তি_আমো,২৯,৩০

0
341

#তি_আমো,২৯,৩০

পর্ব ২৯
লিখা- Sidratul Muntaz

তারিফ ভাইয়ের মোবাইল বেজে উঠল। কয়েক মুহূর্তের জন্য ঈশানকে ডাকা বন্ধ হলো। এর মধ্যে আমরা দ্রুত ভাবতে লাগলাম কি করা যায়! করিডোর আর স্টোর-রুমের দেয়াল লাগোয়া হওয়ায় বাইরের সব কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। এমনকি জানালা দিয়ে দেখাও যাচ্ছে। কিন্তু স্টোর-রুম অন্ধকার হওয়ায় ভাইয়া কিংবা মোহনা আন্টি আমাদের দেখবেন না। ভাইয়া ফোনে কথা শেষ করে ফোনটা পকেটে ভরেই কপালে বিরক্তির ভাজ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,” আপনি আর কিছু বলবেন?”

মোহনা আন্টি হাত ভাজ করে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “বলবো বলেই তো এসেছি। জরুরি বিষয়টাই তো বলা হলো না।”

ভাইয়া কপাল কুচকে তাকিয়ে থেকে উচ্চারণ করল, “আচ্ছা কি জরুরি বিষয় শুনি?”

মোহনা আন্টি চোখ সরু করে বললেন,”জরুরি বিষয়টা আপনার বোনের বিয়ে নিয়ে। এই বিয়েটা হচ্ছে না। আমি হতে দিচ্ছি না।”

“আমার বোনের বিয়ে আপনি হতে না দেওয়ার কে?”

“আমি কেউ না! কিন্তু আপনি তো ওর বড়ভাই। যদি সত্যিকার অর্থে বড়ভাই হয়ে থাকেন, তাহলে পাত্রের চরিত্র সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর নিজেই বিয়েটা ভেঙে দিতে চাইবেন।”

ভাইয়া চরম বিরক্তি আর বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা তাই নাকি?”

” যেই ছেলের সাথে আপনার বোনের বিয়ে দিবেন বলে ঠিক করেছেন, সে একটা অসভ্য, ইতর, বেলেল্লা, চরিত্রহীন, মেয়েদেরকে ইভটিজিং করে, অসম্মান করে, ভীড় জমানো জায়গায় মেয়েদের সাথে অসভ্যতা করার সুযোগও এক চুল ছাড় দেয় না। ফালতু, টাউট, ফ্যামিলির কোনো শিক্ষা-দীক্ষা বলতে কিচ্ছু নেই। বংশ পরিচয়টা তো আচরণের সাথেই পাওয়া যায়। এই ছেলের আচরণগত কোনো বৈশিষ্ট্যই নেই। ছি ছি ছি!”

মোহনা আন্টি মন্তব্য শেষ করলেন প্রবল ক্রোধ নিয়ে। আমি দেয়াল চেপে ধরে মোহনা আন্টির কথা শুনছিলাম। পেছন থেকে ঈশান আমায় ধাক্কা দিয়ে বলল,” মম কি এসব আমাকে বলছে?”

আমি ঘুরে তাকালাম৷কোমরে হাত গুজে বললাম, ” তো আর কাকে বলবে?”

ঈশান বিস্ময় নিয়ে বলল,” কিন্তু আমি এসব কখন করলাম?”

আমি মুখস্তের মতো অনন্ত জলিলের সংলাপ উচ্চারণ করলাম,” একটা মিথ্যা করলে সেটা অনেএএক মিথ্যা করলে সেই মিথ্যাটা আরও বেশি মিথ্যায় পরিণত হয়ে আরও বেশি মিথ্যা দিয়ে সেই মিথ্যাটা মিথ্যাই থেকে যায়।”

ঈশান ভ্যাবাচেকা খাওয়া কণ্ঠে বলল,” মানে?”

আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,” মোহনা আন্টি একটু বাড়িয়ে এসব বলছেন। যাতে আমার বিয়েটা ভেঙে যায়।”

ঈশান চিন্তিত হয়ে উচ্চারণ করল,” হোয়াট রাবিশ!

ঈশানের থেকেও দ্বিগুন শব্দে ওদিকে তখন ভাইয়া উচ্চারণ করছিল,” হোয়াট ননসেন্স! আপনি কি আমাদের ঈশান সম্পর্কে বলছেন? আমাদের ঈশান? যাকে আমি আমার ভাই বানিয়েছি? যে কিছুক্ষণ পর আমার বোনের স্বামী হবে?”

মোহনা আন্টি আঙুল দিয়ে ইশারা করে বললেন,” এক্সাক্টলি!”

ভাইয়া নাক-মুখ ফুলিয়ে বলল,” দেখুন ম্যাডাম আপনি এইমাত্র যা কিছু বললেন সেগুলো আপনার একমাত্র ছেলের গুণ। আমার ভাইয়ের না। সে একজন সৎ, দায়িত্ববান, নিষ্ঠাবান। আপনার ছেলের মতো লাফাঙ্গার না। সবাইকে নিজের গোয়ালের গরু ভাববেন না।”

এই কথা শুনে আমি বিষম খেলাম। ঘুরে-ফিরে সেই একই তো হলো। ভাইয়াও ঈশানকে বকছে, আন্টিও ঈশানকেই বকছেন। আবার দু’জনেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছে।

মোহনা আন্টি বললেন, “আমার ছেলে লাফাঙ্গার? তুমি আমার ছেলের বিষয়ে কতটুকু জানো? ”

ভাইয়াও আঙুল তুলে একই প্রশ্ন করল,”আপনি আমার ভাইয়ের বিষয়ে কতটুকু জানেন?”

মোহনা আন্টি দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন,”আমি জানি বলেই তো বলছি! নিজের কানে শুনেছি তোমার পছন্দের পাত্রের সব গুণগান।”

“আমিও নিজের কানেই শুনেছি আপনার ভদ্র ছেলের গুণগান।”

“কি শুনেছো তুমি আমার ছেলের ব্যাপারে? হলফ করে বলতে পারি সব ভুল শুনেছো। কোনো ধারণাই নেই তোমার আমার ছেলে সম্পর্কে। ”

ভাইয়া মাথা দুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ! সেইম আমিও বলতে পারি। আপনিও ভুল শুনে এসেছেন। আমার ভাই সম্পর্কে আপনারও কোনো ধারণা নেই।”

মোহনা আন্টি তেজ নিয়ে বললেন,”ঠিকাছে তাহলে ডাকো। আসছে না কেন সে? আমি তাকে প্রশ্নগুলো করি!”

” আপনিও আপনার ছেলেকে ডাকুন না! আমারও তো কিছু প্রশ্ন করার আছে!

মোহনা আন্টি তীক্ষ্ণ শব্দে উচ্চারণ করলেন, ” ঈশান! ঈশান!”

ভাইয়াও সমান তালে ডেকে উঠল,” ঈশান, তুমি কোথায়? তারু, ঈশানকে ডেকে আন। মা, ঈশান কোথায়?”

ঈশান এলো না। কিন্তু মা আর বুড়ি ছুটে এলো। করিডোরে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির প্রায় মানুষ জড়ো হয়ে গেল। আমি জানালা থেকে ইশারায় নিহাকে ডাকলাম। নিহা আমাদের হঠাৎ স্টোর-রুমের জানালায় দেখে ভয়ে চিৎকার করতে নিচ্ছিল। আমি ইশারায় ধমক দিতেই সে চুপ হয়ে গেল। আমি নিহাকে কাছে ডাকলাম। নিহা দ্রুত স্টোর-রুমের ভেতরে এলো। ভয়ে ভয়ে ঈশানের দিকে চেয়ে নিহা হুট করেই প্রশ্ন করে বসল”আপনার নিজের নাম মনে আছে তো ঈশান ভাইম মানে কারো ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না যে! তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

আমি নিহার গাল বরাবর থাপ্পড় দিলাম। নিহা গালে হাত রেখে কটমট করে বলল, ” আরে, মারলি কেন? মারলি কেন?”

“সব ভেজাল বাঁধিয়ে এখন মজা নিতে এসেছিস? মারবো না তো কি করবো? তোকে আরো দু’টো থাপ্পর দেওয়া উচিৎ। ”

নিহা জীভ কেটে হাসতে লাগল। আমিও হেসে ফেললাম। এতো বিপদের মাঝেও কেন হাসি পাচ্ছে? ঈশানের দিকে চাইতেই দেখলাম সেও গজদন্ত বের করে হাসছে।

ওদিকে গলা ফাটিয়ে ঝগড়া চলছে ভাইয়া আর মোহনা আন্টির মাঝে৷ আমরা তিনজন স্টোর- রুমের থেকেই উঁকিঝুঁকি মারছি।

ভাইয়া মায়ের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল,” ঈশানকে দেখেছো?”

“না.. সকাল থেকে তো দেখলাম না। ”

ভাইয়া বুড়ির দিকে তাকাল, “দাদী তুমি দেখেছো?”

“আমি কইত্তে দেহুম? ঘুমেত্তুন উটলামই কতখান আগে। আর উইটটাই শুনি তোগো চিক্কুর চেচামেচি। কিয়ের কেচাল লাগসে মাষ্টররে লইয়া? এই বেডি কিতা কয়?”

মোহনা আন্টি রাগে অগ্নিশর্মা রুপ নিয়ে রুবা আন্টির দিকে এগিয়ে গেলেন, “আপা, ঈশানকে দেখেছো?”

রুবা আন্টি উত্তরে বললেন, “হ্যাঁ… সকালে দেখেছিলাম। ব্রেকফাস্টের সময় এসেছিল। তারপর তো আর দেখিনি। ”

মোহনা আন্টি সাফিন ভাইয়ার দিকে তাকালেন। সাফিন ভাইয়া বিহ্বল হাসি নিয়ে বললেন,”হঠাৎ ঈশানকে এতো খোঁজাখোঁজি কেন?”

মোহনা আন্টি ধমক দিয়ে বললেন,” সেটা তোমার জানতে হবে না। আগে বলো, ঈশান কোথায় আছে জানো কি-না!”

তারিফ ভাইয়া ভাবলেশহীন ভাবে উচ্চারণ করলেন,
“ছেলেটা গেলো কই? এতো ডাকাডাকির পরেও আসছে না কেনো?”

আমার হঠাৎ করেই মাথায় চিন্তা ভর করল। আচ্ছা, ফাহিম ভাইয়া এখন কোথায়? সে যদি করিডোরে চলে আসে তাহলে তো আরেক বিপদ। বেচারা এবারও ফাঁসবে।

ওদিকে মোহনা আন্টি গর্জন করে বললেন, “আসবে কিভাবে? এখন তো ধরা পড়ার সময় হয়েছে। তাই আসবে না। ছেলেটা হয়তো তার কু-কীর্তির পর্দা ফাঁস হওয়ার খবর পেয়ে গেছে। আর সেই ভয়েই পালিয়েছে। পার্টির দিনও এমন হয়েছিল। ধরা পড়ার ভয়ে পালিয়ে গেছিল। এই ছেলে ভীষণ চতুর। গভীর জলের মাছ। ”

ভাইয়া রেগে বলল, “এইযে দেখুন, আপনি কিন্তু এবার বেশি বেশি বলছেন। পালাবে কেনো? পালানোর মতো কি এমন করেছে সে? বরং আমি তো বলবো আপনার ছেলে পালিয়েছে। মুখোশ খুলে যাওয়ার ভয়ে।”

“আমার ছেলে পালিয়েছে? আচ্ছা পালালে পালিয়েছে।ভালো কথা। দিনশেষে তো তাকে বাড়ি ফিরতেই হবে। কিন্তু আপনার ওই ধোঁকাবাজ প্রিয়পাত্র আর জীবনেও ফিরবে না। যদি ফিরেও আসে তাহলে আমি তাকে ভাড়া করা গ্যাং দিয়ে এমন টাইড দিবো.. তারিনের ‘ত’ টা পর্যন্ত ভুলে যাবে। জীবনে কোনোদিন তারিনের নাম মুখে আনার আগেও আমার কথা হাজারবার চিন্তা করবে। ”

ভাইয়া ভয়ানক ভারী গলায় আওয়াজ করল,”এক্সকিউজ মি, কি বললেন আপনি? ভাড়া করা গ্যাং? গুন্ডা? আপনি আমার ভাইকে গুন্ডা দিয়ে মার খাওয়াবেন? আর আপনার ছেলে যেই কাজ করেছে, আমরা যে এখনও ওর নামে মামলা তুলে বাড়িতে পুলিশ আনিনি এইটাই আপনাদের মা-ছেলের গুডলাক। আসলে কি বলুন তো? আপনার লাফাঙ্গার ছেলেকে রিজেক্ট করে একটা সাধারণ মধ্যবিত্ত ছেলের সাথে বোনের বিয়ে দিচ্ছি তো! এইটাই আপনার ইগো তে লাগছে। আর তাই ইনোসেন্ট ছেলেটার নামে এসব বাজে ব্লেম দিয়ে বিয়েটা আটকাতে চাইছেন। কোনো লাভ হবে না। ”

মোহনা আন্টি কিছু বলতে নিলে ভাইয়া হাত উঠিয়ে বাঁধা দিয়ে আরও বলল, “আমার বোনের বিয়ে হবেই। আমি যার সাথে চাইবো তার সাথেই হবে।কেউ বিয়ে আটকাতে পারবে না।”

মোহনা আন্টি বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে পড়লেন, ” আপনি তো আচ্ছা ঘাড়ত্যাড়া মানুষ! এতো করে বুঝাচ্ছি তাও বুঝতে পারছেন না? আরে মেয়েটার লাইফটা নষ্ট হয়ে যাবে তো!”

“নষ্ট হোক। আমার বোনের লাইফ নষ্ট হবে তাতে আপনার কি?”

“আমি একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের লাইফ নষ্ট হয়ে যাওয়া দেখতে পারব না। সবকিছু জেনেও হাত গুটিয়ে বসে থাকবো না। কখনোই না। তারিনের বিয়ে আমি হতে দিবো না, দিবো না, দিবো না!”

ভাইয়া দ্বিগুণ জেদ নিয়ে বলল, “আমার বোনের বিয়ে আমি দিয়েই ছাড়ব, দিয়েই ছাড়ব, দিয়েই ছাড়ব। কি করবেন?”

মোহনা আন্টি কটমট করে তাকিয়ে রইলেন। রাগে তার গা কাঁপছে। ভাইয়ার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এসেছে। বিপরীত লিঙ্গ না হলে এই দুইজন এতোক্ষণে মারা-মারি শুরু করে দিতো। এমনটাই মনে হচ্ছে আমার। মা ভাইয়ার হাত টেনে ধরে বললে,
“তারিফ, বাদ দে এসব। যে যা খুশি বলুক। আমরা তো ঈশানকে চিনি। সে কেমন আমরা ভালো করেই জানি। অন্যকারো বলায় কি এসে যায়?”

ভাইয়া হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রোষপূর্ণ গলায় বলল, ” কিন্তু আমার সামনে ঈশানকে রীতিমতো কেউ ইনসাল্ট করবে এটা আমি কেন মেনে নিব?আমি কোনো প্রতিবাদ করব না? ”

সাফিন ভাইয়া হঠাৎ মাথা চুলকে বললেন,” আচ্ছা, ঈশানকে একটা ফোন করে জেনে নিলেই তো হয়। যে সে কোথায় আছে। প্রবলেম সোলভড!”

এই কথা বলেই তুরি বাজিয়ে হাসলেন সাফিন ভাইয়া।

আমি কপালে হাত রেখে নিহার উদ্দেশ্যে বললাম,” বাহ, কি মাস্টার আইডিয়া দিল তোর হাসব্যান্ড। তার গলায় এখনি গোল্ড মেডেল ঝুলিয়ে দেওয়া উচিৎ। ”

নিহা বাঁকা চোখে চেয়ে বলল,”খবরদার, আমার ইনোসেন্ট হাসব্যান্ডকে নিয়ে একদম ফান করবি না।”

আমি ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললাম,” তোরা দুটোই এক। অর্ধেক ঝামেলা তো তুই বাঁধিয়েছিস। এবার দ্যাখ, বাকি ঝামেলা সাফিন ভাই বাঁধাবে। তোদের বর-বউয়ের এই অতি বুদ্ধির কারণে আমার আর ঈশানের জীবন ফানা ফানা। ”

“আচ্ছা এখন সাফিনের জন্য তোদের কি প্রবলেম হবে? ঈশান ভাইয়া ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখলেই তো হয়।”

আমি নিহার মাথায় গাট্টা মারলাম। তারপর বললাম,” গাঁধীরে, দু’জন মিলে যদি এক নাম্বারেই ফোন দেয় তাহলে লাগবে না ক্যাঁচাল?”

নিহা আৎকে উঠ্র বলল,” ওহ, তাইতো! কিন্তু এটা সাফিনের দোষ। আমি কি কিছু করেছি বল?”

“না। তুই তো কিছুই করিস নি। অথচ তোর জন্যই সব হচ্ছে। ”

“আমার জন্য সব হচ্ছে? তোর বুঝি কোনো দোষ নেই? তোরা মিথ্যা বলেছিস কেনো?”

“সেটাও তো তোদের জন্যই বলেছি। সব সমস্যার গোড়া আসলে তুই আর সাফিন ভাই।তোরা এ্যাংগেজমেন্ট করতে গেলি কেন? বিয়েটাই বা কেন করলি? তোদের বিয়ের জন্য এখন আমাদের বিয়ে হচ্ছে না।”

“ও হ্যালো, হ্যালো! আমাদের বিয়ে না হলে তোদের প্রেমটাও হতো না। সেলফিশের মতো এই জিনিসটা ভুলে যাস না।”

ঈশান ধমক দিয়ে বললেন,” প্লিজ চুপ করো তোমরা। এখন কি তোমরাও ঝগড়া শুরু করে দিলে নাকি?”

নিহা থতমত খেয়ে বলল,” স্যরি ঈশান ভাইয়া।”
আমিও মুখে হাত দিয়ে চুপ হয়ে গেলাম।

ঈশান আমার হাত টেনে ধরে বলল,” চলো।”

আমি চোখ গোল বানিয়ে প্রশ্ন করলাম,” কোথায়?”

” বাইরে।”

আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বললাম,” সত্যি যাবেন?”

ঈশান আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,” আমরা কোনো ভুল করিনি। শুধু বিভিন্ন ভাবে মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে। যদি সবাইকে বুঝিয়ে বলতে পারি তাহলে পুরো প্রবলেম ইজিলি সোলভ হয়ে যাবে। শুধু শুধু ভয় পেয়ে কি লাভ? ঝামেলা কন্টিনিউয়াসলি বেড়ে যাচ্ছে। আর দেরি করা উচিৎ নয় তারিন।”

আমি ভীত স্বরে বললাম,” যদি ওরা আমাদের ব্যাখ্যা না শুনেই ভুল বুঝে আমাদের আলাদা করে দেয়?”

” তুমি এতো কেন ভাবছ? আগে তো আমরা সত্যিটা বলি, তারপর দেখা যাবে। ”

আমি ছলছল দৃষ্টিতে বললাম,” কিন্তু আমি এতটুকু রিস্ক নিতে চাই না। ঈশান, আলাদা হওয়ার কষ্ট আমি কোনোভাবেই মানতে পারব না।”

ঈশান হালকা নিচু হয়ে আমার গালে হাত রেখে বলল,” আমার উপর বিশ্বাস নেই তোমার?”

” আছে তো। কিন্তু ভাগ্যের উপর বিশ্বাস নেই। ভাইয়ার উপরেও বিশ্বাস নেই।”

ঈশান আমাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বলল,” শোনো, যদি আমরা নিজেরা নিজেদের কাছে নির্দোষ থাকি তাহলে পৃথিবীর কেউ আমাদের দোষী বানাতে পারবে না। আমরা জানি, আমরা কোনো অন্যায় করিনি। তাহলে শাস্তি কেন পাব? তোমার ভাইয়া যদি জোর করে আমার থেকে তোমাকে আলাদা করতে চায় তাহলে আমি যুদ্ধ করে হলেও তোমাকে ছিনিয়ে আনব। কথা দিচ্ছি, কখনও একা ছাড়ব না তোমাকে।”

ঈশানের কথায় আমার নিশ্বাস অনেকটা হালকা হয়ে এলো। আমি মৃদু হেসে বললাম,” যদি সত্যি তাই হয়, তাহলে আমারও কোনো ভয় নেই। আপনি শুধু আমার হাত ছাড়বেন না।”

ঈশান আমার ডানহাতের আঙুলের ভাজে নিজের আঙুল পুরে শক্তভাবে ধরল। তারপর হাতের উল্টোপিঠে চুমু দিয়ে বলল,” কখনও ছাড়ব না।”

নিহা হাতে তালি বাজিয়ে বলে উঠল,” সো সুইট! তোরা কি সত্যি সব কনফেস করতে যাচ্ছিস? আই এম ভেরি এক্সাইটেড!”

আমি আর ঈশান একে-অপরের দিকে চেয়ে হাসলাম৷ এখন আর একদম ভয় করছে না আমার। কারণ ঈশানের প্রতি আমি তখন সম্পূর্ণ ভরসা করতে শুরু করে দিয়েছি।

চলবে

#তি_আমো
পর্ব ৩০
লিখা- Sidratul Muntaz

মোহনা আন্টি আর ভাইয়া একই সাথে ঈশানকে ফোন করছে৷ দু’জন অবিরত এক নাম্বারে চেষ্টা করার পর মোহনা আন্টি বললেন,” নেটওয়ার্ক বিজি দেখাচ্ছে। ঈশান কোথায়?”

তারিফ ভাইয়া শুকনো মুখে বলল,” এখানেও নেটওয়ার্ক বিজি। ওরা দু’জন কি তাহলে এক জায়গায় আছে?”

মোহনা আন্টি গলা উঁচু করে বললেন,” ওই বদমাইশ আমার ছেলেকে কোথাও নিয়ে যায়নি তো আবার?”

ভাইয়া আঁড়চোখে তাকিয়ে বলল,” আমার ভাইয়ের যদি কিছু হয় আমি কিন্তু আপনার ছেলেকে ছাড়ব না।”

মোহনা আন্টি চোয়াল শক্ত করলেন। দুশ্চিন্তা এবং রাগের সংমিশ্রণে তার চেহারা লাল হয়ে উঠেছে। গজগজ করে বললেন,” ওই বদমাইশের কথা জানিনা।কিন্তু আমার ছেলের গায়ে যদি কোনো ফ্লিপ টেপও লাগে তাহলে খবর আছে।”

ভাইয়া হঠাৎ বেশি চটে গিয়ে বলল,” বার-বার বদমাইশ কাকে বলছেন আপনি? আপনার নিজের ছেলে বদমাইশ। এক নম্বরের বদ।”

মোহনা আন্টি জবাব দিলেন চিবিয়ে চিবিয়ে,”আমার ছেলে বদ? শুনুন, আমার ছেলে যথেষ্ট ভালো। কাকে জিজ্ঞেস করবেন আমার ছেলের চরিত্র সম্পর্কে? এইযে রুবা আপা আছেন, সাফিন আছে, ওদের জিজ্ঞেস করুন। কি আপা? বলেন?”

রুবা আন্টি সম্মতি জানাতে দ্রুত মাথা নাড়লেন,” হ্যাঁ তো। ঈশানকে ছোটবেলা থেকে চিনি না? কত ভালো একটা ছেলে!”

সাফিন ভাইয়া অতি প্রশংসা করতে গিয়ে বললেন,” ঈশানের মতো ভালো ছেলে হয় নাকি? ও তো কোনো সাধারণ ছেলেই না.. হি ইজ এঞ্জেল!”

মোহনা আন্টি আড়চোখে তাকাতেই সাফিন ভাইয়ের মুখ কাঁচুমাচু হয়ে গেল। মোহনা আন্টি কঠিনভাবে বললেন, “এঞ্জেল মেয়েদের বলা হয়।”

সাফিন ভাইয়া হতভম্ব হলেন। বিড়বিড় করে বললেন, “ও আচ্ছা। তাহলে বাংলায় বলি, ফেরেশতা। এইবার ঠিকাছে মেইবি।”

তারিফ ভাইয়া সাথে সাথে গর্বের সহিত বুক ফুলিয়ে বলল,” ফেরেশতা তো হচ্ছে আমার ভাই। আমরা যখন সবচেয়ে বিপদে ছিলাম তখন সে ফেরেশতার মতো আমাদের সাহায্য করেছে। কাল আমার বোনের সাথে ফেরেশতার মতো ছিল। সে একদম ফেরেশতার মতোই ভালো মানুষ। ”

সাফিন ভাইয়া মুখ কালো করে বললেন, ” কিন্তু ফেরেশতা মানুষ হয় না।”

তারিফ ভাই বিরক্ত হয়ে তাকালেন। ঝারি দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ জানি। কিন্তু মানুষ তো ফেরেশতা হয়।”

সাফিন ভাই মাথা নাড়লেন। মোহনা আন্টি টিটকিরি মারতে বললেন,” কিছু কিছু মানুষ আবার শয়তানও হয়।”

ভাইয়ার চোখ দিয়ে আবার আগুনের হলকা ছুটে গেল।এতোক্ষণে বুড়ি সামনে এগিয়ে এসে মোহনা আন্টিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ” শুনো মাইয়া, একখান কতা কই। আমি তুমার মুরব্বি। জীবনের অবিজ্ঞতা তুমার থেকা বেশি হইছে আমার। এইযে দেহো আমার মাথার সব চুল কলাম সাদা৷ তুমার মাথার চুল আবার সব রঙ্গিন। এইত্তুন বুঝোনই যায় কার মানুষ চেনার খেমতা বেশি।”

মোহনা আন্টি এক ভ্রু বাঁকা করে বললেন, ” চুলের রং দিয়ে মানুষ চেনার ক্ষমতা পরিমাপ করা হয় নাকি?”

বুড়ি হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল, “যার নামে তুমি এতো কতা কইতাছো, হেরে কি তুমি দেখছো?”

“দেখা দিলেই না দেখবো! দেখাই তো দিচ্ছে না আপনাদের পাত্র।চোরের মতো পালিয়ে গেছে। আমি নিশ্চিত ছেলেরা চোরের বংশ। ”

ভাইয়া আঙুল উঠিয়ে কিছু বলতে এলেই বুড়ি বাঁধা দিয়ে সরাল,” যা, আমি কতা কইতাছি না?”

তারপর বুড়ি মোহনা আন্টির দিকে চেয়ে নরমভাবে বলল, “শুনো, আগে আমার কতাখান শুইন্না লও। মানুষরে না দেইখা, না জাইনা বিচার করোন ঠিক না। এইযে এতোকিছু মাষ্টরের নামে কইতাছো, তারে যদি একবার নিজে চক্ষে দেখতা তুমার দারনাডাই কলাম বদলায় যাইতো। আমগো মতো তুমিও হেরে সোজা মনে ভরসা কইরালাইতা।”

“কেনো? ছেলে কি জাদু টোনা জানে? এখন বুঝতে পারছি, আপনাদের সবাইকে বশ করে ফেলেছে। এজন্যই তারিনকে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন। কি যেন বলে? ব্ল্যাক ম্যাজিক!”

ভাইয়া রেগে-মেগে বলল,” অনেক সহ্য করেছি। আর না।”

এই কথা বলেই সে তেড়ে আসতে চাইল মোহনা আন্টির দিকে। মা আর সাফিন ভাই আমার ভাইয়াকে দ্রুত থামাল। আমি আর ঈশান তাদের সামনে যাওয়ার জন্য হাত ধরে যখনি বের হয়েছি তখনি ফাহিম ভাই করিডোরে উপস্থিত হলো। সে হুট করে কিভাবে টপকাল সেটা আমরা কেউই আগে বুঝতে পারলাম না। নিহা তড়িঘড়ি করে আমাকে আর ঈশানকে আবার ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। আমি বিরক্ত গলায় বললাম,” কি করছিস তুই?”

নিহা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল,” ঈশান ভাইয়া এখন গেলেই তো ধরা পড়ে যাবে।”

আমি দাঁতে দাঁত পিষে বললাম,” আমরা তো ধরা দিতেই যাচ্ছি গাঁধী।”

নিহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,” ও আচ্ছা। সেটাই তো! ওকে যা। বেস্ট অফ লাক। ”

আমরা বের হতে নিলেই নিহা আবার বলল,” দাঁড়া, দাঁড়া।”

তারপর সে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় শুরু করল। আমি অধৈর্য্য হয়ে বললাম,” করছিসটা কি তুই?”

” আয়তুল কুরছি পড়ি।”

আমি ঈশানের দিকে চেয়ে বললাম,” দেখুন তো, আমরা কি জ্বীনের কাছে যাচ্ছি?”

ঈশান হেসে বলল,” আচ্ছা দাঁড়াও, আয়তুল কুরছি বিপদের সময়ও পড়তে হয়৷ তাছাড়া এখন পরিবেশ অনেকটাই গরম। একটু ঠান্ডা হলে তারপর যাই। সমস্যা কি?”

নিহা চোখ মেলে বলল,” আমার কাছে একটা আইডিয়া আছে।”

আমি জানতে চাইলাম,” কি আইডিয়া?”

” শোন, তোদের এখন ওদিকে যাওয়ার দরকার নেই। কারণ ওরা দুইজন যেভাবে ঝগড়া করছে, তোরা সামনে গিয়ে দাঁড়ালে ঝগড়া আরও বেড়ে যাবে। বিস্ফোরণ শুরু হবে। তোর ভাই যদি হয় আগুন তাহলে মোহনা আন্টি বারুদ। এই দু’জনকে একসঙ্গে রেখে কিচ্ছু করা সম্ভব নয়। এর চেয়ে ভালো ঝগড়া থামুক। দুইজন যখন আলাদা থাকবে তখন তোরাও আলাদা গিয়ে সবকিছু বুঝিয়ে বলবি।”

আমি নিহার সাথে একমত হতে পারলাম না। তবে ঈশান মাথা নেড়ে বলল,” দ্যাটস আ গুড আইডিয়া।”

আমি মৃদু প্রতিবাদ করলাম,” ভাইয়ার সামনে একা দাঁড়াতে আমার ভয় লাগবে। ঈশান থাকলে আমি সাহস পাব। তাই একসঙ্গে যাওয়াই ভালো। ”

নিহা তখন চুটকি বাজিয়ে বলল,” আরও ভালো প্ল্যান আছে আমার কাছে। তারু, তুই যাবি মোহনা আন্টির কাছে। মোহনা আন্টিকে তুই সব বুঝিয়ে বলবি। তাহলে তোর আর ভয় লাগবে না। এদিকে ঈশান ভাই যাবে তারিফ ভাইয়ের কাছে। আর তারিফ ভাই তো এখন ঈশানের সব কথা মানে। তাই ঈশানের ব্যাখ্যাটাও মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং বুঝবে!”

আমার এই বুদ্ধিটা খুবই পছন্দ হলো। পুনরায় নিহার মাথায় গাট্টা মেরে বললাম,” গাঁধী একটা। এতো ভালো বুদ্ধি আগে দিলি না কেন?

ফাহিম ভাইকে দেখে ভাইয়া তখন তড়াক করে বলে উঠেছে,” এইতো, পাপী বান্দা হাজির।”

মোহনা আন্টি ভ্রু কুচকে ফাহিম ভাইয়ের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন,” ঈশানকে দেখেছ ফাহিম?”

ফাহিম ভাইয়া ভীতদৃষ্টিতে ভাইয়ার দিকে চেয়ে বলল,” না তো। আমি ঈশানকে চিনি না।”

এই কথা বলে সে পালিয়ে যেতে চাইল। ভাইয়া সঙ্গে সঙ্গে তার উপর সাড়াশি আ/*ক্রমণ করল। তার কলার চেপে ধরে বলল,” এক মিনিট, তোমার মা অনেকক্ষণ ধরে আমার সাথে তর্ক করে যাচ্ছে। মাথা-টাথা একদম গরম হয়ে গেছে। খবরদার জায়গা থেকে নড়বে না। চুপচাপ এখানে দাঁড়াও। আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করব।”

ফাহিম ভাইয়ের চেহারার অবস্থা দেখলে মনে হবে এক্ষণি কেঁদে ফেলল। ভাইয়া রক্তবর্ণ দৃষ্টিতে বলল,” পার্টিতে যে আমার বোনের সাথে অসভ্যতা করেছিল সে কে?”

ফাহিম ভাইয়া মোহনা আন্টির দিকে তাকাল। মোহনা আন্টি হাত ভাজ করে বললেন,” সত্যিটা বলে দাও ফাহিম।”

ফাহিম ভাইয়া কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,” ঈশান।”

ভাইয়া রাগে ফাহিম ভাইয়ের কাঁধ আরও শক্ত করে চেপে ধরল। মোহনা আন্টি ফটাফট বললেন,” কোন ঈশান? পুরো নাম বলো।”

ভাইয়া হিমশীতল দৃষ্টিতে হুমকি দিল,” মিথ্যা বললে কিন্তু একদম পুঁতে ফেলব।”

ফাহিম ভাইয়া গ্যাঁরাকলে ফেঁসে গেল যেন। চোখ বন্ধ করে বলে উঠল,” পুরো নাম, ঈশান আক্তার ফাহিম।”

তার এমন উত্তরে আমরা সবাই হোচট খেলাম। এতো বুদ্ধু কেউ হয়? ‘ আক্তার’ শব্দটা তো মেয়েদের নামে থাকে। ভাইয়া ফটাশ করে ফাহিম ভাইয়ের গাল চড় দিয়ে বলল,” মশকরা হচ্ছে?”

ফাহিম ভাইয়ের পুরো শরীর কাঁপছে তখন। তড়িঘড়ি করে বলল,” আমি কিছু জানি না৷ আমি কিছু জানি না।”

মোহনা আন্টি অবাক হয়ে বললেন,” ফাহিম তুমি এমন করছ কেন? ভয় পাওয়ার কি আছে? সত্যি বলতে আবার কিসের ভয়? এই বাজে লোক তোমার কিচ্ছু করতে পারবে না। আমি আছি তোমার পাশে।”

তারিফ ভাই বিদ্রূপ করে বলল,” যাও বাবু, মায়ের আঁচলের তলায় লুকাও। এভাবেই ছেলের অন্যায়কে প্রটেস্ট করে যাবেন।”

মোহনা আন্টি বিরক্তি নিয়ে বললেন,” ফাহিম আমার ছেলে না। ও আমার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে।”

ভাইয়া হাত তালি বাজিয়ে বলল,” দারুণ! নিজের ছেলেকে এখন ধরা পড়ার ভয়ে ভাইয়ের ছেলে বানিয়ে দিলেন? ছি, আপনার মতো মা শত্রুরও না থাকুক।”

মোহনা আন্টি আক্রোশ নিয়ে বললেন,” আপনার সমস্যাটা কি? এতো ফালতু কথা বলছেন কেন? আমার ছেলের নাম ঈশান৷”

ফাহিম ভাই চিৎকার করে বলল,” আমি ঈশান না। আমি ঈশান না। আমি ফাহিমও না।”

এই কথা বলতে বলতে সে দৌড়ে পালালো। তারিফ ভাই ফোড়ন কাটল,” মা যদি হয় সিংহী, ছেলে তাহলে বেড়াল। এই ভীতু ছেলেকে নিয়েই এতো অহংকার করেন?”

মোহনা আন্টি ভাইয়ার প্রশ্নের কোনো উত্তরও দিলেন না। মনে হয় তিনি ধৈর্য্য হারিয়েছেন। ভাইয়া ফোন বের করে বলল,” আপনার মোবাইল নাম্বার দিন।”

মোহনা আন্টি বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,” কেন?”

” ঈশানকে পেলে আপনাকে ফোন করব।”

মোহনা আন্টি হাত পেতে বললেন,” আপনার মোবাইল দিন। আমি লিখে দিচ্ছি।”

ভাইয়া মোবাইল বের করে মোহনা আন্টির হাতে দিল। মোহনা আন্টি নাম্বার টাইপ করতে লাগলেন। ভাইয়াও ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে তখন। তারপর কি হলো আমরা কিছুই জানি না। ঝগড়াটা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম৷ পরিবেশ এখন বরফের মতো ঠান্ডা। আমি চলে গেলাম মোহনা আন্টির কাছে। সবকিছু স্বীকার করে নিতে। আর ঈশান চলে গেল ভাইয়ার কাছে।

মোহনা আন্টি মাথায় হাত রেখে বিছানার সাথে হেলে বসে ছিলেন। আমি আড়ষ্ট কণ্ঠে ডাকলাম,” আন্টি।”

মোহনা আন্টি নিথর। কোনো কথা বলছেন না। ঝগড়া করে কি বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন? আমি আবার ডাকলাম,” আন্টি।”

মোহনা আন্টি চট করে চোখে হাত দিয়ে বললেন,” কে তারিন? বসো।”

আমি কিছুটা বিভ্রান্ত হলাম। ভাইয়া আর মোহনা আন্টিকে হয়তো আমরা অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। মনে মনে অপরাধবোধ তৈরী হলো। আর দেরি নয়, এখনি সব সত্যি বলে ক্ষমা চাইব। আমি উশখুশ করে বলে ফেললাম,” একটা কথা বলি আন্টি?”

” বলো।” মোহনা আন্টির নিস্তরঙ্গ উত্তর। তিনি আমার সাথে এতো ভালো করে কথা বলেন। কিন্তু আজ কেন এমন করছেন? সব কি বুঝে ফেলেছেন? এমন হওয়া অসম্ভব কিছু না। একটু বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করলেই পুরো বিষয়টা বুঝে নেওয়া যায়। এই ভেবে আমার বুক কাঁপতে লাগল। গলা শুকিয়ে গেল। ঢোক গিলে বললাম,” অনেক জরুরী কথা।”

মোহনা আন্টি আগের মতোই বিরস মুখে উত্তর দিলেন,” বলো, শুনছি।”

আমি চোখ বন্ধ করে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে বিস্তারিত সবকিছু বুঝিয়ে বললাম। মোহনা আন্টি শুধু শুনেই গেলেন। একবারও আমার কথার মাঝে প্রশ্ন করলেন না। তাই আমার বলতে সুবিধা হলো। আমি কিছুই বাদ রাখলাম না। সবটা গুছিয়ে বললাম। তারপর অনুতপ্ত কণ্ঠে ক্ষমা চেয়ে বললাম,” আমাদের মাফ করে দিন না, আন্টি। আর কখনও মিথ্যা বলব না। কথা দিচ্ছি। আপনাদের কাছে আর কখনও কিছু লুকাব না। ভুল হয়ে গেছে।”

মোহনা আন্টি নাক টেনে মৃদু হেসে বললেন,” আচ্ছা।”

আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, হাসিটা মোহনা আন্টির চোখ অবধি পৌঁছালো না। তিনি জোর করে হাসছেন। আমি বিব্রত হয়ে বললাম,” আপনি কি আমার সব কথা শুনেছেন আন্টি? বুঝেছেন আমি কি বলেছি?”

” হ্যাঁ বুঝেছি।”

” আপনি একটুও রেগে নেই।”

মোহনা আন্টি অতি সহজভাবে বললেন,” একদমই না। এখানে তোমাদের দোষ নেই। জীবনে অনেক কিছু ঘটে যায় যার উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। জীবনটা কখনও আমাদের ইশারায় চলে না তারিন। সবসময় সেটাই হয়, যেটা আমরা কখনও চাইনি।”

আমি ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলাম,” এখন কি হবে? আমি আর ঈশান কি এক হতে পারব না?”

মোহনা আন্টি আমার দিকে চাইলেন মায়াভরা দৃষ্টিতে। তার চোখে অশ্রু টলমল। প্রশ্ন করলেন ভারী কণ্ঠে, ” ঈশানকে খুব ভালোবাসো?”

আমার চোখেও অশ্রু চলে এলো। আঙুলের ডগা দিয়ে মুছতে মুছতে বললাম,” হুম।”

মোহনা আন্টি হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” তোমরা সবসময় ভালো থেকো।”

আমি কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি নিয়ে চাইতেই মিষ্টি হাসলেন মোহনা আন্টি। আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। মোহনা আন্টি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তখন। আমি খুব হকচকিয়ে গেলাম।

ঈশানের সাথে দেখা হলো করিডোরেই। কিছুক্ষণ আগেই এখানে দুনিয়া তোলপাড় করা ঝগড়া হচ্ছিল। আর এখন পরিবেশ কত শান্ত, নিশ্চুপ। বাতাসের শা শা শব্দটাও কানে লাগছে। আমি ঈশানের দিকে ধেঁয়ে যেতে যেতে আনন্দিত কণ্ঠে বললাম,” মিশন সাক্সেসফুল। ইয়েস!”

তারপর জড়িয়ে ধরলাম ঈশানকে। আমার পা অনেকটা উঁচুতে উঠে গেল। ঈশান শুকনো গলায় বলল,” এখনি এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই। অর্ধেক কাজ হয়েছে শুধু। ”

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,” মানে? আপনি ভাইয়াকে বলেননি?”

” খুঁজেই তো পেলাম না তোমার ভাইকে। বাড়ি থেকে বের হয়ে কোথায় গেছেন কে জানে!”

” আপনাকে খুঁজতে যায়নি তো আবার?”

” হতেও পারে। ফোন করব একটা? ”

” হ্যাঁ করুন।”

ঈশান ফোন করতে নিয়েও থেমে গেল। আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,” মম কিভাবে এতো ইজিলি মেনে গেল?”

আমি উত্তেজিত গলায় বললাম,” সেটা তো আমিও ভাবছি। উনি আমাকে একটা ধমক পর্যন্ত দেননি। কিছুই বলেননি। আমি অবাক!”

ঈশান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,” আমার মম খুব সুইট। সব মেনে নিবে জানতাম। এখন তোমার খরুস ভাই কি করে সেটাই দেখার বিষয়।”

আমি রাগী গলায় উচ্চারণ করলাম,” আমার ভাইকে খরুস বলবেন না।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here