তিতির_পাখির_বাসা,পর্ব-১০,১১,১২

0
424

#তিতির_পাখির_বাসা,পর্ব-১০,১১,১২
#জয়া_চক্রবর্তী
পর্ব-১০

‘বাবিনরা কি আর ফোন করেছিলো দিদি?’প্রশ্নটা করেই উদ্বিগ্ন মুখে মাঝপথেই মশলা বাটা স্থগিত রেখে দিলো তৃণা মানে বাবিনের কাকিয়া।
‘নারে,সেই কালকা পৌঁছেই যা একবার ফোন করে জানিয়েছিলো,ওমা মশলা বাটাটা বন্ধ করলি কেন?’বলে গ্যাসটা নিভু আঁচে করে দিলো অনুশ্রী।

তৃনা হাত চালিয়ে মিহি করে পোস্তটা বেটে এগিয়ে দিলো জায়ের দিকে।
অনুশ্রী বাটিটা নিয়ে পোস্তটা কড়াইতে দিয়ে দু-একবার নাড়িয়ে এক কাপ দুধ আর ঘি দিয়ে ফুটিয়ে লাউশুক্তোটা নামিয়ে নিলো।
তারপর টাওয়াতে মেথি-তেজপাতা-রাধুনি ভেজে বেটে দেওয়ার জন্য এগিয়ে দিলো তৃনার দিকে।

তৃনা ভাজা মশলা বাটতে বাটতে বললো,’দেখলে তো দিদি,তিতির কেমন বাবিনের কাছে ডিভোর্স চাইলো?’
উত্তর না পেয়ে নিজেই বলতে থাকলো,’আজকালকার মেয়েদের সুখে থাকতে ভুতে কিলোয়’।

তৃনার কথা শুনে অনুশ্রী নিজেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়।প্রথম প্রথম অনুশ্রীর নিজেরও কি মন বসেছিলো সংসারে?
তখন তো আর ডিভোর্সের চল ছিলোনা।

অবশ্য থাকলেই বা কি হতো!তিনি তো আর বেশিদূর পড়াশোনা করেননি যে ডিভোর্স নিয়ে চাকরি করতেন।তার ওপর বাপের বাড়িতে অতো গুলো ভাই বোন।

দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো অনুশ্রীর।

কোন ছোট বয়েসে বিয়ে,সেই থেকেই সংসার টেনে চলেছেন।তার ওপর শ্বাশুড়ীর বাক্যবাণ তো লেগেই ছিলো।ননদ, জায়েরাও কিছু কম যেতো না।

সেই এক শব্দ আবহমান কাল ধরে চলে এসেছে অ্যাডজাস্ট,অ্যাডজাস্ট আর অ্যাডজাস্ট।

কথায় আছে ‘সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে’..অনুশ্রী বুঝেই পায়না,দুজন মানুষ বিয়ে করে সংসার বাঁধে অথচ সংসারকে সুখের করার যত গুন সব শুধু মেয়েদেরই কেন থাকতে হবে?

শ্বাশুড়ী গত হওয়ার পর সবাই যে যার মতোই ভিন্ন।শুধু তৃনারাই তাদের সাথে থেকে গেছে।তৃনার দুই মেয়ে তো জেম্মা বলতে অজ্ঞান।

তিতির কে প্রথম দিন দেখেই মনে ধরেছিলো অনুশ্রীর।কৌশিককে বলেছিলো এই মেয়েকেই আমার বাবিনের বৌ করতে হবে।কৌশিক ও নাকচ করে দেয়নি।বাবিনের তো ছবি দেখেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু বিয়ের পর তিনি নিজেই কি তিতিরের সাথে ভালো মুখে কথা বলেছেন?মেয়েটা কাজকর্ম করেনি কখনো।তবু শিখে নেওয়ার ইচ্ছেটা আছে।অথচ মেয়েটাকে কাজ নিয়ে খোটা দিতে ছাড়েননি।

বৌমার স্থান থেকে যেই তিনি শ্বাশুড়ীর স্থানে এসেছেন, অমনি তার ল্যাজও মোটা হয়ে গেছে।অনুশ্রী বুঝতে পারছে এই কারনেই সব মেয়েদের গল্প এক।

আজ হঠাৎ নিজের ব্যবহারে নিজেরই মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।তিনিও তো টিপিকাল শ্বাশুড়ী সুলভ ব্যবহারই শুরু করেছেন।

বাবিনের সাথে মেয়েটাকে দেখলেই কেমন যেন গা কুটকুট শুরু হয়ে যায় অনুশ্রীর।
কারনটা তিনি নিজেও জানেননা।

ওরা যেন একসাথে বেশী সময় কাটাতে না পারে তার জন্য তিনি নিজেও কম ফন্দিফিকির করেননি।

প্রতিদিন ইচ্ছে করে রাতেই মনে করে করে তিতিরকে এটা সেটা কাজ দিয়ে নিজের কাছে আটকে রেখেছেন।যেমনটি তার শ্বাশুড়ী করতেন।

আজ বহুদিন পর আয়নায় নিজের শ্বাশুড়ীর রূপ নিজের মধ্যে দেখে,কেমন যেন দমবন্ধ লাগলো অনুশ্রীর।এই কারনেই কি তিনি তিতিরকে এই বাড়ির বৌ করেছিলেন?

তিনি তিতিরের মা হতে পারবেননা কিন্তু তিতিরকে বন্ধুতো করতেই পারেন।কি জানি মেয়েটা কতো কষ্ট মনে পুষে রেখেছে।
যাওয়ার আগেও তো কথা বলেননি কোন তিতিরের সাথে।আজ খুউউউব খারাপ লাগছে অনুশ্রীর।

‘কিগো দিদি তোমার আবার কি হলো?সেই কখন থেকে কি অমন ভেবে চলেছো?বড়দা যে চা-চা হাঁক দিলো দুবার’…তৃনার কথায় সম্বিৎ ফিরে আসলো অনুশ্রীর।বললো,’তুই একটু বসিয়ে দেতো চা টা,আমি একটু ঠাকুরঘর ঘুরে আসি’…

ঠাকুরঘরে কোন কাজ নেই,কিন্তু মনটা বড্ড উতলা আজ।শাড়ী পালটে ঠাকুরঘরে ঢুকে জোড় হাত করে মাকে নমস্কার করলেন।

মাকে বললেন,’জানো মা,আমাদের মেয়েদের জন্যই আজ মেয়েদের এতো দুঃখ।আমরা একে অপরের সমালোচনা করি,অথচ আত্ম-সমালোচনা করিনা।আমরা একে অপরের দুঃখে কপট হা-হুতাশ করি।অথচ মনে মনে বেশ খুশীই হই।আমরা নিজেদের সুখ নিয়ে মিথ্যে গাল গল্প শুনিয়ে অন্যের কালো হয়ে যাওয়া মুখটা দেখতে বড্ড ভালোবাসি।’

ঝরঝর করে জল পরতে থাকলো অনুশ্রীর চোখ দিয়ে।বললো,’আমাদের শক্তিশালী করো মা,আমরা যেন নিজেদের মনের আসুরিক প্রবৃত্তি গুলিকে শেষ করতে পারি।আশীর্বাদ করো যেন একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেরাই নিজেদের অস্ত্র হয়ে উঠি’,মাগো তোমার তুমিকে তুমি, আমাদের আমির আত্মশক্তিতে জাগ্রত করো’।

(চলবে)

#তিতির_পাখির_বাসা
(পর্ব-১১)
#জয়া_চক্রবর্তী

তিতিরের অনিশ্চিত প্রেমের কথা ভেবে মাঝেমাঝেই মেঘলা হয়ে যাচ্ছে সুদর্শনের মনের আকাশ।

আসলে তৃষ্ণার জল আশার অতীত হলে তবেই না মরীচিকা বিভ্রান্ত করে।সুদর্শন এতোদিন কল্পনায় তিতিরকে সাজিয়েছে,ভালোবেসে পাগল করেছে।

সেই তিতিরকে কাল পুরোপুরিভাবে কাছে পেয়েও আজ হারাবার ভয় সুদর্শনের চোখদুটোকে আর্দ্র করে দিচ্ছে বারবার।

আজ সকালে তিতির চোখ মেলতেই দেখেছিলো ঘর জুড়ে সোনালী রোদ্দুর লুকোচুরি খেলছে।

আবার বাইরে তাকাতেই দেখেছিলো রোদেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে উঁচু নীচু শ্বেত শুভ্র পাহাড়ের গায়ে,মাথায়।

পাহাড়ের মাথা ছুঁয়ে ছিলো ঝকঝকে নীল আকাশ।সাদা মেঘেদের সেনা গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো এখানে সেখানে।

তিতির আলসেমি ছেড়ে রেডি হয়ে নিলো।
সুদর্শন কে জাগিয়ে দিয়ে বললো,”আমি বাইরে যাচ্ছি,কাছাকাছিই থাকবো’।

এরপর সুদর্শনের সম্মতির অপেক্ষা না করে, তিতির প্রায় উড়েই বেড়িয়ে গেলো।

মানালির রাস্তার দুই ধারেই বরফ।তিতির হাঁটতে হাঁটতে মাঝেমাঝেই নীচু হয়ে বরফের কুচি মুঠোয় ভরে নিচ্ছে।এ হাত ও হাত করে নিয়ে বল বানাচ্ছে।আবার ছুঁড়ে দিচ্ছে বরফের দিকেই।

বেশ মজা লাগছে তিতিরের।বিয়ের আগে কখনো এই রকম একা কোথাও বের হওয়ার সুযোগ পায়নি তিতির।সবসময় হিটলার দাদা সঙ্গে থেকেছে।

তিতির যেন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে।পাহাড়ি রাস্তার এক একটা বাঁক ঘুরছে আনমনে।
হঠাৎ একটা বড়ো পার্ক দেখে এগিয়ে গেলো। দোলনায় চড়ে দোল খেতে শুরু করলো।

আচ্ছা ওকে তো ফিরতে হবে।হোটেলের নামটা যেন কি ছিলো!
উঁহু হোটেলের নামটা তো ওর মনে নেই।
কি করে ফিরবে এবার!!

ঠিক যেভাবে ফেরবার চিন্তাটা হঠাৎ মনে এসেছিলো, সেই ভাবেই নিমেষে তা ঘাস ফড়িং এর মতোই উধাও হয়ে গেলো।

তিতির ছোট থেকেই হারিয়ে যেতে চাইতো।আর হারাবার জন্য এর চাইতে সুন্দর জায়গা তো আর হতেই পারেনা।

কথাটা মনে হতেই, এক চিলতে হাসি খেলে গেলো ওর পাতলা ঠোঁট দুটিতে।

দোলনা থেকে নেমে আরো এগিয়ে গেলো।
একটা আপেল বাগান দেখে দাঁড়িয়ে পরলো তিতির।যে লোকটা বাগানে কাজ করছিলো,তার সাথে ডেকে কথা বলতে বলতে জানতে পারলো সামনেই হাদিম্বা দেবীর মন্দির।

তিতিরকে জোর করে মালীভাই দুটো আপেল হাতে দিলো।
মালীভাই কি বুঝতে পেরেছিলো তিতিরের খিদে পেয়েছে?নাকি সবাইকেই ও আপেল খেতে দেয়!

তিতির আপেলে কামড় দিতে দিতে এগিয়ে গেলো।
মন্দিরে পৌঁছে অনেকটা সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলো।

কাল প্রায় সারা রাত সুদর্শন তিতিরের শরীরে ডুবে ছিলো।তিতিরের ঘ্রাণ এখনো ওর শরীরে মিশে।তিতির মিশে গেছে ওর রক্তকণিকায়,ওর অস্থি মজ্জায়।
ওর সমস্ত অনুভুতি জুড়ে শুধু তিতির।তিতিরের কথা ভাবতে গেলেই এক চুড়ান্ত ভালো লাগায় ডুবে যাচ্ছে সুদর্শন।আবার হারাবার আশঙ্কাও চেপে ধরছে সুদর্শনকে।

কিন্তু এখনো তিতিরকে ওর মনের কথাটা জানানো হয়নি।আচ্ছা তিতির কি এখনো জানেনা?
তিতির কি এখনো বোঝেনা?এখনো কি ওর মাথায় ডিভোর্স শব্দটা ঘুরছে?
সুদর্শন কে ডিভোর্স দিয়ে কি ভালো থাকতে পারবে তিতির?

ভালোবাসি,এই গভীর শব্দটা নাইবা শুনলে পাখি…
তাতে কি কিছু কম পাওয়া হবে, তোমার কিম্বা আমার?
যা পেয়েছি কাছে থেকে তোমার,
শত বসন্ত কি পারতো দিতে সে রোমাঞ্চ?
বৃষ্টি ভেজা কেতকীর মতো তোমার ভেজা শরীর।
দুচোখের রহস্যময়তা পারেনা ধরতে,গভীর মনের তল।
ভালোবাসি এই গভীর শব্দটা নাইবা শুনলে পাখি,
তাতে কি কিছু কম পাওয়া হবে,তোমার কিম্বা আমার??

মনে মনে শব্দমালা গাঁথতে গাঁথতেই সুদর্শন রেডি হয়ে বেড়িয়ে পরেছিলো।কিন্তু তিতিরের দর্শন পায়নি।আশেপাশে সব জায়গা দেখে নিয়েছে।কোথায় যে গেলো মেয়েটা!

বাধ্য হয়ে সুদর্শন সবাইকেই তিতিরের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছে।

যেতে যেতে রাস্তায় আরো অনেক সদ্য বিবাহিত নারী-পুরুষও দেখলো।তারা কিন্তু দিব্যি একে অপরের হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।নিজেদের মধ্যে দুষ্টুমি করছে।শুধু তিতিরের হাতটাই সুদর্শনের মুঠোয় ধরা নেই।সুদর্শন বাঁহাত দিয়ে চোখের কোন মুছে নিলো।

কাল রাতে তিতিরের অবস্থা দেখে সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো সুদর্শন। পুরো বরফ ঠান্ডা হয়ে গয়েছিলো মেয়েটা।নাহলে ওই ভাবে তিতিরকে সে পেতে চায়নি।আচ্ছা সেই কারনেই কি তিতির ওকে ছেড়ে চলে গেলো!নাকি তিতির রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে!
না আর ভাবতে পারছে না সুদর্শন।

অনেকটা রাস্তা আসার পর আপেল বাগান দেখে এগিয়ে গেলো।ভেতরে মালী কে ডেকে তিতিরের ছবি দেখাতেই মালী বললো,দেখেছে আর মেয়েটি আগে হাদিম্বা দেবীর মন্দিরে গেছে।

সুদর্শন মন্দিরে পৌঁছে দূর থেকে তিতিরকে দেখতে পেলো।খুব শান্ত ভাবে তিতির মন্দির প্রদক্ষিণ করছে।মুখে চিন্তার ছাপ মাত্র নেই।

নিজেকে তিতিরের থেকে দুরেই রাখলো, ও দেখতে চায়,যাকে এতোটা ভালোবাসলো,তার কি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ওর ওপর?

(চলবে)

#তিতির_পাখির_বাসা(পর্ব-১২)
#জয়া_চক্রবর্তী

‘কিরে তিতির তুই এখানে?’উচ্ছ্বাসে ফেটে পরলো তুহিন।
তুহিন তিতিরের কলেজের এক সিনিয়র।কলেজের চেন্নাই ট্যুরে ওরা একসাথেই ছিলো।

কলেজে পড়াকালীন কখনো তুহিনের সাথে কথা বলেছে বলে তিতিরের মনে পরছেনা।তবে অনেকবারই ওরা মুখোমুখি হয়েছে।কখনো কলেজ ক্যান্টিনে,কখনো বা লাইব্রেরি, কখনো বা বাস স্ট্যান্ডে।
তুহিনের মুগ্ধ চাউনি চোখ এড়ায় নি তিতিরের।

তিতির সৌজন্যের দেঁতোহাসি মুখে টেনে এনে বললো, ‘হানিমুনে এসেছি আমরা।’
বলেই আর না দাঁড়িয়ে হনহন করে এগিয়ে গেলো রাস্তা ধরে।

কলেজের প্রথম দিন থেকেই মেয়েটাকে মনে ধরেছিলো তুহিনের।কিন্তু সাহস করে আর মনের কথাটা বলে উঠতে পারেনি।

ভেবেছিলো চাকরী বাকরী জোগাড় করে একেবারেই বিয়ের প্রপোজাল দেবে।
তুহিন এখনো চাকরী পেলোনা,অথচ তিতির বিয়ে করে একেবারে হানিমুনে এসে পরলো।

মেজাজটা বিগড়ে গেলো তুহিনের।
চন্ডীগড়ে ওর একটা ইন্টারভিউ ছিলো।সেটা দিয়ে এই দিন দুই হলো ও একা একাই মানালি এসেছে।

কি দরকার ছিলো,আবার দেখা হওয়ার!বুকের ভিতরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেলো তুহিনের।
আচ্ছা তিতির হানিমুনে এসেছে বললো,কিন্তু একা কেন?ওর হাবিকে তো সঙ্গে দেখলাম না।কথাটা মাথায় আসতেই তুহিন পা চালিয়ে তিতিরের সামনে চলে গেলো।

আজ প্রকৃতির কোলে এসে তুহিনের মধ্যে কোন জড়তা নেই।
তিতিরের কাছে সরাসরিভাবে জানতে চাইলো,’তোর হাবি কোথায়?কোন হোটেলে উঠেছিস তোরা?’

তিতির মিথ্যে সাজিয়ে গুজিয়ে বলতে পারেনা,তাই সে চেষ্টায় না গিয়ে বললো,’ওকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বলেই বেড়িয়েছি।তবে হোটেলের নামটা এখন মনে পড়ছে না আমার।’

তুহিন অবাক,বলে কি মেয়েটা!
বললো,’ সেকিরে ফিরবি কি করে তাহলে?’তিতির হেসে বললো,’ফিরে যাব,চাপ নিও না’।

তুহিন বললো,’আরে আমার তো একটা দায়িত্ব আছে,আমি তো আর অচেনা জায়গায় তোকে এইভাবে একা ছেড়ে দিতে পারিনা’।একটু থেমে আবার বললো,’তুই মনে করে বল,হোটেলের আশেপাশে কোন দোকানের নাম মনে আছে কিনা?’

তিতির বিরক্ত, কে দিয়েছে তুহিনদাকে দায়িত্ব?তুহিনদার এই আগ বাড়িয়ে আদিখ্যেতা দেখানোটা তিতির একেবারেই পছন্দ করছে না।

এই প্রথম সুদর্শন সাথে নেই বলে তিতিরের খারাপ লাগলো।
ও বুঝতে পারে,ওই শান্ত শিষ্ট মানুষ টি সত্যিই তিতিরকে কেয়ার করে,ভালোবাসে।

এই যে তিতির হারিয়ে যাচ্ছে, সেটা তো এই জোরেই যে সুদর্শন ওকে ঠিক খুঁজে নেবে।

তিতির তুহিনের কথার উত্তর না দিয়েই নিজের মতো হাঁটতে থাকলো।দেখতে দেখতে আর একটা মন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছে।সম্ভবত ওটা মানু মন্দির।

সুদর্শনের মুখে শুনেছিলো,মানালির আশেপাশেই দেখবার মতো অনেক জায়গা আছে,যেগুলো হেঁটে হেঁটেই কভার করা যায়।

‘আচ্ছা তিতির তোর মনে আছে,প্রথম দিন কলেজে তুই কোন ড্রেস পরে এসেছিলিস?’তুহিনের আচমকা প্রশ্নে অবাক তিতির।
বিরক্তিটা আড়াল করে ছদ্ম হাসি টেনে বললো,’না’।
‘তুই পরেছিলিস ব্ল্যাক টপ আর ডিপ ব্লু-জিন্স।’
তিতির হেসে বললো,’হবে হয়তো’।

‘জানিস সেদিন থেকেই শুরু।তারপর প্রতিদিন তোকে অন্ততপক্ষে একবার না দেখলে মন ভরতোনা।’
তিতির দাঁড়িয়ে বললো,’আমি একা যেতে চাই তুহিনদা,প্লিজ লিভ মি’।

তিতিরের কথাটা ভ্রুক্ষেপ না করে তুহিন বলতে লাগলো,’প্রতিদিন কলেজ থেকে বেড়িয়েই পাপড়ি চাট কিনতিস,নিজে যত না খেতিস তার চাইতে বিলোতিস বেশী’।

‘আমি কি শুনতে চেয়েছি এসব তুহিনদা?কেন তুমি সঙ্গে আসছো বলোতো?’তিতিরের কথায় তুহিন ছোট্ট করে হেসে বললো,’আজ না বললে যে আর বলবার সুযোগ টাই পাবোনা।’

তুহিন বলতে থাকলো,’আমি পাস করে বেড়িয়েও কলেজে আসতাম শুধু তোর জন্য।চাকরীর পরীক্ষা দিতাম বা দিচ্ছি সেটাও শুধু তোকে বিয়ে করবো বলেই।’

‘এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে তুহিনদা’ কথাটা বলেই তিতির দ্রুত এগিয়ে যেতে চাইলো।
‘বাড়াবাড়ির কি দেখলি তিতির?শুধু বলতে চাই ভালোবাসি,ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি’…

‘যদি কখনো মনে হয় আমার ভালোবাসা নির্ভেজাল, চলে আসিস আমার কাছে।আমি তোর জন্য অপেক্ষা করবো’।কথাটা বলে তুহিন মৃদু হাসলো।

ছেলেটা কি তিতিরের পূর্ব পরিচিত?না সুন্দরী মেয়ে দেখে যেচে কথা বলে যাচ্ছে।সুদর্শনের মনে হলো এবার তিতিরের কাছে ওর যাওয়া উচিৎ।পা চালিয়ে তিতিরদের যখন ঠিক পেছনে তখন সুদর্শন শুনতে পেলো,’অপেক্ষা কোরনা তুহিনদা।আমার হাবি আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে আর আমিও ওকে’।

সুদর্শন ঠিক শুনলো তো!

‘আমিও না হয় দূর থেকেই ভালোবাসলাম তোকে,কি জানিস পাগলী সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো বিনিময়ে কিছু চায়না’।কথাটা বলে তুহিন বিষাদ মিশ্রিত হাসি হাসলো।

সুদর্শন আবার ইচ্ছে করেই পিছিয়ে পরলো।সুদর্শনের মনে হলো,

প্রতিপদেই হাহাকার-ব্যাকুলতা,
প্রতিপদেই প্রতিবন্ধকতা।
প্রতিপদেই ভাঙা-গড়ার আয়োজন,
আবার প্রতিপদেই অবিচল প্রতীক্ষা।
তবু এক ঝাঁক মলয় বাতাস,
উড়িয়ে দেয় মন খারাপের আঁচল।
অবগুণ্ঠন মুক্ত করে,
প্রাতঃ স্নাত আর্দ্র সিক্ত মুখ।
মুছিয়ে দেয় অভিমান,
মুছিয়ে দেয় ক্লান্ত অশ্রুধারা।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here