তারকারাজি- (২৬)

0
536

তারকারাজি- (২৬)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী

নৌকার দুলুনির সাথে সাথে নীলাশার মাথাটাও কেমন ঘুরতে শুরু করেছে। নৌকা ভ্রমণের শুরুতেই জেলে ভাইয়েরা বলে দিয়েছিলেন যে, নৌকার দুলুনিতে মাথা ঘোরা ও গা গুলিয়ে বমি আসার লক্ষ্যণ দেখা দিতে পারে। নীলাশা ভাবেনি যে, মিশমির মতো একটুতেই বমি করে ফেলা মেয়েটাকে পিছে ফেলে এখন তার-ই এমন করুণ দশা হবে। ঠিক মতো বসে থাকতে না পেরে সে রিশানকে বিষয়টি জানাতেই রিশানকে পাল্টা প্রশ্ন করতে শোনা গেল,

“ কত মাস চলে দোস্ত? ”

কথাটা শেষ হতেই রিশান আর সাইফকে দেখা গেল খিলখিলিয়ে হাসতে। তাদের হাসি দেখে নীলাশা নিজের বিরক্তটুকুও প্রকাশ করার মতো গায়ের জোর পেল না। আরাভটা সেই তখন থেকে আবিরের সাথে বকবক করে যাচ্ছে। আচ্ছা, তার মনে কি এই অভিমানিনীর জন্য একটুও জায়গা নেই? নীলাশা তুমুল আক্রোশে ফেটে পড়ল সেই মুহূর্তে। তার খিটখিটে মুখভঙ্গি দেখে, নিজেদের হাসি-ঠাট্টা থামিয়ে, নীলাশাকে প্রশ্ন করল সাইফ,

“ নীল, তোমার কী খুব বেশি খারাপ লাগতাছে বোন? মিশমিও তো কেঁদেকেটে অস্থির! ব্যাক-ই বোধহয় করা লাগবে আমাদের। ”

নীলাশা খেয়াল করল এই মুহূর্তে তার শ্বাস নিতেও খুব কষ্ট হচ্ছে। বমিটা এইবার হয়েই যাবে মনেহয়! সে সাইফকে নঞর্থক হাতের ইশারা করে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। একবার মিশমিদের দেখে নিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বলল,

“ সাইফ ভাই, শুনেন। আমি ওই দিকে চলে যেতেই আপনি তিহাম ভাইকে আমার কাছে পাঠাবেন। পাঠাবেন মানে যেভাবেই হোক তিহাম ভাইকেই পাঠাবেন। বলবেন যে, আমার শরীর খারাপ লাগছে আর তাই ও যেন আমার কাছে যায় একটু যাতে আমি পড়ে-টড়ে না যাই। আর অন্য কেউ আসতে চাইলে আপনারা দু’জন আসতে দিয়েন না। বুঝছেন কী করতে বলছি? আমি গেলাম। ”

তড়বড় করে কথাটা বলেই নীলাশা ছুটে গেল নৌকার অপর প্রান্তের কাছাকাছি যেখানে তিহাম ও মিশমি বাদে, নিজেদের অবস্থান অনুযায়ী অন্য কারো পৌঁছাতে একটু অসুবিধা-ই হবে! মিশমি ভীতু প্রকৃতির মানুষ। এই নৌকাযাত্রায় একলা হেঁটে বান্ধবীর কাছে পৌঁছাতে পারবে না সে। বলতে গেলে, নীলাশা বিষয়টি তীক্ষ্ণভাবে ভেবে নিলেও রিশান আর সাইফ কিছু না বুঝেই তিহামকে তাড়া দিল অসুস্থ নীলাশার কাছে যাওয়ার জন্য। যেহেতু মিশমিকে তিহাম ধরে রেখেছিল তাই সায়ান-ই পিছন থেকে যেতে লাগল নীলাশার কাছে। নীলাশার কথা মতো সাইফ যখন আঁটকে দিল সায়ানকে এ-ই ইশারা করে যে, নীলাশা তাকে যেতে মানা করেছে তখন সায়ান অনেকটা এগিয়ে গিয়েও পিছিয়ে এলো এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে। সে দাঁড়িয়ে থাকার সুবিধার্থে নৌকায় বাঁধা রশিটা ধরে, সাইফকে ইশারা করল যে, কী হচ্ছে এসব?

সাইফও অদ্ভুত মুখভঙ্গি প্রকাশ করে মাথা নাড়ল তখন। অর্থ,

“ আমিও বুঝতে পারছি না। ”

এদিকে নীলাশার পরিকল্পনা মতো মিশমিকে বসিয়ে রেখে তিহাম-ই এগিয়ে গিয়েছে নীলাশার কাছে। বলা বাহুল্য, আরাভও যেতে চেয়েছিল তার কাছে। তার ক্ষেত্রেও সাইফের একই ইশারা ছিল যে, তিহাম ব্যতীত সেখানে অন্যকারো যাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে নীলাশা। অতঃপর যা ঘটল তা দেখা এবং অনুভব করার জন্য নীলাশা ব্যতীত সবাই-ই ছিল ভীষণ অপ্রস্তুত। নীলাশা বমি করে তিহামের সারা গা জবজবে করে ফেলেছে। তার এহেন ইচ্ছাকৃত কর্মে আশ্চর্যান্বিত হলো সকলেই। আসলে ঘটনাটা কী?
ওদিকে বমি করে শ্রান্ত নীলাশা তিহামের হাত ধরেই বসে পড়ল নৌকার বিশেষ আসনের এক কোণে। কুলকুচি করে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা নিয়েই বলল,

“ ইশ তিহাম ভাই! আপনাকে কে আসতে বলছিল এখানে? দেখলেন তো কী অবস্থা হলো এখন? ”

মুখটা আরেকটু কাঁচুমাচু করে অনুতপ্ত হওয়ার চেষ্টা করল নীলাশা। কিছু বিস্মিত চোখ যে তার-ই উপর ঘোরাফেরা করছে তা আর বুঝতে বাকি নেই এই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন মেয়েটির। অতঃপর তাকে আবারও দেখা গেল অত্যন্ত শোচনীয় ভঙ্গিমায় বলতে,

“ আমি সত্যিই বুঝতে পারি নাই তিহাম ভাইয়া। আই’ম সো সো সো সরি। প্লিজ কিছু মনে করবেন না। ”

তিহাম সাংঘাতিক রেগে গিয়েছে। নীলাশা অসুস্থ হয়ে যে তার অবস্থা এমন করুণ করে ফেলবে তা জানলে আর এ-মুখো হতো না তিহাম। সারা গায়ে বিশ্রী গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে মেয়েটা। কেমন জবজব করছে পুরো বুক। তবুও সে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে এনে নীলাশার উদ্দেশ্যে বলল,

“ ইট’স ওকে, নীল। সাইফ ভাই তো ঠিকি বলছিল। আমি না আসলে তো তুমি বমি করতে গিয়েই উল্টে পড়ে যেতে। তুমি নিজে ঠিক আছো এটাই অনেক। ”

নিজের নিখুঁত অভিনয়টা কাজে লেগেছে ভাবতেই নীলাশার মনে এলো বহুত কাঙ্ক্ষিত এক প্রশান্তি। তবুও সেই নিখুঁত অভিনয়ের শালীনতা বজায় রাখতেই দুর্বল শরীর নিয়ে রিশানদের কাছে ফিরতে লাগল নীলাশা। তিহাম স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছে যে, সে এই নোংরা শরীর নিয়ে আর ওদিকে যাবে না। আর যাইহোক, নীলাশা যে কাণ্ড ঘটিয়েছে তা এই মুহূর্তে যতই আয়োজন করে পরিষ্কার করা হোক না-কেন কেউই তিহামের কাছাকাছি আসতে চাইবে না গায়ে লেপ্টে থাকা দুর্গন্ধে। তিহাম পারে না নিজের গা থেকে মাথাটা আলাদা করে নিতে! ছিঃ, কী বিশ্রী অবস্থা তার!

যাওয়ার পথে নীলাশা মিশমির পাশে এসে দাঁড়াল। মেয়েটা তৃষ্ণার্ত চোখে প্রিয় মানুষটির করুণ দশা দেখছে। ইশ! কী অঘটনটাই-না ঘটে গেল। বিষয়টা যে নিতান্তই কাকতালীয় তা ভেবে বান্ধবীকেও কিছু বলতে পারছে না মিশমি। এটা বুঝতে পেরে নীলাশার মনেও কোথাও না-কোথাও অনুশোচনার সত্য আঁচড় লাগল। তিহামকে দূরে রাখতে গিয়ে যে নিজের বান্ধবীটাকেই এমন কষ্ট দিয়ে ফেলবে তা আগে বুঝতে পারেনি নীলাশা। তবে তার এই অনুশোচনা এতটাও তীব্র হলো না যতটা তীব্র হলে এমন একটা কাজ করেও মনে শান্তি অনুভব করতো সে। বরং সে মিশমিকে নিস্তেজ স্বরে বলল,

“ দোস্ত, আমি ইচ্ছা করে এমন সিচুয়েশন ক্রিয়েট করিনি। তিহাম ভাইয়াকে একটু বুঝিয়ে বলিস তুই, প্লিজ। ওই সময় আমি… ”

মিশমি নীলাশার গালে হাত রাখল। অত্যন্ত আদুরে স্বরে বলল,

“ কাউকে কিচ্ছু বোঝাতে হবে না রে ইয়ার! তুই তো সেই কখন থেকেই বলতেছিলিস যে, তোর খারাপ লাগছে। তুই একটু এখানে বোস তো! হাঁটতেও তো পারতেছিস না। ”

নীলাশা হাসল। শরীরটা আসলেই ঢুলছে তার। তবুও এক নিগূঢ় কারণে মিশমিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রিশানদের দিকে এগিয়ে গেল সে। সাথে গেল সায়ানও। তারপর নীলাশা অত্যন্ত ক্ষীণ আওয়াজে বলল,

“ সাইফ ভাই? সানাম ঠিকি বলে। আপনি একটা অকর্মা! এতো লেইট করে কেন তিহাম ভাইয়াকে পাঠালেন? ডোন্ট ইউ রিয়েলি আন্ডারস্ট্যান্ড হাও হার্ড ইট ওয়াজ টু হোল্ড… ”

রিশান বলতে দিল না বাকিটুকু। সে বিশ্রী মুখশ্রী প্রকাশ করে বলল,

“ ইয়াক! তাই তুই তোর মুখে… ছিঃ! আর তিহাম ভাই? ওর উপ্রে বমি করলি ক্যান? বোইন, এখন বলিস না বমিও তুই ইচ্ছা করে হওয়াইছিস। ”

নীলাশা হাসি চেপে ফিসফিসিয়ে বলল,

“ শোন, সঠিক জিনিসের সঠিক ব্যবহার সঠিক জায়গামতো করা উচিত। ওর মিশার সঙ্গে লেপ্টালেপ্টিটা বেড়ে গেছিল। তাই আমার সিকনেসটা একটু কাজে লাগিয়ে খুব সুন্দর একটা জিনিস ওর গায়ে লেপ্টে দিয়ে আসলাম। দেখি এখন ওই কুত্তায় ক্যামনে মিশার সাথে লেপ্টালেপ্টি করে। ”

তার কথা বলার ধরণ দেখে আবির স্বল্প বিস্মিত হলেও বাকি চার যুবকের কান যেন বিশ্বাস করতে চাইছে না যে, এটা তাদের নীলাশা। চুপচাপ অভিমানিনী আবার এতটা দুরন্ত কবে হলো? এই বিশ্বাস করতে না পারার অনিচ্ছাকে প্রকাশ করতেই রিশান সহর্ষে বলে উঠল,

“ আরিব্বাস! বিদেশিনীর মুখে এই দেশের বাংলার টান? তুই তো আমাদের চমকের উপর চমক দেখাচ্ছিস ব্রিটিইশ্শা। ”

নীলাশা হাসল। সাইফ মন্তব্য করল, “ ফাঁটা পোস্টার নিকলা বাটপার! তিহামের উপর কেরামতি করে আসছো… তুমি ভাবছো যে কী করে ফেলছো তুমি? ”

নীলাশা এবারও হাসল। হুটহাট করা পরিকল্পনাগুলো কাজে দেয় বেশি। এর সত্যতা ধরাটাও যে বেশ কঠিন হয় তা নীলাশার জানা। সে সায়ানকে নিজের অবস্থানে ফিরে যেতে বলল যাতে তিহাম কিছু সন্দেহ না করে। হাজার হোক, বমি আসা প্রাকৃতিক হলেও তিহামকে বিপদে ফেলাটা তো ছিল এক প্রকার পরিকল্পিতই! নীলাশা সেখানে দাঁড়িয়েই সাইফ আর রিশানের সাথে চাপা গলায় মশকরা করল কিছুক্ষণ। মাথাটা ঘুরছে এখনও। কিন্তু মন যেন মানেনা মানা আর কোনো! তখন হাসি-ঠাট্টার মাঝেই খুবই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আরাভকে বলতে শোনা গেল,

“ সাইফ, তাহলে স্বীকার করছিস যে, সানামের থেকেও নীলা ডেঞ্জারাস? ”

সাইফ বিনা বাক্য ব্যয়ে কথাটি স্বীকার করে নিলে আরাভের হাসির রেখাটা আরও দীর্ঘ হলো। সেদিন নৌশিন আহমেদ বলেছিলেন যে, ওনার মেয়ে ছিল চঞ্চল ও প্রাণবন্ত। আরাভের মনে প্রশ্নটা সত্যিই জেগেছিল যে, এই অভিমানিনী কেমন চঞ্চল ছিল তখন? হয়তো মিশমির মতো ছিল যে কি-না হঠাৎ একটা দুষ্টুমি করে ফেলে। কিন্তু না, আজ সেই প্রাণবন্ত নীলাশাকে দেখে আরাভ খুবই অবাক হয়েছে। আরাভের মনে হলো যে, যদি সম্ভব হতো তো সেই মুহূর্তগুলো ভিডিও করে, নীলাশার পরিবারকে দেখানোর ব্যবস্থা করতো সে। ইয়াসিন চৌধুরী হয়তো স্বীকার করতে বাধ্য হতেন যে, এটাই তাদের হারিয়ে যাওয়া নীলাশা। সে পুনরায় জেগে উঠেছে এই তারূণ্যপূর্ণ বয়সে। কিন্তু নীলাশা তো নীলাশা-ই! সে সকলকে বিস্ময়ের চরম পর্যায় পৌঁছে দিল এক নিমিষেই। তখন নীলাশা আকস্মিকভাবেই আরাভের গাল টেনে দিয়ে হাসতে হাসতেই বলল,

“ সেইটা বুঝতেও আপনার এতো সময় লাগল আরাভ ভাই? ”

মেয়েটার কথার সাথে-সাথে হাসিতেও কী দারুণ অভিমান! নীলাশার এহেন কর্ম দেখে সকলে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলেও নীলাশা নিজে সরে এসেছিল সেখান থেকে। কয়েক কদম পিছনে একাকী বসে থাকা মিশমিকে সঙ্গ দিতে যে অভিমানিনী ছুটে গেল মুহূর্তেই, সেই অভিমানিনীর গভীর অভিমানের অথৈ নীল সাগরে ডুবুডুবু হলো আরাভের মন। নীলাশার পরিবর্তিত আচরণে হঠাৎই তার বুকটা কেঁপে প্রশ্ন জেগে উঠল,

“ সত্যিই কি আমি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বর্তমান হারিয়ে ফেলছি? দায়িত্ব নেওয়াকে ভয় করে কাউকে অভিমানী সাজতে দিচ্ছি? ”

অতঃপর এক অচেনা কণ্ঠ শুনতে পেল আরাভ, “ হ্যাঁ, দিচ্ছিস। ”

আরাভ খানিকটা চমকে উঠেই নিজের আশেপাশে তাকাল। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ… কোথাও তো কেউ নেই এই কণ্ঠে কথা বলার! কিন্তু সে তো স্পষ্ট শুনতে পেল যে, সে দায়িত্বকে ভয় করে নীলাশাকে অভিমানে ভরিয়ে তুলছে? আরাভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল নীলাশাদের কাছে। নীলাশার শ্রান্ত মাথাটা খুব সুন্দর করে নিজের কাঁধে আগলে রেখেছিল মিশমি। যখন দেখল আরাভ নীলাশার পাশে বসে, উশখুশ করছে কথা বলার জন্য তখনই যেন সুবুদ্ধি উদয় হলো তার। খুব ইচ্ছে হলো এই যুগলকে একাকী ছেড়ে একটু তিহামের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে। ঘুরতে এসেও ছেলেটাকে একা-একা বসে থাকতে হচ্ছে ওই দূরে। তাই সে নীলাশাকে সোজা করে বসিয়ে বলল,

“ তুই একটু বোস। আমি তিহামের কাছ থেকে আসতেছি। ”

নীলাশা বিরক্ত হয়েই সোজা হয়ে বসল। এই সহজ-সরল মিশমির মাথায় যে পরিকল্পনা কাজ করছে তা ধরতে পারল না নীলাশা। বরং সে খিটখিটে স্বভাবে মনে-মনেই বলে উঠল,

“ তোরে কাছে যেতে দেওয়ার হলে আমি মিছামিছি মানুষটার এই দশা করলাম কেন? বাংলায় সরিষা ক্ষেতে ভূতের কথাটা ঠিকি বলে। তুই-ই আসলে ঝামেলা। ”

মিশমিকে দেখা গেল উঠে দাঁড়াতে। সে নৌকার সেই রশিটা ধরেই হাঁটার চেষ্টা করল যার সাহায্যে সায়ান ও সাইফ দাঁড়িয়ে আছে। তিহামের কাছে যেতে হলে সায়ানকে পেড়িয়েই যেতে হবে মিশমির। তাই সায়ানের বুঝতে অসুবিধা হলো না মিশমির গন্তব্যের ঠিকানা। সে সরে দাঁড়িয়ে নম্র স্বরেই বলল,

“ আমি হেল্প করব? ”

খুব সম্ভবত সায়ান ভেবেছিল যে, মিশমি মানা করবে। ঠোঁটের ডান কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুলবে সৌজন্যতার খাতিরে। মিশমি সেভাবে হাসল ঠিকি। কিন্তু সায়ানকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে নিজের হাত বাড়িয়ে দিল সে। সায়ানও দু’হাতে মিশমির দু’হাত ধরে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত হলো। কিন্তু এবার যে উল্টো কিছুই ঘটবে তাদের সাথে তা তারা কীভাবেই-বা জানত? সাগরের ক্ষিপ্ত ঢেউয়ে নৌকা সেদিকে নত হলো যেদিকে সায়ান, মিশমি ও সাইফ দাঁড়িয়ে ছিল। সাইফ আগের থেকেই সন্নিবদ্ধ রশি আঁকড়ে ছিল তদর্থ নিজেকে সামলে নেওয়া কোনো ব্যাপার-ই ছিল না তার কাছে। কিন্তু জেলেদের কথা মতোই ছাড়া হাত-পায়ে একদম ধারে দাঁড়িয়ে থাকা সায়ান উপলব্ধি করল যে, সে জলে পড়ে যাবে। সেই সাথে এটাও উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, আনাড়ি মিশমির-ও তার সাথে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ঘটনাটি ঘটতেই সায়ান প্রবল বেগে মিশমিকে পিছনে সরিয়ে দিয়ে উচ্চরবে বলে উঠল,

“ নীলাশা, মিশমিকে ধরো। ”

ব্যস! আর দেখা মিললো না সায়ানের। জলের কল্লোলে ভয়ানক এক শব্দ হলো তখন। সেই সাথে মিশমির চেঁচানোতে সবার এইটুকু বোঝা হয়ে গেল যে, সায়ান জলে পড়ে গিয়েছে। ছেলেটা সাঁতার জানে না। আর এই অথৈ সমুদ্রে সাঁতার জানলেই-বা কী! ত্রস্ত অন্তরে নৌকার উপরেও উন্মাদনা সৃষ্টি হয়ে গেল। থামানো হলো ইঞ্জিন। খুঁজেও একটা লাইফ জ্যাকেট মিললো না এই দুঃসময়ে। তবুও সায়ানকে নৌকার চাকা ধরে ভাসমান অবস্থায় দেখা গেলে তড়িঘড়ি করে পানিতে নেমে পড়ল জেলেরা। ওপর থেকে উঠতে সাহায্য করল আরাভ, সাইফ, রিশান, তিহাম ও আবির। সায়ানের কাছে এই মরণ যন্ত্রণার ভয়ভীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে হয়তো বোঝা যেত সমুদ্রের কী ভয়াবহ রূপটা দেখে এসেছে সে। কিন্তু না, তাকে ঠিক করে শ্বাস নেওয়ার সময়টুকুও দিল না মিশমি। নৌকায় উঠে বসতে না বসতেই হুড়মুড়িয়ে সায়ানের কাছে ছুটে এলো সেই অঙ্গনা। দূরত্ব রেখে বসলেও সায়ানের দু’গালে হাত রেখে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য মিশমিকে উন্মাদীর মতো কাঁদতে দেখা গেল। সায়ানের হয়তো খেয়াল নেই এদিকটা। সে একটু শ্বাস টেনে বাঁচতে চাচ্ছে আগে। তারপর যখন সবটা অনুভব করতে পারল তখন সে মিশমিকে বলতে শুনল,

“ আপনি আমার জন্য পড়ে গিয়েছিলেন তাই না? আমি আর কখনো আপনার হাত ধরবো না, সায়ান ভাই। ”

সায়ান দেখল সেই ক্রন্দনরত উন্মাদীর অশ্রুসিক্ত মুখশ্রী। কেমন হাউমাউ করে কাঁদছে সে। সায়ান সেই মুখশ্রী অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল। মন দিয়ে… মস্তিষ্ক দিয়ে… নিজ অন্তরের সবটুকু দিয়েই পর্যবেক্ষণ করল বেশ কিছুক্ষণ। মেয়েটা তার জন্য কাঁদছে না-কি? অতঃপর নিশ্চিত হতেই সে অত্যন্ত দুর্বল কণ্ঠে বলল,

“ এতো কাঁদছো কেন? ধাক্কা দিছিলাম দেখে আবারও পড়ে গিয়েছিলে না-কি? ”

মিশমি তার স্বভাবসুলভ নরম সুরেই ধমকে উঠল,

“ আপনি চুপ করবেন? এখনো আপনার মজা করতে ইচ্ছা করতেছে? আমার খুব ভয় করছিল সায়ান ভাই। আই’ম সরি। আমি কখনোই আর আপনার কাছে আসব না। ”

কথাটা বলে মেয়েটি আবারও কাঁদতে লাগল। কিন্তু সায়ানের ঠোঁটে ফুটে উঠল ক্ষীণ হাসি। ভয়ঙ্কর কিন্তু আনন্দদায়ক এই যন্ত্রণাটা পেয়ে সে একটু হলেও হাসল, স্বস্তি পেল। সায়ান বিড়বিড়িয়ে মিশমিকে বলে উঠল,

“ এতো কাছে এসেও বলছো কাছে আসবা না? আমার তো মনে হচ্ছে আমি পড়িনি, তুমিই পড়ে গেছিলা! এইবার আমাকে ছেড়ে উঠে বসো। তিহাম কিন্তু তোমার কাণ্ড দেখে ক্ষেপে যাচ্ছে মিশমি! ”

সায়ানের শেষ কথাটা ভীষণ তীক্ষ্ণভাবে মিশমির মাথায় আঘাত করল। সত্যিই তো! এটা কেমন লজ্জাজনক কাণ্ড ঘটাচ্ছে সে! মিশমি নিজের কান্না থামিয়ে তরান্বিত উঠে দাঁড়াল। খেয়াল করল তিহাম সত্যিই কেমন অদ্ভুতভাবে যেন দেখছিল তাদেরকে। মিশমি আর দেরি না করে তিহামের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বাকি সদস্যরা সায়ানের সাথে কথা বলতে লাগল। এতক্ষণ আরাভের ইশারাতেই তারা চুপ করে দেখছিল মিশমির উন্মাদনা আর সায়ানের ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক স্বস্তিদায়ক হাসি। তাই যখন অন্যদের সুযোগ মিললো তখন সায়ান অত্যন্ত চাপা নিঃস্বনে বলল,

“ নীলি, তোমার আর সানামের জন্য দারুণ সব এডভেঞ্চার পেলাম আমি। সরি, আমি আর তিহাম। ”

নিজের মরণ যন্ত্রণা আর তিহামের উপর নীলাশার অহেতুক অত্যাচারের এই ইঙ্গিতটা বুঝতে কারোরই তেমন অসুবিধে হলো না৷ তারা হেসে উঠল সকলেই। একত্রে কথা বলার মাঝেই সায়ান শুনতে পেল যে, মিশমি রিশানকে ডাকছে। রিশান উঠেও গেল অবশ্য। তখন সকলেই খেয়াল করল, মিশমি তার গলায় পেচানো নরম কাপড়ের স্কার্ফটা রিশানের হাতে দিয়ে বলল,

“ এটা দিয়ে ওনার মাথাটা একটু মুছে দে। ভেজা জামা-কাপড়ে ঠাণ্ডাটা তো লাগবেই। এখন জ্বর না আসলেই হলো! ”

ওর কথা শুনে তিহাম যেন আবারও বিস্ময়াভিভূত হলো। তবুও তার কিছু বলার রইল না এখানে। রিশান এসে সায়ানকে স্কার্ফটা দিল। এই এক টুকরো কাপড়ে মাখা আদরটুকু হাতে জড়িয়েই রেখে দিল সে। পুরুষদের এতো সূক্ষ্মতম কারণে লজ্জা পেতে হয় না। কিন্তু সে লজ্জা পাচ্ছে এবং একই সাথে অনুশোচনায় ভুগছে। আজ যা হলো তাতে করে তিহাম মিশমির সাথে ঝামেলা না করলেই হয়! সে টুকরো কাপড়টা হাতে ধরেই রেখে দিল পরম যত্নে। একটু জ্বর আসুক না হয়! সেই বিভীষিকাময় জ্বরে পুড়ে যাক তার মন, তার হৃদয়। মনটা একবার ভুল করেই না-হয় বলে বসুক,

“ মিশমি? তোমাকে ভুলে যাবার শক্তি, সাহস বা ইচ্ছা… কোনোটাই যে আমার নেই! এ কেমন প্রেমিক বানালে তুমি আমায়? ”

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here