#তি_আমো,১২,১৩
পর্ব ১২
লিখা- Sidratul Muntaz
দুপুরের পর আমি ঘরে এসে দরজা আটকে পড়তে বসেছিলাম। তারপর আর একবারের জন্যেও বের হইনি। সন্ধ্যা ছয়টা কি সাতটার দিকে লক্ষ্য করলাম বাইরে খুব হৈচৈ হচ্ছে। মা, ভাইয়া, বুড়ি সকলের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ সবাই এতো খুশি কেন? আমি দরজা খুলে বের হতেই মা উৎফুল্ল গলায় বলল,
” দ্যাখ তারু, ঈশান আমাদের সবার জন্য উপহার নিয়ে এসেছে। বাজারও করেছে। ছেলেটা একদম পাগল! কি অবস্থা করল বলতো!”
আমি অবাক হলাম। আশেপাশে ঈশানকে খুঁজলাম৷ উপরে নজর যেতেই দেখলাম সে কার্ণিশে হেলান দিয়ে এদিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখেই মুচকি হাসল। আমি মাকে প্রশ্ন করলাম,” উনি কি এখন থেকে এখানেই থাকবেন?”
মা মাথা নেড়ে বলল,” নিশ্চয়ই থাকবে।”
আমি আরও অবাক হলাম। ঈশানের মতো ছেলে যার হিমশীতল ঘরে বিশাল বিছানা আছে। সে কি-না আমাদের এমন ঘুপচি ঘরের, ছোট্ট চৌকিতে, টিনের গরমে থাকতে এলো? ভাইয়া মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,” ছেলেটার মন আছে বলতে হয়। প্রথম দিনই আমাদের জন্য কত কিছু নিয়ে এলো! তারু, এটা তোর জন্য। খুলে দেখবি নাকি?”
আমি ইতস্তত করে প্যাকেটটা হাতে নিলাম। রাগ করা উচিৎ নাকি বিরক্ত হওয়া উচিৎ ঠিক বুঝতে পারছি না। ভাইয়াকেও খুব খুশি দেখাচ্ছে। তাই আমি উচ্চবাচ্য করার সাহস পেলাম না। তবে মোটেও খুশি হলাম না। আমি নিজের ঘরে ঢুকতেই শুনলাম বুড়ি চিন্তিত স্বরে বলছে,
” পোলারে এমনে এমনে বেশিদিন বাইত রাহন যাইব না। মাইনষে আ-কথা, কু-কথা কইব। তাই যত দ্রুত সম্ভব বিয়াডা সারতে হইব। তারিফের লগে আলাপটা পারছিলা, আয়েশা?”
ভাইয়া ততক্ষণে চলে গেছে। আমি কথাটি শুনে দরজায় এসে দাঁড়ালাম। মা আপত্তিকর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। তড়িঘড়ি করে বলল,
” আমরা সব ঠিক করে ফেললেই কি হবে মা বলুন? ছেলে-মেয়েদের পছন্দের একটা ব্যাপার আছে না? তারুর মতটাও তো জানতে হবে।”
বুড়ি অবজ্ঞার স্বরে বলল,” তোমার মাইয়ার তো নাক সিটকাইন্না রোগ আছে। তার মতামতের আমি গুরুত্ত দেই না। আসল কথা হইল, মাষ্টর তারুরে বিয়া করতে রাজি কি-না। সে রাজি থাকলে আর কোনো কথা নাই।”
আমি রেগে ফটাশ করে দরজাটা আটকে বিছানায় এসে বসলাম। তার মানে আমার দৃষ্টির অগোচরে বাড়িতে অনেক কিছুই হচ্ছে। আর আমি তো ঘুমিয়ে আছি৷ ভাইয়াও কি বিয়েতে মত দিয়ে দিবে? দুশ্চিন্তায় অস্থির লাগছে। ঈশানের আনা উপহারটা খুললাম। লাল রঙের একটা জামদানী শাড়ি। যে কোনো সাধারণ মেয়ে এই শাড়ির রূপে মোহিত হবে। ঈশান কিভাবে খুঁজে আনল এমন শাড়ি? শাড়ির সাথে আমি একটা চিরকুটও পেলাম।
” ডিয়ার তারিন,
মনে আছে তোমার? তুমিই বলেছিলে, সবসময় আমার পাশে থাকতে চাও। অথচ সেই তুমিই আমাকে অবিশ্বাস করলে। আমার কথা যদি তোমার মিথ্যাই মনে হয় তাহলে কেন শুনতে এলে? আমি তো আমার দুঃখের অংশীদার করতে চাইনি তোমাকে। তুমি নিজেই কেন এলে? আর এলেই যখন, আবার হারিয়ে কেন গেলে? তোমাদের বাড়ি এসে অদ্ভুত এক গোলকধাঁধায় ফেঁসে গেছি আমি। এতো এতো মিথ্যার ভীড়ে নিজের সত্যিটা আর প্রকাশ করতে ইচ্ছেই হয়নি! তাই মিথ্যা পরিচয়েই এখানে থেকে গেছি। অন্তত তোমার কাছে তো আছি! তোমাকে সবসময় দেখতে পাচ্ছি। আমার কাছে এর চেয়ে ইম্পোর্ট্যান্ট আর কিছু নেই, বিশ্বাস করো! হয়তো আমি ভুল করছি। কিন্তু যে ভুল আমাকে তোমার এতো কাছে নিয়ে আসে, সেই ভুল আমি সবসময় করতে রাজি। তবে চিন্তা কোরো না, তোমার অসম্মতিতে আমি এই বাড়িতে থাকব না।তুমি যদি একবার বলো, তাহলে আমি এখনি বের হয়ে যেতে প্রস্তুত। তোমার উত্তরের অপেক্ষায়..
-ঈশান।
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চিরকুট রেখে দিলাম। দরজা খুলে দেখলাম মা চায়ের ট্রে হাতে ছাদে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে গিয়ে প্রশ্ন করলাম,” কোথায় যাচ্ছ, মা?”
” উপরে। ঈশানকে চা দিয়ে আসি।”
” ও। স্যারের সাথে কালকের ক্লাস নিয়ে একটু কথা আছে। আমিই দিয়ে আসি দাও।”
মা খুশি হয়ে বললেন,” তুই যাবি? তাহলে তো ভালোই হলো। যা।”
আমি মাথায় কাপড় দিয়ে চায়ের ট্রে হাতে নিলাম। এমন সময় বুড়ি এসে বলল,” খাঁড়া! এমন পেত্মীর মতো লাগতাছে ক্যান তোরে? চুল আচড়াছ নাই? আমগোর বাড়িত কি চিরুনী নাই? চোখে কাজল দে। চোখ দুইডা মরা মরা লাগতাছে।”
আমি বুড়ির কথায় পাত্তা না দিয়ে উপরে উঠে যেতে যেতে বললাম,” এতোকিছু করতে গেলে চা ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
ঈশান বোধহয় আমার অপেক্ষাতেই ছিল। দেখলাম ছাদে ক্রমাগত পায়চারী করছে। আমার উপস্থিতি তার চেহারায় হাসির দীর্ঘ রেখা ফুটিয়ে তুলল। আমি মাথা নিচু করে বললাম,” আপনি এখানে এসে ঠিক করেননি। ”
ঈশান আমার মুখের দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থেকে বলল,” কিন্তু আমার কাছে এর চেয়ে বেশি ঠিক আর কিছু মনে হয়নি।”
আমি কুণ্ঠিত গলায় বললাম,” এখন থেকে আমাদের রোজ মিথ্যা বলতে হবে।”
ঈশান বিবশের মতো বলল,” মিথ্যা বলেই যদি রোজ তোমাকে দেখতে পাই, তাহলে মিথ্যা বলাও ভালো। ”
আমি আশেপাশে তাকিয়ে বললাম,” ভেতরে চলুন।”
ঈশান বাধ্যের মতো আমার পেছন পেছন এলো। আমি চায়ের ট্রে টেবিলে রেখে ঈশানের দিকে চাইলাম। বিরক্ত হয়ে বললাম,” কি দরকার ছিল সবার জন্য শপিং করার?”
” সবকিছু দরকারেই করতে হবে? বিনা দরকারে করা যায় না?”
” আপনি কি চাইছেন? এখান থেকে চলে যান প্লিজ।”
” আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই তারিন। আমার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে। আমি তাদের কারো কাছেই ফিরে যেতে চাই না। তাই তোমার কাছে এসেছি৷ এখন তুমি যদি তাড়িয়ে দাও তাহলে আমাকে হারিয়ে যেতে হবে।”
আমি রুষ্ট কণ্ঠে বললাম,” মিথ্যা কথা। আমি শুনেছি, আপনার বাবা-মায়ের সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। তাদের ডিভোর্স হতেই পারে না।”
” কার কাছে শুনেছ?”
” কার কাছে শুনেছি সেটা কি ইম্পোর্ট্যান্ট?”
” অবশ্যই ইম্পোর্ট্যান্ট। কে সেই ভাগ্যবান যাকে তুমি আমার থেকেও বেশি বিশ্বাস করো?”
আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম,” কাল সকালের মধ্যেই আপনি চলে যাবেন।”
এই বলে চলে আসার সময় ঈশান আমার হাত চেপে ধরল। আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বললাম,” ছাড়ুন। এটা আপনাদের অথবা নিহাদের বাড়ি না। এখানে আমার মা, দাদী, ভাইয়া সবাই আছে। যেকোনো সময় যে কেউ চলে আসবে।”
ঈশান দৃঢ় কণ্ঠে বলল,” তুমি কি সত্যি চাও আমি চলে যাই?”
” হ্যাঁ চাই। এটাই আমাদের জন্য ভালো। ”
” চলে গেলে হয়তো আমি আর কখনও তোমাকে দেখব না।”
” আমাকে দেখে কি করবেন?”
ঈশান আমার কাছে এসে বলল,”কিছু না। শুধু মন শান্তি পাবে।”
আমি চুপ করে রইলাম। হঠাৎ দূর থেকে বুড়ির কণ্ঠ কানে এলো। উদ্ভট গানের শব্দ। আমি আর ঈশান দু’জনেই ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলাম বুড়ি কাপড় নিতে এসে গান গাইছে, “বোঝেনা, হেতে বোঝে না। কিল্লাই বোঝে না? বোঝে না.. বোঝেনা হেতে বোঝেনা!”
ঈশান বুড়ির আঞ্চলিক ভাষার টানে গাওয়া গানের লিরিক্স বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করল,” উনি কি বলছে?”
আমি মুচকি হেসে বললাম,” আপনার কাছে লাফিং গ্যাস আছে? প্লিজ আমার দাদীকে খাইয়ে দিন!”
ঈশান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি হাসতে হাসতে ছাদ থেকে চলে এলাম।
সকালে ঘুম ভাঙল মায়ের ডাকে। ভূমিকম্প হলেও মা আমাকে এইভাবে গলা ভেঙে ডাকবে না। আমি ধড়মড় করে উঠে বসে বললাম,” কি হয়েছে মা?”
মা ব্যস্ত সুরে বলল,” ঈশান চলে যাচ্ছে।”
“কোথায় যাচ্ছে?”
” আমি জানি না। আমার কাছে বিদায় নিতে এলো আর বলল যাতে দোয়া করি। দ্যাখ তো কেমন লাগে? এভাবে কেউ চলে যায়? তারিফও বাড়িতে নেই।”
আমি পুনরায় বালিশে মাথা রাখতে রাখতে বললাম,” যে যেতে চায়, তাকে যেতে দাও। বেঁধে রেখে হবেটা কি?”
” তুই অন্তত গিয়ে জিজ্ঞেস কর কারণটা কি? কেন এভাবে চলে যাচ্ছে? আমাদের বাড়ি কি তার পছন্দ হয়নি?”
আমি কৌতুকপূর্ণ গলায় বললাম,” কি জানি? হয়তো বুড়িকে পছন্দ হয়নি৷ তাই চলে যাচ্ছে।”
” ইয়ার্কি করবি না তারু। উঠ বলছি!”
মা আমাকে এক প্রকার ধস্তাধস্তি করেই ঈশানের কাছে পাঠাল। আমি তার ঘরে ঢুকে হাই তুলতে তুলতে বললাম,” কোথায় যাচ্ছেন?”
ঈশান নির্বিকার উত্তর দিল,” জানি না।”
আমি দায়সারাভাবে বললাম,” সাবধানে যেয়েন। কিন্তু মাকে বলার দরকার নেই যে আপনি একবারে চলে যাচ্ছেন। শুধু বলুন কাজে যাচ্ছেন। আবার ফিরে আসবেন।”
” মিথ্যা কথা বলব?”
আমি মুচকি হেসে বললাম,” কখনও বলেননি বুঝি?”
ঈশান এবার একটা অদ্ভুত কান্ড করল। আমার হাত ধরে একটান মেরে দেয়ালের কাছে নিয়ে এলো। দুইহাতে আমাকে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে বলল,” সত্যি করে বলো তারিন, ভালোবাসোনি কখনও আমাকে?”
আমি হতবিহ্বল, তটস্থ হয়ে বললাম,” এটা কি ধরণের পাগলামি? ছাড়ুন।”
” আগে আমার কথার উত্তর দাও৷ নয়তো ছাড়ব না। তোমার ভাইয়া এলেও না।”
” ভাইয়াকে আপনি এখনও চেনেননি। শুধু আমার স্যারের পরিচয় দিয়েছি বলে আপনার সাথে এতো ভালো ব্যবহার করছে। সত্যি বলতে, আমার ভাই এতো ভালোমানুষ না।”
” তোমার ভাইও আমাকে এখনও চেনেনি। মানুষ হিসেবে আমিও খুব একটা ভালো না।”
আমি সরুদৃষ্টিতে বললাম,” সেটা আমিও জানি।”
ঈশান বিভোর হয়ে আমার চোখ আর ঠোঁট পরিলক্ষণ করতে লাগল। আমি অস্থির হয়ে বললাম,” এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না।”
” কেন?”
” অস্বস্তি লাগে।”
” আমাকে যদি ভালোই না বাসো তাহলে সেদিন গ্যারেজে এটা কেন জানতে চেয়েছিলে যে আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি কি-না?”
” জানি না।”
” অবশ্যই জানো। তোমাকে বলতে হবে।”
আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ঈশানের পেছনে তাকিয়ে উচ্চারণ করলাম,” ভাইয়া!”
ঈশান ঝড়ের বেগে আমাকে ছেড়ে দিল। আমি হাসতে হাসতে ছুটে এলাম। ঈশানের দিকে বুড়ো আঙুল তাঁক করে বললাম,” এই তাহলে আপনার সাহস?”
আমার চালাকি বুঝতে পেরে ঈশানও আমার পেছনে ছুটে আসতে লাগল। কিন্তু ততক্ষণে আমি অনেকখানি নেমে এসেছি সিঁড়ি থেকে। নিচে নামতেই আমার পিলে চমকে উঠল। মোহনা আন্টি গাড়ি থেকে নামছেন। সদর দরজার কাছে আসতেই তিনি আমাকে দেখে হাত নাড়লেন। আনন্দিত কণ্ঠে বললেন,” তারিন, কেমন আছো?”
আমি ভয়ে ভয়ে উপরে তাকালাম। ঈশান নেমে আসছে। আমি হাতের ইশারায় তাকে থামতে বললাম৷ কিন্তু ঈশান যেন আমার ইশারা বুঝতেই চাইছে না। এদিকে মোহনা আন্টি দ্রুত পায়ে এগোচ্ছেন। তাঁর উদ্দেশ্য আমাকে জড়িয়ে ধরা। ঈশান অর্ধেক সিঁড়ি অবধি নেমেই মোহনা আন্টিকে দেখে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে সে আবার ঝড়ের গতিতে উপরে উঠে গেল। মোহনা আন্টি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছেন,” এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। তারপর আমার ড্রাইভার বলল তোমার বাসাও নাকি এদিকে। তাই চলে এলাম।”
আমি দ্রুত গলায় বললাম,” ভালো করেছেন। ভেতরে চলুন আন্টি।”
ঈশান দৌড়ে ছাদে উঠতে গিয়ে চার-পাঁচটা গাছের চারা ফেলে দিল।। গ্রিল ফসকে চারাগুলো সোজা পড়ল মোহনা আন্টির মাথায়। আকস্মিক এই ঘটনায় আমি আৎকে উঠলাম। মোহনা আন্টি তূড়ন্ত উপরে তাকালেন। ততক্ষণে ঈশান পগারপা। তবে কেউ একজন এই মাত্র দৌড়ে পালিয়েছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। আমি কিছু বলার আগেই মোহনা আন্টি সিঁড়ি ভেঙে দৌড়ে ছাদে উঠতে লাগলেন। আমি হতবিস্মিত হয়ে ডাকলাম,” আপনি ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন আন্টি?”
মোহনা আন্টি বাজখাঁই কণ্ঠে বললেন,” চোর, চোর, পালাচ্ছে! ধরতে হবে!”
আমি কপালে হাত ঠেকিয়ে বললাম,” আন্টি উনি চোর না!”
কিন্তু কে শোনে কার কথা? হিল পায়েই দৌড়াতে লাগলেন মোহনা আন্টি। আমিও অগত্যা দৌড়াতে লাগলাম তাঁর পিছু পিছু।
চলবে
#তি_আমো
পর্ব ১৩
লিখা- Sidratul Muntaz
আমাদের ছাদের সিঁড়িগুলো লোহার। বেশ উঁচু উঁচু। মোহনা আন্টিকে শাড়ি পরা অবস্থায় দৌড়াতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। তবুও তিনি দৌড়াচ্ছেন। তারপর আমি যা ভেবেছিলাম তাই হলো। ছাদে ওঠার আগেই পা পিছলে পড়ে গেলেন তিনি। ভাগ্যিস পেছনে আমি ছিলাম বলে ধরে ফেললাম। কিন্তু বেকায়দায় মোহনা আন্টির শাড়িটা ছিঁড়ে গেল।
আমি বললাম,” অনেক হয়েছে আন্টি। এবার নিচে চলুন।”
মোহনা আন্টি ঝনঝন করে বললেন,” আমরা নিচে চলে গেলে চোরটা পালিয়ে যাবে না? তুমি আমাকে না ধরে চোরটাকে ধরো আগে, বোকা মেয়ে!”
আমি করুণ গলায় বললাম,” উনি চোর না আন্টি। আমাদের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট থাকেন।”
” পেয়িং গেস্ট?”
” জ্বী। ছাদে একটা ছোট্ট ঘর ফাঁকা আছে। সেখানেই ভাড়া থাকেন।”
মোহনা আন্টি সন্দিহান কণ্ঠে বললেন,” তোমাদের পেয়িং গেস্ট তাহলে আমাকে দেখে পালালো কেন?”
এখন এই প্রশ্নের কি উত্তর দেওয়া যায় আমি বুঝলাম না।
মোহনা আন্টি রাগে গর্জে উঠলেন,” ওর জন্য আমার শাড়িটা ছিঁড়ে গেল। আমার চুলের কি অবস্থা দেখো! গায়ে মাটি চিপচিপ করছে। এভাবে কেউ দৌড়ায়? কি কমন সেন্স ছাড়া মানুষ ভাড়া দাও বলোতো? ন্যূনতম সাধারণ জ্ঞান নেই?”
” উনার দোষ নেই। আপনাকে দেখে ভয় পেয়েছে।”
আমি মুখ ফসকে কথাটা বলেই জীভ কাটলাম। মোহনা আন্টি ফুঁসে উঠলেন,” আমাকে দেখে ভয় পাবে কেন? আমার চেহারা কি ভয়ংকর?”
আমি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একটু বেফাঁস কথাই বলে বসলাম,” না আন্টি, আপনি তো অনেক সুন্দরী। আসলে উনি না খুব সুন্দরী মহিলা দেখলেই ভয় পান। এটা উনার রোগ। আপনি অনেক সুন্দরী তো, তাই আপনাকে দেখে ভয়ে পালিয়ে গেছে।”
মোহনা আন্টি চোখমুখ কুচকে উচ্চারণ করলেন,” সিরিয়াসলি?”
আমি মাথা নিচু করে বললাম,” জ্বী।”
” যদি এই কথা সত্যি হয় তাহলে ওই অসভ্যের আজকে খবর আছে। ওর লজ্জা আমি ভেঙে কুটি কুটি করব। পালাবি ভালো কথা, উপর থেকে ঢিল ছুঁড়বি কেন?”
মোহনা আন্টি আবার উঠে ছাদের দিকে রওনা হলেন। আমি দুশ্চিন্তায় নখ কামড়ে ধরলাম। চেঁচিয়ে বললাম,” উনি তো ইচ্ছে করে আপনাকে ঢিল ছোঁড়েনি। ওটা একটা এক্সিডেন্ট।”
মোহনা আন্টি আমার কথা না শুনেই ছাদে উঠে গেলেন। আমিও দৌড়ে গেলাম। ততক্ষণে মোহনা আন্টি ঈশানের ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেছেন। আমি তো ভাবলাম, এই বুঝি সব শেষ! এখন যা হবে তা শুধুই বিস্ফোরণ। ঈশান তো ধরা খাবেই, সাথে আমিও মা আর বুড়ির কাছে ফেঁসে যাব৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দোয়া জপতে লাগলাম। এমন সময় মোহনা আন্টি বাইরে এসে বললেন,” তারিন, কোথায় লোকটা?”
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম,” ভেতরে নেই?”
মোহনা আন্টি ঠোঁট উল্টে বললেন,” দেখতে পেলাম না তো!”
আমি মনে মনে হাঁফ ছাড়লাম। কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। ঈশান তাহলে গেল কই? বাথরুমে লুকিয়ে পড়েছে নাকি? ঘরের বাইরে একটা বাথরুম আছে। কিন্তু সেই দরজা এই মুহূর্তে খোলা। অর্থাৎ ঈশান বাথরুমেও নেই৷ তাহলে কোথায়? ভয়ে আবার ছাদ থেকে লাফ-ঝাঁপ দেয়নি তো? দুশ্চিন্তায় কলিজা শুকিয়ে গেল। আমি মোহনা আন্টিকে নিয়ে নিচে এলাম। ভাবছি, দুইতলার ছাদ থেকে লাফ দিলে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু হাত-পা যদি ভাঙে? আমার ঘরে প্রবেশ করতেই মোহনা আন্টি বললেন,” আমাকে এখনি শাওয়ার নিতে হবে তারিন। আমার ডাস্ট এলার্জী আছে। শরীর খুব চুলকাচ্ছে।”
আমি হেসে বললাম,” ঠিকাছে। মাকে বলি গরম পানি দিতে।”
” গরমের মধ্যে আবার কিসের গরম পানি? আমি ঠান্ডা পানিতেই গোসল করে নিব। ”
আমি অপরাধী কণ্ঠে বললাম,” স্যরি আন্টি, আমাদের বাড়িতে প্রথমদিন এসেই আপনাকে এতোটা ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।”
মোহনা আন্টি আমার গালে হাত রেখে আদুরে কণ্ঠে বললেন,” এতে তো তোমার কোনো দোষ নেই৷ তুমি কেন মনখারাপ করছ?”
” আপনি বসুন। আমি আপনার গোসলের ব্যবস্থা করছি।”
আমি যখনি বাথরুমের দরজা খুললাম, দেখলাম ঈশান দাঁড়িয়ে আছে। তাকে বাথরুমে দেখে অজান্তেই মুখ দিয়ে চিৎকার বের হয়ে গেল। ঈশান দ্রুত আমার মুখ চেপে ধরল। মোহনা আন্টি তখন ড্রেসিংটেবিলে দাঁড়িয়ে চুল পরিষ্কার করছেন। তাই এদিকে তাঁর খেয়াল নেই। কিন্তু আমার চিৎকার শুনেই প্রশ্ন করলেন,” তারিন, কি হয়েছে আবার?”
আমি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম,” কিছু না আন্টি, তেলাপোকা দেখেছি!”
মোহনা আন্টি হেসে ফেললেন। ঈশান বড় করে শ্বাস ছাড়ল। আমি ফিসফিস করে বললাম,” এখানে কি করছেন?”
ঈশান কথা বলল না। ইশারায় কি ভংচং বোঝাল, আমি বুঝলামও না। শুধু এটুকুই বুঝলাম যে মোহনা আন্টিকে বাথরুমে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। আমি বাথরুম থেকে বের হয়েই বললাম,” আন্টি, আমার বাথরুমে পানি নেই। আপনি বরং আমার ভাইয়ার বাথরুমে চলুন।”
” কি বলছো? তোমাদের বাড়িতে পানির লাইন কি আলাদা?”
” জ্বী আন্টি। আলাদা। আর চিন্তার কিছু নেই। ভাইয়া এখন বাড়িতে নেই। তাই আপনার অসুবিধা হবে না।”
” ঠিকাছে চলো।”
আমি মোহনা আন্টিকে আমার একটা সেলোয়ার কামিজ দিলাম। মায়ের শাড়িও দেওয়া যেত। কিন্তু মোহনা আন্টি এতো স্লিম যে মায়ের ব্লাউজ তার গায়ে ঢিলে হয়ে যাবে। মোহনা আন্টিকে গোসলে ঢুকিয়ে আমি আবার নিজের ঘরে এলাম। ঈশান আমাকে দেখেই প্রশ্ন করল,” মম কখন যাবে তারিন?”
আমি অস্থির হয়ে বললাম,” আমি কি জানি আপনার মম কখন যাবে? আপনি বের হয়ে যান!”
ঈশান দুশ্চিন্তায় মাথা চুলকে বলল, “ধূর, মম যে এভাবে চলে আসবে আমি ভাবতেও পারিনি। ঠিকানা কোথায় পেল?”
” ঠিকানা দিয়েছে আপনাদের ড্রাইভার। মনে নেই নিহার এংগেজমেন্টের দিন তো মোহনা আন্টির গাড়ি করেই আমাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন। ড্রাইভারও ছিল।”
ঈশান মনে পড়ায় বলল,” ও আচ্ছা!”
” এখন বলুন তো, আপনি ছাদ থেকে আমার ঘরে কিভাবে এলেন?”
” ছাদে মই পেয়ে গেছিলাম৷ নামতে গিয়ে দেখি তোমার বারান্দায় চলে এসেছি।”
” তাই বলে আমার ঘরেই বসে থাকবেন? বের হয়ে যেতে পারলেন না?”
” বের হয়ে যেতে নিলে মম দেখে ফেলতো না? তাছাড়া আমি কিভাবে বুঝব তুমি মমকে ড্রয়িংরুমে না নিয়ে সোজা তোমার বেডরুমে নিয়ে আসবে? কই, আমাকে তো কখনও আনোনি!”
আমি চোখ গরম করে বললাম,” আপনাকে বেডরুমে আনব মানে?”
ঈশান নরম করে বলল, ” স্যরি।”
তারপরেই হেসে দিল সে। আমি রেগে বললাম,” খুব মজা না? কতবড় বিপদে যে আমরা ফাঁসতে যাচ্ছি তার কোনো ধারণা নেই আপনার। এখানে থাকা মানেই বিপদ। এই আপনি বের হয়ে যান তো! আন্টি চলে যাওয়ার পর আমি আপনাকে ফোন করব।”
ঈশান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” আমাকে বের করে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই শিখলে না, তারিন। ওকে বায়।”
সে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ভাইয়া বাড়িতে ঢুকল। মোহনা আন্টিও গোসল সেরে বের হয়েছেন। ভাইয়ার বিছানাতে বসেই চুল মুছতে মুছতে ফোন টিপছিলেন। হঠাৎ ভাইয়া এসে মোহনা আন্টিকে দেখেই চমকে উঠল।
” কে আপনি?”
মোহনা আন্টি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,” আসসালামু আলাইকুম, আপনি কি তারিনের বাবা?”
আমি সঙ্গে সঙ্গে হাতের ইশারায় না বললাম। মোহনা আন্টি বললেন,” ওহ স্যরি, আমি ভুলেই গেছিলাম যে তারিনের বাবা নেই। আপনি মনে হয় তারিনের ভাই হবেন।”
ভাইয়া গম্ভীর কণ্ঠে বলল,” ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
তারপর আমার দিকে চেয়ে ভাইয়া প্রশ্ন করল,” কে? তোর বান্ধবী নাকি?”
আমি হতভম্ব কণ্ঠে বললাম,” উনাকে দেখে তোমার আমার বয়সী মনে হচ্ছে?”
মোহনা আন্টি হেসে ফেললেন। ভাইয়া বোতল থেকে পানি খেতে খেতে বলল,” না, ঠিক তোর বয়সী না। তোর চেয়ে বড় হবে। তোর ভার্সিটির সিনিয়র কেউ?”
আমি বিস্মিত কণ্ঠে বললাম,” তার মানে উনাকে দেখে তোমার ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট মনে হচ্ছে?”
ভাইয়া কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে বলল,”হ্যাঁ, সেরকমই তো মনে হচ্ছে..”
আমি আর মোহনা আন্টি একসঙ্গে হেসে উঠলাম। আমি হাসতে হাসতেই বললাম,” উনি নিহার মামী হয়, ভাইয়া!”
ভাইয়া এই কথায় বিষম খেলেন। আমরা আবার হেসে ফেললাম। ভাইয়া নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,” স্যরি, আপনাকে দেখে আমি বুঝতেই পারিনি।”
মোহনা আন্টি স্বাভাবিক স্বরে বললেন,” কোনো ব্যাপার না। তবে আমার আসল পরিচয় হচ্ছে, আমি ঈশানের মা।”
মোহনা আন্টির এই কথায় আমার আত্মা চুপসে এতোটুকু হয়ে গেল। ভাইয়া চোখ বড় বড় করে তাকাল,” ঈশান মানে? আমাদের ঈশান?”
” হ্যাঁ। তারিন তো খুব ভালো করে চেনে ঈশানকে। সেদিন তো তারিনকে বাড়িতেও পৌঁছে দিল।”
ভাইয়া আমার দিকে তাকানো মাত্রই আমি কেশে উঠলাম। বিব্রত ভঙ্গিতে বললাম,” আসলে ভাইয়া, নিহার কাজিনের নামও ঈশান। উনি সেই ঈশানের মা।”
মোহনা আন্টি ভ্রু কুচকালেন। ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,” আরও কেউ ঈশান আছে নাকি?”
আমি জবাব দিলাম,” জ্বী আন্টি। ছাদে যিনি থাকেন, তার নামও ঈশান। ”
মোহনা আন্টি হেসে বললেন,” কি কাকতালীয় ব্যাপার! ওর নামও ঈশান?”
আমি অপ্রস্তুত হয়ে হাসলাম। তবে ভাইয়ার চেহারা দেখে মনে হলো সন্দেহ করছেন। আমাকে একা পেতেই ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,” তোকে ঈশান বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল এর মানে কি? উনার ছেলে তোকে কেন বাড়িতে পৌঁছে দেবে?”
আমি পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতো বললাম,” নিহাদের ড্রাইভার সেদিন ছিল না তাই উনার সাথে এসেছিলাম। ”
” আমাকে তো জানাসনি। আমিই গিয়ে নিয়ে আসতাম তোকে।”
” তুমি ব্যস্ত থাকো বলে জানানো হয়নি। স্যরি।”
” এমন ভুল যেন আর কখনও না হয়।”
” হবে না।”
মায়ের সাথে মোহনা আন্টির বেশ খাতির জমে গেল। তবে বুড়ি মোহনা আন্টিকে একটুও পছন্দ করল না। অযথাই নাক সিঁটকে বলতে লাগল,” নইট্টা কিসিমের বেডি। আলগা ঢং!”
আমার খুব মেজাজ খারাপ হলো বুড়ির উপর। আসলে মোহনা আন্টি এমন একজন মানুষ যে সবার সাথে মিশে যেতে পারে। আমার তাকে পানির মতো স্বচ্ছ মনে হয়। দুপুরে আমরা তিনজন একসাথে খেতে বসলাম। আমি, ভাইয়া আর মোহনা আন্টি। ভাইয়া ঈশানকেও খুঁজল। আমি বললাম জরুরী কাজে সে বাইরে গেছে। মা রান্নাঘরে ছিল। আর বুড়ি নিজের ঘরে। সে এমনিতেও সবার সাথে বসে খায় না। তাকে ঘরে নিয়ে খাবার দিয়ে আসতে হয়। খাওয়ার আয়োজন আমাদের জন্য যথেষ্ট। তবে মোহনা আন্টির জন্য খুবই সামান্য। দেশী মুরগির মাংস, ইলিশ মাছ, চিকন চালের ভাত, সবজির তরকারি আর ডাল। মোহনা আন্টিকে দেখলাম খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছেন। খেতে খেতে বললেন,” তোমার মায়ের হাতের রান্না একদম আমার মায়ের মতো তারিন।”
আমি মিষ্টি করে হাসলাম,” আপনার ভালো লেগেছে?”
” খুব ভালো লেগেছে। অনেক দিন পর এমন রান্না খাচ্ছি। আচ্ছা তারিন, ওই ছেলেটা কি তোমাকে এখনও বিরক্ত করে?”
খাবার গলা দিয়ে নামা বন্ধ হয়ে গেল আমার। ভীত দৃষ্টিতে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভাইয়া ভ্রু কুচকে বলল,” কোন ছেলে?”
মোহনা আন্টি বললেন,” আপনি এখনও জানেন না? আরে সেই ছেলেটা! পার্টিতে তারিনের সাথে বদমাইশি করেছিল।”
ভাইয়ার চোখমুখ লাল হয়ে গেল৷ ভারী গলায় বলল,” হোয়াট? তারু তো আমায় কিছু বলেনি! কোন পার্টিতে গিয়ে এমন হয়েছে?”
মোহনা আন্টি আমার চেহারার অবস্থা দেখে বুঝতে পারলেন যে তিনি ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছেন। তাই বুদ্ধিমতীর মতো ব্যাপারটা খুব সহজে সামলে নিলেন। হাসার ভাণ ধরে বললেন,” ভার্সিটির একটা ফাংশন ছিল। সেখানে একটা ছেলে তারিনের সাথে বদমাইশি করেছিল। তারিন হয়তো ভয়ে আপনাকে বলতে পারেনি। ছেলেটাকে পরে আর খুঁজেও পাওয়া যায়নি। তবে আমি ঈশানকে দায়িত্ব দিয়েছি। সে নিশ্চিত খুঁজে বের করবে।”
ভাইয়া অবাক হয়ে বলল,” তারু, এতোবড় একটা ব্যাপার তুই আমাকে জানালি না?”
আমি ভয়ে প্রায় জুবুথুবু হয়ে গেছি। মোহনা আন্টি বললেন,” আসলে আমিই ওকে নিষেধ করেছিলাম জানাতে।”
” আপনি নিষেধ করবেন কেন?”
” তারিন আমাকে বলেছিল আপনি খুব কনজার্ভেটিভ। জানলে দুশ্চিন্তা করবেন। তাই আমি ঠিক করেছিলাম ছেলেটিকে আগে খুঁজে বের করি। তারপর আপনাকে জানাব।”
এমন সময় আমার মোবাইল বাজল। সাইলেন্ট মোডে ছিল বলে কেউ শুনতে পেল না। দেখলাম ঈশানের কল। আমি রিসিভ করে ওভাবেই মোবাইলটা রেখে দিলাম।
ভাইয়া গম্ভীর হয়ে বলল,” সমস্যা নেই। এখন তো আমি জেনে গেছি। ওই হারামজা*দাকে আমিই খুঁজে বের করব।”
মোহনা আন্টি বললেন,” নিশ্চয়ই। খুঁজে বের করা উচিৎ। অসভ্যটা তো তারিনকে চিঠিও দিয়েছিল। তারিন, তোমার কাছে কি চিঠিটা আছে?”
আমি আৎকে উঠে বললাম,” না। আমি তো কবেই ফেলে দিয়েছি।”
ভাইয়া বলল,” চিঠির দরকার নেই। আমি চিঠি ছাড়াই খুঁজে বের করব।”
মোহনা আন্টি বললেন,” খুঁজে পাওয়ার পর আমাকে জানাতে ভুলবেন না। আমার খুব ইচ্ছা বদমাইশটাকে গণ ধোলাই খাওয়াব। কত ধানে কত চাল একদম বুঝিয়ে দেব। জীবনে আর কোনো মেয়েকে অসম্মান করা তো দূরে থাক, সবাইকে বোনের চোখে দেখবে। তারিনের কাছে ঘেঁষারও আর সাহস পাবে না। তারিন, বুঝতে পারছ আমি কি বলছি?”
আমি মাথা নাড়লাম,” জ্বী আন্টি। বুঝতে পারছি।”
মোহনা আন্টি কোমল গলায় বললেন,” গুড গার্ল। খুব মিষ্টি একটা মেয়ে তুমি। আমার এই মিষ্টি মামনিকে যে জ্বালায় তার একটা উচিৎ শিক্ষা অবশ্যই প্রাপ্য। আমি নিশ্চিত ছেলেটা লো ক্লাস ফ্যামিলির হবে। পারিবারিক শিক্ষার অভাবেই এই হাল। ওর মাকে পেলে আমি সবার আগে জিজ্ঞেস করতাম, কিভাবে মানুষ করেছে ছেলেকে? কুলাঙ্গার পয়দা করেই সমাজে ছেড়ে দিয়েছে। সমাজটাও এদের জন্য দূষিত হয়ে যাচ্ছে। এসব মা-বাবাকে সন্তান মানুষ করা শিখিয়ে দেওয়া উচিৎ। মা-বাবার শাসন থাকলে ছেলে-মেয়ে কখনও এমন হয় না। কই, আমার ঈশান তো কখনও কোনো মেয়েকে অসম্মান করেনি৷ তুমি বিশ্বাস করবে না তারিন, এ যুগের ছেলে হয়েও আমার ঈশান কত ভদ্র আর কত নম্র! কাজিনরা সবাই তার কি নাম দিয়েছে জানো? ভদ্রম্যান! নিজের ছেলে বলে ভেবো না বাড়িয়ে বলছি। তুমি তো ঈশানকে দেখেছ। বলোতো, আমি কি একটুও বাড়িয়ে বলছি?”
আমি ইতস্তত করে বললাম,” না আন্টি। আপনি একদমই বাড়িয়ে বলছেন না। ঈশান ভাইয়া খুবই ভালো মানুষ। ”
ভাইয়া এবার বলল,” আমাদের বাড়িতে যে ঈশান থাকে সেও খুব ভালো মানুষ। একদম আপনার ছেলের মতোই।”
” তাই নাকি?” মোহনা আন্টি হাসলেন। তারপর আবার বললেন,” ভালো মানুষদের জন্যই তো পৃথিবীটা টিকে আছে। কিন্তু সমাজে অসভ্যদেরও অভাব নেই।”
ভাইয়া ক্রোধান্বিত স্বরে বলল,” ওই বদমাইশকে পেলে আমি পুলিশে দিতাম।”
ঈশান দেখলাম এখনও লাইনে। সবার কথা নিশ্চয়ই তার কানে যাচ্ছে। আমার খুব মজা লাগছে। ইশ, এই মুহূর্তে ঈশানের মুখের অবস্থাটা যদি দেখা যেতো!
মনে হয় রোবটদের জন্য গল্প লেখি। কেউ ঠিকঠাক রিয়েক্ট- কমেন্টও করতে পারে না। শুধু লাইক দেয় আর নেক্সট লিখে। আজব পাবলিক!?
চলবে