#তি_আমো,২৩,২৪
পর্ব ২৩
লিখা- Sidratul Muntaz
ফাহিম ভাই আমার সামনে রসগোল্লা ভর্তি পেয়ালা এনে বলল,” একটা খাও তারিন।”
আমি অবাক হলাম। এগুলো তো আমার বানানো মিষ্টি। ঈশান একটু আগে যেগুলো দেখে বলছিল থার্ড ক্লাস। আমি প্রশ্ন করলাম,” কেন? আপনি খান। নাকি আপনারও এই মিষ্টি থার্ড ক্লাস মনে হয়?”
” ছিঃ, ছিঃ, সেরকম কেন হবে? আমি খেয়েছি। অনেক ভালো মিষ্টি। তুমিও একটা খাও।”
আমি গোমরা মুখে বললাম,” রাখুন।”
” হ্যাঁ? ”
” রেখে দিন।”
ফাহিম ভাই আমার সামনে মিষ্টির পেয়ালা রাখল। আমি প্রথমে একটা মিষ্টি মুখে দিলাম। তারপর আরেকটা নিলাম। ফাহিম ভাই তড়িঘড়ি করে বলল,” এতো খাওয়ার দরকার নেই। সবাই একটা একটা।”
আমি রেগে বললাম,” কেন? একটা একটা কেন? আমার যতগুলো ইচ্ছা আমি ততগুলো খাব।”
এই কথা বলেই দ্বিতীয় মিষ্টি মুখে দিলাম। ফাহিম ভাই বিপদগ্রস্ত দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। মনে হচ্ছে আমার সামনে মিষ্টি এনে সে বিরাট ভুল করেছে। আমি ফাহিম ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বললাম,” সত্যি করে বলুন, আমার মিষ্টি কি খেতে খারাপ?”
ফাহিম দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,” একদম না তারিন৷ তুমি আর খেও না।”
” খাবো না কেন? আমার মিষ্টি আমিই খাব। আর কেউ খাক না খাক সেটা আমার দেখার দরকার নেই৷ ভালো জিনিস মানুষের সহ্য হয় না। আমি কত কষ্ট করে বানিয়েছিলাম জানেন? অথচ এমনভাবে বলা হলো, যেন আমি মিষ্টি বানাতেই জানি না। একবার আমাদের কলেজে ক্লাস পার্টি হয়েছিল। আমি মিষ্টি বানিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর সবাই হামলে পড়েছিল। আর সেই মিষ্টিকে ঈশান বলল..”
ফাহিম ভাই ইতস্তত হয়ে বলল,” ঈশানের কথা থাক। আমার খুব ভালো লেগেছে মিষ্টি।”
” তাই? তাহলে খান!”
ফাহিম ভাই সঙ্গে সঙ্গে নিজের মুখে হাত চেপে বলল,” না, না, আমি খাব না।”
আমি ক্ষেপে বললাম,” থাক। বুঝেছি। আপনারও ভালো লাগেনি। আমার মিষ্টি আমিই খাব।”
এই কথা বলে একসাথে আরও চার-পাঁচটা মুখে দিলাম৷ ফাহিম ভাই মিনতির স্বরে বলল,” আর খেয়ো না তারিন। প্লিজ। অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে।”
আমি খেতে খেতে বললাম,” মিষ্টিগুলো কেমন তেঁতো লাগছে ফাহিম ভাই। লেবুর রস মিশিয়ে এনেছেন নাকি?”
” না তো।”
” এখন বলবেন না আমি বাসী মিষ্টি বানিয়েছি৷ কমলার মা সাক্ষী। আমি আজ সকালেই সব মিষ্টি বানিয়েছি। আপনার বিশ্বাস না হলে রান্নাঘরে গিয়ে কমলার মাকে জিজ্ঞেস করে আসুন।”
ফাহিম ভাই বিনীত কণ্ঠে বলল,” আরে, তোমাকে কেউ বাসী মিষ্টি বানানোর অপবাদ দিচ্ছে না। মিষ্টি যথেষ্টই ভালো হয়েছে। কিন্তু তেঁতো লাগছে অন্য একটা কারণে।”
ততক্ষণে আমার সব মিষ্টি খাওয়া শেষ। আমি আঙ্গুল চাটতে চাটতে প্রশ্ন করলাম,” কি কারণ শুনি?”
ফাহিম ভাই আমতা-আমতা করে বলল,” আসলে রিফাত ভাইয়ের প্ল্যান ছিল। সব মেয়েদের এলকোহল মেশানো মিষ্টি একটা করে খাওয়ানো হবে। এজ আ প্র্যাংক। প্রথমে আমি তোমার কাছেই এনেছি। আর তুমি একাই সব খেয়ে ফেলেছ। এখন আমি জানি না কি হতে চলেছে।”
আমি ইতোমধ্যে চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করলাম। আমার শরীর নিজস্ব গতিতে দুলছে। ফাহিম ভাইয়ের কথা আমার মাথায় ঢুকল না। চোখ-মুখ কুচকে বললাম,” কি?”
” মিষ্টিগুলো খেয়ে তোমার নেশা হয়ে গেছে।”
” কি!” আমি হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলাম৷ তারপর উঠে দাঁড়াতে নিলেই দুনিয়া ঘুরে উঠল। ফাহিম ভাই ঝটপট এসে আমাকে দুইহাতে আগলে ধরল। আমি দূর্বল কণ্ঠে বললাম,” আমার খুব অদ্ভুত লাগছে ফাহিম ভাই।”
ফাহিম ভাই অপরাধী গলায় বলল,” আই এম স্যরি। আমার জন্য সব হয়েছে। কিন্তু আমিও তো তোমাকে নিষেধ করেছিলাম। তুমি শুনলে না।”
আমি ফাহিম ভাইয়ের বুকে ঢলে পড়লাম৷ চোখমুখ সব বন্ধ হয়ে আসছে। হাত-পা নাড়াতে পারছি না। শরীরটা ভীষণ হালকাবোধ হচ্ছে। আমি হেসে বললাম,” আমি কি মঙ্গল গ্রহে চলে এসেছি? এতো হালকা লাগছে কেন আমার? আচ্ছা ফাহিম ভাই বলেন তো, মঙ্গল গ্রহের গ্র্যাভিটি বেশি নাকি পৃথিবীর গ্র্যাভিটি বেশি?”
” আমি জানি না।”
আমি ধপ করে পড়ে যেতে নিচ্ছিলাম। ফাহিম ভাই আমাকে কোলে তুলে নিল। আমার খুব লজ্জা লাগছে কিন্তু আমি কিছু বলতে পারছি না। ফাহিম ভাই ফিসফিস করে বলল,” তোমাকে আমি ঘরে রেখে আসব। তুমি কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকবে, ওকে? ভুলেও ঘর থেকে বের হয়ো না প্লিজ।”
আমি বিরস কণ্ঠে বললাম,” জানেন ফাহিম ভাই, ঈশান আমাকে খুব দুঃখ দিয়েছে। আমি তাকে এতো ভালোবাসি অথচ সে..”
ঈশান ঠিক তখনি ফাহিম ভাইয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ফাহিম ভাই আমাকে এটা বলতে নিলেই ঈশান হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলল। আর এদিকে আমি কথা বলে যেতে লাগলাম,” সে আমাকে একটুও বুঝল না ফাহিম ভাই৷ অন্যকারো সাথে তাকে কথা বলতে দেখলেও আমার হিংসা হয়। কিন্তু সে সারাক্ষণ সামিয়ার সাথে ঘুরঘুর করছে। সামিয়ার সামনে আমাকে কিভাবে ইনসাল্ট করল দেখলেন? শুধু একটা চড় মেরেছিলাম বলে আমার সাথে এমন করবে? আমি তো তাকে স্যরিও বলেছি। ভুল কি শুধু আমার ছিল? সে কি কোনো ভুল করেনি?”
ঈশান গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল,” ওর কি হয়েছে?”
ফাহিম ভাই আড়ষ্ট কণ্ঠে পুরো ঘটনা বলল। আমি আবছা দৃষ্টিতে ঈশানের দিকে চাইলাম। তাকে দেখেই আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল৷ আমি উচ্চ কণ্ঠে বলতে লাগলাম,” আপনি এখানে কি করছেন? যান আপনার সামিয়ার কাছে। আই হেইট ইউ। আপনি আমার সামনে আসবেন না।”
ঈশান আমার হাত ধরে বলল,” তারিন, এদিকে এসো। তোমার অবস্থা একদম ঠিক নেই।”
আমি হাত ছাড়িয়ে বললাম,” উহুম। আমি যাবো না। আপনি ভালো না।”
ফাহিম ভাই আমাকে ঈশানের কাছে রেখে নিজে চলে গেল। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। ঈশান আমাকে ধরতে এলেই আমি ধমক দিয়ে বললাম,” ডন্ট টাচ মি।”
” আচ্ছা, টাচ করব না। তুমি আমার হাতটা ধরো তারপর আমার সাথে চলো।”
” না। আপনি ফাহিম ভাইকে ভাগিয়েছেন কেন? কোথায় ফাহিম ভাই?”
” আমি ভাগাইনি। ও নিজেই চলে গেছে।”
” মিথ্যা কথা। আপনি একটা মিথ্যুক। সবার সাথে মিথ্যা বলেছেন। আমার সাথেও মিথ্যা বলেছেন। মিথ্যা বলে বলে আমার মন ভেঙেছেন।”
ঈশান কোমল গলায় বলল,” আই এম স্যরি।”
আমি মাথা নেড়ে বললাম,” আপনার স্যরি গ্রান্টেড হলো না। আমি আপনাকে এতো সহজে মাফ করবই না। আমি যত কষ্ট পেয়েছি ঠিক তত কষ্ট আপনাকেও পেতে হবে।”
ঈশান একহাতে বাউন্ডারির মতো আমার কোমর জড়িয়ে রেখেছে যেন আমি হেলে পড়ে না যাই৷ আশেপাশের মানুষ আমাদের বিস্ময় নিয়ে দেখছে। ঈশান বিড়বিড় করে বলল,” প্লিজ ঘরে চলো তারিন৷ ফাহিমকে আমি পরে দেখে নিব। কি অবস্থা করেছে তোমার!”
” ফাহিম ভাই যা করেছে একদম ঠিক করেছে। আমার তো বেশ লাগছে। বিন্দাস আছি আমি। আকাশে উড়ছি। কিন্তু আপনি আমাকে ধরে আছেন কেন? আমাকে উড়তে দিবেন না?”
” না।”
” আমি উড়ব। অবশ্যই উড়ব।”
হঠাৎ মেইন গেইটের সামনে সিএনজি এসে থামল। আমি ঝাপসা চোখে দেখলাম সিএনজি থেকে নামছে একজন লোক আর তারপাশে বোরখ পরিহিত দু’জন মহিলা। তারা এদিকেই আসছে। আমি অবাক হয়ে বললাম,” আরে দেখুন, লোকটাকে একদম আমার ভাইয়ার মতো লাগছে না।”
ঈশান বিষমচিত্তে বলল,” ওহ শিট! ওটা সত্যিই তোমার ভাই তারিন। তোমাকে এইভাবে দেখলে কেলেংকারী হয়ে যাবে। প্লিজ ঘরে চলো।”
মুহূর্তেই ঈশান আমাকে কোলে তুলে দৌড়াতে লাগল। আর আমি খিলখিল করে হাসতে লাগলাম৷ দুই হাত বাড়িয়ে চিৎকার করলাম,” উড়ালপঙ্খী, আমি উড়ালপঙ্খী। এখন তারু উড়ে যাবে আকাশে৷ পারবে না কেউ ছুঁতে৷ আপনিও ছুঁতে পারবেন না।”
ঈশান আমাকে নিয়ে একটা ঘরের ভেতর এসে দরজা আটকাল। তারপর আমাকে বিছানায় বসিয়ে হতাশ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি হেসে বললাম,” আপনি এভাবে কেন তাকিয়ে আছেন? একটু হাসুন না। হাসলে আপনাকে কিউট লাগে।”
ঈশান বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,” হাসার পরিস্থিতি কি এখন আছে?”
আমি কিছু বললাম না। ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করলাম। ঈশান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” এখানে চুপচাপ শুয়ে থাকো। আমি না আসা পর্যন্ত বের হবে না। ওকে?”
আমি ঈশানকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলাম। ঈশান আমার মুখের কাছে ঝুঁকে প্রশ্ন করল,” কি?”
আমি ফিসফিস করে বললাম,” আমি ভাবছি ছাদে গিয়ে লাফ দিব। আপনার কাছে প্যারাস্যুট আছে?”
ঈশান এই কথা শুনে দরজা বাইরে থেকে লক করে বের হয়ে গেল। আমি দ্রুত দরজার কাছে ছুটে গেলাম। জোরে জোরে ধাক্কাতে লাগলাম দরজাটা। কিন্তু ঈশান ততক্ষণে চলে গেছে। আমি হতাশ হয়ে ফ্লোরে বসে পড়লাম। এতো খারাপ কেন ঈশান? নিজে সারাক্ষণ সামিয়ার সাথে ঢলাঢলি করছে সেটা কিছু না? নিজের বেলায় ষোলআনা আর আমার বেলায় কাচকলা? না, তা হবে না। ওই সামিয়াকে আমি উচিৎ শিক্ষা দিয়েই ছাড়ব। ঈশান কি এখন আবার সামিয়ার কাছে গেছে? আমি জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। যদি কাউকে পাই তাহলে বলব দরজা খুলে দিতে। তখনি দেখলাম আরিশাকে। মাথার লম্বা ঝুঁটিটা এপাশ-ওপাশ দুলিয়ে কোথায় যেন হেঁটে যাচ্ছে। আমি হাত বাড়িয়ে ডাকলাম,” আরিশা বেবি!”
আরিশা থেমে দাড়ালো। এদিকে-ওদিক তাকিয়ে শব্দের উৎস খুঁজছে লাগল। আমি আবার বললাম,
” এইযে দেখো, এদিকে জানালায়। আমি তারিন আপু।”
আরিশা জানালা বরাবর তাকাল। মুচকি হেসে ছোট্ট হাত নাড়িয়ে বলল, “হাই তারি আপু!”
” এদিকে একবার এসো না আরিশা!”
আরিশা জানালার কাছে আসতেই আমি বললাম,” একটা হেল্প করতে পারবে?”
আরিশা ভ্রু কুচকে ঠোঁটের কোণে আঙুল রেখে বলল,
“হেল্প? ওকে। আই ক্যান হেল্প ইউ। বাট ইউ হেভ টু গিভ মি দ্যা রিটার্ন গিফট।”
” রিটার্ন গিফট?আচ্ছা আমি তোমাকে চকলেট দিবো। আগে তুমি দরজাটা একটু খুলে দাও?”
আরিশা মাথা নাড়িয়ে বলল, “উহুম! আগে চকলেট দাও।”
এই বলেই সে হাত পাতল। আমি কি করব বুঝতে পারলাম না। আরিশা বলল,” চকলেট না পেলে আমি হেল্প করতে পারবো না। বা বায়!”
সামনের দিকে ঘুরে হাঁটতে লাগল আরিশা।
আমি চোখ সরু করে তাকালাম। মেয়ে তো খুব শেয়ানা! তবে আমিও কিছু কম না।আমি পুনরায় ডাকলাম,
“আরিশা বেবি! আমি তোমাকে চকলেট দিবো প্রমিস। কিন্তু চকলেট টা খুব বড়। জানালা দিয়ে দেওয়া যাবে না। তুমি দরজাটা খুলো, তারপর আমি দিচ্ছি।”
আরিশা কিছু একটা ভেবে বলল,” এতোবড় চকলেট? সত্যি দিবে তো? নাকি ঢপ মারছ?”
“হ্যাঁ সত্যি দিবো।”
“ঠিকাছে আমি দরজা খুলছি।”
আরিশা দৌড়ে দরজার দিকে গেল। আমিও দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজা খোলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আমি কান পেতে রইলাম। কয়েক মিনিট পর আরিশা বলল,
“তারি আপু! আমি খুলতে পারছি না।খুব শক্ত।”
“পারবে আপু। একটু চেষ্টা করো!”
আরো কয়েক মিনিট মোচড়ামোচড়ির পর অবশেষে খুলে গেল দরজা। আমি হালকা নিচু হয়ে আরিশা কপালে চুমু দিলাম। বললাম,”থ্যাঙ্কিউ বেবি।”
“এবার আমার চকলেট দাও।”
“চকলেট ঈশানের কাছে আছে। তুমি ওর থেকে নিয়ে নিও কেমন?”
এই কথা বলেই ডানদিকে ছুট লাগালাম আমি। আরিশা পেছন থেকে কিছু একটা বলছিল, আমি শুনলাম না।
#তি_আমো
পর্ব ২৪
লিখা- Sidratul Muntaz
আমি খুব ধীরে দৌড়াচ্ছি কিন্তু তবুও আমার মনে হচ্ছে যেন পা দু’টো বাতাসের গতিতে ছুটছে। আর শরীরটা দোলনার মতো দুলছে। বাড়ি এখন ফাঁকা বললেই চলে। সবাই স্টেজে আনন্দ করতে ব্যস্ত। আমি নিহাদের ড্রয়িংরুমের সামনে এসে থামলাম। তখনি খেয়াল করলাম সাফিন ভাই ছুটে এদিকেই আসছেন। আমি কোমরে হাত গুজে বললাম,
” আরে সাফিন ভাই, আজ না আপনার বিয়ে? আপনি অলিম্পিকের দৌড় দিচ্ছেন কেন?”
আমাকে দেখে সাফিন ভাই বিপর্যস্ত কণ্ঠে বললেন,” আচ্ছা তারিন, নিহা তো বলেছিল তোমার বাড়ির কেউ বিয়েতে আসবে না। তাহলে তোমার ভাইয়াকে স্টেজে দেখলাম কেন? তিনি এখানে কি করছেন?”
সাফিন ভাইয়ের ভয়ে চুপসে যাওয়া মুখটি দেখে আমি ঠোঁট টিপে হেসে উঠলাম। মজা করে বললাম,” ও বুঝেছি। ভাইয়া তাহলে আপনাকে দৌড়ানি দিয়েছে?”
সাফিন ভাই চেহারার ঘাম মুছতে মুছতে বললেন,” আরে না, কিন্তু দেখা হলে তো মনে হয় সত্যি চোর চোর বলে দৌড়ানি দিবে। ”
আমি হাসতে হাসতে বললাম,” ও বুঝেছি। এজন্য আপনি আগে থেকেই দৌড়ানোর প্র্যাকটিস করে নিচ্ছেন?”
আমার উচ্চ শব্দের হাসি দেখে সাফিন ভাইয়া অদ্ভুত ভাবে চেয়ে রইলেন। প্রশ্ন করলেন,” তোমার কি হয়েছে তারিন? আর ইউ ওকে?”
আমি সঙ্গে সঙ্গে সোজাভাবে দাঁড়িয়ে বললাম,” অভিয়াসলি! আই এম এবসুল্যুটলি ফাইন। দেখবেন আমি ইয়োগাও করে দেখাতে পারব। ওয়ান, টু, থ্রি…”
আমি কোমর বাকিয়ে বাম হাত দিয়ে ডান পায়ের তালু স্পর্শ করলাম। তারপর আবার ডানহাত দিয়ে বামপায়ের তালু। সাফিন ভাইয়া হত বিস্মিত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন। আমিও তার পেছন পেছন গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” এখন আপনি কি করবেন সাফিন ভাইয়া?”
সাফিন ভাই দিশেহারার মতো মাথা চুলকে বলতে লাগলেন,” জানি না। আপাতত ওয়াশরুমের কথা বলে স্টেজ থেকে পালিয়ে এসেছি। কিছুক্ষণ ওয়াশরুমে বসে থাকব। এর মধ্যে তুমি একটু চেষ্টা করে দেখো তোমার ভাইকে বের করতে পারো কি-না। নাহলে তো আমার বিয়ে মাটি হয়ে যাবে। নিজের বিয়েতে কেউ আমাকে চোর বলে ধাওয়া করছে, ও মাই গড! চিন্তা করতেই কেমন লাগে! মানুষ কি ভাববে?”
আমি হাসতে হাসতে পাগল হয়ে যাচ্ছি। পরিস্থিতিটা আমার এতো মজা লাগছে কেন? সাফিন ভাই বাথরুমে ঢুকে পড়ার আগে আমাকে বললেন,” ঈশান কোথায়? তাকে খুঁজে আনো। শালা নিজে আমাকে ফাঁসিয়ে এখন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছে।”
আমি বাগানের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। তখনি দেখলাম ঈশান হন্তদন্ত হয়ে এদিকে ছুটে আসছে। আমি তাকে দেখে দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। কোথ থেকে যেন আরিশা এসে ঈশানকে থামাল। আমি কেবল আরিশার কণ্ঠ শুনলাম,
” থামো বয়ফ্রেন্ড। তোমার সাথে আমার একটা জরুরী কথা আছে।”
আমি দেয়ালের আড়াল থেকে উঁকি মারলাম। ঈশান নিচু হয়ে আরিশার গাল টিপে দিয়ে বলল,” তোমার সাথে আমি পরে কথা বলব, গার্লফ্রেন্ড। এখন আমার খুব জরুরী একটা কাজ আছে।”
ঈশান চলে যেতে নিলেই আরিশা তার হাত চেপে ধরল। জেদী গলায় বলল,” না। আমি তোমাকে যেতে দিবো না। কেউ আমার সাথে চিট করেছে। তোমার তাকে পানিশমেন্ট দিতে হবে।”
” আচ্ছা পরে পানিশমেন্ট দেই? এখন আগে জরুরী কাজটা করি?”
” না। এখনি পানিশমেন্ট দিতে হবে। নইলে আমি খুব জোরে চিৎকার করে কাঁদব।”
ঈশান উপায়ন্তর না পেয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসল। ধৈর্য্য নিয়ে বলল,” ওকে। আগে তোমার কথাই শুনি। বলো কি হয়েছে?”
” তারি আপু আমাকে বলেছে আমি যদি দরজার লক খুলে দেই তাহলে আমাকে চকলেট দিবে।”
ঈশান বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে বলল,” তারপর? তুমি কি দরজা খুলে দিয়েছ?”
আরিশা বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বলল,” হ্যাঁ। কিন্তু এখন সে আমাকে চকলেট দিচ্ছে না।”
ঈশান রাগে উঠে দাঁড়িয়ে দরাজ কণ্ঠে বলল,” তোমাকে মার দেওয়া উচিৎ স্টুপিড মেয়ে। দরজা খুলেছ কেন তুমি? কি সর্বনাশ হলো, আল্লাহ!”
ঈশান আরিশার হাত ছেড়ে দ্রুত এদিকে আসতে লাগল। আমি সাথে সাথে দেয়ালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঈশান আমাকে খেয়াল করল না। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আরিশাকে দেখলাম মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলছে। আমি তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তার চিবুক স্পর্শ করে বললাম,” কি আরিশা বেবি? ঈশান বকেছে?”
আরিশা নিচের দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল। আহ্লাদে ঠোঁট বেঁকিয়ে কাঁদার চেষ্টা করছে। আমি হাসতে হাসতে বললাম,” একদম ঠিকাছে। পারফেক্ট! আর করবি ইঁচড়েপাকামি?”
আরিশা আমার কথায় অবাক হয়ে তাকাল। আমি হাসছি। অপমানে, অভিমানে এবার ঠোঁট ভেঙে শব্দ করে কেঁদে ফেলল আরিশা। আমি কড়া গলায় বললাম,” আবার কাঁদে! বল ঈশান আমার ভাই। ঈশানকে আমি বিয়ে করব না। দ্রুত বল।”
আরিশা কটমট করে আমার দিকে চাইল। আমি নিচের ঠোঁট কামড়ে হুমকি দেওয়ার মতো বললাম,” কি হলো? বল!”
আরিশা দাঁত কিড়মিড়িয়ে উচ্চারণ করল,” জীবনেও বলব না।”
আমি ক্ষীপ্ত কণ্ঠে বললাম,” তাহলে একদম ঠিকাছে। আরও বকা খাবি তুই।”
আরিশা চিল্লিয়ে কাঁদতে লাগল এবার। এখন এই মেয়ের কান্না শুনে যদি ঈশান চলে আসে? তাহলে আবার আমাকে ধরে আটকে রাখবে। সেই ভয়ে আমি দ্রুত বাথরুমে ঢুকে গেলাম। সাফিন ভাইয়া আমাকে দেখে ফট করে প্রশ্ন করলেন,” ঈশান কই?”
আমি মুখ টিপে হেসে বললাম,” চাঁদের দেশে!”
সাফিন ভাই ভ্রু কুচকে বললেন,” মানে? তারিন আজকে তোমার কি হয়েছে? আমার এমন একটা বিপদের দিনে সবাই এতো অদ্ভুত আচরণ কেন করছ?”
আমি সাফিন ভাইয়ের কথার জবাব না দিয়ে বাথরুমে পায়চারী করতে লাগলাম। নিহাদের বাড়ির বাথরুমটা একদম রেস্টুরেন্টের মতো। সারিবদ্ধভাবে অনেকগুলো বেসিন। বেসিনের সাথে সংযুক্ত বিশাল বড় দুইটা আয়না। তারপর কিছু দূরে তিন রুমের আলাদা তিনটা বাথরুম। আমি আর সাফিন ভাই বেসিন রুমে দাঁড়িয়ে আছি। আমি আয়নার দিকে চেয়ে মুখ ভেংচাতে লাগলাম৷ একবার চোখ ট্যারা করছি, একবার জিহ্বা বের করছি, অন্যবার চুল দিয়ে মুখ ঢেকে ভূত সাজার চেষ্টা করছি। সাফিন ভাই হতবাক দৃষ্টিতে আমার এসব কান্ড দেখতে লাগলেন। একটু পর দেয়ালে মাথা ঠুঁকে বললেন,” হে আল্লাহ, রক্ষা করো। এসব কি হচ্ছে আজ? বিয়েটাও কি শান্তিমতো কপালে ছিল না?”
আমি হঠাৎ শুনলাম জানালার বাইরে কেউ কথা বলছে। একদম ভাইয়ার মতো গলা। আমি জানালা দিয়ে মাথা বের করে চাইলাম। কিছুটা দূরে স্টেজের ডান সাইডে দাঁড়িয়ে তারিফ ভাইয়া কথা বলছে নিহার বাবার সাথে। আঙ্কেল প্রশ্ন করলেন,” তোমার দাদীর শরীর এখন কেমন?”
তারিফ ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,” এখন অনেকটা ভালো। এজন্যই তো সবাইকে নিয়ে চলে এলাম। নিহা এতো করে বলছিল! তারুর মতো আমি তাকেও খুব স্নেহ করি। না এলে সে খুব মনখারাপ করত।”
আঙ্কেল খোশমেজাজে বললেন,” খুব ভালো করেছ। তারুর সাথে দেখা হয়েছে?”
” না। তাকে খুঁজছি। কোথায় যে আছে মেয়েটা?”
আমি সাথে সাথে জানালা দিয়ে হাত বের করে বললাম,” এইতো ভাইয়া, আমি এখানে!”
আমার কণ্ঠ শুনে তারিফ ভাই আশেপাশে খুঁজতে লাগল। সাফিন ভাই পেছন থেকে আমার মুখ চেপে ধরে দ্রুত জানালা আটকে দিল।
মাঝরাতে সবাইকে হাসানোর জন্য এই পর্ব দিলাম৷ কালকে থেকে ১ পর্বই দিব।
চলবে