তি_আমো পর্ব ৫৮

0
301

#তি_আমো
পর্ব ৫৮
লিখা- Sidratul Muntaz

তারিন-ফাহিমের বিয়েতে কোনো ক্লাব ভাড়া করা হয়নি। ঘরোয়া আয়োজনেই শুধু ঘনিষ্ট আত্মীয় আর বন্ধু-বান্ধবদের ডেকে খুব সাবলীলভাবে আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। পুরো অনুষ্ঠানে তারিনের চোখ কেবল ফাহিমের দিকে ছিল। কত খুশি ছিল ফাহিম। রিফাত, সিয়াম, বন্ধু-বান্ধব এবং অন্যান্য কাজিনদের নিয়ে হাসি-তামাশায় মেতে ছিল পুরোটা সময়। কারণে-অকারণে শিষ বাজাচ্ছিল। তার আনন্দ দেখে অতিথিরা সবাই অভিভূত। এই প্রথম কোনো বরকে নিজের বিয়েতে এতোটা আনন্দ করতে দেখা যাচ্ছে যেন। সাউন্ডবক্সে যতগুলো গান বেজেছে সবগুলো গানের সাথেই তালে তালে নেচেছে ফাহিম। এক পর্যায় তো সে তারিনকেও স্টেজ থেকে তুলে নিয়ে এলো নাচার জন্য। তারিন খুশির থাকার অভিনয়টা খুব সুন্দরভাবে পালন করল। ভেতরের অসহ্য অনুভূতি ধামাচাপা দিয়ে শান্ত থাকল। বিদায়ের সময় সে গিলে থাকা কষ্টগুলো একত্রে উগড়ে দিতে চাইছিল। কিন্তু তার কান্নাই এলো না। বেশি শোকে মানুষ পাথর হয়। তারিন পাথর হয়ে গেছিল। বিদায়ের কষ্ট তার কাছে কোনো কষ্টই মনে হলো না। কিছু ব্যাপার আসলে অজানা থাকাই ভালো। তারিন যদি ঈশানের মনের কথা না জানতো তাহলে আজ তার মনটাও এতো উতলা হতো না। আয়েশা, তারিফ, সূর্যবানু বেগম নিশ্চিন্ত হলেন। তারিন হাসি-খুশি বিদায় নিয়েছে মানে বিয়েতে সে সন্তুষ্ট!

মোহনা আর তারিফের বিয়ে স্থগিত করা হয়েছিল। তারিন এই ব্যাপারটা জানতোই না। হঠাৎ করে সে জানতে পারল। তখন এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে একদম ইচ্ছে করেনি। তাই তারিন কারণ জানার চেষ্টাও করেনি। এখন সে ফাহিমের সাথে গাড়িতে বসে প্রশ্ন করল,” আচ্ছা, ভাইয়া আর ভাবীর বিয়েটা হলো না কেন? আপনি জানেন এই ব্যাপারে কিছু?”

” ঈশান ভাই আসেনি এজন্য বোধহয়।”

” ও.. তাহলে কি ঈশান এলে বিয়ে হবে?”

” হ্যাঁ। কিন্তু ঈশান ভাই কবে আসে তার তো ঠিক নেই।”

তারিন মনে মনে প্রার্থনা করল ঈশান যখন আসবে তখন যেন সে কোনোভাবেই ঈশানের সামনে না পড়ে। চাপিয়ে রাখা কষ্টটা তবে আবার ফুঁসে উঠবে।

” আচ্ছা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?” রাস্তা পরিবর্তন হতে দেখেই তারিন প্রশ্নটা করল। ফাহিম হেসে বলল,” কেন, বাড়িতে!”

” কিন্তু এইদিক দিয়ে তো নিহাদের বাড়ি!”

” নিহাদের বাড়ি কি আমাদের বাড়ি না?”

” হ্যাঁ। কিন্তু আপনি আর আন্টি না আলাদা ফ্ল্যাটে শিফট হয়েছেন?”

” এখনও আন্টি বলবে? মা বলো!”

” স্যরি, মা।”

” সবাই চাইছিল আমাদের বাসর এই বাড়িতে হবে। ওরা নাকি ঘর-টরও সাজিয়ে ফেলেছে। এজন্য দুইদিন আমরা এখানেই থাকব।”

” ও আচ্ছা।”

তারিনের দমবন্ধকর অনুভূতিটা আবার হচ্ছে। ওই বাড়িতে গেলে ঈশানের স্মৃতিগুলোর কথা মনে পড়বে। মনের সাথে, কান্নার সাথে আবার একটা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ইশ, এতোদিন তো তারিন খুব ভালো ছিল। সে ধরে নিয়েছিল ঈশান তাকে ভুলে গেছে। তাই সেও ঈশানকে ভুলে ফাহিমকে আঁকড়ে ধরার একটা জেদ পুষে রেখেছিল মনে। সেই জেদ নিয়েই তো সে শান্তিতে ছিল। কিন্তু কালরাতে মোহনার ওই কথাগুলো শোনার পর থেকে তারিন একদম এলোমেলো হয়ে গেছে। ভেতরটা একদম ভেঙে গেছে। মনের শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে জীবনটাকে সবচেয়ে কঠিন বলে বোধ হচ্ছে।

“স্মৃতিগুলো কেন বলো, চলে গেল একা করে.. তুমি নেই আজ, আমার পাশে,, ফিরে এসো.. শূন্য হৃদয়ে!”

গাড়িতে গানটা বাজছে। ঈশান অসহ্য হয়ে বলল,” মিউজিকটা বন্ধ করবেন প্লিজ? মাথা ধরে যাচ্ছে।”

” স্যরি স্যার।”

ঈশান বড় করে শ্বাস নিল। এখন কিছুটা রিল্যাক্স লাগছে। তবে গলা থেকে বুক অবধি দলা পাকানো কিছু একটা আটকে আছে। যা সহ্য হচ্ছে না। তারিনের বিয়ের কথাটা সে কিছুক্ষণ আগেই জানতে পারল। মোহনার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। হঠাৎ পাশ থেকে কেউ বলল, ফাহিম-তারিনের বাসর সাজানো হচ্ছে। মোহনা সঙ্গে সঙ্গেই অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছে। হয়তো সে ভেবেছে ঈশান কথাটা শুনতে পায়নি। কিন্তু ঈশান শুনেছে। এমনকি ওই একটি বাক্য শোনার পর সে আর কোনো কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারেনি। হুম, হ্যাঁ করে ফোন রেখে দিয়েছে। চেম্বারেও ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছিল না। সন্ধ্যা না হতেই বের হয়ে গেছে। মাঝরাস্তায় আবার গাড়িতে সমস্যা দেখা দিল। ঈশান ব্যাঞ্জোকে গাড়ি নিয়ে গ্যারেজে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজে এই গাড়িতে উঠে গেল। এই গাড়ির ড্রাইভার আবার বাঙালী। তাই সে ছেড়েছে বাঙালী গান। আর অদ্ভুতভাবে গানের কথাগুলো ঈশানের জীবনের সাথে যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। হৃদয়ে আঘাত করে। সামান্য একটা গানও বুঝি মানুষকে এতোটা তোলপাড় করে দিতে পারে! বাকিটা পথ ঈশান বসে ছিল নিথর হয়ে। ভাড়া নেওয়ার সময় ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল,” এনি প্রবলেম স্যার?”

ঈশান গম্ভীর গলায় বলল,” না, কেন?”

” তাহলে স্যার.. আপনার চোখে পানি?”

ঈশান দ্রুত মিররে তাকালো। নিজের চোখের পানি দেখে হতভম্ব হয়ে গেল।

ফুল দিয়ে সজ্জিত ঘরটায় আসতে আসতে রাত বারোটা বেজে গেল ফাহিমের। বিছানায় তারিনকে পাওয়া গেল না। বাথরুমেও নেই। অতঃপর তাকে বারান্দায় দেখা গেল। ফাহিম কিছুটা অবাক হলো। কারণ তারিন বেনারসি বদলে সেলোয়ার কামিজ পরে নিয়েছে। গয়না, চুল, সব নিজেই খুলেছে। মুখের মেকাপও তুলে ফেলেছে। অন্তত ফাহিমের জন্য অপেক্ষা করতে পারতো! ফাহিম তো এখনও শেরোয়ানিটা খোলেনি। ভেবেছিল বাসর ঘরে ঢুকে তারিনের সাথে একান্তে কিছু ছবি তুলবে। ফাহিম পাশে এসে দাঁড়াতেই চমকে উঠল তারিন। তারপর একটু হেসে বলল,” ও, আপনি?”

” এখানে কি করছো?”

” কিছু না। দেখছিলাম।” ভারী একটা নিশ্বাস ছাড়ল তারিন। ফাহিম হঠাৎ করেই বলল,” একটা প্রশ্ন করব তারু?”

” কি প্রশ্ন?”

” তুমি খুশি তো?”

তারিন হাসার ভাণ ধরে বলল,” আপনার কি মনে হয়?”

” তোমাকে সন্ধ্যা থেকেই মনমরা লাগছে। কোনো কিছু নিয়ে কি টেনশন করছো?”

” নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর সব মেয়েরই একটু-আধটু মনখারাপ থাকে।”

বাতাসে অর্কিড গাছটার টব উল্টে গেছিল৷ ফাহিম সেটা ঠিক করার জন্য হাত বাড়াল। টবটা ঠিক তারিনের মাথার পেছনেই ছিল। ফাহিম হাত বাড়াতেই তারিন আৎকে উঠে সরে গেল জায়গাটি থেকে। যেন ফাহিমের ছোঁয়া গায়ে লাগলেই কারেন্টের শক খাবে সে। ফাহিম ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। তাই তারিনকে সহজ করার উদ্দেশ্যে বলল,” অর্কিড গাছটা ঠিক করে দিচ্ছিলাম।”

তারিনও নিজের আচরণে হতভম্ব। মৃদু হেসে বলল,” ও আচ্ছা।”

” চলো ভেতরে যাই? এখানে ঠান্ডা অনেক।”

” আচ্ছা, চলুন।”

ফাহিম বারান্দার গ্লাস বন্ধ করে দিল। তারিন বিছানায় বসে হাই তুলছে। ফাহিম ড্রেসিং টেবিলের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমার কি টায়ার্ড লাগছে তারু?”

” একটু তো লাগছেই। সমস্যা নেই। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি অপেক্ষা করছি। তারপর আমরা গল্প করবো।”

” থাক, আজকে আর গল্প করার দরকার নেই। তুমি ঘুমিয়ে যাও। আমারও খুব টায়ার্ড লাগছে।”

তারিন অবাক কণ্ঠে বলল,” শিউর?”

” হুম।”

ফাহিম বাথরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। তারিনের বিশ্বাস হচ্ছে না৷ ফাহিম এতো বুঝদার কেন? এমন একটি মানুষের সাথে বুকে অসহ্য তীব্র ব্যথা নিয়েও নিশ্চিন্তে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়! তারিন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল সে জীবনে কখনও ফাহিমকে কষ্ট দিবে না। নিজের যত কষ্টই হোক, ফাহিমকে সবসময় ভালো রাখবে। এই মুহূর্তে সে মানুষটির প্রতি যে কি অসম্ভব কৃতজ্ঞতা অনুভব করছে তা ভাবনাতীত।

ঈশান ঘরে ঢুকে তার ক্লান্ত শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিল। রান্নাঘর থেকে ঘটরঘটর শব্দ আসছে। সাথে সুস্বাদু রান্নার সুঘ্রাণ। বাবা কি রান্না করছে? ঈশান হেলে-দুলে রান্নাঘরে ঢুকতেই অবাক। উর্বশী দাঁড়িয়ে আছে। ঈশান সবিস্ময়ে বলল,” তুমি আবার এসেছো?”

উর্বশী হাসল,” আপনার ডিনার রেডি করছি। ক্ষিদে পায়নি আপনার?”

” তুমি ঘরে ঢুকলে কিভাবে?”

” আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন ডুপ্লিকেট চাবিটা ড্রয়ার থেকে চুরি করে নিয়ে গেছিলাম।”

ঈশান অসহ্য হয়ে বলল,” দিস ইজ টু মাচ।”

” কিন্তু আমি রান্না করেছি টুনা মাছ।”

” লেইম জোক। যদি চাও আমি তোমার বাড়িতে ফোন না করি তাহলে এক্ষুণি আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও।”

” মেহমান এলে কেউ এইভাবে তাড়ায়? আপনি না, খুব রুড!”

ঈশান বেডরুমে যেতে যেতে বলল,” আমি বাইরে এসে যেন আর তোমাকে না দেখি।”

ঈশান তার বেডরুমের দরজা ফট করে আটকে দিল। কিন্তু উর্বশীর কাছে বেডরুমের ডুপ্লিকেট চাবিও আছে। সে ঝট করে দরজা খুলে ঢুকে পড়ল। ঈশান তখন বাথরুমে। উর্বশী ফলের একটা স্মুথি বানিয়েছে। ঈশান তো আবার স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। তার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। প্রায় বিশ মিনিট পর গোসল শেষ করে ঈশান যখন বের হলো তখন উর্বশী বিছানার চাদর, বালিশের কভার এসব বদলে ফেলেছে। ঈশান কোমরে হাত রেখে কটমট স্বরে বলল,” তুমি তাহলে এইভাবে যাবে না? আমি কি সত্যিই তোমার বাড়িতে ফোন করব?”

উর্বশী কথাটা শুনতেই পায়নি এমনভাবে বলল,” আপনার জন্য ফলের স্মুথি বানিয়েছি। নিন, খেয়ে দেখুন। ভালো লাগবে।”

স্মুথি দেখে ঈশানের আবার মনে পড়ল তারিনের কথা। সে এই ধরণের স্মুথি বানাতে খুব পছন্দ করতো৷ ঈশান এবার সবচেয়ে অদ্ভুত কাজ করল। উর্বশীর হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলল। উর্বশী হকচকিয়ে গেল৷ সঙ্গে সঙ্গেই তার কান্না পেল। কিন্তু বহু কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রাগী কণ্ঠে বলল,” আপনি খুব খারাপ।”

উর্বশী বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে চলে যেতে নিচ্ছিল। তখন কাঁচের টুকরোয় তার পা আটকে গেল। উর্বশী তাও থামল না। র/ক্তা/ক্ত পা নিয়েই বের হয়ে গেল। ঈশান বিছানায় বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল এবার। জানালায় তাকিয়ে আঁধারে মিলিয়ে যাওয়া শহরটার দিকে চেয়ে থেকে ঈশানের হঠাৎ করেই মনে হলো বেঁচে থাকাটা এতো কষ্টের কেন? শান্তি কি তবে কেবল মৃত্যুতেই?

উর্বশীর সাথে এমন ব্যবহারের জন্য মোহনা খুব রেগে গেল। কিছুক্ষণ পরেই ঈশানকে ফোন করে সে ঝারতে লাগল,” এসব কি ঈশান? মেয়েটার সাথে তুই এমন করলি কেন? এগুলো কোনো কথা? তুই জানিস ও নিজের ঘরে জীবনে একটা কাজ করেনি৷ অথচ তোর জন্য…”

ঈশান ক্লান্ত স্বরে বলল,” কে ও? কেন করছে সে এসব? তুমি ওকে পাঠিয়েছো?”

” হ্যাঁ, আমিই পাঠিয়েছি।”

” কেন মম?”

” তুই আমাকে কি প্রমিস করেছিলি মনে নেই? বিয়ে করবি বলেছিলি।”

” হ্যাঁ বলেছিলাম। কিন্তু এখনি কেন?”

” তোকে আমি কষ্টে দেখতে পারব না। যত দ্রুত তুই মুভ অন করবি তত আমার শান্তি। তোর জীবনটা এলোমেলো রেখে আমি কিভাবে নতুন জীবন শুরু করব বলতো?”

ঈশান এবার বলল,” ঠিকাছে। আমি যদি উর্বশীকে বিয়ে করি তাহলে তুমি খুশি থাকবে তো?”

” অনেক বেশি খুশি থাকবো। ”

” ডান।”

পরেরদিন উর্বশীকে ঘুম থেকে টেনে তুলে রোহিনী বলল,” তোর সঙ্গে ঈশান দেখা করতে এসেছে।”

উর্বশী চোখ কচলাচ্ছিল। ঈশানের নামটা শুনে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে বলল,” হোয়াট? তুমি সত্যি বলছো?”

” সত্যি! বিশ্বাস না হলে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দ্যাখ!”

উর্বশীর হাত-পা কাঁপছে উত্তেজনায়। চোখের পলক পড়ছে না বিস্ময়ে। আজকের সকালটা বুঝি তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সকাল! মায়ের কথা বিশ্বাস হচ্ছিল না বলে নিজেই গেল ড্রয়িংরুমে। ঈশানকে একবার উঁকি মেরে দেখেই ঘরে চলে এলো। সুন্দর করে সাজগোজ করল। এতোদিনে কি তাহলে মন গলেছে মিস্টার পাথরের?

ইনজাদ সাহেবকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে কুর্ণিশ করল ঈশান,” আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।”

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছো?”

” জ্বী আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?”

” ভালো। হঠাৎ তুমি কি মনে করে? ইয়াজিনের কাছে এসেছো?”

ঈশান কিছু বলার আগেই উর্বশীর আগমন ঘটল। তার গায়ে কমলা রঙের শাড়ি। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। ইনজাদ সাহেব মেয়ের এমন সাজ দেখে হতবিহ্বল কণ্ঠে জানতে চাইলেন,” কি হয়েছে তোমার? আজ বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান নাকি?”

উর্বশীর মুখ শুকিয়ে গেল। সে যদি আগে জানতো বাবা এখানে আছে তাহলে ভুলেও আসতো না। শুকনো একটা ঢোক গিলে বলল,” আজ ফ্লোরিডাদের বাসায় অনুষ্ঠান আছে। আমি সেখানে যাওয়ার জন্যই তৈরী হয়েছিলাম।”

” ও আচ্ছা। ঠিকাছে যাও। বাইরে অনেক ঠান্ডা। সোয়েটার পরে যাও।”

উর্বশী অসহায় হয়ে ঈশানের দিকে তাকাল। অযথাই তাকে এখন বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হবে। কি মুশকিল! আড়ষ্ট পায়ে দরজার দিকে এগোতে লাগল সে। তখনি ঈশান ডাকল,” উর্বশী, তোমার সাথেই কথা বলতে এসেছিলাম। কিছুক্ষণ পরে যেও? বসো।”

উর্বশী চট করে বসে পড়ল। ইনজাদ সাহেব সন্দিহান কণ্ঠে বললেন,” উর্বশীর সাথে তোমার কি কথা?”

” আসলে আঙ্কেল আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিলাম৷ গতকালকের সেই মিসবিহেভের জন্য আই এম স্যরি, উর্বশী।”

ঈশান উর্বশীর দিকে চাইল। উর্বশী বিমূঢ় হয়ে আছে। সে ভাবতেও পারেনি ঈশান সকাল সকাল তার বাড়ি বয়ে এসে এইভাবে ক্ষমা চাইবে। সবই চকলেট আন্টির কেরামতী। তিনি নিশ্চয়ই আচ্ছামতো ঝেরে দিয়েছিলেন। তাই ঈশানের বাঁকা রগ সোজা হয়ে গেছে। উর্বশী হালকা হেসে বলল,” ইটস ওকে।”

ইনজাদ সাহেব তাদের ব্যাপার-স্যাপার কিছু বুঝতে না পেরে বললেন,” গতকাল কি হয়েছিল? আমি কি জানতে পারি?”

উর্বশী চোখের ইশারায় প্রাণপণে ঈশানকে সত্য বলতে নিষেধ করল। ঈশান ইতস্তত কণ্ঠে বলল, ” তেমন কিছু না৷ একটা ছোট্ট ইনসিডেন্ট।”

” ওকে,,আই সী।”

” আঙ্কেল আমি তাহলে এখন উঠি।”

” ব্রেকফাস্ট করে যাও।”

” না থ্যাংকস। আমি খেয়ে এসেছি। আর এখন একটু চেম্বারে যেতে হবে। একজন ক্লায়েন্ট অপেক্ষায় আছে। দেরি হতে পারে।”

” ঠিকাছে বাবা, আবার এসো।”

ঈশান বের হওয়ার সাথে সাথেই উর্বশী বলল,” আমি ফ্লোরিডার বাসায় যাচ্ছি বাবা।”

এই কথা বলে সেও দ্রুত বের হয়ে গেল। ইনজাদ সাহেব তাদের পুরো ব্যাপারটা চট করে বুঝে নিয়েই মুচকি হাসলেন।

ঈশান লিফটে উঠেছে। দরজা বন্ধ হওয়ার সময় উর্বশী দ্রুত হাত দিয়ে আটকালো। তারপর নিজেও ঢুকে গেল। ঈশানের পাশে দাঁড়িয়ে হাসি-খুশি কণ্ঠে বলল,” কেমন আছেন মিস্টার সাইকোলজিস্ট?”

” ভালো।”

” আপনি এভাবে বাড়িতে চলে আসবেন আমি সেটা চিন্তাও করিনি। মনে আছে সেদিন আপনার বাড়ির জিমনেসিয়ামে দেখা করতে এসেছিলাম যখন, আপনি আমাকে কি বলেছিলেন?”

” মনে পড়ছে না। কি বলেছিলাম?”

” আমি তো বলবো না। আপনি নিজেই মনে করুন।”

লিফটের দরজা খুলে গেল। ঈশান বের হয়ে যেতে লাগল। উর্বশী ত্বরিতে তার পিছু নিয়ে বলল,” এখন কোথায় যাচ্ছেন? চেম্বারে?”

” না। বাড়িতে। কিছু গোছগাছ করতে হবে। আজরাতে আমি বাংলাদেশে রওনা হচ্ছি।”

” ওয়াও, বাংলাদেশ! আমাকেও নিবেন প্লিজ? কতবছর হয়ে গেল বাংলাদেশে যাই না৷ আই মিস মাই কান্ট্রি সো মাচ।”

” ঠিকাছে। রাত আটটায় বাড়িতে চলে এসো।”

” ওকে.. হোয়াট? এই আপনি সত্যি আমাকে নিবেন?”

উবশী বিস্ময়ে বিমোহিত। ঈশান হাসল। উর্বশী খুশিতে গদগদ হয়ে চিৎকার করল। তখনি সে খেয়াল করল ইয়াজিন অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বশী তাকে দেখেই ঘাবড়ে গেল। ঈশান বলল,” আমি আসছি।” সে চলে যাওয়ার পর ইয়াজিন বিস্ময়াভিভূত দৃষ্টি নিয়ে উর্বশীর কাছে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল,” এসব কি দেখছি আমি?”

” কোনসব?”

” তুই ঈশানের সাথে কি করছিলি?”

উর্বশী অযথাই একটা ভাব নিয়ে বলল,” আমার বয়ফ্রেন্ড হয়। তোমার কোনো সমস্যা?”

ইয়াজিন চোখমুখ বিকৃত করে বলল,” তোর বয়ফ্রেন্ড? মানে ঈশান?”

” কেন? ভালো চয়েজ না?”

” আমি তোর চয়েজের কথা ভাবছি না। বরং আমি ভাবছি ঈশানের মতো মানুষ তোর মতো ছাগলকে কিভাবে চয়েজ করল? ছিঃ!”

উর্বশী ফুঁসে উঠল,” ভাইয়া, আই হেইট ইউ।”

ঠিক সময়মতো ঈশানের বাড়িতে চলে এলো উর্বশী। দু’টো টিকিট আগেই কেটে রাখা হয়েছিল। উর্বশী যেতে রাজি হবে এটা ঈশান জানতো। তার পরিকল্পনা হলো মোহনাকে খুশি করা। উর্বশীকে নিয়ে বাংলাদেশে গেলে মোহনা অনেক খুশি হবে। শুধুমাত্র এই কারণেই সে উর্বশীকে নিচ্ছে। বাড়িতে সবকিছু ম্যানেজ করে আসতে উর্বশীর খুব একটা অসুবিধা হলো না। রোহিনী অনায়াসে অনুমতি দিয়েছে। ইনজাদ সাহেব মোহনার অনুরোধে রাজি হয়েছেন। সবকিছু এখন সেট। তারা সবরকম ফরমালিটিজ শেষ করে ফ্লাইটে উঠে গেল। উবশীর অসম্ভব ভালো লাগছে। জীবনে অনেকবার বিমান ভ্রমণ করেছে সে। কিন্তু কখনও এতোটা স্পেশাল লাগেনি। সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে উর্বশী প্রশ্ন করল,” আচ্ছা, আপনি হঠাৎ আমাকে নিজের সাথে নিতে কেন রাজি হলেন?”

ঈশান নির্বিকারচিত্তে বলল,” মমের ইচ্ছা আমি তোমাকে বিয়ে করি।”

উর্বশী বিয়ের কথা শুনে চমকে উঠল। খানিকটা বিব্রত হয়ে প্রশ্ন করল,” আর আপনার কি ইচ্ছা?”

” আমার কোনো ইচ্ছা নেই। তবে আপাতত তোমাকে কিছু কথা বলা একান্ত জরুরী।”

” তারিনের বিষয়ে বলবেন?”

ঈশান অবাক হলো,” তুমি তারিনের ব্যাপারে জানো?”

” আন্টি আমাকে সবকিছু বলেছেন।”

ঈশান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল,” তাহলে তো হয়েই গেল। আমি কখনও ওকে ভুলতে পারবো না উর্বশী। বিয়ের পর কোনোদিন তোমাকে ভালোবাসতে পারব কি-না সেটাও জানি না। কারণ তারিনের জায়গা কেউ নিতে পারবে না। এখন তুমিই ঠিক করো, আমাকে বিয়ে করবে কি-না?”

উর্বশী কোনো উত্তর দিতে পারল না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here