তি_আমো পর্ব ৫১

0
254

#তি_আমো
পর্ব ৫১
লিখা- Sidratul Muntaz

ওয়াসিফকে পড়াতে এসেছে তারিন। কিন্তু তার দৃষ্টি ঘুরছে আশেপাশে। সামনের বড় টেবিলে একটা ডায়েরী আছে। তারিন সেই ডায়েরীটি নেওয়ার পায়তারা করছে। ফারজানা আন্টি যেকোনো সময় ঘরে চলে আসবেন নাস্তা নিয়ে। তিনি যদি দেখেন যে তারিন তারই ছেলের ডায়েরী চুরি করে পড়ছে, তাহলে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ভালোভাবে গ্রহণ করবেন না। অতএব ফারজানা আন্টি চলে যাওয়ার পরেই ডায়েরী নিতে হবে। তবে সমস্যা হচ্ছে ফারজানা আন্টি নাস্তা দিতে এসে অনেকক্ষণ বসে গল্প করেন। ততক্ষণে ওয়াসিফের ছুটির সময় হয়ে যায়। এমন হলে ব্যাপারটা মুশকিল হবে। ডায়েরী পড়ার জন্য আবার সামনের সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

ওয়াসিফ মাদ্রাসার ছাত্র। সে ক্লাস সেভেনে পড়ে। পুরো সপ্তাহ মাদ্রাসাতেই থাকে। শুধু ছুটির দিনে বাড়ি আসে। তখন তারিন তাকে গণিত পড়ায়। ফাহিমের সাথে ওয়াসিফের সম্পর্ক হলো, তারা কাজিন। ফাহিমই তারিনকে নিয়োগ দিয়েছিল ওয়াসিফকে পড়ানোর জন্য। আগে ফাহিমরা নিহাদের বাড়িতে থাকতো। এখন আলাদা হয়ে গেছে। ফাহিম চাকরি পাওয়ার পর মাকে নিয়ে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে। ফাহিমের বাবা নেই। ঠিক তারিনের মতো। প্রথম যেদিন তারিন ওয়াসিফকে পড়াতে এই বাসায় এসেছিল, তখনি ফাহিমের ডায়েরীটার দিকে তার নজর যায়। তারিন কেবল ডায়েরী হাতে প্রথম পেইজটা পড়ল। দৈনন্দিন জীবনের কাহিনী লেখা। তারিনের ভালোই লাগছিল। হঠাৎ ফাহিম দেখে ফেলল এবং ভীষণ রেগে গেল।

” এটা ঠিক না তারু। কারো অনুপস্থিতিতে পারসোনাল ডায়েরী পড়া খুব বাজে অভ্যাস। রাখো, প্লিজ রাখো ”

তারিন থতমত খেয়ে বলল,” স্যরি, আমি ভেবেছিলাম ওয়াসিফের ডায়েরী।”

” ওয়াসিফের টেবিল পাশেরটা। এইটা আমার টেবিল।”

তারিন রেখে দিতে দিতে বলল,” স্যরি ভাইয়া।”

এই প্রথম তারিন ফাহিমকে এতো রাগতে দেখল। এর আগে কখনও তো ফাহিম এমন শক্ত কণ্ঠে কথা বলেনি! সেই থেকে তারিনের আগ্রহ কিংবা জেদ হলো এই ডায়েরী সে পড়েই ছাড়বে। আজকে ফাহিম বাড়িতে নেই। সুতরাং সুবর্ণ সুযোগ পাওয়া গেছে ডায়েরী পড়ার। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের বরাবরই আগ্রহ বেশি। তারিনকে জানতে হবে যে ফাহিম ওই ডায়েরীতে কি এমন লিখে!

” আচ্ছা ওয়াসিফ, ফারজানা আন্টি কোথায়?”

” বড়ফুপি ঘুমায়।”

ওয়াসিফের উত্তর শুনে তারিন নিশ্চিন্ত হলো। অর্থাৎ আজ ফারজানা আন্টি নাস্তা নিয়ে আসবেন না। সুতরাং সে নিশ্চিন্তে ডায়েরী পড়তে পারে। তারিন বলল,”আমি তোমার ভাইয়ার বুকশেল্ফ থেকে একটা বই পড়ছি। তুমি অংক করতে থাকো। শেষ হলে আমাকে ডেকো।”

” আচ্ছা মিস।”

তারিন বুকশেল্ফের কাছে এলো। ডায়েরীটা কত যত্ন করে লুকিয়ে রাখা। তারিন হাতে নিল। এবার আর প্রথম থেকে না, মাঝখান থেকে পড়তে শুরু করল। কারণ প্রথম দিকে তেমন আগ্রহপূর্ণ ঘটনা নেই। ফাহিম তার বাবাহীন জীবনে শৈশবের অবহেলা, লড়াই, কষ্ট, ইত্যাদি সম্পর্কে লিখেছে। তারিনের মনখারাপ হচ্ছিল। সে একটা অপরাধ করছে। কারো ব্যক্তিগত জিনিস লুকিয়ে পড়া অনুচিত। কিন্তু কৌতুহলও দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। কি এমন আছে এই ডায়েরীতে যে ফাহিম সেদিন এতো রেগে গেল? অন্তত এইটুকু জানার জন্য হলেও তারিন পুরো ডায়েরী পড়বে। সে নিখুঁতভাবে না পড়ে শুধু লেখাগুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু শেষের কয়েকটি পেইজে এসে সে থমকে গেল। কারণ এই পেইজগুলোতে ফাহিম তারিনের সম্পর্কে লিখেছে…

তারা। আমার আকাশের একমাত্র তারা। আচ্ছা, আকাশে একটি তারা কি কখনও হয়? আকাশ মানেই তো লক্ষ্য লক্ষ্য তারার সমাবেশ। কিন্তু আমার মনের এই আকাশটা একটি তারাতেই পরিপূর্ণ! এই তারা শুধু দূর থেকে দেখা যায়। কখনও কাছে যাওয়া হয় না। তারা পেতে হলে আকাশের চাঁদ হতে হয়। আমি তো আকাশের চাঁদ না। তাহলে কোন অধিকারে তারাকে চাইব? আমার মনের এই সংকীর্ণতা কখনোই তারাকে মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা জানাতে দেয়নি। আমি বাবাহীন অনাথ ছেলে। বড়চাচার দয়ায় এই বাড়িতে থাকি। তারিনকে চাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। ভেবেছিলাম একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবো। তারিনের যোগ্য হয়ে তাকে মনের সব গোপন কথা বলে ফেলব।

কিন্তু আমার যোগ্য হওয়ার অপেক্ষায় কেউ বসে থাকলে তো! তারিন আজীবনের জন্য আমার কাছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরের সেই আকাশের তারা হয়েই থেকে গেল। আজ তারিনের সাথে ঈশান ভাইয়ের এংগেজমেন্ট হয়েছে। তারা হয়তো সবসময় সুখে থাকবে। হয়তো কি? নিশ্চিত সুখে থাকবে! এই কথা আমি জানি। তবুও তাদের একসঙ্গে দেখলে আমার কষ্ট হয়৷ কেউ আমার আকাশের একমাত্র তারাটি ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এটা মানা আমার পক্ষে মৃত্যুর মতো কঠিন। যখন তাদের একসঙ্গে হাত ধরে হাঁটতে দেখি, অদম্য একটি ঈর্ষার আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে আমার বুকের মধ্যে। দিন দিন আমি পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছি। শ্বাসরুদ্ধকর একটা কষ্টে দম আটকে আসার উপক্রম হচ্ছে। মাঝরাতে প্রায়ই কান্না পায়।

তারা! তুমি কেন আমার হলে না? মানছি আমি ঈশান ভাইয়ের মতো না। আমি তোমার আকাশের চাঁদ না। কিন্তু তুমি যে আমার আকাশের একমাত্র তারা!তোমাকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি। তোমাকে বলতে না পারার এই কষ্ট সারাজীবন আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে। আমি কিভাবে থাকব তারা? তুমি কেন আমার জীবনে এলে বলোতো? ধ্যাত!

আমি সবসময় চাইতাম, কোনো একটা আশ্চর্য ঘটুক। ঈশান ভাইয়ের সাথে তোমার বিয়েটা ভেঙে যাক। খুবই স্বার্থপর চাওয়া। ভালোবাসা বুঝি মানুষকে স্বার্থপরও বানিয়ে ফেলে? না, এমনটা নয়। কারণ মেহেন্দীর অনুষ্ঠানে যখন তারিফ ভাই সত্যি তোমাদের বিয়েটা ভেঙে দিচ্ছিল তখন আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। খুব করে চাইছিলাম যাতে সব ঠিক হয়ে যায়। তোমাদের বিয়েটা না ভাঙে। কারণ তুমি খুব ব্যাকুল হয়ে কাঁদছিলে। তোমাকে অন্যকারো সাথে খুশি দেখার ক্ষমতাটা আমি আয়ত্ত করে নিয়েছি। কিন্তু তোমাকে কষ্টে দেখার ক্ষমতা আমার নেই। আমি সহ্য করতে পারি না। তোমার মুখের হাসি যেন সবসময় অটুট থাকে। রবের কাছে এটাই আমার প্রার্থনা।

ভালো থেকো তারা। তোমার সুখের জীবনের জন্য শুভকামনা কিন্তু…

তারিন দ্রুত ডায়েরী বন্ধ করল। অস্বস্তিতে দম আটকে আসছে। সে যদি আগে জানতো ডায়েরীতে এইসব লেখা থাকবে তাহলে কখনোই পড়তো না। দ্রুত সে ডায়েরীটা বুকশেল্ফে রেখে দিল। ঠিক যেভাবে ছিল সেভাবেই রাখল। যাতে কেউ বুঝতে না পারে। টেবিলের কাছে আসতেই ওয়াসিফ বলল,” মিস, আর দুইটা অংক বাকি। মনে পড়ছে না। একটু নোট দেখতে পারি?”

তারিন ধমকের স্বরে বলল,” অংক কি তুমি মুখস্ত করো যে বার-বার নোট দেখতে হবে? মনে পড়ে না আবার কি?”

ওয়াসিফ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারিন নিজেকে শান্ত করে বলল,” যা করেছো তাই যথেষ্ট। আর অংক করতে হবে না। বাকিগুলো হোমওয়ার্ক। আমি এখন আসছি।”

দ্রুত ছুটি পেয়ে ওয়াসিফ খুশি হয়ে গেল। সানন্দে মাথা নেড়ে বলল,” ওকে।”

ঈশান বাড়ি ফিরে দেখল মোহনা এখনও জেগে আছে। সে খুব স্বাস্থ্য-সচেতন মহিলা। নিয়মিত ঘুম, খাওয়া-দাওয়া, ব্যয়াম কঠোরভাবে মেনে চলে। কিন্তু যেদিন ঈশানের বাড়ি ফিরতে দেরি হয় সেদিন সব নিয়ম খু/*ন করে সে দীর্ঘরাত পর্যন্ত জেগে বসে থাকবে। ঈশান সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। আগে সে একটা ফ্রেশ শাওয়ার নিতে চায়।

বসার ঘরের সোফায় বসে বই পড়তে পড়তে ঝিমিয়ে পড়েছিল মোহনা। ঈশানের ঠান্ডা হাতের স্পর্শে ঘোর কাটল তার। ঈশান মোহনার মুখের উপর থেকে বইটা সরিয়ে রাখতে রাখতে বলল,” গুড ইভিনিং, মম। এখনও ঘুমাওনি কেন?”

মোহনা হাই তুলে জিজ্ঞেস করল,” কোথায় ছিলি তুই? এতো দেরি লাগল যে!”

” একটা সিরিয়াস ক্লায়েন্ট এসেছিল। তার সাথে ডিসকাস করতে করতেই এতো লেইট হয়ে গেছে।”

মোহনা হাসল। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল,” নিহা ফোন করেছিল। দেশে যেতে বলছে। লিটল গার্লের বার্থডে।”

” আজ সকালে আমাকেও ফোন করেছিল।”

” তাই নাকি? তুই কি বললি? যাবি?”

” জোর করে আমার থেকে কথা আদায় করেছে। যেতেই হবে। এখন ভাবছি..”

” আরে শোন, যাওয়াটা কিন্তু উচিৎ। নিহার মেয়ে যখন হলো তখনি তো আমাদের যাওয়া উচিৎ ছিল। তোর কাজের এক্সকিউজের জন্য আর যাওয়া হলো না। এবার কিন্তু নিহা কড়াভাবে বলে দিয়েছে। যেতেই হবে। ”

ঈশান প্রসঙ্গ ঘুরাতে বলল,” ক্ষিদে পেয়েছে। লেটস হ্যাভ সাম মীল।”

মোহনা গরম দৃষ্টিতে তাকাল,” ঈশান, তোর প্রবলেমটা কোথায় আমাকে বলবি?”

” কিসের প্রবলেম? নো প্রবলেম!”

ঈশান দায়সারা একটা ভাব নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। ফ্রীজ থেকে ডিনারের জন্য সবজি বের করল। চিকেন সিদ্ধ বসালো। ইন্সট্যান্ট কিছু একটা বানাবে সে। মোহনাও উঠে ঈশানের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ঈশান বলল,” তোমার জন্য কি বানাবো?”

মোহনা গম্ভীরমুখে বলল,” কিছু না।”

” কেন?”

” আমার কথার জবাব দে আগে তুই। কেন বাংলাদেশে যেতে চাস না? তারিনের জন্য!”

ঈশান চপিং বোর্ডে সবজি কাটতে নিয়েছিল। এই কথা শোনার পর তার চেহারার হাসি উধাও হয়ে গেল। হাত থেকে ছুরিটা ছুঁড়ে ফেলে কিছুটা রাগ নিয়েই বলল,” প্রতিদিন কোনো না কোনো এক্সকিউজে তারিনের নামটা কি তুলতেই হবে?”

মোহনা ছেলের কাছে এসে স্পষ্ট করে বলল,” তারিনের প্রতি যদি তোর উইকনেস না থাকে তাহলে ওর কথা শুনে রেগে যাস কেন? তোর তো নরমাল থাকা উচিৎ। ”

” আ’ম বোরড। প্রতিদিন এক টপিকে কথা বলতে বলতে লিটরেলি টায়ার্ড হয়ে গেছি। আমার ভালো লাগে না, মম।”

মোহনা নিশ্চুপ হলো। ঈশান মেঝে থেকে ছুরিটা তুলে আবার সবজি কাটায় মনোযোগ দিল। মোহনা মাথা নিচু করে থেকে হঠাৎ বলল,” তোকে আমি জন্ম দেইনি বলে কি তোর মনের কথাও বুঝতে পারব না? এতোটাই কেয়ারলেস মা মনে হয় আমাকে?”

ঈশান অবাক হয়ে বলল,” মম, আমি এমন কিছু মীন করিনি..”

ঈশানকে থামিয়ে মোহনা আদেশের কণ্ঠে বলল,” শুধু মুখে না, যদি আমাকে মন থেকে মা হিসেবে মানিস তাহলে আজকে তুই সত্যি কথাটা বলবি।”

” কিসের সত্যি?”

” তারিনের সাথে তোর কি হয়েছিল? কেন তোদের ব্রেকাপ হলো? কেন তুই তারিনের কথা শুনতে চাস না? এমনকি তারিনও কিছু বলতে চায় না আমাকে। এসবের রহস্য কি? কি এমন হয়েছিল তোদের মাঝখানে? প্লিজ ঈশান, মিথ্যা না। একদম সত্যিটা বল।”

” মম, প্লিজ ডন্ট ফোর্স মি। সত্যিটা আমি বলতে পারব না। আর মিথ্যা কথা আমি বলতে চাই না।”

” ঠিকাছে। তাহলে আজকে থেকে আমার সাথে আর একটাও কথা বলবি না তুই।”

ঈশান অসহায়ের মতো তাকাল। মোহনা নিজের ঘরের দিকে চলে যাচ্ছে। পেছন থেকে ঈশান ডাকল,” মম।”

মোহনা থামল না। ঈশান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রান্নায় মনোযোগ দিল। খাবার রান্না করা শেষ হলে সে নিজেরটা আর মায়েরটা একসঙ্গে বেড়ে ঘরে নিয়ে গেল। মোহনা ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিল। ঈশানকে দেখেই দ্রুত ল্যাপটপ বন্ধ করে ঘুমানোর ভং ধরল। ঈশান টেবিলে শব্দ করে বলল,” আমি জানি তুমি ঘুমাওনি। ওঠো।”

মোহনা জবাব দিচ্ছে না। ঈশান কাছে গিয়ে বলল,” মম প্লিজ, তুমি কি বাচ্চা? বাচ্চাদের মতো জেদ করছ।”

মোহনা তখনও সাড়াহীন। ঈশান অবশেষে হার মানল। বিছানায় বসে লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলল,” ঠিকাছে। যা জানতে চাও সব বলব। কিন্তু তার আগে খেতে হবে। আর… তারিনকে এসব নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।”

মোহনা উঠে বসতে বসতে বলল,” আচ্ছা। আগে তুই বল। খাওয়া-দাওয়া পরে।”

ঈশান সম্পূর্ণ কাহিনী বলার পর মোহনা হতভম্ব হয়ে গেল। তীব্র রাগে ফেটে উঠে বলল,” এইজন্য তুই তারিনের সাথে ব্রেকাপ করবি কেন? এইখানে তারিনের কি দোষ ছিল? ওর ভাইয়ের অপরাধের শাস্তি ও কেন পাবে?”

ঈশান শান্ত কণ্ঠে বলল,” এজন্যই তো আমি ব্রেকাপ করেছি মম। কারণ ওর ভাইয়ের অপরাধের শাস্তি আমি ওকে দিতে চাই না।”

মোহনা ঈশানের কথার কোনো অর্থ খুঁজে পেল না। বিরক্তি নিয়ে উচ্চারণ করল,” মানে?”

” যেদিন থেকে আমি জানতে পেরেছি আশু নামের লোকটিই তারিনের ভাই, সেদিন থেকে বিশ্বাস করো তারিনকে দেখলেই আমার অদ্ভুত একটা কষ্ট হয়, রাগ হয়। আমি মনে হয় বিয়ের পর ওকে সুখে রাখতে পারব না। প্রতি মুহূর্তে মনে হবে, যার ভাই আমার মায়ের জীবন নষ্ট করেছে তাকে বিয়ে করে আমি সুখের সংসার করছি। ইজ ইট পসিবল? এই অনুভূতি নিয়ে বাঁচার চেয়ে তো মরে যাওয়া অনেক ভালো! আমি মৃত্যুকে বেছে নিতে পারি মম। কিন্তু তোমাকে যে ডিচ করেছে তাকে ক্ষমা করতে পারব না। ”

মোহনা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বামচোখ থেকে সরল রেখার মতো টুপ করে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু।একটু পর হতাশাগ্রস্ত কণ্ঠে আওড়ালো,” এর মানে আমার জন্য? আমার জন্য তুই তারিনকে কষ্ট দিলি? আর নিজেও তো কষ্ট পাচ্ছিস।”

” আমি মনে ক্রোধের আগুন নিয়ে তারিনের সঙ্গে থাকতে পারব না। বরং এতে আমরা কেউই ভালো থাকব না। তার চেয়ে এটাই ভালো না যে আমরা আলাদা হয়ে যাই? ও যত কষ্টেই থাকুক, অন্তত আমার থেকে কম কষ্টে আছে। কারণ ওর কাছে আমি প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক। ও আমাকে খুব সহজেই ঘৃণা করতে পারবে। কিন্তু আমি তো ওকে ঘৃণা করতে পারব না। আবার ওই লোকটিকেও ক্ষমা করতে পারব না। আমার বেঁচে থাকাটা খুব কঠিন মম।”

মোহনার চোখ অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। ঈশান ধাতস্থ হয়ে বলল,” ছাড়ো এসব কথা। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। চলো এখন আমরা খাই।”

মোহনা খাওয়ার আগে বলল,” তার আগে আরেকটা শর্ত আছে।”

ঈশান অধৈর্য্য কণ্ঠে বলল,” আবার কি? আচ্ছা, বলো।”

” তোকে আমার সাথে বাংলাদেশে যেতে হবে।”

” ওকে, যাবো। হ্যাপি?”

” হুম।”

কিছুদিন ধরে তারিন ইউনিভার্সিটি যাচ্ছে না। সকালটা সে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ায়। অনেকেরই এখন পরীক্ষা চলছে। তাই সকালে পড়াতে যেতে হয়। সন্ধ্যায় সে বাসায় থাকে। আজকেও সেরকম একটি দিন। তারিন বাসায় বসে পড়াশুনা করছিল৷ তারিফ বসার ঘর থেকে তারিনকে ডাকল,” তারু, এদিকে আয়। জরুরী কথা শুনে যা।”

তারিন বই বন্ধ করল। ভাইয়ার জরুরী কথা মানেই বিয়ে নিয়ে ঘ্যানঘ্যানানি। আজকেও যদি সেরকম কিছু বলে তাহলে তারিন ছাড়বে না। দুই-চারটা কথা শুনিয়ে দিবে। নিজে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে সেদিকে হুঁশ নেই। তারিনকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে-পরে লেগেছে। আশ্চর্য! চুল বেঁধে একদম তৈরী হয়ে বের হলো তারিন। দেখা গেল মা, দাদী, ভাইয়া সবাই একসাথে বসে আছে। বোঝা যাচ্ছে বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারিন কপালে ভাঁজ ফেলে সবার সাথে বসল। আয়েশা প্রথমে বললেন,” কেমন আছিস মা?”

তারিন এমন উদ্ভট প্রশ্নে অবাক হয়ে চোখমুখ কুচকে ফেলল। সে জবাব দেওয়ার আগেই তারিফ বলল,” যা ভেবেছিস তাই। বিয়ে নিয়েই কথা বলব। কিন্তু আজকে তুই নিষেধ করতে পারবি না। আর তুই নিষেধ করলেও আমরা শুনব না।”

তারিন খুব রেগে কিছু বলতে নিলেই দাদী বললেন,” আগে হুইন্না লো, পাত্রের নাম কি? আগেই চেতিস না। পাত্র হইলো আমার ফাহিম।”

তারিনের বিষম উঠে গেল। আশ্চর্য হয়ে উচ্চারণ করল,” হোয়াট? ফাহিম ভাই? মানে তোমরা কি পাগল?”

আয়েশা হাসতে হাসতে বললেন,” এখানে পাগল হওয়ার কি আছে? ফাহিম খারাপ কই? পাত্র হিসেবে একদম সঠিক।”

তারিন বসা থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে প্রশ্ন করল,” ফাহিম ভাই কি এইসব জানে?”

তারিফ ভ্রু কুচকে জবাব দিল,” জানবে না কেন? সে-ই তো বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। সেজন্যই আমরা এখন তোর মতামত চাইছি।”

তারিনের মাথা ঘুরে উঠল৷ অসম্ভব, অবিশ্বাস্য লাগছে ব্যাপারটা। যেই মানুষ এতোবছরেও ভালোবাসার কথা তারিনকে মুখ ফুটে বলতে পারেনি, এমনকি নিজের পছন্দের মেয়েটিকে অন্যকারো সাথে প্রেম করতে দেখেও মুখে কুলুপ এঁটে থেকেছে, শান্ত থেকেছে, সে হঠাৎ করে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দিল? ব্যাপারটা একদম মানতে পারছে না তারিন। সে বিভ্রান্তি নিয়ে বলল,” তোমরা মিথ্যা বলছ না তো? ফাহিম ভাই সত্যি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে?”

তারিফ বলল,” হ্যাঁ। তো আমি কি বানিয়ে কথা বলছি? আমার কি খেয়ে কাজ নেই? তোর সাথে ড্রামা করব তাও এমন বিষয় নিয়ে! বেকুব!”

তারিন সত্যিই বোকা বনে গেছে। একই সাথে তার ফাহিমের উপর রাগও হচ্ছে। সে তারিনকে জিজ্ঞেস না করে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো কোন সাহসে? তারিন তাকে পছন্দ করে কি-না এটাও কি জানার প্রয়োজন নেই তার? আশ্চর্য তো!”

দাদী বললেন,” ওমা, এমন তব্দা খাইয়া গেলি ক্যান? বিয়াতে রাজি থাকলে কইয়া ফালা! আমরা ব্যবস্থা করি! ফাহিম কইছে ওর মায়রে নিয়া আইবো।”

তারিন গজগজ করে বলল,” অসম্ভব। আমি কোনো বিয়ে-টিয়ে করতে পারব না। আর ফাহিম ভাইকে তো অবশ্যই না।”

তারিন ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। বিরক্তিতে ফুঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়ল। ফাহিমের আগ বাড়িয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার ব্যাপারটি তার অসহ্য লাগছে। একটু পর আয়েশা এসে দরজা ধাক্কালেন,” তারু, শোন মা। তোর সাথে কথা আছে।”

তারিন কাটকাট গলায় বলল,” বিয়ে সংক্রান্ত বিষয় হলে চলে যাও। আমি এসব শুনতেও চাই না।”

আয়েশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,” ফাহিম বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়নি। তোকে মিথ্যা বলা হয়েছে।”

তারিন দ্বিতীয়বারের মতো অবাক হলো। দ্রুত দরজা খুলেই প্রশ্ন ছুঁড়ল,” এর মানে? তাহলে মিথ্যা কেন বললে? কি শুরু করেছো বলোতো?”

আয়েশা তারিনকে ঠেলে ঘরের ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,” বস। সব স্পষ্ট করে বলছি।”

তারিন মনোযোগী শ্রোতার মতো তাকাল। আয়েশা বললেন,” তুই ভার্সিটিতে যাচ্ছিস না বলে ফাহিম এসেছিল খোঁজ নিতে। তখন তুই স্টুডেন্ট পড়াতে গিয়েছিস। আমি আর তোর দাদী ওকে বসতে বললাম। তারপর আমরাই বিয়ের প্রসঙ্গ তুলেছি। আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম ও তোকে পছন্দ করে কি-না। প্রথমে বলতে চায়নি। তারপর স্বীকার করেছে। ছেলেটা খুব লাজুক! নিজে থেকে বিয়ের কথা মরে গেলেও বলবে না। সেজন্য আমিই বলেছি আর কি, তোকে পছন্দ হলে যেন মাকে নিয়ে আসে। তখন সে বলল, আগে তোর মতামত নিতে। তুই রাজি থাকলে সেও রাজি।”

তারিনের এখন হাসি পাচ্ছে। এমন মানুষও হয়? ভালোবাসতে পারে অথচ বলার সাহস নেই। ইশ, ফাহিম যদি এই কথা আরও আগে বলতো তাহলে তারিন ঈশানের সাথে সম্পর্কে জড়াতোই না। কিন্তু এখন কি খুব বেশি দেরি হয়ে গেল না?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here