তি_আমো,৩১,৩২

0
272

#তি_আমো,৩১,৩২

পর্ব ৩১
লিখা- Sidratul Muntaz

চারদিকে বাতাসের শা শা শব্দ এবং পাশাপাশি ঈশানের জোরালো হাসির শব্দ৷ আমি চোখ পাকিয়ে তাকালাম। ঈশান হাসি থামিয়ে বলল,” খরুস না হলে ভাইয়াকে এতো ভয় পাও কেন?”

আমি অবহেলায় অন্যদিকে ঘুরে বললাম,” ভয় পাই না। এটা হলো রেসপেক্ট।”

ঈশান আমার বাহু ধরে সটান তার দিকে ঘুরিয়ে নিল। চোখে চোখ রেখে, মুখের কাছে মুখ এনে বিড়বিড় করে বলল,” রেসপেক্ট তো আমিও করি। কিন্তু তোমার মতো ভয় পাই না তো। আমি খেয়াল করেছি, তোমার ভাইয়ের সাথে কথা বলার সময় তুমি চোখের দিকে তাকাও না। তোমার পা কাঁপে।”

আমি অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে তাকালাম। ঈশান আমার হাত ছেড়ে দিয়ে হাসছে। আমি মাথা নিচু করে বললাম জবাবদিহি করার উদ্দেশ্যে বললাম,” ছোটবেলায় ভাইয়ার সাথে একটা দূর্ঘটনা ঘটেছিল। তখন আমার বয়স মাত্র তিন। আধো আধো শব্দে ভাইয়া ডাকা শিখেছি মাত্র। কিন্তু ভাইয়া কখনও আমাকে আদর করতো না। সবসময় ধমকের উপর রাখতো। সেটাও ওই দূর্ঘটনার জন্যই। ভাইয়ার মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছিল। এখন বয়সের সাথে ভাইয়া কিছুটা নরম হলেও আমার ছোটবেলার সেই ভয়টা রয়েই গেছে। এজন্যই ভাইয়ার সাথে আমি খুব সামলে চলি। আমি চাই না ভাইয়া আবার আগের মতো খিটখিটে হয়ে যাক। কিন্তু যতই রাগী দেখাক, ভাইয়া যে আমাকে মনে মনে খুব ভালোবাসে এই কথা আমি বুঝতে পারি। আমিও আমার ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসি।”

ঈশান আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। কথা শেষ হতেই সে আমার গালে হাত রেখে বলল,” আর আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি, এই কথা বুঝতে পারো?”

তার হঠাৎ এমন প্রশ্নে আমি হেসে ফেললাম। তারপর হাত ভাজ করে লাজুক মুখে বললাম,” ভাইয়াকে ফোন করবেন না? কোথায় আছে ভাইয়া?”

” ভুলেই গেছিলাম।”

আমি প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলায় ঈশানের কণ্ঠ অভিমান জমল। আমি অন্যদিকে চেয়ে মুখ টিপে হাসলাম। ঈশান ভাইয়ার নাম্বারে ডায়াল করল। কিন্তু ভাইয়া ফোন ধরছে না। ঈশান ভারী বিরক্ত হয়ে বলল,” তোমার ভাই ফোন কেটে দিচ্ছে কেন, আজব!”

আমি মুখ মলিন করে বললাম,” আপনাকে খুঁজতে গেলে তো আপনার ফোন কেটে দেওয়ার কথা না, তাই না?”

” সেটাই। তাহলে তোমার ভাই গেল কই?”

আমি কাঁধ ঝাঁকালাম। কিছুই বুঝতে পারছি না। তারপর নিজের ফোন বের করে আবার ভাইয়াকে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করলাম। দুইবার রিং হওয়ার পর ভাইয়া আমার ফোনটা ধরল। আমি তড়িঘড়ি করে ব্যস্ত গলায় বললাম,” হ্যালো ভাইয়া, কোথায় তুমি?”

ওই পাশে অনেক শব্দ তখন। ভাইয়ার আওয়াজ শোনা গেল আবছা আবছা। যতটুকু বুঝলাম, ভাইয়া কোথায় যেন যাচ্ছে। অবশ্যই শহরের বাইরে। কারণ ভাইয়া এই মুহূর্তে বাসস্ট্যান্ডে আছে। আমাকে বলল মা আর বুড়ির খেয়াল রাখতে। ভাইয়া পরে সব জানাবে। আমি প্রশ্ন করলাম,” কিন্তু ভাইয়া, হঠাৎ করে কোথায় যাচ্ছ? কিছুই তো বুঝতে পারলাম না।”

ভাইয়া অবজ্ঞার স্বরে বলল,” তারু আমি রাখছি। পরে সব বুঝিয়ে বলব। এখন আর বিরক্ত করিস না আমাকে। আমি ফোন বন্ধ করে দিলাম।”

ভাইয়া এই কথা বলেই ফোনটা বন্ধ করে দিল। আমি হতবাক দৃষ্টিতে ঈশানের দিকে চাইলাম৷ ঈশান গুমোট কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” কি ব্যাপার তারিন? এনিথিং রং?”

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,” এভরিথিং ইজ রং!”

ঈশান কাঁচুমাচু হয়ে বলল,” মানে?”

আমি নখে কামড় দিয়ে দ্রুত এপাশ-ওপাশ হাঁটতে লাগলাম। ঈশান আমার হাত ধরে টেনে দাঁড় করাল। প্রশ্ন করল কঠিন গলায়, ” তারিন আমাকে বলো কি হয়েছে? ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিও না।”

তখন আমি নিজেই মরে যাচ্ছি দুশ্চিন্তায়। উপায়ন্তর খুঁজে না পেয়ে বললাম,” আমাদের এখন বাসস্ট্যান্ডে যেতে হবে।”

” কোন বাসস্ট্যান্ড?”

আমি দ্রুত কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম,” এখানে আশেপাশে কি কোনো বাসস্ট্যান্ড নেই?”

” তোমার ভাইয়া কি বাসস্ট্যান্ডে আছে? কোথায় যাচ্ছে?”

আমি দিশেহারার মতো উত্তর দিলাম,” সেটা জানার জন্যই তো বাসস্ট্যান্ড যেতে হবে!”

” তাহলে এসো।”

এই কথা বলেই ঈশান আমার হাত চেপে ধরে বাতাসের গতিতে ছুটতে লাগল। আমিই ভয় পেয়ে বললাম,” আরে, আস্তে চলুন।”

বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে আমি আর ঈশান এদিক-ওদিক দৌড়ে ভাইয়াকে খুঁজছিলাম। ঈশান দক্ষিণে খুঁজলে আমি উত্তরে খুঁজি। ঈশান ডানে খুঁজলে আমি বামে৷ এভাবে একসময় ভাইয়াকে আমরা দু’জনই দেখে ফেললাম। একটি বাস কাউন্টারের ওয়েটিংরুমে বসে আছে। আমরা একসাথে ভাইয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের দেখে ভাইয়া খুব চমকে উঠে বলল,” আরে, তোমরা এখানে কেন এসেছ?”

ঈশান ভাইয়ার পাশে বসতে বসতে বলল,” ভাইয়া, আপনি কোথায় চলে যাচ্ছেন আমাদের ছেড়ে?”

ভাইয়া হেসে ফেলে বলল,” আরে, আমি তোমাদের ছেড়ে যাবো কেন? আমি যাচ্ছি আমার কাজে। খুব জরুরী কাজ৷ তোমাদের এখানে আসার কোনো দরকার ছিল না। যাও, বাড়ি যাও৷ তারুকে নিয়ে যাও।”

আমি হতভম্ব গলায় বললাম,” তোমার হঠাৎ কি এমন কাজ পড়ল যে এভাবে চলে যেতে হবে?”

ভাইয়া বিরক্তির সুরে বলল,” আমার একটা বন্ধু খুব বিপদে পড়েছে। ইমারজেন্সী কল দিল। আমি না গেলে হবেই না।”

ঈশান মসৃণ গলায় প্রস্তাব করল,” আমিও তাহলে আপনার সাথে চলি ভাইয়া?”

ভাইয়া কিছুটা ধমকের স্বরে উত্তর দিল,” আরে নাহ, তুমি কেন যাবে? তুমি আমার সাথে চলে এলে আমার পরিবারের খেয়াল রাখবে কে?”

ভাইয়ার এই কথায় ঈশানের চেহারাটা কেমন শুকনো হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম কারণটা। ভাইয়া ঈশানকে মনে-প্রাণে এখনও ভরসা করে তার প্রমাণ এই কথার দ্বারাই পাওয়া গেল। অর্থাৎ ভাইয়ার কাছে এখন সত্যিটা স্বীকার করা ঈশানের পক্ষে আরও একটু কঠিন। তবুও আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে ঈশান বলে উঠল,” যাওয়ার আগে আপনার সাথে আমার একটা জরুরী কথা ছিল, ভাইয়া। যেটা আপনাকে শুনতেই হবে।”

আমি ইশারায় নিষেধ করছিলাম৷ কারণ এখন ভাইয়া দুশ্চিন্তায় আছে। এই অবস্থায় ভাইয়াকে এসব না জানানোই ভালো। কিন্তু তবুও ঈশান বলবেই। ভাইয়া তাড়াহুড়ো কণ্ঠে জবাব দিল,” পাঁচমিনিটে বাস চলে আসবে। কি বলতে চাও তাড়াতাড়ি বলে তারুকে নিয়ে চলে যাও। তোমরা আমার অপেক্ষায় থেকো না। আজকে তোমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। তোমরা কিন্তু বিয়ে করে নিও। আমি দূর থেকে তোমাদের জন্য দোয়া করব। ফিরে এসে না হয় অনেক বড় করে আয়োজন হবে বিয়ের।”

আমি আর ঈশান একত্রে উচ্চারণ করলাম, ” না!” ভাইয়া অবাক হয়ে তাকাল। আমি বললাম,” তুমি চলে গেলে আমি ঈশানকে কেন বিয়ে করব ভাইয়া? কখনোই করব না।”

এবার ঈশান অবাক হয়ে আমার দিকে চাইল,” আসলেই করবে না?”

আমি চোখ রাঙালাম। ঈশান চুপ করে গেল৷ ভাইয়া রেগে বলল,” আমি থাকা আর না থাকায় কি? তোদের বিয়ে তোরা করবি।”

ঈশান অনুরোধ করে বলল ,” তার আগে জরুরী কথাটা যে আপনাকে শুনতে হবে! আর পাঁচমিনিটে বলা হবে না। আরও কিছু সময় লাগবে।”

আমি ‘হ্যাঁ’সূচক মাথা নেড়ে ভাইয়ার দিকে চাইলাম। ভাইয়া চটপট করে বলল,” না,না, এতো সময় আমার কাছে নেই। পাঁচমিনিটেই যা বলার বলো। নাহলে আমাকে টেক্সট করে দিও। আমি পরে চেক করে নিব।”

ভাইয়া উঠে রিসিপশনের কাছে গেল। বাস কেন আসছে না জিজ্ঞেস করতে। আমি আর ঈশান আশাহত হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ঈশান বিড়বিড় করে আমার কাছে এসে জানতে চাইল,” কি বলো? টেক্সটে বলব?”

আমি নিষেধ করলাম কঠিনভাবে,” অসম্ভব। ভাইয়াকে সামনে বসিয়ে তারপর ভালোমতো বুঝিয়ে-শুনিয়ে সবকিছু জানাতে হবে। সামান্য একটা ভুল হয়ে গেলেই কিন্তু..”

ঈশান আমার হাত চেপে ধরে ভরসা যোগানো কণ্ঠে বলল,” কিচ্ছু হবে না। আমি এখনি ভাইয়াকে সব বুঝিয়ে বলব। ভাইয়া আমাদের ক্ষমা না করে কোথাও যেতে পারবে না।”

আমি আশা ফিরে পাওয়া কণ্ঠে বললাম,” ইয়েস!”

ঈশান দ্রুত ভাইয়ার কাছে গেল। ভাইয়া তখন রিসিপশনিস্টের সাথে তর্কে লেগে গেছে। রিসিপশনিস্ট রূঢ় গলায় বলছে,” আরে মিয়া, এতো ক্যাঁচাল কইরেন না। দুইমিনিট পর পর আইসা এক কথা! বললাম তো বাস সময়মতো আসব। আপনি গিয়া বসেন।”

ঈশান ক্ষেপে সঙ্গে সঙ্গে রিসিপশনিস্টের কলার চেপে ধরে বলল,” ওই, গলা নামিয়ে কথা বল। জানিস উনি কে?”

ঈশানের এমন আচরণে আমিই ভ্যাবাচেকা খেলাম। দুশ্চিন্তায় সবার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। নাহলে হুট-হাট রিসিপশনিস্টের কটূ কথায় কেউ এমন রেগে যায়? নাকি ঈশান আসলেই ভাইয়ার অপমান সহ্য করতে পারেনি! এই ভেবে আমার চোখে জল এলো। ভাইয়া তখন ঈশানকে শান্ত করে বলছে,” আরে ধূর, ছাড়ো, ছাড়ো। কি করছ এসব? তুমি না ভালো ছেলে? আমার ভদ্র-সভ্য ভাই এমন অসভ্য লোকের কথায় কান কেন দিবে? এদিকে এসো।”

ভাইয়া ঈশানকে নিয়ে জায়গাটা থেকে সরে গেল। রিসিপশনিস্ট আগুন গরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ভাইয়া আর ঈশানের দিকে। তারা দু’জন কাউন্টার থেকে বের হলো। আমিও বাইরে এলাম। আর তখনি বাস এসে থামল। ভাইয়া ভ্রু কুচকে বলল,” এইতো, বাস চলে এসেছে। আচ্ছা আমি আসি। এই তারু ভালো থাকিস। ঈশান সবাইকে ভালো রেখো। আমি কিন্তু ফোন করে খোঁজ নিব। তোমরা আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না আবার।”

ঈশান কিছু বলতে পারছে না। আমিও নিশ্চুপ। ভাইয়া আমাদের বিদায় দিয়ে চলে যাচ্ছে৷ তাকে আটকাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আটকে রেখে এই কথা বলা সম্ভব নয়। ঈশান আমার পাশে দাঁড়িয়ে হতাশ কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” বলা হলো না তারিন।”

আমি দ্বিগুণ হতাশ কণ্ঠে বললাম,” ভাইয়া আবার কখন ফিরবে কে জানে? নিহার জন্মদিনেও এমন হয়েছিল। ভাইয়া প্রায়ই এমন করে। বন্ধু বিপদে পড়লেই পাগলের মতো সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে যাবে। তারপর কবে ফিরবে তার কোনো ঠিক নেই।”

” ঠিক নেই মানে?”

” মানে বলা যায় না। হয়তো চারদিন কিংবা চারমাস অথবা চারবছর!”

ঈশান হকচকিয়ে বলল,” ও মাই গড! এর মানে চারবছরেও আমাদের বিয়ে হবে না?”

আমি কিছু বলার আগেই ঈশান বাসের দিকে ছুটে গেছে। ভাইয়া তখনও সিটে বসেনি। কারণ কোনো সিট খালি নেই৷ ভাইয়া কন্ট্রাক্টরের উদ্দেশ্যে বলল,” আমার সিট নেই কেন ভাই?”

কন্ট্রাক্টর বলল,” আপনার টিকিট দেখি।”

তারপর বোঝা গেল টিকিট নকল। রিসিপশনিস্ট ভুঁয়া টিকিট বিক্রি করেছে ভাইয়ার কাছে। হয়তো সে ভাবেনি যে বাসের সব সিট ভর্তি থাকবে। ভাইয়া এই বাসে উঠলে মাঝরাস্তায় বিপদে পড়তো। ঈশান সঙ্গে সঙ্গে বলল,” আসুন ভাইয়া, নেমে যান। এই বাসে যেতে হবে না। আপনার জন্য আমরা এসি বাসের টিকিট যোগাড় করে দিব।”

ভাইয়া দৃঢ়চিত্তে বলল,” আমার এসি বাসের টিকিট লাগবে না। আমি এই বাসেই যাব।”

” এই বাসে কিভাবে যাবেন? সিট নেই তো।”

” না থাকলে নেই। আমি ছাদে উঠে যাবো।”

” আরে ভাইয়া, কি বলেন?”

কন্ট্রাক্টর ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বলল,” আপনি ছাদে উঠে যেতে পারবেন? তাহলে উঠেন। টাকা দিয়ে যেহেতু টিকিট কাটছেন, আপনাকে না নিয়ে যাবো না।”

ঈশান রেগে কন্ট্রাক্টরকে ধমক দিল,” কি বলছেন এসব? ভাইয়া ছাদে উঠে কেন যাবে? রিস্কের ব্যাপার খুব। আমি কোনোভাবেই ভাইয়াকে যেতে দিব না।”

ঈশান ভাইয়ার হাত জাপটে ধরে ফেলল। কন্ট্রাক্টর বলল,” আচ্ছা, আচ্ছা, এখানেই সিট খালি করে দিচ্ছি। বসার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ”

ঈশান প্রতিবাদ করে উঠল, ” দরকার নেই। আপনাদের টিকিট ভুঁয়া, ব্যবস্থা ভুঁয়া, বাসও ভুঁয়া। এই ভুঁয়া বাসে ভাইয়া যাবে না।”

ভাইয়া ভারী কণ্ঠে বলল,” আমি যাব। আমি ছাদে উঠেই যাব। বাসে সিট ফাঁকা থাকলেও আমি বসব না। ছাদেই যাব। আমার ছাদ ভালো লাগে।”

ভাইয়া ছাদে উঠতে লাগল। ঈশান বিপর্যস্ত হয়ে ভাইয়ার কোমর চেপে ধরল। ঈশান যত টানে, ভাইয়া তত উঠে। পাছে যদি আবার কোনো দূর্ঘটনা ঘটে? এই ভেবে আমি আতঙ্কিত হয়ে গেলাম৷ ঈশানকে থামতে অনুরোধ করলাম।

বাসের জানালা দিয়ে সবাই মাথা বের করে তামাশা দেখছে। কন্ট্রাক্টর, ড্রাইভারসহ সবাই হতঅবাক। ভাইয়া একধ্যানে শুধু বলছে,” আমি যাবোই ঈশান।”

ঈশান তেজ নিয়ে বলছে ” আমি যেতে দিবোই না ভাইয়া।”

আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বললাম,” ঈশান থামুন। ভাইয়াকে ছেড়ে দিন।”

ঈশান আমার কথাও শুনছে না। সে ভাইয়ার কোমর ধরে ঝুলেই আছে। ভাইয়া উপরে উঠার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে অবশেষে সফল হলো। ঈশান তখনও ভাইয়ার এক পা ধরে রাখল ভাইয়া শক্ত গলায় বলল,” ছাড়ো।”

ঈশান বলল,” যাবেন না।”

” ছাড়ো।”

” যাবেন না।”

তাদের এই কথা কাটাকাটির মাঝেই বাস ছেড়ে দিল। আমি চিৎকার করে বাসের পেছনে দৌড়াতে লাগলাম৷ কন্ট্রাক্টরকে ধমক দিয়ে বললাম,” এটা কেমন ফাজলামি? বাস ছাড়লেন কেন? ঈশান তো এক্সিডেন্ট করবে।”

আমার চিৎকারে বাস থেমে গেল। কন্ট্রাক্টর খুব বিরক্তি নিয়ে ঈশানকে বলল,” এই ভাই,আপনি নামেন তো। আমাদের দেরি হইতাছে।”

ঈশান ফট করে বলল,” আমি মোহনা সরকারের ছেলে।”

ভাইয়া চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করল,” মোহনা সরকার মানে?”

” আমি সব মিথ্যা বলেছি। আমি কোনো কোচিং এ ক্লাস নেই না। উবার ড্রাইভিংও করি না। ওই গাড়ি আমার নিজের। আমার বাবার নাম ঈমান জুবায়ের। আমার নাম তারায জোহান ঈশান। তারিন যাকে মোহনা আন্টি বলে, তিনি আমার মম।”

ঈশান যেন এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলল। এদিকে আমার শ্বাস তখন আটকে গেছে। ভাইয়াও নিশ্চুপ হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঈশান ঢোক গিলে বলল,”আপনি কি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন ভাইয়া?”

ভাইয়া চোয়াল শক্ত করে বলল,”বুঝেছি।”

ঈশান অনুনয় করল,” তাহলে নামুন প্লিজ। আরও বুঝিয়ে বলি।”

” আমি নামব না। তুমি পা ছাড়ো। নাহলে আমি তোমাকে ধাক্কা দিব।”

আমি চেঁচিয়ে বললাম,” না ভাইয়া, ধাক্কা দিও না প্লিজ। ও মরে যাবে।”

তারপর ঈশান ধপ করে নিচে পড়ে গেল। ভাইয়া ধাক্কা দিয়েছে নাকি ঈশানই পা ছেড়েছে? আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। হন্তদন্ত হয়ে ঈশানকে ধরলাম। বাস তখন চলে যাচ্ছে। আমি ঈশানকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে টেনে দাঁড় করালাম। ভাইয়া আমাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ গলা উঁচিয়ে বলল,” আমি ফিরে এসে তোমাদের ধুমধাম করে বিয়ে দিব।”

আমি আর ঈশান চমকে উঠলাম৷ ঈশান দৌড়ে বাসের পেছনে ছুটে যেতে যেতে বলল,” আমার আসল পরিচয় জানার পরেও আপনি বিয়ে দেবেন?”

ভাইয়া হাত উঠিয়ে বলল,” তুমি প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হলেও বিয়ে দিব। আমার বোনকে সুখে রেখো। আল্লাহ হাফেজ।”

ঈশান স্তব্ধ চিত্রের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল রাস্তার মাঝে। খুশিতে হয়তো সে বাকহারা। পেছন থেকে বড় একটা ট্রাক আসছে। আমি ঈশানকে দ্রুত টেনে সরালাম,” আপনি কি পাগল? এক্সিডেন্ট করতে নিচ্ছিলেন তো।”

ঈশান ফিসফিস করে বলল,” পাগল তো আমি আগেই ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে হার্ট এটাক করে ফেলব তারিন! ”

আমি নিজের মুখ চেপে ধরলাম। অতিরিক্ত খুশিতে কাঁদতে হয় নাকি হাসতে হয়? এই ভেবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম।

চলবে

#তি_আমো
পর্ব ৩২
লিখা- Sidratul Muntaz

যারা নিজের বিপদের তোয়াক্কা না করে মানুষকে সাহায্য করতে চলে আসে তারা পৃথিবীর সরলতম মানুষ। ঠিক যেমন আমাদের ফাহিম ভাই! সকালে ভাইয়া আর মোহনা আন্টির সামনে এসে কি বাজেভাবেই না ফেঁসে গেছিল বেচারা। তবুও একবারের জন্যেও মুখ ফুঁটে কোনো কথা বলেনি। যদি তখন ফাহিম ভাই কিছু একটা বলে দিতো তাহলে আজকে আমাদের সমস্যা এতো দ্রুত সমাধান হতো না। ভাইয়া ফাহিম ভাইয়ের মুখে সত্যি জানার পর অবশ্যই খুব রেগে যেতো। তখন আমি হাজারবার কাঁদলেও আর ঈশান হাজারবার পা ধরে ঝুলে থাকলেও লাভ হতো না। এই কথা ভেবেই আমার গা শিউরে উঠছে। কি ভয়ংকর বিপদ থেকে আমরা পার পেয়েছি! এজন্য ফাহিম ভাইকে ছোট্ট করে হলেও একটা ধন্যবাদ দেওয়া আবশ্যক। আমি এখন ফাহিম ভাইয়ের সামনে তার ঘরেই বসে আছি।

ফাহিম ভাই খোশমেজাজে প্রশ্ন করল,” তোমরা কি আসলেই সব বলে দিয়েছ? এখন থেকে তোমার ভাইয়া আমাকে দেখলে হিটলারের মতো চোখ রাঙাবে না তো?”

আমি হেসে ফেলে বললাম,” একদম না। আপনার ভয়ের আর কোনো কারণ নেই। ভাইয়ার সাথে যদি আপনার আবার দেখা হয় তাহলে ভাইয়া আর আপনাকে ধমকাবে না। নিশ্চিন্ত থাকুন। তবে আপনার কাজে আমি খুবই মুগ্ধ। তখন ভাইয়া আপনাকে ওইভাবে চড় মারল তবুও কোনো প্রতিবাদ করলেন না! আপনি এতো ভালো কেন ফাহিম ভাই?”

ফাহিম ভাই অপ্রস্তুত হাসল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” যত ভালো ভাবছ আমি আবার ততটাও ভালো না। আমি আসলে তোমার ভাইকে মারাত্মক ভয় পেয়েছিলাম তারিন। যে লম্বা উনি,এতোবড় শরীর নিয়ে যদি আমাকে একটা দিতো তাহলে ওখানেই আমি বেহুশ।”

” ভাইয়া আপনাকে কখনোই মারতো না, ফাহিম ভাই। ভাইয়া শুধু রাগই দেখায়। কাউকে মারধোর করে না।”

” কিন্তু যেভাবে তাকাচ্ছিল তোমার ভাই…আমি তো ভয়েই মুখ ফুঁটে কিছু বলতে পারিনি। আর তখন আমি আবোল-তাবোল বলেছি সেটা আমার নিজেরও মনে পড়ছে না। শুধু মনে পড়ছে তোমার ভাই আমার দিকে তাকিয়েছিল। এই বড় বড় চোখ!”

আমি মুখ চেপে হাসি রুখে অপরাধী গলায় বললাম,” স্যরি ফাহিম ভাই,আমাদের ভুলের জন্য আপনাকে এতো ঝামেলা ফেইস করতে হলো। আর আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”

ফাহিম আড়ষ্টভাবে হাসল। বোধহয় সে আমার প্রশংসায় লজ্জা পাচ্ছে। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,” মেনশন নট। আমি তোমার জন্য সব করতে পারি। তুমি হাতটা শুধু ধরো, আমি হবো না আর কারো।”

ফাহিম ভাইয়ের এই কথা শুনে আমার চোখ গোল হয়ে গেল। ফাহিম ভাই বিব্রত গলায় বলল,” গানের লাইন বললাম।”

আমি হাসার ভাণ ধরে বললাম,” এমন তো কোনো গান নাই। মানে আগে শুনিনি।”

ফাহিম ভাই মাথা চুলকে বলল,” তাহলে মনে হয় কবিতার লাইন হবে। আচ্ছা, হবে কিছু একটা। মজা করে বললাম।”

আমি জোর করে হাসলাম। ফাহিম ভাইও অকারণেই আমার সাথে গলা মিলিয়ে হাসতে লাগল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,” আসি ফাহিম ভাই। ভালো থাকবেন।”

” তুমিও ভালো থাকবে। আর কখনও হেল্প লাগলে বলবে।”

আমি হাতজোড় করে বললাম,” আপনি এমনিই যে হেল্প করেছেন তার জন্য সারাজীবন কৃতজ্ঞ। আরও হেল্প করতে চান?”

“এভাবে বোলো না, প্লিজ। তুমি বিপদে পড়লে আমি সবসময় পাশে আছি।”

” সো সুইট!”

আমি যত দ্রুত সম্ভব ঘর থেকে বের হলাম। দরজার সামনেই দেখলাম ঈশান দাঁড়িয়ে আছে। সে এখানে দাঁড়িয়ে আমাদের কথাই শুনছিল। কিন্তু আমাকে দেখা মাত্রই মোবাইলে মনোযোগী হয়ে উঠল। খুব ভালো অভিনয়! আমি জিজ্ঞেস করলাম,” আপনি এখানে কি করছেন?”

ঈশান মোবাইলটা পকেটে ভরে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,” তুমি কি করছ এখানে?”

” ফাহিম ভাইয়ের ঘরে এসেছিলাম। স্যরি বলতে।”

” এতো দ্রুত স্যরি বলা শেষ হয়ে গেল? ” ঈশানের কণ্ঠে হালকা বিদ্রূপ। আমি যে ফাহিম ভাইয়ের ঘরে অনেক বেশি সময় ধরে বসে ছিলাম সেটাই খোঁচা মেরে বোঝাতে চাইছে সে। আমি হাত ভাজ করে বললাম,” আপনি কতক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন?”

ঈশান ভ্রু উঁচু করে উত্তর দিল,” যতক্ষণ ধরে তুমি ভেতরে বসে ছিলে!”

আমি রেগে সামনে হাঁটতে হাঁটতে বললাম,” হাউ পজেসিভ! এরকম কেন আপনি?”

ঈশান আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল ” কারণ আমার সন্দেহ হচ্ছে। ফাহিম তোমাকে পছন্দ করে।”

আমি একটু থমকালাম। এই সন্দেহ আমারও হয়েছে। কিন্তু ঈশান বুঝল কি করে? আমি চোখমুখ কুচকে উচ্চারণ করলাম,” মানে? আপনার এরকম কেন মনে হয়?”

” পছন্দ না করলে তোমার ভাইয়ের মার, ধমক এসব হজম করতো না। কবেই সত্যিটা বলে দিতো!”

আমি মুচকি হেসে বললাম,” তাই? তাহলে তো বলতে হয় ফাহিম ভাই আমাকে পিউর লভ করে।”

আমার কথায় ঈশান বিস্মিত হলো,” কিভাবে?”

” কারণ পছন্দ করলে উনি চাইতো ভাইয়া যেন আপনাকে ঘৃণা করে। তাই আগেই ভাইয়াকে সত্যি জানিয়ে নিজে ভালো হয়ে যেতো। আর আপনাকে খারাপ বানিয়ে দিতো। কিন্তু উনি নিজে ভাইয়ার কাছে খারাপ থেকে হলেও আপনাকে ভালো রেখেছে। কারণ ফাহিম ভাই জানে, আমি আপনাকে ভালোবাসি…”

এইটুকু বলেই আমি থেমে গেলাম। ঈশান গাঢ় কণ্ঠে বলল,” আরেকবার!”

আমি লজ্জিত হয়ে বললাম,” পরে।”

ঈশান হাত চেপে ধরে জেদ করল,” এখনি, আবার বলো না!”

” বললাম না, পরে বলব?”

ঈশান হালকা রাগী গলায় বলল,” ফাহিমের লভ্ পিউর আর আমার লভ্ কিছু না?”

আমি হেসে বললাম,” না। আপনার ভালোবাসায় ভেজাল আছে।”

” তাই? তাহলে তুমি শুদ্ধ করো!””

আমি আৎকে উঠে বললাম,” আরে মা!”

” মিথ্যা কথা। এসব বললেই আমি ছাড়ব না। বার-বার বোকা বানানো যায় না তারিন।”

আমি বিপর্যস্ত দৃষ্টিতে বললাম,” ঈশান আসলেই মা পেছনে!”

ঈশান পেছনে তাকিয়েই ভ্যাবাচেকা খেল। দ্রুত আমার হাত ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মা ইতস্তত করে বলল,” তারু একটু ঘরে আসিস।”

মা দ্রুত চলে গেল। আমি মুখে হাত দিয়ে অস্বস্তি নিয়ে বললাম,” মা সব বুঝেছে।”

ঈশান বেপরোয়া ভাব নিয়ে বলল,” বুঝবেই তো। সবাই সব বুঝে। শুধু তুমি বোঝো না। আন্টি কি সুন্দর আমাদের স্পেস দিয়ে চলে গেল। এটাকেই বলে ইন্টেলিজেন্স!”

ঈশানের কথায় হাসি পেলেও আমি ইচ্ছে করে রাগ দেখালাম,” আপনার যত ফালতু কথা!”

আমি চলে আসতে নিলে ঈশান চওড়া গলায় বলল,” আন্টির সাথে মিটিং শেষ হলে বাগানে..”

আমি জবাব দিলাম না। ঈশান আমার নীরবতাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে নিল হয়তো।

নিহাদের বাড়িতে ফিরে আসার পর মায়ের কাছেও আমরা সব স্বীকার করে নিয়েছিলাম। মা আমাদের স্বীকারোক্তি শুনে যতটুকু অবাক হয়েছে তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছে ভাইয়ার মেনে নেওয়ার ব্যাপারটি শুনে। ভাইয়া সব জেনেও বিয়ের অনুমতি কিভাবে দিল? মা যেন বিশ্বাসই করতে চাইল না। আর যেহেতু ভাইয়া সব মেনে নিয়েছে, তাই মাও বিষয়টা নিয়ে খুব একটা বিচলিত হলো না। কিন্তু আমাকে ঠিকই ধমক দিল-

” না জানি আর কত মিথ্যা বলেছিস! আমাদের চোখের সামনে দিয়ে তোরা এতো নাটক করলি আর আমরা বুঝলামই না?এই, সত্যি তোকে আমি পেটে ধরেছিলাম তো? তুই কি আমারই পেটের মেয়ে? কিভাবে আমার সাথে এতোবড় জোচ্চুরি করলি?”

আমি হাত-পা ধরে ক্ষমা চেয়ে মাকে শান্ত করলাম। ঘরে গিয়ে বসতেই মা বিরস মুখে বলল,” তারিফকে একটা ফোন লাগা তো, তারু।”

আমি হেসে বললাম,” কেন? আমাদের কথা বিশ্বাস হয়নি? ভাইয়াকে ফোন দিয়ে শিউর হবে?”

” তা না। ছেলেটা কই গেল হঠাৎ? তাও আমাদের এভাবে ফেলে? সবসময় আমাকে জানিয়ে যেতো। এবার জানালোও না!”

” আমি যদি ফোন না করতাম তাহলে হয়তো ভাইয়া কাউকেই জানাতো না মা।”

মা খুব দুশ্চিন্তা করতে লাগল। আমি বললাম,” এতো ভেবো না। ভাইয়া বলেছে পরে সব জানাবে। আপাতত যেন তাকে বিরক্ত না করি। তার মোবাইলও বন্ধ।”

মা খুব অস্থির হয়ে বলল,” এই ছেলে আমাকে কোনোদিন শান্তি দিল না।”

আমি মনখারাপ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ রুবা আন্টি আমাদের বাড়ি ফিরে যেতে দেননি। তাঁর কড়া নির্দেশ, বৌভাতের পরে একেবারে যেন আমরা যাই। তাই থাকতে হলো। বিকালে বুড়ি আর মায়ের সাথে বসে ছিলাম। বুড়ির শরীর আবার খারাপ করেছে। সে ঘুমাচ্ছে। বাগানে ব্যাডমিন্টন খেলছিল ছেলেরা। আমি জানালা দিয়ে উঁকি মারতেই হঠাৎ একটি কক এসে গায়ে লাগল আমার। আমি ককটা হাতে নিয়ে দেখি সাদা ককের উপর কালো মার্কার দিয়ে গুটি গুটি করে লিখা। যা পড়তে একটু কষ্টই হলো,” বাগানে আসতে বলেছিলাম, এলে না কেন? ঘর থেকে এসে তুলে নিয়ে যেতে হবে?”

আমি ভয় পেয়ে মায়ের দিকে চাইলাম। মা আমার পাশেই ছিল। মাথা তুলে বলল,” তোর হাতে এটা কি?”

আমি ইতস্তত করে বললাম,” ব্যাডমিন্টন খেলার কক। নিহা ছুঁড়েছে মনে হয়। আমাকে ওরা ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য বাগানে যেতে বলছে।”

” ঘরে এসে ডেকে নিয়ে গেলেই তো হতো। এমন ছোঁড়াছুড়ি করার কি আছে?”

” কি জানি?”

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানের দিকে হেঁটে গেলাম৷ রিফাত ভাইয়ারা সবাই মিলে ব্যাডমিন্টন খেলায় মনোযোগী। আমি সিয়াম ভাইয়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,” ঈশানকে দেখেছেন?”

আমার প্রশ্নে সবাই খেলা থামিয়ে ঘুরে তাকাল। আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। রিফাত ভাই আবার শিষ বাজাচ্ছে। আরও লজ্জা! সিয়াম ভাই আমার অবস্থা দেখে হেসে দিল। তারপর ইশারা করে বলল,” ওইদিকে চলে যাও।”

আমি রাতারাতি প্রস্থান করলাম। খুব অস্বস্তি লাগছিল সবার দৃষ্টিবাণের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। প্রেম করা যে এতো লজ্জার বিষয়, আগে তো জানতাম না! এজন্যই বুঝি প্রেম সবসময় লুকিয়ে করা উচিৎ। মানুষ জানলেই অসুবিধা। ভয়ংকর অসুবিধা!

আমি ঝোঁপের কাছে এসেও ঈশানকে খুঁজে পাচ্ছি না। সিয়াম ভাই যেখানে ইশারা করেছে সেখানেই তো এলাম। তাহলে ঈশান কই? আমি যখন তাকে মগ্ন হয়ে খুঁজছি তখন হেচকা টান মেরে আমাকে সে তার কাছে নিয়ে এলো। আমি আৎকে উঠে বললাম,” কেউ চলে আসবে এদিকে!”

ঈশান মৃদু কণ্ঠে বলল,” আজ সকালের ঝগড়ার পর সবাই আমাদের ব্যাপারে সবকিছু জানে। তাই কেউ চলে এলেও নো প্রবলেম।”

আমি মুখ গোজ করে বললাম,” তাই বলে কি আমরা নির্লজ্জের মতো সবার সামনে হাত ধরে হাঁটব?”

” সবার সামনে কই? এখন তো কেউ নেই।”

” এখন আমরা কি করব?””

ঈশান বামচোখ টিপে বলল,” কেউ না থাকলে যা করা যায়!”

আমি ঈশানের নাক বরাবর ঘুষি মারলাম। ঈশান চেঁচিয়ে উঠল। আমি ভয় পেয়ে বললাম,” স্যরি, বেশি ব্যথা লেগেছে?”

ঈশান অবাক হয়ে বলল,” আমার ব্যথা কেন লাগবে? আমি তো তোমার কথা ভাবছি। দেখি, তোমার হাত ঠিক আছে তো? আমার নাকের সাথে লেগে আবার ফেটে যায়নি তো?”

আমি কটমট করে তাকাতেই ঈশান হেসে ফেলল। আমার দৃষ্টি নরম হয়ে গেল। সে হাসলেই যেন লুটিয়ে পড়ি আমি, লুটিয়ে পড়ি প্রেমে। ঈশান আমার হাত ধরে বলল, ” চলো একটা গেইম খেলি তো। চোখের পলক না ফেলে আমরা একজন-অন্যজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকব৷ যে আগে পলক ফেলবে সে হারবে।”

আমি কোনো কথা না বলে চুপচাপ তাকিয়ে রইলাম। খেলা শুরু হলো। দু’জনেই তাকিয়ে, হাতে হাত রেখে, বরাবর দাঁড়িয়ে, একধ্যানে। ঠিক যেন ডুবে যাওয়া একে-অপরের মাঝে। এতো চমৎকার খেলা আমি আগে কখনও খেলিনি।

মোহনা আন্টি আমাকে এতোবার ডাকলেন কিন্তু আমি ডাকটা শুনতেই পাচ্ছি না। কারণ তখন ধ্যান-জ্ঞান সব একত্র করে আমি শুধু ঈশানকেই দেখছি। ঈশান হালকা গলায় বলল,” ডাকছে তো।”

আমি কথাটা বুঝলাম না। প্রশ্ন করলাম বিবশ হয়ে,” হ্যাঁ?”

ঈশান পেছনে ইশারা করে বলল,” তাকাও।”

আমি তাও বুঝতে পারছি না। তার দিকেই তাকিয়ে আছি হ্যাঙলার মতো। ঈশান আমার দুই কাঁধ চেপে ধরে পেছনে ঘুরিয়ে দিয়ে বলল,” পেছনে তাকাও, তোমাকেই ডাকছে মম।”

আমি মোহনা আন্টিকে দেখে হকচকিয়ে গেলাম। লজ্জাও পেলাম ভীষণ। মোহনা আন্টি বলল,” কোন ধ্যানে ছিলে? এদিকে আসো। আমিই ঈশানকে বলেছিলাম তোমাকে যাতে ডেকে আনে। জরুরী কথা ছিল।”

আমি অপ্রস্তুত গলায় বললাম,” ও।”

মোহনা আন্টি আমাদের নিয়ে বাগানের একপাশে চলে এলো ;যেখানে সুন্দর করে চেয়ার টেবিল পাতা। টেবিলের উপর কফির কেটলি। ধোঁয়া উড়ছে। একটা অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কফির ঘ্রাণও বুঝি এতো সুন্দর হয়? আমার এখনও কিছুক্ষণ আগের ঘটনা ভেবে লজ্জা লাগছে। ঈশানের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিলাম যেন দুনিয়া ভুলে গিয়েছিলাম৷ আমি আঁড়চোখে আবার ঈশানের দিকে তাকাতেই দেখলাম সে মুচকি হাসছে।

আমি ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলাম,” আন্টি আমাকে কেন ডেকেছে?”

“জানি না। আমাকেও কিছু বলেনি মম। বসো, এক্ষুণি জানতে পারবে।”

তারপর ঈশান বিড়বিড় করে খানিকটা বিদ্রুপের স্বরেই বলল,” আমাকে দেখার আরও অনেক সময় পাবে। আপাতত মমের কথা শোনো।”

আমি রেগে বললাম,” আমি তখন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম তাই শুনতে পাইনি। ভাববেন না আপনাকে দেখে ডুবে গিয়েছিলাম।”

ঈশান হেসে প্রশ্ন করল, ” কি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়?”

আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম,” সেটা এখন ভুলে গেছি।”

ঈশান চোখ সরু করে বলল,” আমাকে দেখতে দেখতেই ভুলে গেছ নাকি?”

আমার চোখে রোষানল। ক্ষীপ্ত হয়ে উচ্চারণ করলাম,” শাট আপ!”

ঈশান প্রাণখোলা হাসি হাসতে লাগল। আমি মোহনা আন্টির পাশে বসলাম। মোহনা আন্টি কফি ঢেলে আমাকে এক কাপ আর ঈশানের দিকে এক কাপ বাড়িয়ে দিলেন। তারপর সরাসরি মূল আলোচনায় চলে গেলেন।

” আমার ছেলেকে তুমি কবে বিয়ে করছ তারিন?”

আমি কফিতে ঠিক তখনি চুমুক দিতে যাচ্ছিলাম। এই কথা শুনে এমন বিষম খেলাম যে নাকে-মুখে কফি ঢুকে, জামায় পড়ে, অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। ঈশান তখন মুখে হাত দিয়ে হাসছে। মোহনা আন্টি দ্রুত আমাকে টিস্যু দিলেন। আমি টিস্যু দিয়ে নিজেকে ক্লিন করতে করতে একবার ঈশানের দিকে চাইলাম। ঈশান বিড়বিড় করে কিছু বলল। আমি না শুনেও বুঝতে পারলাম, সে ‘আই লভ্ ইউ’ বলেছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here