#তি_আমো,৪৩,৪৪
পর্ব ৪৩
লিখা- Sidratul Muntaz
” তারিন দরজা খোলো। অনেকক্ষণ ধরে ঘরে বসে আছো। শরীর খারাপ নাকি?”
” আমার মাথা ব্যথা করছে। ”
” হঠাৎ মাথাব্যথা কেন? মেডিসিন নিয়েছো?”
” না, এমনি শুয়ে আছি। সেরে যাবে।”
” দরজা খোলো।”
আমি চোখ-মুখ ঠিক করে মুছে নিয়ে দরজা খুলতে গেলাম। ঈশানের সামনে আমাকে একদম স্বাভাবিক থাকতে হবে; যেন বুঝতেই না পারে আমি কাঁদছি।দরজা খোলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঈশান আমাকে দেখে বলল,” কাঁদছিলে নাকি?”
আমি মনে মনে আৎকে উঠলেও স্বাভাবিক কণ্ঠে বলার চেষ্টা করলাম,” কই, নাতো!”
ঈশান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার গাঢ় কৌতুহলের সামনে অসহায় হয়ে আমি বাধ্য কণ্ঠে বললাম,” দাদী বকেছে।”
ঈশান এই কথা শুনে হেসে উঠল। আমি বেকুব হয়ে গেলাম৷ দাদী বকেছে এটা কি কাঁদার কোনো বিষয় হলো? ঈশান আমার চেহারার বিমর্ষতা লক্ষ্য করে হাসি থামিয়ে প্রশ্ন করল,” কেন বকেছে?”
আমি দরজার সামনে থেকে বিছানায় এসে বসলাম। যাক, ঈশান কথাটা বিশ্বাস করেছে। স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বললাম,” পরে বলব।”
ঈশান আমার পাশে এসে বসল। আমি তার চোখের দিকে ইচ্ছাকৃতই তাকালাম না। মাথা নুইয়ে চুপচাপ বসে আছি। একটু পর ঈশান আবার বলল,” মন কি বেশি খারাপ?”
আমি ঠান্ডা কণ্ঠে জবাব দিলাম,” ঈশান, আমার মন খারাপ না৷ শুধু মাথাব্যথা করছে।”
” তাহলে আমার দিকে তাকাও।”
আমি একটা অদ্ভুত কান্ড করলাম। ঈশানের দিকে তাকানোর বদলে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তার বুকে মাথা গুজলাম। ঈশান লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” এবার তো আমি হান্ড্রেড পারসেন্ট শিউর। কিছু একটা হয়েছে।”
আমি উত্তর দিলাম না। মনটা ভার হয়ে গেল। ঈশান বলল,” আচ্ছা, তোমার বলতে ইচ্ছা না করলে থাক।”
” ওকে।”
” এখন বলো আমি তোমার কে হই?”
হঠাৎ এই প্রশ্নে আমি একটু চমকালাম৷ তারপর ভেবে-চিন্তে বললাম,” আপনি হলেন আমার ভালো থাকা।”
” তাই?”
” উমম.. হুম।”
ঈশান তার দুই হাতে আমার মাথাটা উপরে তুলে অনুরোধ মিশ্রিত গলায় বলল,” এই তারিন, বলো না কি হয়েছে?”
আমি একটু ভেবে বললাম,” কি হবে?”
” আমি জানি না। কিন্তু তোমার মুখে হাসি নেই।”
আমি জোর করে হাসলাম। ঈশান দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,” হয়নি। এটা নকল হাসি।”
” তাহলে আসল হাসি কাকে বলে?”
” যেই হাসি মানুষের চোখ পর্যন্ত পৌঁছায় সেটা আসল হাসি।”
আমি বিভ্রান্ত হয়ে বললাম,” হাসি আবার কিভাবে চোখ পর্যন্ত পৌঁছাবে? কি মুশকিল!”
আমি এই কথা বলে অযথাই হাসতে লাগলাম।কিন্তু ঈশান হাসছে না৷ দৃঢ়চিত্তে বলল,” তোমার মন ভালো করার জন্য কি করতে পারি আমি?”
আমি একটু দুষ্ট কণ্ঠে বললাম,” কিস করুন।”
ঈশান একটু অবাক হলো। আমি লজ্জায় মাথা নিচু করতেই সে তুমুল গতিতে আমাকে কাছে টানল। আমি পড়িমরি করে ঈশানের কাঁধ খামচে ধরলাম। চোখ বড় বড় করে তাকালাম। ঈশান মুচকি হাসল। তার এমন হাসি দেখলেই লজ্জাময় আতঙ্ক জেগে উঠে মনে। সেই আতঙ্ক বাড়াতেই ঈশান তীব্র স্পর্শে আমার ঠোঁট আঁকড়ে ধরল। আমি কেঁপে উঠলাম হালকা। ভাবিনি সে সত্যি এটা করবে। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। মনে হলো, আমার শরীরের স্নায়ুগুলি তাদের যাবতীয় কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। আমি অসাড় হয়ে পড়লাম। ঈশান তার সবটুকু তৃপ্তি ঢেলে দিচ্ছে আমার ঠোঁটে। আমি ছটফট করছিলাম… কত পেরিয়ে গেল জানি না। হঠাৎ দরজার কাছ থেকে আওয়াজ এলো,
” এহেম এহেম, কেমিস্ট্রি ক্লাস চলছে নাকি?”
আমি আর ঈশান এলোপাতাড়িভাবে সরে পড়লাম দুই প্রান্তে। নিহা হাসতে শুরু করেছে। ঈশান অপ্রস্তুত ভাবে উঠে দাঁড়াল।
নিহা রসিকতাপূর্ণ কন্ঠে বলল,”ছোট একটা এডভাইজ দেই কেমন? এরপর থেকে দরজাটা একটু লাগিয়ে নিবেন। এমন খোলামেলা পরিবেশে ক্লাস করা ঠিক নয়।”
ঈশান শক্ত গলায় বলল,” আমিও তোকে একটা এডভাইস দেই। এরপর থেকে ঘরে ঢোকার আগে শব্দ করে ঢুকবি।”
নিহা ফিচেল হাসি দিয়ে বলল ” আমি বুঝি বেশি ডিস্টার্ব করে ফেললাম?এখন কি তাহলে আমাকে পানিশমেন্ট দেওয়া হবে?”
আমি মাথা নিচু করে হাসছিলাম। আবার লজ্জাও লাগছে। এই প্রথম নিহার সামনে লজ্জা লাগছিল।
ঈশান চলে যাওয়ার আগে ত্যাড়া গলায় বলে গেল,” আগে ম্যানার শেখ তুই, ম্যানারলেস।”
নিহা ন্যাকা কণ্ঠে বলল,” উফফ, ঈশান ভাইয়া দেখি খুব রেগে গেলেন… ”
ঈশান ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই সে খিলখিল করে হাসতে লাগল। আমি নিহার পিঠে জোরে একটা ঘুষি মেরে বললাম,” খুব মজা লাগছে তাই না?”
নিহা তেতে উঠে বলল,” মজায় তো আছিস তুই। বিয়ের আগেই হানিমুন শুরু করে দিয়েছিস একদম। ঈশান ভাইয়া কি রোমান্টিক.. আহা! আর আমার গাঁধাটাকে দ্যাখ! সকাল থেকে একবার খোঁজও নেয়নি। সারাক্ষণ ঈশান ভাইয়ের সঙ্গে থেকেও কিছু শিখতে পারল না।”
আমি আহ্লাদ করে বললাম,” আহারে, খুব দুঃখ তাই না?”
নিহা আমার চেয়েও দ্বিগুণ আহ্লাদ করে বলল,” হুম। অনেক দুঃখ।”
আমার হঠাৎ মনে পড়ায় জিজ্ঞেস করলাম,” আচ্ছা নিহা শোন, ভালোই হলো তুই এসেছিস। একটা কথা জানতে চাইছিলাম।”
” বল।”
” আজ সকালে যখন আমরা এখানে এলাম, তুই বাড়ি বিক্রির বিষয়ে কিছু বলতে চেয়েছিলি। ঈশান ভাইয়ের কারণে হয়তো বলিসনি।”
নিহা উত্তেজিত কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তখন আমি বলেছিলাম আমি কিছু জানি না। আসলে ঈশান ভাইয়ের সামনে এমনি বলেছিলাম। সত্যিটা তোকে এখন বলি। মোহনা আন্টি একটা ছেলের সাথে প্রেম করতো। সেই ছেলে এই বাড়ির ঠিকানা জানতো৷ এজন্যই বাড়ি বিক্রি করা হয়েছিল। ”
আমার হৃৎপিন্ড দিয়ে শীতল স্রোত প্রবাহিত হলো। আড়ষ্ট গলায় বললাম,” ওই ছেলে ঠিকানা জানলে কি প্রবলেম?
” আরে, প্রবলেম না? যদি এসে বিরক্ত করে? ছেলেটা তো একটা প্রতারক ছিল।
আমি অগ্নি কণ্ঠে বললাম,” তুই কেমন করে জানলি?”
নিহা মলিন কণ্ঠে বলল,” তুই মোহনা আন্টির সাথে কখনও এই বিষয়ে আলাপ করিস না, প্লিজ! তোকে আমি খুব সিকরেট একটা কথা বলতে যাচ্ছি।”
” আচ্ছা, বল।”
নিহা আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,” ওই ছেলেটা এসেছিল, যার অপেক্ষায় মোহনা আন্টি ছিল।”
” কবে?”
” অনেক আগের ঘটনা। বিয়ের আগে। মানে মোহনা আন্টির বিয়ের আগেই ওই ছেলেটা এসেছিল মোহনা আন্টির সাথে দেখা করতে। কিন্তু হামিদ নানা তাকে অপমান করে বের করে দিয়েছিল। সেই কথা মোহনা আন্টি আজও জানেন না। তিনি তো ছেলেটাকে প্রতারক ভাবেন। কিন্তু আমি মায়ের কাছে শুনেছিলাম। ছেলেটা প্রতারক নয়। সে মোহনা আন্টিকে বিয়ে করার জন্যই এসেছিল। কিন্তু ছেলেটা নাকি খুব দরিদ্র হওয়ায় হামিদ নানা তাকে পছন্দ করেননি। আর মোহনা আন্টির বিয়ের পর হামিদ নানা বাড়ি বিক্রি করেছেন এক প্রকার ভয়েই। ছেলেটা যদি আবার ফিরে আসে? এই বাড়ির ঠিকানা তো জানতো সে।”
” তাহলে এই কারণেই এতো সুন্দর বাড়িটা বিক্রি করে দিল? শুধুমাত্র গরীব বলেই ছেলেটাকে রিজেক্ট করা হলো? এভাবে একটা ভালোবাসা হেরে গেল টাকার কাছে!”
” এমনই তো জীবন।”
” ঈশানও কি এই কথা জানে?”
” হয়তো জানে। সে পুরোটা জানে কি-না তা আমি বলতে পারব না।”
” আমার ছেলেটার জন্য খুব খারাপ লাগছে। মোহনা আন্টি সারাজীবন তাকে প্রতারক ভেবে যাবে। কোনোদিন জানতেই পারবে না যে ছেলেটা এসেছিল তার কাছে। কিন্তু তার বাবাই ছেলেটিকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এটা কি অন্যায় নয়?”
” কিছু বিষয় না জানাই ভালো। এখন জানলেও আর কি? মোহনা আন্টি শুধু শুধুই আফসোস করবেন। ওই ছেলেকে তো আর খুঁজে আনতে পারব না আমরা।”
” এমনও তো হতে পারে যে ওই ছেলেটা এখনও বিয়ে করেনি। মোহনা আন্টির অপেক্ষায় আছে! চাইলেই কিন্তু মোহনা আন্টি তার কাছে ফিরে যেতে পারে।”
” হিন্দি সিনেমা নাকি? আর মোহনা আন্টি চলে গেলে ঈশান ভাইয়ের কি হবে?”
” ঈশান তো আর বাচ্চা নয় যে মা ছাড়া ম’রে যাবে। মোহনা আন্টি ঈশানের মা নয়। তাই তার কোনো দায়বদ্ধতাও নেই ঈশানের সঙ্গে থাকার।”
নিহা বিস্মিত গলায় বলল,” এটা তুই কি বললি তারু? স্বার্থপরের মতো কথা বলছিস। আপন মা না হলেও মোহনা আন্টি ছাড়া ঈশান ভাইয়ের এই পৃথিবীতে কেউ নেই। যদি মোহনা আন্টি চলে যায় তাহলে ঈশান ভাই অবশ্যই মরে যাবে।”
আমি চুপ রইলাম। আসলেই তো, ভাইয়ার কথা ভাবতে ভাবতে ঈশানের কথা আমি ভুলেই গেছিলাম। সেও মোহনা আন্টিকে খুব ভালোবাসে।সে কি করে থাকবে?
নিহা অবজ্ঞার সুরে বলল,” তাছাড়া ওই ছেলেটাও মোহনা আন্টির যোগ্য ছিল না। মোহনা আন্টি তাকে এতো ভালোবাসল, কিন্তু সে কি করল মোহনা আন্টির জন্য? শুধু ছুটে এলেই ভালোবাসা প্রমাণ হয় না। বিয়ের পর কিন্তু সে মোহনা আন্টির একবারও খোঁজ নেয়নি।”
আমি রোষপূর্ণ কণ্ঠে বললাম,” এমনও তো হতে পারে, ছেলেটা অতিরিক্ত শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তারপর সে নিজের বাড়িও ফিরতে পারেনি৷ কোনো সহৃদয়বান মানুষ তাকে হসপিটালে ভর্তি করিয়েছিল। দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থেকে সে যখন বাড়ি ফিরল, তখন সেদিকের অবস্থা খুব খারাপ। তার পরিবারটা অথৈ জলে ভেসে যাচ্ছে। বাবার মৃত্যু, মায়ের আহাজারি, ভালোবাসা হারানোর দুঃখ, সব মিলিয়ে নিদারুণ অবস্থা। ওই সময় সে কি সংসারের হাল ধরবে নাকি ভালোবাসার পেছনে ছুটবে? বাস্তবতা কি বলে? আবেগ দিয়ে তো আর পেট ভরানো যায় না।”
আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। নিহা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। আমি মুখে হাত দিয়ে কাঁদতে লেগেছি। একেবারে নিশ্বাস আটকে আসা কান্না। নিহা আমার বাহু চেপে ধরে উচ্চারণ করল,” তারু, কি হয়েছে তোর?
আমি নিহাকে জড়িয়ে ধরে সবকিছু বলতে লাগলাম। নিহা স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর একসময় সেও আমার মতো কেঁদে ফেলল।
গেস্ট হাউজের পেছনের জঙ্গলে জোরালো শব্দে গিটারের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ফাহিম ভাই গান গাইছে। ঈশান তাকে নিয়ে নাচছে। সবাই করতালি বাজাচ্ছে। আমি সেখানে গিয়ে বসলাম৷ নিহা কোমর দুলিয়ে নাচতে নাচতে বলল,” হঠাৎ এতো উৎসব কেন? কি হয়েছে সবার?”
সাফিন ভাই জবাব দিল,” তারুর নাকি খুব মনখারাপ। তাই ঈশানের অনুরোধে আমর ডান্স করছি। তুমিও আমাদের সাথে আসতে পারো।”
” না থাক, তোমরাই ডান্স করো। ”
নিহা আমার পাশে এসে বসল। ঈশান আর সাফিন ভাইয়ের নাচ দেখে আমরা হেসে পেট ব্যথা করে ফেলতে লাগলাম। পেছন থেকে শুনলাম সামিয়া কাঠখোট্টা স্বরে বলছে,” ঈশান ভাই দিন দিন চার্লি হয়ে যাচ্ছে। একটু বেশি বেশি ন্যাকামি। তারুর মন ভালো করার জন্য গাঁধার মতো নাচতে হবে নাকি? এটা কেমন কথা! রিডিকিউলাস!”
নিহা শুনতে পেয়ে ঠিক জবাব দিয়ে দিল,” প্রিয় মানুষকে হাসি-খুশি রাখা রিডিকিউলাস? আগে জানতাম না তো!”
আনিকা বলল,” হাসি-খুশি রাখা রিডিকিউলাস না। কিন্তু সবার সামনে এমন জোকারের মতো করা অবশ্যই রিডিকিউলাস। ”
নিহা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” তাও ভালো। ঈশান ভাইয়া তো শুধু জোকার সেজেছে। অন্যসব টক্সিক মানুষের মতো জাজমেন্টাল হয়নি। যারা কথায় কথায় দোষ ধরে আর হিংসায় জ্বলে।”
আনিকা রুঢ় স্বরে বলল,” এখানে কে হিংসায় জ্বলছে?”
” জানি না। কিন্তু আমি তো পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি। তারু তুই পাচ্ছিস না?”
আমি নিহাকে ইশারায় অনুরোধ করলাম, প্লিজ চুপ কর। নিহা খিটমিট করে বলল,” তুই কি ভয় পাস? যা বলবে তাই মেনে নিবি নাকি? জবাব দিবি না?”
আমি ফিসফিস করে বললাম,” যেখানে জবাব দিলে ঝগড়া হবে, সেখানে নিশ্চুপ থাকাই ভালো। ”
নিহা আমার গাল টিপে চুমু দিয়ে বলল,” এতো সুইট কেন তুই?”
বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়ায় বেশিক্ষণ নাচ দেখা সম্ভব হলো না। সবাই দৌড়ে ঘরে ঢুকে যেতে লাগল। কেবল যাচ্ছে না ঈশান। কেউ তাকে টেনেও ঘরে নিতে পারল না। সে মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজছে। আমিও ঈশানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,” ঘরে যাবেন না?”
” উহুম। এখানেই ভালো লাগছে আমার।”
” জ্বর আসে যদি?”
” বৃষ্টিতে ভিজলে আমার জ্বর আসে না৷ তোমার খারাপ লাগলে চলো ভেতরে চলে যাই।”
” না থাক, আমারও ভালো লাগছে।”
খুব জোরে বজ্রপাতের শব্দ হলো। আমি ঈশানকে জড়িয়ে ধরলাম। ঈশান হাসতে লাগল। আমি ফিসফিস করে বললাম,” আমি যদি আপনার কাছে কিছু চাই, আপনি কি দিবেন?”
ঈশান অকপটে বলল,” অবশ্যই দিবো। কি চাও বলো? তোমার জন্য জান কোরবান।”
” যদি আমি বলি আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি আমার জন্য ছেড়ে দিতে, আপনি কি পারবেন?”
ঈশান সন্দিহান গলায় বলল,” মমের কথা বলছ?”
আমি চমকে উঠলাম। মাথা তুলে তাকিয়ে বললাম,” আপনার এটা কেন মনে হলো?”
ঈশান একটু গম্ভীর হয়ে বলল,” কারণ মম ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই।”
বজ্রপাতের ওই শব্দটা আবার হলো। তবে এবার আকাশে নয়; আমার মনে।
চলবে
#তি_আমো
পর্ব ৪৪
লিখা- Sidratul Muntaz
ঈশান আমার হাত ধরে ব্রীজের কাছে নিয়ে এলো। ধুপধাপ শব্দে দৌড়াতে দৌড়াতে জিজ্ঞেস করল,” তুমি সাতার জানো?”
চারপাশে বৃষ্টির টাল-মাটাল শব্দ। হাওয়া বইছে উত্তালভাবে। অন্ধকারাচ্ছন্ন শব্দময় রাত। মেঘের গর্জন৷ আমি শুনতে পেলাম না ঈশানের কণ্ঠ। সে কি প্রশ্ন করল সেটাও বুঝলাম না। কোনোকিছু না বুঝেই মাথা নেড়ে বললাম,” হ্যাঁ। ”
তারপর যে কি হলো! ঈশান হুড়মুড়িয়ে আমার দিকে ধেঁয়ে আসছিল। আমি ভাবলাম সে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু ঈশান করল সবচেয়ে অদ্ভুত কাজ। আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঝিলে ফেলে দিল। আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম৷ ততক্ষণে ঈশান নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমি ডানা ভাঙা পাখির মতো তড়পাতে লাগলাম। মুখ দিয়ে পানি ঢুকে নাকানিচুবানি খাওয়ার অবস্থা। ঈশান মনের আনন্দে সাতরাচ্ছে। এদিকে আমার দম আটকে যাচ্ছে। ঈশান তা লক্ষ্য করেই দ্রুত আমার কাছে এলো। আমি তো ডুবেই যাচ্ছিলাম। পড়িমরি করে দুইহাতে ঈশানের কাঁধে ভর দিয়ে মুখ উপরে তুললাম। বড় বড় শ্বাস নিতে লাগলাম। ঈশান আমার কোমর চেপে ধরে উঁচু করে রাখল। আমার চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে। নিশ্বাস আটকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কাশতে লাগলাম জঘন্যভাবে। ঈশান বিস্ময়ের সুরে বলল,” তুমি সাঁতার জানো না?”
আমি সঙ্গে সঙ্গে দুইপাশে মাথা নাড়লাম৷ কড়া গলায় উচ্চারণ করলাম,” আপনি এটা কেন করলেন আমার সাথে? আরেকটু হলেই আমি মরে যেতাম..”
ঈশান চট করে আমার ঠোঁটে তার আঙুল চেপে ধরে বলল,” শশশ!”
তারপর তার কপাল আমার কপালে ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল,” মরবে কেন? আমি আছি না? ”
আমি হাসলাম। দুই পা দিয়ে ঈশানের কোমর জড়িয়ে ধরে বললাম,” ইয়েস। এখন আমার ভয় একটু কমেছে। জানেন? জীবনে এই প্রথমবার আমি পানিতে নেমেছি।”
” কি বলো? সত্যি?”
” হুম।”
” তাহলে তো পানির মজা তোমাকে বোঝাতেই হবে।”
ঈশান এই কথা বলে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম,” কিভাবে?”
” আমাকে শক্ত করে ধরে থাকো। সাতার কাটবো।”
আমি রুদ্ধ কণ্ঠে বললাম,” আমার ভয় লাগে।”
ঈশান আমাকে ভরসা যোগাতে বলল,” রিল্যাক্স! আমার উপর বিশ্বাস নেই?”
” আছে। কিন্তু পানির উপর বিশ্বাস নেই। নিজের উপরেও বিশ্বাস নেই।”
ঈশান হেসে ফেলে আমাকে নিয়েই দূর্দান্ত ভঙ্গিতে সাতার কাটতে লাগল। আমি তার গলা ধরে ঝুলে রইলাম। মনে হচ্ছিল এতো আনন্দ আমি কখনও পাইনি৷ সারাজীবন পানির মধ্যে থাকলেও এই আনন্দের স্বাদ মিটবে। হুট করেই খুব আফসোস হলো আমার। কেন মাছ হয়ে জন্মালাম না? ছোটবেলায় ফেইরিটেইল দেখে জলপরী হওয়ার ইচ্ছেটা আবার জেগে উঠল। ঈশান প্রশ্ন করল, ” কেমন লাগছে?”
আমি স্বপ্নময় কণ্ঠে বললাম,” খুব মজা। সুইমিং এতো দারুণ আমি তো জানতামই না। প্লিজ আমাকেও সুইমিং শেখান!”
” সুইমিং এ কষ্ট আছে। সাইকেল চালানোর চেয়েও বেশি কষ্ট। অন্যের উপর দিয়ে ভাসছ বলে টের পাচ্ছো না।”
” আহারে, আপনার বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে আমাকে নিয়ে সুইমিং করতে?”
” পরিশ্রম তো হচ্ছেই। কিন্তু ভালো লাগছে। এতো মজা করে আমি আগে কখনও সুইমিং করিনি।”
” সত্যি? তাহলে আমার আর সুইমিং শেখার দরকার কি? সবসময় না হয় এভাবেই আপনি আমাকে নিয়ে সুইমিং করবেন।”
ঈশান নিরামিষ কণ্ঠে বলল,” তবুও সুইমিং শেখা উচিৎ তারিন। সবসময় তো আমি লাইফ জ্যাকেট হয়ে পাশে থাকব না।”
আমি অভিমানী ভঙ্গিতে বললাম,” থাকতেই হবে৷ আপনি আমার লাইফ জ্যাকেট। সবসময় পাশে থাকবেন। আর আমি আপনার কি বলুন তো?”
ঈশান হাসতে হাসতে বলল,” লাফিং গ্যাস!”
আমিও হেসে উঠলাম। হঠাৎ শিষ বাজানোর শব্দ আর করতালির আওয়াজ শুনে আমরা দু’জনেই একটু চমকালাম। তারপর উপরে তাকিয়ে দেখলাম নিহা, সাফিন ভাই, নীরা, রেহেনা, রিফাত ভাই, সিয়াম ভাই, নাশফী আপু, সবাই বারান্দায় সমবেত হয়েছে। তারা আগ্রহ নিয়ে আমাদের সাঁতার কাটা দেখছে। লজ্জায় গাঁট হয়ে ঈশানের গলায় মুখ লুকিয়ে ফেললাম আমি। অথচ ঈশানের কোনো তোয়াক্কাই নেই। সে বরং হাত নাড়িয়ে সবাইকে ‘হায়’ বলছে। আমি হতভম্ব হয়ে তাকালাম। হঠাৎ ফ্ল্যাশ লাইটের আলো জ্বলে উঠল। নিহা শয়তানি করে আমাদের ছবিও তুলছে। রাগে ফুঁসে উঠে বললাম,” প্লিজ ওদের নিষেধ করুন। এসব কি?”
ঈশান প্রশমিত কণ্ঠে বলল,” থাক না, ছবি তোলাটা খারাপ কি? একটা মেমোরি থাকল।”
” ছবিতেই কেন মেমোরি থাকতে হবে? স্মৃতিতে থাকলে হয় না? এই ছবি আপনি কাকে দেখাতে চান?”
” আমাদের যখন বিয়ে হবে তখন বেডরুমের দেয়ালে টানানো থাকবে।”
” ছিঃ, অসম্ভব!”
উপর থেকে মিশ্র কণ্ঠদের আওয়াজ এলো, ” ঈশান ভাই থামলেন কেন? ক্যারি অন!”
” এতো রোমান্টিক সুইমিং কনটেস্ট আমরা আগে কখনও দেখিনি।”
বাকিরা খিকখিক করে হাসল। ছেলেদের মধ্যে কেউ বলল,” কনটেস্ট কেন বলছিস তোরা? এটা তো রোমান্টিক সুইমিং রোমান্স হচ্ছে!”
সবাই এই কথায় আরও জোরে হেসে উঠল। বৃষ্টির শব্দ আর হাসির শব্দ মিলে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরী হয়েছে। ফ্ল্যাশলাইট তখনও জ্বলছিল। নিহা উঁচু গলায় বলল,” তারু, তোর মুখ দেখা যায় না। একটু হেসে এদিকে তাঁকা না মা!”
আমি চিৎকার করে বললাম,” তুই যদি ছবি তোলা বন্ধ না করিস তাহলে আমি তোকে পানি মারব।”
নিহা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল,” তুই ওখান থেকে পানি মারলে আমার কিছুই হবে না। বরং আমি চাইলে তোকে উপর থেকে অনেক কিছু ছুঁড়ে মারতে পারব। তাই বলছি, ঠিকঠাক পোজ দে। নাহলে কিন্তু…”
কথা শেষ করার আগেই অতি উত্তেজনাবশত নিহা তার ফোনটাই ফেলে দিল। আমি জিতে যাওয়ার মতো চিৎকার করলাম,” ইয়াহু!”
উপর থেকে নিহা আর্ত চিৎকার করল,” আমার ফোন!”
আমি দ্রুত ঈশানকে বললাম,” ফোনটা খুঁজে পেলেও কিন্তু দেবেন না।”
ঈশান ফোন খোঁজায় ব্যস্ত হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাওয়া গেল। আমি ঈশানের হাত থেকে ফোন ছিনিয়ে নিলাম,” ফোন দেবেন না। আগে ছবি ডিলিট করতে হবে।”
নিহা তড়িঘড়ি করে বলল,” খবরদার তারু, তুই কিন্তু ছবি ডিলিট করবি না।”
” অবশ্যই করব। তুই বিনা অনুমতিতে ছবি তুলেছিস। তাই শাস্তিস্বরূপ তোর গ্যালারির সব ছবি আজ ডিলিট করব।”
নিহা চেঁচিয়ে উঠল,” তারিফ ভাই.. তারু তুই ফোন না দিলে আমি কিন্তু তারিফ ভাইকে ডাকব। সে এসে দেখুক তার বোন কিভাবে সুইমিং শিখছে!”
আমার প্রাণটা এসে গলার কাছে আটকে গেল যেন। ভাইয়া দেখলে যদিও কিছু বলবে না। কিন্তু আমি আর লজ্জায় ভাইয়ার সামনে দাঁড়াতে পারব না। ঈশান মৃদু ধমক দিয়ে বলল,” এটা বেশি হচ্ছে, নিহা। শাট আপ।”
” তাহলে তারুকে বলুন আমার ফোন দিতে।”
আমি অনেকটা হিঁচকি তোলার মতো উচ্চারণ করলাম,” তুই ফোন নিয়ে যা, বিচ্ছু। সময় আমারও আসবে।”
নিহা হৈহৈ করতে লাগল। তখনি শুনলাম ভাইয়ার আওয়াজ,” এখানে কি হয়েছে? কেউ পানিতে পড়ে গেল নাকি? এতো হৈচৈ কেন?”
ভাইয়ার গলা শুনে আমার আত্মায় তখন একফোঁটা পানি নেই। ঈশানকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলাম যেন অদৃশ্য হয়ে যেতে চাইছি। ঈশান দ্রুত কণ্ঠে বলল,” নিশ্বাস আটকে তুমি কতক্ষণ থাকতে পারো?”
আমি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালাম। বিরক্ত হয়ে বললাম,” মানে? এইসময় আপনি কি আজগুবি প্রশ্ন করছেন? ভাইয়া আমাদের দেখে ফেললে কি হবে সেটা ভাবুন।”
আমি কিছু বোঝার আগেই ঈশান আমাকে নিয়ে পানিতে ডুব দিল। ভাইয়া ততক্ষণে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। কাউকে দেখতে না পেয়ে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল,” সবাই এখানে কি করছ? এতো হল্লাহল্লি কেন? কিছু হয়েছে?”
সাফিন ভাই ইতস্তত করে জবাব দিল,” নিহার ফোন পড়ে গেছে নিচে। কে আনতে যাবে সেটা নিয়েই তর্ক হচ্ছিল।”
তারিফ ভাই ধমকের সুরে বলল,” কে আনতে যাবে মানে? বউটা কার? তোমার না? তোমারই যাওয়া উচিৎ। ”
” কিন্তু আমি সাঁতার জানি না ভাইয়া।”
” এই যুগের ছেলে হয়েও সাঁতার জানো না? এইটা কোনো কথা হলো?”
নিহা অসহায় সুরে বলল,” থাক ভাইয়া, বাদ দিন। আমিই গিয়ে খুঁজে আনব। আর পাওয়া না গেলে তো কিছু করার নেই।”
ভাইয়া রুষ্ট হয়ে উঠল,” পাগল নাকি? এতোগুলো ছেলে থাকতে তুমি মেয়ে হয়ে পানিতে নামবে ফোন খুঁজতে? এটা কোনো কথা হলো না। আমি যাচ্ছি।”
নিহা বিনীতভাবে বাঁধা দিল,” ছি,ছি ভাইয়া। আপনার কষ্ট করতে হবে না। রিফাত ভাই সাঁতার জানে তো! সে গিয়ে নিয়ে আসবে।”
” আশ্চর্য! আমি কি তোমার ভাই না? আমি আনলে প্রবলেম কি?”
ভাইয়া সত্যি সত্যি নিচে নামছে। আমি আর ঈশান ততক্ষণে পারে উঠার প্রাণপণ চেষ্টা শুরু করলাম৷ ভাইয়া আসার আগেই এখান থেকে উঠতে হবে। কিন্তু আমি উঠতে নিয়েও পা পিছলে আবার পড়ে গেলাম। অগত্যাই ঈশানকে নেমে আমাকে আবার তুলতে হলো। ভাইয়া যখন নিচে নেমে গেছে, তখন আমি আর ঈশান কাকভেজা অবস্থায় স্থলে উঠে দাঁড়িয়েছি। বৃষ্টিও থেমে গেছে। মাঝে মাঝে টুপটপ করে কয়েক ফোঁটা করে ঝরছে। আমাদের দু’জনকে এভাবে দেখে ভাইয়ার চক্ষু চড়কগাছ। আমি লজ্জায় আড়ষ্ট, ঈশান কাঁচুমাচু। ভাইয়া হতভম্ব কণ্ঠে বলল,” তোমাদের এই অবস্থা কেন?”
আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ঈশান অপ্রস্তুতভাবে বলল,” নিহার ফোন পড়ে গেছিল সেটাই তুলতে এসেছিলাম।”
এই কথা বলে ঈশান নিহার ফোনটা বের করল। ভাইয়া আরও অবাক হয়ে বলল,” ফোন খোঁজার জন্য দু’জনকে একসাথে পানিতে নামতে হবে কেন?”
ঈশান আর কোনো অযূহাত খুঁজে পাচ্ছিল না হয়তো। তার নীরবতা দেখে আমিই বললাম,” আসলে ভাইয়া, নিহার ফোনের সাথে আমিও পানিতে পড়ে গেছিলাম। ঈশান আমাকেই তুলতে এসেছিল।”
তারিফ ভাই বিভ্রান্ত হলো। ভ্রু কুচকে খানিক রাগ নিয়ে বলল ,” যেকোনো একটা বল। ফোন পড়ে গেছিল নাকি তুই পড়ে গেছিলি?”
ঈশান বলল,” ফোন আর তারিন একসাথেই পড়ে গেছিল।”
ভাইয়া এবার রাগী দৃষ্টিতে বলল,” তাহলে তুমি প্রথমে ফোনের কথা বললে কেন? কে বেশি ইম্পোর্ট্যান্ট তোমার কাছে? ফোন নাকি আমার বোন?”
ঈশান ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,” আমার বোন.. মানে আপনার বোন, আমার বউ.. মানে তারিন!”
আমি ঈশানের দিকে চাইলাম বাঁকা দৃষ্টিতে। ভাইয়ার প্রশ্নবাণের সামনে সে এমনভাবেই ভড়কে গিয়েছে যে কি বলবে সেটাই স্থির করতে পারছে না। হাঁদারাম! ভাইয়া যে কিভাবে তখনও না হেসে গম্ভীরমুখে তাকিয়ে ছিল কে জানে? কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শান্ত কণ্ঠে বলল,” ভেতরে যাও। ড্রেস চেঞ্জ করো। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে নিউমোনিয়া হবে। সামনে তোমাদের বিয়ে…”
ভাইয়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি দ্রুত ঘরে ঢুকে গেলাম।
প্রথমে বৃষ্টিতে ভেজা তারপর পানিতে নেমে সাতার কাটা; আমার সর্দি হওয়ার জন্য এই দুইটি কাজই যথেষ্ট ছিল। সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন দুই নাকের একটাও খোলা যাচ্ছে না। শ্বাস নেওয়া তো দূরের কথা। মুখ দিয়ে হা করে শ্বাস নিতে হচ্ছে। ঈশানের কি অবস্থা কে জানে? সে সকাল সকাল উঠেই মোহনা আন্টিদের আনতে গিয়েছিল। আমাকেও ডাকা হয়েছিল। কিন্তু আমি ঘুমে এতো বিভোর ছিলাম যে যেতে পারিনি।এতোক্ষণে মোহনা আন্টিরা চলে এসেছে। নিহা আমার ঘরে এসে ফিসফিস করে বলল,” তারু, মোহনা আন্টি এসে গেছে। কথা বলবি?”
আমি মাথা নত করে বললাম,” কি বলব?”
” গতকাল রাতে ঈশান ভাইকে সবকিছু বলেছিলি?”
” উহুম। বলতে পারিনি। বজ্রপাত হলো।”
” মানে? বজ্রপাত হওয়ার জন্য বলতে পারিসনি? এইটা কেমন কথা?”
” আকাশের বজ্রপাত না। বজ্রপাত হয়েছিল আমার মনে। মেঘেদের গর্জনে মুখে তালা লেগে গেল। আমি কিছু বলতেই পারলাম না!”
নিহা মুখ কুচকে বলল,” মানে? কি বলছিস আবোলতাবোল? ”
আমি বেদনা মিশ্রিত কণ্ঠে বললাম,” ঈশানকে যখন আমি জিজ্ঞেস করলাম, সে আমার জন্য কোনো প্রিয় জিনিস ছাড়তে পারবে নাকি? তখন সে বলল সব পারবে। কিন্তু মোহনা আন্টি ছাড়া তার এই পৃথিবীতে কোনো প্রিয় জিনিস নেই। এই কথার পর আমি কিভাবে বলি যে সেই একমাত্র প্রিয় জিনিসটিই আমার জন্য ছেড়ে দিতে! এই কথা আমার মুখ দিয়ে আসেনি৷ আমার কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে গেল। তারপর আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফেললাম৷ আর ওই বিষয়ে কথা হয়নি।”
” তুই কাকে বেশি ভালোবাসিস তারু? তোর ভাইয়াকে নাকি ঈশান ভাইকে?”
” খুবই জটিল প্রশ্ন। এমন প্রশ্নের উত্তর হয় না।”
নিহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,” নেক্সট প্ল্যান কি? এবার কি করবি?”
” ঈশানকে আমি কিছু বলতে চাই না। তার আগে আমি জানতে চাই ভাইয়া আর মোহনা আন্টির মধ্যে এখনও কিছু আছে নাকি! তারা কি আবারও এক হতে চায়? এটা কি সম্ভব?”
” কেন সম্ভব না? যেভাবে তারা একে-অন্য থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তাতে আমার মনে হয় তাদের মনে এখনও কিছু আছে। এই ভয়েই তারা মুখোমুখি হতে পারছে না। কারণ মুখোমুখি হলে তারা হয়তো নিজেদের সামলাতেই পারবে না।”
নিহার এই কথা শুনে আমি একটু আশার আলো খুঁজে পেলাম। উৎসাহিত কণ্ঠে বললাম,” তাহলে কি করা যায়?”
” আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।”
নিহার উপর আমার কখনোই ভরসা থাকে না। কারণ এই মেয়ে সবসময় পাগলামি কান্ড করে। তবুও এইবার কেন যেন তার উপর আমার ভরসা করতে ইচ্ছে হলো। সকালে সব মেয়েরা যখন একত্রে নাস্তা করতে বসেছি তখনি নিহা ভাইয়াকে ধরে আনল। আমি লক্ষ্য করলাম, ভাইয়া ঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই মোহনা আন্টির হিঁচকি উঠে গেল। তিনি দ্রুত পানি খেয়ে পালানোর পায়তারা করতে লাগলেন। নিহা সেই সুযোগ দিল না। সঙ্গে সঙ্গে বলল,” মোহনা আন্টি, তারিফ ভাইয়া কালরাত থেকে আপনার অপেক্ষায় ছিলেন। এখন আপনি এসে গেছেন, আবার ভাইয়াও আছে! তাই দু’জন মিলে ঈশান ভাই আর তারুর বিয়ের পরিকল্পনা করুন।”
নিহার সাথে তাল মেলাতে নীরা বলল,” দ্যাটস আ গুড আইডিয়া!”
মোহনা আন্টির চোখমুখ তখন লাল হয়ে গেছে। ভাইয়াও যথেষ্ট বিব্রত। আর মায়ের মুখের অবস্থা তো একদম অন্ধকারাচ্ছন্ন। সে আমার দিকে এমনভাবে তাকাল, যেন সব দোষ আমার। এর মাঝেই রুবা আন্টি বললেন,” হ্যাঁ। এবার কিন্তু ঈশান আর তারিনের বিয়েটা নিয়ে ভাবা উচিৎ। ওরা যেহেতু ঠিক করে নিয়েছে বিয়ে করবেই তাই তোমাদের আর দেরি করা ঠিক হবে না। কি বলো মোহনা?”
মোহনা আন্টি জবাব দিলেন না। ভাইয়া বলল,” আমি ঠিক করেই রেখেছি। আজকে হলুদের ফাংশন হবে। জালাল চাচাকে মার্কেটে পাঠালাম। ফুল-টুল কিনে আনবে। বিকালে মেয়েরা সবাই শপিং করতে যাবে। সব তো ক্লিয়ার।”
নিহা হাসি-খুশি গলায় বলল,” তবুও মোহনা আন্টির একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা! আন্টি আপনি কিছু বলবেন এই বিষয়ে?”
মোহনা আন্টি ভ্রু উঁচু করে বলল,” আমি আর কি বলবো? সব তো ঠিক করাই আছে। ”
নিহা আমার দিকে চাইল। আমি ইশারায় তাকে কিছু বলে দিলাম। নিহা আমার কথা না বুঝেই বলল,” আমার মনে হয় তারু আপনাদের সাথে একটু আলাদা কথা বলতে চায় এই বিষয়ে।”
ভাইয়া আর মোহনা আন্টি দু’জনেই আমার ঘুরে দিকে তাকাল। মায়ের অগ্নিদৃষ্টিও আমারই দিকে। আমি আসামীর মতো হাসলাম। ভাইয়া প্রশ্ন করল,” কি বলতে চাস তুই?”
নিহা আগ বাড়িয়ে বলল,” ওই রুমে আসুন ভাইয়া। তারু, এদিকে আয়।”
আমি মায়ের ভয়ংকর দৃষ্টি উপেক্ষা করে নিহার পেছন পেছন গেলাম। তারিফ ভাইয়া আমাদের সাথে এলো। নিহা আমাকে আর তারিফ ভাইয়াকে ঘরে রেখে বের হয়ে গেল। ভাইয়া নরম সুরে আমাকে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?”
আমি অপ্রস্তুতভাবে বললাম,” মোহনা আন্টি আসুক, তারপর বলব।”
ভাইয়া অস্বস্তির সাথে উচ্চারণ করল,” তাকেও ডাকতে হবে?”
” হ্যাঁ। হবে।”
পাঁচমিনিট পরেই নিহা মোহনা আন্টিকে সঙ্গে নিয়ে এলো। ভাইয়াকে দেখেই মোহনা আন্টি দরজায় দাঁড়িয়ে গেল। ভাইয়াও বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। যেন বিকর্ষণ বল কার্যত হয়েছে দু’জনের মাঝে। একজন-অন্যজনের সামনে এক মুহূর্তও থাকতে রাজি নয়। নিহা অতি সহজভাবে বলল,” ভাইয়া দাঁড়ালেন কেন? বসুন। আন্টি, বসুন। এই তারু এদিকে আয় তো।”
নিহা আমার হাত ধরে টেনে আমাকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছিল। মোহনা আন্টি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,” এটা কি হচ্ছে? তারিন তুমি আবার চলে যাচ্ছ কেন?”
আমার হয়ে নিহা উত্তর দিয়ে দিল,” ওকে ঈশান ভাই ডাকছে। শুনেই চলে আসবে। পাঁচমিনিট।”
আমি আর নিহা বের হয়ে গেলাম। নিহা আমার দিকে চেয়ে খুব হাসতে লাগল। আমিও হাসছি। নিহা বলল,” মিশন সাক্সেসফুল।”
আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম,” ওরা যদি আবার বের হয়ে যায়? আমাদের পাহারা দেওয়া উচিৎ। চল শুনি কি কি বলে! ”
” ঠিক বলেছিস।”
আমি আর নিহা আলগোছে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। শুনতে পেলাম ভাইয়ার কণ্ঠ, ” আমার কিছু বলার নেই। আপনি যা বলতে চান, বলুন।”
” আমি কি বলব? তাছাড়া আপনার এটা কেন মনে হলো যে আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই?”
মোহনা আন্টির কণ্ঠ খঞ্জরের মতো ধারালো। ভাইয়া বলল,” স্যরি।”
নিহা বিড়বিড় করে বলল,” এই প্রথম তারিফ ভাইকে দেখলাম কাউকে স্যরি বলতে। আমেইজিং!”
আমিও একই সুরে উচ্চারণ করলাম,” ঠিকই তো!”
মোহনা আন্টি বলল,” এখানে স্যরি বলার কিছু নেই।”
” আপনি এতোদিন আমার অপেক্ষায় না থেকে ওদের বিয়েটা দিয়ে দিলেও পারতেন। ”
” আমি কারো অপেক্ষায় থাকিনি। তারিন আপনাকে ছাড়া বিয়েতে রাজি ছিল না।”
” অপেক্ষা না করে ভালোই করেছেন। ঈশানও আপনাকে ছাড়া বিয়েতে রাজি না।”
মোহনা আন্টি নিশ্চুপ। ভাইয়াই আবার বলল,” ওদের বিয়ে দেওয়ার জন্য হলেও আমাদের মুখোমুখি থাকতে হবে।”
” আমার তো কোনো সমস্যা নেই এতে।”
ভাইয়া একটু খোঁচা মারার মতো বলল,” সমস্যা না থাকলে কাল পালিয়ে গেলেন কেন?”
মোহনা আন্টি তৎক্ষণাৎ ফুঁসে উঠে জবাব দিল,” স্কিউজ মি, আগে আপনি পালিয়েছিলেন!”
” ওহ, স্যরি। তাহলে আমারই ভুল। পালানো উচিৎ হয়নি।”
” কাল ওইভাবে চলে যাওয়া আমারও উচিৎ হয়নি। আমিও স্যরি।”
নিহা বিরক্ত হয়ে বলল,” এরা দেখি এখনও স্যরিতেই আটকে আছে।”
আমি বললাম,” তুই কি চাস প্রথমদিনই আই লভ ইউ বলুক?”
” পনেরো বছর পর দেখা! একটু তো ইমোশন থাকা উচিৎ। ”
“ইমোশন তো নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তারা মন খুলে কথা বলতে পারছে না৷ একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরী হয়ে গেছে তাদের মধ্যে। ”
” একটা কাজ করলে কেমন হয়? তাদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেই। তখন দু’জনেই মন খুলে কথা বলবে। আর প্রবলেম সোলভ হয়ে যাবে।”
নিহার বুদ্ধিটা আমার ভালো লাগল। ঝগড়া লাগলেই তাদের ভুল বুঝাবুঝি পরিষ্কার হবে। কিন্তু ঝগড়া লাগানোর উপায়টা কি?
চলবে