জানে না দুটো ট্রলারে আকার-আকৃতিগত পার্থক্য ছাড়া আরো কোনো ভিন্নতা রয়েছে কি-না। সে তো এই প্রথম বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রকে স্পর্শ করার সুযোগ পেল! তবুও জীবনে কিছু সুন্দর মুহূর্ত আঁটকে রাখতে সানামের সাথে তাল মিলিয়েছে সে। আর তা-ই করা হলো অবশ্য! কেউ রাজি থাকুক বা না-থাকুক, দল বেঁধে ওঠা হলো দুটো মাছ ধরার বিশাল-বিশাল নৌকায়।
আট হাজার টাকা ব্যয়ে কিছু সমুদ্রবিলাসের অক্ষয় গল্প তৈরি করতে ছুটন্ত যুবক-যুবতীর মনে ছিল প্রশান্তি, তৃষ্ণা ও একই সাথে প্রচণ্ড ভয়। শহরতলীকে পিছনে ফেলে জেলেদের বসবাসরত এই সুনসান দ্বীপেও রয়েছে অদেখা এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। রাস্তার পূবে হরিদ্বর্ণ চাদরে ঘেরা বিশাল পাহাড় আর পশ্চিমের ঝাউগাছের বাগান পেড়িয়ে সুজলা জলধি। প্রেক্ষাপটের এই প্রান্তে এসে বৃষ্টিকন্যাকে গালি-গালাজ করা বন্ধুদল দুটোও স্বীকার করে নিল যে, প্রকৃতির দীর্ঘ বৃষ্টিস্নান ও তারপর রোদের আলোয় তার ঝলমলিয়ে ওঠাটা ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। যাইহোক, জেলেদের বিশাল নৌকায় অবস্থান করা যায় তেরো জনেরও বেশি। কিন্তু তারা তেরো জন এবং তিহাম ও আবিরকে নিয়ে মোট পনেরো জন যদি একটি নৌকায় ওঠে তো নৌকা পরিচালনা করবে কে? হিসাব মিলতেই একটি নৌকায় অবস্থান করল নীলাশা, মিশমি, রিশান, তিহাম, সায়ান, আরাভ, আবির, সাইফ ও চারজন জেলেভাই। আর অন্য একটিতে অবস্থান করল নিশান, সানাম ও পিহুসহ বাকিরা সবাই। নৌকা যখন ধার ছাড়িয়ে গভীরে পৌঁছাতে চাইলো তখনও মিশমি ছিল একদম স্বাভাবিক। নীলাশার পাশে বসে উন্মাদী হয়েছিল নৌকার দোলায় ও সমুদ্রের কলরবে। কিন্তু নৌকা গভীরে যাওয়ার সাথে সাথে যে সমুদ্রও তার উন্মাদনা দেখাবে তা মিশমি বা নীলাশা কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। তরঙ্গের দাপটে এই বিশাল নৌকাটিও যেন উল্টে পড়বে এমন অবস্থা! নীলাশা খানিকটা ভয় পেলেও মিশমিকে দেখা গেল ভয়ে চোখের পানি ফেলতে। এক জেলে ভাই তাদের আঞ্চলিক ভাষায় বললেন যে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সাধারণ নৌযান আর তাদের নৌযানে আকাশ-পাতাল তফাত থাকলেও এই নৌকা ডুববে না। সমুদ্র অভিযানে পারদর্শীরা ব্যতীত এইসব নৌকায় ছাড়া হাত-পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তো দূর, কেউ বসেও থাকতে পারবে না। কিন্তু মিশমির কান্না থামল না ওনার কথা শুনে। তিহাম তার দুই হাতে মিশমিকে আগলে রাখলেও ভয় কমলো না মেয়েটির। আশেপাশের মানুষগুলো দেখল তিহামের নির্লজ্জ সব কাণ্ড। মেয়েটি শুধু তার শার্ট খামচে ধরলেও তিহাম এতোগুলা মানুষের সামনে গোটা মিশমিকেই ধরে রেখেছে। তাদের দুজনকে উদ্দেশ্য করেই সাইফ রিশানকে বলল,
“ কী রে, তোরা তিহামের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে জানিস না? ওরে লুইচ্চা বললেও তো ভুল হবে। পাক্কা মা*বাজ! মিশমিরে তো একটু বুঝাইতে পারিস? ”
রিশান অপ্রস্তুত হলো সাইফের কথা শুনে। কাল-ই তারা দুই ভাই ও পিহু তিহামের সম্পর্কে জেনেছে। এমনকি হোটেলে মিশমির সাথে তিহামের আচরণ সম্পর্কেও জেনেছে তারা। কিন্তু এখানে তারা কী করবে যেখানে মিশমিই প্রশ্রয় দিয়েছে? রিশান উত্তর দিতে চাইলে নীলাশা-ই সেখানে এসে উপস্থিত হয়ে দারুণ সতর্কতার সাথে বলল,
“ ওকে কী বুঝিয়ে বলব, সাইফ ভাই? কালকে তো এই নিয়ে কম কথা বলিনি আমরা পাঁচজন। জানেন কালকে কী হয়েছে? ”
সাইফ তীব্র আগ্রহ নিয়ে নীলাশার দিকে তাকাতেই নীলাশা উন্মুক্ত করল কালকের ঘটনা। মিশমি স্বভাবতই একটা কথা দীর্ঘ সময় চেপে রাখতে পারে না। হোটেলের ঘটনাটি বান্ধবী দুজনকে বললেও নীলাশারা দুজন সেই নিয়ে তেমন কিছুই বলেনি মিশমিকে। উদ্দেশ্য ছিল সবাই মিলে বুঝিয়ে বলবে তাকে। কারণ সানাম তিহামের সম্পর্কে আগেই জেনে গিয়েছিল সবটা। শুধু জানার অপেক্ষায় ছিল যে, এ-ই সেই তিহাম কি-না! অতঃপর সবটা পরিষ্কার হতেই যখন হোটেলে ফিরে এসে মিশমিকে নিয়ে ছোটমোটো একটা বৈঠক-ই বসিয়ে ফেলল তারা ছয়জন তখন সানাম বলেছিল,
“ মিশমি, শুনলি তো ওই কী-রকম লুইচ্চা মার্কা পোলা? তুই ভাবতে পারিস? কোনো ভয়-ডর বলতে কিছুই নাই ওর। পুরা ভার্সিটিতে শুধুই ওর দুর্নাম আর দুর্নাম। ”
মিশমি তখন হেসে বলেছিল, “ আমি সবকিছুই আগের থেকে জানি সানাম। তোদের হয়তো মানুষ ঘুরিয়ে-পেচিয়ে, তেল-মশলা মাখিয়ে বলছে কথাগুলো। এটা ঠিক ওর দুর্নাম পুরা ভার্সিটিতেই। কিন্তু এক বছরে ওর কোনো ব্যাড রেকর্ড আছে বলে শুনছিস? ”
সানামসহ সবাই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছিল তখন। কারো থেকে উত্তর না পেয়ে মিশমি বলেছিল,
“ দেখ, আমরা ভার্সিটিতে পড়ি মানেই আমরা যে খুব বড় হয়ে গেছি আসলে তা না। শারীরিক বয়স বাড়লেও কি সকলের মনস্তাত্ত্বিক বয়স বাড়ে? যদি তাই হতো তো তুই কখনোই সাইফ ভাইদের নামে ডাইরেক্ট উপাচার্যের কাছে অভিযোগ করতিস না। আর… ”
“ তুই কোন কালের কথা টেনে আনতেছিস মিশা? ওইটা আর এইটা এক হলো? ”
সানাম তেতে উঠে কথাটা বললেও মিশমি কোনো ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায়নি তখন। বরং সে নরম স্বরেই বলেছিল,
“ ও তখন ভুল করেছিল ঠিকি তার মানে এই না যে, ও এখনো ভুল কিছু করছে। তিহাম অনুতপ্ত দোস্ত! ও এখন কোনো খারাপ কিছুর সাথেই জড়িত না। আর আমি তো সবটাই জানি, বল? জেনে-বুঝে কি সম্পর্কে জড়াইনি? ”
নিশান কঠোর প্রশ্ন করেছিল, “ এইসব তোকে কে জানাইছে মিশু? আর জানার পরও তুই মেনে নিলি ক্যামনে যেখানে এতো ভালো-ভালো ছেলেরেও তুই রিজেক্ট করে আসছিস? ”
মিশমি উত্তর দিয়েছিল যে, তাকে তিহাম-ই সবটা জানিয়েছে। তিহাম যদি ভালো না হতো তাহলে কি নিজের সকল দোষ স্বীকার করে মিশমিকে বলতো যে, মিশমি চাইলে তাকেও প্রত্যাখ্যান করতে পারে? মিশমির এরূপ বক্তব্য শুনে সানাম সেই বৈঠক থেকে উঠে গিয়ে ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়েছিল। আর এ-ই বলে উঠেছিল,
“ দোস্ত, তোরা বাদ দে। ওই বদজাত পোলা ওর ব্রেইনওয়াশ করে ফেলছে অলরেডি। আমাদের বলেও কোনো লাভ হবে না। ”
তবুও বাকি চারজন বুঝিয়েছিল অনেক আর মিশমি বিনা আক্রোশে তাদেরকে বুঝিয়ে গিয়েছিল যে, তিহাম নিজের ভুল শুধরে নিয়েছে। মানুষটা এখন মিশমিকেই তার পাশে চায় যাকে সে নিঃশর্তে ভালোবেসে যেতে পারবে এবং যার থেকে নিঃশর্তে ভালোবাসা পেতে পারবে। মিশমি জানে তার বন্ধুরা তাকে খুব ভালোবাসে দেখেই তিহাম আর তার সম্পর্ক নিয়ে চিন্তিত। তাইতো মিশমি না রেগে এই ভালোবাসাটা উপভোগ করে গিয়েছিল গতকাল। সে এটাও বলেছিল যে, সে তার ভালোবাসায় বিশ্বাসী। তিহাম যদি এখনও খারাপ হয় তো সে নিজের ভালোবাসা দিয়েই তিহামকে শুধরে দিবে। কিন্তু এইসব শুনে সাইফ মোটেও সন্তুষ্ট নয়। সে বলল,
“ মিশমি একটু বেশিই ইমোশনাল! আরেহ আবুল, ওই নিজের নামে সবকিছু স্বীকার না করলে তো মিশমি এমনিই জেনে যেত যে, তিহাম একটা ধান্দাবাজ। তারপরও কি মিশমি রিলেশনশিপে যেত? ব্যাটা আস্ত আবুলরেই বশ করার জন্য পাইছে। ”
এই কথা শুনে তারা দুজন-ই সহমত প্রদর্শন করল।ফাঁকা পেয়ে রিশান একবার সায়ানের দিকে তাকাল। আরাভ আর আবির নিজেদের আলোচনায় মগ্ন থাকলেও সায়ান চুপচাপ দাঁড়িয়ে নানান বাহানায় তিহাম-মিশমিকে দেখছে। এই দেখে রিশান বিড়বিড়িয়ে বলে উঠল,
“ সায়ান ভাই মিশমিরে খুব লাইক করে, তাই না সাইফ ভাই? ”
সাইফ চমকে উঠল। সায়ান বলেছিল যে, নীলাশা সব বুঝে গিয়েছে। কিন্তু বিষয়টা যে তারা এতো দ্রুতই জেনে যাবে তা বুঝতে পারেনি। সাইফ আগের থেকেও সতর্কতা অবলম্বন করে বলল,
“ তোরা জানিস? ”
রিশানের ব্যথিত উত্তর, “ আসল মানুষটা বাদে সবাই-ই সবটা জানি, সাইফ ভাই ! ”
#চলবে ইন শা আল্লাহ!