#তিতির_পাখির_বাসা,পর্ব-০১,০২,০৩
#জয়া_চক্রবর্তী
০২
বরাবরই স্বপ্নের জগতে থাকতে ভালোবাসতো তিতির। মৈত্রেয়ী দেবীর ণ হন্যতে থেকে শুরু করে দেশ পত্রিকা সবই গিলতো গোগ্রাসে।যদিও তার জন্য বরাদ্দ ছিলো চাঁদমামা-শুকতারা-হাঁদা ভোদা-নন্টেফন্টে-বাঁটুল দি গ্রেট।তিতিরের অবশ্য এই বই গুলোও দারুন লাগতো।
চোখ বুজলেই এদের সবাইকে সে দেখতে পেতো,কথাও বলতো এক সমুদ্র।
মাঝেমাঝেই শেষের কবিতার অমিত তার প্রেম গভীর স্বরে বলতো,”দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর,ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর”…….তিতির অস্থির হয়ে পরতো।মনে হতো ঐ অদেখা মানুষটির গভীরতা একমাত্র সে বুঝতে পারছে।
ছুটির অলস দুপুর গুলিতে বালিশে মাথা দিয়ে,আধশোয়া হয়ে, খোলা বই বুকের ওপর রেখে, সে ভেসে যেতো তার স্বপ্নের প্রেমিকের সাথে।তিরতির করে কাঁপতো চোখের পাতা।চোখ বুজে নিজের ঠোঁটের পাপড়ি দুটো সমর্পন করতো আরো দুটো পাপড়ির কাছে।সময় শেষ হয়ে যেতো।
বিকেলের নরম আলোয় এক রাশ ভালো লাগাকে সঙ্গী করে,কোলবালিশের আড়ালে লাজুক হেসে মুখ লুকোতো।
বাস্তবের ছেলেদের মোটেও তিতির পাত্তা দিতনা।অনেকেই চেষ্টা করতো তার মন জয় করতে।হয়তো মাঝেমাঝে কাউকে ভালো লাগতো,কিন্তু মোহভঙ্গ হতে দুদিনের বেশী লাগতোনা।বুঝতো এরা তার মনের সাথে পাল্লা দিতে পারবেনা।
এদের প্রত্যেকেই আমিত্ব ছেড়ে বের হতে পারেনি।যেন বাজারে এসে নিজের যোগ্যতা প্রমানে ব্যস্ত।তাই এদের যাবতীয় গুন তিতিরের চোখে পোকা ধরা বেগুন,যার ওপরটাই শুধু সুন্দর।
মনের সৌন্দর্য্য ধূপের মতো,যা ছড়িয়ে পরে আপন গুনে।আর দৈহিক সৌন্দর্য্য তিতিরকে যে খুব একটা টানে এমন নয়।কারন তা কোনও মানুষের নিজের হাতে নেই।তিতির নিজেও যে খুব রূপসী এমন নয়।তবে সব মিলিয়ে একটা আকর্ষন আসে তাকে দেখলে।
তিতির স্বপ্নের সাথে বাস্তব মেলাতে চায়।নিবিড় ভাবে কাউকে ভালোবাসতে চায়।কিন্তু পারেনা।চোখ ফেটে জল আসে তিতিরের।আরো ডুবে যেতে থাকে বই এ।
আরো অলস দুপুর কাটে হাতে হাত,চোখে চোখ,ঠোঁটে ঠোঁট রেখে।
ইতিমধ্যে বাড়ির লোকের চোখে তিতির বিবাহ যোগ্যা বলে গণ্য হয়।তিতির হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে কোলবালিশে মুখ গুজে।বাড়ির লোকে ভাবে নির্ঘাত কেউ আছে চোখের জলের আড়ালে।ভাৎসনাও জোটে যথেষ্ট।
দেরী না করে নিজেদের পছন্দ করা পাত্রের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় তিতিরের।শুভদৃষ্টির সময়ও সকলের অনুরোধকে সন্মান করে ,একবারও সে তাকায়নি সুদর্শনের দিকে।
আজ আবার বৌভাত।চারদিক ঝলমল করছে আলো।অতিথিদের দিকে তাকিয়ে তিতিরকেও সৌজন্যের দেঁতো হাসি হেসে পরিচয়পর্ব সারতে হচ্ছে।এরমধ্যে একসময় বিয়েবাড়ি খালি হয়ে যায়।বাড়ির মেয়েরা হাসাহাসি করতে করতে তিতিরকে একটা ফুল সাজানো ঘরে নিয়ে যায়।তিতিরের নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
ভয়ে বুকের তিতির পাখিটি ছটপট করতে থাকে।মেয়েগুলোর মধ্যে কয়েকজন গিয়ে সুদর্শনকেও ঘরের মধ্যে নিয়ে আসে।মেয়েটির দীর্ঘ চুল খুলে দেয় বলে সুদর্শনের পা নারকেল জল দিয়ে ধুয়ে, চুল দিয়ে মোছাতে হবে।তারপর সেই জল চরণামৃতের মতো মুখে নিতে হবে।
তিতিরকে সুদর্শন এটা করতে দেয়নি।সুকৌশলে মেয়েদের দলকে বের করে দরজায় আগল দিয়ে বলে,”আর ভয় পেতে হবেনা,চুপটি করে ঘুমিয়ে পরো।”………এই প্রথম সুদর্শনের দিকে তাকালো তিতির।
সাদামাটা ছেলেটিকে ভালো লাগলো।এই ভালো লাগাগুলো জমতে জমতেই একদিন হয়তো এক সমুদ্র ভালোবাসা হবে।
(চলবে)
#তিতির_পাখির_বাসা (২ পর্ব)
#জয়া_চক্রবর্তী
ইইইবাবা।এসব কি কথা।না না কিছুতেই নিয়ে যেতে পারবে না সুদর্শন কে।কে জানে লোকটা অপয়া কিনা।যদি ফার্স্ট ক্লাসটা এর জন্য কেচিয়ে যায়।তার ওপর বন্ধুদের মাঝে এই অতি শান্ত,নিরীহ,গোবেচারা লোকটাকে নিয়ে যাওয়া মানে সকলের হাসির খোরাক জোগানো।”
মনে মনে এমন লক্ষ কথা বলছিলো তিতির।
মাত্র এক মাস এগারো দিন আগে বিয়ে হয়েছে তিতিরের।মনে মনে সে যথেষ্ট বিরক্ত তার মা বাবার ওপরে।এদের হাবভাব ও মোটেই ভালো লাগছে না তার।সন্দেহ হচ্ছে বাকি জীবনটা গৃহবঁধু হয়েই না কাটাতে হয় তার।
“কি হলো তিতির?তৈরী হওনি?চটপট করো,”সুদর্শনের কথায় সম্বিত ফেরে তিতিরের।সত্যিই তো বড্ড দেরী হয়ে গেলো।কিন্তু কি করে বলবে ওকে যে তিতির একাই যেতে চায়।
তিতিরের চিন্তাচ্ছন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে সুদর্শন মৃদু হেসে বলে ,”ভয় করছে?আরে ভালোই হবে রেজাল্ট।”গম্ভীর মুখে তিতির বলে,”আমি কিন্তু একাই যাবো।”সুদর্শন বললো,”আচ্ছা,তুমি না চাইলে আমি যাবোনা।”
এবার তিতির নিশ্চিন্ত মনে শাড়ি পরলো।দীর্ঘ চুলটাকে আঁচড়ে একটা বেনী,ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক ,কানে ছোট্ট দুল,সিঁথিতে সামান্য সিঁদুর ছুঁইয়ে তিতির সুদর্শনের দিকে চাইলো।মনে হলো একটু বিষন্ন।উঃ হুঃএখন এসব ভাববার সময় নেই।দেরী হয়ে যাচ্ছে।
কাঁধে ব্যাগ ফেলে ঝড়ের গতিতে বের হতেই পাহাড়ের মুখোমুখি।
“একা যাচ্ছো নাকি?কিরে বাবিন ওকি একা যাচ্ছে নাকি?তোর কি কান্ডজ্ঞান নেই? ইত্যাদি নানান প্রশ্নবানে জর্জরিত হতে হতে বাবিনটি ও তৈরী হয়ে তিতিরের সঙ্গে চলে।
তিতির আর কথা বাড়ায় না।গাড়ীতে ও চুপচাপ থাকে।অবশেষে কলেজ।সুদর্শনকে দাঁড়াতে বলে তিতির প্রায় উড়ে কলেজে গিয়ে ঢোকে।
মনে এমনিতেই তখন দামামা বাজছে।চোখে সর্ষে ফুল।লিস্টের সামনে ও বড়সড় ভীড়।এই প্রথমবার ভয়ে তিতিরের হাত পা কাঁপছে।নামটা থাকবে তো?
সকাল থেকেই শঙ্কিত মন।হঠাৎ দেবযানী কোথা থেকে এসে তিতিরকে জড়িয়ে ধরলো।বললো ,”কপাল ফাটালি কবে?”,কথাটা বেশ মনে ধরলো তিতিরের।প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললো,”আমি লিস্ট দেখিনি এখনো”।
দেবযানী নিজেই ভীড় ঠেলে সামনে নিয়ে গিয়ে নাম দেখালো।তারপর হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলো ক্যান্টিনে।
বললো,”বিয়ে আর রেজাল্টের খুশিতে খাওয়াতে হবে।তুই অর্ডার দে,আমি বাকীদের ডেকে আনছি।সবাই মিলে জমিয়ে তোর বিয়ের গল্প শুনবো।”
তিতির চটপট দেখে নিলো ব্যাগে কত টাকা আছে।তাড়াহুড়োতে আলাদা করে কিছুই ঢোকানো হয়নি।মনেমনে হিসেব করে দেখলো দুটো করে এগ্ ডেভিল আর একটা করে কফি হয়ে যাবে।
এগডেভিলে ছোট্ট ছোট্ট কামড় আর এক এক চুমুক কফির আমেজ নিয়ে জমে উঠলো আড্ডা।সুদর্শনকে আনতে চায়নি বলেই হয়তো ভুলে গেলো ওকে দাঁড় করিয়ে রেখে আসবার কথা।
বাইরে তখন অস্থির সুদর্শন।ছট্পটে মেয়েটি এর মধ্যেই তার মনের অনেকটা জুড়ে।অকারন ব্যস্ত পায়ে সিঁড়ি ভাঙা- চানঘর বন্ধ হলেই এক নাগাড়ে গান নয়তো কবিতা পাঠ করা-অপছন্দের কথা কিছু বললেই জিভ বের করে ভেঙানো…….সব মিলিয়ে নিজের থেকে সম্পূর্ন বিপরীত চরিত্রের মেয়েটিকে ভালো লেগে গেছে তার।
কিন্তু কি হলো এতো দেরী করছে……সকাল থেকেই আনমনা।একাই আসতে চাইছিলো।
আরে ঐতো তিতির বের হলো।সঙ্গে এক দঙ্গল ছেলে মেয়ে।কিন্তু তিতির কোথায় যাচ্ছে ওদের সাথে?সুদর্শন কে কি ভূলে গেলো?ড্রাইভারকে ইশারায় পেছনে আসতে বলে সুদর্শন ও হাঁটতে থাকলো।
কি মনে হতে তিতির পেছনে তাকালো।দূর থেকে হেঁটে আসা লোকটাকে বড্ড চেনা লাগছে।আরে এর সাথেই তো বিয়ে হয়েছিলো।আজ তো ওর সাথেই এসেছিলো, বেমালুম ভুলে গেছে।এখন যে কি করে তিতির!!
বন্ধুদের হাত ছেড়ে ছুটে এসে সুদর্শনের কাছে ক্ষমা চাইতে যেতেই ওর হাতে আলতো চাপ দিয়ে সুদর্শন বললো,”আমি আছি তো, আমি থাকবো,তুমি কথা বলে নাও ওদের সাথে”।
(চলবে)
#তিতির_পাখির_বাসা(পর্ব-৩)
#জয়া_চক্রবর্তী।
মন বলছে,”প্রতিবাদের ভাষা মুখে,সবার আগে দাঁড়াও রুখে”…কিন্তু পারছে কই??ভাবনার অজস্র-অনুচ্চারিত শব্দরা মুক্তির প্রহর গোনে,বিধ্বস্ত মন পতাকা পালটায় অথচ মুখে সুদর্শনকে কিছুই জানাতে পারেনা তিতির।
তবে কী লিখে জানাবে?যদিও অনাহারী মন তিতিরকে কলম ধরতে মানা করে।তবে এই কয়দিনেই বুঝে গেছে তিতির যে, প্রতিশ্রুতি দিলেও তিতিরকে পড়াবার ব্যাপার নিয়ে, শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের কোন মাথাব্যথা নেই।
কতগুলো ছেঁড়া জীর্ন রাত,নির্জন দুপুরকে বুকে জড়িয়ে তিতিরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনারা রাতের বালিশ ভেজায়,তবে কী সারা জীবন গৃহবধূ হয়েই থেকে যাবে সে??
না-না-না কিছুতেই সম্ভব নয়।অবশেষে হাতিয়ারটা নিজেই তুলে নিলো তিতির।রাতে খাওয়ার টেবিলে সবার সামনে সোজাসুজি সুদর্শন কে জানালো,”আই ওয়ান্ট ডিভোর্স”।
তারপরেই সোজা বেডরুম, শুয়ে শুয়েই তিতিরের কানে আসতে থাকে টুকরোটুকরো কথাবার্তা, যার কিছুই প্রায় তিতিরের মাথায় ঢুকছিলোনা।তিতির যে সিদ্ধান্তটা ভীষন ভুল নিয়ে ফেলেছে,হয়তো সেসব নিয়েই আলোচনা চলছে,সে যাই-ই চলুক তিতিরের কী?বরং বলে দিতে পেরে খানিকটা ভারমুক্ত সে…এবার একটা টেনে ঘুম দিতে হবে,বেশ কয়েকটা হাই তুলে কোলবালিশটায় নাক ঘসে আমেজে চোখ বুজলো….”মুক্তি-মুক্তি-মুক্তি”,ছোট্ট একটা শব্দ অথচ কি তৃপ্তির,কি শান্তির”।
কিন্তু চোখ বুজলেও ঘুম যে কেন আসছেনা তিতিরের….কোথাও কি কোন ভুল করে ফেলেছে সে?”কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয়”….”যে সয় সেই রয়”…এমন অনেক কথা তার মাথায় আসছে।শুনেছিলো হয়তো আগে।ছোট থেকেই তো কত জন কত জ্ঞান ফ্রিতে দিয়ে গেছে,অবচেতন মনে সেসবের কিছু কিছু রয়ে গেছে হয়তো।
তিতির উঠে বসে ঢকঢক করে গলায় জল ঢাললো,খাওয়ারটা না খেয়েই ডিভোর্সের কথা শুনিয়ে চলে আসাটা ভুল ছিলো,খিদেতে এখন নাড়িভুঁড়ি বেড়িয়ে আসবার জোগাড়।
সুদর্শনের মনে ওদিকে এলোপাথাড়ি ঝড় বয়ে চলেছে…কি শুনিয়ে গেলো পাখিটা??ডিভোর্স চায়??!!কিন্তু কেন??কাজের জন্য হয়তো সময়টা কম দিতে পারে তিতিরকে,কিন্তু এই তিন মাসেই ওর মনের আনাচেকানাচে তিতির যে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
নেক ব্যস্ততার মধ্যেও বাড়ী ফিরলে তিতিরের মন খোলা হাসি ওর কাছে এক ঝাঁক মলয় বাতাস,তিতির ওর অক্সিজেন, বেঁচে থাকবার রসদ।সুদর্শন বুঝতে পারছেনা,এটা কি নিছক মজা!!ভয় পাওয়াবার কৌশল!!নাকি সত্যিই ডিভোর্স চায় তিতির!!
এদিকে তিতির ঘর ছেড়ে চলে যেতেই আলোচনার ঝড় উঠেছে ঘরে,ওরা নাকি জানতোই তিতির সংসারী মেয়ে নয়,এই মেয়ে যে ঘর করবে না সেটাও ওদের অজানা নয়।সুদর্শন কিছুক্ষন ভাত নাড়াচাড়া করে উঠে পরলো,তবে ঘরে যাওয়ার আগে কি মনে হতে প্লেটে এক হাতা ভাত,দুপিস চিকেন কষা নিয়ে নিলো।
তিতির বাইরে অন্ধকারের দিকে একমনে চেয়ে আছে,সুদর্শন ছদ্ম হাসি মুখে টেনে নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলো,বললো,”ডিভোর্স কি ক্যাডবেরি, যে চাইলেই দিয়ে দেওয়া যায়?? এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।কিন্তু ততদিন কি পাখিটা দানাপানি বন্ধ করে রাখবে?বলতে বলতেই ভাত মেখে গ্রোস করে তিতিরের মুখে ঢুকিয়ে দেয়,তিতির ও কথা না বলে চুপচাপ সুদর্শনের হাত থেকে খেতে থাকে।
(চলবে)