#তিতির পাখির বাসা,পর্ব-২৭,২৮,২৯,৩০ শেষ
#জয়া চক্রবর্তী।
২৭
বেলা সাড়ে তিনটে বাজতে চললো জ্যেঠিমা এখনো পুজোঘর থেকে বের হতে পারলেন না।
সকালে আদা-চা আর লুচি-আলুরদম খেয়ে ঠায় রান্নাঘরে দাঁড়িয়েই এক নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছিলেন।
তার ওপর কত যে বায়নাক্কা মহিলার।
একবার লিকার-চা তো একবার দুধ-চা।ফ্রিজ থেকে দুবার কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল ও বের করে দিয়েছে তিতির।
তার ওপর একটু বাদে বাদেই,নিজের হাতে রাখা ষ্টীলের টিফিন ক্যারিয়ার খুলছিলেন।
তারপর ভেতর থেকে পান নিয়ে তাতে চুন- জরদা- মৌরি- সুপুরি-জোয়ান দিয়ে মুখে চালান করে জাবরের মতো চিবিয়েই যাচ্ছিলেন।
তিতিরের মনে হচ্ছিলো সুযোগ পেলে ইনি হয়তো বিড়ি,সিগারেট, খৈনি, নস্যিটাও বাদ দিতেন না।
মাঝে শেফালি এসে ঘরমুছে বাসন মেজে দিয়ে গিয়েছিলো।সাথে শেফালির মেয়ে প্রমীলাও এসেছিলো।তিতির ওদেরকেও ভরপেট লুচি আলুরদম খাইয়ে দিয়েছে।
প্রমীলাকে পুজোর দিনগুলোতে তিতিরদের বাড়ীতে রেখে আর কাজে যেতে হয়নি শেফালির।
কারন বাকি কাজের বাড়িগুলোতে সবাই বাইরে ঘুরতে যাওয়াতে শেফালি একরকম ছুটিতেই এখন দিন কাটাচ্ছে।
তিতির বলেছিলো,তিতিরদের বাড়ীর কাজটা না হয় তিতির একাই সামলে নেবে।কিন্তু শেফালি রাজি হয়নি।তাছাড়া প্রমীলার ও তিতিরকে একবার না দেখলে চলেনা।
শেফালি জ্যেঠিমাকে দেখে যে খুশী হয়নি সেটা ওর মুখেই স্পষ্ট।তাছাড়া তিতির যখন রেকাবি করে লুচি আলুরদম বেড়ে ওদের খেতে দিচ্ছিলো তখন জ্যেঠিমা যে সব তির্যক মন্তব্য করছিলেন,মনে হয় শেফালির কানেও কিছু পৌঁছেছিলো।কারন শেফালি খেতে চাইছিলো না কিছুতেই।তিতির একপ্রকার জোর করেই খাইয়েছে ওদের।
তিতির খুঁড়িয়ে হাঁটছিলো দেখে শেফালি নিজেই জিজ্ঞেস করে তিতিরের সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যাওয়ার খবর জেনেছিলো।
তিতিরের বড়মার মতো শেফালিও চুন-হলুদ গরম করে তিতিরের হাঁটুতে লাগাতে চেয়েছিলো।তিতির রাজি হয়নি।
গরম-ঠান্ডা জলে সেঁক দেওয়াতে চেয়েছিলো সেটাও তিতির এককথায় নাকচ করে দিয়েছিলো।কারন পাপান সকাল থেকে দরকারে অদরকারে বারবার রান্নাঘরের দিকে আসছে।
শেফালিরা চলে যেতেই জ্যেঠিমা বলেছিলো,’পায়ের জুতো পায়েতে রাখাই ভালো।মাথায় তুলতে যেওনা’।
তিতির বলেছিলো,’আমাদের বাড়ীতে আবার শেখানো হয়েছিলো,মানুষকে অসম্মান করা ভগবানকে অসম্মান করবার সমান।আপনি আর দেরী না করে বরং স্নানটা সেরে নিন’।
তিতিরের কথা ওনার মনে ধরেনি।কাজের লোক দিয়ে সংসার সামলাতে তিনি যে কত বড় পটীয়সী তারই বিস্তারিত বিবরনী দিয়ে যাচ্ছিলেন ।শুধু কি তাই,সঙ্গে তিতিরকে সুগৃহিণী হওয়ার নানান কলাকৌশলও শেখাচ্ছিলেন!
অবশেষে সুদর্শনের হস্তক্ষেপে বেলা একটা নাগাদ তিনি তিতিরকে ক্ষমাঘেন্না করে দিয়ে স্নানে গেলেন।
কিন্তু স্নান সেরে সেই যে পুজোর ঘরে ঢুকেছেন,আর বের হওয়ার নাম মাত্র নেই।
এদিকে তিতিরের ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে।বেলার দিকে আরো একবার পেইন কিলার খাওয়ায় হাঁটুর ব্যথাটা এখন কিছুটা সহ্যের মধ্যে।
কিন্তু হয়তো ওষুধের কারনেই একটা ঝিম ঝিম ভাব লাগছে তিতিরের।
তিতিরের মনে হলো মামনিও পুজো করেন, ঠাকুর ঘরে সময় কাটান,কিন্তু ওনার জন্য ওদের কাউকেই কোনরকম অসুবিধা ভোগ করতে হয়নি।মামনি বলেন আগে আমার রক্তমাংসের ঠাকুরের সেবা তারপর অন্যসব।
এই ভদ্রমহিলা কি করে যে সংসার সামলান কে জানে!কথাটা ভেবে না চাইতেই তিতিরের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি খেলে গেলো।
‘একা একা হাসছো যে!কি মনে পড়লো হঠাৎ!কাল রাতে বাবিনদার আদর বুঝি!’কথাটা বলেই হা হা করে হেসে উঠলো পাপান।
তিতির উত্তর না দিয়ে গ্যাসের ওভেন মুছতে শুরু করলো।
‘কাল যেভাবে তোমায় কোলে তুলে নিয়ে বাবিনদা ঘরের দিকে গেলো,সত্যি বলবো,বাবিনদা যে এতো বৌ পাগলা হবে আগে বুঝিনি’।
এই সব হাল্কা কথাবার্তা তিতির কোনদিনই পছন্দ করতে পারেনা।তিতির জানে এসব থেকে বাঁচার সবচেয়ে সহজ উপায় ইগনোর।
‘ওদের খেতে দিয়ে দিয়েছো তো?’,তিতির ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলো জ্যেঠিমা পেছনে।তিতির বললো,না ওরা দুই ভাই আপনার সাথে খাবে বলে এখনো খায়নি।অনেকবার বলেছিলাম’।
‘মা আমি বাবিনদাকে ডেকে আনছি।আসার আগে দেখলাম দিব্বি নাক ডাকছে ইজিচেয়ারে শুয়ে।এতো জোরে মাইকে গান বাজছে,তার ওপর মাঝেমাঝেই ঢাকে কাঠি পড়ছে,কি করে যে ঘুমোচ্ছে বাবিনদা ভগবান জানে!’
একটু থেমে আবার বললো,’কাল রাতে বোধহয় ঘুমোয়নি বাবিনদা!’,এই শেষ কথাটা বলেই তিতিরের দিকে তাকিয়ে একটা অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বেড়িয়ে গেলো পাপান।
তিতির বিরক্তিটা হজম করতে থালায়-থালায় ভাত বেড়ে ফেললো।পাশে লালশাক দিলো। বাটিতে পাঁচ-ছয় পিস করে রেওয়াজি খাসির মাংস আর দুপিস করে আলু দিলো,কাঁচের বাটীতে খেজুর আমসত্ত্বের চাটনি বেড়ে নিয়ে একেবারে টেবিল সাজিয়ে নিজেও বসে পড়লো নিজের নির্ধারিত চেয়ারে।
‘সেকি তিতির তুমি বসে পড়লে আমাদের খেতে দেবে কে?’,জ্যেঠিমার কথায় অবাক হয়ে তিতির বললো,’আমি তো আগে থেকেই আপনাদের সবার খাওয়ার বেড়ে দিয়েছি।একসাথে খাবো বলে’।
‘বাড়ীর বৌকে সবার খাওয়া হয়ে গেলে খেতে বসতে হয়,এটাও জানোনা?’,তিতির জ্যেঠিমার কথায় হেসে বললো,’কেন বলুনতো?বাড়ীর বৌদের কি খিদে পায়না নাকি!,জ্যেঠিমা এবার রাগ রাগ গলায় বললেন,’ঠিক আছে।অতো কথা শোনাতে হবেনা।তোমরা খেয়ে নাও।আমি সবার খাওয়া হয়ে গেলে তবেই খেতে বসবো।তাছাড়া খেতে খেতে ওদের কিছু লাগলে!’
তিতির হেসে বললো,’খেতে খেতে কিছু লাগলে ওরা বাঁ-হাত দিয়ে নিয়ে নেবে।আর তাতে যদি আপনার আপত্তি থাকে সেক্ষেত্রে আমি না হয় হাত ধুয়ে এসে আবার দিয়ে দেবো’।
তিতিরের কথা শেষ না হতেই বাবিন ঘুম চোখ নিয়ে তিতিরের পাশের চেয়ারে এসে বসলো।পাপান তিতিরের মুখোমুখি চেয়ারটা টেনে নিলো।জ্যেঠিমার ও সম্ভবত খিদেই পেয়েছিলো।তাই,’সবার খাওয়া হয়ে গেলে খাবেন’এই পণ টা ভুলে নিজেও চেয়ারে বসে থালা টেনে নিলেন।
সুদর্শন খেতে খেতে তিতিরকে বললো,’খেয়ে নিয়ে রেডি হয়ে নাও।সবাই মিলে আজ আমরা তোমাদের বাড়ীতে যাব’।তিতির বললো,’সবাই মিলে আমাদের বাড়ী যাবে মানে!’
সুদর্শন বললো,’ জ্যেঠিমা, পাপান তো আমাদের বিয়ের সময় ছিলো না।তোমার বাপের বাড়ীর কারোর সাথেই পরিচয় নেই ওদের।তাই আমরা আজ যখন যাচ্ছিই তোমাদের বাড়ী তখন ভাবলাম একটু ওদেরও ঘুরিয়ে আনি’।
তিতির বললো,’বেশ তো,বাড়ীর সবাই খুশীই হবেন’।
সুদর্শন বললো,’তুমি কিন্তু তিনদিনের মতো জামাকাপড় গুছিয়ে নিও পাখি।তোমাকে রেখেই আসবো তিনদিনের জন্য।এখানের জন্য চিন্তা কোরনা,জ্যেঠিমা তো আছেই সব সামলে দেবে।তাই না জ্যেঠিমা?’
সুদর্শনের কথা শুনে রীতিমতো বিষম খেলেন জ্যেঠিমা।জল খেয়ে সামলে-টামলে নিয়ে বললেন,’কিন্তু আমায় যে আজ বিকেলে যেতেই হবে।তোর জ্যেঠুর যা অবস্থা’।
সুদর্শন বললো,’সেকি জ্যেঠিমা!আজ সকালেই তো পাপানকে দিয়ে ফোন করিয়ে জ্যেঠুকে কদিন চালে-ডালে ফুটিয়ে খেতে বলেছিলে।পাখির পড়ে যাওয়া,ব্যথা পাওয়া নিয়ে কত উদ্বিগ্ন ছিলে তুমি!’
‘হ্যাঁ,সেতো তুই ঠিকই বলছিস।সে কারনেই তো ভেবেছিলাম থেকে যাব।কিন্তু কি জানিস বাবিন, ঠাকুরঘরে পুজো করবার সময় যেন স্পষ্ট শুনলাম তিনি ডাকছেন আমায়’।
সুদর্শন হাসি চেপে আরো কিছু বলবার আগেই কলিংবেল জানান দিলো,দরজার বাইরে কেউ এসেছে।পাপান এঁটো হাতেই দরজা খুলতে চললো।(চলবে)
(পর্ব-২৮)
জ্যেঠিমা খেতে খেতেই বলে উঠলেন,’এখন আবার কোন আপদ!’
পাপান দরজা খুলে আগন্তুক কে সঙ্গে নিয়ে একেবারে খাওয়ার ঘরেই উপস্থিত হলো।
বাবিন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলো,’হোয়াট আ সারপ্রাইজ!’তারপর জ্যেঠিমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,’তুমি কিন্তু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারিনী।জেঠু আসবার আগেই জেঠুর ডাক তুমি পুজোঘর থেকে শুনে ফেলেছো’।
জেঠু গোল গোল চোখ করে বলে উঠলেন,’সেকি আমি আবার কখন ডাকলাম তোর জ্যেঠিমাকে!হ্যাঁগো তুমি কার ডাক শুনেছো সত্যি করে বলো?এই বুড়ো বয়েসে আমাকে ভাসিয়ে দিয়ে আর কারো ডাকে সাড়া দিতে যেও না সোনা!’
জেঠুর কথা বলবার ধরনে তিতির,পাপান,বাবিন তিনজনেই হো হো শব্দে হেসে উঠলো।
জ্যেঠিমা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠলেন,’নকশা কোরনা বাচ্চাদের সামনে।ভালো লাগেনা’।
তিতির এবার চটপট চেয়ার ছেড়ে উঠে বেসিনে হাত ধুয়ে জ্যেঠিমার পাশের চেয়ার টা টেনে দিয়ে বললো,’আসুন জেঠু আগে খেয়ে নিন’।
জেঠু হেসে বললেন,’তুমিই তিতির?আমাদের বাবিনের বউ?’তিতির হেসে জেঠুর পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে বললো,’আপনি বসুন জেঠু। আমি থালা এনে আপনার খাবারটা বেড়ে ফেলি’।
কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের দেখলে শ্রদ্ধায় এমনিতেই মাথা নত হয়ে আসে।
যদিও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে শ্রদ্ধা জানানোটা তিতিরের একেবারেই পছন্দ নয়।
কতবার যে মায়ের কাছে বকুনি খেয়েছে এই নিয়ে।তবুও তিতির নিজের ইচ্ছেতে কখনোই এই পায়ে হাত দেওয়া কাজটা করেনি।
আসলে তিতির মনে করেনা এইভাবে পায়ে হাত দিয়ে কাউকে শ্রদ্ধা জানানো যায়।তবু নিজস্ব নীতি ভেঙে ভালো লাগার জের নিয়ে সুদর্শনের জেঠুকে মন থেকে প্রণাম টা করেই ফেললো তিতির।
জেঠু মাথায় হাত দিয়ে বললেন,’সুখী হও মা।তোমার বিয়ের সময় আমার শরীর খারাপের জন্য আশীর্বাদ করা হয়নি’।
তারপর পকেট থেকে একটা বাক্স বের করে তিতিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘একটু খুলে দেখোতো মা পছন্দ হয় নাকি!
তিতির বললো,’নিচ্ছি জেঠু আপনি আগে বসুন।ঘেমে একেবারে জল হয়ে গেছেন’,কথাটা বলতে বলতেই তিতির স্ট্যান্ড ফ্যানটা জেঠুর দিকে ঘুরিয়ে দিলো।
‘তিতির তোমাকে বোধহয় শেখানো হয়নি!জানো কি একসাথে গুরুজনেরা থাকলে একজনকে প্রণাম করলে বাকীদের ও প্রণাম করতে হয়?’
তিতির আর তর্কে না গিয়ে জ্যেঠিমাকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে আবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দ্যোগ নিতেই জ্যেঠিমা বলে উঠলেন,’কী হলো তিতির বাবিনকে প্রণাম করলে না যে!’
বাবিন বললো,’না না এসব থাকুক পাখি।তুমি আগে জেঠুর খাবারটা বেড়ে দাও’,তিতির বাসনের র্যাক থেকে থালা নামিয়ে আবার ডাইনিং এ ফিরে আসলো।
জেঠু বাক্সটা আবার এগিয়ে দিলেন তিতিরের দিকে।বললেন,’পছন্দ হলে একটু পরে দেখাও মা।পুজোর দিনে মাকে দর্শন করি’।
তিতির বাক্স খুলে দেখলো এক জোড়া ঝুমকো পাশা।জ্যেঠিমা একটু উঁকি দিয়ে দেখে বললেন,’এতো তোমার মায়ের গয়না’।
জেঠু বললেন,’হ্যাঁগো তুমি ঠিক দেখেছো।মাকে তো মায়ের গয়না দিয়েই আশীর্বাদ করতে হয়।নাও মা একটু পরে দেখাও’।
জ্যেঠিমার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে জেঠুর এই কাজটা তিনি একেবারেই পছন্দ করেননি।
তিতির নিজেও ভারী গয়না পছন্দ করেনা।কেমন একটা বেশী সাজসাজ মনে হয়।তবু জেঠুর কথা রাখতে তখনই ডাইনিং এ দাঁড়িয়ে দুলটা বদলে নিলো।
জেঠু বললেন,’বাবিন দ্যাখ মাকে আমার সাক্ষাৎ দুর্গাপ্রতিমা লাগছে’।বাবিন হেসে বললো,’তোমার হাত এই অধমের মাথায় একটু রেখো মা’।পাপান হো হো করে হেসে উঠলো।তিতির বাবিনকে জিভ ভেঙিয়ে জেঠুর খাবার বাড়তে শুরু করলো।
বাবিন বললো,’প্রায় একযুগ বাদে দেখা তোমার সাথে।রিটায়ার করবার আগে যেন তোমার কোথায় পোস্টিং ছিলো জেঠু?’
জ্যেঠু বললেন,’সুন্দরবন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট’।
তিতির সাজানো থালা জ্যেঠুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,’আপনি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক যখন তখন তো আপনার প্রচুর অভিজ্ঞতা’।
বাবিন বলে উঠলো,’সত্যিই জেঠুর প্রচুর অভিজ্ঞতা।ছোটবেলায় জেঠুর কাছে গল্প শুনতে বসলে রাত কাবার হয়ে যেত ‘।তিতির বললো,’তাহলে আজ রাতে জেঠুর গল্প শুনবো।কি জেঠু শোনাবেন তো?’
‘কিগো ড্যাংড্যাং করে চলে এলে যে বড়!বলি নিজের জামাকাপড়,ওষুধপত্র কিছু এনেছো?কাল যখন বললাম পাপানকে গিয়ে রেখে এসো,তখন তো শরীরের অজুহাত দেখিয়ে আসতে রাজি হলেনা’।
জ্যেঠিমার কথার উত্তর না দিয়েই জেঠু বললেন,’রান্নাটা কিন্তু বেড়ে হয়েছে বৌমা।অনেকদিন বাদে এইরকম কচিপাঁঠার ঝোল খাচ্ছি।আমার বরাদ্দ তো ওই পিন্ডির মতো গলা ভাত,এক বাটি পানসে সেদ্ধ সবজি আর পেঁপে কাঁচকলা দিয়ে ট্যালট্যালে মাছের ঝোল’।
জ্যেঠিমা মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন,’ওই রকম খাবারই খেতে বলেছে ডাক্তার।আমি তো আর সখ করে ওসব পিন্ডি রেঁধে খাওয়াইনা’।জ্যেঠিমার কথা শেষ হতে না হতেই পাপান টেবিল ছেড়ে উঠে হাত ধুতে বেসিনে গেলো।
জেঠু হো হো করে হেসে বললেন,’বুঝলি বাবিন বাঘকেও ডরাইনি কোনদিন।কিন্তু তোর এই জ্যেঠিমাকে…’।
তারপর মাংসের হার চুষতে চুষতে তিতিরের দিকে তাকিয়ে বললেন,’তা মা শুনতে চাইছো যখন অবশ্যই শোনাবো।তবে কি জানো, জীবন হাতে নিয়ে কাজ।একটু বেসামাল হয়েছো কি প্রাণ হারিয়েছো।কতবার যে কত অঘটন ঘটতে ঘটতে বেঁচে গেছি’।
একটু থেমে বাবিনের দিকে চোখ টিপে গলাটা গম্ভীর করে নিয়ে বললেন,’এখন ভাবি ভালোই হতো বুঝি প্রানটা গেলে।তোর জ্যেঠিমার রান্না করা ওইসব অখাদ্য-কুখাদ্য গিলতে হতোনা’।
এবার জ্যেঠিমা শব্দ করে চেয়ার সরিয়ে ডাইনিং ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন।জেঠু আবারো হো-হো করে হেসে উঠলেন।
তিতির চিন্তাগ্রস্ত মুখে বললো,’আমি জানতাম না জেঠু আপনি আসবেন।তাহলে জ্যেঠিমার কাছ থেকে জেনে নিয়ে সেভাবেই রান্না করে দিতাম।এতো তেল মশলা যুক্ত খাবার খাওয়ানো ঠিক হলোনা’।
জেঠু হেসে বললেন,’আরে কিচ্ছু হবেনা মা।আমি তো আর রোজ খাচ্ছি না।মাঝেমাঝে মুখ না বদলালে বুঝবো কি করে বেঁচে আছি?’
একটু দম নিয়ে বললেন,
‘রিটায়ার করবার কিছুদিন পর থেকেই শরীরটা খারাপ করছে।আজ এটা কাল সেটা করে লেগেই রয়েছে’।
বাবিন বললো,’আরে জেঠু শরীর থাকলে শারীরিক উপদ্রবগুলি ও থাকবে।এগুলো কে যত বেশী পাত্তা দেবে,তত চেপে বসবে’।
তিতির সবার এঁটো থালা বাটী এক জায়গায় করে নিয়ে এবার রান্নাঘরে চলে গেলো।শেফালিদি আবার কাল সকালে আসবে।তিতির নিজেই কিছুটা বাসন মেজে রাখলো।তারপর রাতে জেঠুর খাবারের জন্য সবজি কাটতে বসলো।
সুদর্শন রান্নাঘরে এসে দেখলো তিতির ব্যথা পা মুড়ে মেঝেতে বসে সবজি কাটছে।
সুদর্শন বললো,’আমায় একবার ডাকতে কি হয়েছিলো পাখি?আমি কি মরে গেছি নাকি!কোন আক্কেলে হাটু মুড়ে বসলে সবজি কাটতে?আর দরকারই বা কি?রাতের খাওয়ার আমি আনিয়ে নেবো’।
তিতির বললো,’ব্যথাটা সেইভাবে আর কষ্ট দিচ্ছেনা।আর শুনলে তো জেঠুর বরাদ্দ খাবার।আমার তো ভয় করছে এখন।শরীর খারাপ না হয়ে যায় ওনার।তুমি গিয়ে বরং জেঠুকে একটা এন্টাসিড খাইয়ে রেস্ট নেওয়ার ব্যবস্থা করে দাও’।
সুদর্শন বললো,’আর আমি যে তোমাদের বাড়ীতে যাওয়ার জন্য গাড়ী বুক করে দিয়েছিলাম।সেটার কি হবে!তিতির বললো,’কী আবার হবে?বুকিং কেন্সেল করে দাও।বাড়ীতে লোকজন রেখে আমি নিজের বাড়ীতে আরাম করতে যাব নাকি!কি যে বলোনা তুমি!’
সুদর্শন অবাক চোখে তিতিরকে দেখতে লাগলো।মনে মনে বললো, সত্যিই তোমরা মহান।তোমরা কত সহজে অন্যের বাড়ীকে নিজের ভেবে নিয়ে সেই বাড়ীর লোকজনদের সুবিধা অসুবিধার কথা ভেবে নিজেদের সামান্য খুশী,আনন্দকে বিসর্জন দিয়ে দিতে পারো।(চলবে)
(পর্ব-২৯)
“চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে,অন্তরে আজ দেখবো যখন আলোক নাহিরে”, ছাদের জামাকাপড় গুলো তুলতে তুলতে আপন মনে গাইছিলো তিতির।
হঠাৎই মনে হলো যেন পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে। সুদর্শন ভেবে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলো পাপানের দাঁত বের করা মুখ।
তিতির মাথাটা ঠান্ডা রেখেই প্রশ্ন করলো,’জেঠু কি ঘুম থেকে উঠে গেছেন?পাপান মাথা নাড়াতেই বললো,’আচ্ছা,তোমারা ডাইনিং এ গিয়ে বসো,আমি সবার জন্য চা আনছি’।
তিতির সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাওয়ার আগেই পাপান গেয়ে উঠলো,” ধরায় যখন দাও না ধরা হৃদয় তখন তোমায় ভরা/এখন তোমার আপন আলোয় তোমায় চাহিরে”,তিতির ঘুরে তাকাতেই পাপানের মুখে অদ্ভুত হাসি।
তিতির বিরক্ত গোপন রেখেই নীচে নেমে এসে চায়ের জল চাপালো।
তিতিরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে,পাপান ছেলেটি অত্যন্ত অভদ্র।প্রথম থেকেই পাপানের চাউনি,কথাবার্তা ওর অস্বাভাবিক লাগছে।কিছু একটা ব্যবস্থা নিতে হবে এই ছেলের জন্য।
তিতিরের হঠাৎই নিজের বাড়ির কাজের মাসির কথা মনে পরলো।
কাজের মাসি বলতো,’ ছেলে গুলোন যেন সব এক একটা জ্যন্ত জানোয়ার,’তিতির হেসে ফেললো।মনে মনে বললো,সব ছেলে নয় মাসি,কিন্তু কিছু ছেলে তো অবশ্যই।
তিতির ট্রে-এর মধ্যে কাপ গুলো সাজিয়ে নিয়ে,যত্ন করে চা ঢাললো।আর একটা ছোটো প্লেটে বিস্কুট আর চানাচুর ঢেলে প্লেটটাও ট্রে-এর ভিতরে বসিয়ে নিলো।
ঢুকতে গিয়েই জেঠুর কথা কানে এলো,’আমাদের বাবিনের বৌটা কিন্তু বড্ডা লক্ষ্মীমন্ত।অনুশ্রী,তৃনা বাড়িতে নেই,অথচ দেখো কি সুন্দর গুছিয়ে সব সামলাচ্ছে’,জেঠিমা মুখ বেঁকিয়ে বললো,’তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি,এ মেয়ে খুব চালাক….কথা শেষ না হতেই ,তিতির চা নিয়ে ঢুকলো।
কে কি বললো ব্যাপারটা আজকাল তিতির গায়ে মাখেনা।বরং মজাই পায় সে।ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি খেলে গেলো তিতিরের।
বাবিন,পাপান কেউই নেই ডাইনিং এ।অগত্যা তিতির চায়ের ট্রে-টা টেবিলের উপর রেখে ওদের ডাকার জন্য বেরিয়ে গেলো।
সুদর্শন এখন অলস ভঙ্গিমায় ইজিচেয়ারে বসে।একটু আগেই ঘুম ভেঙে গেছে।হাতের কাছের রাইটিং প্যাড আর কলমটা এখন সুদর্শনের বুকের উপর।তিতির দরজার উঁকি মেরে চায়ের কথা বলে গেলো।
পাপান ছাদে আছে বুঝে সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে ডেকে পাপানকে ও চায়ের জন্য আসতে বললো।
সুদর্শনের হাতের কলম তিতিরকে দেখেই কাগজের শ্বেত স্তন চিঁড়ে কথা বলে উঠলো,
শেষ বিকেলের লাজুক আকাশ..
দিকচক্রাবালে দেখি তোমারই
ঘামে ভেজা মুখ।
বিন্দু বিন্দু মুক্তোদানা
বুকের গভীরে গিয়ে,
মিশে যায় বক্ষবেষ্টনীতে।
তোমার বুকের ঘ্রান
মৌন করে আমার পৃথিবী,
তোমাকে দিলাম যা
সেটুকুই অর্জন,সেটুকুই প্রাপ্তি আমার।
‘কী হলো আসবে তো,চা তো ঠান্ডা জল হয়ে গেলো।সুদর্শন তাড়াতাড়ি কাগজের প্যাডটা টেবিলে রেখে দিয়ে বললো,’আসছি পাখি’।
চা পর্ব মিটতে মিটতে সন্ধ্যে সাতটা বাজলো।পাপান নিজে থেকেই বললো,’বাবিন দা চলো আজ সারা রাত ঠাকুর দেখি।বাবিন পাখির দিকে তাকিয়ে বললো,’যাবে পাখি? চলো ঘুরে আসবে’।
পাপানের মুখটা চকচক করে উঠলো। সেটা খেয়াল করেই তিতির বললো,’না না আমি যাবোনা।ভিড় ঠেলে ঠাকুর দেখা পোষাবে না আমার।তাবলে তোমারা যাওয়া কেন্সেল কোরোনা’।
পাপানের উৎসাহী মুখটা চুপসে গেলো।
ভেবেছিলো তিতিরের সাথে ভালোভাবে মিশতে পারবে।
এই তিতির মেয়েটাকে দেখার পর থেকেই বুকের ভিতরটা কেমন খাঁ খাঁ করছে।ওকে কিছুতেই বৌদি বলে মানছে না মন।
বরং মন বলছে,বাবিনদার সাথে ডিভোর্স করিয়ে নিজেই বিয়ে করে নেয়।
হয়তো তিতির ওর মনের ভাব কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে,সে কারনেই এড়িয়ে চলতে চাইছে ওকে।কিন্তু কতো দিন!!
বাবিন আর গাড়ি বের করেনি,বাইকে নিরুৎসাহিত পাপানকে নিয়েই বেড়িয়ে গেলো ঠাকুর দেখাতে।
তিতির ব্যালকনি থেকেই ওদের যাওয়া দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা দিলো।প্রায় সাড়ে দশটা বাজে,জেঠু-জেঠিমা দুজনেই এতোক্ষণে ঘুমের দেশে।
ঘাড়ের কাছের খোপাটা খুলে দিতেই এক ঢাল চুল পিঠের উপরে।তিতির সময় নিয়ে চুলটা আঁচড়ে বেনী বেঁধে, ক্যাচার দিয়ে চুলটা মাথার উপরে তুলে দিলো।বাথরুমে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে সাওয়ার নিলো।তারপর হাল্কা নাইটি গায়ে বিছানায় সারাদিনের ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলো।
নিমেষেই রাজ্যের ঘুম এসে গ্রাস করলো তিতিরকে।হঠাৎই মনে হলো প্রচন্ড আওয়াজ হচ্ছে।
চোখ মেলে একটু ধাতস্থ হওয়ার পর বুঝলো,কেউ প্রানপনে তিতিরের দরজা ঢাক্কা দিচ্ছে।তিতির চোখ কচলাতে কচলাতেই কোনোরকমে হাউজকোটটা গায়ে চাপিয়ে দরজা খুলে বেড়িয়ে দেখে জেঠিমা দাঁড়িয়ে।
‘কী ব্যাপার জেঠিমা,এতো রাতে এখানে?ঘুমোননি এখনো?’,তিতিরের কথায় জেঠিমা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন।কোনোরকমে বললেন,’তোমার জেঠু’।
তিতির এক ছুটে জেঠুর ঘরে গিয়ে ঢুকলো।দেখলো,জেঠু উপুড় হয়ে খাটে শুয়ে।শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে জেঠুকে সোজা করে শোওয়ালো তিতির।দেখলো জামাটা ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে,মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ,চোখ বিস্ফারিত।
আচ্ছা জেঠিমা তোমার কাছে প্রেসারের কোনো ওষুধ আছে,থাকলে তাড়াতাড়ি দাও’।
জেঠিমা বললেন,’,তোমাদের ড্রয়িং রুমে আমার ব্যাগটা আছে,ওখানেই…’
তিতির কোনরকমে ছুটে গিয়ে ড্রয়িং রুম থেকে ব্যাগটা এনে,মেঝেতে উপুড় করে ঢেলে দিলো।তারপর ওখান থেকে দুটো সলবিটেড নিয়ে অনেক কষ্টে জেঠুর মুখ খুলে জিভের তলায় ঢুকিয়ে দিলো।
জেঠিমা তখনো একনাগাড়ে কেঁদে চলেছেন।তিতির বুঝলো,ইমিডিয়েটলি একটা এম্বুল্যান্স বুক করে জেঠুকে নার্সিংহোমে এডমিট করতে হবে।কিন্তু এই পুজোর সময়ে ডাক্তার যদি না থাকে!,অজানা আশঙ্কায় তিতিরের বুক কেঁপে উঠলো।
তিতির টেলিফোন ডায়রেক্টারি দেখে তখনি এম্বুলেন্স বুক করে,ঘরে গিয়ে নাইটি বদলে শাড়ি পরে নিলো।আলমারি খুলে নিজের জমানো টিউশনের টাকাগুলো হাত ব্যাগে ভরে জেঠুর ঘরে ঢুকলো।
জেঠিমাকে বললো,’সময় খুব কম,এক্ষুনি এম্বুলেন্স আসবে,জেঠুকে বাড়িতে রাখা ঠিক হবেনা।আমি যাচ্ছি,বাবিনদের রাস্তায় বেড়িয়ে ফোন ক’রে ডেকে নেবো,তুমি চিন্তা কোরোনা, আমি আছি’।
তিতিরের হাত চেপে ধরে আবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন জেঠিমা।
রাস্তায় প্রচন্ড ভিড়ের ভিতর দিয়ে সাইরেন বাজিয়ে এম্বুলেন্স ছুটছে।অক্সিজেনের ব্যবস্থা থাকায়,তিতির সামান্য নিশ্চিন্ত।
যে মেয়েটা স্কুল,কলেজ জীবনে কখনো একা বের হয়নি,আজ সেই মেয়েটিই কোথা থেকে এতোটা মনের জোর পেলো সে নিজেও জানেনা।
ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে না গিয়ে ওর মন শুধু একটা কথাই বলছে,জেঠুকে বাঁচাতেই হবে।
আসলে দূর থেকে সব সমস্যাই তীব্রতর মনে হয়।কাল্পনিক আতঙ্ক আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে।
সর্বদাই সেই কল্পিত আশঙ্কা আমাদের বিপর্যস্ত করে।
একবার যদি সাহসে বুক বেঁধে সেই সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়ানো যায়,তাহলে সহজেই উৎকণ্ঠার কারনটিকে ঠান্ডা মাথায় প্রশমিত করে আতঙ্কের নিরসন ঘটানো যায়।
তিতিরের সাহসী পদক্ষেপ আজ হয়তো সুদর্শনের জেঠুর প্রান ফিরিয়ে দিতে পারে।
(চলবে)
(পর্ব-৩০,#অন্তিম পর্ব)
সময়ের হাত ধরে আরো একবছর এগিয়ে গেলো তিতির।
বসিরহাটের জেঠু এখন সম্পূর্ণই সুস্থ।তিনি বসিরহাটের বাড়িঘর বিক্রি করে তিতিরদের পাশের পাড়াতেই একটা ফ্ল্যাট নিয়েছেন।
বেশ খোশ মেজাজেই আছেন তিনি।মাঝেমাঝেই এসে আড্ডা বসান কৌশিক, অঞ্জন আর দেবের সাথে।
জেঠিমার কথায়, সে রাত্রে তিতিরের কারনেই ওনার সিঁথির সিঁদুর এখনো অক্ষত।তিতিরের মতো একটা করে মেয়ে যেন প্রতিঘরে থাকে।
তবে জেঠুর ফ্ল্যাট কেনবার কারনে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে তিতির,আর সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছে পাপান।
এই বাড়িতে থেকে পাপান আর তিতিরকে সারাক্ষণ জ্বালাবার সুযোগ পায়না,এটাই তিতিরের খুশির কারন।
তবে তিতিরকে দেখতে না পাওয়াটা পাপানের কাছে বিশাল বড়ো শাস্তি।
তিতির তার সংশপ্তকের পড়ানো,নিজের পড়াশোনা,চাকরির ইন্টারভিউ, সংসারের কাজে পুরোদমে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছে।
তাছাড়া সংশপ্তকে ছাত্র ছাত্রীর পরিমান বেড়ে গেলেও তিতির আর ওর বেকার দেওর দীপ ছাড়া আর কেউ-ই নেই পড়াবার মতো।
কলেজের পড়া শেষ হতেই তিতিরের অনুরোধে দীপ সংশপ্তকে পড়ায়।সঙ্গে চাকরির পড়াও পড়ে তিতিরের সাথে।কে বলবে ওরা দেওর-বৌদি।দেখে মনে হয় দুই ভাই-বোন।
অবশ্য পাপান নিজে থেকেই উৎসাহ দেখিয়েছিলো সংশপ্তকে পড়াবার।কিন্তু তিতির বিশেষ পাত্তা দেয়নি।এই ছেলেটির থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল।
তবে রবিবার দিন পাপান নানা অছিলায় তিতিরদের বাড়ি আসে।দীপ কিছুটা বুঝতে পারে বলে পাপান আসলেই সে তার বৌমুনির সাথে গল্প জোড়ে।
আজকাল অর্না-পর্না দুজনেই বেশ পছন্দ ক’রে তিতিরকে।করবে নাই বা কেন,তিতির তো যখন তখন কারন ছাড়াই ওদের ছোট বড়ো নানান উপহার দেয়।
তৃনা আজকাল আর কথায় কথায় তিতিরের খুঁত ধরে বেড়ায়না।বরং বেশ খুশিই হয় যখন দেখে তার দুই মেয়েই তিতিরের কাছে মন দিয়ে পড়াশোনা করে।
প্রতিদিনই রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে বইপত্র নিয়ে তিতিরদের ঘরে চলে আসে।ঘন্টা খানেক পড়ে ফিরে আসে নিজেদের ঘরে।
আজকাল সুদর্শন আর তিতিরকে সেভাবে পায়না।মনের ভিতর অভিমানের পাহাড় জমছে ক্রমশঃ।
এরমধ্যেই হঠাৎ একদিন সুদর্শন অফিস পৌঁছোতেই বসের রুমে ডাক পরলো।
‘গুড ইভিনিং স্যার,মে আই কাম ইন?’,সুদর্শনের কথায় মিস্টার রেড্ডি বলে উঠলেন, ইয়েস ইউ মে কাম ইয়ং বয়।
হাতের ফাইলটা বন্ধ করে দিয়ে বললেন,’আওয়ার বোর্ড অফ ডিরেক্টরস হ্যাভ সিলেক্টেড ইউ টু হেড দ্য নিউ প্রোজেক্ট ইন দ্য ইউ.এস ব্রাঞ্চ।ইউ উইল হ্যাভ টু জয়েন ফর্ম নেক্সট মান্থ।
সুদর্শন হ্যান্ডশেক করে বের হতেই মনের মধ্যে হাজার প্রজাপতির ছোটাছুটি।
সবার আগে মামুনি আর তিতিরকে খবরটা জানাতে চাইলো।আজ সুদর্শন দারুন খুশি।এই নতুন প্রোজেক্টটা নিয়ে সে ও তার কলিগরা দিন রাত এক করে অনেক খেটেছে,নিজেদের প্ল্যান বানিয়ে সাবমিট ও করেছে।
তবে ভাবতে পারেনি এতোজন এফিসিয়েন্ট লোকজনকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র সুদর্শনই সিলেক্টেড হবে।সুদর্শন ঠিক করলো,আজ সবাই মিলে বাইরে খাবে।সেই হিসেবে ফোন করে ‘ব্লু-হেভেন’ রেস্টুরেন্টের দুটো টেবিল ও বুক করলো।
আনন্দে চোখে জল চলে এলো সুদর্শনের।তিতিরকেও সম্পূর্ণ নিবিড় ক’রে ফিরে পাবে এই আনন্দেও।সুদর্শন সময়ের আগেই সোজা ব্লু-হেভেনে চলে গেলো।
নির্দিষ্ট করা টেবিলে বসে,আবার ফোন করলো মামুনিকে।আজ যেন আর দেরি সইছে না।
বাড়ির সবাই আসতেই সুদর্শন দরজায় গিয়ে তার মামুনিকে জড়িয়ে ধরলো।
তারপর বললো,’জানো মামুনি,গত ছয় মাস ধরে কোম্পানির একটা নতুন প্রোজেক্টের ওপর আমাদের সবাইকেই কাজ করতে হচ্ছিলো’।
অনুশ্রীকে চেয়ার টেনে বসিয়ে দিয়ে বললো,’বলা হয়েছিলো,যার প্ল্যান-প্রোগ্রাম বোর্ড ওফ ডিরেক্টররা সিলেক্ট করবে সেই এই প্রোজেক্টের হেড হয়ে কাজ করবে’।
একটু থেমে বললো,’আমি সিলেক্টেড মামুনি,সব্বাইকে ফেলে শুধুমাত্র তোমার বাবিনের নাম সিলেক্ট হয়েছে।শুধুমাত্র এই খুশিটা শেয়ার করার জন্য আমি এতোটা বেশি উদগ্রীব ছিলাম।আজ যার যা ইচ্ছে অর্ডার করো,আমি কার্ডে পেমেন্ট করবো’।
অনুশ্রী আনন্দে কেঁদে ফেললো।বললো,’আমি চাই সাফল্যের শিখরে তোমায় দেখতে’।
তিতির সহ বাকিরাও প্রচন্ডই খুশি।সবাই ওরা একসাথে হাততালি দিয়ে উঠলো।মিলিত হাততালি থামিয়ে সুদর্শন জানালো,’এই প্রোজেক্টের কাজ হবে ইউ.এসে।আমি আর তিতির খুব তাড়াতাড়ি ইউ.এসে যাচ্ছি’।
কেউ এবার আর হাততালি দিতে পারলোনা,এমনকি তিতিরের মুখটা ও আনন্দ-বিষাদের মাঝামাঝি কোনো এক জায়গায় থমকে।
একদিকে সুদর্শনের সাফল্যে আনন্দ অন্যদিকে সবাইকে ছেড়ে যেতে হবে শুনে বিষাদ।তিতির যে সবাইকে নিয়েই এক সাথে থাকতে চায়।
হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিতির বলে উঠলো,’তুমি অন্য কাউকে তোমার প্রোজেক্টের প্ল্যান প্রোগ্রাম বুঝিয়ে,তোমার জায়গায় তাকে পাঠাতে পারবে না?’
তিতিরের কথায় প্রচন্ড গম্ভীর হয়ে যায় সুদর্শন। জানালো,তেমনটি সম্ভব নয়।তাছাড়া আমেরিকায় কাজের আরো বেশি সুযোগ।কোনো মূল্যেই সে এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়না।
তিতির বললো,’আমি কিন্তু যাচ্ছিনা’।সুদর্শন কিছুক্ষণ চুপ করে বললো,’বেশ’।
তারপর সবার পছন্দ জিজ্ঞেস ক’রে খাওয়ার অর্ডার দিয়ে দিলো।খেতে খেতে কথা তেমন আর এগোলোনা।
তিতিরের কথায় সবচেয়ে অবাক হলো অনুশ্রী আর তৃনা।নিজেরা চোখে চোখে কথা বলে এই মুহুর্তে চুপ থাকলো।
তবে দীপ-অর্না-পর্না দারুন খুশি তিতিরের আমেরিকায় না যাওয়ার সিদ্ধান্তে।সেটা ওদের চোখ মুখ দেখে যে কেউ বলে দেবে।
তিতিরের সিদ্ধান্তে সুদর্শন কিন্তু ভিতরে ভিতরে রক্তাক্ত হতে থাকলো।তবে কি তার এতো ভালোবাসা সব মিথ্যে!তিতির কি এখনো ভালোবাসতে পারেনি সুদর্শনকে!সুদর্শনের আনন্দ এখন গভীর বিষাদে পরিনত।
মনে মনে বোঝে মেয়েটি সবাইকে নিয়েই থাকতে ভালোবাসে।সেটা এপ্রিশিয়েট ও করে।কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি তো বুঝতে হবে তিতিরকে।
আরে সুদর্শন কি নিজে তার পরিবারকে ভালোবাসে না?এই পরিবারটাই তো তার ভালো থাকবার রসদ। বিদেশে অন্তত তিতির পাশে থাকবে ভেবেই সে মন স্থির করেছিলো।
তৃনা বাড়ি ফিরে তিতিরকে বললো,’আজ আর অর্না,পর্নাকে পড়াতে হবেনা।ওরা ক্লান্ত,আর তুমিও।বরং ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও গিয়ে।রাত অনেক হয়েছে’।
তিতির ঘর ছেড়ে যেতেই দুই জা বসলো আলোচনায়।
ওদিকে প্রমীলাও বেশ ভালো রেজাল্ট করেছে স্কুলে।শিউলি তাই একটু বেশি বেশিই কাজ ক’রে দেয় তিতিরদের বাড়ি।
‘বৌমুনি না থাকলে তার মেয়ের যে কি হতো’,ভাবলেও শিউরে ওঠে শিউলি।এতো ব্যস্ততার ফাঁকেও কিন্তু প্রমীলাকে অনেকটা করেই সময় দেয় তিতির।
তবে অনুশ্রী-তৃনা দুজনেই কিন্তু বাবিনের সাথে তিতিরের না যাওয়ার সিদ্ধান্তটা মেনে নিতে পারেনিএকেবারেই।মাঝেমাঝেই বিষয়টা নিয়ে আলোচনায় বসছে দুই জা।তৃনা বলেছে প্রয়োজনে গরম হতে হবে।
এদিকে অর্না,পর্না,দীপ তিনজনেরই প্রিয় বৌদি তিতির।এদের কারো সামনেই তিতিরকে কিছু বলা যায়না।
সুদর্শনের যাওয়ার সময় এগিয়ে আসতে থাকে।অনুশ্রী আলাদা করে ভরসা দেয় তার আদরের বাবিনকে, বলে তিতিরেরও পাসপোর্ট, ভিসা রেডি রাখতে।তিতির সুদর্শনের সাথেই যাবে।
একদিন সকালে তিতিরকে একা পেয়ে প্রশ্ন করেন অনুশ্রী,’বাবিনের সাথেই যাচ্ছো তো?’,অনুশ্রীর প্রশ্নে তিতিরের মনটা খারাপ হয়ে যায়।উত্তর না দিয়েই হাতের কাজগুলো সারতে থাকে।
সেদিন রেস্টুরেন্ট থেকে ফেরবার পর সুদর্শন আর একটা কথাও বলেনি তিতিরের সাথে।তিতির পাশে শুয়ে কাঁদছে বুঝেও আদর ক’রে চোখের জল মোছায়নি।দুজনের মধ্যে যেন এক অদৃশ্য দেওয়াল গড়ে উঠছে।
উত্তর না পেয়ে অনুশ্রী আবার বলেন,’কি হলো,উত্তর দিচ্ছো না যে।তোমার তো ওর সাথেই থাকবার কথা।ছেলেটা বিদেশে কি খাবে,কিভাবে থাকবে তার ঠিক নেই,আর তুমি এখানে থেকে সারাদিন হই চই ক’রে আনন্দ করে বেড়াবে সেটি হচ্ছে না’।
অনুশ্রীর কথা শেষ হতেই তিতির বললো,’ভালোই থাকবে তোমার ছেলে,এতো চিন্তা কোরোনা মামুনি’।
‘আরে ছেলেটা একা একা থাকবে বলেই কি বিয়ে দিয়েছিলাম আমরা?এতো কিসের গুমোর তোমার?বিয়ের পর বরের সাথেই থাকবার কথা।তা নয় উনি কোথাকার কোন শিউলি মাসির মেয়ের দায়িত্ব নিয়ে রেখেছেন,টিউশন করে খরচ যোগাচ্ছেন’।
একটু থেমে নিয়ে বললেন, ‘এসব আর চলবে না।দায়িত্ব নিতে হলে ওখান থেকেও নিতে পারবে।ছোটকাকুকে বললেই প্রমীলাকে বোর্ডিং এ রেখে পড়ানোর ব্যবস্থা করা দেবে।
তাছাড়া তুমি এখানে পরীক্ষা দিয়ে কোন পন্ডিত হবে শুনি?পড়তে চাইলে ওখানকার ইউনিভার্সিটিতেও পড়তে পারবে। আমি বাবিনকে বলে দিচ্ছি ওর সাথে যেনো তোমারো ফ্লাইটের টিকিট কাটে। তোমাকে আমেরিকাতেই যেতে হবে বাবিনের সঙ্গে এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত’।
তিতির কিছু না বলে,একেবারে ছুটে চলে গেলো ছাদে।ছাদে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পরলো তিতির।
অনুশ্রী এভাবে বলতে চাননি তিতিরকে।কিন্তু তিনি বেশ বুঝতে পারছেন,তিতির তাদের ছেড়ে আমেরিকায় বাসা বাঁধতে চায়না।
অথচ তিতিরেরও তো নিজস্ব সংসার,বর,সন্তানের সুখের অধিকার আছে,সেটা তো আর অস্বীকার করতে পারেননা অনুশ্রী।
তিতিরকে যে তিনি নিজের মেয়ের মতোই ভালোবেসেছেন।
তাই কোনোভাবেই চাননা,দীর্ঘ অদেখায় বাবিনের মন পালটে যাক,বাবিন ওখানে গিয়ে অন্য কোন নারীকে আঁকড়ে ধরুক।
অনুশ্রী জানেন ওখানকার ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সুযোগ পেয়ে আরো বেশি প্রস্ফুটিত হতে পারবে তিতির।
দিশেহারা মানুষের সঠিক দিক নির্নয়ের জন্য মাঝেমাঝে প্রকৃতির কোল জরুরি, উন্মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা জরুরি।এই মুহূর্তে তিতির সেই আকাশের দিকেই তাকিয়ে।
মামুনি এইভাবে তিতিরকে বকবে, নিজস্ব মতামত চাপিয়ে দেবে এ তিতিরের কল্পনার অতীত ছিলো।
তিতির তো চাইলে প্রথমেই সুদর্শনের সাথে আমেরিকায় যেতে রাজি হয়ে যেতেপারতো।আরে আমেরিকা তো তিতিরের ছোট বেলা থেকে স্বপ্ন।
শুধু যেতে চায়নি কারন বাবিন সহ ওদের সবাইকে নিয়ে এখানেই ঘর বাঁধতে চেয়েছিলো তিতির,সবাইকে নিয়েই স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলো তিতির।যদিও সুদর্শন সেদিনের পর থেকে একটা কথাও বলেনি তিতিরের সাথে।এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় গুমরে মরছিলো তিতির।
তিতির ভালো ভাবেই জানে,একবার চলে গেলে সুদর্শন আর এদেশে ফিরবার কথা ভাববে না,ওখানেই গ্রিন কার্ডের ব্যবস্থা করে নেবে।
হঠাৎই কবিগুরুর পৃথিবী কবিতার শেষ পঙক্তি মনে মনে আবৃত্তি করে উঠলো তিতির,
“হে উদাসীন পৃথিবী,
আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে
তোমার নির্মম পদপ্রান্তে
আজ রেখে যাই আমার প্রণতি”… এই বাড়িটিকেই পৃথিবীর এক আলাদা সত্তা হিসেবে নির্দিষ্ট করে নিজেকে এই বাড়ি থেকে বিযুক্ত করবার আগে যেন তার কাছেই আশ্রয় খোঁজা।
ঝরঝর ঝর্নার মতো তিতিরের দুগাল বেয়ে অশ্রুধারা নেমে যাচ্ছে।
‘কি বৌমুনি তুমি এই রোদের মধ্যে ছাদে দাঁড়িয়ে কাঁদছো’,অর্নার কথায় তিতির তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে ফেলে বললো,’ও কিছু নয়’।
খানিক থেমে বললো,’আচ্ছা অর্না যদি আমি আমেরিকায় তোমার দাদার সাথে চলে যাই,তাহলে তুমি, পর্না আর দীপ মিলে আমার সংশপ্তকের দায়িত্বটা নিতে পারবে না?’
তিতিরের কথায় কেঁপে উঠলো অর্না।’সেকি বৌমুনি,তুমি চলে গেলে তোমায় ছেড়ে থাকবো কি ক’রে আমরা?আর তোমার সংশপ্তক ও তো তোমায় ছেড়ে ভেঙে পরবে’।
তিতির অর্নার গালে হাত ছুঁয়ে বললো,’তা কেন?আমার দুই বোন এক ভাই থাকতে সংশপ্তক কিভাবে ভেঙে যাবে শুনি!তোমরা বরং তোমাদের পাপানদাকেও কিছুটা পড়াবার দায়িত্ব দিও।তেমন হলে নিজেদের বন্ধুবান্ধব কেও যুক্ত করো সংশপ্তকে।
অর্না তিতিরের কথায় তিতিরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো।তারপর পর্না আর দীপকে খবরটা দেওয়ার জন্য তিতিরকে সাথে করেই নীচে নামলো।
অনুশ্রীর কথায় তিতিরের পাসপোর্ট, ভিসা আগেই রেডি করে রেখে ছিলো সুদর্শন।দুদিন আগেই অফিস যাওয়ার আগে অনুশ্রীকে বলে গিয়েছিলো একটু দেখতে,যদি তিতিরকে রাজি করানো যায়।কারন এরপর রাজি হলেও আর কিছু করার থাকবে না।
অনুশ্রী ফোন করে আনন্দ সংবাদ জানাতেই সুদর্শন চিৎকার করে উঠলো,’ইউ আর মাই সুইট মম’।
অনুশ্রী ফোন রেখে মৃদু হাসলেন।
অনুশ্রী জানেন পুরুষ তার গভীর দুঃখকে গভীরতর নিভৃতিতে আড়াল করে রাখতে চায়।
ব্যক্তিগত দুঃখ অভিমান নিয়ে অন্যকে আক্রান্ত করতে বোধহয় তার পৌরুষে বাঁধে।
তিতির যখন এক কথায় নাকচ করে দিয়েছিলো,বাবিনের সাথে আমেরিকায় যাওয়ার প্রস্তাব,তখন বাবিনের দুঃখকে শুধু অনুশ্রীই পেরেছিলেন অনুধাবন করতে,সম্ভবত তৃনাও।
বাবিন মুখে কিছুই প্রকাশ করেনি।তাই ওর ব্যথা আরো তীব্রতর হয়ে ওকে ক্ষত বিক্ষত করছিলো,মা হয়ে এটুকু তো বুঝতেই পেরেছিলেন অনুশ্রী।
ভেবেছিলেন বাবিনের যাওয়ার দিন যত এগোবে, তিতির নিজেই অস্থির হয়ে উঠবে যাওয়ার জন্য।কিন্তু এ মেয়ের মধ্যে তেমন কোন হেলদোল দেখতে পাননি।সে কারনেই আজ অতো কিছু বলতে হলো তিতিরকে।
কিন্তু তিনি তিতিরকে বাবিনের চাইতে কম ভালোবাসেননি।তিতির তার ছেলের বৌ নয়,তিতির তার মেয়ে,তার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী।
ফোন ছেড়ে সুদর্শন অফিস ক্যান্টিনের ভিতরেই গেয়ে উঠলো,”কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশ কুসুম চয়নে।সব পথ এসে মিলে গেলো শেষে তোমারি দুখানি নয়নে”,আশেপাশের কলিগরা সব হেসে উঠলো।
রাতে সুদর্শন নিজেই তিতিরকে বুকের কাছে টেনে নিলো।তিতিরের চোখে জল সুদর্শনের গালে লাগতেই সুদর্শন চমকে উঠলো। তবে কি তিতির নিজের ইচ্ছেয় তার সাথে যেতে রাজি নয়!
তিতিরকে বসিয়ে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো,সে কি চায়?সত্যিই কি যেতে চায়না?
তিতির বললো,’না না আমি যাবো তোমার সাথে,তুমি অমন করে আমার থেকে দূরে সরে যেওনা’,তিতির কান্নায় ভেঙে পরে।সুদর্শন আবার কাছে টেনে নেয় তিতিরকে।
দুটি প্রান যখন দুজনেই দুজনের জন্য নিবেদিত,তখন অনেক আপাত তুচ্ছ ঘটনাও আর তুচ্ছ থাকেনা।মহার্ঘ্য হয়ে যায়।সামান্য আকাঙ্ক্ষার ও তাৎক্ষনিক পূর্নতা ভীষণ জরুরি হয়ে ওঠে।
অভিমানের পাহাড় ভেঙে অনুভবের এই সোনালী মুহুর্ত দুজনেরই হৃদয় বসন্ত বনে মাধুরি
ভরিয়ে দিচ্ছে।
পরের দিন সকালেই কৌশিক দেবকে নিয়ে গিয়ে টিকিট কেটে এনেছে।
খবরটা অনুশ্রীই এসে তিতিরকে দিলো।তারপর নিজেই উদ্যোগ নিয়ে তিতিরকে বাপের বাড়ি পাঠালেন।বললেন,’ওদেশে যাওয়ার আগে নিজের বাড়ি গিয়ে থেকে এসো দুদিন’।
তিতির এখন নিজের বাড়ির ছাদে।বাড়ির সবাই দারুন খুশি তিতির আমেরিকায় যাচ্ছে বলে।সবাই কিছু না কিছু উপহার দিচ্ছে।হাড়কিপটে দাদাটাও একটা টাইটানের সোনালি ব্যান্ডের ঘড়ি উপহার দিয়েছে।
তিতির শুধু ভাবছে,এটাই তার একমাত্র বাড়ি ছিলো,একমাত্র সুখের আশ্রয় ছিলো।তারপর হঠাৎই ছন্দপতন।
তার নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য একটি বাড়িকে নিজের ভেবে নতুন নতুন স্বপ্ন গড়া।তাদের ভালোবেসে নিজের করে নেওয়া।আর আজ সেই বাড়ির সবাইকে ছেড়ে তাকে আরো একবার বাসা বাঁধতে হবে।যদিও সেখানে তার ভালোবাসার মানুষটি আছে।
তিতির ভাবছে,বিয়ে হয় একটি ছেলের সাথে একটি মেয়ের।কিন্তু বৈবাহিক সূত্রে মেয়েটি যাদের পায় তাদের সাথেও তার জীবন জড়িয়ে যায়।ভালোবাসায়, অভিমানে,রাগে, অনুরাগে সেই পরিবারটিকেও সে আপন করে নেয়।
তিতির জানেনা, জীবনে আর কতোবার তাকে বাসা বদলাতে হবে।
তিতির পাখিরা বাসা বাঁধতে চায়,খড়কুটোকে আশ্রয় ক’রে বাসা বাঁধে।কিন্তু তিতির পাখিদের নিজস্ব কোন বাসা হয়না।অন্যের বাসাকে নিজের ভাবে,আর সেই ভেবেই খুশি থেকে কাটিয়ে দেয় একটা গোটা জীবন।
তিতিরের ফ্লাইট আজ।তিতিরের এই বাড়ির মামুনি,কাকিয়া,বাবা,কাকাই,ছোটকাকু,অর্না,দীপ,পর্না
এমনকি জেঠু,জেঠিমা,পাপান সবাই এসেছে এয়ারপোর্টে।
হঠাৎই অনুশ্রী তিতিরকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ ক’রে কেঁদে ফেললেন।অনুশ্রীর মনে হচ্ছে নিজের মেয়েকেই বুঝি শ্বশুর বাড়ি পাঠাচ্ছেন তিনি।
ফ্লাইট এনাউন্স হয়ে গেছে। কৌশিক তিতিরের চিবুক ছুয়ে চুমু খেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বললেন,ভালো থাকিস মা আর আমার বাবিনকেও ভালো রাখিস।
বাবিন আর তিতির সবাইকে বিদায় জানিয়ে,প্রতিবছরেই আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, সবার অনেক অনেক শুভেচ্ছা আর শুভকামনা সহ রওনা হলো নতুন দেশে।তাদের জীবনে অপেক্ষা করে আছে অনেক অনেক অজানা সুখ।
আমাদেরও শুভেচ্ছা রইলো তিতিরকে।
(সমাপ্ত)