তি_আমো,৩৫,৩৫ বোনাস

0
323

#তি_আমো,৩৫,৩৫ বোনাস

পর্ব ৩৫
লিখা- Sidratul Muntaz

বাসে উঠে ঈশান এক আজব কান্ড করল! শীতের রাত। সবাই মিলে যেতে গোটা একটি বাস রিজার্ভ করা হয়েছে। বরফশীতল ঠান্ডা পানি বিক্রি করছিল এক ফেরিওয়ালা। বাস থেকে মাথা বের করে আমি বললাম,” এই শীতের রাতে কে খাবে আপনার ঠান্ডা পানি? পারলে গরম পানির ব্যবস্থা করুন। আমরা সবাই কিনব।”

আমার কথায় নিহারা হেসে উঠল। ফেরিওয়ালা আমাদের দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকাল। বুড়ি আমার পাশে বসল। খিটমিট করে বলল,” জানলা খুলা ক্যা? লাগা জলদি! শীতে শইল কাঁপতাছে।”

আমি জানালা টেনে বন্ধ করে বললাম,” বাস এখনও ছাড়েনি, তাতেই এই অবস্থা? বাস ছাড়ার পর কি করবে?”

বুড়ি ফোকলা হাসি দিয়ে বলল,” কি আর করমু? আমার এই শালটা গায়ে দিয়া ঘুমায় যামু!”

আমি অবাক হলাম,” আরে এই শালটা তো..”

শালটা হাতে নিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে দেখতে লাগলাম৷ বুড়ি ধমক দিল,” দে আমার জিনিস। ভাজ খুলিস না। তোর জিনিস আমি ধরি? তুই গপ কইরা আমার জিনিস লইয়া ফালাস ক্যান? ইডি কুন খাইচ্চত?”

“ওরে বাবা! থাক ধরব না যাও।”

শালটা অবশ্য ভীষণ সুন্দর। এই শালটাই ঈশান বুড়িকে উপহার দিয়েছিল যেদিন সে আমাদের বাড়িতে ভাড়া নিল। সন্ধ্যায়ই গিয়ে সবার জন্য এতোকিছু শপিং করে এনেছিল।

নিহা ফিসফিস করে বলল,” ঈশান ভাই তোকে পেছনে তাকাতে বলেছে।”

আমি সামনে চেয়ে বললাম,” পেছনে কিছু নেই। আমার ফোকাস সামনের দিকে। কারণ আমরা যাচ্ছি সিলেট। আর সিলেট পেছনে তাকিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।”

নিহা কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল,” আরে পাগল, ঈশান ভাইয়া পেছনে বসেছে। এজন্য তোকে বলেছে পেছনে তাকিয়ে তার দিকে একটু দেখতে।”

আমি পরিষ্কার কণ্ঠে জানালাম,”এই ভরা বাসে মুরব্বিদের উপেক্ষা করে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে একটু করে দেখার কোনো মানে হয় না। তাকে আমি অনেক দেখেছি। এখন আমি শুধু দেখব সিলেটের চা বাগান। কখন বাস ছাড়বে?”

নিহা হেসে ফেলে বলল,” তারু তুই কি মজা করছিস? ঈশান ভাইয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি তোর?”

আমি নির্বিকার হয়ে বললাম,” এখনও হয়নি। তবে হতে পারে। যদি উনি আমার কাছে ক্ষমা না চায়।”

” কিসের জন্য ক্ষমা চাইবে?”

” উনি আমাকে অনেক মিথ্যা বলেছে। সেজন্য ক্ষমা চাইবে।”

নিহা বার্তাবাহকের দায়িত্ব পালন করে ঈশানের নিকট আমার বার্তা পৌঁছে দিল। এই হৈচৈ এর মাঝেও আমিও স্পষ্ট করে শুনতে পেলাম, নিহা পেছনে গিয়ে ঈশানকে বলছে,” ঈশান ভাই, আপনি নাকি তারুর সাথে মিথ্যা বলেছেন? সেজন্য ক্ষমা চাইতে হবে। নাহলে ও আপনার দিকে তাকাবেও না আর কথাও বলবে না।”

ঈশান কি বলেছিল তা আমি শুনতে পেলাম না। একটু পর নিহা একটা চিরকুট নিয়ে হাজির হলো। সবাইকে সাক্ষী রেখেই চিরকুট আমার হাতে তুলে দিল। আমার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তখন। এমনি এমনি নিহাকে গাঁধী ডাকি না। চিরকুট একটা ব্যক্তিগত জিনিস। দিতে হয় লুকিয়ে। তা না করে সে দিল ঘোষণা করে,” তারু, তারু,নে। ঈশান ভাইয়া তোর জন্য চিরকুট পাঠিয়েছে।”

নিহার এই কথায় সাড়া পড়ে গেল বাস জুড়ে। নীরা, আনিকা, সামিয়ারা ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। ছেলেরা হাসাহাসি শুরু করল। রিফাত ভাই মজা নিতে বলল,” বাসে উঠতে না উঠতেই শুরু? নিহা, এদের দু’জনকে একসঙ্গে বসিয়ে দে না! তোর কষ্ট কম হবে। ”

নিহা মুখ টিপে হাসল৷ আমি লজ্জায় চিরকুট মুঠোয় নিয়ে মাথা নিচু করলাম। পেছনে মা রুবা আন্টিদের সাথে বসেছিল। সেও নিশ্চয়ই শুনছে এসব। ইশ! রিমা আগ বাড়িয়ে ছুটে এলো,” দেখি, দেখি ঈশান ভাই পেছন থেকে সামনে কি এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করল?”

রিমার কথায় হেসে উঠল সব পরিচিত যাত্রীরা। আমি অসহায় চোখে চাইলাম। নিহা ধমক দিয়ে বলল,” এইসব ব্যক্তিগত জিনিস দেখতে নেই।”

রেহেনা বলল,” এতো ব্যক্তিগত হলে তোমাদের গোপন রাখা উচিৎ ছিল। যেহেতু আমরা জেনেই ফেলেছি, সেহেতু আমাদের চিরকুটের লেখাও দেখতে দিতে হবে। দোষ তোমাদের। আমাদের আগ্রহ জাগালে কেন?”

রেহেনার কথায় সবাই উৎসাহিত হলো। সাফিন ভাই প্রতিবাদ করে বলল,” আরে ধূর, বাদ দাও তোমরা। তারু এমনিই লজ্জা পাচ্ছে। কি দরকার?”

রিফাত ভাই ফোড়ন কাটতে বলল,” বুঝি মামা। ঈশান তো তোমার দলেরই লোক৷ এজন্য ওকে বাঁচাতে চাইছ। কিন্তু তা হবে না। আমরা যারা সিঙ্গেল আছি, তারা সবাই দেখব এই চিরকুটে কি আছে! তোমাদের প্রেমে কত মধু! এটা আমাদের সিঙ্গেলগত অধিকার। তবে তারু তুমি দেখাতে না চাইলে থাক। আমরা বুঝে নিব অত্যন্ত ব্যক্তিগত জিনিস। যা দেখানো একেবারে অসম্ভব।”

ব্যাপারটা এবার নেগেটিভ দিকে চলে যাচ্ছে। সবাই মুখ টিপে এমনভাবে হাসছে যে আমি লজ্জায় বলে ফেললাম,” আচ্ছা, দেখুন।”

আমার কথাটা বলতে দেরি হলো কিন্তু চিরকুটের উপর সবার হামলে পড়তে দেরি হলো না। চূড়ান্ত লজ্জায় আমার তখন মাথা কাটা যাওয়ার উপক্রম। রিফাত ভাই সব ছেলে-মেয়েদের কাছে এনে পরিষ্কার কণ্ঠে পড়লেন,
” এই মিষ্টি হাসি, একবার আমার দিকে তাকাও না, প্লিজ! সকাল থেকে মাথা ঘুরছে, চোখে ঝাপসা দেখছি। মনে হচ্ছে আমার লো স্যুগার হয়ে গেছে। কারণ তুমি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছো। সকাল থেকে প্রচন্ডভাবে আমি মিষ্টির অভাববোধ করছি। সেই অভাবে এখন আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমাকে সুস্থ করতে সিরাজগঞ্জের পানতোয়া, ধানসিঁড়ির দই কিংবা কুমিল্লার রসমলাই লাগবে না। শুধু তোমার একটা মিষ্টি হাসিই যথেষ্ট। কারণ তোমার মিষ্টি হাসি, আমি সবথেকে ভালোবাসি।”

সবাই চিৎকার করতে লাগল চিরকুট পড়ে। না জানি কি ভাবছে! ঈশানের প্রতি অনেক মেজাজ খারাপ হলো। এতো ঢং কেন তার লেখায়? আমি তীব্র লজ্জায় চোখে হাত দিয়ে বসে রইলাম। রিফাত ভাইয়েরা গিয়ে ঈশানকে ধরল। ঈশান গম্ভীরমুখে বলল,” এতো হাসির কিছু নেই। গুগল থেকে কপি পেস্ট করেছি।”

” ও আচ্ছা।গুগলের কোন সাইটে আছে এমন লেখা?”

সিয়াম ভাই টিটকিরি মারল,” হ্যাঁ, আমাদেরও একটু দেখা!”

এসব নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করতে করতেই বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেল। নিহা ঈশানের কাছে একগাদা ধমক খেয়ে আমার কাছে এসেও ধমক খেল। তারপর সে নির্বাসন নিয়ে সাফিন ভাইয়ের কাছে চলে গেল। সিদ্ধান্ত নিল এখন থেকে সে আমাদের আর সাহায্য করবে না। আমি অবশ্য এতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তার বিপদে ফেলার মতো সাহায্যের কোনো প্রয়োজন নেই আমার। বাস অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর ঈশান খুব ঝামেলা শুরু করল। পা দিয়ে আমাকে খোচা মারতে লাগল আর বলল তার সাথে পেছনে যেতে। আমি চোখ বড় করে চাইলাম৷ ঈশান বলল,” শুধু কথা বলব। খারাপ কিছু না। এভাবে তাকাচ্ছ কেন?”

” আমি আপনার কথাই শুনব না।” ফিসফিস করে এই কথা বলেই আমি মেয়েদের পাশ থেকে উঠে বুড়ির পাশে বসে পড়লাম। ঈশানকে শায়েস্তা করার জন্যই। বুড়ি তখন ঘুমাচ্ছে। তার নাক ডাকার শব্দেই বিরক্ত হয়ে নীরাদের সাথে পেছনে বসতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ঈশানের যন্ত্রণায় অতিষ্ট হয়ে আবার সামনে ফিরে আসতে হলো। বুড়ি তীক্ষ্ণ শব্দে নাক ডেকে চলেছে। আমি কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে বসলাম। জেটসিন ডোনা লামা নামের একটি কিউট পিচ্চি মেয়ে এসেছে সারেগামাপাতে। তার গান শুনতে ইদানিং আমার অনেক ভালো লাগছে। এভাবে অনেক সময় পেরিয়ে গেল। চঞ্চল পরিবেশ ঝিমিয়ে পড়েছে। কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউ জানালায় বাইরের দৃশ্য মনোযোগ দিয়ে দেখছে, কেউ বা বই পড়ছে। আবার কেউ ডুবে আছে মোবাইলে। পরিবেশ এখন সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। এই নিস্তব্ধতার সুযোগ নিয়েই ঈশান ঠিক আমার আর বুড়ির বামপাশের সিটে এসে বসল। সেই সিটে সামিয়া বসেছিল। ঈশান সামিয়াকে উঠিয়ে নিজে বসল। তারপর আমাকে ফিসফিস করে ডাকতে লাগল। কিন্তু আমার কানে তখন ইয়ার ফোন। ঈশানের ডাক বাসের সবাই শুনে ফেলবে তাও আমি শুনব না। আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে বাস। একটু পর পর বিরাট ঝাঁকি সামলাতে হচ্ছে। আমি তাও চোখ বন্ধ করে গান শোনায় মগ্ন। ঈশান কাছে এসে হাত বাড়াল আমার ইয়ার ফোন খোলার জন্য। সে যখন ইয়ার ফোন টেনে খুলল, আমি সাথে সাথেই টের পেলাম না। সে আমার কানে কিছু বলতে এলো আর তখনি বাস খুব জোরে ঝাঁকি খেল। ঈশানের ঠোঁট এসে ধাক্কা লাগল আমার গালে। উদ্ভট একটা শব্দ সৃষ্টি হলো। আমি চিৎকার করে উঠলাম। বুড়ি হড়বড় করে জেগে উঠল। ঈশান বাতাসের গতিতে তার জায়গায় গিয়ে বসে পড়ল। বুড়ি আশেপাশে তাকাতে লাগল। আমি চুপচাপ বুড়ির দিকে চেয়ে রইলাম। বুড়ি কিছু না বুঝে বেকুব হয়ে রইল।

মোহনা আন্টি সামনের সিটের ডানপাশে ছিলেন। আমার চিৎকার তিনিও শুনেছেন। তাই প্রশ্ন করলেন ,” তারিন, তুমি চিৎকার করেছ নাকি?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম,” হ্যাঁ। বাইরে কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছি।”

” ও।”

নীরা বিষয়টা বুঝল। তাই মজা নিতে জিজ্ঞেস করল,” কি দেখেছ তারু?”

আমি দাঁত খিঁচে বললাম,” একটা খাটাশ দেখেছি!”

নীরা চাপা হেসে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল ” ইউ আর সো লাকি! ঈশান ভাইয়া তোমাকে মানানোর জন্য কত চেষ্টা করছে। এভাবে কেউ রাগ ভাঙায় না। প্লিজ, মেনে যাও।”

আমি শান্ত স্বরে বললাম,” আচ্ছা, মানব।”

” ঈশান ভাইয়ের মতো বয়ফ্রেন্ড ঘরে ঘরে হোক।”

আমি মিনমিন করে বললাম,” তওবা, তওবা, এমন বয়ফ্রেন্ড শত্রুরও না হোক!”

চলবে

#তি_আমো
পর্ব ৩৫(বোনাস)
লিখা- Sidratul Muntaz

মাঝরাতে আরও একটা মজার কান্ড হয়েছিল৷ সবার জন্য মজার হলেও আমার জন্য অত্যন্ত লজ্জার। আমরা মেয়েরা বাস থেকে নেমে ফ্রেশ হতে লেডিস ওয়াশরুমে ঢুকলাম। আমি আগেই বাস থেকে নেমে গেছিলাম কারণ জানতাম ঈশান বাস ফাঁকা হওয়ায় সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে। তাই আমি অতি দ্রুত নেমে গেছি যাতে ঈশান আমার নাগালই না পায়। কিন্তু আমি যদি চলি ডালে ডালে তাহলে ঈশান কিন্তু মোটেও পাতায় পাতায় চলবে না। সে সরাসরি ডাল ভেঙে আমার চলার পথ বন্ধ করে দেবে। সেটাই করল। মা, রুবা আন্টি, মোহনা আন্টি, সামিয়া, রেহেনা, আনিকা, নীরা, সবাইকে উপেক্ষা করে ঈশান লেডিস ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। তাকে দেখে সবার দৃষ্টি বিস্ফোরিত। মোহনা আন্টি কপালে ছত্রিশ ভাজ ফেলে বললেন,” ছিঃ ঈশান, তোর এখানে কি কাজ?”

ঈশান চোখে হাত রেখে বলল,” আমি কারো দিকে তাকাচ্ছি না। শুধু তারিনকে লাগবে। ওর সাথে আমার কথা ছিল৷ তারিন তুমি বের হও।”

এই কথা শুনে আনিকা আর সামিয়া আমার দিকে এমন দৃষ্টিতে চাইল যেন খেয়ে ফেলবে। আমি দ্রুত বাথরুমে ঢুকে পড়তে চাইলাম। নীরা চট করে আমার হাত ধরে ফেলল। যেন চোর ধরে ফেলেছে এমনভাবে বলল,” এইযে ধরেছি, নিয়ে যাও ঈশান ভাই।”

আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। মোহনা আন্টি বললেন,” তারিন, প্লিজ তুমি যাও। নাহলে দেখা যাবে ঈশানও যাচ্ছে না।”

শেষমেষ আমাকে বের হতেই হলো। পরিচিতদের মধ্যে যারা অপরিচিত ছিল তারা কিভাবে যেন তাকাচ্ছিল, হাসছিল। আমার এতো লজ্জা লাগল! ঈশান আমাকে নিয়ে হোটেলের বাইরে চলে এলো। নীরব একটা জায়গায় আমরা দাঁড়ালাম। ঠান্ডা বাতাসে শরীর জমে যাচ্ছে। আমি নিজেকে গুটিয়ে রেখেছি। ঈশান আমার গায়ে জ্যাকেট জড়িয়ে দিয়ে বলল,” ঠান্ডা লাগছে তোমার? এটা পরো।”

আমি ধমক দিয়ে বললাম,” রাখুন আপনার এটা, আমার লাগবে না।”

ঈশান কোমল গলায় বলল,” এখনও রেগে আছ?”

আমি চোখ বড় করে বললাম,” আপনি তো রাগার মতো কাজই করে যাচ্ছেন তাহলে আমি রাগব না কেন? রাগ কমানোর বদলে শুধু বাড়ছে।”

ঈশান হতাশ নিশ্বাস ছাড়ল,” তাহলে কি করলে তোমার রাগ কমবে?”

” আপনি দূরে থাকুন। এইরকম লোক দেখানো ড্রামাবাজি বন্ধ করুন। সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। না জানি কি ভাবছে! আপনি মায়ের সামনে, মোহনা আন্টির সামনে এমনকি অপরিচিত সবার সামনে সিন ক্রিয়েট করে যাচ্ছেন। এসব কি? এগুলো বন্ধ করুন, প্লিজ।”

ঈশান হাত উঁচু করে আমাকে থামানোর উদ্দেশ্যে বলল,” আচ্ছা, কুল, কুল। সব বন্ধ করব। কিন্তু তার আগে তুমি আমার সঙ্গে কথা বলা শুরু করো।”

” কেন কথা বলা শুরু করব? আপনি আমার সাথে মিথ্যা বলেছেন। এখনও ঠিক করে ক্ষমা চাননি। যতক্ষণ আমি মন থেকে আপনাকে ক্ষমা করতে না পারব ততক্ষণ কথাও বলতে পারব না। ”

ঈশান বেদনাভরা মুখে মাথা নিচু করে রইল। আমি চলে যেতে নিলাম। তারপর আবার ফিরে এসে বললাম,” আর শুনুন, এসব সিন ক্রিয়েট করা বন্ধ করুন। মানুষ ভুল বুঝবে। ”

ঈশান আমার কথার কি অর্থ বের করেছিল আল্লাহ মালুম। হোটেলে যখন আমরা সবাই খেতে বসলাম তখন সে যেটা করল সেটা আমি জীবনে ভুলব না। সবাই তাঁক লেগে গেল৷ আমার মনে হয় হোটেলে যারা অপরিচিত ছিল তাদের জন্যেও এই ঘটনা একটি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। হঠাৎ করেই ঈশান মাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল হোটেলের রিসেপশনে। সে মাইক কোথ থেকে পেল সেটা আমার মাথায় তখনও আসেনি। ঈশান সরাসরি মাইকে বলল,” এটেনশন প্লিজ! এই মুহূর্তে এখানে যারা উপস্থিত আছেন তাদের সবাইকে মন থেকে জানাই শুভেচ্ছা। আজকে সকাল থেকে শুরু হয়েছে আমার মনখারাপ দিবস।আপনাদের কারণে আমার মন ভালো হতে যাচ্ছে। মন ভালো করার আগে মন খারাপ হওয়ার ঘটনাটা বলা জরুরী। আমার একটা ভীষণ মিষ্টি গার্লফ্রেন্ড আছে। কাল থেকে আমার সাথে সে একদম কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। আমার দিকে তাকাচ্ছেও না, এমনকি হাসছেও না। সারাক্ষণ গোমরা মুখে তাকে দেখতে দেখতে আমার মনের ভেতরটাও গুমরে গেছে। আমি চাই সে আমার দিকে চেয়ে হাসুক, অন্তত একবার! তার প্রাণ খোলা হাসি পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি। এখন সবাই নিশ্চয়ই ভাবছেন, আমি এসব মাইকে এসে এভাবে কেন বলছি? কারণ আমি চাই আপনারা আমাকে সাহায্য করুন। আমার গার্লফ্রেন্ডকে অনুরোধ করুন যেন সে আমাকে ক্ষমা করে দেয়। যার অনুরোধে কাজ হবে, সে পাবে আমার কাছ থেকে এত্তবড় মিষ্টির হাড়ি।”

আমি কপালে হাত রাখলাম। ঈশানের হাতে বড়সড় একটা হাড়ি। নিশ্চয়ই হোটেলের মিষ্টির দোকান থেকে কিনেছে! ঈশানের কথা শেষ হওয়া মাত্র হাসির রোল পড়ে গেল চারদিকে। সবাই হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল, “কে সেই গার্লফ্রেন্ড? ”

আমি পারলে নিজের মাথা হ্যান্ডব্যাগে ঢুকিয়ে বসে থাকি। পরিচিত যারা ছিল, তারা সবাই আমার দিকে আঙুল তাঁক করল। উপহারের লোভে হোক কিংবা ঈশানের কান্ড-কারখানায় মুগ্ধ হয়েই হোক সবাই আমার কাছে এসে অনুরোধ শুরু করল যেন আমি ঈশানকে ক্ষমা করে দেই। এমনকি হোটেলের ওয়েটার পর্যন্ত আমার কাছে এসে বলল,” ম্যাডাম প্লিজ, স্যারের দিকে তাকিয়ে একবার হাসুন। স্যার বলেছে আপনি হাসলে নাকি আজ এখানে সবার বিল স্যার নিজেই দিবেন।”

এই কথা শুনে একজন পেটুক, মোটা আঙ্কেল শিষ বাজালেন। বাকিরা আমাকে হাসানোর নানা কৌশল খাটাতে লাগল। বিষয়টা এখন সবার কাছে একটা মজার খেলায় পরিণত হয়েছে। আমি কি করব বুঝতেই পারছিলাম না। শেষমেষ সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আমার হাসি পেয়েই গেল। যখন আমি হাসছিলাম, নীরা আমার মুখটা ঈশানের দিকে ঘুরিয়ে দিল। ঈশান উল্লাসী কণ্ঠে বলল,” ইয়েস! আজকে সবার জন্য আমার পক্ষ থেকে ফ্রী মিষ্টি। যে যত খুশি খান। ”

সবাই হৈহৈ করে উঠল। মুহূর্তেই পরিবেশ বদলে গেল। এতোগুলো অপরিচিত মানুষ নিমেষেই আমাদের পরিচিত হয়ে উঠল৷ এমনভাবে আমরা মজা করে সময় কাটালাম যেন সবাই একটা ফ্যামিলি। চলে যাওয়ার সময় আমরা বিদায়ও নিলাম। ঈশানের এই একটা কাজ আমার সত্যিই পছন্দ হয়েছে। হুট করে ঝিমিয়ে থাকা বিষাক্ত একটা গড়পড়া পরিবেশ কেউ এভাবে মাতিয়ে তুলতে পারে আমার ধারণাই ছিল না। ঈশান শুধু একা আমার মন ভালো করেনি, সবার মন ভালো করে দিয়েছে। আমি বাসে উঠার আগে ঈশানের সঙ্গে নিরালায় এলাম৷ তাকে প্রশ্ন করলাম,” এমন বুদ্ধি আপনার মাথায় কেন এলো? নেহায়েত সবাই মজা পেয়েছে। কিন্তু যদি ট্রল করতো?”

ঈশান দায়সারা হয়ে বলল,” ট্রল করবে কেন? তুমিই তো বলছিলে, সবাই নাকি আমার কান্ড দেখে ভুল বুঝবে। তাই আমি একদম মাইক নিয়ে সবার সামনে দাঁড়িয়ে সঠিক ব্যাপার বুঝিয়ে বললাম! যেন কারো মাঝে কোনো কনফিউশন না থাকে, তার তোমার রাগও না থাকে।”

আমি হেসে ফেললাম। ঈশানের বাহুতে হালকা করে চাপড় দিয়ে বললাম,” আর মাইক কোথায় পেয়েছেন?”

ঈশান আঙুল দিয়ে ভ্রু এর একপাশ চুলকে বলল,” নিহাদের রিসিপশনের অনুষ্ঠানের জন্য মাইক, সাউন্ডবক্স সব আলাদা করে একটা ব্যাগে আনা হয়েছিল৷ রিফাত আমাকে সেখান থেকে মাইক বের করে দিয়েছে।”

আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম,” বুদ্ধিটা তাহলে রিফাত ভাইয়ের ছিল?”

” না, না, আমারই বুদ্ধি ছিল। আমি শুধু রিফাতের কাছে মাইক ধার চাইলাম।”

আমি খিলখিল করে হেসে উঠলাম। ঈশান ফিসফিস করে বলল,” এখন আমার মন ভালো লাগছে। মাথা ঘুরছে না, চোখে ঝাপসাও দেখছি না। পুরোপুরি সুস্থ আমি!”

শীতের সকালে সূর্যের উত্তাপ হয় কুয়াশায় আবছা সুন্দর। ঝাপসা ঝাপসা শীতল আমেজ নিয়ে প্রবেশ করি আমরা সিলেট শহরে। রাতে একটু চোখ লেগে এসেছিল। আপাতত আমি জানালার কাছে বসেছি। আমার পাশের সিট ফাঁকা। বুড়ি মায়ের সাথে গিয়ে বসেছে। কারণ তার ঔষধপত্র সব মায়ের ব্যাগে। সকালে নাস্তা করার পর সে মায়ের থেকে চেয়ে ঔষধ খাবে। বুড়ির নাকি এখনি প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে।।

নিহা আমার পাশে এসে বসল। ঘুমের কারণে চোখ এখনও খুলতে পারছে না। মাঝরাতে বাস যখন যাত্রা বিরতিতে থেমেছিল, তখনও নিহা আর সাফিন ভাই ঘুমিয়ে ছিল। আমরা সবাই নামলাম, শুধু তারা দু’জন নামল না। আর তারা এতো সুন্দরভাবে একে-অপরের কাঁধে, মাথায় ঢলে পড়ে ঘুমাচ্ছিল যে আমাদের ডাকতেও ইচ্ছে হয়নি। আমি নিহাকে প্রশ্ন করলাম,” ঘুম কেমন হয়েছে?”

নিহা আড়মোড়া ভেঙে বলল,” ভালো। একদম হুশই ছিল না। তোরা নাকি খুব মজা করেছিস? নীরাদের কাছে তো শুনলাম ঈশান ভাইয়ের কান্ড-কারখানা।”

আমি লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসলাম। আমার গাল লাল হয়ে গেল। নিহা আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কাঁধে মুখ ঠেঁকিয়ে বলল,” ঈশান ভাই তোকে প্রচন্ড ভালোবাসে, তারু। আমি তো তোর বয়ফ্রেন্ড হিসেবে এমন একটা রাজপুত্রই কল্পনা করেছিলাম।”

আমার চোখে অশ্রু জমে উঠল। মনে মনে ভাবলাম,” আসলেই সে রাজপুত্র। ঠিক যেমন রূপকথায় থাকে…”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here