তি_আমো,০৬,০৭

1
647

#তি_আমো,০৬,০৭
পর্ব ৬
লিখা- Sidratul Muntaz

ভয়ে আর বিস্ময়ে আমি হিঁচকি তুলতে লাগলাম। রাগ আসছে না তবুও জোর করে চেহারায় রাগী ভাব ফুটিয়ে তুললাম,” আপনি দরজা কেন বন্ধ করলেন? কি ধরণের অসভ্যতা? আমি কিন্তু খুব বাজেভাবে চিৎকার করব এখন।”

ঈশান আমার কথার তোয়াক্কা না করে নিজের কথা বলে গেল,” ময়রা হওয়ার ব্যাপারে কি যেন বলছিলে? মিষ্টির দোকান দিয়ে বসবো? আর দোকানের নাম হবে ‘হাসি দিয়ে তৈরী মিষ্টি’ তাই না? আমার মনে হয় নামটা একটু চেঞ্জ করা দরকার। নাম হবে, ‘মিষ্টি দিয়ে তৈরী হাসি।’ আমি মিষ্টি দিব, আর তুমি হাসবে। ”

” মানে? কি বলছেন আবোলতাবোল?”

” দেখাচ্ছি।”

ঈশান দরজার কোণা থেকে বিশাল আকৃতির একটা বেলুন খুলে নিল। আমি উপরে তাকিয়ে দেখলাম এমন সাইজের আরও কয়েকটি বেলুন ঝুলছে। ঈশান বলল,” হা করো।”

” হা কেন করব?”

” করো।”

” একদম হা করব না।”

আমি দুইহাতে মুখ চেপে ধরলাম। ঈশান তার একহাত দিয়ে আমার কোমর চেপে ধরল। আতঙ্কে আমি সাথে সাথেই জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। তখনি ঈশান বেলুনটা আমার মুখের সামনে ধরল। বেলুনের সমস্ত গ্যাস আমি নাক-মুখ দিয়ে শুষে নিলাম। মনে হলো মিষ্টি কিছু খাচ্ছি। একটা সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। আমি হাসতে লাগলাম। অকারণেই এতো হাসছি কেন? ঈশান আমার মুখটা নিজের আজলায় নিয়ে বলল,” এইতো, এখন খুব মিষ্টি লাগছে।”

আমি হেসে হেসে বললাম,” আপনি চরম অসভ্য একটা মানুষ। আমাকে যেতে দিন নয়তো আমি চিৎকার করব!”

রাগার চেষ্টা করেও রাগতে পারছি না। কেবল হাসি পাচ্ছে আমার। আমি ওরনার আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরলাম। তবুও হাসি থামল না। বাইরে থেকে মোহনা আন্টি আর নিহার কথার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তারা কি ফিরে এসেছে? আমি দ্রুত দরজায় করাঘাত করে বলতে লাগলাম,” নিহা, আমি এখানে। সেইভ মি প্লিজ।”

এই পর্যায় ঈশান দরজা খুলে দিল। আমাকে আর পায় কে? এক দৌড়ে বের হয়ে গেলাম৷ হাসি তখনও চলছে। নিহা আর মোহনা আন্টি আমাকে অদ্ভুতভাবে হাসতে দেখে অবাক হয়ে গেল। তারা নিজেদের চেহারা, চুল ঠিক করল। হয়তো ভাবল আমি তাদের দেখে হাসছি। মোহনা আন্টি বিস্মিত গলায় বললেন,” তোমার কি হয়েছে তারিন? হাসছ কেন?”

নিহা ভীত কণ্ঠে বলল,” তুই কি পাগল হয়ে গেলি?”

আমি হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলাম,” তোরা কোথায় গিয়েছিলি? আমাকে সাথে নিলি না কেন?”

মোহনা আন্টি এগিয়ে এসে বললেন,” তুমিই তো যেতে চাওনি।”

আমি উথাল-পাতাল হাসতে হাসতে বললাম,” যেতে চাইনি মানে? কে বলল যেতে চাইনি?”

” বিসমিকে তো পাঠিয়েছিলাম তোমাকে ডাকতে। সে বলল, তুমি নাকি যাবে না।”

আমি হাসি জারি রেখে বললাম,” ও বুঝেছি। বিসমি বলেছে? ও একটা মিথ্যুক। ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিন। সাথে আপনার ছেলেকেও বের করে দিন। সেও মিথ্যুক, ধোঁকাবাজ। মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বেড়ায়। ”

নিহা চোখ রাঙিয়ে বলল,” তারু কি বলছিস এসব? মাথা ঠিকাছে?”

আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি হাসি আটকে সিরিয়াস হওয়ার। কিন্তু কোনোভাবেই পারছি না। হো হো করে হাসতে হাসতেই বললাম,” আমার মাথা একদম ঠিকাছে। শুধু হাসি পাচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না। ওই ঈশান আমাকে কি যেন করেছে।পাক্কা বদমাইশ একটা!”

আমি হাসছি বলে আমার কথায় কেউ গুরুত্ব দিল না। মোহনা আন্টি বিসমিকে ডাকতে রান্নাঘরে গেলেন। নিহা আমার হাত ধরে বলল,” এদিকে আয়।”

আমি নিহার হাত ছেড়ে বললাম,” আসব না। তুই আমাকে অবিশ্বাস করেছিস কেন?”

” তুই মোহনা আন্টিকে এসব কি বলছিস ঈশান ভাইয়ের নামে?”

” ঠিকই তো বলছি!”

আমি হাসতে লাগলাম। নিহা রেগে চলে গেল। আমি ঈশানের ঘরে ছুটে গেলাম। সে রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে। আমি সটান গিয়ে তার টি-শার্ট খামচে ধরে বললাম,” অসভ্য, ইতর, আপনি আমার সাথে কি করেছেন?”

ঈশান হাসল৷ গভীর আবেগ নিয়ে তাকিয়ে রইল।আমি হাসতে হাসতে ক্লান্ত। ঈশান বসা থেকে উঠে আমার মাথাটা তার বুকের মধ্যে নিল। আমি কিছু বললাম না। অল্প অল্প হাসছি তখনও। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি যেন। ঈশান আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” তারিন শোনো!”

আমি রাগী গলায় বললাম,” কি শুনব?”

ঈশান গাঢ় গলায় বলল,” তুমি আমার।”

আমি ক্লান্ত কণ্ঠে বললাম,” আমার এতো অদ্ভুত লাগছে কেন?”

ঈশান আমার মুখটা হাতে নিয়ে বলল,” কারণ তুমি লাফিং গ্যাস খেয়েছো।”

” লাফিং গ্যাস কি?”

” মানুষকে হাসানোর গ্যাস। ”

” মানুষকে হাসানোরও গ্যাস হয়?”

” নিশ্চয়ই হয়।ডেন্টিস্টদের কাছে থাকে।”

” ডেন্টিস্টদের কাছে কেন?”

” দাঁতের ব্যথা উপশমের জন্য রোগীকে লাফিং গ্যাস দেওয়া হয়। তলহ্ন ব্যথায় কাতরাতে থাকা মানুষটিও হাসতে শুরু করে।”

” তাহলে আপনি এটা দিয়ে কি করেন? আপনি কি ডেন্টিস্ট?”

” না। কিন্তু জিনিসটা আমার মাঝে মাঝে প্রয়োজন হয়। যখন বুকের বামপাশে ব্যথা করে, আমিও লাফিং গ্যাস নেই। আর পাগলেত মতো হাসি। যেমন করে তুমি হাসছো। ”

” আপনার বুকের বামপাশে ব্যথা হয় কেন?”

” জানি না। এখনও খুব ব্যথা হচ্ছে।”

” এখনও হচ্ছে?”

” হুম। এইযে দেখো।”

ঈশান আমাকে আবারও জড়িয়ে ধরল। আমি তার বুকের মাঝে মাথা রাখলাম৷ ঈশান বিভোর কণ্ঠে বলল,” এখন একটু ভালো লাগছে।”

” অদ্ভুত মানুষ আপনি!”

ঈশান প্রবল আবেগ নিয়ে বলল,” তারিন, তুমি কি জানো? তুমিই আমার লাফিং গ্যাস।”

আমি জবাব দিলাম না। প্রথমে চারদিক ঝাপসা, তারপর অন্ধকারে ছেয়ে গেল। কিছু মনে নেই আর। যখন চোখ মেললাম তখন একটা অপরিচিত ঘরে শুয়ে আছি। খানিক বাদেই বুঝতে পারলাম, ঘরটা মোহনা আন্টির। ঘরে সব মেয়েলী জিনিসপত্র। তাছাড়া বিছানার সামনে মোহনা আন্টির বিশাল ফ্রেমের একটা ছবিও আছে।

একটু পর নিহা এলো। আমাকে দেখেই পাগলের মতো হাসতে শুরু করল। আমি ভ্রু কুচকে বললাম,” কি সমস্যা?”

নিহা বিছানায় উঠে এসে বলল,” তুই আজকে এটা কি করলি তারু?”

আমি অসহায় স্বরে প্রশ্ন করলাম,” কি করেছি? খারাপ কিছু?”

” খারাপ না, ফানি! এমনভাবে হাসতে তোকে আমি কখনও দেখিনি।”

” আমি কেন এতো হাসলাম?”

” এটা তো আমিও বুঝতে পারছিলাম না। তারপর ঈশান ভাইয়া বলল তুই নাকি তার ঘরে গিয়ে নাইট্রাস অক্সাইড শুঁকে নিয়েছিস।”

” নাইট্রাস অক্সাইড মানে?”

” মানে লাফিং গ্যাস। অটোমেটিক হাসি পাওয়ার গ্যাস।”

আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম,” আমি উনার ঘরে যাইনি। উনিই আমাকে ডেকে নিয়ে বেলুনের মাধ্যমে লাফিং গ্যাস খাইয়েছেন!”

নিহা হাসি থামিয়ে চোখ সরু করে বলল,” উনি অযথা তোকে ঠেসে ধরে লাফিং গ্যাস খাইয়ে দিয়েছেন? অদ্ভুত! ”

” হ্যাঁ। উনি প্রথমে বিসমিকে দিয়ে আমাকে উনার ঘরে ডাকালেন। তারপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর বললেন হা করতে। আমি চিৎকার করলাম। উনি একটা বিশাল সাইজের বেলুন আমার মুখে চেপে ধরলেন।”

নিহা একটু সিরিয়াস হয়ে বলল,” আমার কি মনে হয় জানিস তারিন? তোর হ্যালুসিনেশন আছে। নাহলে এতো আজগুবি চিন্তা একটা মানুষ কিভাবে করতে পারে? রিডিকিউলাস!”

আমি খুব রেগে বললাম,” নিহা, তুই আমার কথা বিশ্বাস করছিস না?”

” না, করছি না। কারণ তুই যা বলছিস তা টোটালি লজিকলেস। ঈশান ভাইয়া তোকে তার ঘরে নিয়ে দরজা আটকে দিবে? মানে ইম্পসিবল! তাছাড়া তোকে গ্যাস খাইয়ে উনার কি লাভ?”

” কারণ উনি চেয়েছেন, আমি যেন হাসি।”

” উনি তোকে কেন হাসাতে চাইবে? আজব! ”

” বুঝতে পারছিস না? প্রতিশোধ! উনার আবেগমাখা চিঠি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম না? সেজন্যই এভাবে আমাকে অপমান করলেন। অসভ্য!”

নিহা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বোঝাই যাচ্ছে সে আমার কথা পাত্তা দিচ্ছে না। এমন সময় বিসমি ঘরে ঢুকল।

” আপুরা, ম্যাডাম আপনাদের লাঞ্চের জন্য ডাকছেন।”

আমি বিসমিকে দেখেই চট করে বললাম,” এইতো বিসমি এসেছে। ওকেই জিজ্ঞেস কর। তোর ঈশান ভাইয়ার ঘরে আমি সেধে গিয়েছি নাকি সেই আমাকে ডেকেছে! এই বিসমি, বলোতো! আমি যখন ড্রয়িংরুমে বসেছিলাম তখন তুমি এসে বললে না যে আমাকে তোমার ভাইজান ডাকছে?”

বিসমি খুব অবাক হয়ে বলল,” কখন?”

আমি চোখ বড় করে বললাম,” আরে, আজ সকালেই তো! নিহা আর মোহনা আন্টি যখন শপিংয়ে চলে গেল। তখন তুমি আমার কাছে আসোনি?”

বিসমি একটু ভেবে বলল,” হ্যাঁ এসেছিলাম। কারণ আপনিই আমাকে ডেকেছিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন ভাইজানের ঘর কোনটা? আমি দেখিয়ে দিলাম!”

আমি চূড়ান্ত বিস্মিত হয়ে বললাম,” মিথ্যুক! এক চড়ে আমি দাঁত ফেলে দিব তোমার।”

বিসমি ভ্রু কুচকে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমি নিহার দিকে তাকিয়ে বললাম,” এই মেয়ে এক নাম্বারের শেয়ানা।”

নিহা শান্ত সুরে বলল,” বিসমি খুব ভালো মেয়ে তারু। ও অযথা মিথ্যা বলবে না।”

আমি ক্ষীপ্ত হয়ে বললাম,” তাহলে কি আমি মিথ্যা বলছি?”

নিহা মৃদু হাসল,” না। কিন্তু তুই ঈশান ভাইয়াকে নিয়ে একটু বেশিই ভাবছিস৷ তারু, আর ইউ ক্রাশড অন হীম?”

আমার ইচ্ছে করল নিহার গলাটা টিপে দেই। সাথে ঈশানেরও। মানুষটা আমাকে নিয়ে খেলছে। মারাত্মক খেলা খেলছে।

মোহনা আন্টির সাথে আমি আর নিহা খেতে বসেছি। মেন্যু দেখে অবাক লাগছে। এতো ধরণের খাবার যে বাফেট লাঞ্চকেও হার মানাবে। খুব জানতে ইচ্ছে করল আমার জন্যই কি এতো আয়োজন নাকি তারা রোজ এমন খায়? মোহনা আন্টি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন, ” রান্না কেমন হয়েছে তারিন?”

আমি মিষ্টি হেসে বললাম,” খুব ভালো। ”

নিহা রহস্যের ভঙ্গিতে বলল,” বলতো কে রেঁধেছে?”

আমি বললাম,” কে?”

নিহা হাত দিয়ে মোহনা আন্টির দিকে ইশারা করে বলল,” মোহনা আন্টি!”

আমি অবাক হয়ে বললাম,” ওমা তাই? প্রত্যেকটা আইটেম আপনি রেঁধেছেন আন্টি?”

নিহা উত্তর দিল,” অফকোর্স! ”

আন্টি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,” তারিন, তোমার বাড়িতে কে কে আছে?”

” আমি, ভাইয়া, মা, আর দাদী।”

” বাবা নেই?”

আমি মলিন মুখে বললাম,” না। আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন মারা গেছেন।”

মোহনা আন্টি দুঃখিত কণ্ঠে বললেন,” ও আচ্ছা। তাহলে সংসার কে চালায়? তোমার ভাই?”

” জ্বী।”

” বিয়ে করেছে তোমার ভাইয়া?”

” না।”

নিহা অভিযোগ করার মতো বলল,” ওর ভাইটা না খুব রুড। ও যমের মতো ভয় পায় ভাইকে। ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া বাথরুমেও যায় না।”

আমি লজ্জিত ভঙ্গিতে বললাম,” আসলে ভাইয়া খুব কনজার্ভেটিভ। আমার বাবাও এমন ছিলেন।”

মোহনা আন্টি বললেন,” ভালো তো। বাবা যদি হয় প্রথম ছায়া তাহলে বড়ভাই হলো দ্বিতীয় ছায়া। তুমি এখনও ছায়ার নিচে আছো বলেই সুরক্ষিত আছো। এমনিতে কি করে তোমার ভাইয়?”

” ভাইয়ার একটা ছোট ওয়ার্কশপ। লোহার ব্যবসা করে।”

” ও। আচ্ছা।”

মোহনা আন্টি এবার বিসমিকে ডেকে বললেন,” তোমার ভাইজান কোথায়? খেতে আসছে না যে! ডেকে আনো।”

ঈশানের আসার কথা শুনে আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। অস্বস্তি ভর করল মনে। কিছুক্ষণ পরেই ঈশান হাজির হলো। আমাকে দেখেই বলল,” হায় তারিন, তোমার শরীর এখন ঠিকাছে?”

আমি জবাব দিলাম না। নিহা বলল,” হ্যাঁ, হ্যাঁ, একদম ঠিকাছে।”

মোহনা আন্টি হঠাৎ মনে পড়ায় বললেন,” আচ্ছা, পার্টির ওই ছেলেটার কি খবর? তাকে কি পরে আর খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল?”

নিহা উত্তর দিল,” না আন্টি। কিন্তু ছেলেটা তারিনকে চিঠি লিখেছে। এত্তোবড় কাগজে।”

” বলো কি! এখনও পিছু ছাড়েনি?”

আমি গম্ভীর মুখে বললাম,” না আন্টি। এখনও পিছু ছাড়েনি। এক নম্বরের ছ্যাঁচড়া।”

ঈশানের চেহারা দেখার মতো হলো। আমি তার দিকে চেয়ে চেয়ে বললাম,” ছেলেটার নামে ভাবছি ইভটিজিং এর মামলা করব। কি বলেন আন্টি?”

মোহনা আন্টি তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,” ওসব মামলা-টামলায় কাজ হবে না। তুমি বরং এক কাজ করো। তোমার ভাইয়াকে বলে ইচ্ছেমতো মার খাওয়াও। একদম সোজা হয়ে যাবে।”

ঈশান এই পর্যায় বিষম খেল। মোহনা আন্টি পানি ঢেলে দিতে দিতে বললেন,” তোর আবার কি হল?”

ঈশান পাশ কাটানো গলায় বলল,” কিছু না।”

আমি খুব মজা পাচ্ছি। নিহা বলল, ” কিন্তু ছেলেটাকে তো আগে খুঁজে বের করতে হবে!”

মোহনা আন্টি ঈশানের দিকে চেয়ে বললেন,” ঈশান, বদমাইশটাকে কিভাবে খুঁজে বের করা যায় বলতো বাবা?”

ঈশান পানি খেতে খেতে বলল,” পার্টির মধ্যে যদি কেউ হয় তাহলে খুঁজে বের করা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু আউটসাইডার হলে কিভাবে বুঝব?”

নিহা বলল,” পার্টিতে কোনো আউটসাইডার ছিল না ঈশান ভাইয়া। সব আমাদের পরিচিত গেস্ট।”

” ওয়েটার অথবা ক্যামেরাম্যানের মধ্যেও কেউ হতে পারে। তারা তো আউটসাইডারই।”

নিহা হতাশ গলায় বলল,” ঠিক তো! এভাবে ভেবে দেখিনি। তাহলে তো খুঁজে পাওয়া মুশকিল।”

মোহনা আন্টি সাথে সাথে বললেন,” কেন মুশকিল হবে? ঈশান, তোকে আমি দায়িত্ব দিলাম৷ ছেলেটাকে খুঁজে বের কর।”

আমি বিরবির করে বললাম,” ভালো মানুষের কাছেই দায়িত্ব গেছে। যাহ, এবার নিজেকেই নিজে খুঁজে বের কর।”

চলবে

#তি_আমো
পর্ব ৭
লিখা- Sidratul Muntaz

সামনেই ইনকোর্স এক্সাম। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করছি। মা আমার মাথায় তেল লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,” আচ্ছা তারু, তোর স্যারকে একদিন বাড়িতে দাওয়াত করলে কেমন হয়?”

আমি পড়ার তালে ছিলাম। তাই প্রথমেই মায়ের কথাটা বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম,” কোন স্যার?”

মা হাসি-খুশি গলায় বলল,” তোর কোচিং-এর স্যার। সেদিন যে তোকে বাড়ি পৌঁছে দিল!”

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,” হঠাৎ তাকে কেন দাওয়াত করতে চাইছো?”

” আমি না, তারিফ বলছিল।”

আমি শঙ্কিত হলাম। ভাইয়া আর মায়ের মনে কি চলছে বুঝতে পারছি না। আর ঈশানকে বাড়িতে দাওয়াত করার প্রশ্নই আসে না। আমি কঠিন গলায় বললাম,” এসবের কোনো দরকার নেই।”

” দরকার নেই কেন?”

” আমার কোচিং-এ তো পনেরো জন স্যার। সবাইকেই কি বাসায় দাওয়াত করে খাওয়াবে? আজব!”

” সবাইকে খাওয়াতে যাব কেন? আমি শুধু ঈশানের কথা বলছি।”

” তোমার নামও মনে আছে?”

” তো মনে থাকবে না? একই এলাকায় থাকি আমরা। সেদিন তো দেখাও হলো। গলির মোড়ের দোকানটায়। আমার হাতে বাজারের ব্যাগ দেখে বলল, আন্টি দেন। আমি ধরি। আপনার কষ্ট হচ্ছে। সে ব্যাগগুলো বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিল। আমি বললাম, বসো। সে বসল না। তুই বাড়িতে নেই শুনেই চলে গেল।”

ভালোই মাকে কবজা করেছে ঈশান। আমার রাগ লাগল। ইদানীং সে আমাদের বাড়ির আশেপাশে খুব ঘুরছে। ভাইয়ার চোখে পড়লে সর্বনাশ হবে। লোকটা কি চায়? আমি বিরক্ত গলায় বললাম,” বাজারের ব্যাগ ক্যারি করেছে বলে কি এখন তাকে বাড়িতে এনে খাওয়াতে হবে? এসবের কোনো দরকার নেই মা।”

আমার কথা শুনে মা রেগে বলল,” তোর এতো সমস্যা কিসের? তুই তো সম্মানও দিতে জানিস না মানুষকে। সেদিন ঈশানের সাথে তোর কথা বলার ধরণ তো দেখলাম। এমন ভাবে কথা বলছিস যেন স্যার না, সে কোনো বখাটে! কি ভাববে সে? ভাববে আমরা তোকে আদব-কায়দা শেখাইনি।”

আমি নিজেকে ধাতস্থ করে বললাম,” ঠিকাছে। তোমার যা ইচ্ছা তাই করো মা। আমি আর কিছু বলব না।”

” তোকে কিছু বলতেও হবে না। তুই শুধু স্যারের বাসার ঠিকানা দে।”

আমি চুপ করে পড়ার ভাণ ধরলাম। হুট করে বাসার ঠিকানা কিভাবে দিব? সে তো এখানে থাকেই না। মা উত্তর না পেয়ে আবার বলল,” কিরে? ঠিকানা জানিস তো? না জানলেও সমস্যা নেই। আমি খুঁজে বের করব। এই গলির পরের গলি না?”

আমি বিব্রত হলাম,” তোমার খুঁজে বের করতে হবে না। তুমি যে দাওয়াত করেছ এটা আমি কোচিং-এ দেখা হলে স্যারকে বলে দিব।”

” ঠিকাছে। বলিস কিন্তু। সামনের শুক্রবার দুপুরে যেন আমাদের বাড়িতে চলে আসে।”

” আচ্ছা বলব। কিন্তু স্যার না-ও আসতে পারে।”

মা চলে যাচ্ছিল। আমার কথা শুনে থামল।

” না-ও আসতে পারে মানে? আসবে না কেন?”

আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। ঈশানকে তো আমি জীবনেও দাওয়াত করতে যাব না। চট করে মিথ্যা বলা খুব কঠিন। আর একবার মিথ্যা বলে ফেললে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়। আমি এখন মিনিটে মিনিটে মিথ্যা বলছি।

” কারণ শুক্রবারে স্যার বাড়িতে যায়।”

” বাড়িতে যায় মানে?”

” মানে স্যার তো এখানে ব্যাচেলর থাকেন। আর স্যারের মা-বাবা থাকেন মফস্বলে। তাদের সাথেই দেখা করতে যায় আরকি!”

” ও আচ্ছা। তোর স্যার ব্যাচেলর থাকে মানে কি একা থাকে? আহারে! তাহলে রান্না-বান্না কে করে?”

” আমি কিভাবে জানব? একদিন স্যারের বাড়িতে গিয়ে দেখে আসি রান্না-বান্না কে করে.. তারপর তোমাকে জানাই?”

” একা বাড়িতে তুই যাবি কেন? খবরদার!”

আমি হাসলাম,” সত্যি সত্যিই তো আর যাব না। মজা করে বললাম।”

মায়ের কপালে সুক্ষ্ম চিন্তার ভাজ পড়ল। ঈশানের বাড়িতে রান্না-বান্না কে করে তাই নিয়ে মা গভীর দুশ্চিন্তায় ডুবে গেল। একটু পর মা বলল,” আচ্ছা তারু, আমাদের ছাদের ওই চিলেকোঠার ঘরটা তো খালি পড়ে আছে। তোর স্যারকে ওখানে থাকতে দিলে কেমন হয়? তুই জিজ্ঞেস করিস তো ভাড়া নিবে নাকি?”

আমি রেগেমেগে বললাম,” কি উল্টা-পাল্টা কথা বলছ? উনি নিজের বাসা ছেড়ে আমাদের চিলেকোঠার মতো ভাঙা ঘরে থাকতে যাবে কেন?”

মা কোমল স্বরে বলল,” ভাঙা ঘরে কেন থাকবে? তারিফ তো ঘরটা মেরামতের কথা ভাবছেই। আর দেয়ালগুলো রঙ করা হলে আরও নতুন হয়ে যাবে ঘর। তখন তো ভাড়া দেওয়াই যায়। তাছাড়া তোর স্যারের কাছে ভাড়া দিলে লাভ আছে। তোর পড়াশুনাতেও সুবিধা হয়ে গেল। আর তারও খাওয়া-দাওয়ায় সমস্যা হবে না। আমাদের সাথে খাবে।”

বাহ, আমার জননীর মাথার বুদ্ধি দেখে ইচ্ছে করল মোটা বইটা দিয়ে কিছুক্ষণ নিজের মাথায় মারি। কোন দুঃখে যে বলতে গিয়েছিলাম ঈশান ব্যাচেলর!এখন মায়ের মাথায় নতুন ভূত চড়েছে। ওই রাজপুত্র নাকি তার রাজমহল ছেড়ে আমাদের ছোট্ট কুটিরে ভাড়া থাকতে আসবে! জোকস অফ দ্যা ইয়ার।আমার ভেবেই হাসি পেল। মা বলল,” কিরে?বুদ্ধিটা কেমন?”

আমি হেসে বললাম,” খুব দারুণ বুদ্ধি মা। তোমার বুদ্ধি বুদ্ধি খেলা শেষ হলে এবার আমাকে একটু পড়তে দাও?”

এমন সময় পানের বাটা নিয়ে ঘরে ঢুকল বুড়ি। দেখে মনে হচ্ছে আমাদের কথা এতোক্ষণ সব আড়ি পেতে শুনছিল। বুড়ির এই স্বভাবটা অত্যন্ত বাজে। কান পেতে সব কথা শুনবে। বুড়ি আমার বিছানায় আয়েশ করে বসতে বসতে বলল, ” ঘর ভাড়া দেওনের দরকার কি? মাষ্টরের লগে আমগো তারুরে বিয়া দিয়া দিলেই তো হয়। তাইলে মাষ্টরের বেতনও দেওন লাগব না। ফিরি পড়াইবো। মাষ্টরও হইল, ভাড়াইট্টাও হইল, আবার ঘরজামাইও হইল। ঘরের মাইয়া, ঘরেই থাকল।”

বুড়ির কথা শুনে আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। কুচুটে বুড়ির মাথায় সব কুচক্রী মার্কা বুদ্ধি। মাকে দেখলাম হাসছে। আমি অবাক হয়ে বললাম,” ছিঃ এসব তোমরা কি বলছ? উনি আমার স্যার হয়। আমার গুরুজন। উনাকে আমি কিভাবে বিয়ে করব?”

” স্যারের লগে বিয়া নিষিদ্ধ নাকি? ওইদিন খবরে দেখলাম গাইবান্দার এক ছেড়ি মাষ্টরের লগে ভাগছে। বিয়াও হইছে। ”

” সেই মেয়ে ভেগেছে বলে কি আমাকেও ভাগতে হবে? আমি কি বাজে মেয়ে?”

” তোরে তো ভাগতে কেউ কয় নাই। তুই খালি বিয়া করবি।”

আমি বুড়ির ভাষাতে বললাম,” না। আমি বিয়া করতাম না!”

” দেখা যাইব। শুনো আয়েশা, মাষ্টররে ঘরে ডাকো। তার যদি তোমার মাইয়ারে পছন্দ হয় তাইলে আলাপ সালাপ কইরা কথা আগাও। না পারলে আমারে কইও। আমি ব্যবস্তা করুম। পোলাডা ভালা আছে। এক্কেরে চান্দের টুকরা।”

” এতোই যদি চান্দের টুকরা হয় তাহলে তুমিই বিয়ে করে ফেলো।”

” হেই বয়স কি আর আছে?”

” বয়স থাকলে বুঝি বিয়ে করতে?”

” ভাইবা দেখতাম।”

আমি মনে মনে বললাম,” ছিঃ, ছি, নির্লজ্জ বুড়ি!”

আমাদের কথোপকথন শুনে মা খুব জোরে হাসতে লাগলেন।আমি ক্ষেপে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম।

ভাইয়া কিছুদিনের জন্য ঢাকার বাইরে আছে। ঘনিষ্ট এক বন্ধুর মা মারা গেছে। চারদিন শেষ না করে আসতে পারছে না। আমি বেজায় খুশি। ভাইয়া বাড়িতে না থাকলেই নিজেকে মুক্ত পাখি মনে হয়। আগামীকাল নিহার জন্মদিন। আমি ঠিক করেছি আজরাত বারোটায় গিয়ে নিহাকে সারপ্রাইজ দিব। আমাকে এতোরাতে দেখলে নিহার পিলে চমকে উঠবে। নিজের হাতে কেক বানালাম। বুড়ি রাত দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। তাই মাকে শুধু রাজি করাতে হলো। মা অল্পতেই কনভিন্স হয়ে যায়। আমাকে খুব বেশি কষ্ট করতে হলো না।

রাত এগারোটা পঞ্চান্ন। আমি নিহাদের বাড়ির মূল ফটকে দাঁড়িয়ে আছি। গেইট বন্ধ। দারোয়ান শুয়ে পড়েছে। আমি নিহাকে ফোন করতে বাধ্য হলাম৷ এতোরাতে জেগে আছে কি-না কে জানে? প্রথম রিং-এই ফোন ধরল নিহা। অর্থাৎ সে জেগেই ছিল। আমি বললাম, ” একবার বারান্দায় আয়।”

নিহা বিস্মিত হয়ে বলল,” বারান্দায় কেন? তুই কি বাড়ির সামনে?”

” এসেই দ্যাখ!”

নিহা বারান্দায় আসতেই আমি হাত নেড়ে বললাম,” হ্যাপি বার্থডে!”

নিহা প্রচন্ড জোরে একটা চিৎকার দিল। আমি সাবধানী কণ্ঠে বললাম,” আরে কি করছিস? পুরো পাড়া জাগাবি নাকি?”

” তুই এক মিনিট দাঁড়া।”

নিহা দ্রুত নিচে নেমে এলো। গেইট খুলে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” থ্যাঙ্কিউ দোস্ত। আমি ভাবতেও পারিনি তুই এতোরাতে চলে আসবি। বাড়িতে ম্যানেজ কিভাবে করলি?”

” তোর জন্য সব করতে পারি।”

” সত্যি? আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।”

আমি নিহার ডানগালে জোরে চিমটি কাটলাম। নিহা হাসতে হাসতে বলল,” খুব ভালো সময় এসেছিস। আমাদের বাড়িতে তো পার্টি হচ্ছে৷”

” পার্টি মানে? তোর বার্থডের পার্টি?”

” হ্যাঁ। সারপ্রাইজ পার্টি। সব কাজিনরা একসাথে এসে আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছে। আর এখন তুইও এসে পড়লি। এবারের বার্থডেটা সবচেয়ে স্পেশাল। কাল সাফিনও আসবে।”

নিহার গালে লাজুক আভা দেখা যাচ্ছে। আমি বললাম,” বাহ, দারুণ তো! আচ্ছা, ঈশান ভাইয়াও কি এসেছে?”

” না। ঈশান ভাইয়া এই রাতের বেলা আসবে? তাও আমাকে সারপ্রাইজ দিতে? অসম্ভব! তার কাছে ঘুম অনেক ইম্পোর্ট্যান্ট।”

আমি বুকে হাত রেখে বললাম,” উফ, বাঁচলাম।”

নিহা হেসে বলল,” তবে কাল আসতে পারে।”

” তাহলে সকাল হতেই আমি চলে যাব।”

নিহা খিকখিক করে হাসল,” সবাই সকাল পর্যন্ত থাকতে চাইছে ঈশান ভাইয়া আসবে বলে। আর তুই কি-না চলে যেতে চাইছিস? তুই উনাকে এতো অপছন্দ করিস কেন?”

” জানি না।”

রাতে সবাই খুব মজা করলাম। হাসি-আনন্দে কেটে গেল সময়। ঘুমাতে গেলাম রাত দুইটা বাজে। আমি আর নিহা একই ঘরে শুলাম। বাকিরা শুলো গেস্টরুমে। নিহা সারারাত জেগে সাফিন ভাইয়ার সাথে ফোনে কথা বলল। তার কথার যন্ত্রণায় আমি ঘুমাতেই পারলাম না। ফজরের আযান পর্যন্ত জেগে রইলাম। তারপর ঘুমালাম। সেই ঘুম ভাঙল সকাল এগারোটায়। আমি হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙলাম। পাশ থেকে একজন বলল,” গুড মর্ণিং।”

আমি ঘুম জড়ানো কণ্ঠে জবাব দিলাম,” গুড মর্ণিং..”

মানুষটি জিজ্ঞেস করল,” চা না কফি?”

আমি একটু ভেবে বললাম,” কফি!”

তারপর কিছুক্ষণ কাপে চামচ নাড়ার শব্দ পেলাম। পাশ ফিরে মানুষটিকে দেখতেও আমার আলসেমি লাগছে। একটু পর মানুষটি বলল,” তোমার কফি।”

আমি কফি নিয়ে চুমুক দিলাম। মনে হলো যেন অমৃত খাচ্ছি।

” চিনি ঠিকাছে?”

আমি বিরবির করে বললাম,” একদম পারফেক্ট। থ্যাংকিউ!”

এতোক্ষণ পর পাশ ফিরে তাকালাম আর ঈশানকে দেখেই ভীষণ জোরে চিৎকার করে উঠলাম। আমার হাত থেকে কফির কাপ পড়ে ভেঙে গেল। বিছানার চাদর নোংরা হয়ে গেল। নিহা দৌড়ে এসে বলল,

” তারু কি হয়েছে? দুঃস্বপ্ন দেখেছিস নাকি?”

দরজার কাছে দেখলাম নিরা আর সামিয়াও দাঁড়িয়ে আছে। তারাও অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আমতা-আমতা করে বললাম,” ঈশান ভাইয়া এসেছিল।”

” হোয়াট?”

” হ্যাঁ। এইতো, আমাকে কফি দিয়ে গেল।”

আমার কথা শুনে নিরা আর সামিয়া হাসতে শুরু করল। নিহা আমার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,” তুই পাগল হয়ে যাচ্ছিস তারু। ঈশান ভাইয়া আমার বেডরুমে আসবে তাও তোকে কফি দিতে? হাস্যকর! ”

” আমি সত্যি বলছি। নাহলে আমার কাছে কফির কাপ কিভাবে এলো?”

সামিয়া বলল,” কফির কাপটা তো সাইড টেবিলেই ছিল। ঘুম থেকে উঠে হয়তো তুমি নিজেই নিয়েছো।”

আমি উত্তপ্ত কণ্ঠে বললাম,” আমি নিজে কেন নেব? কেউ আমাকে দিয়েছে। আর সে ঈশান। তোমাদের কি মনে হয় আমি মিথ্যা বলছি?”

নিহা বলল,” না। তুই মিথ্যা বলছিস না৷ তুই হয়তো স্বপ্ন দেখেছিস।”

” আমার ঘুমের মধ্যে কথা বলার অভ্যাস নেই নিহা। কফি খাওয়ারও অভ্যাস নেই। যখন আমি কফিতে চুমুক দিলাম তখন ঈশান ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করল, চিনি ঠিকাছে কি-না। সেটাও কি তাহলে স্বপ্নে ঘটেছে?”

আমার কথায় আবার হাসতে লাগল সবাই। নিহা হাসতে হাসতেই বলল,” এটা তোর হ্যালুসিনেশন।”

আমার অতিরিক্ত রাগে কান্না পেয়ে যাচ্ছে। কল্পনা এতো বাস্তব কিভাবে হয়? তাদের কিছুতেই বিশ্বাস করানো গেল না যে ঈশান সত্যিই এসেছিল!

ব্রেকফাস্ট করতে সবাই ছাদে গেলাম। সেখানে টেবিল সাজানো হয়েছে। রাতে অনুষ্ঠান হবে৷ সাফিন ভাইয়ার সাথে দেখা হল। তার পাশে ঈশানও ছিল। তাই আমি আর সেদিকে গেলাম না। পাশ কাটিয়ে চলে আসতে চাইলাম। কিন্তু সাফিন ভাইয়া আমায় দেখে ফেললেন। সাথে সাথে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,” আরে তারিন, কি খবর?”

” এইতো ভাইয়া। ভালো। আপনি কেমন আছেন?”

” আমিও খুবই ভালো। তোমার ঘড়িওয়ালার কি অবস্থা? শুনলাম তোমাকে নাকি চিঠিও লিখেছে?”

আমি লজ্জা পেয়ে বললাম,” এসব আপনাকে নিহা বলেছে তাই না? ওর পেটে একটা কথাও থাকে না।”

” সাবধানে থেকো। যদি পরিচিত কেউ হয় তাহলে সে কিন্তু আজকেও আসবে।”

আমি আঁড়চোখে ঈশানের দিকে চেয়ে বললাম,” আসুক। চোরের দশদিন হলেও গৃহস্থের একদিন। খুব শীঘ্রই দেখবেন ধরা পড়ে গেছে।”

সাফিন ভাইয়া হেসে ফেললেন। আমি টেবিলে এসে বসলাম। এখনও টেবিলে কেউ আসেনি। আমি একাই বসে মোবাইল ঘাটছি। পেছন থেকে হঠাৎ কেউ বলল,” তুমি কি চাও আমি ধরা পড়ি?”

আমি পেছনে তাকিয়ে দেখলাম ঈশান ঠিক দ্বিতীয় টেবিলের প্রথম চেয়ারে বসে আছে। একদম আমার পিঠের কাছে। তবে দুইজন দুইদিকে মুখ করে আছি। দূর থেকে কেউ দেখলে বুঝবেই না যে আমরা কথা বলছি। আমি বললাম,” নিশ্চয়ই চাই৷ আপনার এই খেলা আমার ভালো লাগছে না।”

” আমি কখন খেললাম? খেলছ তো তুমি আমাকে নিয়ে।”

” আমি খেলছি মানে? আমি কি করেছি আপনাকে?”

” করেছ। আমার খুব বড়-সড় ক্ষতি করেছ। এই ক্ষতি পূরণ করতে গেলে সারাজীবন লেগে যাবে তোমার।”

” আপনার ধাঁধার মতো কথা বোঝার মতো জ্ঞান আমার নেই।”

” এটাই তো প্রবলেম। তুমি অবুঝ।”

” আমি অবুঝ না। আপনি কৌশলী। সকালে কি করলেন এটা?”

” কি করলাম?”

” আমাকে কফি দিতে এসে পালিয়ে গেলেন কেন?”

” তুমি চিৎকার করলে কেন?”

” আমি তো ভয়ে চিৎকার করেছি।”

” আমিও ভয়ে পালিয়েছি। ওই অবস্থায় কেউ রুমে ঢুকে আমাকে দেখলে তো গণপিটুনি খেতাম।”

আমি হেসে বললাম,” সেটাই ভালো হতো।”

” আমাকে মার খেতে দেখার এতো শখ তোমার?”

” হ্যাঁ। খুব শখ।”

এই পর্যায় নিহা আর সাফিন ভাইয়া চলে এলো। ঈশান তাদের দেখেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। একটু পরেই টেবিল ভরে গেল মানুষে। চারদিকে হৈচৈ। ঈশান আর আমার মাঝে নীরবতা। তবে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, ঈশান তার পা দিয়ে আমার পায়ে খোঁচা মারছে। আমি রেগে বললাম,” হোয়াটস রং উইদ ইউ?”

ঈশান কোমল কণ্ঠে বলল,” স্যরি।”

সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত। আমাদের কথা কেউ শুনছে না। পাঁচমিনিট পর ঈশান আবারও একই কাজ করল। আমি দ্বিগুণ তেজে বললাম,” আপনি আরেকবার এমন করলে কিন্তু আমি উঠে চলে যাব।”

” আহা, স্যরি। আমি ইচ্ছে করে দিচ্ছি না।”

” তাহলে কি আপনার পা অটোমেটিক আমার পায়ের কাছে চলে আসছে?”

” হয়তো।”

” একদম ফাজলামি করবেন না। আপনি এই নিয়ে দুইবার খোঁচা দিয়েছেন।”

” স্যরিও তো দুইবারই বলেছি।”

” শুধু স্যরি বললেই কি প্রবলেম সোলভ হয়ে যায়?”

” তাহলে কি কিস করতে হবে?”

” নির্লজ্জ!”

ঈশানের শেষ কথাটা নিরা শুনে ফেলল। সাথে সাথেই বোম ব্লাস্টের মতো উচ্চস্বরে বলে উঠল,” এখানে কে কাকে কিস করছে?”

আমি আর ঈশান একসাথে বিষম খেলাম।

চলবে

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here