তার দেখা
পর্ব – ১
আমিরাহ্ রিমঝিম
( কপি করবেন না)
সকালের স্নিগ্ধ সুন্দর পরিবেশে বসে মৃদু বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ খেলা নদীর দিকে চেয়ে ছিলো অনন্যা। কয়েকটা দাড় টানা নৌকা শান্তভাবে বিচরণ করছে সেখানে, পাড় দিয়ে সবুজ ঘাসের আস্তরণ, আশেপাশের গাছগুলোতে পাখিদের কলতান। ভালোই লাগছে বেশ।
– অনন্যা?
মুক্তার ডাকে ঘোর ভেঙে পাশে তাকায় অনন্যা।
– চুপচাপ বসে আছিস কেন? কি হয়েছে?
অনন্যা মাথা নেড়ে না করলো, বোঝালো কিছু হয়নি।
– নদী দেখছিলাম। সুন্দর অনেক, মাশাআল্লাহ।
বৃষ্টি উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো,
– সুন্দর না বল? এজন্যই নিয়ে এলাম এখানে। ভালো লাগার মতোই জায়গা এটা।
বৃষ্টির সাথে তাল মেলালো মুক্তাও।
– হ্যাঁ, আর এখানের খাবারও কিন্তু বেশ ভালো।
অনন্যা সায় জানালো দুজনের কথায়। জায়গাটা সত্যিই অনেক সুন্দর। বেশ জনপ্রিয় একটা ক্যাফে আর রেস্টুরেন্ট এটা। অনেকখানি জায়গাজুড়ে খোলা আকাশের নিচে কিছু দূরে দূরে ছাতার নিচে বসার ব্যবস্থা। অবস্থানটা নদীর পাশেই হওয়ায় দিনের নানান সময় জলধারার ছোট বড় ঢেউ চোখ জুড়ায়। মাঝে মাঝে নৌকা-ট্রলারও দেখা যায়, যেমন অনন্যা দেখছে। নৌকায় উঠতে মন চাইছে ওর।
– অনন্যা, ফুলটা দে তো, এস্থেটিক ছবি তুলি আরো কয়েকটা।
– নে, নষ্ট করিস না।
হাতের কাঠগোলাপটা বৃষ্টির দিকে বাড়িয়ে দেয় অনন্যা। জীবনে আজই প্রথম সে সরাসরি কাঠগোলাপ দেখেছে, হাতে নেয়ার সুযোগ পেয়েছে। ঘন্টা দুয়েক আগে কুড়িয়ে আনা হলদে আর সাদার মিশেলের সুগন্ধি ফুলটা এখনো যত্ন করে নিজের সাথেই রেখেছে।
কাঠগোলাপটা নিয়ে নানাভাবে ছবি তুলছে বৃষ্টি। একবার নদীটাকে পেছনে রেখে ফুলের ছবি তুলছে, একবার ক্যাফের নেইমপ্লেট পেছনে রেখে ছবি তুলছে। মুক্তা ব্যাগ, ফোন গুছিয়ে রেখে উঠার জন্য তাড়া দিলো।
– ছবি তোলা হলে চল উঠি এবার, অনেকক্ষণ হয় বসে আছি।
ধীরে সুস্থে চেয়ার ছেড়ে উঠলো তিনজন। অনন্যার যেতে ইচ্ছা করছে না এখান থেকে। কিন্তু সারাদিন তো আর এখানে বসে থাকা যাবে না।
কাউন্টারে আরো অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে বিল দেয়ার জন্য, ওদেরকে তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। হঠাৎ হাচি চলে এলো বৃষ্টির।
– আলহামদুলিল্লাহ!
– ইস, জীবাণু জীবাণু!
বৃষ্টি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে দেখে ছোট্ট একটা মেয়ে, বাবা-মা আরো কয়েকজনের সাথে দাঁড়িয়ে আছে হাতে একটা কাপদই নিয়ে।
– কোথায় জীবাণু?
– এই যে তুমি হাচ্চু দিলে, হাচ্চুতে কত্তগুলো জীবাণু। ইস!
নাক মুখ কুচকে বললো পিচ্চিটা। বৃষ্টি যে পিচ্চিটার সাথে কথা বলছে এটা পিচ্চির বাসার কেউ খেয়াল করে নি। ওদিকে অনন্যা আর মুক্তা খাবারের বিল দিতে ব্যস্ত। বৃষ্টি ছোট মেয়েটার কাছে একটু এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,
– এই যে তুমি দই হাতে নিয়ে আছো, এটাতেও কিন্তু অন্নেএএএকগুলো জীবাণু আছে। হাচ্চুর চেয়ে বেশি জীবাণু দইয়ে।
পিচ্চি মেয়েটার দই খুব পছন্দের। তার পছন্দের খাবারে জীবাণু আছে এটা মেয়েটা বিশ্বাস করতে চাইলো না। কিছুটা রাগতভাবে প্রতিবাদ জানালো।
– না, মিথ্যা কথা।
– সত্যি কথা। দইয়ে সত্যিই জীবাণু থাকে। তোমার হাতে যে দই না, সেটাতেও অনেক জীবাণু আছে। তারপর তুমি এই দই খাবে আর জীবাণু সব তোমার পেটে।
– না, দইয়ে জীবাণু থাকে না। জীবাণু পেটে যায় না।
– থাকে থাকে। অনেক জীবাণু থাকে, খেলে পেটে যায়।
এবার তারস্বরে চেচিয়ে “না” বললো মেয়েটা। তারপর “আম্মু” বলে ওর মা কে ডেকে ভ্যাঁ করে কেঁদেই ফেললো। কান্নার আওয়াজে আশেপাশের অনেকেই ঘুরে তাকালো ওদের দিকে। বৃষ্টি কিছুটা বিব্রতবোধ করলো। অনন্যা আর মুক্তা বিল দিয়ে এসেছে ততক্ষণে, ওরাও বৃষ্টির দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে। আর পিচ্চির মা ওকে কোলে নিয়ে শান্ত করতে ব্যস্ত।
কাউন্টারের কাছে এক টেবিলে একা বসে ছিলো তরুণ। বাচ্চার কান্না শুনে এক পলক তাকিয়েছিলো সেদিকে, তারপর আবার আগের মতো ফোন চালানোয় ব্যস্ত হয়ে গেলো।
মাসখানেক ধরে নানান টিউটোরিয়াল, প্রেজেন্টেশন, এসাইনমেন্টের চাপ শেষে ফাইনাল পরীক্ষার আগে রিফ্রেশমেন্ট হিসেবে বন্ধুদের সাথে ট্যুরে এসেছে তরুণ। গত রাত জার্নি করে এসে বাকিরা সব পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে এখন। ফজরের পর ঘুমানোর অভ্যাস না থাকায় একাই ঘুরতে বেড়িয়েছে তরুণ।
অনেক চেষ্টার পর ছোট্ট মেয়েটার কান্না থামানো গেলো। অনেক বলে বলে তাকে বুঝানো হলো যে দইয়ে ভালো জীবাণু থাকে, সেগুলো মানুষের ফ্রেন্ড। অবশ্য বৃষ্টির অনেকবার করে সরি বলতে হয়েছে পিচ্চিটাকে। শেষে মুক্তা আর বৃষ্টি ভাব জমানোর চেষ্টা করতে লাগলো ছোট্ট মেয়েটার সাথে।
ছোট্ট মেয়েটার সাথে তার দাদাও এসেছে। উনি বেশ কৌতুহলি হয়ে অনন্যার সাথে কথা বলতে শুরু করলেন।
– ঘুরতে এসেছো এখানে বান্ধবীদের সাথে?
– আসলে আমার খালার বাসা এখানে, খালার দাওয়াত ছিলো সেজনই আসা। মুক্তা আমার খালাতো বোন আর বৃষ্টি ওর বান্ধবী, আমারো বান্ধবী।
– ও আচ্ছা, খালার বাসায় এসেছো তাহলে। নাম কি তোমার?
– তাসফিয়া জাবিন অনন্যা।
– তাসফিয়া-জাবিন-অনন্যা! মাশা আল্লাহ! চমৎকার নাম। কোথায় পড়ো তুমি?
বয়স্ক লোকটা অনেক কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন, অনন্যা সবেরই উত্তর দিলো বিনীতভাবে।
অনন্যা ধীরে জবাব দিলেও পিচ্চির দাদা প্রতিটা জবাব আবার আওয়াজে রিপিট করায় সবই তরুণের কানে যাচ্ছে। মনোযোগটাও চলে গেছে সেদিকে। তরুণের অস্বস্তি হতে লাগলো। এভাবে অপরিচিত কারো তথ্য শোনা- ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। শেষে টেবিলটা ছেড়ে দূরের একটা টেবিলে গিয়ে বসলো ও।
– তুমি একটা জীবাণু।
– আমি কিভাবে জীবাণু হলাম? দেখো না আমি কত বড়? তুমি তো ছোট্ট, তুমি জীবাণু।
– আমি তাহলে ভালো জীবাণু। তুমি পচা জীবাণু।
পিচ্চিটা আর বৃষ্টির কথাবার্তা শুনে হাসছিলো মুক্তা, এগিয়ে এসে ছোট মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
– ঠিক আছে ভালো জীবাণু, আমরা এখন বাসায় যাই?
– আচ্ছা। আল্লাহ হাফিজ।
তারপর বৃষ্টিকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে বললো,
– পচা জীবাণু, আল্লাহ হাফিজ।
হাসলো সবাই। তারপর মেয়েটার বাসার সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে এলো রেস্টুরেন্ট এরিয়া থেকে।
কিছুদূর যেতেই অনন্যার খেয়াল হলো কাঠগোলাপটা সাথে নেই। সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেল ও। বাকি দুইজনও থামলো।
– এই, ফুলটা রেখে এসেছি টেবিলে।
মুক্তা অবাক হয়ে বললো,
– তোর কি লাগবেই ওটা?
– একটু দাড়া, আমি নিয়ে আসছি।
দ্রুতবেগে পা চালিয়ে আবার রেস্টুরেন্টের ভেতর গেলো অনন্যা। কিন্তু ওদের টেবিলের কাছাকাছি গিয়ে দেখতে পেলো একটা ছেলে টেবিল দখল করে বসে আছে। ওর রেখে যাওয়া কাঠগোলাপটা হাতে নিয়ে সেটার দিকেই তাকিয়ে আছে।
ও চলে আসার জন্য পেছন ঘুরতে যাবে, তখন হুট করেই তরুণ তাকালো ওর দিকে। বোরকা নিকাব পরা মেয়েটাকে দেখেই তরুণ চিনে ফেললো, এটা তখন ওই পিচ্চিটার দাদার সাথে কথা বলা মেয়েটাই, নাম অনন্যা।
– ফুলটা কি আপনার?
যদিও তখন তরুণ সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিয়েছে, তবুও অনন্যা বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছে। মাথা যেন হুট করে প্রশ্নটা ধরতে পারলো না।
তরুণ কাঠগোলাপটা টেবিলের উপর রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো।
– ফুলটা আপনার হলে নিয়ে যান।
বলে তরুণ আবারো টেবিল ছেড়ে দূরে অন্য টেবিলে গিয়ে বসলো।
ফুলটা নেবে কি নেবে না- এই ইতস্তত করতে করতে নিজেদের টেবিলের কাছে এগিয়ে গেলো অনন্যা। কাঠগোলাপটা হাতে নিয়ে বের হয়ে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)