#তি_আমো,২৫,২৬
পর্ব ২৫
লিখা- Sidratul Muntaz
সাফিন ভাইয়ের সাথে জোরাজুরি করার মতো শক্তি আমার দূর্বল শরীরে নেই। তাই সে যখন আমার মুখ চেপে ধরে মেঝেতে বসাল তখন আমিও চুপচাপ বসে পড়লাম। সাফিন ভাই অতি রাগ নিয়ে আমার মাথায় গাট্টা মেরে বলতে লাগল,” এই মেয়ে, তুমি হুঁশে আছ তো? বেহুঁশের মতো আচরণ কেন করছ?”
আমি হাসলাম। সাফিন ভাই ভারী বিরক্ত হয়ে বলল ” কি খেয়েছ তারিন? এই অবস্থা তোমার কি করে হলো? তোমাকে কিন্তু আমি ভালো মেয়ে ভাবতাম!”
ঈশান তখন দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেছে। তাকে দেখে আমি পালানোর জন্য উঠতে নিলেই সাফিন ভাই আমার হাত চেপে ধরল। আমি পালাতে ব্যর্থ হলাম। ঈশান কোমরে হাত গুজে আমার দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর হতাশ গতিতে আমার কাছে এসে চিন্তিত স্বরে বলল,” তারিন, তুমি ঠিকাছ? ঘর থেকে আমি বের হতে নিষেধ করেছিলাম। তবুও কেন বের হলে? ”
সাফিন ভাই দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বলল,” আজ-কালকের ভালো মেয়েরাও সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব কি? শেষ-মেষ তারুও? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
ঈশান সাফিন ভাইয়ের দিকে চেয়ে হতাশ গলায় বলল,” তারিনের দোষ নেই। ফাহিম এই কাজ করেছে। মিষ্টির সাথে এলকোহল মিশিয়েছিল। তারিন সেই সব মিষ্টি খেয়ে এখন এই অবস্থা।”
সাফিন ভাই মুখ কুচকে বলল,” মিষ্টির সাথে এলকোহল? এই ফাহিম তো খুব ফাজিল!”
ঈশান পাশ কাটানো গলায় বলল,” ওরও দোষ নেই। রিফাতের প্ল্যান ছিল। সব মেয়েকে একটা করে এলকোহল মেশানো মিষ্টি খাওয়িয়ে প্র্যাংক করা। কিন্তু তারিন একাই সব মিষ্টি খেয়ে ফেলল।”
” তাহলে তো ঘুরে-ফিরে দোষ তারিনেরই হলো। সে এতো মিষ্টি খেতে গেল কেন?”
ঈশান আবারও হতাশ কণ্ঠে বলল,” আমার জন্য হয়েছে সব। আমি যদি তখন মিষ্টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতাম তাহলে তারিনও এমন পাগলামি করতো না। ভুলটা আমারই!”
ঈশান এবার আমার মাথায় স্পর্শ করে বলল,” আই এম স্যরি তারিন। প্লিজ ঘরে চলো।”
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম,” আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আপনি কি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন?”
ঈশান মৃদু হেসে বলল,” এদিকে এসো।”
তারপর সে আমাকে কোলে নিল। আমি রাগী কণ্ঠে বললাম,” আবার সামিয়ার কাছে চলে যাবেন না তো?”
ঈশান অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে বলল,” তুমি কি সামিয়ার প্রতি জেলাস?”
আমি ঈশানের প্রসারিত ঠোঁট স্পর্শ করে বললাম,” আরিশাও আপনাকে বিয়ে করতে চায়। কেন? পৃথিবীতে কি আর কোনো ছেলে নেই?”
ঈশান আরও জোরে হেসে উঠে বলল,” ওহ মাই গড তারিন! শী ইজ জাস্ট আ লিটল বেবি। তার কথাও তুমি ধরে বসে আছ?”
” কেন ধরব না? সে আমার হৃদয়ে হাত দিয়েছে।”
ঈশান গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,” কে তোমার হৃদয়?”
আমি ঈশানের গজদাঁতের উপর আঙুল রেখে বললাম,” এই গজদন্তওয়ালাই আমার হৃদয়।”
ঈশান আরও গাঢ় করে হাসল। আমি মুগ্ধ হয়ে তার অদ্ভুত সুন্দর হাসির দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভাবতেই ভালো লাগে যে এই মানুষটি শুধু আমার! তার পাশে অন্যকারো কথা আমি চিন্তাও করতে পারি না। এক মুহূর্তের জন্যেও না। ঈশান হঠাৎ আমার দিকে চেয়ে সিরিয়াস হয়ে বলল,” শোনো তারিন, আরিশা বলো কিংবা সামিয়া। তারা দু’জনই আমার বোন। এছাড়া অন্য কিছু না। তাই ওদের নিয়ে তোমার ইনসিকিউরড ফীল করার কোনো প্রয়োজন নেই। আর শুধু ওরা কেন? কাউকে নিয়েই ইনসিকিউরড ফীল করার প্রয়োজন নেই। ঈশান শুধু তারিনের।”
আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,” তাই বুঝি? ওরা শুধুই আপনার বোন?”
” হ্যাঁ মহারাণী!”
আমি ঘাড়টা একটু হেলিয়ে প্রশ্ন করলাম,” আর আমি আপনার কি?”
ঈশান গাঢ় কণ্ঠে বলল,” তুমি আমার জান।”
আমি খুশিতে গদগদ হয়ে ঈশানের গলা জড়িয়ে ধরলাম। ঘরে ঢুকে পড়ার সময় দেখলাম ড্রয়িংরুমের ঠিক সামনে সামিয়া দাঁড়িয়ে আছে। ঈশান যে আমাকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকছে, এই দৃশ্য সে হতবিস্ময় নিয়ে দেখছে। আমি তাকে দেখানোর জন্য ইচ্ছে করেই ঈশানের গালে চুমু দিলাম। এই মেয়ে আজ সারাদিনে অনেক জ্বালিয়েছে আমাকে। তাই দিনশেষে আমারও উচিৎ তাকে একটু জ্বালিয়ে দেওয়া। আর মজার বিষয়, সামিয়ার চোখ-মুখ দেখে তখন মনে হচ্ছিল সত্যিই সে ঈর্ষার আগুনে জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে!
ঠিক একই সময় সাফিন ভাইয়ের সাথে কি হচ্ছিল? ওই ঘটনাগুলো আমি স্বচক্ষে দেখিনি। কিন্তু নিহার থেকে পরে সব শুনেছিলাম। পুরো ব্যাপারটাই কৌশলে সামলে নিয়েছিল ঈশান। তারিফ ভাই স্টেজে যখন প্রথমবার সাফিন ভাইকে দেখল, তখনি বলে উঠল,” আরে, এই ছেলেটাকে আমি কোথায় যেন দেখেছি।”
ঈশান তখন বলল,” হ্যাঁ দেখেছেন। আপনার বাড়িতে।”
তারিফ ভাই চোখ বড় করে বলল,” চোরটা!”
” না, চোর না। ও আমার বেস্টফ্রেন্ড। যেই ফ্রেন্ড আমাকে জামিনে ছাড়িয়ে এনেছিল তারপর আমাকে তার গাড়ি দিয়েছে উবার ড্রাইভিং এর জন্য। যখনই আমার কোনো অসুবিধা হয়, সে ঢাল হয়ে আমার পাশে থাকে। হি ইজ দ্যা বেস্ট ম্যান।”
তারিফ ভাই আঁড়চোখে চেয়ে প্রশ্ন করল,” তাহলে আমার বাড়িতে চুরি করতে এলো কেন তোমার বেস্টম্যান?”
” আরে ভাইয়া, চুরি করতে আসেনি। ওর উদ্দেশ্য ছিল আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়া। কিন্তু আমি যে ওইদিন আপনাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গেছি এটা সে জানতোই না। চেয়েছিল আমার ঘরে বসে থেকে আমাকে সারপ্রাইজ দিবে। ও মানুষকে চমকে দিতে খুব ভালোবাসে। আপনাদের সবাইকেও চমকে দিয়েছিল, তাই না?”
” তোমার এই ফ্রেন্ড তো আস্তো গাঁধা। আমার সবাই তাকে চোর ভেবে কি ভয়টাই না পেয়েছিলাম।”
” গাঁধা হলেও ওর মনটা খুব ভালো। ”
” তা অবশ্য ঠিক বলেছ। এই যুগে বন্ধুকে খুশি করার জন্য কেউ এমন রিস্ক নেয়? ছেলেটা একদম সরল। ”
ঈশানের এইটুকু কাজই যথেষ্ট ছিল। তারপর ফাঁকা স্টেজে ‘বর কই’, ‘বর কই’ করে সবার মাঝে যখন হল্লা বেঁধে গেল তখন সাফিন ভাই বাধ্য হয়েই স্টেজে উপস্থিত হলো। কিন্তু তার মুখে চাপানো ছিল একটি সাদা রুমাল। মানুষ জামাইয়ের মুখে রুমাল চাপা দেখে সে কি হাসাহাসি! এগুলো অনেক পুরনো রেওয়াজ। আজ-কাল কোন জামাই মুখে রুমাল চেপে বসে থাকে? তাছাড়া ক্যামেরাম্যানও ছবি তোলার জন্য বার-বার অনুরোধ করতে লাগল রুমাল সরানোর।
নিহা ফিসফিস করে বলল,” এসব কি হচ্ছে সাফিন? প্লিজ রুমাল সরাও। তোমাকে উইয়ার্ড লাগছে।”
সাফিন ভাই দুই পাশে মাথা নাড়ল। সে রুমাল ছাড়বে না কিছুতেই। নিহা চোখ পাকিয়ে বলল,” আমি বলছি, তাও তুমি আমার কথা শুনবে না? আমার জন্য সামান্য রুমাল সরাতে পারবে না?”
সাফিন ভাই করুণ গলায় বলল,” তোমার জন্য চাইলে জান দিয়ে দিব। তাও রুমাল দিতে পারব না। প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
নিহার তখন ইচ্ছে করছিল রাগে স্টেজ ভেঙে ফেলে। সবাই হাসতে হাসতে মরে যাচ্ছে এদিকে সাফিনের যেন কোনো হেল-দোল নেই। নিহার নিজের বিয়েতেই নিজেকে কমেডিয়ান মনে হচ্ছিল। এটা কি আসলেই বিয়ের মন্ডপ নাকি কমেডি শো? বাধ্য হয়ে নিহার বাবাও সাফিন ভাইকে অনুরোধ করলেন,” মুখ থেকে রুমালটা সরাও, বাবা। মানুষ খুব হাসাহাসি করছে।”
সাফিন ভাই কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,” হাসাহাসি করুক আঙ্কেল। দৌড়াদৌড়ি করার চেয়ে হাসাহাসি করা বেটার অপশন।”
আঙ্কেল অবাক হয়ে বললেন,” দৌড়াদৌড়ির প্রসঙ্গ কেন এলো?”
সাফিন ভাইয়া বিপর্যস্ত কণ্ঠে বলল,” জানি না আঙ্কেল। আমাদের জীবনটাই এমন অনিশ্চিত। যা ঘটার কথা নয় তাই ঘটে যায়। যার আসার কথা নয় সে এসে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। তখন দৌড়ানো ছাড়া আর উপায় থাকে না।”
আঙ্কেল বিব্রত হয়ে বললেন,” তুমি এসব কাকে ইন্ডিকেট করে বলছ?”
নিহা জবাব দিল,” আমি বুঝেছি। এই সাফিন, তুমি এখনি রুমাল সরাও।”
সাফিন ভাই অনুরোধ করে বলল,” এমন করে না নিহা। বিয়ের পর তোমার সব কথা শুনব। অন্তত আজকে তুমি আমার একটা কথা শোনো!”
নিহা নিজের আসন থেকে উঠে সাফিন ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,” আমি কিচ্ছু শুনব না। তোমাকে রুমাল সরাতেই হবে। না সরালে এমন একটা ঘুষি মারব যে নিজেও নিজেকে চিনবে না।”
সাফিন ভাই হতাশ হয়ে বলল,” সেটাই ভালো। আমিও নিজেকে চিনতে চাই না। আর আমাকে কেউ চিনুক সেটাও চাই না। তুমি বরং আমাকে ঘুষিই মারো।”
নিহা ” ধ্যাত” বলে জোর করে সাফিন ভাইয়ের হাত থেকে রুমাল কেঁড়ে নিল। সাফিন ভাই নিভু নিভু দৃষ্টি নিয়ে আশেপাশে তাকাতে লাগল। তারিফ ভাই কি তাকে দেখে নিল? এখনই কি ‘ চোর’ ‘চোর’ বলে চেঁচিয়ে তার ইজ্জতের ফালুদা করে দিবে? কিন্তু তেমন কিছু হলো না। তারিফ ভাইকে আশেপাশে দেখা গেল না। সাফিন ভাই কাঁপা বুক নিয়ে বসে রইল। কিছুক্ষণ পরেই পেছন থেকে কেউ আচমকা এসে তার কাঁধ চেপে ধরল। সাফিন ভাই পেছনে ঘুরতেই দেখল তারিফ ভাইকে। সে যেন কারেন্টের শক খাওয়ার মতো উঠে দাঁড়াল। তারিফ ভাই হাসতে হাসতে বলল,” আরে আবার দাঁড়াও কেন? বসো, বসো। তোমার কিন্তু অনেক প্রশংসা শুনেছি আমি। নিহা খুব ভাগ্যবতী যে তোমার মতো ছেলে পেয়েছে। আই জাস্ট প্রাউড অফ ইউ। ”
সাফিন ভাই হতবিহ্বলের মতো বলল,” কি?”
” কি আবার? বলো জ্বী! তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল ভাই। আজ ইচ্ছেটা পূরণ হয়ে গেল। এমন উদারমনের মানুষ এখনও পৃথিবীতে আছে, ভাবতেই আমার ভালো লাগে। জিও ভাই, জিও।”
তারপর তারিফ ভাই ক্যামেরামেনের দিকে ইশারা করে বলল,” ভাই, আমাদের দুইভাইয়ের একটা সুন্দর ছবি তুলে দেন তো! আমি আমার দেয়ালে বাঁধাই করে রাখব।”
সাফিন ভাইয়ের চেহারা তখন পুরো উজবুকের মতো। সে হা করে তাকিয়ে আছে। ছবিতেও তার ঠোঁট হা করা উঠল। তারিফ ভাই হেসে বলল,” এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি তো তোমার ফ্যান!”
সাফিন ভাই হতভম্ব হয়ে বলল ” ও।”
একটু পর ভাইয়া সাফিন ভাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,” সেদিনের জন্য স্যরি। তোমাকে চিনতে পারিনি আসলে। সব ভুলে যাও৷ আমিও কিন্তু ভুলে গেছি।”
সাফিন ভাই আমতা-আমতা করে বলল,” জ্বী।”
তারিফ ভাই স্টেজ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও সাফিন ভাইয়ের মাথা পুরো ফাঁকা হয়ে রইল। সে কিছুই বুঝতে পারছিল না। তারপর নিহা সাফিন ভাইকে আসল কথা জানাল। সেদিন সাফিন ভাইকে চোর বলে ঠেঙানোর জন্য ভাইয়া লজ্জিত ছিল। কয়েকবার ঝুঁকে ক্ষমাও চাইল।সাফিন ভাই ইতস্তত করে বলল,” ইটস ওকে, ইটস ওকে।”
এভাবে নিহা আর সাফিন ভাইয়ের সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। কিন্তু আমার আর ঈশানের জন্য তখন এর চেয়েও বড় ঝামেলা অপেক্ষা করছিল। মিথ্যা মানুষের জীবনে শুধু বিপদই ডেকে আনে।পৃথিবীর একটি অসম্ভব কাজ হলো মিথ্যা দিয়ে সত্যকে ঢেকে রাখা। এই ব্যাপারটি আমরা ওইদিনই বুঝতে পারলাম। কিন্তু সেটা বুঝতেই আমাদের খুব দেরি হয়ে গেছিল।
চলবে
#তি_আমো
পর্ব ২৬
লিখা- Sidratul Muntaz
ঈশান দ্বিতীয়বার আমাকে ঘরে ফেলে যাওয়ার মতো ভুলটা করল না৷ এই সুযোগে আমি তাকে ইচ্ছেমতো জ্বালিয়ে মারতে লাগলাম। প্রথমেই আমি ঈশানের গায়ে এক গাদা বমি করে ভাসালাম। সে বিড়বিড় করে বলল,” এইটাই বাকি ছিল। ”
আমি খিলখিল করে হাসলাম। ঈশান নিজের হাতেই আমার বমি পরিষ্কার করল। বিসমিকে পাঠানো হলো আমার ঘর থেকে কাপড় আনার জন্য। বোকা মেয়ে হাতে করে একটা নাইটি নিয়ে চলে এলো। ঈশান তাকে ধমক দিয়ে বলল,” এটা কার?”
বিসমি নিচু গলায় বলল,” আমি কিভাবে জানি কার? বিছানায় পেয়েছি তাই নিয়ে এসেছি। তারিন আপুর ব্যাগ কোনটা আমি তো জানি না।”
আমি হাসিমুখে বললাম,” আমি জানি। আমার ব্যাগে এত্তোগুলো ইঁদুর আছে। হাত দিলেই কামড়ে দিবে।”
বিসমি বিস্মিত হয়ে বলল,” ওরে বাপরে, ঈশান ভাই আমাকে মাফ করেন। আমি যাবো না।”
ঈশান বিরক্ত হয়ে বলল,” আরে মাতালের কথার কি কোনো বেইল আছে? যাও বলছি।”
” না। আমাকে যদি কেউ দেখে ফেলে আর কিছু জিজ্ঞেস করে তখন আমি কি বলব?”
ঈশান কড়া নির্দেশ দিল,” ভুলেও এই ঘটনা বলা যাবে না।”
” তাহলে?”
ঈশান চিন্তা করতে লাগল। এর মাঝে আমি দুইবার হাচি দিলাম। ভেজা কাপড়ে বেশিক্ষণ বসে থাকলে আবার না আমার ঠান্ডা লেগে যায়। এই ভয়ে ঈশান তৎক্ষণাৎ বিসমিকে দিয়ে আমাকে গোসলে পাঠাল। আমি ধমক দিয়ে বিসমিকে বাথরুম থেকে বের করে দিতে চাইলাম। বিসমি যখন কোনোভাবেই বের হচ্ছে না, আমি তার গায়ে পানি ঢেলে দিলাম। বিসমি রেগে-মেগে বের হয়ে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল,” আমাকে আর ডাকবেন না। আমি আর এখানে আসব না।”
বিসমি চলে যাওয়ার পর ঈশান আমার কাছে এসে উত্তপ্ত কণ্ঠে বলল,” এটা কি করলে তারিন? একজনই ছিল আমাদেরকে হেল্প করার মতো। এখন তাকেও তুমি রাগিয়ে দিলে।”
আমি নিচের ঠোঁট কামড়ে বললাম,” আমাদের হেল্প করার জন্য ওকে লাগবে কেন? আপনিই তো আছেন।”
এই কথা শুনে ঈশান প্রথমে অবাক হলো। তারপর হাসল৷ তারপর কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠে বলল,” তাই? তাহলে আসো, আমি তোমার ড্রেস চেঞ্জ করে দেই, তোমাকে গোসল করিয়ে দেই।”
” হ্যাঁ আসুন।”
আমি সাথে সাথে দরজা খুলে ফেললাম। ঈশান তার আগেই ঝড়ের চেয়েও দ্রুত গতিতে ঘরের বাইরে চলে গেল। আমি খুব শব্দ করে হাসতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর ঈশান ঘরে ঢুকল। ততক্ষণে আমি ভদ্র মেয়ের মতো পোশাক পরে, মাথা মুছ বিছানায় গুটিশুটি মেরে বসে আছি। ঈশান আমার কপালে হাত রাখল। আমি তাকিয়ে বললাম,” কি হয়েছে?”
” জ্বর আছে কি-না দেখছি।”
আমি আগ্রহপূর্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,” আছে?”
” উহুম। নেই।”
আমি অসহিষ্ণু হয়ে বললাম,” না,আছে!”
ঈশান মুচকি হেসে বলল,” আচ্ছা, আছে।”
আমি নরম গলায় আবেদন করলাম,” আপনি আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবেন প্লিজ।”
ঈশান অবাক হয়ে বলল,” কেন?”
” আমার খুব শীত লাগছে।”
ঈশান আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার নাকে ধাক্কা লাগল ঈশানের পারফিউমের ঘ্রাণ। জীবনে প্রথম প্রেমের ছোঁয়ায় আমার শরীর ক্রমশ বিবশ হয়ে আসতে লাগল। হাত-পা কেমন অবশ অবশ লাগছিল। আমার মনে হচ্ছিল ঈশানকে সারাক্ষণ এভাবেই জড়িয়ে ধরে রাখতে৷ সে যদি আমায় ছাড়ে, তাহলে আমি মরে যাব। ঈশান হঠাৎ সতর্ক কণ্ঠে বলে উঠল,” তুমি ঘুমাচ্ছ না কেন তারিন?”
আমি চোখ বন্ধ রেখে উচ্চারণ করলাম,” ঘুমিয়ে গেলে তো এই আরামটা আর পাব না। আপনি আমার কাছে এভাবে থাকলে আমি কখনও ঘুমাতে চাই না। সারাজীবন জেগে থাকতে চাই।”
ঈশান সাথে সাথে আমায় ছেড়ে দিয়ে বলল,” এবার তাহলে ঘুমাও।”
আমি টলমল দৃষ্টিতে বললাম,” আমার ঘুম আসছে না। আমার…”
ঈশান আমার ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল,” আজকে আর কোনো কথা না। ঘুমাও৷ না ঘুমালে হবে না ভালো মেয়ে।”
আমি ঈশানের শার্টের কলার খামচে ধরে বললাম,” আমি ভালো মেয়ে হতে চাই না। আমার এভাবেই বেশ লাগছে। আপনার ভালো লাগছে না?”
ঈশান দুই পাশে মাথা নেড়ে গম্ভীর গলায় বলল,” না। আমার আগের তোমাকে চাই। এই এলোমেলো, নেশায় বুঁদ হয়ে যাওয়া কিউট তারিনের থেকে কাঠখোট্টা, রাগী তারিনকেই আমার বেশি পছন্দ ছিল। ”
আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,” কিন্তু সেই তারিন তো পঁচা। আপনাকে কষ্ট দেয়। আপনাকে চড় মারতেও দ্বিধা করে না।”
ঈশানের ঠোঁট দু’টোয় হালকা হাসি ফুটল,” তবুও আগের তারিন বেস্ট। সে আমার ভুল শুধরে দেয়। আমার বিবেকের দরজা খুলে দেয়। আমি তাকে প্রচন্ড ভালোবাসি৷ ”
” তাহলে আমার উপর রেগে ছিলেন কেন?”
ঈশান কিছুটা মনখারাপের স্বরে বলল,” রাগটা তোমার উপর ছিল না, রাগটা আমার নিজের উপর। আমি কতটা অন্যায় করলে তুমি আমাকে ওইভাবে আঘাত করতে পারো সেটাই ভাবছিলাম সারাদিন ধরে।”
” তাহলে আমার সাথে কথা বলছিলেন না কেন?”
ঈশান আমার চোখের দিকে চেয়ে বলল,” তোমার সাথে কথা না বলে নিজেকে শাস্তি দিচ্ছিলাম।”
আমি অভিমান ঝরা কণ্ঠে বললাম,” কিন্তু আপনি আমাকেও শাস্তি দিচ্ছিলেন। সারাদিন আমি কত কষ্ট পেয়েছি জানেন?”
” জানি। সেজন্য স্যরি।”
ঈশান নিজের দুইকানে হাত রাখল। আমি হেসে উঠে বললাম,” আই লভ ইউ।”
ঈশান আমার দুইহাত মুঠোয় নিয়ে চুমু দিতে দিতে বলল,” আই লভ ইউ টু।”
আমি মুগ্ধচোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কি প্রশান্ত, কি স্নিগ্ধ, কি আশ্চর্য সুন্দর সে। সময়গুলো খুব দ্রুত কেটে যাচ্ছিল আমাদের। সুখের সময় হয়তো এভাবেই দ্রুত কেটে যায়। ঈশান অনেকটা সময় আমার সাথে ছিল। কিন্তু ভুল করেও আমার অচেতনতার সুযোগ নিল না। আমি দুষ্টমি করে বললাম,” মাত্র এক চড়েই আপনি এমন সাধু হয়ে যাবেন জানলে আরও আগেই চড় মারতাম।”
ঈশান রেগে বলল,” আচ্ছা তাই? এখন যদি আবার খারাপ হয়ে যাই তাহলে কি আবার চড় মারবে?”
” না। কারণ এবার আমিও একটা খারাপ মেয়ে হয়ে গেছি। আমার মাথায় শুধু দুষ্ট চিন্তা আসছে। ইচ্ছে করছে আপনাকে জড়িয়ে ধরে জোরে একটা চুমু দেই।”
ঈশান দ্রুত বিছানা থেকে নেমে বলল,” তুমি শুয়ে থাকো এখানে। আমি বারান্দায় যাচ্ছি।”
আমি এই কথা শুনে পেটে হাত দিয়ে হাসতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর ঈশানকে ডেকে বললাম,” শুনুন,আমার খুব ড্যান্স করতে ইচ্ছে করছে। ক্যান আই?”
ঈশান চোখ বড় করে বলল,” মানে? দেখো তারিন, প্লিজ আর ড্রামা না। আমি খুব টায়ার্ড হয়ে গেছি।রেহাই দাও।”
আমি সাথে সাথেই বিছানায় উঠে লাফাতে শুরু করলাম। ঈশান মুখে হাত রেখে চিন্তিত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইল। তাকে খুব হতাশ দেখাচ্ছে।
আমি লাফাতে লাফাতে হঠাৎ থেমে গেলাম। হালকা নিচু হয়ে ঈশানের মুখের কাছে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললাম,
” নিহা কোথায়? সে কি বাসর ঘরে ঢুকে গেছে?”
ঈশান আমাকে মানানোর উদ্দেশ্যে বলল,” হ্যাঁ। ওরা ঘুমাচ্ছে৷ এখন তুমিও ঘুমাও।”
আমি মুখ চেপে হেসে বললাম,” আপনি দেখি একটা ভেলকা! ধূর ভেলকা, বাসর রাতে কেউ ঘুমায়?”
ঈশান আমার হাত ধরতে এগিয়ে এলো। কিন্তু আমি ধরা দিলাম না। এক দৌড়ে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দরজা খুলে ফেললাম। ঈশান অতিষ্ঠ হয়ে বলল, “তারিন একদম না। বের হবে না কিন্তু। খবরদার বলে দিচ্ছি। আর কোনো তামাশা না প্লিজ।”
আমি ঈশানের কথার তোয়াক্কা করলাম না। সহসা সবেগে দৌড়াতে দৌড়াতে ড্রয়িং রুমে চলে এলাম। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে ছিল নাশফী, রিদি, আনিকা আর সামিয়া।তারা আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
আমি ভ্রু নাচিয়ে মুচকি হেসে নাশফী আপুর পাশে গিয়ে বসলাম। আমার উদ্ভট চাহনি দেখে নাশফী আপু কিছুটা সরে বসল। আমিও কিছু কম যাইনা। আরো এগিয়ে গেলাম নাশফী আপুর কাছে। একদম গা ঘেঁষে বসলাম। শয়তানি হাসি দিলাম। তাকে হালকা খোঁচা মেরে বললাম,” ঘটনা কি?”
নাশফী আপু যারপরনাই বিব্রত হয়ে জানতে চাইল,” মানে?”
আমি আগের মতোই মুখে হাসি রেখে বললাম,”কি করছিলে কালরাতে? রিফাত ভাইয়ার সাথে? বাগানের পেছন দিকে? একদম খুল্লামখুল্লা! ভেবেছো কেউ কিছু দেখবে না? আমি তো সব দেখে ফেলেছি!”
নাশফী আপু হা করে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে ভয়। ঈশান ছুটে এলো। সবার সামনেই ঈশান ‘এক্সকিউজ মি’ বলে আমাকে নিয়ে যেতে চাইল।
আমি ঈশানকে জিভ দেখিয়ে সোফার উপর উঠে দাঁড়ালাম। এক লাফে সোফা থেকে নেমে খিলখিল করে হাসতে হাসতে দৌড়াতে লাগলাম। তারপর আমার দেখা হলো আরিশার সাথে। মেয়ে আমাকে দেখেই রাগী দৃষ্টিতে চাইল৷ আমি ঈশানকে উদ্দেশ্য করে বললাম,” শুনুন, আপনি এই মেয়েকে আর কখনও কোলে নেবেন না।”
ঈশান হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,” কেন? ওর সাথে তোমার কি প্রবলেম?”
আমি হাত ভাজ করে বললাম,” জানি না। ওকে আমার ভালো লাগে না। আপনি ওর জন্য রোজ চকলেট আনেন। আমার জন্য কেন আনেন না? আমি কি বানের জলে ভেসে এসেছি?”
ঈশান নত স্বীকার করে বলল,” ঠিকাছে এখন থেকে তোমার জন্যেও আনব। এবার চলো।”
ঈশান আমাকে জোর করে কাঁধে উঠালো। কিছু পথ যাওয়ার পর আমি বললাম,” ওয়াশরুমে যাব।”
ঈশান এই কথা শুনে আমাকে কাঁধ থেকে নামাল। আমি আবার এক দৌড়ে বাগানের দিকে ছুটে গেলাম। ঈশান মাথায় হাত চেপে বলল,” ওহ শিট!”
আমি বাগানের বাইরে বের হলাম না। দরজার কাছে এসেই থমকে দাঁড়ালাম। ঈশান আমার কাছে এলেই আমি তার শার্ট খামচে ধরে বললাম,” ওই দেখুন, ভূত।”
ঈশান তাকিয়ে বলল,” কই?”
” আরে, এতোবড় ভূতটা চোখে দেখছেন না?”
” এটা ভূত নয় তারিন। এটা গাড়ি।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,” গাড়ি এমন ভূতের মতো লাগছে কেন?”
” কারণ গাড়ির উপর কভার পরানো হয়েছে।”
আমি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম৷ চোখ ভেঙে ঘুম আসছিল। ঈশানের বুকেই আমি হেলে পড়তে যাচ্ছিলাম। দৃষ্টি পুরোপুরি ঝাপসা হয়ে আসার আগে ভাইয়াকে দেখলাম।
চলবে