তি_আমো,৪১,৪২

0
419

#তি_আমো,৪১,৪২

পর্ব ৪১
লিখা- Sidratul Muntaz

সন্ধ্যায় বার-বি-কিউ পার্টি। পরিকল্পনা অনুসারে জঙ্গলে ক্যাম্প-ফায়ারের ব্যবস্থা হয়েছে। পোড়া মাংসের মশলাদার সুঘ্রাণে জমে উঠেছে পরিবেশ। আমরা মেয়েরা সবাই মাদুরে বসেছি। ছেলেরা চেয়ার-টেবিল পেতে ক্যারাম খেলছে। জামশেদ নামের লোকটি এদিকে নেই। তিনি ঘরের ভেতরে সন্ধ্যা থেকেই নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুমিয়ে আছেন। সেজন্য নিহার মনটা খুব খারাপ। সে লোকটার সঙ্গে বাড়ির বিষয়ে কথাই বলতে পারেনি। আমি নিহাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে বললাম,” থাক, মনখারাপ করিস না৷ এখন থেকে তো তুই এখানেই মানে সিলেটেই থাকবি। যখন ইচ্ছা এই গেস্ট হাউজে চলে আসতে পারবি। আর লোকটার সঙ্গে দেখা করাও তেমন কঠিন কাজ হবে না।”

নিহা দ্বিধান্বিত স্বরে বলল,” কিন্তু তারিফ ভাই বলছেন এই লোক নাকি জার্মানি থাকেন। একবার চলে গেলে বছরের পর বছর কেটে গেলেও আসেন না। কালও নাকি চলে যাবেন। এই লোকটাকে এখানে রাখার ব্যবস্থা কর না, তারু!”

” আমি কিভাবে ব্যবস্থা করব? আমি বললেই কি এই লোক এখানে থেকে যাবে? আজব!”

অবজ্ঞার সুরে কথাটি বলে জুসের গ্লাসে চুমুক দিলাম। নিহা ঠোঁট উল্টে কিছু একটা চিন্তা করছিল। হঠাৎ ফট করে বলে উঠল,” আইডিয়া পেয়েছি। তুই বিয়ে কর।”

নিহার কথায় আমি বিষম খেলাম। নাকে জুস ঢুকে এতো জোরে কাশি পেতে লাগল যে চোখমুখ লাল হয়ে এলো। নিহা আমার মাথায় আলতো দু-একটা চাপড় মেরে দিল। আমি তার হাত সরিয়ে রোষাবিষ্ট কণ্ঠে বললাম,” তুই কি বললি আমাকে এটা? ওই বুড়ো ভামকে আমি বিয়ে করব? ছিঃ! এতো ফালতু কথা তুই আমার সাথে কিভাবে বলতে পারলি?”

আমার রেগে যাওয়া দেখে নিহা ভ্যাবাচেকা খেল। কয়েক মুহূর্ত হাঁ করে চেয়ে থেকে পানসে কণ্ঠে বলল,” যা বাবা, আমি তোকে ওই ব্যাটাকে বিয়ে করতে বলব কেন আজব! আমি বলেছি তুই আর ঈশান ভাই বিয়ে কর। তাহলে ওই লোক তোদের বিয়ে উপলক্ষ্যে থেকে যাবে। কাল সকালে তার যাওয়াটা ক্যান্সেল হবে আর কি!”

আমি শান্ত হলাম। মৃদু কণ্ঠে বললাম,” ও আচ্ছা। তো এটা বুঝিয়ে বলবি না?”

” বুঝিয়ে বলার কি আছে? আমি কি জানি তোর চিন্তা-ধারায় যে এমন গলদ? ওই বুইড়া ব্যাটার সাথে আমি তোকে বিয়ে করতে কেন বলব? কি আজব!”

আমাদের কথা-বার্তা শুনে বাকিরা হাসতে লাগল। আমি লজ্জিত ভঙ্গিতে জুসের গ্লাসে চুমুক দিলাম। রেহেনা বলল,” নিহার আইডিয়াটা কিন্তু খারাপ না তারু। তোমরা যেহেতু বিয়ে করবেই, এই সিলেটেই বিয়ে করে ফেলছ না কেন? ঈশান ভাইও তোমাকে প্রপোজ করে দিল। আবার তোমার ভাইয়াও চলে এলো। আমরা সবাই এখানে আছি। তাহলে বিয়ে করতে প্রবলেম কি?”

আমি হাসার ভাণ ধরে সংকুচিত কণ্ঠে বললাম,” আমার তো কোনো প্রবলেম নেই। এখন বড়রা যদি বিয়ের ব্যাপারে কিছু না বলে তাহলে আমার কি করার আছে বলো?”

আমার বেখেয়ালে বলা এই কথাতেই সবার মাঝে হল্লা-হল্লি শুরু হলো। সবাই উৎসাহী ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠল। নিহা আমার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল,” এইবার বুঝেছি। তুই তাহলে লজ্জায় তারিফ ভাইকে বিয়ের কথা বলতে পারছিস না, তাইতো? আরে এটা আমাকে বললেই হতো! আমি আছি তো! আমি থাকতে তোর এতো চিন্তা কিসের?”

আমি বিপর্যস্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম,” তুই আছিস মানে? কি করবি তুই?”

” তারিফ ভাইয়ের সাথে কথা বলবো।”

আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে নিহার হাত চেপে ধরে অনুরোধ করলাম,” এসব করার দরকার নেই। ভাইয়া ভাববে আমি তোকে শিখিয়ে দিয়েছি।”

নিহা আমার হাত ছাড়িয়ে বলল,” তোর ভাইয়া এমন কিছু ভাববে না। আমি সেভাবেই বলব। টেনশন নট মাই ডার্লিং!”

আমি আগেও বলেছিলাম, নিহা একবার যেটা বলে সেটা করেই ছাড়ে। পৃথিবীর সব ধরণের পাগলামির কাজ এই মেয়ের পক্ষে সম্ভব। ভাইয়াকেও সে রাজি করিয়েই ছাড়ল। নিহার কথা-বার্তা আর যুক্তি শুনে ভাইয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল আগামীকাল এই গেস্ট হাউজেই আমার গায়ে হলুদ আর মেহেন্দীর অনুষ্ঠান হবে। এই খবর শুনে সবাই উল্লাসে চিৎকার দিল। ছেলেরা ‘ওয়াও’ বলে করতালি বাজাতে লাগল। আমাকে আর ঈশানকে ‘অভিনন্দন’ জানানো হলো। কিন্তু এতোকিছুর মাঝে বাঁধ সাধল ঈশান। ভদ্র কণ্ঠে সে বলল,” কিন্তু মম তো এখানে নেই। ”

তারিফ ভাই ঈশানের দিকে চেয়ে সন্দিহান গলায় বলল,” তোমার মম বিয়েতে রাজি আছে তো?”

ঈশান উত্তর দেওয়ার আগেই পেছন থেকে অতি উৎসাহ নিয়ে জবাব দিল রিফাত ভাই,” রাজি মানে? অনেক বেশি রাজি। আপনার অপেক্ষাতেই তো মোহনা আন্টি দেরি করছিলেন। নাহলে তিনি নিজেই বিয়ে দিয়ে দিতেন ওদের। ”

তারিফ ভাইয়া সহজ হেসে বলল,” আমার অপেক্ষাতেই যদি থাকেন.. তাহলে তিনি চলে যাবেন কেন?”

আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম। ঈশান বিব্রত কণ্ঠে বলল,” ইমারজেন্সী ছিল হয়তো। মম অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।”

তারিফ ভাইয়া সোজাসাপ্টা গলায় বলল,” তুমি এখন কি করতে চাও ঈশান?”

” আমার মনে হয় মমের সাথে ডিসকাস করে নিলে ভালো হতো। ভাইয়া, আমি মমকে ফোন করে আপনার সাথে কথা বলতে বলি?”

” দরকার নেই। তুমি তোমার মমকে এখানে আসতে বলো।”

ঈশান ফোন করার পরেও মোহনা আন্টি আসতে রাজি হলেন না। কিন্তু তিনি অনুষ্ঠান করার অনুমতি দিলেন। আমি বললাম,” এটা কিভাবে হয় ঈশান? মোহনা আন্টিকে ছাড়া আমরা কিভাবে অনুষ্ঠান করব? তিনি কেন আসবেন না? যদি তিনি না আসেন তাহলে আমরা সবাই ওই বাড়িতে যাবো। অনুষ্ঠান সেখানে হবে।”

তারিফ ভাইয়া বাঁজখাই গলায় বলল,” না। অনুষ্ঠান এখানেই হবে। এটাই একদম পারফেক্ট প্লেস। ছবি তোলার জন্যেও বেস্ট এই জায়গা।”

” তাহলে মোহনা আন্টি?”

ঈশান আমার দিকে তাকিয়ে বলল,” আমি ঠিক করেছি সকালে গিয়ে মমকে নিয়ে আসব। ”

আমি আগ্রহী গলায় বললাম,” তাহলে আমিও আপনার সঙ্গে যাবো।”

নিহা হাত তালি বাজিয়ে বলল,” প্রবলেম তাহলে সোলভ। আজকে রাতে আমরা এখানেই থাকছি। ইয়ে!”

নীরা উল্লাসিত কণ্ঠে বলল,” সাচ আ বিউটিফুল প্লেস! আমার অনেক খুশি লাগছে..”

নিহা নীরাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,” এই বিউটিফুল প্লেস খুব জলদি আমাদের হবে।”

নীরা করুণ গলায় বলল,” ইনশাআল্লাহ। ”

আমি তাদের কথা শুনে হাসছিলাম। কিন্তু মনে মনে একটা দুশ্চিন্তা কাজ করছিল। আমি জানি, ঈশানও আমার মতো দুশ্চিন্তায় আছে। মোহনা আন্টি হুট করে চলে গেলেন। তিনি অনুষ্ঠানেও আসতে চাইছেন না। সবকিছুর পেছনেই জামশেদ নামক লোকটার হাত আছে বলে আমার মনে হয়। কিন্তু এই ব্যাপারটা আমি ঈশানকে বলতে পারছি না। কারণ এমনিতেই সে লোকটার উপর ক্ষেপে আছে।

আমি বাড়ির ভেতরে ঢুকে একটা ফাঁকা ঘরে বসলাম। ছোট্ট বিছানার পাশে ল্যাম্পশেড আর টেবিল। টেবিলের উপর সিগারেটের কিছু প্যাকেট আর মোবাইল ফোন। এগুলো ভাইয়ার জিনিসপত্র। কিছুক্ষণ আগেও ভাইয়া এখানে ছিল। আমি বাথরুম থেকে বের হতেই মনে হলো, মোহনা আন্টিকে এখন একটা ফোন করা উচিৎ। হতে পারে তিনি আমাকে কিছু বলবেন।

যেই মানুষটি আমার আর ঈশানের বিয়ে নিয়ে এতো উৎসাহী ছিলেন তিনি হঠাৎ অনুষ্ঠানেই আসতে চাইছেন না। কেন? একটা বড়সড় ঘাপলা তো আছেই। আর আমি নিশ্চিত, জামশেদ নামক লোকটিই সকল সমস্যার মূল। এই বিষয়ে কি আমি সরাসরি মোহনা আন্টিকে প্রশ্ন করব? কিন্তু তিনি যদি রেগে যান? মোহনা আন্টি ঈশানের মতো রাগবেন বলে মনে হয় না। তিনি তো খুব নরম স্বভাবের।

আমার মোবাইলে ব্যালেন্স ছিল না। তাই আমি ভাইয়ার মোবাইল নিয়ে মোহনা আন্টির নাম্বারটা ডায়াললিস্টে তুলে নিলাম। তারপর যেটা দেখলাম সেটা নিতান্তই অবিশ্বাস্য একটি ব্যাপার। আমার দুনিয়া থমকে গেল এক মুহূর্তের জন্য। মনে হলো, আমি বুঝি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি। বুকের মধ্যে অগ্নিকুন্ডের মতো কিছু একটা বিঁধে গলা অবধি উঠে এলো। ভাইয়ার ফোনে মোহনা আন্টির নাম্বার আগে থেকেই সেইভ করা। আমি স্তব্ধ হলাম নামটি দেখে। মাধবীলতা! আমার চোখের সামনে নাম্বারটা আমি দুইবার মিলিয়ে নিলাম। হ্যাঁ, এটাই মোহনা আন্টির নাম্বার। আমাদের কাছে যিনি মোহনা আন্টি, ভাইয়ার কাছে তিনি মাধবীলতা। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম কিয়ৎক্ষণ।

আমাদের জীবনে কত-শত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যায়। কিন্তু তাই বলে বুঝি নিয়তিকে এতোটাই নিষ্ঠুর হতে হবে! যে মেয়েটির জন্য ভাইয়া পনেরো বছর আগে ত্যাগ করেছিল সব সুখ, স্বপ্ন, আশা, সেই মেয়েটিই মোহনা আন্টি! আমার চোখ থেকে একফোঁটা জল অচিরেই গড়িয়ে পড়ল। মিশে গেল ফোনের স্ক্রিনে।

চলবে

#তি_আমো
পর্ব ৪২
লিখা- Sidratul Muntaz

উপরের দ্বিতীয় বেডরুমে বুড়ি আর ফাহিম ভাই জমিয়ে গল্প করছে। এই বাড়িতে যে কেয়ার টেকারের পরিবার থাকেন, তাদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে মা। ডিনারের আয়োজনও করছে মা। মাঝে মাঝে রেহেনা অথবা নীরা এসে মাকে সাহায্য করছে। আনিকা আর সামিয়া ইউটিউবে ভ্লগ তৈরী করতে ব্যস্ত। তারা কিছুক্ষণ আগে বাইরেও যেতে চেয়েছিল; সিয়াম ভাইয়া আর রিফাত ভাইয়াকে নিয়ে। কিন্তু তারিফ ভাই নিষেধ করে দিল। পরামর্শ দিল সকালে যাওয়ার। এই নিয়ে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে আনিকা আর সামিয়া। তারা ভাইয়াকে একদম সহ্য করতে পারছে না। যেমনটা আমাকেও সহ্য করতে পারে না।

বুড়ি যে ঘরে বসেছিল, আমি সেখানে গেলাম৷ ফাহিম ভাই বুড়ির সাথে তার মেয়ে বেস্টফ্রেন্ডের বিষয়ে গল্প বলছে। আর বুড়ি সেই মেয়েটিকে গালা-গাল দিয়ে চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছে। মেয়েটি নাকি ফাহিম ভাইয়ের সরলতার সুযোগ নিয়ে অনেক টাকা হাতিয়েছে, প্রতারণা করেছে। তারপর হুট করেই যোগাযোগ বন্ধ করে শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত ফাহিম ভাই মেয়েটির প্রেমে পড়েনি। যদি প্রেমে পড়তো তাহলে নির্ঘাত একটা জটিল ছ্যাঁকা খেতো। বুড়ি আনন্দিত গলায় বলল,” আলহামদুলিল্লাহ! ভালা করছ ওই ছেড়ির লাইগা পাগল হওনাই। এসব নইট্টা ছেড়িগো তো কামই এমন। ব্যাডা ধরবো, তারপর টাকা-পয়সা হাতায় লইয়া ভাগবো। আর এইসব নইট্টা ছেড়িগো লগে মিশবা না। এডি একদম ভালা না।”

ফাহিম ভাই গর্ব করে বলল,” সেই মেয়ে আমাকে আবারও ফোন দিয়েছিল। সে নাকি ঢাকায় এসেছে, দেখা করতে চায়। আমি ব্লক করে দিয়েছি। ঠিক করেছি না দাদী মা?”

” একদম ঠিকই আছে। ফাস্ট কেলাস কাম করছ। তুমি খুব ভালা পোলা। এসব নইট্টা ছেড়িগো পিছে ঘুইরা সময় নষ্ট করনের কাম নাই। তুমি একটা লক্ষী মন্ত মাইয়া দেইকখা বিয়া করবা। আমার নাতনির বিয়া ঠিক না হইলে তোমার লগেই বিয়া দিতাম।”

ফাহিম ভাইয়ের চেহারা আরক্ত হলো। লজ্জিত কণ্ঠে খানিকটা আক্ষেপ মিশিয়ে বললেন,” সেই সৌভাগ্য আমার নেই। আপনি যে বলেছেন এটাই অনেক।”

আমি ভেতরে ঢুকে কাশলাম। ফাহিম ভাই আমাকে দেখেই প্রসঙ্গ ঘুরানোর উদ্দেশ্যে বলল, ” আরে তারু। আসো, বসো না! তোমার দাদীকে কোম্পানি দিচ্ছিলাম৷ একা একা বসে আছেন। বললাম আমাদের সঙ্গে নিচে চলেন.. বার-বি-কিউ পার্টি হচ্ছে। কিন্তু তিনি যাবেন না। পোড়া মাংসের গন্ধ নাকি তিনি শুনতেই পারেন না।”

আমি মুচকি হাসলাম। বুড়ি সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” তুই কি কিছু কবিনি? বয় আমগো লগে..”

আমি দ্বিধাভরা গলায় আওড়ালাম,” তোমার সাথে একটু কথা ছিল দাদী..”

আমি আমার দাদীর সাথে আলাদা কথা বলতে চাই, ফাহিম ভাই বিষয়টা বুঝে নিল। সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” আমাকে মনে হয় কেউ ডাকছে। নীরা অথবা সামিয়া হবে.. আমি আসছি।”

ফাহিম ভাই চলে যেতেই আমি উদগ্রীব হয়ে বুড়ির সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসলাম। বিচলিত গলায় প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগলাম,” দাদী, বলো না দাদী! ভাইয়া যে মেয়েটিকে ভালোবাসতো সেই মেয়েটি এখন কোথায়? সে কেন ভাইয়াকে ছেড়ে চলে গেল? ভাইয়া সেই মেয়েটিকে ফেরানোর চেষ্টা করেনি? ভাইয়া কি তাকে এখনও মনে করে?”

বুড়ির আমার প্রশ্নগুলো সাথে সাথে বুঝল না। ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,” কার কথা কস?”

আমি ভারী কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম,” ওইযে.. মাধবীলতা!”

বুড়ির চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল। খিটমিট করে বলে উঠল,” ওই নডির কথা আমারে জিগাইতে আইছোস? সর সামনের থেকা। এসব কইলেও মুখ নোংরা হয়া যাইবো। ছি, ছি, ছি!”

আমি করুণ গলায় বললাম,” তুমি তাকে এতো ঘৃণা কেন করো দাদী?”

” ঘিন্না করমু না তো কি করমু? ওই নডি তো একটা ডাইনি। আমগো সংসারটা ধংস কইরা সাড়ছে৷ ওই নডির লাইগাই তোর বাপে মরছে। তোর ভাইয়ের জীবনটা কি হইছে দেখছোসনি? সব ওই ডাইনির লাইগা। পাগল করব এক পোলারে, বিয়া করব আরেক ব্যাডারে। নইট্টাগিরির একশেষ! ”

” কিভাবে হয়েছিল এসব? আমাকে বলো!”

” এতো কথা আমি জানি না। এডি আমি কইতে চাই না। তুই হঠাৎ আজকা এডি জিগাইতাছোস ক্যান? কি হইছে তোর? আয়েশা, আয়েশা, জলদি এদিকে আয়ো।”

আমার কলিজার পানি শুকিয়ে গেল। উতলা হয়ে বললাম,” মাকে ডাকছ কেন?”

” তুই এডি কইত্তে শুনছোস? তর মায়রে জিগামু।”

” মা কিছু জানে না। তোমরাই আগে বলা-বলি করতে। আমি শুনেছিলাম, সব মনেও আছে আমার। শুধু মাধবীলতা নামটা মনে পড়ছিল না। আজকে ভাইয়ার ফোনে…”

আমি থামলাম। আত্মার আকৃতি ছোট হয়ে গেল। জোরে জোরে লাফাতে লাগল হৃৎপিন্ড। বুড়ি বিস্মিত দৃষ্টিতে বলল,” ওই ছেড়ির লগে আইজও কথা হয় তারিফের? এল্লিগাই তো পোলা এহনো বিয়া করে না..”

আমি দ্রুত বললাম,” না। ভাইয়া কথা বলে না। আমি তো..”

বুড়ি আমার কথা না শুনেই চেঁচামেচি শুরু করল। আমি ভাবতেও পারিনি যে বিষয়টা এতো বিপজ্জনক হয়ে যাবে। মা ছুটে এলো। বিচলিত গলায় জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে?”

বুড়ি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে মাকে বলল সবকথা। মা আমার দিকে গরম দৃষ্টিতে তাকাল। আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। মা বুড়িকে শান্ত করে আমার হাত ধরে বলল,” এদিকে আয় তারু।”

বুড়ি বাঁজখাই গলায় বলল,” ওরে বোঝাও। ওই ডাইনির নাম যেন আর কখনও আমার সামনে না লয়। তাইলে ওরে আমি চড় মাইরা বয়রা বানায় দিমু। বেদ্দব!”

আমি ভয়ে শিটিয়ে গেলাম। মা আমাকে নিয়ে দ্রুত অন্যঘরে এলো। তারপর দরজা বন্ধ করেই প্রশ্ন করল,” এসব কি তারু? তুই হঠাৎ মাধবীলতার কথা কেন জিজ্ঞেস করলি তোর দাদীকে? তুই জানিস না তোর দাদী যে ওই মেয়ের নাম শুনতে পারে না?”

আমি কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম,” ওই মেয়ের তো কোনো দোষ ছিল না, মা। তোমরা শুধু শুধুই তাকে এতো ঘৃণা করো।”

মা আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি পিছিয়ে গেলাম। মা কটমট করে বলল,” আমার থেকে বেশি জানিস তুই? কে বলেছে ওই মেয়ের দোষ ছিল না?ওই মেয়ের জন্য আমার তারিফের জীবনটাই ছাড়খাড় হয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত তারিফ বিয়ে করেনি এমনকি সে বিয়ের কথাও শুনতে চায় না। ভালোবাসার উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাওয়ার মানে বুঝিস?”

আমি রুদ্ধ কণ্ঠে বললাম,” মা, তুমি কি জানো ওই মেয়েটি কে?”

” জানি। তোর মোহনা আন্টি।”

মায়ের কণ্ঠ একদম নির্বিকার। আমি বিস্ময়ের সুরে বললাম,” তুমি সব জানো?”

” জানব না কেন? তারিফ আমাকে না বলে থাকেনি।”

আমি কাঁদতে শুরু করলাম৷ মা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি কাঁদতে কাঁদতে নুইয়ে পড়েছি। হঠাৎ মাথা তুলে জানতে চাইলাম,” ভাইয়া কি তাহলে এজন্যই নিহাদের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল সেদিন? আমাদের কাউকে কিছু না জানিয়ে এভাবে এতোদিন যোগাযোগ বন্ধ করে রাখল এজন্য?”

” হ্যাঁ। ”

” তুমি তাহলে সব জানতে? তাহলে ভাইয়াকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিলে কেন? আমাকে কেন জিজ্ঞেস করলে ভাইয়া কোথায়?”

” আমি পরে জানতে পেরেছি।সিলেট আসার জন্য যেদিন আমরা বাসে উঠব সেদিন সন্ধ্যায় তারিফ আমাকে ফোন করেছিল। তারপর সবকিছু বলেছে।”

আমার মনে পড়ল, সিলেট আসার আগে মায়ের মনখারাপ ছিল। বাসে এতো মজার মজার কান্ড হয়েছে। কিন্তু মা একটুও হাসেনি। আমি কেন তখন খেয়াল করলাম না ব্যাপারগুলো?

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,” তাহলে এতোদিন কেন ভাইয়া চুপ ছিল? সেদিনই কেন তোমাকে বলল?”

” এতোদিন বলবে কি করে? সে তো আগে মোহনাকে চিনতে পারেনি। আমিও চিনতে পারিনি। কোনোদিন দেখা হয়েছিল নাকি তাদের?”

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম৷ মা বলে যেতে লাগল,

” পনেরো বছর আগের ঘটনা তারু। অনেক সময়। তখন তোদের মতো এমন ইউটিউব, ফেসবুক ছিল না। মানুষ এক জেলার থেকে অন্য জেলার মানুষের সাথে ফোনেই কথা বলতো। তারিফের সাথে মোহনার যোগাযোগ হয় কল সেন্টারের মাধ্যমে। তোর ভাই চাকরি করতো সেখানে। মোহনাই তাকে বার-বার ফোন করতো। তারপর ধীরে ধীরে তাদের প্রেম হয়। তারিফ সবই বলতো আমাকে। আমি ভেবেছিলাম ব্যাপারটা শুধুই টাইমপাস। কিন্তু তোর ভাই যে ওই মেয়ের জন্য এমন পাগল হয়ে যাবে সেটা আমি কি করে বুঝব? মোহনার বাড়িতে তখন বিয়ের কথা চলছিল। মোহনা একদিন বলল, তার যেকোনো সময় বিয়ে হয়ে যেতে পারে। তারিফ তখন মাত্র ইউনিভার্সিটিতে উঠেছে। বয়স বিশ কি একুশ। হঠাৎ আমায় এসে বলল,’ মা আমি বিয়ে করব। সিলেট যাচ্ছি বউ আনতে। দোয়া করো আমার জন্য।’ সেদিন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তুই তখন অনেক ছোট। তোর বাবা অসুস্থ। তোর দাদী এসব শুনলে আমাকে ঘর থেকেই বের করে দিবে। আমি মহাবিপদে পড়ে গেলাম। সারাটি রাত তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতাম যেন আমার ছেলেটা ফিরে আসে। ”

আমি চুপচাপ চোখের জল ফেলছি। কারণ এরপরের ঘটনাগুলো আমার জানা। ভাইয়া ঠিকই ফিরে এসেছিল৷ কিন্তু বহুদিন পর। ততদিনে ভাইয়ার নামে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া শুরু হয়েছে। বাবা ভাইয়ার শোকে স্ট্রোক করে মারা গেলেন। আমাদের পুরো পরিবারের অবস্থা দেউলিয়া। আমরা তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম৷ তারপর হঠাৎ করেই একদিন ভাইয়া উপস্থিত হলো। কাঁদতে কাঁদতে মাকে জড়িয়ে ধরে ভাইয়া শুধু একটা কথাই বলেছিল,” তারা অনেক বড়লোক মা। আমি তার যোগ্য না। কোনোদিন হতে পারব না। ”

সেদিন ভাইয়া কি ভীষণ কান্নাটাই না করেছিল! সেটাই ছিল ভাইয়ার শেষ কান্না৷ এরপর আর কোনোদিন ভাইয়াকে আমি কাঁদতে দেখিনি। কি আশ্চর্য! যে মেয়েটিকে ভাইয়া জীবনে কোনোদিন চোখের দেখা দেখল না তার শোক নিয়েই কাটিয়ে দিল পনেরোটি বছর। আর নিয়তি এতোই নির্মম যে, তাদের সত্যিই দেখা হলো। কিন্তু এমনভাবেই দেখাটা হলো কেন? যেই মুহূর্তে ভাইয়া বুঝতে পারল মোহনা আন্টিই মাধবীলতা, ঠিক সেই মুহূর্তে ভাইয়া সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে পালিয়ে গেল। সেদিন আমি আর ঈশান ভাইয়াকে গাড়িতে তুলে দিতে গিয়ে একবারের জন্যেও বুঝতে পারলাম না যে ভাইয়া কতটা চাপা কষ্ট নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি ঈশানই ভাইয়ার মাধবীলতার ছেলে এই কথা শুনে ভাইয়া কত কষ্ট পেয়েছিল কে জানে! তবুও ভাইয়া আমাদের বিয়ের অনুমতি দিয়েছে। অন্যকেউ হলে কি দিতো? এই মুহূর্তে আমি ভাইয়ার প্রতি কতটা শ্রদ্ধাবোধ করছি তা আমি নিজেও জানি না৷ একই সাথে ভাইয়ার জন্য আমার বুক পুড়ে যাচ্ছে। ইশ, তখন যদি ভাইয়াকে একবার আটকানো যেতো! অবশ্য আটকে রেখেই বা কি হতো? কষ্ট ছাড়া আর কি পেতো ভাইয়া? তখন আমি ঈশানকে পাওয়ার খুশিতে অন্ধ ছিলাম। তাই ভাইয়ার চোখের নিদারুণ কষ্ট দেখেও দেখিনি। এখনও কি আমার অন্ধ হয়ে থাকা উচিৎ?

আমি চোখের জল মুছতে মুছতে বললাম,” মা, তুমি তো জানো মোহনা আন্টির সাথে ঈমান আঙ্কেলের ডিভোর্স হয়ে গেছে। মোহনা আন্টি কখনোই ঈমান আঙ্কলকে মানতে পারেনি। কারণ সে ভাইয়াকে ভালোবাসে!”

মা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। ভর্ৎসনার সুরে বলল,” এসব ফালতু কথা বলিস না তারু। সে তারিফকে ভালোবাসলে ওই লোককে বিয়ে করল কেন? তোর ভাইকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল কেন? তার সামনে পর্যন্ত এলো না। মোহনার বাবা তোর ভাইকে কুকুরের মতো অপমান করেছিল। সব ভুলেও আমি ঈশানের সাথে তোর বিয়েতে মত দিয়েছি কেন জানিস? কারণ তারিফের মতো তোর পরিণতি হোক সেটা মা হয়ে আমি কিভাবে চাইব?”

মায়ের দৃষ্টি সিক্ত হয়ে এলো। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মোহনা আন্টি এমন করতেই পারেন না! তিনি কত কোমল, স্নেহময়ী, তিনি আমার ভাইয়ার সাথে এতো নিষ্ঠুর আচরণ কিভাবে করলেন? আমি খুব কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে আমার মাথা ধরে গেল। ফাঁকা একটা ঘরে আমি দরজা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে শুয়ে রইলাম। সবকিছু অসহ্য লাগছে। কারো সঙ্গে কথাও বলতে ইচ্ছে করছে না।

মোহনা আন্টির প্রতি এতোদিন আমার যত ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা ছিল, সবকিছু ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে যেন। আমি ভাইয়ার দুঃখে দুঃখবিলাস করছি। আর মোহনা আন্টির প্রতি অভিমানে আমার চোখ দিয়ে অহর্নিশ অশ্রুপাত হচ্ছে। আচ্ছা, মোহনা আন্টি যদি ভাইয়াকে ভালো না বাসে তাহলে কেন সেদিন আমাকে বলল, তিনি কারো জন্য অপেক্ষায় ছিলেন! অপেক্ষা কষ্টকর! ভাইয়া তো তার কাছে এসেছিল। তবুও সে কেন বলল, তার অপেক্ষা শেষ হয়নি? ভাইয়া আর মোহনা আন্টি ঝগড়ার পর হুট করেই যখন শান্ত হয়ে গেল তখনি খটকা লেগেছিল, বিশাল কিছু একটা ঘটে গেছে তাদের মাঝে। এখন আমি বুঝতে পারছি সেই বিশাল কিছুটা কি! হয়তো তখন মোহনা আন্টি ভাইয়ার ফোনে নাম্বার লিখতে গিয়েই খুঁজে পেয়েছিল নিজের নাম! ভাইয়াও বুঝতে পেরেছিল সব। তারপর দু’জন আর একটা শব্দও করল না। নিঃশব্দে একে-অন্য থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে নিল। আমি যখন মোহনা আন্টিকে সবকিছু বলতে গেলাম, তখন তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কিভাবে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন! সেটা কি অপরাধবোধের কান্না ছিল? নাকি ভাইয়াকে তিনি এখনও ভালোবাসেন?

দরজায় খটখট শব্দ হচ্ছে। আমি কান্না মুছে গলা পরিষ্কার করে বললাম,” কে?”

” আমি।” ভরাট কণ্ঠে শব্দ এলো। ঈশানের গলা। আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল। এই মুহূর্তে ঈশানের সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না। সে যদি আমাকে প্রশ্ন করে কেন কাঁদছি? তখন কি উত্তর দিবো? আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলতেই পারব না। সে সব বুঝে ফেলবে! ভয়ে বুকে কম্পন সৃষ্টি হলো আমার। ওইপাশ থেকে দরজায় খটখট শব্দ তুলে আবার ডাকল ঈশান,

” তারিন দরজা খোলো। অনেকক্ষণ ধরে ঘরে বসে আছো। কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ নাকি?”

‘ বেশি বেশি লেখা কমেন্ট করুন সবাই। পেইজের রিচ একদম কমে গেছে। কেউ পর্ব পায় না।’?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here