তি_আমো পর্ব ৩৪

0
264

#তি_আমো
পর্ব ৩৪
লিখা- Sidratul Muntaz

ছাদে ঠান্ডা বাতাস। পতপত করে উড়ছে আমার গায়ের ওরনা, চুল, আরও উড়ছে ঈশানের গায়ের টি-শার্ট। আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি,তাকিয়ে আছি দূরে। ঈশান আমার পাশে, তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। সে একটা প্রশ্ন করেছে। যার উত্তর আমি এখনও দেইনি। ঈশান প্রশ্নটা আবার করল,” আমি কি কোনো অপরাধ করেছি? কথা বলো, তারিন!”

আমি ঈশানের দিকে রক্তিম দৃষ্টিতে চেয়ে বললাম,” আমাকে এভাবে জোর করে তুলে এনে আপনি ঠিক করেননি। কাজটা আমার একদম পছন্দ হয়নি।”

ঈশান নিচু হয়ে আমার মুখের কাছে এসে কড়া গলায় বলল,” এর আগে তুমি যেটা করছিলে সেটাও তো আমার পছন্দ হচ্ছিল না। আর এখন যেটা করছো সেটাও পছন্দ হচ্ছে না। যতক্ষণ তোমার কাজ আমার পছন্দ না হবে, ততক্ষণ আমিও তোমার অপছন্দের কাজ করেই যাব।”

আমি ক্রোধ নিয়ে চেয়ে রইলাম। দাঁত কিড়মিড় করছে। ঈশান নরম হয়ে আমার মুখটা আঁজলায় নিয়ে অতি মোলায়েম স্বরে বলল,”তোমার কি হয়েছে? কেন এতো মনখারাপ?”

ঈশানের চোখের দৃষ্টি মায়া মায়া। কিছুক্ষণ তার ওই মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার দরুণ আমার চোখ দিয়ে হঠাৎই অভিমানের অশ্রু নামল। ঈশান হতভম্ব হয়ে গেল। আঙুলের ডগা দিয়ে আমার চোখের অশ্রু ছুঁয়ে বলল,” কাঁদছ কেন? হোয়াট হ্যাপেন্ড?”

ঈশানের সেই মায়াভরা দৃষ্টিতে এবার ভয়ংকর অস্থিরতা যোগ হলো। আমি শান্তভাবে চোখের জল মুছতে মুছতে বললাম,” আমাকে একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করলেন না, যে আপনি লন্ডন চলে যাচ্ছেন!”

ঈশানের দৃষ্টিতে বিস্ময় খেলে গেল। কিছুক্ষণ চুপ মেরে থেকে আনম্র হাসল সে। আমার একটু কাছে এসে আদুরে কণ্ঠে বলল,” এজন্য তুমি কাঁদছ? হায়রে! এতো বোকা কেন? তুমি অনুমতি না দিলে লন্ডন তো দূর, আমি এই ছাদ থেকেও নিচে নামব না। সারাক্ষণ তোমার সামনে বসে থাকব। যতক্ষণ তুমি চাইবে! যতদিন চাইবে! ওকে?”

ঈশানের কথায় চোয়াল ঝুলে গেল আমার। খানিক রেগে বললাম,” উফ, আমি লন্ডন যেতে নিষেধ করছি না। আপনি আমার কথা কেন বুঝতে পারছেন না? আপনি লন্ডনে থাকেন নাকি বাংলাদেশে?”

ঈশান সরল মুখে বলল,” এখন বাংলাদেশেই তো আছি।”

আমি চোখ বড় করে দাঁত খিঁচে জানতে চাইলাম,” পারমানেন্টলি কোথায় থাকেন?”

এবার যেন ঈশানের সম্বিৎ ফিরল। হালকা গলায় বলল,” ওহ, লন্ডনেই!”

আমি এবার হাত উঠিয়ে বললাম,” তাহলে এই কথাটা আমি কেন জানি না?”

ঈশান খুব বিস্মিত হয়ে বলল,” তুমি জানতে না? তুমি যে জানতে না এটা তো আমিও জানতাম না!”

আমি রাগে চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। আঙুল উঠিয়ে বজ্রকণ্ঠে বললাম,” আমার সাথে একদম ফাজলামি করবেন না। মোহনা আন্টি বলেছেন আপনি লন্ডনের হলওয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়েন। সাইকোলজি ডিপার্টমেন্ট! অথচ আমাকে কি বলেছেন? আপনি নাকি স্কলারশিপ নিয়ে কানাডা চলে যাবেন? তাও আমার বিয়ের শোকে! আমার ভাইয়াকেও তো এই কথা বলে আমাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছিলেন। এখন আবার মিথ্যা বলছেন কেন? এমন একটা ভাব করছেন যেন আপনি আমাকে সব জানিয়েছেন আর আমিই মনে রাখিনি! আপনি তো আসলে অনেক কিছুই মিথ্যা বলেছেন। আপনি একটা আস্তো মিথ্যুক!”

ঈশান হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আমার কথা গিলছিল। যেই আমি থামলাম ওমনি সে বলল,” ও….”

আমি ক্ষেপে উঠে বললাম,” ও মানে কি?”

ঈশান ঠোঁট টিপে চিন্তা করার ভঙ্গিতে কার্নিশের দেয়াল চেপে ধরল। মাথা নেড়ে বলল,” আসলেই এখানে একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছে।”

আমি তার কাছে এগিয়ে গেলাম। দরাজ কণ্ঠে বললাম,” কি মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং? ক্লিয়ার করুন।”

ঈশান ঝট করে আমার দিকে চেয়ে বলল,” শোনো তারিন, আগেই রেগে যেও না। আমার ব্যাখ্যাটা তোমার বোঝা উচিৎ। নাহলে কিন্তু প্রবলেম। হুট করে রেগে যাওয়া কোনোকিছুর সমাধান নয়। মানুষকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দিতে হয়!”

” আমি আপনার কাছে এক্সপ্লেনেশনই চাইছি। আপনি বলুন, প্লিজ।”

ঈশান এবার চুপ করে কিছু একটা ভাবতে লাগল। আমি জহুরী চোখে বললাম,” খবরদার, আমাকে এক্সকিউজ দিয়ে ভোলানোর একদম চেষ্টা করবেন না। যা সত্যি তাই বলুন। অন্যায় করে থাকলে স্বীকার করুন।”

ঈশান ভ্রু কুচকে খানিক বিরক্তি নিয়ে বলল,” বিশ্বাসই করো না আমাকে। ধ্যাত!”

” আগে আপনি আমাকে বোঝান যে কোনো মিথ্যা বলেননি! তারপরে বিশ্বাস!”

ঈশান মাথা নিচু করে বলল,” আমি মিথ্যা বলেছি।”

আমার চোখে সাথে সাথে আগুন জ্বলে উঠল। ঈশান কাঁচুমাচু হয়ে বলল,” আগে পুরো কথাটা শোনো! লেট মি এক্সপ্লেইন!”

আমি চুপ করলাম। ঈশান আবারও আগের মতো মাথা নিচু করে বলল,” তুমিও আমাকে মিথ্যা বলেছ।”

এবার আমার সত্যি রাগ উঠে গেল,” আমি কখন মিথ্যা বললাম?”

ঈশান কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে কিছুটা ধমকের স্বরে বলল,” বলোনি? তুমি মিথ্যা বলোনি আমাকে সেদিন?”

” কোনদিন?”

” ওইতো, তোমার বিয়ের ব্যাপারে। তোমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এই পুরো ঘটনাটাই তো মিথ্যা ছিল৷ শুধু তুমি একা তো মিথ্যা বলোনি। তোমার ভাই, মা, দাদী শুদ্ধো সবাইকে নিয়ে একসাথে মিথ্যা বলেছ।”

ঈশানের কথায় আমি এমনভাবে থতমত খেলাম যে তৎক্ষণাৎ কোনো শব্দই খুঁজে পেলাম না জবাব দেওয়ার মতো। ঈশান আমার নীরবতার সুযোগ নিয়ে আরও বলল,” যখন তোমার বিয়ের খবর শুনলাম তখন আমার কি অবস্থা হয়েছিল, জানো? সেটা তো প্রথমে। কিন্তু দুইমিনিট পরেই বুঝে গেছি তোমার দাদী মিথ্যা বলছে। তাঁর কথা এলোমেলো হয়ে গেছিল। তিনি আমার চোখের দিকেও তাকাননি। আর তুমিও বার-বার বিয়ের কথা উঠিয়ে আমাকে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করেছিলে।”

আমি হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলাম৷ হাসি আটকে অপরাধী স্বরে প্রশ্ন করলাম,” আপনি তাহলে সব বুঝেছেন?”

ঈশান ভ্রু নাচিয়ে বলল,” বুঝব না কেন? আমি কি তোমার ভাইয়ের মতো মাথামোটা? সামনে দাঁড়িয়ে কেউ একগাঁদা মিথ্যা বলবে আর আমি কিছুই বুঝব না!”

” এখানে আমার ভাইয়া কোথ থেকে এলো?” আমি তেতে উঠলাম। ঈশান প্রশমিত কণ্ঠে বলল,” আচ্ছা, স্যরি। যাইহোক..”

” যাইহোক না… আমি মিথ্যা বলেছি সেটার কারণ ছিল৷ কিন্তু আপনি কেন মিথ্যা বললেন? এর পেছনে কি কারণ?”

” তুমি যে কারণে মিথ্যা বলেছো আমিও সেই একই কারণে মিথ্যা বলেছি।”

আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চাইলাম,” এর মানে?”

” তুমি মিথ্যা বলেছো যাতে আমি তোমার বিয়ে ভেঙে নিজে তোমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেই।”

এই কথা শুনে আমি লজ্জায় জীভ বের করে অন্যদিকে তাকালাম। ঈশান একটু ঝুঁকে বলল,” আর আমি মিথ্যা বলেছি কেন জানো?”

আমি তাকালাম উত্তর শোনার জন্য। ঈশান স্পষ্ট করে বলল,” যাতে তুমি বুঝতে পারো যে তুমি শুধু আমাকেই ভালোবাসো!”

এবার আমি একটু চমকালাম। বিহ্বল কণ্ঠে বললাম,” মানে? এটার সাথে ওইটার কি সম্পর্ক? ”

” শোনো, আমি যখন তোমার ভার্সিটি এসে বললাম যে আমি কানাডা চলে যাচ্ছি আর কখনও ফিরব না তখন তুমি কষ্ট পেয়েছ না? অবাক হয়েছ না? তারপর আমি তোমাকে না জানিয়ে তোমার বাড়ি থেকেও চলে গেলাম। তুমি আরও কষ্ট পেলে। রাতে নাক টানতে টানতে আমাকে ফোন করে আসতে বললে। তোমার পুরো মাথা খারাপ হয়ে গেল! এর থেকেই বোঝা যায়, তুমি অনেক আগেই আমাকে ভালোবেসেছো৷ কিন্তু সেটা রিয়েলাইজ করেছো আমি চলে যাওয়ার পর। যদি আমি মিথ্যা না বলতাম, তোমাকে ছেড়ে না যেতাম, তাহলে কি এতো সহজে তোমাকে পেতাম?”

আমার মুখ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘হা’ হয়ে গেল। ‘চোরের উপর বাটপারি’ প্রবাদটা অনেক শুনেছিলাম। আজ তো হাতে-নাতে প্রমাণ পেলাম। আমি বিস্ময়ের সুরে বললাম,” আপনি তো শুধু মিথ্যুক না, একটা আস্তো চিটারও। চিটিং করেছেন আমার সাথে।”

ঈশান পকেটে হাত গুজে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে বলল” একটু চিটিং করে যদি কারো থেকে ভালোবাসার কথা আদায় করা যায় তাহলে সেই চিটিংয়ে দোষ নেই।”

” এই কথা কোন মহামানব বলেছে?”

” মহামানব তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। এত্তো হ্যান্ডসাম একটা মহামানব। তোমার পছন্দ হচ্ছে না?”

আমি রাগে আহত-নিহত হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার মেয়েলী আত্ম অহংকার ভেঙে-চুরে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। ঈশান এতোবড় প্ল্যান করে আমাকে পটিয়ে ফেলল আর আমি ঘূণাক্ষরেও টের পেলাম না! ক্রোধে, ক্ষোভে ঈশানকে ধাক্কা মেরে বললাম,” আমার সাইকোলজি নিয়ে এতোবড় ছেরখানি? আপনি এটা কিভাবে করতে পারলেন? জানেন আপনি চলে যাওয়ার পর আমার কত কষ্ট হয়েছিল? আপনি ইচ্ছে করে আমাকে কষ্ট দিয়েছেন! আমি আপনাকে ছাড়ব না।”

ঈশান আমার দুই হাত চেপে ধরে বলল,” সব কষ্ট শোধ করে দিব আমার মিষ্টি হাসি! কিন্তু তুমিও আমাকে কম কষ্ট দাওনি। তোমার বিয়ের কথা শুনে তো হার্ট এটাক করতে নিয়েছিলাম।”

” কিন্তু আপনি তো মিথ্যা ধরে ফেলেছিলেন।”

” এজন্যই তো কষ্ট হচ্ছিল। তুমি আমাকে মিথ্যা বলছ এটা কি কষ্টের ব্যাপার না?”

আমি ঈশানের টি-শার্ট খামচে বললাম,” যদি সেদিন আপনার উপর রাগ করে আমি সত্যি বিয়ে করে ফেলতাম?”

ঈশান আমার মুঠো থেকে টি-শার্ট ছাড়িয়ে অন্যদিকে চাইল। তীক্ষ্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে উচ্চারণ করল,” তুমি এটা করতে না৷ আমি জানতাম।”

” কিভাবে জানতেন?”

” কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসো। অন্য কাউকে কিভাবে বিয়ে করবে?”

আমি বড় নিশ্বাস ছেড়ে বললাম,” এটা আপনি কিভাবে বুঝলেন? আমি তো কখনও বলিনি?”

ঈশান ভ্রু কুচকাল, ” বলার প্রয়োজন আছে নাকি? আমি এমনিই বুঝি৷ তুমি আমাকে প্রথম দিনই মেনে নিয়েছ। সাফিনের এংগেজমেন্টের দিন থেকেই।”

আমি হতবাক হলাম,” কিভাবে?”

” তুমি তো প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলে অন্ধকারে আমি তোমাকে কিস করেছি। আমার চুলের সাথে আটকে ছিল তোমার দুল। তোমার যদি আমাকে ধরা খাওয়ানোর ইচ্ছে থাকতো তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে দেখাতে। তোমার বাড়িতে যখন আমি গিয়েছিলাম, তুমি আমাকে বের করে দিতে পারতে৷ রাস্তায় যখন আমি তোমাকে বিরক্ত করতাম, তুমি আমাকে থাপ্পড় মারতে পারতে। আমার চিঠি কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে পারতে৷ আমি যে তোমাকে পায়েলসহ চিরকুট দিয়েছিলাম সেটা তুমি ওখানেই ফেলে চলে আসতে পারতে। যদি ভালো না বাসতে, তাহলে তুমি এগুলোই করতে। কিন্তু আমাকে ভালোবাসো বলেই তুমি আমাকে কারো সামনে অপমান করোনি। আমি হাজারবার তোমাকে বিরক্ত করেছি। তুমি চাইলেই পারতে আমার মুখোশ খুলে দিতে৷ কিন্তু তোমার মস্তিষ্ক সেটা চাইলেও মন কখনও সায় দেয়নি। তাই তুমি আমার সমস্ত অত্যাচার মেনে নিয়েছ। উপরে রাগ দেখালেও মন থেকে আমাকে ঘৃণা করোনি।”

আমি নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। ঈশান একদম ভুল কিছু বলেনি। সে যা যা বলছে, আমার অনুভূতি ঠিক তেমনই ছিল। সে আমাকে বিরক্ত করলে আমি আদতে বিরক্ত হতামই না। বরং আমার ভালো লাগতো। কিন্তু এটা আমি বুঝতে পেরেছি যখন ঈশান আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করে দিল। যখন কানাডা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সেদিন ভার্সিটিতে নিহাকে জড়িয়ে ধরে কি অঝোর ধারায় কেঁদেছিলাম আমি! এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে ঈশান আমার মানসিকতা নিয়ে রীতিমতো ছেলে-খেলা করেছে। আমি রাগে কটমট করে বললাম,

” আমার আপনাকে সেদিন রাতে ফোন করা একদম উচিৎ হয়নি। সত্যি সত্যি একটা বিয়ে করে নিলে ভালো হতো।”

ঈশান চওড়া গলায় হুমকি দিল,” এতো সহজ? একদম তুলে নিয়ে আসতাম!”

” ঈশ, মগের মূল্লুক?”

” অবশ্যই না। আমার ভালোবাসা কোনো মগের মূল্লুক না। এজন্যই তুলে আনতাম।”

আমি না চাইতেও হেসে ফেললাম। ঈশানও হাসছে। ঠিক এই মুহূর্তে আমার সমস্ত বিষণ্ণতা, খারাপ লাগা, অস্থিরতা উধাও হয়ে গেছে৷ মনজুড়ে বিরাজ করছে নরম এক শান্তি।

আমি একটু পর বললাম,” আচ্ছা, আপনার তো মিথ্যা বলার কোনো দরকার ছিল না। আপনি লন্ডনে থাকেন আর লন্ডনে ফিরে যাচ্ছেন এটুকু বললেই হতো। সত্যিও বলা হতো আবার আপনার কাজও হয়ে যেতো।”

” আরেহ, সত্যি বলার চেয়ে মিথ্যা বলে সিমপ্যাথি আদায় করা বেশি সহজ। তুমি এসব বুঝবে না। মেয়েরা সত্যি কথার চেয়ে মিথ্যা বেশি বিশ্বাস করে।”

” ও আচ্ছা।”

আমি মাথা নাড়লাম। তারপর চট করেই ঈশানের কথার মূল অর্থ ধরতে পেরে সাথে সাথে তীব্র কণ্ঠে চিৎকার করলাম,”এই কি বললেন? মেয়েরা মিথ্যা বিশ্বাস করে? সত্যি বিশ্বাস করে না? আর কয়টা মিথ্যা বলেছেন আপনি? তার মানে এই পর্যন্ত যা যা বলেছেন সবই মিথ্যা ছিল?”

” সব মিথ্যা হবে কেন? কিছু কিছু সত্যি ছিল।”

আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম,” এর মানে বাকিগুলো মিথ্যা ছিল? ”

ঈশান বিভ্রান্ত হয়ে বলল,” আরে আমি বলতে চাইছি কিছুই মিথ্যা না। শুধু কানাডার স্কলারশিপের ব্যাপারটাই মিথ্যা ছিল। সিমপ্যাথির জন্য বলেছিলাম৷ এতো সন্দেহ করো কেনো?”

আমি অন্যদিকে চেয়ে অভিমানী কণ্ঠে বললাম,” যাইহোক, মিথ্যা বলেছেন এটাই আসল কথা। কিন্তু আমার খুব আফসোস হচ্ছে।”

” কি নিয়ে আফসোস?”

” যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হলো আমি জানিই না সে কই থাকে, কি করে! সব আজকে মাত্র জানলাম। সকালে যদি গন্ডগোলটা না বাঁধতো তাহলে আমরা এখান থেকে চলে যেতাম আর হয়তো এতোক্ষণে আমাদের বিয়েও হয়ে যেতো। ভাবুন তো, তখনও আমি জানতাম না যে আপনি লন্ডনে থাকেন, সেখানে পড়াশুনা করেন। মানে আপনার সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই থাকতো না।”

ঈশান ধীরপায়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি হালকা পিছিয়ে গেলাম। ঈশান নিচু হয়ে আমার চিবুক স্পর্শ করে বলল,” আমার সম্পর্কে তোমার যতটুকু ধারণা আছে, বিয়ের জন্য সেটাই কি যথেষ্ট না? আমি তোমাকে মারাত্মক ভালোবাসি। এর বাইরে আর কিছু জানার প্রয়োজন কি আছে তারিন?”

ঈশানের দৃষ্টি গাঢ়, অতি মায়াময়, মোহময়। আমার চোখ টলমল হলো। দুই পাশে মাথা নেড়ে আমি বললাম,” একদম না!”

তারপর কিছুটা রাগ নিয়ে বললাম,” যাইহোক, আপনি আমাকে মিথ্যা বলেছেন, আমার সাথে চিটিং করেছেন। তাই আপনাকে শাস্তি পেতে হবে।”

ঈশান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,” ওকে। তুমি যদি আমাকে শাস্তি দিয়ে শান্তি পাও, তাহলে দিতে পারো।”

” শাস্তি হলো আপনি আমার সাথে একদম কথা বলবেন না।”

ঈশান মুখে হাত দিয়ে মৃদু হাসল। আমি ক্রোধানলে জ্বলে উঠলাম,” হাসছেন কেন?”

” আমি তোমার সাথে কথা না বললে তো আমার শাস্তি হলো না। এটা তোমারই শাস্তি হয়ে গেল।”

আমি কোমরে হাতে গুজে বললাম,” আচ্ছা, তাই নাকি? ঠিকাছে, দেখা যাক! কে কতক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারে!”

” আমি তো কথা বলতে চাইবোই। তুমি না বললে…”

আমি দরাজ কণ্ঠে বললাম,” আমি কিছুতেই বলব না আপনার সাথে কথা।”

ঈশান অতি সহজভাবে মেনে নিয়ে বলল,” আচ্ছা।”

আমি রাগে গজগজ করে ছাদ থেকে নেমে আসছিলাম। ঈশান আমাকে থামালও না। আমি একবার ভাবলাম, পেছনে তাকাবো। কিন্তু তাকালাম না। কারণ জানি, ঈশান এখন আমার দিকেই চেয়ে আছে।

সকালে হুট করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, আজরাতের ট্রেনে সবাই সিলেট যাবে। নিহার শ্বশুরবাড়ি তথা স্বামীর বাড়ি। কারণ শ্বশুর-শাশুড়ী তো বেঁচে নেই। বৌভাতও নাকি সিলেটেই হবে। সকালে পরিকল্পনা হলো আর রাতের মধ্যেই ব্যবস্থা হয়ে গেল। একদম পিকনিকের মতো আমেজ। আমি তখনও ঈশানের সঙ্গে কথা বলছি না। কিন্তু সে মাঝে মাঝে আমাকে মানানোর খুব চেষ্টা করছে। কোনোকিছুতেই আমার মন গলছে না। দেখা যাক, ঈশান আরও কত কি করতে পারে আমার জন্য!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here