#তি_আমো
পর্ব ৫২
লিখা- Sidratul Muntaz
সময়টা ছিল শীতের মাঝামাঝি।কুয়াশাচ্ছন্ন এক শীতল ভোরে তারিন হাজির হয়েছিল নিহার বিশাল বাংলো বাড়িটায়। দীর্ঘরাত যাত্রার কারণে খুব ক্লান্ত ছিল সে। তাই দুপুর পর্যন্ত বিশ্রামের ঘুম চললো।
দুপুরের দিকে নিহা গরম গরম নাস্তা আর চা নিয়ে যে ঘরে তারিন ঘুমিয়েছিল, সেই ঘরে এলো। জানালার পর্দা সরিয়ে, কাঁথা টেনে, গুঁতো মেরে তারিনের ঘুম ভাঙালো। তারিন বিরক্ত কণ্ঠে বলল,” প্লিজ, একটু ঘুমাতে দে।”
” চটকানা খেলে বুঝবি ঘুম কি জিনিস। এতোদিন পর দেখা হলো আর তিনি ঘুমাচ্ছেন। এই আমার বাড়ি কি তুই ঘুমাতে এসেছিস?”
তারিন চোখ পিটপিট করে আশেপাশে চেয়ে আড়মোড়া ভাঙল। হাই তুলতে তুলতে বলল,” এখন কি সকাল না বিকাল?”
” দুপুর। যা হাত-মুখ ধুঁয়ে আয়। আমরা এখন ব্রাঞ্চ করব।”
” ব্রাঞ্চ কি?”
” ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ। একসাথে ব্রাঞ্চ।”
তারিন জানালার দিকে তাকালো। রোদ উঠেছে। নরম রোদে ঝলমল করছে সবুজ বাগান। তারিন আয়েশী কণ্ঠে বলল,” তোদের এখানে ভালোই শীত। আর ঘুমাতেও আরাম..”
তারিনের চোখ আবার বুঁজে আসতে নিচ্ছিল। নিহা তাকে সর্বশক্তি দিয়ে একটা ঠেলা মেরে বলল,” আরেকবার ঘুমের কথা উচ্চারণ করবি তো লাথি মেরে খাট থেকে ফেলে দিবো। ওঠ!”
” আহা যাচ্ছি তো। এমন করিস কেন? তোর বাড়ি কিন্তু আর আসব না এমন করলে।”
” ব্ল্যাকমেইল করছিস নাকি তুই আমাকে?”
তারিন হাসতে হাসতে বাথরুমে ঢুকল। একেবারে গোসল সেরে নিল। তারপর ভেজা তোয়ালে মাথায় মুড়িয়ে নিহার সাথে খেতে বসল। পরোটা আর মাংসের ঝোল মুখে নিয়ে বলল,” তোর পুচকি কি করে?”
” ঘুমাচ্ছে।”
” যখনি জানতে চাই কি করে, তুই উত্তর দিস ঘুমাচ্ছে। সারাদিনই কি ঘুমায়?”
নিহা হতাশ কণ্ঠে বলল,” হ্যাঁ।সারারাত জেগে থাকলে তো দিনেই ঘুমাবে তাই না?”
তারিন এই কথা শুনে আফসোস করতে লাগল,” আহারে, তোর তো তাহলে বিরাট কষ্ট। রাতে ঘুমাতেও পারিস না।”
নিহা দায়সারাভাবে বলল,” আমি ঘুমিয়ে যাই। বাপ সামলায় মেয়েকে।”
” বাবাহ, বেচারা সাফিন ভাইকে খাটিয়ে তুই আরামে ঘুমাস, তাই না? মায়া লাগে না?”
” মায়া লাগবে কেন? এই কাজ ও নিজের ইচ্ছেতেই করে। তার শর্ত হলো মেয়েকে যদি সে কোনোভাবে ঘুম পাড়িয়ে ফেলতে পারে তাহলে দিতে হবে।”
তারিন ভ্রু কুচকে বলল,” দিতে হবে মানে? কি দিতে হবে?”
নিহা ইঙ্গিতপূর্ণ কণ্ঠে বলল,” ন্যাকা, তুই বুঝিস না?”
তারিন লজ্জা পেয়ে গেল। বিব্রত কণ্ঠে বলল,” ও আচ্ছা। এবার বুঝেছি।”
নিহা বলল,” কিন্তু মেয়ে ঘুমায় ভোরের দিকে।”
তারিন আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করল,” তাহলে কি ভোরেই…”
” হুম। এতে লাভ আছে। ফজরের নামায মিস হয় না। নামাযের পর শুরু করা যায়। যোহর পর্যন্ত সময় থাকে। ফরজ গোসল করে একদম যোহরের নামায ধরা যায়।”
তারিন এবার না হেসে পারলোই না। চায়ে চুমুক দেওয়া বন্ধ করে খুব জোরে হাসতে লাগল। নিহাও হাসছে। তারপর হঠাৎ সে প্রশ্ন করল,” আচ্ছা, তারিফ ভাইয়া, আন্টি, দাদী, ওরা কেন আসেনি?”
” ওরা আমাদের গেস্ট হাউজে আছে। ভাইয়া তার ভার্সিটির কিছু বন্ধুদের ইনভাইট করেছে। এবার নাকি সবাই নিউ ইয়ার একসাথে সেলিব্রেট করবে। কয়েকজন আগে থেকে বউ-বাচ্চা নিয়ে হাজির। তাদের সাথে দেখা করতেই ভাইয়া, মা, দাদী সেখানে চলে গেছে। আর আমি এখানে এসে গেছি।”
” তোর ভাইয়ার সব বন্ধুদের বিয়ে হয়ে গেছে, তাই না?”
” অবশ্যই। শুধু কি বিয়ে? বাচ্চাও আছে। তাদের মেয়েরাও প্রায় আমার সমান হয়ে গেছে।”
নিহা হেসে উঠল। ঠিক এমন সময় দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল ঈশান। তারিন দরজায় শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই চমকে উঠল। ঈশান নিহার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করছিল,” আমার পাওয়ার ব্যাংকটা…”
বাকি শব্দ আর উচ্চারিত হলো না। কারণ ঈশানের কণ্ঠ থেমে এলো যখন সে তারিনকে দেখল। কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল সবকিছু। থেমে গেল সময়টা। বাতাসে মিশে গেল অস্বস্তি। তারিনের মুখে পরোটা ছিল। সে গিলতে ভুলে গেল। ঈশান ভুলে গেল শ্বাস নিতে। কিছুক্ষণ ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ সে ভারী গলায় বলল,” আরে তারিন, কেমন আছ?”
তারিন খুব কষ্টে মাথা নেড়ে বোঝালো, সে ভালো আছে। তারপর আর কারো মুখে কোনো কথা নেই। নিহা বলল,” আপনার পাওয়ার ব্যাংক সাফিন নিয়েছিল। ওর কাছে হয়তো পাবেন। আমি জানি না।”
সাফিনকে বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে হয়তো বাইরে গেছে। এজন্যই ঈশান এসেছিল নিহার কাছে। কিন্তু আপাতত সেই কথা বলতে ইচ্ছে করল না। সবকিছু কেমন শূন্য স্তম্ভিত লাগছে। পৃথিবীটা যেন থেমে গেছে। সে শুধু মাথা নেড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। যত দ্রুত এখান থেকে বের হতে পারবে ততই যেন তার মঙ্গল! ঈশান বের হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তারিনের হিঁচকি উঠল। নিহা তাকে পানি ঢেলে দিল। তারিন সেই পানি খেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করেই ঝটপট প্রশ্ন ছুঁড়ল,” উনি এইখানে কি করছে?”
” কি করবে আবার? তিশার বার্থডেতে এসেছে!”
” উনি যে আসবে এটা তো তুই আমাকে বলিসনি?”
” বললে যদি তুই না আসতি?”
তারিন অসহ্য কণ্ঠে বলল,” দিস ইজ টু মাচ নিহা! তোর বলা উচিৎ ছিল।”
” এমন করছিস কেন তুই? বি নরমাল! তোদের মধ্যে তো আর কিছু নেই। নাকি তুই এখনও ঈশান ভাইকে ভালোবাসিস যে দেখেই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিস?”
তারিনের চেহারা রক্তবর্ণ হয়ে গেল রাগে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” ফালতু কথা বলবি না।”
নিহা নিজের মুখে আঙুল চেপে ধরে বলল,” ওকে। সাইলেন্ট।”
” উনি কখন এসেছে?”
” গতকাল রাতে।”
” তাহলে আমি যখন সকালে এলাম, উনাকে দেখলাম না কেন?”
” তখন উনি ঘুমিয়েছিলেন। আর উনিও জানতেন না যে তুই এখানে আছিস। জানলে হয়তো আসতেন না।”
তারিন বড় করে শ্বাস ছেড়ে বলল,” আমার খুবই অকওয়ার্ড লাগছে।”
” সমস্যা নেই। সামনে না গেলেই হলো। আচ্ছা, একটা সত্যি কথা বলতো। তোদের ব্রেকাপটা কেন হয়েছিল?”
তারিন কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দিল,” তুই কিন্তু প্রমিস করেছিলি যে এই বিষয় নিয়ে আমাকে কখনও প্রশ্ন করবি না।”
নিহা মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল,” ওকে। স্যরি।”
তারিন শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল। কাজিন মহলে ঈশানের একটা আলাদা ভাবমূর্তি আছে। সবাই তাকে খুব ভালো জানে, শ্রদ্ধাও করে। সেই ভাবমূর্তিটা তারিন নষ্ট করতে চায়নি বলেই কখনও সে ঈশানের সেই মেসেজ, প্রতারণা, এইসব বিষয়ে কাউকে কিছু বলেনি। তারিন নিজেও বিষয়গুলো ভুলতে চায়। সে ঈশানকে কখনোই দোষ দেয় না৷ সে শুধু ধরে নিয়েছে, সবই নিয়তির পরিহাস। আর আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। নিশ্চয়ই এই সব ঘটনার পেছনে কিছু না কিছু ভালো লুকিয়ে আছে।
এদিকে ঈশান ঘর থেকে বের হওয়ার পরেই যেন শ্বাস নিতে পারল। এতোদিন পর তারিনকে হঠাৎ এইভাবে দেখে তার বুকের মধ্যে রীতিমতো ভূ-কম্পন শুরু হয়েছে। এই তীব্র আলোড়ন সামলাতে সে দেয়াল চেপে ধরল। বহুদিন পর তারিনের অবাক হয়ে তাকানো, বিস্ময়ভরা দৃষ্টি, ভেজা স্নিগ্ধ মুখ, কেমন আছ জিজ্ঞেস করার পর কোমল হাসি দিয়ে মাথা নাড়ানো, এসব এখনও চোখে লেগে আছে। ঈশান ভুলতে পারছে না। নিজেকে সামলাতেও পারছে না। তার ভয়ংকর কষ্ট হচ্ছে। যেই কষ্ট ভেতর থেকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে তাকে কয়লা বানিয়ে দিয়েছে এতোকাল, সেই কয়লাতেই যেন আবার নতুন করে আগুন জ্বলে উঠেছে।
সময় যত বাড়ছিল নিহাদের বাড়িতে মেহমানদের ভীড়ও তত বাড়ছিল। আবারও সেই এক উৎসবের আমেজ, সিলেট ভ্রমণ, আনন্দমুখর মিলনায়তন। সন্ধ্যার মধ্যে সবাই উপস্থিত হয়ে গেল। বাড়ির বাইরে মাদুর বিছিয়ে, সামিয়ানা টানিয়ে সবার গল্প-গুজবের ব্যবস্থা করা হলো। জন্মদিন তো কেবল একটি বাহানা। মূল উদ্দেশ্য হলো সবাই এক হওয়া। নিহা একদম পাকা গিন্নীর মতো রান্নাঘরে অতিথিদের জন্য রান্নাবান্না করছিল। মোহনা এসে ফিসফিস করে নিহাকে জিজ্ঞেস করল,” তারিনের সাথে কি ঈশানের দেখা হয়েছে?”
নিহা অতি আনন্দিত হাসি দিয়ে মাথা নাড়ল,” হয়েছে। আজ দুপুরে।”
” কিছু বুঝলে?”
” তারিন একটু রেগে গিয়েছিল। কিন্তু ঈশান ভাই কিছু বলেননি। আমি বুঝতে পারছি না ওদের মধ্যে এখনও কিছু আছে নাকি…”
মোহনা নিহার এক কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করে বলল,” আরে আছে, আছে। শুধু আরও কয়েকবার দেখা করাতে হবে।”
” কিন্তু ওরা তো একজন আরেকজনকে কঠিনভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে। ঈশান ভাই বাইরে এলে তারু ভেতরে চলে যাচ্ছে, ঈশান ভাই দক্ষিণে গেলে তারু ছুটে যাচ্ছে উত্তরে। এমন উল্টোদিকে যাওয়ার খেলা খেলতে থাকলে দেখা হবে কিভাবে?”
মোহনা হেসে ফেলে বলল,” এতো অধৈর্য্য হওয়ার কিছু নেই। আমার মনে হয় ওরা যদি কমপক্ষে একঘণ্টা একসঙ্গে বসে কথা বলে তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
নিহা চোখ বড় বড় করে বলল,” এটা কি কোনোদিন সম্ভব? দু’জনেই তো ঘাড়ত্যাড়া।”
” অবশ্যই সম্ভব। আমাদের একটা প্ল্যান বের করতে হবে।”
নিহা মেরিনেট করা মুরগির মাংস তেলে ছেড়ে দিল। তারপর খুন্তি দিয়ে নাড়তে লাগল আর ভাবতে লাগল। মোহনাও তার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছে। সাফিনের চাচী পেঁয়াজ কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করলেন,” মাংস বসাবো কিসে, মা? বড় ডেগ লাগবে না? বের করেছো?”
নিহা চিন্তিত হয়ে বলল,” দশকেজি মাংস রাঁধার মতো ডেগ তো স্টোর-রুমে আছে। বের করা অনেক ঝামেলা। উপরে উঠতে হবে। আচ্ছা দেখছি..”
মোহনা সঙ্গে সঙ্গে চুটকি বাজিয়ে বলল,” আইডিয়া পেয়ে গেছি।”
” কিসের আইডিয়া?”
” আমি তারিনকে পাতিল নামানোর কথা বলে স্টোর-রুমে নিয়ে যাবো। তুমিও ঈশানকে নিয়ে স্টোর-রুমে চলে আসো। তারপর কোনোভাবে দু’জনকে ভেতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে লক করে দিবো।”
নিহা এই কথা শুনে শুধু হাসতেই লাগল। মোহনা বলল,” হাসলে হবে না৷ কাজটা পারতে হবে।”
” এমন করা গেলে তো দারুণ হতো। কিন্তু ঈশান ভাইকে আমি কি বলে আনব?”
” কিছু একটা বলে নিয়ে আসো। এইটা কোনো ব্যাপার হলো নাকি?”
নিহাকে চিন্তায় ফেলে রেখে মোহনা চলে গেল তারিনকে খুঁজতে। তারিন ড্রয়িংরুমে শরবত বানাচ্ছিল। আরিশা তারিনের সাথে বসে আছে। তার হাতে একটা ফলের বই। সে বিভিন্ন ফলের নাম জিজ্ঞেস করে তারিনকে বিরক্ত করছে। মোহনা বলল,” তারিন, এদিকে আসো। একটা জরুরী কাজ আছে।”
” কি কাজ আন্টি?”
” যেতে যেতে বলি।”
মোহনা তারিনের হাত ধরে স্টোর-রুমে নিয়ে এলো। অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গাটিতে একটা ভ্যাপসা গন্ধ ছড়িয়ে আছে। মোহনা বিসমিকে ডেকে তার ব্যাগ থেকে এয়ার ফ্রেশনার আনাল। তারপর পুরো ঘরে স্প্রে করে দিল। আলো জ্বালানো হলো। তারিন চারদিক দেখতে দেখতে বলল,” আমরা এইখানে কি করব?”
” সানসেটের উপর থেকে বড় পাতিল নামাতে হবে। মাংস রান্নার জন্য। তুমি উপরে উঠতে পারবে না?”
” হ্যাঁ পারব।”
পেছন থেকে বিসমি আগ বাড়িয়ে বলল,” আমি উঠবো ম্যাডাম?”
মোহনা চোখ পাকিয়ে মৃদু ধমক দিল,” তোমাকে উঠতে বলেছি আমি? যাও এখান থেকে। ”
বিসমি মাথা নিচু করে চলে গেল। মোহনা বলল,” ওঠো তারিন।”
” কিভাবে উঠব?”
” দাঁড়াও, আমি টুল দিচ্ছি।”
দু’টো উঁচু সাইজের টুল চেয়ারের উপর রেখে তারিনের উপরে ওঠার ব্যবস্থা করা হলো। তারিন যখন উপরে উঠে গেছে, তখন মোহনা চেয়ার আর টুল সরিয়ে দিল। তারিন ভয়ে চোখ বড় করে বলল,” আমি এবার নামব কিভাবে?”
” নামার দরকার নেই। তুমি ওখানেই থাকো। আমি একটু আসছি।”
” আন্টি প্লিজ, আমাকে এইভাবে রেখে যাবেন না!”
” পাঁচমিনিট।”
মোহনা বের হয়ে নিহাকে খুঁজতে লাগল। এখনও ঈশানকে নিয়ে আসছে না কেন মেয়েটা? একটু পরেই তারা এলো। ঈশান মোহনাকে দেখে ভ্রু কুচকে বলল,” কি হয়েছে মম? এনিথিং সিরিয়াস?”
নিহা বলল,” একটা কাজ করতে হবে ঈশান ভাই। কি কাজ সেটা মোহনা আন্টি বলবে।”
মোহনা ইতস্তত করে বলল,” স্টোর-রুমে একটা জরুরী কাজ আছে।”
” কি জরুরী কাজ?”
মোহনা বেশি কথা না বলে ঈশানকে জোর করে ঠেলে স্টোর-রুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা লক করে দিল। ঈশান হতভম্ব হয়ে বলল,” আরে, কি হচ্ছে এসব? তোমরা দরজা খোলো, প্লিজ। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
উপর থেকে তারিন কথা বলল,” আরে ঈশান, আপনি এখানে কি করছেন?”
ঈশান অবাক হয়ে উপরে তাকাল। মুহূর্তেই তার কাছে পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল। নিহা আর মোহনা যে ইচ্ছাকৃতই কাজটি করেছে সেটা বুঝতে পেরেই ঈশান বলল,” কিছু না, তুমি উপরে কি করছ?”
” কাজ করছি। হাড়ি-পাতিল নামানোর কাজ।”
” তাহলে ধরে নাও আমি তোমাকে হেল্প করতে এসেছি। তোমার কি কোনো হেল্প লাগবে?”
বাইরে থেকে মোহনা আর নিহা কান পেতে তাদের কথোপকথন শুনছিল আর হাসছিল। তারিন বলল,
” হ্যাঁ। হেল্প তো লাগবে। কিন্তু আপনি দরজা বন্ধ করলেন যে? দরজা খুলে দিন!”
” দরজা তো আমি বন্ধ করিনি। বাইরে থেকে বন্ধ হয়ে গেছে।”
এবার তারিনও সবকিছু বুঝতে পারল। যথেষ্ট অস্বস্তি নিয়ে বলল,” আচ্ছা, তাহলে আপনি চেয়ারগুলো দিন। আমি নিচে নামব।”
ঈশানের হঠাৎ মনে হলো, তারিন নিচে নামতে গেলেই পা পিছলে পড়ে যাওয়ার মতো একটা ঘটনা ঘটবে। তখন ঈশানকেই তারিনকে ধরতে হবে। বাইরে থেকে ফাহিমের গলা শোনা যাচ্ছে,” মোহনা আন্টি, নিহা এখানে কি করছ তোমরা?”
মোহনা পাশ কাটানো গলায় বলল,” নাথিং। তুমি যেখানে যাচ্ছিলে সেখানে যাও ফাহিম। এখানে তোমার কাজ নেই।”
তখনি ভেতর থেকে তারিন চেঁচিয়ে উঠল,” ফাহিম ভাই, একটু ভেতরে আসবেন প্লিজ? আমি নামতে পারছি না।”
ফাহিম ত্বরিত বলল,” তারিন ভেতরে আছে নাকি? দেখি, সরো।”
নিহা আর মোহনাকে উপেক্ষা করেই ফাহিম দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ঈশান দাঁড়িয়ে আছে নিচে আর তারিন বসে আছে সানসেটের উপরে। এই দৃশ্য দেখে যারপরনাই বিস্মিত হলো ফাহিম। তারিন অনুরোধ করে বলল,” আমাকে নামতে সাহায্য করুন।”
ফাহিম হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,” এসো। লাফ দাও।”
ঈশান আতঙ্কগ্রস্ত কণ্ঠে নিষেধাজ্ঞা দিল,” এটা রিস্ক হয়ে যাবে। চেয়ার দিচ্ছি আমি।”
ঈশানের কথার মাঝেই তারিন লাফ দিয়ে ফেলল। ফাহিম শক্ত করে তার হাত ধরে রেখেছিল। তারিন আরেকটু হলেই পড়ে যেতে পারতো; ফাহিম তাকে খুব সাবধানে ধরে ফেলল। ঈশান ছুটে যেতে নিয়েও গেল না। কারণ ফাহিমই তারিনের জন্য যথেষ্ট। সেখানে তার যাওয়াটা নিষ্প্রয়োজন! সফলভাবে নিচে নামতে পেরে তারিন আর ফাহিম দু’জনেই হেসে উঠল। মোহনা আর নিহা তখন ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা সবাই একটু আপত্তি নিয়েই তাকিয়ে আছে তারিন আর ফাহিমের দিকে। ফাহিম সেটা লক্ষ্য করেই লাজুকমুখে বলল,” সবাইকে একটা গুড নিউজ দেওয়া হয়নি। আমরা চেয়েছিলাম সারপ্রাইজ রাখতে।”
নিহা আশঙ্কাজনক কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” কি গুড নিউজ?”
ফাহিম তারিনের দিকে চেয়ে অনুমতি চাইল,” বলব?”
তারিন মাথা নিচু করে সম্মতি দিতেই ফাহিম খোশমেজাজে বলল,” উই আর এংগেজড।”
মুহূর্তেই যেন বজ্রপাত ঘটল ঘরটায়। কারো মুখে হাসি ফুটল না। কারণ প্রথমে কেউ বুঝতেই পারল না ব্যাপারটা। নিহার মনে হলো সে ভুল শুনেছে।মোহনা নিশ্চিত হতে আবার প্রশ্ন করল,” কি?”
এবার তারিন কথা বলল,” আমাদের পারিবারিকভাবে এংগেজমেন্ট হয়ে গেছে। কিন্তু কাউকে জানানো হয়নি।”
মোহনা সঙ্গে সঙ্গে তাকালো ঈশানের দিকে। ঈশান চমৎকার করে হেসে বলল,” কংগ্রাচুলেশনস, ফাহিম।”
” থ্যাঙ্কিউ ঈশান ভাইয়া।”
মোহনাও খুব কষ্টে হাসল, বলল,” কংগ্রাচুলেশনস। অনেক হ্যাপি থেকো তোমরা।”
নিহা তারিনের কাছে গিয়ে বলল,” আগে জানাবি না? গাঁধী! তাহলে এতো কষ্ট করতেই হতো না।”
তারিন হেসে বলল,” কষ্ট মানে?”
” কিছু না।”
” আচ্ছা শোন, আমি তো উপরে পাতিল খুঁজে পেলাম না। ওই সাইডে মনে হয় আছে। আবার উঠতে হবে।”
মোহনা বাঁধা দিয়ে বলল,” থাক, লাগবে না। বিসমিকে দিয়ে নামাবো। তুমি যাও।”
তারিন মাথা নেড়ে বলল,” আচ্ছা। ”
তারপর তারিন আর ফাহিম হাত ধরে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। ঈশান নিষ্পলক তাকিয়ে রইল তাদের হাতবন্ধনের দিকে। বুকের ভেতরটা কেউ পিষে দিচ্ছিল যেন। মোহনা ঈশানের কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখল। তার দৃষ্টি অশ্রুপূর্ণ হয়ে এসেছে। ঈশান সন্তর্পণে নিজের আবেগটাকে লুকিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,” ওহহো! এখানে কাঁদার কি আছে মম? চিল, ইটস অ্যাবস্যুলুটলি অলরাইট!”
মোহনা ভেজা-সিক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” আসলেই কি অলরাইট? তোর কষ্ট হচ্ছে না?”
” একদম না!”
মোহনা নিহার দিকে চেয়ে বলল,” তুমি কি এটা আগে জানতে না, নিহা?”
নিহা দুঃখিত কণ্ঠে বলল,” আমি সত্যিই জানতাম না। তারু তো সব কথা বলে। কিন্তু এইটা বলেনি। হয়তো আসলেই সারপ্রাইজ রাখতে চেয়েছিল।”
মোহনা বিষাক্ত একটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করল। ঈশান অযথাই হাসল। বলল,” ইটস টোটালি ফাইন, মম। চলো যাই।”
ঈশান মোহনাকে নিয়ে স্টোর-রুম থেকে বের হয়ে গেল। আর নিহা ছুটে গেল তারিনের কাছে।
চলবে