তি_আমো,১০,১১

0
412

#তি_আমো,১০,১১

পর্ব ১০
লিখা- Sidratul Muntaz

” আমি বাড়ি যাবো।” এই কথা বলেই গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে এলাম। নিহাও ছুটে এলো আমার সাথে। আমার একটা হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বলল,” প্লিজ তারু, বল না এসব কি হচ্ছে?”

আমি লাজুক লাজুক ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বললাম,” জানি না!”

নিহা গোল গোল চোখে তাকাল। কৌতুকপূর্ণ গলায় বলল,” অয়হয়! লজ্জায় তো একদম লাল টমেটো হয়ে যাচ্ছিস। বিয়ে ঠিক হলো আমার। অথচ আমার আগেই বাসর সেরে ফেললি তুই? ভেরি ফাস্ট!”

আমি চকিতে মাথা নেড়ে বললাম,” তুই যা ভাবছিস এমন কিছুই না। আমার চোখ লেগে এসেছিল। তারপর হয়তো ঘুমের মধ্যে শীত লাগছিল তাই ওভাবে… এর বেশি কিছুই না।”

” সেন্টেন্স শেষ কর আগে। ওভাবে কি?”

আমি লজ্জায় মাথা নুইয়ে বললাম,” জড়িয়ে ধরেছিলাম।”

” এটাকে জড়িয়ে ধরা বলে না। সাপটাসাপটি বলে। ঈশান ভাইয়া তো তোকে একদম আষ্টেপৃষ্টে বুকের মধ্যে বিদ্ধ করে রেখেছিল।”

আমি তড়িৎ নিহার মুখ চেপে ধরলাম। আশেপাশে চেয়ে সতর্ক গলায় বললাম,” আস্তে কথা বল। মানুষ শুনে ফেললে কি হবে?”

আমার কথা শুনে নিহাও সাবধান হয়ে গেল। ফিসফিসিয়ে বলল,” শোন, তোরা যে সারারাত একসাথে ছিলি এই কথা যাতে কেউ জানতে না পারে প্লিজ।”

” তোর কি আমাকে বেহায়া মনে হয়? আমি কি জনে জনে এই কথা বলে বেড়াব? তুই কাউকে না বললেই হলো।”

” আমি তো ভুলেও বলব না। এইযে মুখে অদৃশ্য সেলোটেপ আটকে নিলাম। এখানে ঈশান ভাইয়ের দিওয়ানি অনেক আছে। যদি এই কথা জানতে পারে তাহলে সবাই তোর দিকে হিংসা হিংসা দৃষ্টিতে তাকাবে। মুহূর্তেই দেখবি তোর আশেপাশে শত্রু তৈরী হয়ে যাচ্ছে। তুই বিপদে পড়বি। তার চেয়ে ভালো, গোপন থাক। সবকিছু প্রকাশ পাবে বিয়ের সময়। লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করার কিন্তু আলাদা মজা আছে।”

প্রেম, বিয়ে এই শব্দগুলো শুনে আমার কান গরম হয়ে উঠল। লজ্জায় গাল জ্বলতে লাগল। আমি ইতি-উতি করে বললাম,” অনেক দেরি হয়ে গেছে রে। বাড়ি ফিরতে হবে। আমার ফোন কোথায়?”

” আমার কাছে আছে। ও, তোকে বলতে ভুলে গেছি। আন্টি অনেকবার ফোন করেছিল।”

” সেটা তো করবেই৷ দে, ফোন দে।”

নিহা মোবাইল দিতে দিতে বলল,” তোকে অনেক জায়গায় খুঁজেছি আমি। সাফিন তোকে গ্যারেজে পাঠিয়ে নিজেই ভুলে গেছিল। পাক্কা গাঁধা বিয়ে করছি একটা। এরেঞ্জ ম্যারেজ হলে বাবা-মায়ের ঘাড়ে দোষ চাপানো যেতো। কিন্তু লভ ম্যারেজ বলেই ফেঁসে গেলাম। কাউকে দোষ দিতে পারি না। সব দোষ তো নিজেরই।”

আমি ফোন খুলতেই দেখলাম নিরানব্বইটা মিসডকল। সাথে সাথে কলিজা কেঁপে উঠল। মা কি সারারাত ধরে আমাকেই ফোন করেছে? ভাইয়া চলে এলো নাকি? দ্রুত মাকে কলব্যাক করলাম। এতো দীর্ঘসময় ফোন রিসিভ না করার অপরাধে মা আমাকে কিছুক্ষণ ঝারল। তবে ভাইয়ার ফিরে আসতে আরও দুইদিন লাগবে এই কথা শুনে আমি কিছুটা স্বস্তি পেলাম। নিহা বলছিল লাঞ্চ করে যেতে। ঈশানও থাকবে। তাকে দেখার লোভে আমিও থেকে গেলাম।

বাগানে ঈশান আর সাফিন ভাইয়া দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। ঈশানের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে কোনো আসামী। তাকে জেরা করা হচ্ছে। নিশ্চয়ই গতরাতের ব্যাপারেই জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আমি নিহার বেডরুমে বসে আছি। কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছিলাম। ঈশানের কথাগুলো ভাবতেই মনখারাপ হয়ে গেল। কালরাতে ঈশান আমাকে মোহনা আন্টি আর ঈমান আঙ্কেলের সম্পর্কের ব্যাপারে অনেক কিছুই বলেছে। গল্প করতে করতেই রাত্রী পেরিয়ে ভোর হয়েছে। একটি ঘটনা এখনও আমার খুব মনে পড়ছে। আর মনে পড়তেই বার-বার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ঈশান বলেছিল,

” জানো তারিন, তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। একটি লোক প্রায়ই আমাদের বাড়িতে যাওয়া-আসা করতো। বাবা ওইসময় বেশিরভাগ লন্ডন থাকতো। বাবা আর মম বিজনেস পার্টনার ছিল। তাই বাবার অনুপস্থিতিতে মমকেই অফিস সামলাতে হতো। আমি ভাবতাম ওই লোকটি অফিসের কাজে বাড়িতে। একদিন দেখলাম লোকটি খুব উঁচু আওয়াজে আমার মমের সাথে কথা বলছে। এতোটা এগ্রেসিভ ওয়েতে বাবাকেও কখনও মমের সাথে ঝগড়া করতে দেখিনি। আমার রাগ হলো। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম। আমি ছুটে গিয়ে লোকটির কলার চেপে ধরে বললাম আর কখনও যাতে আমাদের বাড়িতে না আসে। লোকটি অপমানিত হয়ে বেরিয়ে গেল। মম সেদিন খুব কাঁদল। কিছুদিন পর মম আমার কাছে রিকোয়েস্ট করল আমি যেন লোকটিকে স্যরি বলি। কিন্তু আমি রাজি হলাম না। কারণ ওই ঘটনায় আমার কোনো দোষ ছিলই না। আমি কেন স্যরি বলব? তবুও মমের অনুরোধে আমি স্যরি বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। তখন থেকেই বুঝতে পারতাম আমার মম আর আগের মতো নেই। বাবা আর মম আর একসঙ্গে থাকে না। তাদের মধ্যে সবসময় ঝগড়া হয়। লন্ডনে বাবার গার্লফ্রেন্ড আছে। আর যে সুদর্শন লোকটিকে আমি অপমান করে বের করে দিয়েছিলাম, সে আসলে মমের বয়ফ্রেন্ড। ছোটবেলা থেকে বাবা-মমের ঝগড়া দেখে বড় হয়েছি। ভেবেছিলাম বড় হলে, বয়স বাড়লে তারা শুধরে যাবে। কিন্তু তারা শুধরায়নি। আর এখন তো পারমানেন্টলি ডিভোর্স নিচ্ছে। আমি যেমন তাদের বড় হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম, তেমনি তারাও আমার বড় হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। এখন আমি নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারি। তাই তারাও আমার দায়িত্ব নেওয়া ছেড়ে দিয়েছে। দুইজন দুই রাস্তায় চলে যাচ্ছে। আমার পৃথিবীটা দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে তারিন। একভাগে মায়া, অন্যভাগে টান। আমি কোন ভাগ বেছে নেই বলোতো?”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম। কিছু বলতে পারিনি। কথাগুলো মনে করে আবারও মন বিষণ্ণ হয়ে উঠল।আহারে, ঈশানের মনে এতো কষ্ট! অথচ তাকে দেখলে তো কখনও বোঝা যায় না!
হঠাৎ খেয়াল করলাম, ঈশান আমাকে ইশারায় বারান্দায় যেতে বলছে। আমি দ্রুত হেঁটে গেলাম। ঈশান দুইমিনিটে পাশের বারান্দায় এলো। ওই ঘরটা রুবা আন্টিদের। বারান্দা পাশাপাশি হওয়ায় হাত পর্যন্ত ধরা যায়। তবে আমরা হাত ধরলাম না। ঈশান দেয়ালে হাত ঠেঁকিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে বলল,” নিহা কিছু জিজ্ঞেস করেছে?”

আমিও একই ভঙ্গিতে বাইরে তাকালাম। দূর থেকে কেউ দেখলে হয়তো বুঝবেই না আমরা কথা বলছি। আমি বললাম,” হুম।”

” কি জিজ্ঞেস করল? আর তুমি কি বললে?”

” যা সত্যি তাই বলেছি। গল্প করতে করতে ঘুম চলে এসেছিল। এর বেশি কিছুই না।”

” সত্যি? এর বেশি কিছুই না?”

আমি বিব্রত হলাম। লজ্জিত কণ্ঠে বললাম,” মানে নিহাকে ম্যানেজ করার জন্য বলেছি।”

” ও তার মানে শুধু নিহাকে ম্যানেজ করার জন্য বলেছো? আসলে অন্যকিছু?”

আমি লজ্জায় ভ্যাবাচেকা খেলাম। বিরক্ত হওয়ার ভাণ ধরে বললাম,” আপনি আমাকে কনফিউজড করছেন।”

ঈশান শব্দ করে হাসল৷ আমি তার গজদন্ত যুক্ত হাসি দেখার লোভে সমস্ত অস্বস্তি উপেক্ষা করে তাকালাম। আমাকে ওমন হাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে ঈশান আশ্চর্য হয়ে বলল,” কি ব্যাপার?”

আমি সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরিয়ে বললাম,” কিছু না।”

” বাড়ি ফিরবে কখন?”

” নিহা বলল, লাঞ্চের পর যেতে।”

” ঠিকাছে। লাঞ্চের পর আমি বাইরে অপেক্ষা করব।”

” আমরা কি একসাথে যাব?”

” তোমার কোনো সমস্যা আছে?”

আমি মাথা নেড়ে ‘ না’ বলেই ভেতরে চলে এলাম। নিহা বিছানায় বসে শব্দ করে হাসছে। সে ফোনে কথা বলছে। কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারলাম, মানুষটি মোহনা আন্টি। আচ্ছা, মোহনা আন্টির সাথে নিহা কি নিয়ে এতো হাসাহাসি করছে? আমি একটু অবাকই হলাম। নিহা ফোন রাখতেই আমি প্রশ্ন করলাম,” লাইনে কে ছিল? মোহনা আন্টি?”

নিহা দুষ্টমি করে বলল,” হ্যাঁ। তোর হবু শ্বাশুড়ী।”

” কি নিয়ে কথা হচ্ছিল? এতো হাসছিলি কেন?”

” এমনি সাধারণ একটা বিষয়। মোহনা আন্টি ফোন করলেই আমার এই অবস্থা হয়। উনি এমন সব কথা বলে যে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যায়।”

আমি হতাশ কণ্ঠে বললাম,” যাদের জীবনে খুব দুঃখ তারাই বেশি হাসে তাই না?”

নিহা কপাল-টপাল কুচকে বলল,” কার জীবনে দুঃখ? মোহনা আন্টির? উনি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ, ওকে? কি নেই উনার? পছন্দের মানুষকে বিয়ে করেছেন, মনের মতো ছেলেকে মানুষ করেছেন, টাকা-পয়সার কথা তো নাই-ই বললাম!”

” পছন্দের মানুষকে বিয়ে করলেন কিভাবে? আমি তো শুনেছিলাম মোহনা আন্টির সাথে ঈমান আংকেলের বিয়েটা ফ্যামিলি প্রেশারে হয়েছিল। কেউই রাজি ছিল না।”

” হোপ! কচু জানিস তুই। তাদের সেই ছোট্টবেলা থেকে প্রেম। পিউর লভ ম্যারেজ। তারা কাজিন ছিল তো। মোহনা আন্টি আমার দূর সম্পর্কের খালা হয়। আর ঈমান আংকেল আমার মামা। এবার হিসাব কষে সম্পর্ক বের কর।”

আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ঈশান তো বলেছিল, তার বাবা-মাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যে কারণে তারা কেউই সুখী ছিল না। আমি কনফিউশন ক্লিয়ার করতে বললাম,” আচ্ছা, ঈমান আংকেল আর মোহনা আন্টির রিলেশন কেমন?”

” একদম মেইড ফোর ইচ আদার। এতো বয়সে এসেও তাদের মধ্যে যেই প্রেম.. তুই দেখলে তব্দা খাবি। মামা কিন্তু খুব রোমান্টিক। তোর ভাগ্যটা ভালোরে। ঈশান ভাইয়াও মামার মতো রোমান্টিক হবে।”

নিহা খিলখিল করে হাসল৷ আমি রাগে ঝনঝন করে উঠলাম,” সবসময় ফাজলামি ভালো লাগে না। তুই কি নিশ্চিত হয়ে বলছিস? সত্যিই কি তাদের রিলেশন এতো ভালো?”

নিহা দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,” অবশ্যই। কোনো সন্দেহ আছে? এইতো কয়েক মাস আগে তাদের ছাব্বিশতম ম্যারেজ ডে সেলিব্রেট হলো। তারা হানিমুনেও গিয়েছিল। দুবাই।”

আমি বিস্ময়ে উঠে দাঁড়ালাম। নিহা আশ্চর্য হয়ে বলল,” কি হয়েছে? তুই এমন করছিস কেন? আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা, তোকে মিথ্যা বলে আমার লাভটা কি?”

আমি বিরবির করে বললাম,” তোর কথা যদি সত্যি হয় তাহলে খুব খারাপ হবে নিহা।”

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানে চলে এলাম। অস্থির লাগছে। মাথা ব্যথা করছে। এই মুহূর্তে আমি যা চিন্তা করছি তা যেন কখনও না হয়। ঈশান এতো নিকৃষ্ট হতে পারে না। শুধুমাত্র আমাকে হাসিল করার জন্য সে তার বাবা-মা সম্পর্কে বানিয়ে বানিয়ে এতো কুরুচিপূর্ণ কথা বলতে পারল? আমি নিজেকে শান্ত করতে চেয়ার টেনে বসলাম। অতিরিক্ত রাগ হলে আমার চোখ দিয়ে পানি বের হয়। এখনও বের হচ্ছে। হঠাৎ ফাহিম ভাই কোথ থেকে এসে আমার পাশে বসল। চটপট করে বলল,

” হাই তারু, একটা মিউজিক শুনবে? আমি বানিয়েছি। ওহো, তোমাকে তো বলাই হয়নি। আমি কিন্তু গিটার বাজানো শিখছি।”

আমি যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে বললাম,” আমার এই মুহূর্তে মিউজিক শুনতে ইচ্ছে করছে না ফাহিম ভাই। প্লিজ!”

” কেন? এনি প্রবলেম? তোমাকে ডিস্টার্বড দেখাচ্ছে!”

ফাহিম ভাই আমার কাঁধে হাত রাখল। আমি হাত সরিয়ে বললাম,” ভালো লাগছে না। মাথাব্যথা। আমি একটু একা থাকতে চাই।”

” মাথাব্যথা করছে? তুমি আগে বলবে না? দাঁড়াও, রুবা কাকীকে দিয়ে এখনি আদা চা বানিয়ে আনছি।”

” নো থ্যাংকস। আমি আদা চা খাই না।”

” তাহলে শরবত খাবে? ঠান্ডা, ঠান্ডা।”

আমার প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। অন্যকেউ হলে নির্ঘাত চড় মেরে দিতাম। ফাহিম ভাই বয়সে বড় আবার নিহার কাজিন, তাই কিছু বলতে পারছি না। আমার হাজার বারণ করা সত্ত্বেও যখন ফাহিম ভাই যাচ্ছে না তখন হঠাৎ দমকা হাওয়ার মতো ছুটে এলো ঈশান। আমি অবাক হয়ে দেখলাম। ঈশান চোয়াল শক্ত করে ফাহিম ভাইকে বলল,” তুই কি বাংলা কথা বুঝিস না? ও নিষেধ করেছে। না মানে না!”

ফাহিম ভাই স্তব্ধ হয়ে একবার আমাকে দেখল তো একবার ঈশানকে। ঈশান ভারী কণ্ঠে বলল,” যা।”

ফাহিম ভাই মুখটা কালো করে সরে গেল। ঈশান আমার পাশে বসল। নরম স্বরে কিছু বলতে চাইল হয়তো। আমি তাকে সেই সুযোগ না দিয়েই সেখান থেকে উঠে চলে এলাম। জানি এখন ঈশান খুব বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তবুও আমার কিছু যায়-আসে না। সে প্রতারণা করেছে, মিথ্যা বলেছে। নোংরা মিথ্যা! অথচ আমি তখনও জানতাম না, আমাদের এই গল্পে ঈশান কখনোই আমার সাথে মিথ্যা বলেনি। বরং আমিই সেই নির্বোধ মানবী যে প্রতিটি পদে ঈশানকে শুধু ভুল বুঝে গেছি।

এই পর্বে ৫০ টা কমেন্ট হলে নেক্সট পর্ব সকালে দিব। কিন্তু শর্ত হলো, কয়েক লাইনের প্রাসঙ্গিক কমেন্ট হতে হবে। গল্প সম্পর্কে। অন্য কমেন্টগুলো যেমন, নাইস নেক্সট আমাজিং, স্টিকার, এগুলো কাউন্ট হবে না। আর একজন শুধু একটাই কমেন্ট করবেন। ওকে, গুড নাইট।

চলবে

#তি_আমো
Writer: Sidratul muntaz
পর্ব- ১১

আমি বাগান থেকে ছুটে এসে নিহার ঘরে ঢুকলাম। নিহা তখন ফোনে সাফিন ভাইয়ের সাথে কথা বলছে। কিছু মানুষ আছে ফোনে কথা বলতে ওস্তাদ। দিনে কমপক্ষে সাত-আটঘণ্টা ফোনে কথা না বললে তাদের পোষায় না। নিহাও সেরকম। সাফিন ভাইয়া বাগানেই আছেন। তাহলে অযথা তার সঙ্গে ফোনে কথা বলে টাকা নষ্ট করার কি দরকার?

আমি নিহার ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসলাম। ঠিক সেই সময় সামিয়া এসে বলল,” নিহা, ঈশান কাল সারারাত কোথায় ছিল?”

সে প্রশ্নটা এমনভাবে করল যেন ভয়ংকর কোনো এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। নিহা পাশ কাটানো গলায় বলল,” আমি কি জানি?”

” তোরা সকালে উনাকে কোথায় পেয়েছিস?”

” আমি পাইনি। সাফিন পেয়েছে৷ তাকেই গিয়ে জিজ্ঞেস কর।”

” আমি সাফিন ভাইকে জিজ্ঞেস করেই এখানে এসেছি। সাফিন ভাই বলছে, ঈশান নাকি তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে ছিল?”

এই কথা শুনে বিষম খেলাম আমি। নিহা আঁড়চোখে একবার আমাকে দেখে নিয়ে বলল,” হতে পারে!”

সামিয়া আশঙ্কাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল,” আর ইউ শিউর? ঈশানের গার্লফ্রেন্ড আছে? কে সে? আনিকা আপু?”

” আমি জানি না সে কে… তবে আনিকা আপু না। চিল!”

সামিয়া দিশেহারার মতো বলল,” তাহলে আর কে হতে পারে? নিহা, আমি তোকে পাঁচহাজার টাকা দিবো। তুই শুধু মেয়েটাকে খুঁজে বের কর।”

আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম,” পাঁচহাজার টাকা লাগবে না। আমিই তোমাকে বলছি কাল সারারাত ঈশানের সাথে কে ছিল? ”

নিহা ইশারায় আমাকে থামতে নির্দেশ দিল। সামিয়া উদগ্রীব হয়ে তাকাল,” তুমি জানো? তাহলে বলো না, প্লিজ!”

আমি মৃদু হেসে বললাম,” কিন্তু ব্যাপারটা যাতে কেউ জানতে না পারে।”

” জানলে কি হবে?”

” মেয়েটা তো ঈশানের গার্লফ্রেন্ড না। তাই জানাজানি হলে ব্যাপারটা খারাপ হবে।”

” গার্লফ্রেন্ড না হলে ওরা সারারাত একসাথে থাকবে কেন? আচ্ছা বাদ দাও, বলো কে?”

” আমি।”

সামিয়া চোখ বড় বড় করে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,” হোয়াট?”

আমি মাথা নাড়লাম। সামিয়া মানতেই পারছে না এমনভাবে বলল,” তোমার তো হ্যালুসিলেশন আছে। সব উল্টা-পাল্টা কল্পনা করো। কাল সকালেও বললে ঈশান নাকি তোমাকে স্বপ্নে কফি দিয়ে গেছে।”

” কফির ব্যাপারটাও সত্যি ছিল আর এটাও সত্যি।”

সামিয়া নিহার দিকে চাইল। নিহার হাতের ইশারায় বোঝাল, আমি পাগল। আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম।

সামিয়া হাত ভাজ করে বলল,” আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না তারিন। নিশ্চয়ই আবার স্বপ্ন দেখে ভুল-ভাল বকছো।”

এই কথা বলে সামিয়া চলে গেল। নিহা হাসতে হাসতে বলল,” এটা হচ্ছে তোর সতীন নাম্বার টু। আর নাম্বার ওয়ান হচ্ছে আনিকা আপু। সেই ক্লাস টেন থেকে ঈশান ভাইয়াকে পছন্দ করে। বুঝতেই পারছিস কেন সবার থেকে তোকে লুকাতে বলেছিলাম। ”

” তুই সামিয়াকে কেন বললি যে আমি পাগল?”

” সামিয়ার মুখপাতলা। ও নিউজ রিপোর্টারের মতো সবার কাছে ছড়াবে। আর এই ঘটনা জানাজানি হলে তোরই ক্ষতি। আমি নিজেই বলছি, আমার কাজিনগণ যথেষ্ট দজ্জাল। তাই ব্যাপারটা গোপন রাখ। ভালোর জন্যই বলছি।”

” গোপন রাখার মতো কিছুই নেই এখানে। তাই গোপন রাখার প্রশ্নই আসে না।”

নিহা আমার কথার অর্থ বুঝতে না পেরে বলল,” মানে?”

আমি নির্বিকার কণ্ঠে বললাম,” কিছু না।”

দুপুরে খাওয়ার সময় আমি সবার সাথে খেতে ডাইনিং টেবিলে গেলাম না। কারণ ঈশানের চেহারাও দেখতে ইচ্ছে করছে না। নিহা আমার জন্য খাবার পাঠিয়ে দিল। আমি বললাম খিদে নেই। বিছানায় বসে বই পড়ছিলাম। এমন সময় দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। আমি ভয়ে চমকে উঠলাম। নিহা এলে তো খোলা দরজায় কড়া নাড়বে না। তাহলে কে? আমি প্রশ্ন করলাম,” কে?”

ঈশানের স্থির কণ্ঠ ভেসে এলো,” আমি। আসব?”

” আপনি এখানে কেন? কেউ দেখে ফেললে?”

ঈশান ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলল,” দেখলে দেখবে! আমার তো কোনো অসুবিধা নেই।”

তারপর সে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি আৎকে উঠে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,” দরজা খুলুন।”

ঈশান সহজ হেসে বলল,” ভয়ের কিছু নেই। এই সময় এদিকে কেউ আসবে না।”

” এই কথার দ্বারা আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?”

” কিছুই না। তুমি বললে আমি এখনি চলে যাব। শুধু জানতে এসেছিলাম তোমার কি হয়েছে? নিহা বলল, শরীর খারাপ নাকি?”

” আমার শরীর একদম ঠিকাছে।”

” তাহলে খেতে আসোনি কেন?”

” খিদে নেই।”

” খিদে নেই কেন?”

” সব কৈফিয়ৎ কি আপনাকে দিতে হবে? আপনি নিজেকে কি মনে করেন?”

ঈশান বিস্ময় প্রকাশ করল,” তোমার প্রবলেমটা কি তারিন?”

” আমার তো কোনো প্রবলেম নেই! সব প্রবলেম আপনার মধ্যে। সমস্ত ঘাপলা আপনার। আমি তো একটা নির্বোধ প্রাণী। যাকে চাইলেই মিথ্যা বলে ধোঁকা দেওয়া যায়।”

” কে তোমাকে ধোঁকা দিল?”

” আপনি। কালরাতে সবকিছু মিথ্যা বলেছেন।”

ঈশান আহত গলায় বলল,” ও। তোমার তাহলে ওই সবকিছু মিথ্যা মনে হয়েছিল?”

আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম,” হ্যাঁ। ”

ঈশান হতাশ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,” ওকে। গুড।”

আমি দরজা খুলে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বললাম,” দয়া করে আর কখনও আমার সামনে আসবেন না, প্লিজ।”

সেদিনের পর ঈশান আমাকে আর একবারও বিরক্ত করেনি। আমিও তাকে নিয়ে ভাবিনি। কিন্তু এই ঘটনার দুইদিন পরেই আরও একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল। যা আমরা কেউই চিন্তা করিনি।

সেদিন ছিল ছুটির দিন। বেসিনে দাঁড়িয়ে দাঁতব্রাশ করছি। বুড়ি আমার আশেপাশেই ঘুরাঘুরি করছে। দুইদিন বাড়ি না ফেরার কারণে বুড়ি ক্ষীপ্ত। মা অবশ্য বিষয়টা সামলে নিয়েছিল। আমি নিহার বাড়িতে পরীক্ষার জন্য গিয়েছিলাম ইম্পোর্ট্যান্ট কিছু বইয়ের জন্য। নিহারও এক্সাম সামনে। তাই সে আমাকে বই দেয়নি। দু’জন একই বই দিয়ে পড়াশুনা করেছি। এই যুক্তি বুড়ি কতটুকু মেনেছে বোঝা যাচ্ছে না। ভাইয়া এলে কূটনামি নিশ্চয়ই করবে। সে করুক। মা আছে তো! মা আমাকে সবসময় বাঁচিয়ে দেয়। এজন্যই মাকে আমি ডাকি রক্ষকবচ বলে।

মুখ ধুয়ে নাস্তা খেতে বসলাম। শক্ত শক্ত রুটি চিবাতে হচ্ছে। শুক্রবারে শক্ত রুটি ছাড়া কপালে ভালো কিছু জোটে না। কারণ আমি ঘুম থেকেই উঠেছি বেলা করে। আজ ভাইয়ারও ফেরার কথা। সকালেই তো এসে পড়ার কথা ছিল৷ এখনও আসছে না কেন?

মা ডাইনিং টেবিলে আমার পাশে এসে বসল। মুখটা মলিন করে বলল,” তারিফকে একটা মেসেজ পাঠাতে পারবি?

” ভাইয়াকে মেসেজ? কেনো?”

” সেই ভোরবেলা বলেছিল ঢাকায় ঢুকে গেছে। এখন পর্যন্ত এসে পৌঁছাল না। যে রাস্তা দিয়ে ফিরবে ওই রাস্তায় নাকি এক্সিডেন্টের কারণে বড় গাড়ি চলা বন্ধ। বাস, ট্রাক কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু রিকশা আর কয়েকটা ঠেলাগাড়ি চলছে। এখন এতোটা পথ কি রিকশায় আসা সম্ভব?কি একটা অবস্থা বল তো?”

“এখন কি করবে?”

” ফোন করছি। কিন্তু নেটওয়ার্ক বিজি। তুই মেসেজ পাঠিয়ে একটু জিজ্ঞেস কর তো, কোথায় আছে?”

মা আমার দিকে ফোন এগিয়ে দিল। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে বললাম,

“আচ্ছা দাঁড়াও, আমি আরেকবার ফোন করে দেখি। তারপর মেসেজ দিবো।”

আমি ফোনই করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ডায়াল লিস্টে ঢোকার আগেই হর্ণের তীক্ষ্ণ শব্দ কানে এলো। শব্দের উৎস খুঁজতে আমি আর মা সদর দরজার দিকে তাকালাম। বড় একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। সেই গাড়ি থেকে নামল ভাইয়া। আমি টেবিল ছেড়ে উঠে দৌড়ে ভাইয়ার দিকে এগিয়ে গেলাম। মাও আমাকে অনুসরণ করে এলেন। ভাইয়াকে এতোবড় গাড়িতে দেখে প্রথমেই একটু হতচকিত হলাম। তার থেকেও বেশি চমকালাম, যখন দেখলাম গাড়ির মালিক ঈশান! ভাইয়া প্রীতিকর হাসি দিয়ে ঈশানকে বলল,

” থ্যাঙ্কিউ সো মাচ। ভেতরে চলো।”

ঈশান আমার দিকে তাকাল দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে। মা উচ্চস্বরে বলল, ” আরে তুমি? তোমাকে কয়েকদিন ধরে তো দেখাই যাচ্ছে না। কোথায় ছিলে?”

তারিফ ভাই ঈশানের কাঁধ চাপড়ে বলল,” ও হচ্ছে আমার.. বলতে পারো বিপদের বন্ধু। মাঝরাস্তা থেকে নিজের গাড়িতে তুলে বাসা পর্যন্ত সেইফলি নিয়ে এসেছে। ও না থাকলে আজ বাড়ি আসতে খবর হয়ে যেতো। সূর্য ডুবিয়ে ঘরে ঢুকতাম। তুমি যে কি উপকার করেছো ভাই! তোমাকে আজ লাঞ্চ ট্রিট না দিতে পারলে আমার মন শান্ত হবে না।”

মা বলল,” এমনিতেও আমি ভাবছিলাম তোমাকে একদিন দাওয়াত করে খাওয়াব। ভালোই হলো তুমি এসেছ। ”

ঈশান ইতস্তত করে বলল, “কিন্তু আজকে মনে হয় আপনাদের কথাটা আমি রাখতে পারবো না। তবে নেক্সট টাইম অবশ্যই আসবো।”

আমি বুঝতে পারছি ঈশান আমার জন্যই বাড়িতে ঢুকতে চাইছে না। গত পরশু নিহাদের বাড়ি থেকে চলে আসার পর দুইদিন হয়ে গেল আমি ঈশানের ফোন ধরছি না। তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। আরও যতভাবে তাকে অবহেলা করা যায়, আমি করছি। এটাও বলেছি যেন আমাকে সে আর কখনও ফোন না দেয়।

মা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, “না। কোনো নেক্সট টাইম শুনব না। তুমি সবসময় একই কথা বলো।”

তারিফ ভাইয়া ভ্রু কুচকে তাকাল মায়ের দিকে,” সবসময় একই কথা বলে মানে?”

মা চওড়া হাসি দিয়ে বলল,” সেদিন তো ঈশান আমার বাজারের ব্যাগ পৌঁছে দিল বাসা পর্যন্ত। আমি ভেতরে আসতে বললাম, কিন্তু এলো না। বলেছিল নেক্সট টাইম৷ এখনও একই কথা বলছে। আজকে কিন্তু তোমাকে আমি যেতে দিচ্ছি না।”

ভাইয়া ঈশানের কাঁধে হাত রেখে বলল,” এবার তো তোমাকে ছাড়ার প্রশ্নই আসছে না। বাসায় তোমাকে ঢুকতেই হবে।চলো ভেতরে গিয়ে কথা বলি।

ঈশান যথেষ্ট দ্বিধা নিয়েই ভেতরে ঢুকল। এদিকে আমি দুশ্চিন্তায় মরে যাচ্ছি। ভেতরে গিয়ে আর কি কি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় কে জানে?

বসার ঘরে আড্ডা দিচ্ছে ঈশান আর ভাইয়া। মা আমার হাতে শরবতের ট্রে ধরিয়ে বলল,” এগুলো ওদেরকে দিয়ে আয়।”

ঈশানের সামনে যেতে আমার অস্বস্তি লাগছে। আমি বললাম,” একটু পর ভাতই খাবে। এখন আবার শরবত কিজন্য?”

” ছেলে দু’টো এতোদূর থেকে এসেছে। একটু ঠান্ডা খেতে দিব না?”

আমি বিরস মুখে ট্রে নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ঈশান সঙ্গে সঙ্গেই আমার দিকে চাইল। দৃষ্টি বিনিময় হলো। আমি লক্ষ্য করলাম তার চেহারায় বিষণ্ণ ভাব। চুল উশকোখুশকো। মনে হয় না জানি কতদিন ধরে আঁচড়ায়নি। তবে বলতে কি, এলোমেলো চুলেই তাকে মানাচ্ছে।আমি ট্রে টা টেবিলে রাখলাম। ভাইয়া আমায় জিজ্ঞেস করল,

“মা কোথায় রে?”

“রান্নাঘরে।”

“আচ্ছা ঠিকাছে তুই যা। মাকে আসতে বল।”

ভাইয়ার শেষ কথাটা শুনে আমার বুকের ভেতর কেমন জানি ধুকপুক করছে। আমি রান্নাঘরে ঢুকে মায়ের কাছে ভাইয়ার বার্তা পৌঁছে দিলাম। মা আমাকে চুলায় বসানো মাংসের হাড়িতে নজর রাখতে বলে ড্রয়িং রুমে গেল। এদিকে আমার মনও রান্নাঘরে টিকছে না। ওদিকটায় কি নিয়ে আলাপ হচ্ছে সেটা না জানতে পারলে অস্থিরতা কমবে না। শেষমেষ মিথ্যে বলার জন্য ধরা পড়ে যাবো না তো? ঈশান যদি মুখ ফসকে কিছু বলে দেয় তাহলেই যে শুরু হবে কেলেংকারী! তার উপর বুড়িটা যদি একবার জানতে পারে সেদিন আমি কোচিং এ না গিয়ে নিহার এংগেজমেন্ট পার্টিতে গিয়েছিলাম, তাহলে তো কালবৈশাখী শুরু হয়ে যাবে। মায়ের সাথে সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে বলার জন্য মাও আমাকে আস্তো ছাড়বে না। উফফ, টেনশনে মাথা ধরে আসছে। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকলাম না। গুটি গুটি পায়ে হেঁটে বসার ঘরের দিকে গেলাম। পর্দার পেছনে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে রইলাম। এক কথায় আড়ি পাততে লাগলাম। মায়ের গলার আওয়াজ ভেসে এলো,

” আচ্ছা ঈশান! তুমি যে বাসায় একা থাকো, তোমার খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোনো অসুবিধা হয়না?

তারিফ ভাইয়া অবাক হয়ে বলল, ” ঈশান বাসায় একা থাকে? তোমাকে এই কথা কে বলল মা?”

” কেনো তারিন বলেছে! ওর বাবা-মা তো মফস্বলে থাকে। আর ও লেখাপড়ার জন্য এইখানে একা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। কি ঈশান? ঠিক তো?”

ঈশান দ্বিধাভরা কণ্ঠে বলল,” হ্যাঁ। ঠিক।”

আমি মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এর মাঝে ভাইয়া আবার বলল, ” তাহলে তুমি যে তখন ফোনে মায়ের সাথে কথা বলছিলে? বাসায় আর কখনও ফিরবে না, এসবই তো বলছিলে। সেটা কি ছিল?”

ঈশান বিব্রত কণ্ঠে বলল, ” আসলে মায়ের সাথে ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়েছে। আজ আমার বাড়ি ফেরার কথা ছিল। মানে মফস্বলে আর কি.. তাই আমি ফিরব না বলেছি।”

” কোথায় তোমার বাড়ি? কোন জেলায়?”

ঈশান আমতা আমতা করে বলল, “তারিন.. যেখানে বলেছে। সেখানেই।”

এই কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম। ঈশানের ঘটে বুদ্ধি আছে ভালোই।

তারিফ ভাই মাকে প্রশ্ন করল,” মা, তারিন কোন জেলায় বলেছে?”

মা ইতস্তত করে বলল, ” তারিন তো কোনো জেলার নাম বলেনি।”

ঈশান ভেবে বলল, ” কিশোরগঞ্জ। আমার বাড়ি কিশোরগঞ্জ।”

ভাইয়া এবার বলল ” আজকে কি তোমার কিশোরগঞ্জ যাওয়ার কথা ছিল?”

ঈশানের প্রশ্নের উত্তর মা দিয়ে দিল,” হ্যাঁ। ও তো প্রত্যেক শুক্রবার কিশোরগঞ্জে যায়। বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে।”

ঈশান অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,” এটাও কি তারিন বলেছে?”

” হ্যাঁ। কেন? সত্যি না?”

” একদম সত্যি।”

আমার ঈশানের জন্য মায়া লাগছে। আমার একটা মিথ্যা ঢাকতে বেচারা কত-শত মিথ্যা বলে যাচ্ছে!

মা করুণ স্বরে বলল,” এতোটা দূর প্রতি সপ্তাহে যাওয়া আসা করো? খুব কষ্ট হয়ে যায়না?”

তারিফ ভাই বলল, “কষ্টের কি আছে? গাড়ি নিয়ে যায়। তাই হয়তো প্রবলেম হয়না। আচ্ছা, এই গাড়িটা কি তোমার?”

ভাইয়ার প্রশ্নে আতঙ্কিত অনুভব করলাম আমি। গাড়ির ব্যাপারটা ভুলেই গেছিলাম। সামান্য কোচিং এর স্যার, যার বাবা-মা থাকে মফস্বলে তার কাছে এতোবড় গাড়ি আসবে কোথ থেকে? এই কথা তো কোনো গাঁধাও মানবে না। আর আমার ভাইয়া তো গাঁধাও নয়। কিন্তু ঈশান ব্যাপারটা খুব সুন্দর কৌশলে সামলে নিল।

ঈশান বলল, জ্বী? আসলে গাড়িটা আমার নিজের না। এটা আমার ফ্রেন্ডের গাড়ি।”

ভাইয়া এবার পরবর্তী প্রশ্নটা করল,” তোমার ফ্রেন্ডের গাড়ি তুমি চালাও নাকি?

ঈশান যথেষ্ট বিভ্রান্তি নিয়ে জবাব দিল,” হ্যাঁ… চালাই। শুধু কোচিং আর টিউশনির টাকায় আমার পোষায় না। দিনশেষে কোনো সেভিংস থাকে না তো!তাই একটু এক্সট্রা ইনকাম সোর্স হিসেবে উবার ড্রাইভিং করি। ফ্রেন্ডের সাপোর্টে।”

তারিফ ভাই ঈশানের কাঁধে হাত রেখে মলিন গলায় বলল, “তুমি উবার ড্রাইভার? তাহলে তো আমি আজকে তোমার লস করে দিলাম ভাই! আমাকে লিফট দিতে গিয়ে তুমি যাত্রীও পেলে না।

মা বলল, “আহারে! সত্যিই তোমাকে দেখে আমার অবাক লাগছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি এতো কষ্ট কিভাবে করো? আচ্ছা বাবা শোনো, তোমাকে একটা অনুরোধ করি। রাখবে?”

ঈশান বলল,” জ্বী বলুন আন্টি। নিশ্চয়ই রাখব।”

মা বলল,” তোমার যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে কিন্তু আমাদের বাসাতেই তুমি থাকতে পারো। আমাদের ছাদের উপরে একটা ছোট ঘর খালি আছে। তুমি সেখানে থাকলে আমাদের খুব ভালো লাগবে। খাওয়া দাওয়াটাও না হয় আমাদের সাথেই করলে? নিজের পরিবারের মতো? আর তারিনের জন্যও বাসায় একটা টিচার দরকার। মেয়েটার সামনে পরীক্ষা।”

তারিফ ভাই মায়ের কথায় পূর্ণ সম্মতি জানাল,” মা তুমি খুব ভালো আইডিয়া দিয়েছো। ঈশান, প্লিজ তুমি আমাদের সাথে চলে এসো। এইটা বেস্ট হবে। তোমারও প্রয়োজন মিটবে, আর আমাদেরও। ঘর ভাড়া নিয়ে টেনশন করার দরকার নেই। থাকা-খাওয়া সব ফ্রী। তুমি শুধু আমার বোনকে পড়াবে। তাহলেই হলো।”

ঈশানের উত্তর শোনার আগেই আমি দৌড়ে রান্নাঘরে চলে এলাম। বেচারা আমার জন্য এইভাবে ফেঁসে গেল। এখন ইচ্ছে করছে কচু গাছের সাথে গিয়ে নিজের গলায় ফাঁস লাগাতে। ধুর! একটা মিথ্যাকে ঢাকতে আরো কতগুলো মিথ্যার জন্ম দিতে হচ্ছে। এই ঘটনাটা একবার শেষ হয়ে যাক, তারপর আর জীবনেও মিথ্যা বলবো না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here