#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_২৪,২৫
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
২৪
২৯.
হলদেটে জামা গায়ে চড়িয়ে হলুদ পাখির মতো ঘর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। সাউন্ড বক্সে বেজে চলছে, ‘আজ কন্যার গায়ে হলুদ, কাইল কন্যার বিয়ে।’
গায়ে হলুদে কন্যার বদলে পুত্র উপস্থিত। আত্নীয়-স্বজন ও কৌতূহল প্রতিবেশীর ভিড়ে ঘর পরিপূর্ণ। সবার হাসিখুশি মুখভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করছি আর মুগ্ধ হয়ে ভাবছি। বিয়ে ব্যাপারটা খুব সুন্দর। সবচেয়ে মুগ্ধকর।
আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। উঠোনে গায়ে হলুদের স্টেজ সাজানো হচ্ছে। নানা নতুন মুখের আগমন দেখতে পাচ্ছি। তাদের সঙ্গে পাশ কাটিয়ে একজন মহিলা ভেতরের দিকে গেলেন। আমি তখন বারান্দা ছেড়ে বাহিরে পা রাখতে যাচ্ছিলাম। মহিলাকে কেমন চেনা-পরিচিত মনে হলো। যেতে যেতে পিছনে মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। মধ্য বয়সী মহিলাটিকে ভালো মতো পরখ করতেই আমার চলন গতি স্থগিত হয়ে গেলো।
ভিড়েই মাঝেই উনি হাত উঁচিয়ে বলে ওঠলেন,
“পুত্রবধূ!”
সর্বনাশ! এ দেখি আমার শাশুড়ি মা। এখন কি হবে? দিগ্বিদিক দিশা হারিয়ে আমি দৌঁড়ে ছুটলাম। স্টেজের সামনে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির থালা নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। থতমত খেয়ে ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে স্টেজের পিছনে স্থান নিলাম। পেছনে পাশ ঘেঁষে বাউন্ডারির দেওয়াল। ফলে এখানে আর কেউ নেই।
আমার বুক উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ধক ধক করছে। প্রিয়লের মা যে আসবে তা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। সবার সম্মুখে উনি বিয়ে সমন্ধীয় কথাবার্তা তুললে কি যে বিগিদিস্তা অবস্থা হবে কে জানে।
উঁকি মেরে আড়াল থেকে দেখার চেষ্টা করছিলাম আমার শাশুড়ি কাছেপিঠে এসেছে কি-না। উনি নজরে পড়লো। চোখের আকৃতি হ্রাস করে তীক্ষ্ণ চোখে চতুর্দিক পর্যবেক্ষণ করে আমাকে খোঁজে চলছেন। আমি পিছন দিকে দৌঁড়ের উদ্দেশ্যে ছুটতেই আবার ধাক্কা খেলাম।
ঘুরে দেখি সামনে মাস্ক পরা লম্বাটে একজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে গেলাম।
আমি আঙ্গুল তুলে বললাম,
“আপনি?”
ছেলেটি কাঁধ ঝাকালো।
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বললাম,
“আপনাকে চেনা চেনা লাগছে।”
ছেলেটি মাস্ক খুললো।
হেসে বললো,
“এক রাতেই স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ার মতো বউ তো আমার নয়।”
আমি প্রিয়লকে দেখে ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করি।
প্রিয়ল ভ্রু খানিক তুলে বললো,
“এখানে কাজ চলছে তো। তুমি এখানে বিড়ালের মতো ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে কেন?”
আমি সেসবে জবাব না দিয়ে আবার আওড়ালাম,
“আপনাকে চেনা মনে হচ্ছে।”
প্রিয়ল আমার কপালে মৃদুভাবে টোকা মেরে বললো,
“আমি আপনার হাজব্যান্ড যে তাই।”
আমার টিউবলাইট মাথা আচমকা একশো ওয়াটের বাতি জ্বালিয়ে দিলো।
রেস্টুরেন্টে একটা ছেলে আমাকে জিগ্যেস করেছিল। রিজওয়ান আমার বয়ফ্রেন্ড কি-না। ঠিক একই মাস্ক, একই লুক!
আমি কোমরে হাত রেখে জোর গলায় জিগ্যেস করলাম,
“আপনার সঙ্গে আমার রেস্টুরেন্টে কথা হয়েছিল!”
তাকে খানিক বিভ্রান্ত দেখালো।
“মানে?”
আমি প্রিয়লের মাস্কটা তার হাত থেকে আমার হাতে নিয়ে বললাম,
“এটা পরিহিত অবস্থায় আপনার সঙ্গে আমার রেস্টুরেন্টে দেখা হয়েছিল।”
প্রিয়ল দ্বৈধিভাব নিয়ে বললো,
“তোমার সঙ্গে তো আমার রেস্টুরেন্টে কতবারই দেখা হয়েছে। তাতে কি? আর মাস্ক বলছো? একইরকম দেখতে আমি অনেকগুলো কিনেছিলাম। এমন ডিজাইনের আরও আছে। কিন্তু সেসবে কি হয়েছে?”
আমি তার দিকে খানিক এগিয়ে গিয়ে চোখ পাকিয়ে বললাম,
“বিয়ের পূর্বে একদিন রেস্টুরেন্টে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আপনি আমাকে টিটকারি মেরে জিগ্যেস করেছিলেন সঙ্গের ছেলেটি আমার বয়ফ্রেন্ড কি-না।”
প্রিয়ল হাসার চেষ্টা করে বললো,
“এটা অন্য কেউ হবে জান। এরকম মাস্ক তো..”
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
“নাহ! আপনার বউ আসলেই একরাতে স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ার মতো মানুষ নয়। সত্যি করে বলুন তো। আপনি আমাকে আগে থেকে চিনতেন?”
প্রিয়ল মাথা চুলকে বললো,
“ওই মানে, হ্যাঁ, চিনতাম আরকি।”
বলেই একটা অপাপবিদ্ধ হাসি দিলো।
“আচ্ছা! এইজন্যই! এইজন্যই বিয়ের সময় আপনি রোবট। নড়ে না, চড়ে না। ড্যাং ড্যাং দামড়া একটা ছেলে মানুষের ধমকে বিয়ে করে ফেলে। মা বলেছেন কাজী ডাকুন, ছেলে পাছা নাড়িয়ে কবুল হে কবুল হে বলেন!”
“জান আসলে..”
আমি চোখ পাকিয়ে বললাম,
“আসলে? এই! আপনিই ভাড়া করে ওই লোকদের ওখানে পাঠাননি তো? নাহলে আমি তো কখনো শুনিনি কোনো চেয়ারম্যানের এতো আজাইরা কাজ থাকে যে মানুষকে ধরে ধরে বিয়ে দেয়। বরং তারা বিয়ে ভাঙে।”
“না, না! তওবা, আমাকে এতো বড় দোষারোপ দিও না জান। ইট ওয়াজ জাস্ট..”
“প্রিয়ল, আপনি যদি আর আধা আধা কথা বলেন তো আপনার মাথা ফাটাবো।”
প্রিয়ল চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিলো। চোখ খুলে মৃদু হেসে বললো,
“হ্যাঁ, আমি তোমাকে আগে থেকেই চিনতাম। বেশ কয়েকবার গাড়ি থেকে তোমাকে লক্ষ্য করেছিলাম। সেদিন রেস্টুরেন্টে এক মিনিট কথা হওয়ার পর তোমার সম্পর্কে যা যা সম্ভব খবর সংগ্রহ করি।”
আমি অবাকের চরম পর্যায়ে উল্লম্ফন করি।
আমি রেগে বললাম,
“একদম ভেটকাবেন না। এইজন্যই বিয়ের সময় আপনি নির্বিকারচিত্ত। বউ আমি, অথচ উনি নতুন বউয়ের মতো ঘোমটা দিয়ে থম মেরে রইলেন। ভাঁওতাবাজ!”
প্রিয়ল কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গি করে বললো,
“এরকমটা নয় জান।”
আমি অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে তাকালে প্রিয়ল বলে,
“আসলেই এরকমটাই। তোমাকে ওইদিন আমি বউ হিসেবে কল্পনা করে এতো বিধ্বস্ত হয়ে যাই যে বিয়েটা করেই ফেলি।”
আমি দাঁত কিড়মিড় করে মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত দুইদিকে ছড়িয়ে দেই। হাতের মুঠোয় খুললেই ওপর থেকে ঝাড়ু এসে ঠেকে।
উপরে তাকিয়ে দেখি বাঁশের মাচার মতো একটা স্থানে একজন ঝুলে আছে।
সেখান থেকে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আপা ঝাড়ুটা ছুড়ে মারেন। ভুলে পইড়া গেছে। মাফ কইরেন।”
আমি সেই ঝাড়ু সহ প্রিয়লের পিছনে ছুটলাম।
প্রিয়ল থতমত খেয়ে দৌঁড় লাগালো। ছুটতে ছুটতে চাপা গলায় বললো,
“জান, প্লিজ! আ’ম ইউর হাজব্যান্ড!”
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আবার ধাক্কা খেয়ে পড়লাম।
“আহ, আম্মু!”
কোমরে হাত রেগে প্রিয়লের দিকে তেড়ে যেতেই দেখি আমার শাশুড়ি মা।
মূলত উনার সঙ্গেই আমি আর প্রিয়ল ধাক্কা খেয়ে পরে যাই। শাশুড়ি একবার তার পুত্রের দিকে আরেকবার তার পুত্রের বধূর দিকে তাকাচ্ছিল।
প্রিয়লের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আবরেশাম..”
আমি আর্তচিৎকার দিয়ে আবার দৌঁড় দেই।
শাশুড়ি মা উঠে আমার পেছন পেছন আসতে লাগলেন।
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একটা রুমে গিয়ে আটকা পড়ে যাই।
পিছন থেকে ভেসে এলো,
“পুত্রবধূ! তুমি আমাকে দেখে দৌঁড়ে পালাচ্ছো কেন?”
আমি ঘুরে উনার দিকে ফিরলাম।শাশুড়ির আম্মার চোখের চাহনি দেখে আমার শরীরের রক্ত কমে যায়।
হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
“আসলে শাশুমা, আপনাকে দেখে আবেগে আমি আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। চোখের পানি লুকোতেই ছুটে ছিলাম।”
উনি নরম হলেন না। একই চাহনি বহাল রেখে জিগ্যেস করলেন,
“তুমি এখানে কি করো?”
আমি ঢোঁক গিলে জবাব দিলাম,
“বিয়ে খেতে এসেছি।”
“কেন?”
আমি চমকে ওঠলাম। কেন মানে কি বলবো, পেটে খাবার নেই তাই খেতে এসেছি?
উনি কঠিন গলায় বলে ওঠলেন,
“কি হলো!”
“ফায়াজ ভাইয়ের বাবা আমার বাবার বন্ধু। সেই উপলক্ষে ফুল ফ্যামিলিসহ খেতে এসেছি। মানে বিয়ে বাড়িতে এসেছি।”
উনি তখন নমনীয়তা এনে বললেন,
“ওহ, মোজাম্মেল ভাই তোমার বাবার বন্ধু?”
আমি মাথা নাড়লাম।
উনি নিজে নিজে রাগান্বিত সরে বলতে লাগলেন,
“আবরেশাম এতো বজ্জাত হয়েছে! বউ নিয়ে বিয়ে বাড়িতে ঘুরে, অথচ আমাকে কিছু জানায়নি।”
আমার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন,
“আচ্ছা তোমার মা-বাবা এসেছে?”
ওহ গড। আমার মা-বাবাকে দিয়ে এখন আবার কি করবে? তাদেরকে আবার বলবে না তো, ‘আন্তরিকভাবে দুঃখিত ঝুলন্ত বেয়াইই-বেয়াইন। কিন্তু আপনার ঝাড়ুপ্রিয় কন্যাকে আমি আমার ছেলের বউ গ্রহণ করি না, না!”
আমি ভীত গলায় অতিরিক্ত সম্মান প্রদর্শন করে বললাম,
“না শাশুমা। কেউ নেই।”
উনি তৎক্ষণাৎ খুশি হয়ে গেলেন। বললেন,
“যাক ভালোই হয়েছে। তাহলে এখানেই এনাউন্স করতে পারবো তোমার আর আবরেশামের ব্যাপারে। আজকেই এখানের উপস্থিত সবাইকে তোমাদের বিয়েতে দাওয়াত দেব। পরে ধীরে সুস্থে তোমার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলা যাবে।”
শাশুড়ির এই কথা শুনে আমার পেটে ই. কুলাই ব্যকটেরিয়া নাড়া দিয়ে ওঠলো।
আমি হন্তদন্ত হয়ে বললাম,
“আসলে মা-বাবা আছে! বাহিরে কেনাকাটা করতে গিয়েছিল। আমি ভেবেছি আপনি বর্তমানে আছে কি-না জানতে চেয়েছেন।”
শাশুড়ির মুখ খানিক কালো হয়ে গেলো। বিমর্ষ গলায় বললো,
“তাহলে তো সমস্যা।”
“আপনি মা বসে বসে পরিকল্পনা করুন কিভাবে তাদের জানানো যায়। আমি আসি, হ্যাঁ?”
উনি মাথা নাড়লেন।
দরজা ভেজিয়ে ভাবলাম বাহির থেকে তালা মেরে যাই।
পরে ভাবলাম, না। আবার খোলার জন্য চিল্লাপাল্লা করে পুরো বাড়ি এক করবে। মাঝখানে বেচারা আমি অগোচরে মানুষের গালাগালি খাবো।
প্রিয়লটা যে কোথায়!
(চলবে)
#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_২৫
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
৩০.
রাতের দেড়টা কি দুটো বাজে। গায়ে হলুদের কার্যক্রম সমাপ্তি করে যে যেখানে পারে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিয়েছে। আমি ভূতের মতো পা টিপে টিপে উদ্দেশ্যহীনভাবে পুরো ঘর বিচরণ করছি।
আম্মু, মানসুরা খালা ও তার বোন অর্থাৎ ফাহাদের মা ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। একটু পর আমার শাশুড়ি মা এসে মানসুরা খালার পাশে এসে বসলেন। আমি লক্ষ্য করেছি আমার শাশুড়ি মা মানসুরা খালার আশেপাশে এলেই উনার মুখভঙ্গি অন্যরকম হয়ে যায়। খুশি খুশি ভাব ফুটে ওঠে। অনেক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের মধ্যে যেমন সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়, তাদের মধ্যে ঠিক তেমন।
আম্মু আমাকে ডাকলেন,
“এই ফাবলীহা, এদিকে আয়।”
আমি হেলেদুলে গেলাম।
“পাশে বস। ভাত খাইয়ে দেই।”
আমি ডানে বামে মাথা নাড়াই।
আম্মু চোখ পাকিয়ে বললো,
“বসতে বলেছি বস।”
আমি বসলাম। খিদে পেয়েছি, কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না। অস্থির অস্থির অনুভূত হচ্ছে।
শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে সাক্ষাত হওয়ার পর ভেবেছিলাম কিছু একটা ধামাকা হবে। আফসোস, কিছুই হলো না। সারাজীবন সেলাই মেশিন নিয়ে বসে থাকা শাবানার মতো মনে হচ্ছে এখন।
আম্মু রান্নাঘর থেকে ভাত নিয়ে এসে বসলো।
খাওয়াচ্ছে আর বকছে,
“এতো বড় মেয়ে। খাইয়ে না দিলে খাবে না। প্রতি বেলায় খাবারের অনিয়ম। নিজের শরীরটাকে দেখেছিস? চড়ুই পাখিরও তোর থেকে মাংস বেশি।”
ফাহাদের মা আমার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠলেন,
“সবসময় মায়ের হাতে খেলে চলবে? শ্বশুরবাড়ি গেলে তো নিজের হাতেই সব করতে হবে।”
আম্মু আমার মুখে খাবার দিতে গিয়ে আবার হাতটি নিয়ে গেলেন।
ফাহাদের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আপনাকে তো আর খাইয়ে দিতে বলছি না আপা। যে আমার মেয়েকে খাইয়ে দিতে পারবে, সেই ঘরেই মেয়েকে পাঠাবো।”
ফাহাদের মায়ের মুখ থমথমে হওয়ার বদলে বিস্ময় রূপ ধারণ করলো।
আম্মু আবার আমার দিকে ফিরে খাইয়ে দিতে লাগলেন।
ফাহাদের মা হাসার চেষ্টা করে বললো,
“আপা কি আমার কথায় রাগ করেছেন? আমি তো এভাবেই বললাম। সবাইকেই তো নিজের কাজ করতে হয়, ছেলে বলুন আর মেয়ে। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে ফাবলীহা তো আমাদের ঘরেই আসবে। তাকে কি আমরা আদর যত্নে রাখবো না?”
আমার বুক কেঁপে ওঠলো!
ফাহাদের মায়ের এমন প্রত্যক্ষ প্রকাশভঙ্গি ঠাহর করে আমি ধাক্কার মতো খেলাম। সঙ্গে সঙ্গে গায়ে জ্বালা ধরে গেলো।
আমার শাশুড়ি মা পাশ থেকে জিগ্যেস করলেন,
“আপনাদের ঘরে আসবে মানে?”
উনি হেসে জবাব দিলেন,
“হ্যাঁ, আপা। ফাবলীহাকে আমি ফাহাদের জন্য আনবো।”
উনার ভাবভঙ্গি দেখে বোধ হচ্ছে এখানে আমার কোনো উপস্থিতি নেই। নাকি আমাকে ছেলের বউ হিসেবে কল্পনা করে ভবিষ্যতে কতটুকু দাম দেবে তা প্রকাশ করছে?
আমার শাশুড়ি মা চিৎকার করে ওঠলেন,
“কি উল্টাপাল্টা কথা বলছেন আপনি! মাথামোটা মহিলা!”
আমরা সবাই বিস্ময় নিয়ে উনার দিকে তাকালাম।
প্রিয়ল চোখ ঘষতে ঘষতে এদিকেই আসছিল। সে তার জায়গাতেই স্থির হয়ে যায়। এরপর দ্রুত পদে এদিকে এগিয়ে এসে জিগ্যেস করে,
“কি হয়েছে?”
শাশুড়ি মা ফাহাদের মায়ের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
“এই মহিলা নাকি ফাবলীহাকে তার ছেলের বউ হিসেবে নেবে। তা-ও আবার বুক ফুলিয়ে সবার সামনে বলছে।”
ফাহাদের মা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“আপনার সমস্যা কি? বাইরের মানুষ হয়ে আমাদের কথায় নাক গলাচ্ছেন কেন?”
মানসুরা খালা তার বোনকে ধমকে ওঠলেন।
যাহ বাবা! শুরু হয়ে গেছে সিনেমার কাহিনী।
ফাহাদের মায়ের স্পর্ধা আপাতত ভুলে বসে বসে বিনোদন নেওয়া যাক। হাতে পপকর্ন, পাশে প্রিয়লের কাঁধ থাকলে আরও জমতো।
যারা যারা ঘুমাচ্ছিল, ঝিমুচ্ছিল সবাই চিৎকার চেঁচামেচি শুনে একত্রিত হয়ে যায়।
এরমধ্যে আমার মা জননী একটা উচ্চ শব্দ করলেন না।
মাথা নিচু করে ফিসফিসিয়ে আমাকে জিগ্যেস করলেন,
“তুই কি এই ছেলেকে পছন্দ করিস?”
আমি চমকে উঠে আম্মুর দিকে তাকালাম। পছন্দ তো করিনি, পছন্দ করতে হয়েছে। নাহলে আমার সুদর্শন স্বামী অন্য কোনো রমণীর কবলে পড়তো। তা আমি কিভাবে হতে দেই?
মোজাম্মেল চাচ্চু এসে মধ্যস্থতা করলেন।
“আপা, কি হয়েছে একটু খুলে বলুন। কখন থেকেই আপনি আমার স্ত্রীকে গালাগালি করে যাচ্ছেন।”
উনি চুপ করে রইলেন। আমি ভীত মুখে তাকিয়ে আছি। আশেপাশে অপরিচিত অনেকে আছে। তাদের সম্মুখে আমার আর প্রিয়লের বিয়ের কথা তুললে খোলাসা তো হবেই না, বরং ঘোলাটে হয়ে ঠেকবে।
উনি মুখ খুললেন,
“ফাবলীহাকে আমার ছেলে আবরেশামের বউ হিসেবে নিতে চাই।”
আব্বু তখন এগিয়ে এসে বললেন,
“কিন্তু আপা আমরা তো আগে থেকেই..”
আব্বুর কথা শেষ আগেই আম্মু চওড়া গলায় থামিয়ে দিলেন,
“দাঁড়াও!”
বাটিতে পানি ঢেলে হাত ধুতে ধুতে বললো,
“সবাই ভেতরের ঘরে চলুন। সেখানে কথাবার্তা হবে।”
আম্মুর বলিষ্ঠ গলার স্বর শ্রবণ করে আব্বুও প্রশ্ন করতে পারলো না। সুরসুর করে ভেতরের দিকে হাটা দিলো।
সবার শেষে আমি আর প্রিয়ল যাচ্ছি। প্রিয়ল আগে আগে এগিয়ে গেলে আমি তার হাত খামচে ধরি।
“প্রিয়ল!”
“বলো জান।”
“আম্মু যদি চটকিয়ে আমার দাঁত সব ফেলে দেয়, আপনি কি ফোকলা বউ নিয়ে সংসার করবেন?”
প্রিয়ল হেসে গলা নামিয়ে বললো,
“অবশ্যই করবো।”
“আমি মানি না। আমি আপনারগুলো ফেলে দেব। পরে ফোকলা-ফুকলি সুখের সংসার পাতবো।”
রুমে সবাই প্রবেশ করার পর মানসুরা খালা জিগ্যেস করলেন,
“আপু, এবার সব বলো তো। তুমি কি আবরেশামের জন্য ফাবলীহাকে পছন্দ করেছো?”
শাশুড়ি মা জবাবে বললেন,
“ব্যাপারটা এরকম নয়। মেয়ের অনুমতি না দিয়ে চট করে বউ বানানোর স্বপ্ন দেখে ঢাক ঢোল পিটাই না আমি।”
ফাহাদের মা ছ্যাৎ করে উঠে বললেন,
“আপনি কি বলতে চাইছেন?
আপনি বলতে চাইছেন মেয়ে এই বিয়েতে রাজি না? তার মা-বাবা রাজি না? তাদের না জানিয়েই আমি ঢাক পেটাচ্ছি?”
আম্মু জিগ্যেস বললেন,
“আপা, সবার কথা বাদ দিন। আপনি বলুন। ফাবলীহাকে আপনার পছন্দ হয়েছে?”
তখন তিনি বললেন,
“পছন্দ তো অবশ্যই আপা। ফাবলীহা ভীষণ মিষ্টি মেয়ে। কিন্তু আবরেশামের জন্য তাকে বউ করে নিতে চাওয়ার অন্য কারণ আছে।”
এরপর তিনি একে একে সব বলতে লাগলেন। বিয়ের দিনের শুরু থেকে শেষ, খুটিনাটি সকল বিষয়বস্তু।
“আপা, একটা যেহেতু সমন্ধ হয়েছেই, সেটা যেভাবেই হোক; ফাবলীহাকে আয়োজন করে বউ হিসেবে গ্রহণ করলে আমি মনে করি বিয়েটা অপাত্রে যাবে না।”
আব্বু বলে ওঠলেন,
“আমি এই সমন্ধ মানি না। আমার মেয়ে বউ হলে শুধু ফাহাদের হবে। ফাহাদকেই শুধু আমি মেয়ে জামাই হিসেবে মানি!”
মোজাম্মেল চাচ্চু গলা মিলিয়ে বললেন,
“আপনার ছেলে ওকে তালাক দেবে। শেষ! আর কোনো কথা নেই।”
প্রিয়ল তখন বললো,
“ফাহাদ যদি ফাবলীহাকে বিয়ে করতে রাজি হয়, তখন আমি তাকে তালাক দিয়ে দেব।”
ফাহাদ ছিঁচকে চোরটা কোণাতেই থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে ছিল। ফায়াজ ভাই তার মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল।
প্রিয়ল ফাহাদকে জিগ্যেস করলো,
“তুমি ফাবলীহাকে বিয়ে করবে? তুমি হ্যাঁ বললে আমি আর দ্বিতীয় কোনো কথা বলবো না।”
প্রিয়লের ঠান্ডা কণ্ঠ শুনে আমিও কেঁপে ওঠলাম। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ফাহাদ হ্যাঁ বলবে। আর এটাই হবে তার কাল।
আর সেটাই হলো।
ফাহাদ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, আমি ফাবলীহাকে বিয়ে করবো।”
আমি গা দুলিয়ে হেসে ওঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলাম আমার ডিফল্ট মুডে। মামা’স গার্ল, পাপা’স ডটার হয়ে থাকা অনেক হয়েছে।
“কিছু ছেলে আছে। প্রতিবন্ধী ছেলে। হাত-পায়ে সমস্যা থাকলে, নড়াচড়া না করতে পারলে প্রতিবন্ধী হয় না? তো সেসব ছেলেরা হয় শারীরিকভাবে নিষ্প্রাণ, নির্জীব। ফলে তাদের নষ্ট যন্ত্র নিয়ে জীবন কাটানোর জন্য প্রতিবন্ধীদের মেন্টাল বাবা-মা ফন্দি আঁটে। বন্ধুর মেয়ে, ভাবীর মেয়ে, এই বোন সেই বোনকে বাগিয়ে প্রতিবন্ধী ছেলেকে গলায় ঝুলিয়ে দিতে চায়। মান-সম্মানের ভয় আছে এমন আত্নীয় হলে বড় সুবিধা হয়।”
বলেই আমি মোজাম্মেল চাচ্চুর দিকে তাকালাম।
“আর সেসব ছেলেদের.. বাদ দিন। ডিরেক্ট বলি। আপনার ছোট ছেলে মাটিতে বসে ভাত খায়, মাটিতে বসে ঘুমায়। কেন? জান্নাতে লাফ মেরে চলে যাবে? ফুফুর সঙ্গেও চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। অথচ ভার্সিটির সরু গলিতে তার লুকায়িত বাল সুন্দর সুন্দর মেয়েরা ফেলে যায়। সত্তর হাজার দামের খাটে সে শুয় না, কিন্তু অন্য জায়গায় ভিডিও দেখে শুয়ে আসে।”
“এই মেয়ে!”
ফাহাদের মায়ের দিকে ঘুরে আঙুল উঁচিয়ে বললাম,
“মেয়ে মেয়ে বলবেন তো!”
নিজেকে শান্ত করে বললাম,
“এই মহিলা? আমার নাম নাই? এখন জনে জনে আমার বদনাম করবা? করো। তোমার ছেলে একটা থার্ড ক্লাস চাইল্ড। একটা জোচ্চুর। আর তুমি হলে এর আদর্শ মাতা।”
“ফাবলীহা!”
ফায়াজ ভাইয়া এগিয়ে এসে বললেন,
“তোমার ফাহাদ পছন্দ না-ই থাকতে পারে। মত না থাকলে সেখানে বিয়ে আমিও সমর্থন করি না। কিন্তু তাই বলে তুমি এভাবে অপমান করতে পারো না। আর আমার মা তোমার বড়।”
আমি কিছুক্ষণ ফায়াজ ভাইয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
এরপর হালকা হেসে বললাম,
“আপনার অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আপনি আপনার ভাইকে চেনেন। বন্ধ দরজার ভেতরে মোবাইল দ্বারা কি কি সংঘটিত হয় তা-ও আপনার কাছে ধরা পড়েছে। এটা দয়া করে বলবেন না, আপনার মা জানে না। উনি অন্তত ধূর্ত মহিলা। ছেলেদের প্রতি উনার তীক্ষ্ণ লক্ষ্য!”
ফায়াজ ভাইয়া থতমত খেলেন। বিব্রত ভঙ্গিতে ফাহাদের দিকে এবং তার মা-বাবার দিকে তাকালেন।
ফাহাদ মাথা নিচু করে আছে।
“শুধু অপছন্দ হলে আমি এতো কষ্ট করে মুখের বুলি নষ্ট করি না ভাই। এতটুকু বিশ্বাস রাখতে পারেন।”
আমি ফাহাদের দিকে এগিয়ে জিগ্যেস করলাম,
“আমায় বিয়ে করবে ফাহাদ ভাইয়া? কথা দিচ্ছি, তুমি হ্যাঁ বললে আমি এই মুহূর্তে তোমাকে বিয়ে করবো!”
ফাহাদ মাথা ডানে বামে নাড়লো।
মোজাম্মেল চাচ্চু রেগে গিয়ে বললেন,
“তুমি এতো বেয়াদব জানলে কখনোই তোমাকে পুত্রবধূ করার কথা ভাবতাম না। কি করেছে আমার ছেলে? বলো দেখি!”
ফায়াজ ভাইয়া বলে ওঠলেন,
“আব্বা প্লিজ! চুপ করুন।”
“চুপ করবো মানে?”
“প্লিজ! আমি চুপ করতে বলছি মানে চুপ করবেন। বেশি প্রয়োজন হলে ফাহাদকে অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করুন।”
চাচ্চু অত্যন্ত দ্বিধা নিয়ে দুই ছেলের দিকে পালা বদল করে তাকালেন। দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা গেলো আমার মা-বাবাসহ সবার মুখে।
ফায়াজ ভাইয়া বিনীত স্বরে আমার মা-বাবাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,
“আমি আমার মা-বাবার পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইছি আঙ্কেল-আন্টি। আপনারা প্লিজ কথাটা ছড়াবেন না। আমি অনুরোধ করছি। ফাহাদ খারাপ সঙ্গে মিশে ভুল পথে চলে গিয়েছে। ও ভালো হয়ে যাবে আঙ্কেল। প্লিজ, কথাটা ছড়াবেন না।”
বলেই ফায়াজ ভাইয়া চলে গেলো। তার পেছন পেছন তার মা-বাবা ও ফাহাদও গেলো।
আব্বু দ্বিধায় ভরা গলায় জিগ্যেস করলেন,
“ফায়াজ কিসের কথা বললো ফাবলীহা?”
আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,
“আমি কি জানি। তোমার বন্ধু, জিগারকা টুকরা! তোমার সঙ্গে তো সবই শেয়ার করে। তার থেকে জেনে নিও।”
আব্বু তোতলিয়ে বললেন,
“তবুও আমি এই বিয়ে মানি না। এই ছেলে আমার পছন্দ নয়।”
“ছিঃ! ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ!”
চেয়ে দেখলাম আমার শাশুড়ি বলছে।
“আপনার টেস্ট খুবই খারাপ ভাই। আমি না বলে পারছি না। কিন্তু বাধ্য হচ্ছি। যেখানে আমার ছেলেকে রিজেক্ট করছেন, সেখানে আপনাদের টেস্ট সত্যিই! অত্যন্ত দুঃখজনক টেস্ট।”
প্রিয়ল চাপা গলায় বললো,
“মা!”
“ইয়েস!”
আমি চেঁচিয়ে ওঠলাম,
“আমিও তাই বলি শাশুড়ি মা। টেস্ট অত্যন্ত খারাপ। মানে তারা মরা মুরগি কোনটা আর জেতা মুরগি কোনটা জানে না। কোনটা পঁচা ডিম, কোনটা ভালো ডিম তার পার্থক্যই জানে না।”
মানসুরা খালা হেসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। এরপর আমরা দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করলাম টেস্ট কত প্রকার হয় এবং কার টেস্ট কিরকম হওয়া বাঞ্ছনীয়।
আব্বু আম্মুর দিকে তাকিয়ে কাষ্ঠহাসি দিয়ে বললেন,
“দুটো দেখি এক জাতের। যেমন বউ, তেমন শাশুড়ি। রাজি হয়েই যাই। কি বলো?”
আম্মু মুখ শক্ত করে জবাব দিলেন,
“আমাকে বলছো কেন? আমি তো রাজিই আগে থেকে। আশ্চর্য!”
বলেই আম্মু চলে গেলো।
আব্বু প্রিয়লের দিকে দুঃখভরা চাহনি নিয়ে তাকালেন।
(চলবে)