তিতির_পাখির_বাসা,পর্ব-১৩,১৪,১৫

0
423

#তিতির_পাখির_বাসা,পর্ব-১৩,১৪,১৫
#জয়া_চক্রবর্তী
পর্ব-১৩

মন্দিরের চাতালে বসে সুদর্শন ভাবছিলো,কিছুদিন আগেও কাজকর্ম,বন্ধুবান্ধব,ভ্রমণ এসব নিয়ে দিব্যি ছিলো।
হঠাৎ মা এর আনা তিতিরের ছবিটা ওর জীবনটাই কেমন বদলে দিলো।
মায়ের এককথায় সে রাজি হয়ে গিয়েছিলো তিতিরকে বিয়ে করতে।

তবে এই কথাটা সুদর্শন বুঝে গেছে যে,তিতিরের জায়গাটা আর কাউকে দেওয়াই সম্ভব নয়।
যদি সত্যিসত্যিই তিতির সুদর্শনের পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়,তখন নিজের ছায়াই হবে সুদর্শনের সর্বক্ষণের সঙ্গী।

ছায়ার সাথেই তখন চলাফেরা,ছায়ার সাথেই কথা বলা-ভাব ভালোবাসা।
সব কিছুই ওই ছায়ার সঙ্গে।

সুদর্শন কখনোই ভালো বক্তা ছিলো না।তবে তিতিরের সঙ্গে মনে মনে অনেক কথা বলেছে।
চোখে চোখ রেখে মনের কথা বুঝিয়ে দিতেও চেয়েছে।তিতির হয়তো বুঝতে চায়নি বলেই বোঝেনি।

সুদর্শন ভাবলো,
‘আমিই শুধু রঙহারানো সাদা কালোয়
জমিয়ে রাখি উড়ানরাঙা ইচ্ছেপালক’।

তুহিনের অহেতুক সঙ্গদানের কারনে তিতিরের আর মন্দির ঘুরে দেখতে ভালো লাগছিলো না।
তিতির দ্রুত পায়ে মন্দির ছেড়ে বেড়িয়ে যেতেই দেখলো,সুদর্শন চাতালে বসে।
কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সুদর্শন হেসে বললো,’দেখা হলো মন্দির?’

তিতির অপরাধী মুখ করে নিয়ে সবে বলতে শুরু করেছিলো…কিন্তু সুদর্শন থামিয়ে দিয়ে বললো,’কৈফিয়ত তো চাইনি পাখি,কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে বোলো না।সম্পর্কের মধ্যে কৈফিয়ত আসলে সম্পর্কটা যে দমবন্ধ হয়ে আসবে,গল্প হিসেবে বোলো পরে শুনবো’।

সুদর্শনের কথাটা তিতিরকে কোথাও ছুঁয়ে গেলো।হেসে বললো,’আচ্ছা পরে শুনো’।

তুহিন নিজেই এগিয়ে এসে পরিচয়টা সারলো।
‘হাই আমি তুহিন চ্যাটার্জী,আমরা এক কলেজেই পড়তাম’।
সুদর্শন হেসে বললো,আমি সুদর্শন।
তুহিন গম্ভীর স্বরে বললো,’আজ তো আপনার গিন্নীকে হারিয়েই ফেলছিলেন।অচেনা পাহাড়ি রাস্তায় এই রকম একা বের হতে দেওয়া ঠিক হয়নি আপনার।যদি কোন বিপদে পড়তো মেয়েটা,ক্ষমা করতে পারতেন নিজেকে?খারাপ লোকের পাল্লাতেও তো পড়তে পারতো।তাছাড়া তিতিরের তো হোটেলের নামটাও মনে ছিলোনা,কি করে ফিরতো?’

সুদর্শন বললো,’সত্যিই ভারি অন্যায় হয়ে গেছে।কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবো আপনাকে?ভাগ্যিস সাথে ছিলেন’।

একটু চুপ থেকে তুহিন বললো,’ধন্যবাদ নিয়ে আমি কি করবো?তিতির খুব ভালো মেয়ে,ওকে দেখবেন’।সুদর্শনের মনে হলো তুহিনের চোখটা ছলছল করছে।তাকিয়ে দেখলো আশেপাশে তিতির কোথাও নেই।তুহিন বললো,’ও আবার মন্দিরের ভিতরে চলে গেছে।আপনিও ভিতরে যান।আমি এবার আসছি’।
তুহিন সামনের দিকে এগিয়ে গেলো।”ভালোবাসা বিনিময় চায়না”,কথাটা যে কতবড় মিথ্যে সেটা অনুমান করতে পারছিলো।

আসলে ‘ভালোবাসা বিনিময়ে ভালোবাসা চায়’-এটাই চিরন্তন সত্য,সে যে যাই বলুক না কেন।

সুদর্শন তুহিনের উদ্বিগ্ন কথাবার্তায় বুঝতে পারছিলো তিতিরকে ছেলেটা ভালোবাসে,এক তরফা ভালোবাসা যে কী ভীষণ কষ্টের সেটা সুদর্শন ভালোই বোঝে।তুহিনের সাথে একাত্ম লাগলো নিজেকে।

তবে তুহিনের সাথে মন্দিরে ঢোকবার আগে তিতির বলছিলো যে, ওর হাবি ওকে প্রচণ্ড ভালোবাসে আর ও নিজেও।
কথাটা কি শুধু তুহিনকে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য ছিলো!?

তিতির মন্দির থেকে বের হতেই সুদর্শন বললো,এবার ফেরা যাক’।তিতির মাথা নাড়িয়ে সুদর্শন কে সায় দিলো।

তিতিরের হাত সুদর্শন নিজের মুঠোয় ভরে নিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলো।

তিতির মুদ্ধ দৃষ্টিতে চারদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছে।হঠাৎ সুদর্শন বলে উঠলো,’আচ্ছা তিতির তুমি কি সত্যিই হারিয়ে যেতে চাইছিলে?’তিতির বললো,’হারিয়ে আর কোথায় যেতাম,আমি তো জানতাম খুঁজে নেবে আমায়’।

‘তুহিন কিন্তু ভালোবাসে তোমাকে’,কথাটা বলেই সরাসরি তিতিরের চোখের দিকে তাকালো।হয়তো কিছু বুঝে নিতে চাইছিলো।

তিতির বললো,’তাতে কি হলো?এমন অনেকেই ভালোবাসে আমায়’।সুদর্শন বললো,’তুমি কাউকে ভালোবাসো না?’।

তিতির বললো,’হ্যাঁ বাসি তো।আমার গল্পের বই এর পুরুষ দের প্রেমে আমি হামেশাই পরি।চোখ বুজলেই ওরা রক্তমাংসের শরীর ধারন করে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।আমি আমার মতো করে ওদের সাথে মিশি,ভালোবাসি’।

সুদর্শনের একটু অবাক লাগে কথাটা।বললো,’ এখনো এমন হয় নাকি?’।

ততক্ষনে তিতির নীচু হয়ে, বরফ কুচি মুঠোয় ভরে বল বানাতে ব্যস্ত।কিছুক্ষণ চুপ করে সুদর্শন বললো,তাহলে তো আমাকে তোমার পছন্দই হয়নি।গল্পের বই এর নায়কদের মতো সৌন্দর্য্য,ব্যক্তিত্ব কোনটাই নেই আমার।

তিতির কোন উত্তর না দিয়ে সুদর্শন কে বললো,জল তেষ্টা পেয়েছে বড্ড।সুদর্শন খুব চিন্তিত মুখে বললো,কাছেপিঠে তো কোন দোকান দেখছি না।আসার সময়তেও চোখ শুধু তোমাকেই খুঁজছিলো,তাই খেয়াল নেই দোকান ছিলো কিনা’।

তিতির নিজেই একটা পাহাড়ি বাড়ির দরজা নক করলো।একটা বাচ্চা মেয়ে বেড়িয়ে আসলো।
জল তেষ্টার কথা বলতেই মেয়েটি হাসিমুখে ওদের জল এনে দিলো।দুজনেই জল খেয়ে মেয়েটিকে বিদায় জানিয়ে বেড়িয়ে এলো।

সকাল থেকে কিছুই পেটে পরেনি।পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটার পরিশ্রমে খিদেও পেয়েছে প্রচণ্ড।সুদর্শন ঠিক করলো প্রথম যে খাওয়ারের দোকানটাই দেখবে,সেখানেই ঢুকে লাঞ্চ সেরে নেবে।

খাওয়াদাওয়া সেরে সুদর্শন তিতিরকে নিয়ে হোটেলে ফিরলো।

বিকেলের অস্তগামী লাল সূর্য্যটা শ্বেতশুভ্র পাহাড়ের ওপর মায়াবী আলো ছড়িয়ে দিতেই,ভালো লাগা ছড়িয়ে পরলো দুজনের রক্তের শেষ বিন্দুতে।
দুজনেই জানালার ধারে, আলো আঁধারীতে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে থাকলো।

রাত বাড়তেই সুদর্শন পরের দিনের প্ল্যানিং নিয়ে তিতিরকে জানিয়ে দিলো।
আগামীকাল ওদের গন্তব্য সোলাং ভ্যালি আর রোটাং পাস।

সোলাং ভ্যালি হোটেল থেকে প্রায় ১৪ কিমি দূরে।তবে ছবির মতো সুন্দর।পথে ভ্যাসিসথ উষ্ণ প্রস্রবণ পরবে।

রোটাং পাস প্রায় ১৩.৫০০ফিট উঁচুতে।পথ ভয়ঙ্কর হলেও অসাধারণ সুন্দর।তিতির গোল গোল চোখ করে সুদর্শনের কথাগুলো শুনলো।তারপর টাওয়াল নিয়ে ফ্রেশ হতে যেতেই,সুদর্শন জোরে জোরে বলল,’ দেখো কালকের মতো যেন গরম করতে না হয়’।

তিতির লজ্জার লাল হয়ে টাওয়াল দিয়েই মুখ ঢাকলো।(চলবে)

#তিতির_পাখির_বাসা(পর্ব-১৪)
#জয়া_চক্রবর্তী

ফায়ারপ্লেসের ঝলসে ওঠা আলোয় খোলা চুলে বসে থাকা তিতিরকে অসাধারণ লাগছে।
সুদর্শন কষ্ট করে চোখ ফিরিয়ে ডিনারে মনোযোগী হলো।

তিতির খেতে খেতে নিজেই সকালের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলো সুদর্শনকে।তুহিনের কথাও বাদ দিলোনা।

সুদর্শন বললো,কাল সকালে বের হতে হবে তাই ঘুমটা দুজনের জন্যই খুব জরুরী।

হাত মুখ ধুয়ে তিতির সোজা কম্বলের ভিতর।সুদর্শন লাইট নিভিয়ে কম্বলের ভিতর ঢুকতেই তিতির নিজে থেকেই ওকে জড়িয়ে ধরলো।
ঠান্ডার জন্য নাকি আবেগে সুদর্শন বুঝতে পারলো না।
তবে ভালো লাগলো।তিতিরের কপালে ঠোঁট ছুইয়ে চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে নিজেও ঘুমিয়ে পরলো।

সকালে দুজন রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে গাড়ীতে গিয়ে বসলো।আজ ওদের সাথে আর একটি হানিমুন কাপল শেয়ারে যাচ্ছে।

ওদের দেখে তিতিরের অচিন্ত্য আর দিয়ার কথা মনে পরে গেলো।
জীবনে কিছু কথা, কিছু ঘটনা স্মৃতি হয়েই রয়ে যায়,হারিয়ে যায় তার আগে পরের অনেককিছু।

সুদর্শন সামনে ড্রাইভারের পাশে বসেছে।তিতির সুদর্শনের ঠিক পেছনে।ওর পাশে ওরা দুজন।
সুদর্শন পাশে না থাকলেও মাঝেমাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে তিতিরের সাথে কথা বলছে।

পাশের দুজন হিন্দীভাষী।তিতির তাই ওদের সাথে কথা বাড়ায়নি।
সেবার চেন্নাইতে তিতিরের হিন্দী নিয়ে বন্ধুরা যেভাবে ওর পিছনে লেগেছিলো,তাতে তিতির সাহস করে আর হিন্দী বলতে যায়না।

সোলাং ভ্যালি আর রোটাং পাস দুটো জায়গাতেই ওরা অনেকক্ষণ সময় ধরে রইলো।

রোটাং পাসে বরফে স্লিপ করে দুজনেই পরলো বেশ কয়েকবার।
তারপর একসময় তিতিরের বায়নাতে সুদর্শনও ওর সাথে হাত লাগালো বরফ দিয়ে স্নো-ম্যান বানাবার।

বারবার করে ওরা স্নো-ম্যান বানাচ্ছে।
তারপর বরফের বল বানিয়ে নিজেরাই টিপ করে ভেঙ্গে ফেলছে।

বরফের ওপর রোদের দাপটে সোয়েটার, জ্যাকেট কিছুই গায়ে রাখা যাচ্ছে না।

তিতির এবার বুঝলো, মুভিতে কোন বরফের পাহাড়ে নায়িকারা কিভাবে স্বল্পবসনে নাচ গান করে থাকে।
অনেক হইচই করে দিনটা কেটে গেলো।

ফেরার পথেও সুদর্শন সামনেই বসলো।তিতিরের পাশের মেয়েটি নিজে থেকেই তিতিরের সাথে কথা বলতে শুরু করেছে।বাধ্য হয়ে তিতিরকেও বলতেই হচ্ছে।

তিতিরের দারুণ হিন্দী শুনে সুদর্শন আর নিজের হাসি ধরে রাখতে পারছে না।

ব্যাপারটা গাড়ীর লুকিং গ্লাসে খেয়াল করে তিতির গুম গুম করে দুটো কিল মারলো সুদর্শনের পিঠে।সুদর্শনের মুচকি হাসি এবার অট্টহাস্যে বদলে গেলো।তিতির নিজেও হেসে ফেললো।

হোটেলে ফিরে ফ্রেস হয়ে দুজনেই ব্যাগ গোছাতে শুরু করলো।সকালেই বাসে করে চণ্ডীগড়।ওখান থেকে ট্রেনে হাওড়া।

সুদর্শন বললো,’ফিরে গিয়েই ডিভোর্স চাই তাইতো?’।তিতির ছোট্ট করে বললো,’হুম’।
‘ডিভোর্স নেওয়ার পর বিয়ে করে নিও তোমার মনের মতো কাউকে’,সুদর্শনের কথায় তিতির হেসে বললো,’বিয়ে করবো কে বললো?’।

‘তাহলে ডিভোর্স চাইছো কেন তিতির?’সুদর্শনের কথায় ওর ভিতরের যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে।তিতির কোন উত্তর দিলোনা।শুধু হাত বাড়িয়ে সুদর্শনের চুলটা ঘেঁটে দিলো।

সুদর্শন তিতিরের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,’ডিভোর্সের পরের প্ল্যানিং টা তো জানাবে’।তিতির বললো,’পড়াশোনাটা কন্টিনিউ করবো হোস্টেলে থেকে,চাকরীর পরীক্ষা গুলোও দিতে থাকবো।তোমাদের বাড়ীতে থেকে সেসব হবেনা’।

সুদর্শনের ব্যথিত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো,তুমি বিয়ে করে নিও’।

সুদর্শন বললো,’একবার করেছি তো,আর নয়।তবে তোমায় আমার জন্য আটকাবো না।তুমি নিজের স্বপ্ন পূরণ করো।

তিতির চুপ করে আছে দেখে সুদর্শন বললো,’আমি কিন্তু ডিভোর্সের পরও তোমার সাথে যোগাযোগ রাখবো,তুমি ভালো আছো দেখলে ভালোই লাগবে আমার’।

তিতির কোন উত্তর না দিয়ে ছোট্ট করে হাসলো।
সুদর্শন বললো,’চলো ছাদে হেঁটে আসি’।তিতির জ্যাকেটটা চাপিয়ে ওর পিছন পিছন ছাদে গেলো।

সুদর্শন বললো,’বাড়ীতে যখন তুমি ঘুমিয়ে থাকতে,আমি ছাদে গিয়ে ঘুরতাম।মাঝেমাঝে মনে হতো তুমি ঘুম ভেঙে আমায় বিছানায় না দেখে ছাদে চলে আসবে।আমরা একসাথে বসে অনেকটা সময় গল্প করে কাটাবো’।

একটু থেমে বললো,’কিন্তু তুমি আসোনি কখনো।জানো তিতির জীবন বড়ো হোক চাই না,শুধু চাই দামী কিছু মুহুর্ত।চোখ বোজবার সময় সেই মুহুর্ত গুলো নিয়ে ভাবতে চাই’।

‘তিতির তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহুর্ত আমার কাছে মূল্যবান,ভীষন ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়’।
সুদর্শনের কথা বলতে বলতে গলা ধরে যাচ্ছিলো।

তিতিরের নিজেকে এবার দারুণ অপরাধী লাগতে শুরু করলো।সুদর্শন কে বললো,’আপাতত ডিভোর্স কেন্সেল’।

‘প্লিজ করুণা করোনা।আমি নিতে পারিনা।একটু ইমোশনাল হয়ে পরেছিলাম মাত্র।তুমি ফিরে গিয়েই তোমার কাঙ্ক্ষিত সইটা পেয়ে যাবে।আমি গিয়েই ব্যবস্থা করবো মিউচুয়াল ডিভোর্সের’।

সুদর্শনের কথায় তিতির কি খুশী হতে পারলো!
এর উত্তর তিতিরেরও জানা নেই।

তবে সুদর্শনকে ছুঁয়ে আসা এক ঝাঁক মলয় বাতাসের পাগলামি তিতিরকেও ছুঁয়ে গেলো।শিরশির করে উঠলো তিতিরের শরীর,ওর গোলাপি আমন্ত্রনী ঠোঁট,অমাবস্যা চুল।

তিতির বললো,’নীচে চলো,খুব ঠান্ডা ছাদে’।সুদর্শন বললো,’তুমি যাও আমি একটু পরেই আসছি’।তিতির একাই নীচে চলে আসতে পারতো।কিন্তু সুদর্শনের মনের অবস্থা দেখে সেটা করলো না।

তিতির সুদর্শনের দিকে এগিয়ে গিয়ে জোর করে নিজের দিকে ওর মুখটা ফেরালো।অবাক হয়ে দেখলো,সুদর্শনের বন্ধ চোখ থেকে অঝোরে জল পরছে।

সুদর্শনের মুখটা দুহাতের মধ্যে তুলে নিয়ে, সামনের দিকের পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, সুদর্শনের চোখের পাতার ওপর ঠোঁট ছোঁয়ালো তিতির।গালের গড়িয়ে পরা জল শুষে নিতে থাকলো ঠোঁট দিয়ে।সুদর্শন নিজের বুকে চেপে ধরলো তিতিরের মাথাটা।প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে যেতে থাকে তিতির,ভিজে যেতে থাকে সুদর্শন।(চলবে)

#তিতির পাখির বাসা(পর্ব-১৫)
#জয়া চক্রবর্তী

ঘড়ির কাঁটায় এখন রাত্রি দুটো অথবা আরো বেশী।
মানে স্বপ্ন ভঙ্গের মতো রাত পোহাবার এখনো অনেক দেরী।

সুদর্শন তিতিরকে নিয়ে ছাদ থেকে নীচে নেমে আসলো। বললো,’ঘুমিয়ে পরো পাখি,আমি একটু গুছিয়ে নিই।কাল সকালেই চণ্ডীগড় যাওয়ার বাস ধরতে হবে’।

‘আমার আর ঘুম আসবে না,বেটার আমিও হেল্প করি তোমাকে’তিতিরের কথায় সুদর্শন খুশীই হলো।

আসলে রাত্রি মানেই ফিরে পাওয়ার আশ্বাস,রাত্রি মানেই নতুন স্বপ্নে গা ভাসানো।

‘জানো পাখি এই জায়গাটা আমার ভীষণ পছন্দের।আগেরবার যখন নিলয়,কল্লোলদের সাথে এসেছিলাম,তখন পাহাড়ি গ্রাম গুলোতেও ঘুরে বেড়িয়েছিলাম’।
সুদর্শনের কথায় তিতির গোছানো থামিয়ে বললো, ‘ওমা তাই?ওখানে যাওয়া যায়?’।

সুদর্শন বললো,’পরের বার এসে তোমাকে ও নিয়ে যাব’।তারপর হেসে বললো,’আরে ডিভোর্স নিলেও তো আমরা ভালো বন্ধুই থাকবো,তাইনা?দুই বন্ধুতে আসা যাবে কখনো আবার,যদি তোমার আপত্তি না থাকে’।

তিতির মৃদু হেসে যত্ন করে একএকটা জামাকাপড় ভাঁজ করে এগিয়ে দিতে থাকলো সুদর্শনের দিকে।

তিতির না চাইতেও সুদর্শন ওর মনের কোথাও একটা জায়গা করে নিয়েছে।তাই হয়তো তিতির নিজেই ভিভোর্সের কথায় আনমনা হয়ে পরছে।ফিরে গিয়ে মুক্তি পাওয়ার খুশীটা ওর মধ্যে থেকে উধাও।

তিতির বুঝতে পারছে না,সুদর্শনের স্পর্শসুখ কি বিচলিত করেছে ওর মনকে!নাকি সুদর্শনের মাত্রাতিরিক্ত কেয়ারিং মনোভাবে ওকে আসক্ত করছে সুদর্শনের প্রতি!নাকি এটা সাময়িক আবেগ!

না,তিতির কিছুই বুঝতে পারছে না,আবার ব্যাপারটা এড়াতে চাইলেও এড়াতে পারছে না।

তার ওপর আজ যেভাবে অঝোরে কাঁদছিলো ছেলেটা,তাতে তিতিরের মনে হচ্ছিলো সুদর্শন কে বাদ দিয়ে এ কিসের স্বপ্ন দেখছে ও!!এতো সব পেয়েও সব হারানোর দেশে পৌঁছে যাওয়ার মত!!

‘পাহাড়ি বাচ্চা গুলোকে আমার দারুন লাগে জানো।ওদের নিয়ে কোন ঝঞ্ঝাটই নেই ওদের মা-বাবার।আপন মনে খেলে বেড়ায়,নাক দিয়ে সর্দি গড়ালে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে নিজেরাই মুছে নেয়।বৃষ্টি পড়লে হুড়মুড় করে আস্তানায় ঢোকে,আবার থেমে গেলেই খেলায় মেতে ওঠে’।সুদর্শনের কথায় তিতিরের চিন্তায় ছেদ পড়লো।

‘আচ্ছা ওরা কি দিয়ে খেলে?মানে আমাদের মতো তো খেলার সামগ্রী ওদের নেই’।তিতিরের কথায় সুদর্শন হেসে বললো,’ কে বললো নেই?ওরা আমাদের থেকেও অনেক বেশী ভাগ্যবান।ওরা খেলে জলের মাছ,মাঠের ঘাস,ফুল,ফল,লতাপাতা,ঘাস ফড়িঙ আর প্রজাপতিদের সাথে।ওরা খেলে হুড়মুড়িয়ে নেমে আসা ঝর্ণার সাথে, লুকোচুরি খেলে পাহাড়ি বৃষ্টি আর মেঘেদের সাথে’।

তিতির গোছানো থামিয়ে সুদর্শনকে বলে,’আচ্ছা বাসে উঠবার আগে আশপাশটা আর একবার ঘুরে আসলে হয়না?সকাল হতে তো বেশী দেরী নেই’।

তিতিরের কথায় সুদর্শন মাথা নেড়ে, চটপট হাত লাগিয়ে ব্যাগ গোছানো সেরে নেয়।
রাত্রি এখন অন্তিম পথের যাত্রী। কেয়ারটেকার কে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে মেন গেট খুলিয়ে আবছা অন্ধকার থাকতেই বেড়িয়ে পরে দুজন।

ঠান্ডাটা যেন কামড় লাগাচ্ছে হাড়ে।সুদর্শনের বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরে তিতির এগিয়ে যেতে থাকে।
সুদর্শন তিতিরকে বলতে চাইলো,’এই হাত ছেড়ে থাকতে পারবে তো পাখি?আমি তো তোমায় ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেই পারছি না’।
কিন্তু মুখ দিয়ে কথা ফুটলো না।
আপাত ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে পরলো মন।

পূর্নতার আকাঙ্ক্ষায় অপ্রাপ্তিকে অস্বীকার করার মধ্যেও শক্তি চাই।
এই শক্তিই আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করে,সমস্ত পরাভবের সম্ভাবনাতে ও নির্ভীক রাখে।

রাস্তার আশেপাশে বরফ।
যে কোন মুহুর্তে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা।সুদর্শন তিতিরকে ধরা হাতের মুঠিটা আরো শক্ত করে নিলো।

দেখতে দেখতে মেঘের সীমানায় রোদ জাগলো।শ্বেতশুভ্র পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে পড়লো সেই রূপোলী মেঘ।স্বপ্নালু রাত শেষে ভোরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুজন দুজনকে সুপ্রভাতের অভিবাদন জানিয়ে ফেরার পথ ধরলো।এখনো সুদর্শনের মুঠোয় তিতিরের নরম আঙুলগুলো।

হোটেলে ফিরেই ব্রেকফাস্ট সেরে দুজন চন্ডীগড়ের বাসে উঠে বসলো।

‘আমি তুহিন,চিনতে পারছেন?কাল পরিচয় হয়েছিলো’।সুদর্শন বললো,’অবশ্যই চিনতে পারছি।আজকেই ফিরছেন?’
তিতিরের দিকে একঝলক তাকিয়ে তুহিন বললো,’ওই আর কি,একা একা উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘুরতে আর ভালো লাগছিলো না’,বলেই তিতিরের দিকে তাকিয়ে বললো,’কী সব ভালো তো?’ সৌজন্যের দেঁতো হাসি মুখে এনে তিতির বললো,হ্যাঁ আমি ভালোই থাকি’।

সুদর্শন তুহিনকে বললো,’কি করা হয় আপনার?মানে কোন প্রফেশনে আছেন?’
না,এখনো কিছুই পাইনি।আসলে সরকারি চাকরীর পরীক্ষা দিচ্ছিলাম,যদি লেগে যায়’।
তুহিনের কথায় সুদর্শন হেসে বললো,’বাহ সরকারি চাকরী করবেন,তাহলে তো মেয়ের বাবাদের লাইন লেগে যাবে।বেস্ট অফ লাক,ট্রাই করুন,পেয়ে যাবেন’।

তুহিন একবার তিতিরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,ঠাট্টা করছেন?তা করতেই পারেন।তবে আর চাকরীর পরীক্ষা দেওয়ার কোন প্রয়োজন দেখছি না।ভাবছি ফিরে গিয়ে বাবার দোকানেই বসবো’।

‘কেন হঠাৎ আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন- প্রশ্নটা করে আপনাকে বিব্রত করতে চাইনা।তবে একটা সময় হয়তো আজকের সিদ্ধান্তটাকে ছেলেমানুষি বলে মনে হবে’।

সুদর্শনের কথায় তুহিনের চোখটা ভিজে আসছিলো।সামলে নিয়ে বললো,’কি জানেন আমরা প্রত্যেকেই একটা লক্ষ্য নিয়ে এগোই’।

তিতিরের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আবার বললো,’সেখানে কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকে।যখন দেখি পাওয়ার আর কিছু নেই, তখন না চাইতেও ভিতরটা ভেঙে যায়’।

‘বুঝলাম।কিন্তু চাওয়া-পাওয়া শব্দগুলো আপেক্ষিক।আজকের চাওয়াটা আগামী দিনে অন্য চাওয়াতে বদলে যাবে।কারন চাওয়া-পাওয়ারা বদলে যায় অহরহ’।সুদর্শনের কথার কোন উত্তর দিলোনা তুহিন।

তিতির অবাক হচ্ছে তুহিনদার কথাবার্তায়,সঙ্গে বিরক্তও…
‘সুদর্শন কি ভাবছে কে জানে!!’কথাটা মাথায় আসতেই মনটা অস্বস্তিতে ছেয়ে গেলো।

আচ্ছা সুদর্শন কি ভাবছে, সেটা নিয়ে তিতিরের কি যায় আসে!তিতিরের কেন অস্বস্তি হচ্ছে সেটা নিয়ে!

‘একটু ঘুমিয়ে নাও পাখি,কাল সারা রাত জাগা,না ঘুমোলে শরীর খারাপ হবে’,সুদর্শনের কথায় বাধ্য মেয়ের মতো চোখ বুজলো তিতির।

তুহিন আড় চোখে তাকিয়ে দেখে নিলো, তিতিরের মাথাটা সুদর্শনের কাঁধে।সুদর্শন হাতের বের দিয়ে ধরে আছে তিতিরকে, যাতে বাসের ঝাঁকুনিতে আঘাত না পায়।

না আর নিতে পারছে না তুহিন।পাগল পাগল লাগছে তুহিনের।
বুঝতে পারছে বাকী জীবনটা এইভাবেই একবুক অতৃপ্তি নিয়ে,প্রণয় পিলসুজে জ্বলতে হবে তুহিনকে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here