তারকারাজি-২৯ প্রথম পরিচ্ছেদের অন্তিম পর্ব
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
ঊর্ধ্বস্থিত বাতির ক্ষীণ হরিদ্বর্ণ আলোয় আরাভ স্পষ্ট দেখতে পায় বিনিদ্র নিশান ও রিশানকে। এখন শেষ রাত। টেনে-হিঁচড়ে আরও নানান কাহিনি করে দুই ভাইকে নিজের বাসায় আনতে পারলেও একটুকু স্বস্তির আভাস দিতে পারেনি আরাভ। মানুষ কি আর অন্য মানুষকে মানসিক স্বস্তি দিতে পারে? আরাভও তা পারছে না কোনোমতেই। আবারও এক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার জন্য তার ভয় হচ্ছে ভীষণ। এই জীবনে দায়িত্ব নেওয়ার পিছনেও কেউ কেউ বিশদ আনন্দ খুঁজে পায়। এই যেমন আরাভ; দু’ঘন্টার মাঝে তিনবার অভ্রর ঘর থেকে এসে নিজের ঘরে উঁকি দিল যেখানে নিশান ও রিশানের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দু’বার নিজের আত্মিক ভয় দূর করতে এলেও এবার এসেছে নীলাশাকে খোঁজ দিতে যে, বন্ধু দুটো আসলেই ঠিক আছে কি-না। আরাভ দেখল সেই হরিদ্বর্ণ আলোয় আপন-ভোলা স্বভাবে বসে আছে তারা দুই ভাই। নিজেদের মতোই ঘরের পরিবেশকে করে তুলেছে থমথমে, দমবন্ধকর। আরাভ অবশ্য কোনো আওয়াজ করল না। দরজাটা আবারও লাগিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার সময় শুনতে পেল এক কণ্ঠ,
“ তুমি গিয়ে ঘুমায় যাও, আরাভ ভাই। তোমাকে যখন বলছি আমরা কিছু করব না, তোমাকে না-বলে কোথাও যাব না তখন যাব না। বিশ্বাসঘাতকের ছেলে হইছি দেখেই কি বিশ্বাসঘাতক হয়ে যাব আমরা? ”
আরাভ অবাক না হলেও একটু সময় নিল বুঝতে যে, কণ্ঠটা কার। রিশানের কণ্ঠটা নিশানের কণ্ঠের থেকে কিছুটা পাতলা। এই কথাটা যে অনিঃশেষ কষ্ট নিয়ে নিশান-ই বলে উঠল তা নিয়ে আর সন্দেহ রইল না আরাভের মনে। সে তার স্বভাবসুলভ কণ্ঠে স্পষ্ট উত্তর দিল,
“ তোরা আমার ভাই। আর এই জীবনে কোনো ভাইকে বিশ্বাসঘাতক ভেবেছি বলে মনে পড়ছে না সঠিক। নীলা…শা টেনশন করছিল তাই দেখতে আসলাম। ফোন না-কি অফ তোদের? ”
নিশান তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে উত্তর দিল তখন, “ মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি! ”
কথাটা একজন মানুষ হিসেবে ঠিক হজম হলো না আরাভের। নিজের মনে নীলাশার প্রতি এক নরম অনুভূতি লুকায়িত থাকলেও আরাভের বিষয়টা খারাপ লাগল অন্য একটি কারণে। সে কাষ্ঠ হেসে নিশানকে কড়া জবাব দিল,
“ ঠিকি বলছিস। অবশ্য মাসি বললে ভুল হবে। নীলা তোদের বান্ধবী কম, বোন কম, মা-ই বেশি। ”
আরাভ চলে এলো অভ্রর ঘরের লাগোয়া বারান্দায়। ওদিকে নিশান বোধহয় ভাবল, তাদের এই অত্যধিক বন্ধুপাগল নীলাশার বন্ধুদের প্রতি অশেষ ভালোবাসাকে উদ্দেশ্য করেই আরাভের এই উক্তিটি করা। কিন্তু এই যান্ত্রিক দুনিয়ায় ক’জনই-বা জানে ক’জনের মনের খবর? আরাভ তার ফোনের পর্দায় সর্বপ্রথমে ভাসমান নাম্বারটায় ডায়াল করল। তার মনে হলো যেন সংযোগ পৌঁছানোর আগেই ওপাশ থেকে তার নীলা বলে উঠল, “ হ্যালো? ”
সে হাসল ক্ষীণ। সারা গায়ের অস্থিসমূহ ঝিনঝিন করে উঠল তার। এ কেমন নির্লজ্জ অনুভূতি! নিজের অনুভূতির দিকে এক রাশ বিরক্তির বাণ মেরে আরাভ বলে উঠল,
“ ওরা ঘুমায় নি এখনও। ”
ওপাশের মখমলী মনের নারীটি বোধহয় খপ করেই ধরে ফেলল আরাভের শ্রান্তিতে ভরপুর কণ্ঠটি। আর কোনো বাড়তি অক্ষরও উচ্চারণ না করে নীলাশা বলে উঠল,
“ আপনাকে বারবার ডিস্টার্ব করছি, তাই না? আচ্ছা আজ রাখি। কাল ভার্সিটিতে দেখা হবে। ”
ভাগ্যিস মেয়েটা ধরতে পারেনি শ্যামবর্ণ পুরুষের শ্রান্তির আসল কারণ! আরাভ সংযোগ স্থাপন করতে মানা করে নীলাশাকে প্রশ্ন করল,
“ ঈশা ঘুমাইছে? ”
“ ঘুমোলো তো…! ”
নীলাশার অতি আদুরে, হৃদস্পর্শী উত্তরটির পিছনের পরিশ্রমটা বেশ ধরতে পারল আরাভ। সে মৃদু হেসে পুনরায় প্রশ্ন করল,
“ সব-ই তো ঠিকঠাক কিন্তু তুমি যে ঈশাকে নিয়ে চলে আসার মতো রিস্কটা নিলে… তো এটার কী হবে শুনি? জানো তো, হুজুগে বাঙালি? তারপর নিশানদেরও জানাতে দিচ্ছ না ব্যাপারটা। পরে কিন্তু ওরা তোমাদেরকেই দোষারোপ করবে! ”
আরাভ তার শেষ কথাটা নিশানদের করা উক্তিকে উদ্দেশ্য করে বললেও নীলাশার কাছে ব্যাপারটা ছিল খুবই চিন্তার বিষয়। মেয়েটা ভাইদের সাথে চলে আসার জন্য বায়না করলে মিলা রহমান ও রুবেল আহমেদ বাঁধা দিয়েছিলেন বলেই ঈশা জানিয়েছে নীলাশাদের। কিন্তু ঈশা আর যাইহোক, নিজের মায়ের এরূপ আচরণ মানতে পারেনি বলেই না-কি রুবেল আহমেদের মাথায় আঘাত করে, দালানের মূল ফটকে ছুটে এসেছিল নিজের ভাইদের কাছে। ভাই দুজনকে তখন পায়নি সে। তবে নীলাশা ও সানামকে পেয়ে ঈশা যে তাদের পায়ে পড়ে বসবে তা কল্পনাও করেনি নীলাশারা। অতঃপর তারা দুই বান্ধবী মিলে পরিকল্পনা করেই ঈশাকে নিজের বাসায় নিয়ে যাওয়ার মতো কাজটি করে ফেলেছে। এই রাতে তো আর কিছুই করতে পারবে না কেউ। ভালোয়-ভালোয় রাতটা পার করে সকালেই একটা সিদ্ধান্ত নিবে বলে ঠিক করেছে তারা। আর যাইহোক, মেয়েটার তো কোনো দোষ নেই! বরং সে একটু আগেও নিজের ভাইদের কাছে যাওয়ার জন্য পাগলের মতো আচরণ করেছে বলেই নীলাশা আরাভকে জানালো। সে আরও বলল,
“ ও নিশানদের সাথেই থাকতে চায় কিন্তু এখন নিশানদের জানানোটা কি ঠিক হবে? এমনিই তো ওদের মন-মেজাজ ভালো না। ঈশাকে দেখলে ওর সাথেও যা-তা বিহেভ করবে। আর এখন ওরাই-বা কোথায় থাকবে, কী করবে, কী খাবে বলুন তো? আমি ভাবছি ঈশাকে আমার কাছেই রেখে দিব কয়েকটা দিন। আর নিশান, রিশানকেও এখানে নিয়ে আসব। নয়তো ওরা যাবে কই? ”
“ নীলা, বাচ্চাদের মতো কথা বলো না। ঈশাকে আজ নিয়ে গিয়ে তো সত্যি কথাটাই বলে দিছো আঙ্কেল-আন্টিকে। ধরে নিলাম আঙ্কেল-আন্টি তোমার কথা ভেবে বা ওদের কথাটা ভেবেই ওদেরকে নিজেদের কাছে রাখল। কিন্তু কত দিন, নীলা? আর ওরা জানতেছে, তুমি ঈশাকে নিয়ে গিয়েছো বলেই সত্যিটা প্রকাশ করতে বাধ্য হইছো। ওরা কি একটুও গিল্টি ফিল করবে না এই নিয়ে যে, আঙ্কেল-আন্টিও বিষয়টা জেনে ওদের হেল্প করছে? শোনো, ওদের সাথে এমন বিহেভ করো-না যা ওদের জন্য অ্যাবনরমাল হয়ে যায়। আগে যেমন ছিলা ওইরকম-ই থাকো সবাই। আর প্লিজ, কথা যে পর্যন্ত আছে সে পর্যন্তই যেন থাকে। যদি চাও তো মিশমি আর পিহুকেই শুধু বলো; এর বেশি আর কাউকে কোনো কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন নাই। আর ওদেরও একটু টাইম দাও তোমরা, ঠিক হয়ে যাবে সব। আমি বরং নিশানদের হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তবে এখানেও যে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে…! ”
অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে আরাভের কথা শোনার পর নীলাশা বিরক্ত হয়ে বলল,
“ আরও সমস্যা বাকি আছে? হলো তো অনেক! ”
আরাভ হাসল, “ আরে পাগলি! এতোদিন যার টাকাতেই হোক, ওদের চলে গেছে তিনজনের। কিন্তু এখন? আমরা তো এই দিকটা হেল্প করতে পারব না কেউই। তিনটা মানুষ কি মুখের কথা! আর ঈশা তো দেড় বছর পর এসএসসি দিবে। এক্সাম দেওয়ার জন্য যেসব ফর্মালিটিস পূরণ করতে হয় সেখানে নিশ্চয় গার্ডিয়ান হিসেবে ওদের মাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে? ঈশা যেখানেই থাকুক, ঘুরে-ফিরে তো সেই আন্টিকেই প্রয়োজন হবে ওর। তখন? ”
আরাভ উদ্বিগ্নতার সাথে কথাটা শেষ করলেও ওপাশ থেকে নীলাশা যেন লাফিয়ে উঠে বলল,
“ অ্যাই শুনেন, আই হ্যাভ অ্যান আইডিয়া! ”
“ ওরে বাবা! তোমার আইডিয়া মানেই তো অ্যাডভেঞ্চারময়। সেই আইডিয়া আর মাথা থেকে বের করো না, নীলা। এমনিই আমাদের অবস্থা বমিতে মাখা-মাখা সেই তিহামের মতোই হয়ে আছে। ”
আরাভের কথা শুনে ওপাশ থেকে তেতে উঠল নীলাশা,
“ ইয়াক! আপনি সিরিয়াস কথার মাঝেও ওই কথা টেনে আনছেন? অ্যানিওয়ে, একটু বাদে সকাল-ই হয়ে যাবে। ভার্সিটিতে গিয়ে না-হয় বলব সবটা। ”
আরাভ আবারও ঠোঁট চেপে হাসি আঁটকে বলে উঠল,
“ কোনটা? ওই বমি করার মতো অ্যাডভেঞ্চারময় কিছু? ”
অতঃপর ওপাশের রমণীর দাঁত কিড়মিড় করে বলা কথা ভেসে এলো,
“ ইউ নো হুয়াট? আপনি দিন দিন সাইফ ভাইয়ের মতো হয়ে যাচ্ছেন। ”
“ তুমিও তো সানামের মতোই আইডিয়া আবিষ্কার করছো আজকাল। তো আমি সাইফের মতো হলে দোষটা কোথায় বলো তো? ”
নীলাশা হাসল। কথা না বাড়িয়ে ফোনটা রেখেই দিত কিন্তু এমন সময় আরাভ জরুরি তাগিদে ডেকে উঠল তাকে,
“ অ্যাই নীলা! আরেকটু শোনো। ”
“ বলুন? ” খুবই চিন্তিতপূর্ণ কণ্ঠ ফিরে এলো রমণীর। অতঃপর আরাভকে বলতে শোনা গেল,
“ অ্যালার্মটা একটু ঠিক করে সেট করে নিও, আচ্ছা? তুমি যে কুম্ভকর্ণের ঘুম দাও…! পরে দেখা যাবে আমি তোমার জন্য ওয়েট করতে করতে পাগল হয়ে যাব আর তুমি ঘুমেই পাগল হয়ে থাকবা। ”
নীলাশা এবার একটু বেশিই বিরক্ত হয়ে বলল,
“ আপনি কিন্তু সত্যিই সাইফ ভাইয়ের মতো জ্বালাচ্ছেন এবার। আমি কি সানামকে ফোনটা দিব? ”
উত্তরে আরাভ শব্দ করে হাসল। হাসতে হাসতেই বিদায় নিল দুজন দুজনের থেকে। সংযোগ কেটে দূরের ওই জমাট বাঁধা কুয়াশার ধূসরে তাকিয়ে আরাভ ভাবতে লাগল নীলাশার কথা। মেয়েটা দুনিয়ার সকল কিছু ভুলে কেন যে নিজের বন্ধুদের নিয়েই এতো চিন্তা করে কে জানে! এখন সে যদি নীলাশাকে হাসিয়ে তার চিত্তবিক্ষেপ না করতো তো দেখা যেত, নিজের চিত্তে এইসকল চিন্তাকেই আঁকড়ে ধরে থাকতো মেয়েটি। যাক, এতকিছুর পর একটু ভালো কিছুও তো হলো!
কিন্তু পরিকল্পনা মোতাবেক সকালে উঠে ভার্সিটিতে আর পৌঁছানো হলো না আরাভের। শেষ রাত্রিতে ঘুমিয়েছিল বলে জাগ্রত হতেই দুপুর গড়িয়েছিল ঘড়িতে। নীলাশারও অবস্থা ঠিক তেমনই হয়েছে আজ৷ দুজনে মিলে ঠিক করল তারা ভার্সিটিতেই দেখা করবে তবে আজ বিকেলে। মিশমি আর পিহুকেও জানানো হলো বিষয়টা। স্বীকার না-করলেই নয়, মিশমিরা সকালে নিশানদের কল করলেও সংযোগ পৌঁছাতে পারেনি। বন্ধুদের ফোন বন্ধ। নীলাশাদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা জানায় যে, বিকেলে ভার্সিটিতে সবটা বলবে তাদের। সে এ-ও বলে যে, এই মুহূর্তে মিশমিদের সকলের সাহায্যই খুব প্রয়োজন তাদের পাগলাটে বন্ধুদের। তারা যে এখন নিষ্প্রভতায় মজেছে! কিন্তু অগ্রীম পরিকল্পনা করে ভার্সিটিতে পৌঁছালেও আশান্বিত ফলাফল পেল না নীলাশা। সানাম নিজের ব্যাগপত্র নিয়ে নিজেদের হলে ছুটে গিয়েছে এবং যাওয়ার আগে বলেছে, সে যেন আরাভের সাথে তাদের দুজনের পরিকল্পনাগুলো উন্মুক্ত করে। খুব বেশিক্ষণ না… নিজের ব্যাগপত্র রেখেই তাদের কাছে চলে আসবে সানাম।
কিন্তু সানাম আসেনি তখন। হলে পৌঁছানোর পথে একটি অচেনা নাম্বার থেকে কল আসায় সানাম যখন তা রিসিভ করল তখন ওপাশ থেকে এক পরিচিত পুরুষালি কণ্ঠ শুনতে পেয়েছিল সে,
“ তোমাকে ছাড়া ট্রিপটা আর ট্রিপ-ট্রিপ লাগছে না। মনে হচ্ছে কতকাল ধরে পেত্নীর বিদঘুটে হাসিটা শুনি না! ”
সানাম বিরক্ত হয়ে উত্তর দিয়েছিল তখন, “ সাইফ ভাই? আপনি ফোন করেও দেখি জ্বালাচ্ছেন আজকাল। ইঞ্জিনে তেল বেশি পড়তেছে না-কি যে, আমাকে জ্বালিয়ে ফাও-ফাও সময় নষ্ট করছেন? রাখেন ফোন৷ ”
ধমকটা সানাম দিয়েছিল ঠিকি তবে সংযোগ আর কাটা হয়নি তাদের। নানান কথায় নীলাশার তাড়াটা যে কী-করে ভুলে বসেছিল সে তা প্রকৃতপক্ষেই অনুপভোগ্য!
ওদিকে মিশমিরা ঢাকায় ফিরেছে জেনে তিহামের সেই কি ছটফটানি! তার মিশমির সাথে দেখা করতে হবে তক্ষুনি। মূল ফটকের সামনে প্রিয়তমাকে পেয়েই তিহামকে সোনায় সোহাগা রূপে দেখা গিয়েছিল তখন। মিশমি বলেছিল তাকে এখানে আসার কথা। সেই কতদিন দেখা হয়না প্রেমিকযুগলের! মেয়েটির মুখে অন্য কথা থাকলেও মনটা ছিল তিহামের কাছেই। তিহাম যখন বলল তার সাথে জরুরি কথা আছে তখন মিশমিকেও বান্ধবী পিহুকে বলতে শোনা গিয়েছিল,
“ দোস্ত, তুই টিএসসিতে চলে যা। নীলদের বলিস আমি চলে আসব কিছুক্ষণের মধ্যে। ”
এই শুনে পিহু রাগটা দেখিয়েছিল বেশ, “ জানিস-ই তো নীল আমাদের সাথে আর্জেন্ট কথা বলতে চাইছে। নিশানদের কী হইছে জানতে হবে তো, না-কি? পরে কথা বলে নিস তিহাম ভাইয়ার সাথে? ”
মনুষ্যত্ব ও মানসিকতা নিয়ে বন্ধুমহলের সবচেয়ে হ্যা-ধর্মী মেয়েটি যখন প্রেমে মত্ত হয়ে বলে উঠল,
“ দোস্ত, তোরা কথা বলতে থাক একটু। মানুষটা এইভাবে বলতেছে যে, জরুরি দরকার আছে সেখানে না শুনে গেলে কেমন অভদ্রতা দেখানো হয়না, বল? তুই যা। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসতেছি। ”
তখন পিহুও ভীষণ বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলতে চেয়েছিল অনেক কথা। প্রেমিক কি তার একার-ই আছে? কিন্তু সে স্তব্ধই ছিল তখন৷ সব কথা কি সবাইকে বলা যায়? মিশমি তো এইটুকুই সহ্য করতে পারবে না। সে শীঘ্রই চলে আসবে ভেবে পিহু নীলাশার কাছে গিয়েছিল ঠিকি। তবে পাঁচ, দশ, পনেরো মিনিট করে-করে সময় অতিবাহিত হলে যখন বাকি দুই বান্ধবীর দেখা পেল না তারা, তখন তুমুল আক্রোশে চোখ ভরে আসলো পিহু এবং নীলাশার। পিহু যথাসাধ্য নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,
“ থাম, ওদের ফোন করি। ”
কিন্তু বন্ধুদের প্রতি অভিমান কি এতই দুর্বল? সে ক্ষণস্থায়ী হলেও হয় ভীষণ উত্তপ্ত! নীলাশা নিজের বুকে সেই অভিমান জমা রেখেই বাঁধা দিল পিহুকে। তারা আসার আগেই তো আরাভের সাথে কথা হয়ে গিয়েছে নীলাশার। এখন ওদের ডেকে কী হবে? বৈঠক ঘন্টাখানেকের জন্য ছিল না-কি যে, তারা শামিল না-হয়ে আগে নিজেদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল? কীসের এতো ব্যক্তিগত কাজ তাদের যেখানে একজন বন্ধু নিজের ব্যক্তিত্ব ভুলে গিয়ে অন্য বন্ধুদের জীবন্ত করতে উঠেপড়ে লেগেছে?
পিহুকে বিদায় জানিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো নীলাশা। শহরতলীর ঘিঞ্জি গলির সোরগোলকে ভুলে নিরুদ্দেশ হাঁটতে লাগল সঙ্গহীন, একাকী মেয়েটি। তার মনটা আজ প্রচণ্ড খারাপ। বন্ধুদের এমন আচরণ মানতে পারেনি সে। হাঁটতে হাঁটতেই ভীষণ অসহায়ত্ব নিয়ে নীলাশা যখন মাথা উঁচিয়ে আকাশ পানে তাকাল তখন সে খেয়াল করল যে, আকাশটা ক্ষীণ মেঘাচ্ছন্ন হওয়ায় খুব একটা তারা দেখা যাচ্ছে না। মুহূর্তেই থেমে গেল নীলাশার চলন্ত পা। নিজের বন্ধুমহলের মরমর অবস্থা ঘনিয়ে এসেছে ভেবে মনটা কেমন যেন করে উঠল তার। চোখ দুটো ছলছল করে উঠল নোনাজলের ফোয়ারায়। কিচ্ছু ভাল্লাগছে না তার… কিচ্ছু না! ভবিষ্যতে এই বন্ধুমহলের অধঃপতন হতে পারে অনুভব করতেই অদৃশ্য এক যন্ত্রণায় নীলাশার বুকটা কেঁপে কেঁপে বলে উঠল,
“ কেন তারারা এতো দূরে সরে-সরে রয়?
তারা কি জানে না,
‘তারকারাজি’ মানেই- পথ চলায় নেই কোনো ভয়?
একসাথে থাকার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে,
তাদের কেন হতে হলো এতটা নির্দয়?
সত্যিই কি তারা জানে না,
‘তারকারাজি’হীন ঐ আঁধার-আকাশে আমি দেখেছি নিজের সাঙ্ঘাতিক অবক্ষয়? ”
———- প্রথম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি ———-
আবার ও আসবো দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ নিয়ে খুব তারাতারি।