#তি_আমো
পর্ব ৫৪
লিখা- Sidratul Muntaz
তারিন মুখে হাসি এঁকে দাঁড়িয়ে আছে। ঈশান ধীরপায়ে তার দিকে হেঁটে গেল। চোখে আকুল অনুরোধ। তারিন ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করল,” কিছু বললেন?”
ঈশান মাথা নিচু করে বলল,” আমাকে মাফ করে দাও।”
” কিসের জন্য মাফ চাইছেন? ও, বুঝেছি। আমাকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য? সেজন্য মাফ চাওয়ার কিছু নেই। আমি আপনাকে অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছি। তাছাড়া আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ আপনি আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন।”
তারিনের কথাগুলো ফলার মতো আঘাত করছে ঈশানের র/*ক্তক্ষরিত হৃদয়ে। সে ব্যাকুল হয়ে বলল,” আমি ভুল করেছিলাম। কিন্তু আমাকে এতোবড় শাস্তি দিও না প্লিজ। আমি মরে যাচ্ছি।”
” আমারও মরে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। যখন আপনি আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলেন।”
ঈশান নির্বাক। তারিন কঠিন দৃষ্টিতে বলল,” তাও থ্যাঙ্কিউ। আপনি যদি ছেড়ে না যেতেন তাহলে আমি ফাহিম ভাইকে পেতাম না। আপনি তো ভালোবাসা শিখিয়েছেন। কিন্তু ফাহিম ভাই আমাকে শিখিয়েছেন ভালোবাসার মর্যাদা কিভাবে রাখতে হয়। আপনি এখন কোন মুখে বলছেন আপনাকে ক্ষমা করতে? নিজেকে প্রশ্ন করুন। সত্যিই কি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য আপনি?”
ঈশান তীব্র অপরাধবোধ নিয়ে বলল,” আমি স্বীকার করছি, আমি ভুল করেছি। কিন্তু আমি তো তখন সত্যিটা জানতাম না। তুমি কেন একবার বোঝালে না আমাকে? যখন আমি ফিরে এসেছিলাম তখন আমার গালে থাপ্পড় মেরে কেন বললে না সবকিছু?”
” কাকে বলবো? যে আমার ভাইয়ের উপর প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে আমার নিষ্পাপ ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে চলে যায় তাকে? সত্যিই কি আপনার ভুল ভাঙানো উচিৎ ছিল আমার? বরং আমি তো মনে করি ভালো হয়েছে যে আপনি ভুল বুঝেছেন। কারণ একটা ভুলের মাধ্যমেই আমি আপনার সঠিক রূপটা চিনতে পেরেছি। ঈশান আপনি না আমাকে কখনও ভালোবাসেননি। ভালোবাসার মানুষকে এতো সহজে ছেড়ে দেওয়া যায় না। আপনি শুধু আমার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন। তারপর যখন জানতে পারলেন আমার ভাইয়ের পরিচয়, তখন আপনার আকর্ষণটা মুছে গেল।”
” না। আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। এখনও প্রচন্ড ভালোবাসি।”
” যে ভালোবাসা প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে যায় সেই প্রচন্ড ভালোবাসা আমার লাগবে না ঈশান।”
” তোমার কি আমার জন্য একটুও কষ্ট হচ্ছে না?”
” একদম না। কষ্ট হওয়ার কিছু নেই। তবে দয়া হচ্ছে, করুণা হচ্ছে।”
” কেন তারিন? কেন এতো নিষ্ঠুর হচ্ছো তুমি? ভালো না বাসলে এই দুইবছর কেন একটুও শান্তিতে থাকতে পারিনি আমি? কেন এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারিনি তোমাকে? কেন যন্ত্রণায় কেটেছে আমার প্রত্যেকটি দিন? তবুও তুমি বলবে আমি তোমাকে ভালোবাসি না?”
তারিন মুচকি হেসে বলল,” এগুলো আপনার অপরাধবোধ ঈশান। এই অপরাধবোধকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করবেন না।”
তারিনের নিষ্ঠুর বাণীগুলো ঈশানের সমস্ত শরীরে বিষাক্ত কিছু ছড়িয়ে দিল। অসহ্য অনুভূতিতে ঈশান একবার চিৎকার করে উঠল। তখনি বৃষ্টি নামল। আর ঈশান অবাক হয়ে খেয়াল করল, তার আশেপাশে কেউ নেই। এতোক্ষণ ঈশান কার সাথে কথা বলছিল? তারিন তো এখানে নেই! সেই কবেই চলে গেছে সে! এতোক্ষণ তারিনের হয়ে যে ঈশানকে উত্তরগুলো দিচ্ছিল সে পারতপক্ষে ঈশানের বিবেকবোধ। আসলেই, তারিনের কাছে ক্ষমা চাওয়ার কোনো অর্থ নেই। কারণ সে নিজে ক্ষমা ডিজার্ভ করে না। সে তারিনকেও ডিজার্ভ করে না। এই শীতল বৃষ্টির রাতে নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অসহায় বলে বোধ হলো ঈশানের। তার মতো দুঃখী আজকের এই রাতে বুঝি আর কেউ নেই। বৃষ্টির শীতল পানি আর ঈশানের চোখের উষ্ণ জল মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। এই বৃষ্টির পানির সাথে তার জমানো কষ্টগুলোও ধুঁয়ে-মুছে যাচ্ছে না কেন?
ঈশান একটা ছাউনির নিচে এসে দাঁড়ালো।
তারিফের বন্ধুদের সাথে আসরেই বসেছিল ফাহিম।তারিন সেখানে গিয়ে তাকে হাত নাড়িয়ে ডাকল।ওই ছোট্ট ইশারাতেই দ্রুত ছুটে এলো ফাহিম।
” কি হয়েছে, বলো।”
তারিন আড়ষ্ট গলায় বলল,” আমি ঈশান ভাইয়ের সাথে বকুলতলায় গিয়েছিলাম।”
ফাহিম নির্বিকারচিত্তে বলল,” জানি।”
” আপনি নিষেধ করেছিলেন তার কাছাকাছি যেতে। তবুও আমি তাকে নিয়ে বকুলতলায় চলে গেছি এজন্য আপনি রাগ করেননি?”
” রাগ করা উচিৎ? ”
” অবশ্যই। ”
ফাহিম একটু চিন্তিত হয়ে বলল,” কিভাবে রাগ করতে হয়? একটু শিখিয়ে দাও তো।”
তারিন হেসে ফেলল। তারপর মাথা নিচু করে বলল,” শুনুন, আমি চেয়েছিলাম ঈশান আমার ভাইয়া আর মোহনা আন্টির ব্যাপারটা বুঝুক। তাদের বিয়ের ক্ষেত্রে ঈশান একটা বড় বাঁধা হতে পারে। আর আমি শতভাগ নিশ্চিত যে ঈশান না চাইলে মোহনা আন্টি কখনোই বিয়েতে রাজি হবে না। সেজন্যই আমি ঈশানকে নিয়ে গেছিলাম যেন সে ব্যাপারটা বোঝে।”
ফাহিম শান্ত কণ্ঠে বলল,” এটা আমি বুঝেছি, তারু।”
তারিন অবাক হয়ে তাকাল,” সত্যি বুঝেছেন? কি করে বুঝলেন?”
” বুঝেছি। তুমি যখন ঈশান ভাইকে নিয়ে গেলে তখন সবার আগে এই ব্যাপারটাই মাথায় এসেছিল আমার।”
” আপনার জায়গায় অন্যকেউ হলে কিন্তু অন্যকিছু ভাবতো।”
” আমি তো অন্যকেউ না।”
তারিন কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে বলল,” জানি। আপনি দারুণ মানুষ। আমার ইচ্ছে করছে আপনাকে জড়িয়ে ধরতে। ”
ফাহিম আশেপাশে চেয়ে দ্বিধান্বিত স্বরে বলল,” এতো মানুষের সামনে?”
তারিন আবারও হেসে উঠল। ফাহিমও হাসছে। ঠিক সেই সময় বৃষ্টিটা নামল। সবাই অবাক হয়ে গেল। কেউ কেউ আবার শীতকালের এই হঠাৎ বৃষ্টিতে খুশি হলো। আবহাওয়াও যেন রসিকতা করছে। বাগানে যারা আসর বসিয়েছিল তারা সবাই ছুটে ঘরের দিকে পালাতে লাগল। তারিন বলল,” আমরা ভেতরে যাবো না। চলুন ওইখানে গিয়ে দাঁড়াই। আপনার সাথে কথা আছে।”
” চলো।”
তারিনরা যেই ছাউনির নিচে এসে দাঁড়ালো সেটা একটা কাঁচঘরের মতো। দেয়ালের পেছনেই দাঁড়িয়েছিল ঈশান৷ তারা কেউ ঈশানকে লক্ষ্য করল না। কারণ তারা নিজেদের আলোচনায় ব্যস্ত। তারিন বলল,” আমাদের বিয়েটা কিন্তু আরও পরে হবে। ভাইয়া না বিয়ে করা পর্যন্ত আমিও বিয়ে করব না।”
” ওকে। এজ ইউর উইশ।”
” আপনি অপেক্ষা করতে পারবেন তো?”
“এতোবছর ধরে অপেক্ষা করেছি আর মাত্র কিছুদিন কেন পারব না?”
তারিন মজা করে বলল,” কয়বছর ধরে অপেক্ষা করেছেন, শুনি?”
ফাহিম একটু হিসাব করে বলল,” এপ্রোক্সোমেটলি পাঁচবছর হবে। ছয়বছর রানিং।”
তারিন বিস্মিত হয়ে গেল। চোখ বড় বানিয়ে বলল,” এর মানে কি? নিহার সাথে আমার ফ্রেন্ডশীপই তো ছয়বছরের। আপনি তাহলে আমাকে প্রথম থেকেই পছন্দ করতেন?”
” কোনো সন্দেহ আছে?”
তারিন মনখারাপের কণ্ঠে বলল,” একবারও কেন বলেননি ফাহিম ভাই?”
” বললে কি হতো? তুমি রিজেক্ট করে দিতে।যে কনজার্ভেটিভ মাইন্ডের ছিলে তুমি!তারপর হয়তো আমার জন্য বাড়িতেও আসা বন্ধ করে দিতে। এমনিও আসতে সপ্তাহে দুয়েকবার। যাওয়া- আসা বন্ধ করে দিলে দেখাও হতো না। আর কথা হওয়া তো দূরের ব্যাপার। আমি তো মরেই যেতাম।”
তারিন হেসে ফেলল। ফহিমও হাসল। প্রাণবন্ত, সুন্দর হাসি। তারিন ফাহিমের একহাতের বাহু জড়িয়ে ধরে স্বপ্নাতুর কণ্ঠে বলল,” আমার ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে ছোটবেলা থেকে অনেক পরিকল্পনা ছিল। আজ মনে হচ্ছে সব পূরণ হবে। ভাইয়া আর মোহনা আন্টির বিয়েটা দ্রুত হয়ে যাক। আপনি কিন্তু ভাইয়াকে রাজি করাবেন।”
” চিন্তা কোরো না। আমার যতদূর মনে হয় ভাইয়া রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু মোহনা আন্টির ব্যাপারটা বলতে পারছি না। এইক্ষেত্রে ঈশান ভাই আমাদেরকে হেল্প করলে ভালো হতো। সে ছাড়া মোহনা আন্টিকে কেউ রাজি করাতে পারবে না।”
” ঠিক বলেছেন।”
” কিন্তু ঈশান ভাই কি হেল্প করবে? তোমার কি মনে হয় তারু?”
তারিন কিছু জবাব দিতে পারল না। সেও আসলে বুঝতে পারছে না যে ঈশান কি করবে! তবে ঈশান দেয়ালের পেছন থেকে তাদের সব কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল। তার বামচোখ থেকে অনবরত অশ্রু নির্গত হচ্ছিল। সে বাম হাত দিয়ে মুছে নিচ্ছিল।
সাফিন জন্মদিনের কার্টুন আঁকা কাগজী টুপিটা আবার তিশার মাথায় দিল৷ নিহা ঝাঁজালো স্বরে বলল,” এটা সরাও। ও ব্যথা পাচ্ছে কপালে।”
সাফিন অবাক হয়ে বলল,” ব্যথা পাবে কেন? এইযে আমার মেয়ে হাসছে!”
সাফিন মেয়ের দিকে চেয়ে আহ্লাদ করল,” কুচুপুচু মামণিটা…আমার সোনামণিটা..”
নিহা ফট করে করে টুপিটা নিয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিল। সাফিন চিৎকার করে উঠল,” আরে ফেলে দিলে কেন? আমি এটা কত শখ করে কিনেছিলাম!”
” তোমার শখের আমি গুষ্টি মারি। খবরদার আমার মেয়েকে এসব ধারালো জিনিস পরাবে না।”
নিহা তিশাকে কোলে নিয়ে সোফায় বসল। সাফিন বিরস মুখে চেয়ে রইল। তিশা হাত-পা নাড়িয়ে বাবার কাছে যাওয়ার তাল করছে। সাফিন বলল,” ও আমার কাছে আসতে চায়”
নিহা গম্ভীর গলায় বলল,” আসতে চায় না।”
” ওইতো চাইছে। এসো মামণি..”
সাফিন হাত পাততেই তিশা ঝাপটাতে লাগল। নিহা বাধ্য হয়ে দিয়ে দিল। তারপর রাগী কণ্ঠে বলল,” বাপের কাছেই যা। বাপই তোর সব৷ মা তো কিছু না।”
সাফিন হু-হা করে হাসছে। মেয়ে বাবাভক্ত হওয়ায় সে গর্বিত। নিহার মন-মেজাজ এখন খুব খারাপ। সে ভেবেছিল বাগানে কেক কাটার আয়োজন করবে। তিশার অনেকগুলো ছবি তোলা হবে। কিন্তু বৃষ্টিটা এসে সব ভেস্তে দিল। এখন যা করার বাড়ির ভেতরেই করতে হবে। এতো মানুষ এক বাড়িতে গাদাগাদি করে বসে আছে এটা ভাবতেই তো অসহ্য লাগছে! সবাই নিশ্চয়ই বিরক্ত হচ্ছে৷ সাফিন একটু পর বলল,” চিন্তা কোরো না। বৃষ্টি দ্রুত থেমে যাবে। এটা তো আর কালবৈশাখীর বৃষ্টি না। শীত বাড়ানোর হালকা বৃষ্টি। ”
নিহা খ্যাক করে বলে উঠল,” বৃষ্টি থামলেও আর লাভ কি? আমরা কি কাদার মধ্যে বাইরে কেক কাটতে যাবো?”
” তুমি এতো রাগ করছো কেন? শোনো একটা ভালো খবর দেই। তারিফ ভাইয়া কিন্তু মোহনা আন্টিকে প্রপোজ করতে যাচ্ছে।”
নিহা হকচকিয়ে বলল,” হোয়াট? সিরিয়াসলি?”
” সত্যি। একটু আগে তারু এসে তোমাকে খুঁজছিল। তুমি ব্যস্ত ছিলে তাই আমাকে এসে বলল।”
নিহা উঠে দাঁড়ালো। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” সাফিন, তুমি এতোক্ষণ এই কথা কেন বললে না?”
” মাত্র মনে পড়ল।”
” ইডিয়েট! সরো যেতে দাও।”
নিহা দ্রুত ঘর থেকে বের হলো। তার চঞ্চল দৃষ্টি তারিনকে খুঁজছে। ড্রয়িংরুমে নীরারা বসে আছে। নিহা সবার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,” তারিনকে দেখেছো কেউ?”
সামিয়া বলল,” তারিন মনে হয় বাইরে করিডোরের দিকে আছে।”
নিহা তাড়াতাড়ি সেখানেই গেল। ফাহিম আর তারিন জোট বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। নিহার উপস্থিতি টের পেয়ে তারিন ঘুরে তাকাল। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,” নিহা, তুই কোথায় ছিলি এতোক্ষণ? জানিস না তো কতকিছু হয়ে গেছে!”
” কি কি হয়েছে? ভাইয়া আর মোহনা আন্টির বিয়ে ঠিক হয়েছে?”
ফাহিম এই কথা শুনে হেসে ফেলল। তারিন একটু রাগী দৃষ্টিতে বলল,” আরে না, এখনও অতোদূর যায়নি। তবে ইনশাআল্লাহ হবে। কারণ মা ভাইয়াকে রাজি করাচ্ছে।”
” কিসের জন্য রাজি করাচ্ছে?”
” বিয়ের জন্য।”
নিহা তাচ্ছিল্য করে বলল,” হয়েছে বুঝেছি। এই কাজ আর কস্মিনকালেও সম্ভব হবে না। আন্টি তো সেই কবে থেকেই রাজি করাচ্ছে। তোর ঘাড়ত্যাড়া ভাই শুনলে তো!”
” ভাইয়ার নামে উল্টা-পাল্টা কথা বলবি না। তখনকার সময় আর এখনকার সময় আলাদা। ভাইয়াকে দেখে মনে হচ্ছে রাজি হবে। আর এখন তো বুড়িও রাজি হয়ে গেছে।”
নিহা বিস্ময় নিয়ে বলল,” দাদী রাজি হয়ে গেছে? ওয়াও, কিভাবে রাজি হলো? তিনি না মোহনা আন্টির নামও শুনতে পারতেন না?”
তারিন গৌরবান্বিত কণ্ঠে বলল,”সব ক্রেডিট এই ভদ্রলোকের।”
ফাহিম হাসি দিয়ে তাকালো। নিহা কোমরে হাত গুজে বলল,” ও এইবার বুঝেছি। দাদী যে ফাহিম ভাইকে অসম্ভব পছন্দ করে এই ব্যাপার আমি ভুলেই গেছিলাম। ফাহিম ভাই কি মন্ত্রে রাজি করালেন বলেন তো?”
ফাহিম বলল,” বেশি কিছু করতে হয়নি। শুধু একটু বুঝিয়েছি। আর এখনি তোমরা এতো খুশি হয়ে যেও না। কারণ মোহনা আন্টি কিন্তু এসবের কিছুই জানে না। আর ঈশান ভাইয়ের জন্য তিনি বিয়েতে রাজি নাও হতে পারেন।”
সবার চেহারায় এবার দুশ্চিন্তা ভর করল।
আয়েশা দু’টি মোটা স্বর্ণের বালা তারিফের হাতে দিয়ে বলল,” এগুলো নিয়ে মোহনাকে দিবি।”
তারিফ আপত্তিকর দৃষ্টিতে তাকাল। খুব অস্বস্তি নিয়ে বলল,” এসব তুমি কি শুরু করেছো মা? ছাড়ো না। আজকেই কেন সব করতে হবে?”
” এমনিই অনেক দেরি হয়েছে। আর দেরি করে কাজ নেই। একদিন আমিই তোকে বলেছিলাম মোহনাকে ফিরিয়ে দিতে। এখন আমিই আবার বলছি, ওকে ফিরিয়ে আন।”
তারিফ অপরাধীর মতো মাথা মাথা নিচু করে বলল,” একবার আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি এবার যদি সে আমাকে ফিরিয়ে দেয়? আমি কি করব মা?”
” এরকম কক্ষনো হবে না। আর যদি সত্যি ফিরিয়ে দেয় তাহলে সেটা তখন দেখা যাবে। তাই বলে কি তুই চেষ্টা করবি না?”
তারিফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বালাগুলো হাতে নিল। সুখী হওয়ার দ্বিতীয় সুযোগ জীবন সবাইকে দেয় না। তারিফকে জীবন দ্বিতীয়বার সুযোগ দিয়েছে। তার উচিৎ সুযোগটাকে কাজে লাগানো। তারিফ ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরেই আয়েশা তারিনকে ডাকলেন। তারিনসহ নিহা আর ফাহিমও ছুটে এলো।
আয়েশা হাসিমুখে বললেন,”এতোদিন তোর ভাইয়ের সুবুদ্ধি উদয় হয়েছে। বল আলহামদুলিল্লাহ।”
তারিন তুমুল উত্তেজনা নিয়ে বলল,” ভাইয়া কি যাচ্ছে?”
আয়েশা মাথা নাড়লেন। নিহা আর তারিন খুশিতে জোরে ‘ আলহামদুলিল্লাহ ‘ বলে চিৎকার দিয়ে উঠল। একে-অপরের হাত ধরে বাচ্চাদের মতো লাফাতে লাগল। তাদের উচ্ছ্বাস দেখে নিঃশব্দে হাসছিল ফাহিম আর আয়েশা।
তারিফ দরজায় টোকা দিল। ঘরে শুধু ঈশান আর মোহনা ছিল। তারা কথা বলছিল। তারিফের উপস্থিতি টের পেতেই তাদের কথা বন্ধ হয়ে গেল। তারিফ ইতস্তত করে বলল,” আমি কি ভেতরে আসতে পারি?”
মোহনা মুচকি হেসে বলল,” এসো।”
তারিফ ভেতরে প্রবেশ করল। ঈশান বলল,” আমি বাইরে যাচ্ছি।”
তারপর অনুমতির অপেক্ষা না করেই সে বেরিয়ে গেল। তারিফ অযথাই হেসে বলল,” কি করছিলে?”
” তেমন কিছু না। ছেলের সাথে গল্প করছিলাম। তুমি কি কিছু বলবে?”
” হুম।”
“বলো।”
তারিফ কিছুই বুঝতে পারছে না কিভাবে শুরু করা উচিৎ। এখন আর সেই বয়সও নেই যে দুই-চারটা কবিতা বলে সুরে সুরে প্রেম নিবেদন করবে। সে কেবল বিরস মুখে বালা দু’টো এগিয়ে বলল,” মা তোমাকে দিতে বলেছিল।”
মোহনা হকচকিয়ে গেল। কিছু বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে হাসল,” মানে? আমি বুঝিনি আসলে।”
তারিফ অন্যদিকে চেয়ে অপ্রস্তুত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে ফেলল,” আমাকে বিয়ে করবে?”
সে এই কথা বলে সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে ফেলল। সবকিছু নীরব, নিস্তব্ধ। তারিফ শুধু শুনতে পচ্ছে তার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ। এতোটা অস্থির আগে কখনও লাগেনি। বেশ কিছুক্ষণ পর সে যখন চোখ খুলে তাকাল তখন মোহনা তার সামনে নেই। দেখা গেল মোহনা বিছানায় মাথা নিচু করে বসে আছে। তারিফ আড়ষ্ট গতিতে এগিয়ে গেল। দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলল,” কি হয়েছে?”
মোহনা নিরস দৃষ্টিতে তাকাল। প্রশ্ন করল,” এটা কি এখন সম্ভব আশু?”
তারিফের মুখ মলিন হয়ে গেল। দৃষ্টি অনুজ্জ্বল, বিষণ্ণ। একটু অধৈর্য্য হয়েই বলল,” কেন সম্ভব না?”
মোহনা বেদনাভরা কণ্ঠে বুঝাতে চাইল,” আমি স্ত্রী না হলেও কারো মা। ঈশান একদম একা হয়ে যাবে। সে আমাকে ছোট্ট থেকে মা বলে জানে। ওকে ছেড়ে আমি কি করে থাকব বলো? প্লিজ তুমি কিছু মনে কোরো না। কিন্তু তুমি এমন একটা সময় এসেছো যখন আমার তোমাকে ফেরানো ছাড়া অন্যকোনো উপায় নেই।”
তারিনরা অনেক আশা নিয়ে অপেক্ষায় ছিল যে এই বুঝি তারিফ সুসংবাদ নিয়ে আসবে। সবাই অবিরত দোয়া পড়ছিল। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিল। কিন্তু কিছুই বোধ হয় আল্লাহর দরবারে কবুল হলো না। কারণ তারিফ এলো বিষণ্ণ মুখে, হতাশার নিশ্বাস নিয়ে। আয়েশা আশংকজনিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,” কি হয়েছে, বাবা? মোহনা রাজি হয়নি?”
তারিফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” না।”
সবার চেহারা অন্ধকারে ঢেকে গেল। তারিনের তো প্রায় কান্নাই পেয়ে গেল। তারিফ বালা দু’টো মায়ের হাতে তুলে দিতে দিতে বলল,” সে এখন কারো মা। সে তার সন্তান ছেড়ে আমার কাছে আসতে পারবে না৷ এটা তো আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল।”
তারিফ ঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে গেল। তারিন ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। আয়েশা আশাহত হয়ে তাকালেন। নিহা সান্ত্বনার সুরে বলল,” ভাবিস না তারু। মোহনা আন্টির সাথে আমি কথা বলব।”
ফাহিম নিরুপায়ের মতো বলল,” লাভ নেই। আমার মনে হয় না তিনি রাজি হবেন। এখন তো শুধু একজনই আমাদের সাহায্য করতে পারে।”
সকলেই প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ফাহিমের দিকে। যদিও সবার উত্তরটা জানা।তবুও নিহা প্রশ্ন করল, “কে?”
ফাহিম তারিনের দিকে তাকাল। তারিন হতাশ কণ্ঠে বলল,” ঈশান?”
ফাহিম মাথা নাড়ল। নিহা তারিনের কাঁধে হাত রেখে বলল,” তোকেই ঈশান ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে। তাহলে তিনি রাজি হতেও পারেন।”
তারিন দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,” এটা আমার পক্ষে অসম্ভব।”
আয়েশা বললেন,” ভাইয়ের জন্য এইটুকু করতে পারবি না?”
তারিন এই ক্ষেত্রে অসহায় হয়ে পড়ল। তার ভাইয়ের জীবনে এতোবছর পর আবার সুখের আলো এসেছিল। সেই আলো হঠাৎ দপ করে নিভে যেতে দেয় কি করে তারিন?
বৃষ্টি থেমে গেছে। শীতল বাতাস বইছে পরিবেশে। ঈশান দাঁড়িয়ে আছে সদর দরজার কাছে। তারিন নিজের উপস্থিতি বোঝাতে কাশি দিল। ঈশান ঘুরে তাকিয়ে তারিনকে দেখেই প্রশ্ন করল,” কিছু বলতে চাও?”
” হুম।”
ঈশান কিছুক্ষণ থেমে থেকে বলল,” আমি জানি তুমি কি বলতে এসেছো।”
তারিনের চোখ বড় হয়ে গেল,”জানেন? কি করে জানেন?”
” সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে আমি তোমাকে শুধু শুধু কেন সাহায্য করব?”
” এর মানে?”
” মানে… আমি মমকে রাজি করাতে পারি। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”
তারিনের গলা শুকিয়ে গেল। ঢোক গিলে প্রশ্ন করল,” কেমন শর্ত?”
চলবে