তি_আমো পর্ব ৫৫

0
235

#তি_আমো
পর্ব ৫৫
লিখা- Sidratul Muntaz

আশঙ্কায় তারিনের হার্টবিট বেড়ে গেছে। ঈশান কেমন শর্ত রাখতে পারে? নিহা যা বলেছিল সেটাই কি হবে? তারিনের হৃৎস্পন্দনের গতিতে থামিয়ে ঈশান বলে উঠল,” আমার সাথে লন্ডন যেতে হবে।”

তারিনের চেহারা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। শুষ্ক ঠোঁট নেড়ে প্রশ্ন করল ত্বরিতে,” মানে কি?”

ঈশান হাসিমুখে বলল,” মমকে ছাড়া আমি একা হয়ে যাবো তারিন। তুমি আমার পাশে থাকবে না?”

তারিন দুই কদম পিছিয়ে গেল। ঈশান দুই কদম এগিয়ে এসে বলল,” আমরা দু’জন একসাথে লন্ডন চলে যাবো। তারপর আমাদের বিয়ে হবে। তুমি আর আমি অনেক খুশি থাকবো। আর এদিকে তোমার ভাইয়া আর আমার মম বাংলাদেশে একসঙ্গে খুশি থাকবে৷ প্রবলেম সোলভড। সবাই খুশি। হ্যাপি এন্ডিং।”

তারিন ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল বিস্ময়ের দৃষ্টিতে। তারপর হুট করেই খুব জোরে একটা চিৎকার দিয়ে উঠল,”না! আমি পারব না!”

নিহা তারিনের অবস্থা দেখে হতভম্ব। কৌতুহল নিয়ে বলল,” এ্যাই তোর কি হলো হঠাৎ?”

তারিন ঘামতে ঘামতে একনাগাড়ে বলল,” আমি পারব না। ঈশানের সাথে আমি কিছুতেই এই বিষয়ে কথা বলতে পারব না।”

ফাহিমও বেশ অবাক তারিনের এমন আচরণ অতি অদ্ভুত আচরণে। সে ঠান্ডা গলায় বলল,” রিল্যাক্স! তুমি এতো ঘাবড়ে যাচ্ছো কেন?”

তারিন মাথা নিচু করল। আশঙ্কা প্রকাশ করে বলল,” যদি ঈশান আমাকে বিয়ের কথা বলে? তখন কি করবো আমি?”

নিহা খুব জোরে হেসে দিল। ফাহিম চোখমুখ কুচকে বলল,”হোয়াট? এই কথা কেন বলবে? বোকার মতো চিন্তা করছো তারু।”

তারিন ভয়ে আড়ষ্ট হলো। বলল, ” বলতেও তো পারে। কারণ মোহনা আন্টির বিয়ে হয়ে গেলে ঈশান একা হয়ে যাবে। সে যদি চায় তাকে কোম্পানি দেওয়ার জন্যে আমাকে তার সাথে লন্ডন যেতে হবে!”

ফাহিম আর নিহা চোখাচোখি করল, তবে হাসল না। নিহা ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে তারিনের মাথায় গাট্টা দিয়ে বলল,” তুই একটা পাগল। বেশি বেশি ভাবছিস। ঈশান ভাই এমন কেন করবেন? তিনি কি জানেন না তোর সাথে ফাহিম ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে?”

তারিন বোকা কণ্ঠে বলল,” তবুও যদি চায়?”

ফাহিম আর নিহা দু’জনেই হেসে উঠল এবার। কিন্তু তারিন নিজের অদ্ভুত ভাবনাটা ভুলতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে ঈশানের কাছে গেলে ঈশান এমনকিছুই বলবে যেটা শুনে তারিনের প্রাণ ঠোঁটের আগায় চলে আসবে। তারিন অভিযোগের সুরে বলল,” দ্যাখ নিহা, তুই হাসবি না। তুই-ই কিন্তু প্রথমে এই উদ্ভট চিন্তা আমার মাথায় ঢুকিয়েছিস।”

” আমি তো মজা করে বলেছিলাম রে!”

” তবুও আমি যাবো না। এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। তার চেয়ে ভালো আমি মোহনা আন্টির সঙ্গে কথা বলি।”

তারিন উঠতে নিলেই নিহা তাকে আবার বসিয়ে দিয়ে বলল,” শোন আমার কথা। মোহনা আন্টির সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই। তিনিও ঈশান ভাইয়ের কথাই চিন্তা করছেন। কারণ ঈমান আঙ্কেলের সাথে এখন ঈশান ভাইয়ের এখন কোনো যোগাযোগ বা সম্পর্ক নেই। ঈশান ভাই লন্ডন গিয়ে সম্পূর্ণ একা হয়ে যাবে। এটাই হয়তো ভাবছে মোহনা আন্টি। এখন তুই যদি ঈশান ভাইকে ভয় পেয়ে মোহনা আন্টির কাছে যাস তাহলেও কিন্তু একই ঘটনা ঘটতে পারে। ধর মোহনা আন্টিই তোকে বলল,’ আমার ছেলেকে বিয়ে করে নাও। তাহলে আমিও তোমার ভাইকে বিয়ে করে নিবো। ‘তখন তুই কি করবি?”

ফাহিম চাপা হেসে বলল,” এক্সাক্টলি।”

তারিন অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল,” আপনারও কি তাই মনে হয়? মোহনা আন্টি এটা বলবে?”

” ঈশান ভাই যদি বলতে পারে তাহলে মোহনা আন্টি কেন পারবে না?” ফাহিম মজা করে বলল।

তারিন পড়িমরি করে বলল,” অসম্ভব। আমি যাবোই না ধ্যাত! ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।”

নিহা বোঝানোর উদ্দেশ্যে বলল,” সেটাই তো আমি বলতে চাইছি। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। তুই যা। ঈশান ভাইয়ের কাছেই যা। আমার মনে হয় তিনি তোর কথা রাখবেন।”

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছিল মোহনা। তার বুকের মাঝে তীব্র যন্ত্রণা। তারিফের মলিন মুখশ্রী মনে পড়তেই সেই যন্ত্রণা হাহাকারের রূপ নিচ্ছে। পেছন থেকে ঈশান ডাকল ভরাট কণ্ঠে, “মম।”

মোহনা তড়িঘড়ি করে চোখের জল মুছে মুখে হাসি আনল। পেছনে ঘুরে ঈশানকে দুই চোখ ভরে দেখে নিয়ে আনন্দিত কণ্ঠে বলল,” এইতো, আমার হ্যান্ডসাম ছেলে! বল বাবা?”

” তুমি কি কাঁদছো?”

ঈশানের কণ্ঠ অসম্ভব শান্ত শোনাল। মোহনা ভয় পেল, মিইয়ে গেল। কিছুটা বিব্রত গলায় বলতে চাইল,” না তো… ”

ঈশান সঙ্গে সঙ্গে মোহনার কাছে এসে কাঁধ চেপে ধরল। তাকে থামিয়ে ফিসফিস করে বলল,” শশশ… আমি জানি। আমার মম আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমার জন্য সে পৃথিবীর সবকিছু ছেড়ে দিতে পারে। তবুও আমাকে সে কখনও একা ছাড়তে পারে না। কিন্তু আমার মম কি এইটা জানে যে আমি তার কাছে কি চাই?”

মোহনা অবাক হেসে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে বলল,” কি চায় আমার ছেলে?”

ঈশান তার মায়ের চিবুক স্পর্শ করল। মিষ্টি করে বলল,” এই সুন্দর মুখের হাসি দেখতে চাই। ওই চোখে উজ্জ্বলতা দেখতে চাই৷ মমকে অনেক অনেক হ্যাপি দেখতে চাই।”

মোহনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে গাঢ় করে হাসলেন,” আমি খুব হ্যাপি আছি। কারণ আমার ছেলে আমার পাশে আছে।”

” আমি তোমার পাশে সবসময় থাকবো মম। কিন্তু তুমি তোমার হ্যাপিনেস আমার জন্য সেক্রিফাইস করবে এটা আমি দেখতে পারবো না।”

ঈশানের কথার অর্থ বুঝেই মোহনা ভ্রু কুচকাল। খানিক বিচলিত হয়েই বলল,” তুই ভুল ভাবছিস ঈশান। আমি কিছুই সেক্রিফাইস করছি না। এভ্রিথিং ইজ অলরাইট…”

ঈশান সাথে সাথে মোহনাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” ওহ, মম। এভ্রিথিং ইজ অলরাইট বলার কষ্ট আমার থেকে ভালো আর কেউ জানে না। তাই প্লিজ আমাকে এট লিস্ট এই কথা বলে কনভিন্স করতে চেও না!”

মোহনা ছেলের বুকে মাথা রেখে ফুপিয়ে উঠল এবার। ঈশান চুপচাপ তার মাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। মোহনা একটু পর মাথা তুলে বলল,” আমি কি তারিনের সাথে একবার কথা বলে দেখবো? হয়তো সে মনে মনে তোর অপেক্ষায় আছে।”

ঈশান নির্লিপ্ত কষ্ট নিয়ে নিষেধাজ্ঞা দিল,” না মম, এটা প্লিজ তুমি কখনও কোরো না।”

” কেন?”

” কারণ তারিন একদম আমার অপেক্ষায় নেই। থাকা উচিৎও না। সে তার জীবনের গন্তব্য খুঁজে নিয়েছে। এখন আমি সেখানে প্রবেশ করতে গেলে অযথাই সব এলোমেলো হয়ে যাবে। কি দরকার?”

মোহনা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ঈশান শ্রান্ত গলায় বলল,” যদি তারিনকে ফিরে পাওয়ার সামান্য উপায়ও থাকতো তাহলে আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করতাম। কিন্তু এখন কোনো উপায় নেই। আই লস্ট হার!”

মোহনা অসহ্য হয়ে উঠল। ছেলের এই কষ্ট তার মন নিতে পারছে না। বুকে চাপ অনুভব করল ভীষণভাবে। চোখ থেকে টুপ করে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তেই ঈশান তা মুছে দিল সযত্নে। মোহনা মুখ তুলে তাকাল। ঈশান প্রশ্ন করল,” আমার জন্য কষ্ট পাচ্ছো?”

বেদনাতুর কণ্ঠে উত্তর এলো,” কেন পাবো না? তুই আমার একমাত্র ছেলে! তোর কষ্ট কি আমার সহ্য হতে পারে?”

ঈশান মৃদু হেসে জানালায় তাকাল। আকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,” যেটা হওয়ার ছিল সেটাই হয়েছে, মম। আফসোসে কষ্ট বাড়ে। আমি আফসোস করতে চাই না। যেটা করলে এই মন শান্তি পাবে আমি সেটাই করতে চাই।”

মোহনা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,” কি করতে চাস তুই?”

” আমি সবাইকে খুশি দেখতে চাই। তুমি আর তারিফ ভাইয়া এক হলে তারিন খুব খুশি হবে।”

মোহনা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল,” আর তুই? তোর কি হবে? তুই পারবি একা থাকতে? তারিন তোকে ছেড়ে চলে গেল। আর এখন আমিও তোকে ছেড়ে চলে যাবো?”

মোহনা এই কথা বলতে নিয়ে কেঁদেই ফেলল। ঈশান আবারও হাসল। মোহনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,” এতো কেঁদো না তো মম। বিশ্বাস করো একা থাকতে আমার একফোঁটা কষ্ট হবে না। কিন্তু তুমি যদি তোমার এতোবছর পর ফিরে পাওয়া খুশি আমার জন্য সেক্রিফাইস করো তাহলে আমি নিজের কাছেই অপরাধী হয়ে যাবো। আমাকে এতোবড় শাস্তি দিবে তুমি? দিতে পারবে?”

মোহনা দুইপাশে মাথা নাড়তে লাগল। তবে কান্নার জন্য মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারল না। ঈশান ভারী গলায় বলল,” এর চাইতে একা থাকা অনেক ভালো।”

মোহনা এবার ভেজা দৃষ্টি নিয়ে তাকাল ছেলের দিকে। ঈশানের মুখটা নিজের আঁজলায় নিয়ে বলল,” আমার বাবা, আমার সোনা, তোকে ছেড়ে আমি খুশি থাকব এটা তুই ভাবলি কেমন করে?”

” জানি আমাকে ছেড়ে থাকতে তোমার কষ্ট হবে। হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু একবার চিন্তা করো, তুমি যদি আমার সাথে চলে যাও তাহলে এখানে কতজন কষ্ট পাবে? তারিনও খুব কষ্ট পাবে।”

” তুই তারিনের কথা কেন এতো ভাবছিস? কই, সে তো তোর কথা ভাবেনি!”

ঈশান হতাশ গলায় বলল,” এটাও আমারই দোষ। আমিই তো তার মন ভেঙেছিলাম। দ্বিতীয়বারের মতো তার মন আবার ভাঙতে চাই না। আর যে মানুষটি তোমার জন্য এতোবছর অপেক্ষা করল তাকে ফিরিয়ে দেওয়াটা অন্যায়। আমার মম কারো সাথে অন্যায় করতে পারে না।”

ঈশান মোহনার ডানহাত নিয়ে সেই হাতের উল্টোপিঠে চুমু দিয়ে বলল,” প্লিজ মম, তুমি যাও।”

মোহনা অন্যদিকে ঘুরে তাকাল। জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে রইল। ঈশানও নিশ্চুপ হয়ে গেল। বাইরে ঘন অন্ধকার। শীতল বাতাস গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। মোহনা স্মৃতিচারণে হারিয়ে যাওয়ার মতো বলল,” ছোটবেলায় তুই যখন ঘুমিয়ে যেতি, আমি চলে যাওয়ার ভয়ে আমার আঁচল ধরে রাখতি। অবুঝ কণ্ঠে সবসময় শুধু একটা প্রশ্নই করতি। মনে আছে তোর?”

ঈশান মাথা নাড়ল,” মনে আছে। আমি শুধু বলতাম, আমাকে ছেড়ে কখনও চলে যাবে না তো মম?”

মোহনা হেসে উঠল। চোখে জল নিয়ে বেদনাময় হাসি। তারপর কাতর কণ্ঠে বলল,” এখন তুই নিজেই আমাকে অনুরোধ করছিস তোকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য৷ এতোটা বড় কিভাবে হয়ে গেলি বাবা?”

ঈশান কোমলভাবে হাসল,” আমরা কেবল তাকেই চলে যেতে দেই যাকে আমরা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।”

মোহনার আবার কান্না পাচ্ছে। অসহনীয় কষ্টে ভেতরটা যেন ঝলসে যাচ্ছে একদম। ঈশান পেছন থেকে মোহনাকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরল। তার মাথায় চিবুক ঠেকিয়ে বলল,” একটা ব্যাপার চিন্তা করে দেখো তো মম! কেন তোমার বাবার সাথেই বিয়েটা হলো? যদি অন্যকারো সাথে বিয়ে হতো তাহলে কি এতো সহজে সংসার থেকে মুক্তি পেতে? যদি তোমার একটা আবদ্ধ সাংসারিক জীবন থাকতো আর ঠিক সেই সময় তারিফ ভাইয়ের সাথে দেখা হতো তাহলে আফসোস ছাড়া আর কিছুই করতে পারতে না। ঠিক যেমন আমার ক্ষেত্রে হলো এখন আফসোস ছাড়া আর কিছুই করতে পারছি না আমি। তারিন তার জীবন ফাহিমের সাথে আবদ্ধ করে নিয়েছে। আমি চাইলেও সেখানে আর যেতে পারব না। কিন্তু তোমার কাছে তো সুযোগ আছে। তোমার জন্য সে পথ চেয়ে বসেও আছে। তাহলে কেন তুমি যাবে না? তোমার জায়গায় যদি আমি হতাম তাহলে এক মুহূর্তও দেরি করতাম না কিন্তু! হয়তো নিয়তিই চায় তোমরা এক হয়ে যাও। নাহলে কেন নিহার বেস্টফ্রেন্ড তারিনই হবে? কেন আমার সাথে তারিনের দেখা হবে? আর কেন তারিনের ভাই-ই তোমার প্রাক্তন হবে? এতোগুলো কো-ইন্সিডেন্ট একসাথে ঘটার মধ্যেই তো একটা চমৎকার ব্যাপার লুকিয়ে আছে। সেই চমৎকার ব্যাপারটা এবার শুধু তোমার হাতে। তুমি চাইলেই সবকিছু আবার রঙিন হবে। মুষড়ে পড়া জীবনটা সতেজ হবে। তুমি আবার আগের মতো হাসবে। ”

মোহনা চোখের কোণ মুছে প্রশ্ন করল এবার,” আমি চলে যাওয়ার পর তুই কি কি করবি?”

ঈশানের চেহারায় সুখের হাসি ফুটল। মোহনা রাজি হয়েছে! এর থেকে শান্তির ব্যাপার আর কি হতে পারে? সে গভীর আনন্দ নিয়ে উচ্চারণ করল,” কি করব সেটা তো জানি না মম… তবে আমি খুব খুশি থাকব।”

মোহনা শীতল কণ্ঠে বলল,” বিয়ে করবি তো?”

ঈশান এই প্রশ্নে ভড়কে গেল কিছুটা। আমতা-আমতা করে বলল,” করব।”

” এভাবে বললে হবে না। আমাকে কথা দে, তুই বিয়ে করবি।”

ঈশান হেসে ফেলে মোহনার হাতে হাত রেখে কথা দিল,” আচ্ছা, কথা দিলাম বিয়ে করব।”

” প্রতিদিন একবার করে আমাকে ফোন করতে হবে।”

” কাজের চাপে ভুলে যেতে পারি। তখন তুমি ফোন কোরো!”

মোহনা ছেলের গালে আদর করে বলল,” করব। আর শোন, নিয়মতি খাওয়া-দাওয়া করবি। শরীরের যত্ন নিবি। ঘুমে অনিয়ম করবি না। আর খবরদার, ড্রিংকস একদম নিষেধ। আমি কিন্তু হুট-হাট করে চলে আসব। তখন যেন তোকে একদম সুস্থ দেখি।”

” আমি একদম সুস্থ থাকব মম। এখন থেকে আমি সবসময় সুস্থ থাকব।”

বসার ঘরের সেন্টার টেবিল ঘিরে সমবেত হয়েছে সবাই। প্রত্যেকের হাতে তালি বাজছে। মুখে গান চলছে,” হ্যাপি বার্থডে টুয়্যু।”

তিশা মোমবাতির জ্বলে ওঠা দেখে খিলখিল করে হাসল। কেক কাটার পর কিছুক্ষণ ছবি তোলা হলো। তারপর সবাই যে যার মতো জায়গায় বসল। সবাইকে এখন কেক পরিবেশন করা হচ্ছে। নিহা তারিনকে কেক দিতে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,” ঈশান ভাইয়ের কাছে কখন যাচ্ছিস?”

তারিনের হাসিমুখ ভয়ে কালো হয়ে গেল। চিন্তিত স্বরে বলল,” জানি না।”

” দেরি করিস না। যত দ্রুত যাবি, প্রবলেম তত দ্রুত সোলভ হবে।”

তারিন তাকাল তার ভাইয়ের দিকে। ওইতো দূরে বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে আছে তারিফ। সবার চেহারায় ঝলমলে হাসি থাকলেও তারিফের হাসিটা মলিন। বুকের ভেতর অসহ্য কষ্ট চেপে দাঁড়িয়ে আছে সে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিবে না। তারিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনস্থির করল, সে অবশ্যই ঈশানের কাছে যাবে। এই ভেবে যখন তারিন উঠতে নিল তখনি দেখল মোহনা তারিফের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সে বিড়বিড় করে তারিফকে কিছু একটা বলল। অতো দূর থেকে তারিন শুনতে পেল না তবে তার আন্দাজ করতেও অসুবিধা হলো না৷ কারণ এরপরেই দেখা গেল তারিফ মোহনার সাথে কোথাও একটা যাচ্ছে৷ তারিন দ্রুত ফাহিমের কাছে গিয়ে বলল,” দেখুন ফাহিম ভাই, ভাইয়া আর মোহনা আন্টি কোথায় যেন যাচ্ছে!”

ফাহিম কেক মুখে দিয়েছিল। সে বোকার মতো তাকিয়ে রইল। ব্যাপারটা বুঝতেই তার সময় লাগল। তারিন উৎফুল্ল হয়ে দ্রুত নিহার কাছে ছুটে গেল। নিহাকে এই খবর জানাতেই সে তড়িঘড়ি করে তিশাকে সাফিনের কোলে গছিয়ে তারিনের হাত ধরে বলল,” চল আমরা গিয়ে দেখি!”

তারিন হাসিমাখা মুখে বলল,” ইয়েস, ইয়েস! যা ভাবছি তাই যেন হয়।”

নিহা ফিসফিস করল,” ইনশাআল্লাহ, তাই হবে।”

ফাহিম পানি খেতে খেতে বলল,” ওয়েট, আমিও আসছি।”

নিহা আর তারিন একটু দাঁড়ালো। অতঃপর তিনজন একসঙ্গে রওনা হলো। দূর থেকে ঈশান দেখছিল তাদের কান্ড-কারখানা।

মোহনা করিডোরে এসে থামল; এদিকে একদম মানুষ নেই। তবে দেয়ালের পেছনে যে তিনজন কান পেতে আছে সেই কথা মোহনার অজানা। তারিফ প্রশ্ন করল,” কিছু বলবে? এভাবে সবার সামনে থেকে নিয়ে এলে… কেউ দেখল কি-না কে জানে?”

মোহনা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,” দেখলে দেখুক। তোমার কি কোনো অসুবিধা আছে?”

তারিফ থতমত খেয়ে বলল,” না। অসুবিধা কেন থাকবে? আমি তো এমনিই বললাম।”

মোহনা আগের চেয়ে শক্ত গলায় বলল,” বালা দু’টো কোথায় রেখেছো?”

” হ্যাঁ?” তারিফ যেন হতবাক। তাকে দেখতে এই মুহূর্তে একদম হাবাগোবা লাগছে৷ মোহনা মুচকি হেসে বলল,” আমি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি। এবার বালা দু’টো আমার হাতে পরিয়ে দাও।”

তারিফ বড় বড় চোখে বেয়াক্কেলের মতো তাকিয়েই রইল। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সে কি কোনো স্বপ্ন দেখছে? চোখ বন্ধ করে আবার তাকাল। মোহনা ফিক করে হেসে বলল,” এমন তব্দা খেয়ে গেলে কেন? কথা বলো! চলে যাবো কিন্তু। ”

মোহনা যেতে নিলেই তারিফ হাত টেনে ধরল। নিহা ওই দৃশ্য দেখে একটু উঁচু শব্দেই বলে উঠল,” ওয়াও…”

সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ চেপে ধরল তারিন। ধমক মেরে বলল,” চুপ, শুনে ফেলবে!”

নিহা চুপ করল। তারিফ নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে খুব রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,” চলো মায়ের কাছে যাই?”

মোহনা সম্মতি প্রকাশ করল,” চলো।”

তারা চলে যেতেই নিহা কোমর দুলিয়ে নাচতে শুরু লাগল। ফাহিমও খুশিতে গান গাইতে লাগল। সুখের গান। আর তারিন কেবল দেয়ালে ঠেস দিয়ে মুখে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। তার কান্না পাচ্ছে ভীষণভাবে। এতো খুশি সে আগে কখনও হয়নি। নিহা উল্লাসিত কণ্ঠে বলল,” নিশ্চয়ই ঈশান ভাইয়া কিছু করেছে। নাহলে মোহনা আন্টি এতো দারুণভানে কনভিন্স হলো কি করে? চল আমরা সবাই ঈশান ভাইকে জিজ্ঞেস করি।”

ঈশান তখন তাদের পেছনেই দাঁড়িয়েছিল। সে সামনে যাওয়ার কথাই ভাবছিল আর ঠিক সেই মুহূর্তে ফাহিম তারিনের মাথায় হাত রাখল। তারিন চোখে খুশির অশ্রু নিয়ে জড়িয়ে ধরল ফাহিমকে। ঈশান এটা দেখে সাথে সাথেই জায়গাটা থেকে সরে এলো।

আয়েশা সুখবর শুনে খুশিতে কেঁদেই ফেললেন। নিজের হাতে স্বর্ণের বালা দু’টো বের করে মোহনাকে পরালেন৷ কিন্তু মোহনার হাত এতো চিকন যে মাপে হলো না। হাত নিচু করে করলেই যেন খুলে পড়ে যাবে। আয়েশা কান্নামাখা গলায় বললেন,” আমি তোমার মাপের নতুন একজোড়া গড়িয়ে দিবো। আপাতত তুমি এইটা নাও।”

আয়েশা নিজের গলা থেকে স্বর্ণের চেইন খুলে মোহনার হাতে তুলে দিলেন। মোহনা কি বলবে বুঝতে না পেরে আয়েশা কে জড়িয়ে ধরল। পুরো মুহূর্তটাই আজ ভীষণ সুন্দর। তারিনের ইচ্ছে করছে সময়টা বন্দী করে ফেলতে। সে তার ভাইয়ার দিকে নির্ণিমেষ তাকিয়ে রইল। ভাইয়া দাঁত বের করে শুধু হাসছে। ওইতো তার ভাইয়ার চোখ দু’টো ঝলমল করছে। তারিনের মন ভরে যাচ্ছে। আয়েশা তারিনকে দরজায় দাঁড়ানো দেখেই ডাকল,” এদিকে আয় তারু।”

তারিন কাছে এসে একবার মোহনার দিকে তাকালো তো আরেকবার তারিফের দিকে। নিহা আর ফাহিম তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে৷ তারিন নিজের আবেগ সামলাতে না পেরে মোহনাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” থ্যাঙ্কিউ আন্টি।”

মোহনা হেসে তারিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। আয়েশা বললেন,” এখনও আন্টি ডাকবি? ভাবী বল!”

তারিন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ডাকল,” ভাবী, আমার ভাইয়ার জীবনে ফিরে আসার জন্য তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। লাভ ইউ।”

সবার মুখে হাসি ফুটল। মোহনা ইচ্ছাকৃতই তারিনের অবগতির জন্য বলল,” এখানে পুরো ক্রেডিটটাই ঈশানের। সে যদি না বলতো তাহলে হয়তো আমার মত এতো দ্রুত বদলাতো না।”

কথাটা শুনে তারিন একটু অবাক হলো। নিহা তারিনের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,” দেখেছিস, বলেছিলাম না? সব ঈশান ভাইয়ের কেরামতি।”

আয়েশা কৃতজ্ঞতার স্বরে বললেন,” ঈশানকে অনেক ধন্যবাদ। খুব ভালো থাকুক ছেলেটা।”

জানালার ফাঁক গলে সকালের নরম রোদটা উঁকি দিচ্ছে। ঘড়িতে এখন সকাল ছয়টা। ঈশানের ফ্লাইট নয়টায়। সে হাতে অল্প সময় নিয়েই এসেছিল। কিন্তু ভাবেনি যে এইটুকু সময়ে তাকে এতোকিছু করতে হবে। লাগেজে জিনিসপত্র গুছাতে গুছাতে হঠাৎ দরজার দিকে নজর গেল। তারিন দাঁড়িয়ে আছে। ঈশান একটু অবাক হয়ে হাসল,” আরে তারিন, ভেতরে আসো।”

তারিন মাথা নিচু করে ঢুকল। আঁড়চোখে একবার ঈশানের ব্যাগের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল,” আজকেই চলে যাচ্ছেন?”

ঈশান সোজা হয়ে বিছানায় বসল। মুখে নরম হাসি এঁকে বলল,” হুম।”

তারিনের খুব খারাপ লাগছে। অনুরোধের স্বরে বলল,” থেকে যান। অন্তত বিয়ে পর্যন্ত!”

” বিয়েতে আমি নিশ্চয়ই আসবো। ”

” আসবেন সেটা জানি। কিন্তু একবার যাওয়া তারপর আবার আসা খুব ঝামেলা হয়ে যায় না? লন্ডন তো আর বাড়ির কাছে না।”

তারিনের কথা বলার ধরণে হেসে ফেলল ঈশান। কিন্তু কোনো জবাব দিল না। প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করল,” তুমি কিছু বলবে?”

” হ্যাঁ। আপনাকে থ্যাংকস দিতে এসেছিলাম। যদিও আপনি যা করেছেন সামান্য থ্যাংকস দিয়ে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমি আসলে বুঝতেই পারছি না যে কিভাবে এক্সপ্রেস করবো। আমি অন্নেক বেশি খুশি হয়েছি ঈশান। এতো খুশি আমার আগে কখনও লাগেনি। আর ভাইয়াকেও আমি কখনও এতো খুশি দেখিনি।”

ঈশান ভালো করে একবার তাকালো তারিনের মুখের দিকে। অশ্রুপূর্ণ দৃষ্টি, অথচ মুখে কি স্বচ্ছ হাসি! ঈশান রসিকতার সুরে বলল,” মেনশন নট। এইরকম ছোট-খাটো সাহায্য আমি সবাইকেই করে থাকি..!”

তারিন হেসে দিল। হাসতে হাসতে চোখ মুছল। তারপর কাতর কণ্ঠে বলল,” আপনি অনেক ভালো ঈশান। আমি সারাজীবন আপনার কাছে ঋণী থাকব। আর যদি কখনও ঋণ শোধ করার সুযোগ পাই…”

তারিনকে মাঝপথে থামিয়েই ঈশান ভরাট কণ্ঠে বলল,” উহুম। ঋণ শোধ করার কথা বোলো না। সব ঋণ শোধ করতে হয় না। ”

তারিন মাথা নিচু করে হাসল। ঈশান আবার বলল,” ধরো আমি তোমার কাছে এমন কিছু চেয়ে বসলাম যেটা তুমি আমাকে দিতে পারবে না। তখন তোমার আফসোস লাগবে। সেই আফসোস করার চেয়ে ঋণী থাকাই ভালো। ”

তারিন একটু চমকে তাকালো। ঈশান ব্যাপারটাকে সহজ করার জন্য বলল,” শুধু তুমি না, সবার ক্ষেত্রেই বলছি।”

” ও।”

ঈশান পকেটে হাত গুঁজে বলল,” ভালো থেকো তারিন৷ সবসময় এভাবে হেসো।”

” আপনিও খুব ভালো থাকবেন। সবসময় হাসবেন।”

ঈশান বিড়বিড় করে বলল,” সারাক্ষণ বুকে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে যদি ভালো থাকা যায়, তাহলে আমিও ভালো থাকব।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here