তি_আমো পর্ব ৫৭

0
260

#তি_আমো
পর্ব ৫৭
লিখা- Sidratul Muntaz

নিহা বাড়ি চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ তারিন ঘরের আলো জ্বালিয়ে এভাবেই বসে রইল। তার ভেতর থেকে একটা অশান্তি কাজ করছে। একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখল। তার মনে হলো সে বুঝি নিজের কাছেই খুব অচেনা হয়ে গেছে। মোবাইল বাজল। তারিন ফোন রিসিভ করতেই ওইপাশ থেকে কথা বলল ফাহিম,” তারু, কি করছো?”

” এইতো, শুয়েছিলাম..”

” ঘুমিয়ে পড়েছিলে?”

” হ্যাঁ। ” তারিন এই কথা বলে একটু চমকে উঠল। সে মিথ্যা কেন বলছে ফাহিমকে? সে তো ঘুমায়নি! ফাহিম আফসোস করে বলল,” ডিস্টার্ব করলাম তাহলে।”

” সমস্যা নেই। আপনি বলেন।”

” সমস্যা তো আছেই। এই শীতের রাতে তোমাকে একটু বের হতে হবে।”

” মানে? আপনি কি বাইরে?”

” হুম। অপেক্ষা করছি। একটু আসো না প্লিজ। পাঁচমিনিটের জন্য।”

তারিন কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে উচ্চারণ করল,” ঠিকাছে আসছি।”

দরজা খুলে বের হওয়ার সময় তারিন দেখল মোহনার ঘরের আলো জ্বলছে। সেও কি জেগে আছে তারিনের মতো? তারিনের দাদী যেই ঘরে থাকতেন সেই ঘরে আজরাতে মোহনাকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। দাদী ঘুমাচ্ছেন তারিনের মায়ের সাথে। যদিও মোহনা তার বাড়িতেই থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু ওতোবড় বাড়িতে সে একা থাকবে বলে রাজি হয়নি তারিফ। নাক উঁচু তারিফের বক্তব্য হলো, ‘রাজা ছেড়ে ফকিরকুমারকে যেহেতু বিয়ে করতে এসেছো তাই রাজপ্রাসাদ ছেড়ে কুঁড়েঘরে থাকার অভ্যাস করতে হবে।’ বিসমিরও এখানে থাকার কথা ছিল। সে সবসময় মোহনার সঙ্গেই থাকে। কিন্তু আজ নিহা বিসমিকে নিজের সঙ্গে নিয়ে গেছে। তারিন যখন মোহনার ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন চাপা কণ্ঠে কিছু ধারালো বাক্য তার কানে এলো। যেগুলো শুনে সে না থেমে পারল না। মোহনা ফোনে কথা বলছে। খুব সম্ভবত নিহার সঙ্গেই কথা বলছে,

” তারিনও কি চাইছে যে ঈশান বিয়েতে আসুক? কিন্তু সে আসবে না। হাজারবার বললেও আসবে না নিহা। ভালোবাসার মানুষকে অন্যকারো হয়ে যেতে দেখার ক্ষমতা সবার থাকে না…”

তারিন দেয়াল চেপে দাঁড়ালো। মোহনা কি ঈশানের বিষয়েই বলছে? এমন যেন না হয়! কিন্তু পরের বাক্য কানে আসতেই বোঝা গেল সে যা ভাবছে তাই সঠিক।

“হ্যাঁ তারিনের জন্যই। ঈশান তারিনের জন্যই বিয়েতে আসতে চাইছে না। নিহা, তুমি তো কিছুই জানো না৷ তবুও কেঁদে একাকার হয়ে যাচ্ছো। আর আমি তো মা, এতোবছর ধরে তাকে ছেলের মতো মানুষ করেছি। আমার কি অবস্থা হচ্ছে বোঝো? ঈশান শুধুমাত্র তারিনের খুশির জন্য আমাকে বিয়েতে রাজি করিয়েছিল। ও আমাকে বার বার কি বলছিল জানো?’ রাজি হয়ে যাও মম, তারিন খুশি থাকবে।’ অথচ তারিনকে দেখো, সে বুঝতেও পারছে না ছেলেটা কত কষ্ট নিয়ে এখান থেকে চলে গেছে। অবশ্য এসব তারিনের না বোঝাই ভালো। বুঝেই বা কি করবে সে? সামনে ওর বিয়ে। মেয়েটা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে৷ এখন এসব বললে অযথাই অপরাধবোধে ভুগবে। এছাড়া তো কোনো লাভ হবে না। আসলে ঈশানের ভাগ্যটাই খারাপ। ছোটবেলা থেকেই দূর্ভোগ নিয়ে জন্মেছিল ছেলেটা..”

তারিন আর শুনতে পারল না। আড়ষ্ট পায়ে হেঁটে চলে গেল ঘরে। বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। বালিশে মুখ গুঁজল। ফাহিম যে বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে সেই কথাটাও বেমালুম ভুলে গেল সে। অনেকক্ষণ পর আবার ফোন এলো ফাহিমের। ততক্ষণে তারিন যে বালিশে শুয়েছিল সেই বালিশটা ভিজে গেছে। সে নিজেকে ধাতস্থ করে ফোন রিসিভ করল। শুকনো গলায় বলল,” হ্যালো।”

” তারু, কোথায় তুমি? এতো দেরি লাগছে কেন?”

” আমি আসতে পারব না ফাহিম ভাই। আমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। আর সদর দরজাটাও লাগানো।”

ফাহিম মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল,” ও… আচ্ছা তাহলে একবার ছাদে আসতে পারবে?”

” ঠিকাছে আসছি।”

তারিন চোখেমুখে পানি দিয়ে নিজেকে শান্ত করে ছাদে উঠল। দেখা গেল ফাহিম রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ফুল, চকলেট আর মুখভর্তি হাসি। তারিন ফোন করে জিজ্ঞেস করল, ” এসব কি ধরণের পাগলামি ফাহিম ভাই? এতোরাতে আপনি কেন এলেন?”

” ঘুম আসছিল না। তাই ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করি।”

তারিনের মন চট করে ভালো হয়ে গেল। মিষ্টি করে হেসে বলল,” আপনি অপেক্ষা করুন। আমি এখনি আসছি।”

তারিন দৌড়ে নিচে নামল। এতো কষ্ট করে যে মানুষটা এমন শীতের রাতে তার মন ভালো করতে ছুটে এসেছে সেই মানুষটিকে ফিরিয়ে দেওয়া অন্যায়! ফাহিম এখনও হলুদের পাঞ্জাবী খোলেনি। তার ফরসা মুখে হলুদের দাগ লেগে আছে। তারিন হেসে বলল,” আপনি একটা পাগল একদম।”

” আগামীকাল আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির ব্যাপারটি ঘটতে যাচ্ছে। আমি পাগল না হয়ে কি করব বলো?”

ফাহিম এই কথা বলে টলমল দৃষ্টিতে হাসল। তারিন মুখ গোমরা করে বলল,” বিয়ের জন্য এতো খুশি হতে আমি এই প্রথম কাউকে দেখলাম।”

” সবাই তো আমার মতো ভাগ্যবান না যে বিয়ের জন্য স্বপ্নের রাণীকেই পেয়ে যায়।”

এই কথা শুনে তারিনের উজ্জ্বল মুখ ম্লান হয়ে এলো। স্মৃতিপটে ভেসে উঠল এক দূর্ভাগার মুখ। চলে যাওয়ার সময় বেদনাতুর দৃষ্টিতে কতটা কাতরতা নিয়েই না তাকিয়েছিল সে! পুনরায় কানে বাজল মোহনার কণ্ঠস্বর,” আসলে ঈশানের ভাগ্যটাই খারাপ…”

” কি ভাবছো তারু?”

তারিন চট করে ভাবনাটা মুছে ফেলে মুখে হাসি এনে বলল,” অনেক সুন্দর ফুল। একদম তাজা। কোথায় পেয়েছেন?”

ফাহিম হাঁটু গেঁড়ে বসতে বসতে বলল,” শুধু তোমার জন্য।”

তারিন খিলখিল করে হেসে ফুলের তোড়া হাতে নিল। ফাহিম আবেগমাখা কণ্ঠে বলল,” আই লভ ইউ।”

তারিন অবলীলায় বলল,” আই লভ ইউ টু।”

ফাহিম কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারিনের উত্তরটা তার পছন্দ হয়নি। এভাবে কেউ ‘ আই লভ ইউ’ বলে? যেন বলার দরকার ছিল তাই বলেছে। এর সাথে মনের কোনো সংযোগ নেই। ফাহিম উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জরুরী কণ্ঠে বলল,” একটা প্রশ্ন করি তারু?”

” করেন।”

” তুমি আমাকে কেন ভালোবাসো?”

তারিন দারুণভাবে হাসল। উত্তর দিল,” কারণ আপনি আমাকে অনেক ভালোবাসেন৷ তাহলে আমি কিভাবে ভালো না বেসে থাকি?”

উত্তরটা শুনে ফাহিম হেসে উঠল। কিছুটা রসিকতার সুরে প্রশ্ন করল,” তাহলে আমি যদি কখনও ভালোবাসা বন্ধ করে দেই তোমাকে… তুমিও কি তখন আর ভালোবাসবে না আমাকে? এটা তো শর্ত সাপেক্ষে ভালোবাসা হয়ে গেল। অনেকটা সওদা করার মতো ব্যাপার।”

তারিন একটু থামল। বিভ্রান্ত হলো। তারপর বিব্রত কণ্ঠে বলল,” এসব কি বলছেন? আপনি আমাকে ভালোবাসা কেন বন্ধ করবেন?”

” ধরো আমার জীবনে অন্যকেউ চলে এলো। মানে জাস্ট ধরো! আমার মনে হলো আমি তোমাকে না, তাকেই ভালোবাসি। তুমি কি কষ্ট পাবে?”

তারিন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,” জানি না।”

ফাহিমের মুখটা মলিন হয়ে গেল। তারিন সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলল,” এতো প্রশ্ন প্রশ্ন খেলা ভালো লাগছে না ফাহিম ভাই। অন্য কথা বলুন।”

ফাহিম তারিনের গা ঘেঁষে যেতে যেতে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যে বলল,” তোমার জন্মদিনের উপহারটা কিন্তু এখনও দেওয়া হলো না।”

” ওহহো ফাহিম ভাই, জন্মদিন তো সেই কবেই চলে গেছে। এখনও আপনি উপহার নিয়ে পড়ে আছেন?”

ফাহিম তারিনের পথ আটকে বলল,” হ্যাঁ। কারণ তুমি যা চাইবে আমি তাই দিবো। খুব ভালো সুযোগ কিন্তু। এমন সুযোগ বার-বার আসে না।”

তারিন বাধ্য হয়ে বলল,” আচ্ছা তবে আমার চাওয়া হলো আপনি কখনও আমাকে কষ্ট দিতে পারবেন না। সবসময় আমাকে ভালো রাখতে হবে। ”

” ব্যস এইটুকুই?”

” হুম। এইটুকুই।”

সকালে ঈশানের ঘুম ভাঙল মোহনার ফোন পেয়ে। লন্ডনে এখন কনকনে ঠান্ডা। আবহাওয়া ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস কিন্তু অনুভব হচ্ছে আরও কম। মোটা ব্ল্যাংকেটের ভেতর থেকে হাত বের করে ফোনটা নিয়েই আবার দ্রুত হাতটা ঢুকিয়ে ফেলল ঈশান। ঘুমকাতুরে কণ্ঠে বিরবির করে বলল,” গুড মর্ণিং,মম।”

মোহনা কটকটে স্বরে বলল,” শোন ঈশান, আমি একটা গুরুতর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

” কি সিদ্ধান্ত?”

” আমি বিয়ে করবো না।”

” হোয়াট?” চমকপ্রদ কথাটি শুনেই ইতোমধ্যে তিড়িং করে লাফিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে গেছে ঈশান। যথেষ্ট বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করল,” কেন মম? কি হয়েছে? এনিথিং সিরিয়াস? তোমাকে কি কেউ হার্ট করেছে?”

” হ্যাঁ করেছে।”

” হু ইজ দ্যা শিট?”

” তুই।”

ঈশান হতভম্ব হলো। সবিস্ময়ে উচ্চারণ করল,” আমি কি করলাম?”

” তুই বিয়েতে আসবি না আর আমি ড্যাংড্যাং করে বিয়ের পিরিতে বসবো এই কথা ভাবলি কি করে? তুই না এলে বিয়েই হবে না, ব্যস!”

ঈশান হেসে দিল। ইতস্তত কণ্ঠে বলল,” প্লিজ মম, এইরকম করো না। আমি কি ইচ্ছে করে আসছি না? বাংলাদেশে এখন রাত না? এই রাত শেষ হলেই তোমার বিয়ে। আমি কিভাবে আসবো বলো?”

” বিয়ে পেছানো হবে। তুই যেদিন আসবি সেদিন হবে। এখন আবার এইটা বলিস না যে কোনোদিনই আসবি না।”

” বিয়ে পেছাতে হবে কেন? বিয়ে করে নাও৷ আমি এলে আবার অনুষ্ঠান হবে।”

” না। তুই ছাড়া বিয়েই হবে না।” মোহনার কণ্ঠস্বর দৃঢ় এবং কঠিন। ঈশান হার মেনে বলল,” আচ্ছা বাবা, আসবো। দেখি টিকিট পাই নাকি। যদি না পাই, তাহলে কিন্তু আমার দোষ নেই।”

” তুই যেদিনের টিকিট পাবি তার পরের দিন বিয়ের ডেইট ফিক্সড হবে। ”

” একদম ছেলেমানুষী করছো মম।”

” তুই নিজে ছেলেমানুষী করিসনি?”

” আমি আবার কি করলাম?”ঈশান চমকে ওঠা গলায় জানতে চাইল ঈশান।

” তারিনের জন্য বিয়েতে আসা ক্যান্সেল করেছিস। আমি কিছু বুঝি না নাকি? জন্ম না দিলেও মা হই তোর।”

” বার-বার এই কথাটা বলা কি খুব জরুরী মম? আর এখানে তারিনের কোনো ব্যাপার নেই। তুমি শুধু শুধু আমাকে নিয়ে চিন্তা করছো বলে এমন মনে হচ্ছে তোমার। আমি যথেষ্ট চিল আছি।”

” হুম। জানি তুই কত চিল আছিস। কাল সারারাত ডিংক করেছিস কেন?”

ঈশান চুপ করে গেল। আসামীর মতো বলল,” তুমি কি করে জানলে?”

” জানি। আমার কাছে গোয়েন্দা আছে। তুই কি ভেবেছিস? ব্যাঞ্জো মুখ বন্ধ রাখলে আমি আর কিছু জানতে পারব না? তুই যে ওইখানে কিভাবে আছিস তার সবকিছু আমার জানা। চেম্বারেও তো যাচ্ছিস না কয়েকদিন ধরে। এইভাবে চললে কি হবে? তোরও তো একটা জীবন আছে বাবা। কেন নিজেকে শেষ করছিস এভাবে?”

ঈশান নিস্তার পেতে বলল,” ওহ, আমি তো ভুলেই গেছিলাম। আমার একটা ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং ছিল আজকে। খুব জরুরী ক্লায়েন্ট। ম্যাসেজ এসেছে। তোমার সঙ্গে একটু পরে কথা বলি?”

” শোন, তারিনকে নিয়ে যদি সমস্যা হয় তাহলে তোকে আসতে হবে না। তুই কিছুদিন পরেই আসিস। তখন ফাহিম আর তারিন হানিমুনে চলে যাবে। ওর সাথে তোর দেখা হবে না আর কষ্টও পেতে হবে না। আমি আবারও বলছি, তুই না এলে কিন্তু আমি বিয়ে করব না। তাই তোকে অবশ্যই আসতে হবে। রাখছি।”

ঈশান শান্ত কণ্ঠে বলল,” মিস ইউ মম।”

” আই অলসো মিস ইউ।”

ফোনটা রাখতেই ঈশান অপ্রতিরোধ্য একটা চাপ অনুভব করল বুকের ডানপাশে। ‘হানিমুন’ শব্দটা এতো বিষাক্ত কেন?

চারদিকে গমগমে আয়োজন। সুরেলা শব্দে গান বাজছে। হাসির ধ্বনিতে মুখরিত পরিবেশ। উঠানে রান্না-বান্নার কাজ চলছে। তারিনকে বিকালেই পার্লার থেকে সাজগোজ করিয়ে আনা হয়েছিল। সন্ধ্যার মধ্যেই বিয়ের আয়োজন শুরু হবে। পাত্রপক্ষ এখনও আসেনি৷ তারিনকে ঘিরে বসে আছে তার বান্ধবীরা, নিহা এবং কাজিনরা। তারিন হঠাৎ মেঘলার উপর চেঁচিয়ে উঠল,” বার-বার খোপা ধরে টানছিস কেন মেঘলা? আমি ব্যথা পাচ্ছি তো।”

” খোপাটা খুলে যাচ্ছে। আমি ঠিক করে দেই!”

” লাগবে না।”

মেঘলা তারিনের মাথা থেকে হাত সরিয়ে আনল। ঠিক তখনি চুল থেকে পিছলে ফুলের গাজরাটা পড়ে গেল। সবাই হেসে উঠল এমন ঘটনায়। নিহা বলল,” ভালো হয়েছে না এবার? মেঘলা তো ঠিক করে দিচ্ছিলই। তুই নিষেধ করলি কেন?”

তারিন রূঢ় কণ্ঠে বলল,” এমনি।”

তারপর সে গাজরাটা ছিঁড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিল। সাউন্ডবক্সে মিউজিক চলছিল। সে সুইচ বন্ধ করে বলল,” আমার খুব মাথা ধরেছে। প্লিজ তোরা অন্যঘরে গিয়ে গল্প কর।”

তারিনের আচরণগুলো দেখে সবাই বিব্রত হলো। হালিমা বলল,” আচ্ছা দোস্ত, তুই রেস্ট নে। বিয়ের দিন একটু-আধটু এমন হয়। আমার বড় আপুর সময়ও হয়েছিল। আমরা যাই।”

মেঘলা চলে যাওয়ার সময় তারিনকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল,” তোর কি পিরিয়ড চলছে? ”

তারিন শান্ত কণ্ঠে বলল,” না।”

” তাহলে মেজাজ এমন খিটখিটে করে রেখেছিস কেন? সকালে কি তুই করল্লার জুস খেয়েছিলি?”

তারিন রক্তিম দৃষ্টিতে তাকালো। মেঘলা হাসতে হাসতে চলে গেল। সকলেই একে একে প্রস্থান করল। শুধু নিহা গেল না। সে চুপচাপ বসে ছিল। সবাই চলে যাওয়ার পর সে দরজাটা বন্ধ করে তারিনের সামনে বসল। স্পষ্টভাষায় জিজ্ঞেস করল,” তোর কি হয়েছে তারু? এমন করছিস কেন? তুই তো এতো বদমেজাজি না!”

তারিন দিশেহারার মতো আফসোস করে বলল,” আমি বুঝতে পারছি না নিহা। কালরাত থেকে আমার একটা দমবন্ধ অনুভূতি হচ্ছে। আমি কোনোকিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না। আমার ইচ্ছে করছে কোথাও চলে যাই। যেখানে কেউ থাকবে না, কোনো শোরগোল থাকবে না, শুধু আমি একা, নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে পারবো।”

নিহা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর বলল,” তোর অবস্থা দেখে আমার এখন ভয় লাগছে। এসব কি শোনাচ্ছিস আমাকে তুই? এসব বিয়ের জন্য হচ্ছে না তো? তারু, তুই একবার নিশ্চিন্ত হয়ে বলতো! ফাহিম ভাইকে তুই সত্যি বিয়ে করতে চাস?”

” অবশ্যই চাই। কেন চাইব না? তিনি কত ভালো একটা মানুষ! ”

” কেউ ভালোমানুষ হলেই যে তাকে বিয়ে করতে হবে এমন কিন্তু কোনো কথা নেই। পৃথিবীতে অনেক আছে ভালোমানুষ। তুই কি সবাইকে বিয়ে করবি?”

” ফাহিম ভাই তো আমাকে ভালোবাসে। অন্যদিকে আমার মনে হচ্ছে ঈশানও আমাকে ভালোবাসে। সে আমার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। এই বিয়ে হলে সে আরও কষ্ট পাবে। আর যদি বিয়েটা না হয়,তাহলে ফাহিম ভাই কষ্ট পাবে। কি অদ্ভুত দোটানায় পড়লাম বলতো? আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছি নাহ..”

নিহা তারিনের কাঁধ চেপে ধরল। চোখে চোখ রেখে বলল,” তারু রিল্যাক্স! পৃথিবীতে একসাথে সবাইকে খুশি করা কখনও সম্ভব না৷ তুই যদি ফাহিম ভাইকে ভালোবাসিস তাহলে ঈশান ভাইয়ের কষ্টে তোর এতো খারাপ লাগছে কেন? সে কষ্ট পেলেও বা তোর কি?”

তারিন পাল্টা প্রশ্ন করে বসল,” যে আমার খুশির জন্য এতোকিছু করল তাকে আমি বিনিময়ে এতো কষ্ট কি করে দিবো?”

” তাহলে এখন তুই কি করবি? দু’জনকে একসঙ্গে বিয়ে করবি? এটা তো আর সম্ভব না তাই না?”

” আমার ইচ্ছে করছে মরে যেতে।”

” মরে যাওয়াটা কোনো সমাধান না। তোকে বুঝতে হবে তুই কি চাস? ফাহিম ভাইকে ভালোবাসলে কেন ঈশানের জন্য তোর কষ্ট হচ্ছে?”

” জানি না। ঈশানের কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না।”

“বেশ তো। তাহলে তুই ফাহিম ভাইকে নিষেধ করে দে। বলে দে বিয়ে করবি না। ”

” কিন্তু ফাহিম ভাইও আমাকে ভালোবাসে। এই কথা বললে সে মরে যাবে।”

নিহা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল,” ধর তোকে দশজন মানুষ ভালোবাসে। দশজনই তোর জন্য জীবন দিতে চায়। এখন তুই এদের মধ্যে থেকে কাকে বেছে নিবি?”

তারিন বিরক্ত কণ্ঠে বলল,” আমি জানি না।”

” যদি ওদের বাঁচাতে চাস তাহলে তো দশজনকেই বেছে নেওয়া উচিৎ।”

” হ্যাঁ সেটাই তো!”

” কিন্তু এটা অসম্ভব। দশজনকে তো একসঙ্গে বেছে নেওয়া যায় না। তুই ফাহিম ভাইকে শুধুমাত্র এই কারণে বিয়ে করছিস যে তিনি খুব মানুষ আর তোকে ভালোবাসে। কিন্তু বিয়েটা তো কোনো ব্যবসায়িক চুক্তি নয়। মনেরও একটা ব্যাপার আছে। যাকে মন থেকেই মানতে পারছিস না তাকে বিয়ে কেন করবি? শুধুমাত্র সে তোকে না পেলে মরে যাবে বলে? এটা তো দয়া করে বিয়ে করা হলো। নিজের ফিলিংসের সাথে আপোষ করা হলো। ”

তারিন মাথা নিচু করে বলল,” আমি খুব খারাপ তাই না নিহা? কেন আমি ফাহিম ভাইকে স্বপ্ন দেখালাম? এখন আবার কেন তার স্বপ্ন ভাঙতে চাইছি? একই ব্যাপার তো আমার সাথেও হয়েছিল। ঈশান আমাকে স্বপ্ন দেখিয়ে ছেড়ে চলে গেছিল৷ তখন মৃতের মতো বেঁচেছিলাম আমি। সেই অবস্থা থেকে ফাহিম ভাই আমাকে টেনে তুলল। আর এখন আমি স্বার্থপরের মতো তাকে ছেড়ে শুধু ঈশানের কথাই চিন্তা করছি!”

” এবার তাহলে তুই নিজেকেই প্রশ্ন কর! তোর মন তোকে কোনদিকে টানছে? তুই আসলে কাকে পেতে চাইছিস?”

” কিন্তু আমার এই চাওয়াটা অন্যায়।”

” এজন্যই হয়তো বলে, এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লভ।”

” নিহা তুই আমাকে আর কনফিউজড করিস না প্লিজ। আমি আর ভাবতে পারছি না এসব।”

” কিন্তু তোকে ভাবতে হবে। আমি তোকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করছি শুধু। তুই একবার বোঝার চেষ্টা কর। ফাহিম ভাইয়ের প্রতি তোর একটা সম্মান তৈরী হয়েছে। কারণ তিনি খুব ভালোমানুষ। ঈশান ভাই তোকে ছেড়ে যাওয়ার পর তোর সদ্য ভাঙা মন ফাহিম ভাইয়ের দিকে ঝুঁকে গেছে। তুই তাকে নিজের জীবনে সৌভাগ্য হিসেবে শুধু মেনে নিয়েছিস। কারণ তিনি তোকে ভালোবাসে। তাই তোর মনে হয়েছে তোরও ভালোবাসা উচিৎ। কিন্তু ভালোবাসা কি এতো হিসাব-নিকাশ করে হয়? ঈশান ভাই যখন ফিরে এলো আর তুই বুঝতে পারলি সে তোর জন্য কষ্ট পাচ্ছে তখন আবার তোর মনের সুপ্ত ভালোবাসা জেগে উঠল। এখন তুই শুধু ঈশান ভাইকেই ভালোবাসিস। আর ফাহিম ভাইয়ের প্রতি তোর যে অনুভূতি সেটা কৃতজ্ঞতাবোধ কিংবা আরও সহজ ভাষায় বললে করুণা!”

তারিন মুখে হাত চেপে কাঁদতে লাগল। অসহায় সুরে বলল,” আমি ফাহিম ভাইকে ঠকাতে পারব না। তিনি খুব ভালোমানুষ। এই কাজ করার আগে আমার মরণ হোক। ”

নিহা হতাশ কণ্ঠে বলল,” সবাইকে খুশি রাখতে গিয়ে নিজের উপর জুলুম করে ফেলিস না তারু।”

বাইরে থেকে হৈহৈ আওয়াজ শোনা গেল,” বর এসেছে, বর এসেছে!”

কিন্তু তারিন যেন শুনতে পাচ্ছিল,” মরণ এসেছে, মরণ এসেছে।”

ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তারিনের সাথে ফাহিমের বিয়ে হয়ে গেল। তারিন কবুল উচ্চারণ করেছিল নিষ্প্রাণ কণ্ঠে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here