#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_২,০৩,০৪
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
২.
কলিংবেল বাজানোর কয়েক সেকেন্ড পরেই দরজায় শব্দ হলো। ভিতর থেকে কেউ ইমাজিন ড্রাগনের বিলিভার গানের সুর আঙ্গুলের মাধ্যমে কাঠের দরজায় তুলছে। কে হতে পারে? অবশ্যই আমার জন্মদাতা পিতা। কোমড়ের নাট-বল্টু ক্ষয় করে পাঁচ তলার সিঁড়ি ভেঙে উঠে কারোরই এই নাটক সুমধুর লাগবে না। আমার বাপের দরজা খোলারও কোনো হেলদুল নেই। সুতরাং, মন চাইছে দুই সিঁড়ির রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে টপ করে নিচে পড়ে যাই। আমার বাপ থাকুক তাহার বিবির সঙ্গে।
লাফ দেব দেব করছি, এমন সময় দরজা খুলে গেলো। আম্মু চওড়া গলায় আব্বুকে ধমকে ওঠলো,
“সুখে থাকতে ভাল্লাগে না তোমার! তুমি তো কলিংবেল টিপে এক সেকেন্ডও সহ্য করতে পারো না। নিজের সময় ষোলো থেকে একেবারে বত্রিশ আনা বুঝো।”
আমি ঘরে প্রবেশ করে বললাম,
“থাক থাক, বুড়ো মানুষ। চোখে দেখে না, কানে শুনে না। মাফ করে দাও।”
আব্বু বিড়ালের মতো গুটি গুটি পায়ে সোফায় গিয়ে বসলেন।
আমিও ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোফায় গা এলিয়ে বসলাম।
“তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
আব্বুর কথা শুনে ভ্রু তুলে তাকালাম,
“ওহ, টাকা দিবে নাকি? ওই পাওনা টাকাটা, যেটা আমার ঘুমের মাঝে চুরি করে তুমি তোমার টয়লেট মেরামত করেছো? যার ফলে বাড়িওয়ালির কৃপায় এই বাড়িতে আরও দীর্ঘদিন ঠাই পেয়েছো?”
আম্মু সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় চাটি মেরে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“হয়েছিস তো ঠিক বাপটার মতো। একটা কথাও মুখ থেকে পড়ে না।”
অবসন্নতা কাটিয়ে অবাক চোখে আম্মুর দিকে তাকালাম। কথা মুখ থেকে পড়ে না বুঝলাম, কিন্তু পড়লে কিভাবে পড়ে? কোথায় পড়ে, কেন পড়ে? মাটিতে পড়লে তো কচ্ছপের মতো কান ঘষা মেরে মেরে শুনতে হবে। উপরে পড়লে বান্দরবানের বানরের মতো শূণ্যে ডিগবাজী দিয়ে শুনতে হবে। আম্মু কী টেলিপ্যাথিকে নির্দেশ করেছে? চেনা চেনা লাগে, তবুও অজানা। মনে মনে কথা, তবুও বুঝো না।
আম্মুকে প্রশ্ন করে রহস্য উদ্ঘাটনের পূর্বেই আব্বু বললো,
“তোমার মোজাম্মিল চাচ্চু কালকে আসবেন। তাই আজকে বাজার করতে যেতে হবে। তুমি লিস্ট করবে বলে তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
আমি সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুচকালাম। জিগ্যেস করলাম,
“মোজাম্মিল চাচ্চা? একা আসবেন?”
“না, তোমার চাচী আর ফাহাদ আসতে পারে। ফ্যামিলি ছাড়া একা আসবেন কেন? কয়েকদিন থাকবে তারা।”
আমার মাথার উপর দিয়ে কাক কা কা করে উড়ে গেলো। কানটা ব্যথা করছে। কানের ভিতর আলতোভাবে আঙুল ঢুকিয়ে দেখলাম, নাহ ময়লা নেই। একদম ক্রিস্টাল ক্লিয়ার।
কান ব্যথা হওয়া আমার মেজাজ খারাপের প্রথম লক্ষণ। দ্বিতীয় লক্ষণ প্রচন্ড মাথা ব্যথা। তৃতীয় লক্ষণ খানাপিনা বিসর্জন দিয়ে হয়তো সন্ন্যাসী নতুবা বাপের অন্ন ধ্বংস করে ভোজনরসিক হওয়া। চতুর্থ লক্ষণ হলো বাঙালি খালাম্মা-খালুদের বৈশিষ্ট্য বাংলা গালি অর্জনপ্রাপ্তি প্রকাশবোধ। যদিও গালি আমি একান্তভাবে মনে মনে দেই, ভদ্র মেয়ে সেটা আমার সর্বজনীন লক্ষণ যে তাই।
ওহ হ্যাঁ, মেজাজ খারাপ হওয়ার কারণ হলো ফাহাদ। মোজাম্মিল চাচ্চা না চ্যাচ্চা আমার বাপধনের অতি আদরের বন্ধু। এবং এই বন্ধুর তিনটে ছাগলছানার বড় ভাই ও দশ বছরের ছোট বোনের মধ্যে বেটে-খাটো, ভেটকি মারা ছাগলটি হলো ফাহাদ। তার গলায় আমাকে ঝুলিয়ে আর আমার কোলে তাকে বসিয়ে আমার আব্বাজান আমাদের কাপল পিক তুলতে চান। অর্থাৎ আমাদের বিবাহ সম্পন্ন করতে চান। এই খবর আমার সামনে আম্মু-আব্বু ভুলেও কখনো তুলেনি। কিন্তু আমার একটা বিশেষ গুণ আছে। ঘুমের ঘোরে অনেক অজানা রহস্য উদ্ধার করা। আমি ঘুমিয়ে থাকলে আশেপাশের মানুষ তাদের কুকীর্তি, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিকল্পনা-সিদ্ধান্ত আলোচনা করে বেড়ায়। আধো ঘুমের মধ্যে আমি খানিক শুনতে পাই। এরপর ঘণটাময় মরার ঘুমের অভিনয় করে চ্যাগাইয়া থাকলেই সব স্পষ্ট শ্রবণ করি। এটা আমার দোষ? অবশ্যই না। এটা আমার গুণ। মানুষ আমার ভান করা ঘুমকে মরার ঘুম ভেবে কানের কাছে রসের আলাপ ছাড়ে, এটা তাদের বোকামি। ফাহাদ সম্পর্কিত তথ্য আমি এভাবেই সংগ্রহ করেছি। এই ছেলের সঙ্গে আমার এখনও সাক্ষাৎ হয়নি। সাক্ষাৎ হলে জনমের শিক্ষা দিয়ে দেব। তার জন্য তুশিরার সঙ্গে বিস্তর পরিকল্পনা প্রয়োজন।
পাশে দেখি আম্মু-আব্বু তুমুল উৎসাহে ফাহাদের গলা দিয়ে কি এবং কয়টা মুরগি ভরবে তা লিস্ট করছে। আর আমি লিস্ট করছি কয়টা হাড্ডি তার বিশেষ জায়গা দিয়ে বিশেষভাবে ভরা যায়, যাতে সারাজীবন ফাকাদের ফাবলীহা নামটি মনে থাকে।
(চলবে)
#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_৩
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
৩.
“আকাশেতে লক্ষ তারা চাঁদ কিন্তু একটারে, ইয়াহ!”
দাঁত খিচিয়ে এমন ইয়াহ বলা শুনে আমি মাথা ঘুরিয়ে তুশিরার দিকে তাকালাম। এখন আমরা কোচিংয়ে আছি। মাত্র এসে বসলাম। স্যার কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন। কিন্তু আমার বান্ধবীর মনে রঙ লাগার কারণ উদ্ঘাটন করতে পারছি না।
আমি তুশিরার উদ্দেশ্যে অবাক হওয়ার ভান করে বললাম,
“আকাশে যে একটা চাঁদ তা তো জানতামই না। জানতাম তো দুইটা থাকে। একটা সূর্যের গার্লফ্রেন্ড, আরেকটা আমাদের নাহিয়ান ভাইয়ার সুন্দরী প্রেয়সী।”
তুশিরা খুশি হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে পাঁচশো চল্লিশ ভোল্ট নিয়ে হাজির হয়ে স্মাইল দিলো।
আমি আমার মাথাটা পিছনে সরিয়ে বললাম,
“আরে, প্রশংসা করছি বলে এভাবে দাঁত দেখাবি? পেঁয়াজের গন্ধ আসছে। ওয়াক ওয়াক।”
তুশিরা হাসি বন্ধ করে চোখ পাকিয়ে আমার ঘাড় চেপে ধরলো।
“তোর মতো গিরগিটির নানী কিভাবে যে আমার বান্ধবী হলো আল্লাহ জানে।”
“তোর মতো চুন্নি বেডি আর কি জানবে?”
আমাদের এই ঝগড়া-ঝাটির মাঝে দরজা ঠেলে রিজওয়ান ভিতরে ঢুকলো। গুন গুন করতে করতে পাশ দিয়ে হেঁটে ছেলেদের সারিতে গিয়ে বসলো।
আমি তুশিরাকে কাঁধ দ্বারা মৃদু ধাক্কা মেরে বললাম,
“দেখছিস? বাদরের লাল নিতম্ব আমাদের পাশে এসেই গুন গুন করছিলো। অসভ্য কোথাকার!”
তুশিরা বিহ্বলতা নিয়ে আমার দিকে তাকালো। জিগ্যেস করলো,
“বাদরের লাল কি? পাছা? এখানে বাদর কই পেলি তুই?”
আমি চুপ হয়ে তুশিরার দিকে তাকালাম। এক বাদরের কথা বলতে গিয়ে আরেক বাদর আবিষ্কার করে ফেলেছি দেখছি। নাহিয়ানের মতো বুদ্ধিমান, গুছানো, শান্তশিষ্ট একটা ছেলে এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুকে কিভাবে গার্লফ্রেন্ড বানালো? আসলেই বানিয়েছে নাকি জরিনা বেওয়ার পানি পড়া খাইয়ে হয়েছে কে জানে।
তুশিরা সন্দিহান গলায় বললো,
“তুই আমাকে এভাবে কি দেখছিস? মনে মনে গালাগালি করিস নাকি?”
আমি তাকে জিহ্বা দেখিয়ে বললাম,
“চুপ থাক।”
সামনে থেকে ইলা উঠে এলো। আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,
“এই ফাবলীহা, তুই আর রিজওয়ান নাকি পরশু ডেইটে গিয়েছিলি?”
আমি ইলার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালাম। তৎক্ষণাৎ কিছু বললাম না। এ হলো আরেক ছাগলের জাত। পাবনার চাটমোহরের ছাগল। রিজওয়ান আর ইলা অনেক ভালো বন্ধু। দুজনের কোচিংয়ে আসার প্রধান উদ্দেশ্য একে নিয়ে তাকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা করা। এতোটাই থার্ড ক্লাস স্বভাব।
আমি মুখের অভিব্যক্তি পরিবর্তন করে জোরেসোরেই বললাম,
“ছিঃ! মানুষের সাথে ডেইট করতে না গিয়ে আমি এই হাতির সাথে ডেইট করতে যাবো? হাতির দাঁত ভেঙে বিক্রি করে বড়লোক হওয়ার আমার কোনো পরিকল্পনা নেই। এই বিশালাকার পাহাড় কোনো অস্ট্রেলিয়ান গরুর সাথেই যায় বুঝলি। আমি কিন্তু আবার কোনো রেসিস্ট না ভাই।”
আমার পিছনের সারির বড় আপুরা আমার কথা শুনে হি হি করে হাসতে থাকলো। তুশিরা তো পারলে চেয়ার থেকে উঠে মেঝেতে গড়াগড়ি করে হাসে।
আমি আসলেই রেসিস্ট না। কিন্তু স্বভাব-চরিত্র খারাপ হলে সে কালো, ভোটকা, বদমাশ এককথায় জঙ্গলের কীটপতঙ্গ।
স্যার এসে প্রবেশ করলেন। বড় আপুদের হাসতে দেখে স্যার জিগ্যেস করলেন,
“কি ব্যাপার? একেকজন দেখি হাসতে হাসতে কুপোকাত।”
নায়লা আপু জবাবে বললো,
“স্যার আজকে কোচিংয়ে অস্ট্রেলিয়ান গরু প্রবেশ করেছে তাই হাসছি।”
আপুর কথা শুনে সবাই সশব্দে হেসে ওঠলো। আমি আড়চোখে রিজওয়ানের দিকে তাকালাম। তার কৃষ্ণবর্ণ চেহারাটা অমাবস্যার রূপ ধারণ করেছে। এইবারে যদি এই ছেলের শিক্ষা না হয়, তবে একে আমি জুতো পিটা করে শায়েস্তা করবো। যেমন গরু, তেমন ইনজেকশন। এরমধ্যে আমার নতুন উন্মোচিত প্রেমিকের কথা মনে পড়ে গেলো। তুশিরার সঙ্গে আজকেই তোড়জোড় পরিকল্পনা করতে হবে।
কোচিং শেষে ফুটপাত ধরে হাঁটছি আর তুশিরাকে আমার দুঃখভরা জীবনের উপাখ্যান শুনাচ্ছি।
“তুই জানিস না দোস্ত, দুনিয়ার বাটপার একটা ছেলে। বরিশাইল্লা আর কি হবে। উপরে জোব্বা নিচ দিয়ে পোঁকা ধরা। পুরাই মাকাল ফল।”
তুশিরা মুখে চানাচুর পুরতে পুরতে জানতে চাইলো,
“দেখতে কেমন সেটা বল।”
“আমি কি জানি ওই রাম ছাগল দেখতে কেমন। কেমন ধূর্ত দেখ! বাপ-মাকে বাসায় পাঠিয়ে ওই ছেলে সঙ্গে সঙ্গে এলো না। নীলক্ষেত কি কাজ নাকি আছে। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করবে বলেছে। আমি নিশ্চিত, এই ছেলে নিশ্চয়ই ইডেন কলেজের সামনে বোরকা পরে বসে আছে। শালা মেয়েবাজ!”
“আরে, না দেখেই একটা মানুষ সম্পর্কে এভাবে বলবি? হতেও তো পারে তাকে দেখে তোর দেখে পছন্দ হয়ে গেলো, কথাবার্তা বলার পর আগ্রহ কাজ করলো। হতে পারে না?”
তুশিরার কথা শুনে আমি আঁতকে ওঠলাম। ঢাকা ব্যতীত আমি কোথাও বিয়ে বসবো না। ভাঙ্গা-মাওয়া ব্রিজ পাড়ি দিয়ে আমি সুদূর বরিশাল সংসার পাততে পারবো না। আল্লাহ সহায় হও।
তবুও আমি ভাবছিলাম। ছেলে কী এতোই ভালো হতে পারে যার জন্য আমার মতামতই পরিবর্তিত হতে পারে?
তুশিরাকে বিদায় দিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে পা চালালাম। বাসার গেইটের থেকে খানিক দূরে থাকতেই হাঁটা থামিয়ে দাঁড়ালাম। হ্যাঙলা পাতলা, শ্যামবর্ণ একটা ছেলে টিশার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তার ফোন। পরক্ষণেই কানের সংস্পর্শে এনে কারও সঙ্গে কথা বলতে লাগলো। আমার অন্তর আত্মা অক্ষিগোলক ঘুরিয়ে ছেলেটি পর্যবেক্ষণ করে বললো,
“ফাবলীহারে এটাই তোর ফাকাদ। এবার কাবি খুশি কাবি গামের মতো দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়। তোর ভবিষ্যৎ বলে কথা।”
আমি লিকুইড নেওয়া মনের প্ররোচনায় পা দিয়ে দৌঁড়ে গেলাম না। লিকুইড হলো– আসার সময় লাচ্ছির বোতলে একই স্ট্র দিয়ে আমি আর তুশিরা লাচ্ছি খেয়েছি। এভাবে আমার বান্ধবী আমাদের মধ্যে ভালোবাসার ব্যাকটেরিয়া আদান-প্রদান করায় বিশ্বাসী।
আমি সামনে তাকালাম। এই ছেলেকে তো দিন-রাত গ্যাস দিয়ে ফুলিয়ে প্রাণ অভ্যন্তরে সঞ্চিত রাখতে হবে। আমি একটা পাদ দিলেই তো দুনিয়া ছেড়ে মহাশূন্যে স্যাটেলাইটের মতো ঘুরতে থাকবে। ছেলেটাকে দেখে মায়া লাগলো। আমার যদি কোনো ঢাকাইয়া ছেলের সাথে বিয়ে হয় তাহলে আমি এই ফাকাদকে প্রধান সাক্ষী হিসেবে রাখবো। সঙ্গে এক কার্টুন ভিটামিনের ঔষধ উপহার দেব।
আমি কাউকে চিনি না, কিছু দেখিনি এমন ভাব ধরে স্মৃতিভ্রষ্ট ওমর সানী ও আন্ধা সালমান শাহের মতো গেইটের ভিতরে প্রবেশ করলাম। পিছনে থেকে চিকন গলায় কেউ ডাকলো তখন,
“এই যে শুনছেন।”
তাকিয়ে দেখলাম ওই ছেলেটা, আশা করছি ফাহাদই সে।
আমি স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলাম,
“জি, শুনছি।”
ছেলেটি লাজুক হেসে জিগ্যেস করলো,
“আপনি ফাবলীহা তাই না?”
আমি তখন নিশ্চিত হলাম, এই বেডা মানুষটিই তবে আমার বাপের ঠিক করা আমার কিডনির অসুখ। কিন্তু এভাবে লজ্জা পাচ্ছে কেন? কেউ কী চুমা দিয়েছে? দারোয়ান আঙ্কেল তার খুপরির দরজা খুলেই বিছানার উপর ঝিমুচ্ছে। দরজার সামনে বাড়িওয়ালার কুকুরটি আবেদনময়ী ভঙ্গিতে লেজ নাচাচ্ছে, পা নাড়াচ্ছে। এ তো নিশ্চয়ই এই চিকনা পুঁটি মাছের দিকে নজর দেবে না। আমি খানিক মাথা ঝুঁকিয়ে চোখ ছোটো ছোটো করে কুকুরটিকে পর্যবেক্ষণ করলাম। ওহ, আচ্ছা। দিতেও পারে, মেয়ে জেন্ডারই তো।
ফাহাদ এবার চিন্তিত গলায় আমাকে ডেকে ওঠলো,
“আপনি কী আমার সঙ্গে কথা বলতে বিরক্ত বোধ করছেন?”
আহা, কি আলাভোলা উক্তি। আসলেই কি এমন? খুন্তি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অভ্যন্তরীণ সত্তা বের করতে হবে।
আমি মিষ্টি হেসে বললাম,
“জি, আমি ফাবলীহা। আপনি নিশ্চয়ই বাড়িওয়ালা আন্টির চাচাতো বোনের খালাতো ভাইয়ের নানীর একমাত্র এতিম নাতি? আম্মু কাজের লোকের জন্য আন্টিকে বলেছিলো। আপনি আসুন, পাঁচতলায় আমাদের ফ্ল্যাটে আসুন। যাবতীয় কাজ, বেতন আম্মুর সঙ্গে আলোচনা করুন।”
বলেই আমি হাঁটা দিলাম।
পিছনে তাকিয়ে দেখলাম ফাকাদ ভ্যাবাচ্যাকা মুখভঙ্গি নিয়ে মাথা চুলকাচ্ছে।
আমি তাকে ডাকলাম,
“কি হলো কামলা ভাই, আসুন কামলা ভাই। কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব করবেন না। পুরুষ কাজের লোকদের আমাদের ঘরে ডান্ডা দিয়ে অনেক সম্মান দেওয়া হয়। আসুন কামলা ভাই।”
(চলবে)
#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_৪
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
৪.
কলেজে গিয়ে দেখি তুশিরা একজনের সঙ্গে ক্যান্টিনে বসে ভেটকা-ভেটকি করছে। হি হি, হে হে করেই যাচ্ছে। আমি কাছে যেতেই তুশিরা হাত তুলে বললো,
“হেই দোস্তো।”
বলেই পাশের ব্যক্তিটির সঙ্গে কোনো কথা নিয়ে হাসিতে মেতে ওঠলো। আমি তাদের হাসি শুনে চোখ গরম করে তাকালাম।
জামার দুটো বোতাম খোলা, গলায় গুন্ডাদের মতো আইডি কার্ড ঝুলানো একটা মেয়ের সঙ্গে তুশিরা রঙ-ঢঙ শুরু করেছে। মেয়েটাকে আগে কখনো নজরে পড়েনি। সোল্ডার ব্যাচে সি সেকশন লেখা। অর্থাৎ আমাদের ক্লাসেরই ছাত্রী। নতুন হবে বোধহয়, তাই-ই আগে দেখিনি। আমার এখন ইচ্ছে করছে তুশিরাকে শূণ্যে তুলে আছাড় মারি। অকৃতজ্ঞ, কা-মহিলা। নতুন মানুষ পেয়ে আমাকে ভুলে গেছে। আমি তাদের থেকে খানিক দূরত্ব বজায় রেখে একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম।
তুশিরা আমাকে ডেকে বললো,
“দোস্ত এই হলো আমার দূর সম্পর্কের কাজিন। কাজিন নাকি আন্টি সঠিক বলতে পারছি না। নাম ধরেই ডাকি। আমাদের কলেজে নতুন এসে ভর্তি হয়েছে।”
মেয়েটা হাত তুলে তুশিরাকে থামিয়ে বললো,
“দাঁড়া, বাকিটা আমি কই। আমার নাম চাঁদনী, দেখতে যদিও কালনী। হোস্টেলে উঠেছি। আর তুই ফাবলীহা আমি জানি। তুই অত্যধিক সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও যে তোর চৈত্রের খড়ার কপালে পিড়িত নাই সেটাও আমি জানি। আর কি জানতে চাস ক।”
এক নিশ্বাসে মেয়েটি কথা বলে থামলো। আমার উত্তরের সে এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না।
মেয়েটাকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম। সে উঠে গিয়ে ছেলেদের বড় করে সালাম দিচ্ছে,
“আসসালামুআলাইকুম ভাই, ভালো আছেন?”
ছেলেরাও আমোদিত হয়ে আহ্লাদিত গলায় জবাব দিচ্ছে। ছোট ক্লাসের গার্ডিয়ানদের সঙ্গেও দেখছি নিমিষেই ভাব জমাচ্ছে। পরিবর্তে পাচ্ছে গাল ভরা চুমু।
ব্যতিক্রম ঘটলো এক জায়গায় গিয়ে। পাশের টেবিলে বসে জিরাফের মতো মাথা উঁচিয়ে হাউ-কাউ করা আন্টি মহলে সে গিয়ে প্রবেশ করলো।
একটা আন্টির কাঁধে হাত রেখে বললো,
“ভালো আছেন কাকী? তো আপনার সাংসারিক কি সমস্যা? কাকা টাকা-পয়সা আপনাকে না দিয়ে বোনদের দেয়? শুনে দুঃখ লাগলো। আপনি এতো অসহায় যে একটা বোরকাও পিনতে পারেন না। ভুড়ি-চর্বি সব বাইর হওয়া মানুষরে হাই দিতাছে।”
মেয়েটি ঝুঁকে ফিসফিসের মত অভিনয় করে গলা ফাটিয়ে বললো,
“আপনাকে বোধহয় আন্ডার পেপারের ট্যাকাও দেয় না। সব দেহা যায়। এই নেন আমি ট্যাকা দিলাম।”
চাঁদনীর গলা ফাটানো কথা বুঝি দূরে অবস্থান করা ছেলেরাও শুনতে পেলো। সবার মাঝে হাসির রোল পড়ে গেলো।
চাঁদনী পায়জামার পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকা বের করে মহিলাটির হাতে গুঁজে দিলো। বললো,
“এই ট্যাকায় নিউ মার্কেটের সামনে ফুটপাতে ভালো মানের পাইবেন।”
পাশে বসা আরেকজন মহিলা রাগান্বিত হয়ে বললো,
“এই বেয়াদব মেয়ে! তোর শিক্ষা দীক্ষা নাই? বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানিস না?”
মেয়েটি বিগলিত হেসে পাশের মহিলাটির কাছে গেলো। টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে বললো,
“কি ব্যাপার আন্টি? ভিতরে এভাবে কারেন্ট উঠছে কেন? ওই আন্টিরে এভাবে আধা কাপড়ে দেখতে ভালা লাগে? মাইয়া হইয়া মাইয়াগো লগে পরকীয়া করেন?”
“এই মেয়ে..”
আরেকটা আন্টি কিছু বলতে গেলে চাঁদনী ধমকে ওঠলো,
“এই চুপ! কথা শেষ হইছে আমার!”
পূর্ব মহিলাটির দিকে আবার ফিরে বলতে লাগলো,
“তো আন্টি আজকে আপনার কোন ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে আসছেন কলেজে? কোনটারে পছন্দ হইছে?”
“এই ছেড়ি!”
মহিলাটি চিৎকার করে দাঁড়াতে গেলে মেয়েটি কাঁধ চেপে বসিয়ে দিতে দিতে বলে,
“কলেজের ছাত্রীদের উপর নজর রেখে ভাড়া করে তুলে নিয়ে যাস শালী! ভাতার রাখিস ভাতার? এইজন্যই তো তোর জামাই অন্য বেডিগো কাছে যায়। কারেন্ট মধ্যমা আঙ্গুল দিয়ে খাওয়ায় দেব ঠিক।”
চাঁদনী ধমকা-ধমকি ঠাহর করে আশেপাশের ছাত্র-ছাত্রী এসে জড়ো হতে লাগলো।
কয়েকটা মেয়েদের দল থেকে একজন বলে ওঠলো,
“এই মহিলাকে আমিও দেখেছি মেয়েদের ধরে ধরে খোঁজখবর নেয়, বাড়ির ফোন-ঠিকানা জোর করে নেয়। আমার একটা বান্ধবীর বাসায় গিয়েও বিয়ে দেওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে অনেক ঝামেলা করেছে।”
কয়েকজন বলতে লাগলো,
“ছিঃ, এতো খারাপ এই মহিলা.. মেয়েদের তো কলেজেও কোনো নিরাপত্তা নেই.. কার কার সর্বনাশ করেছে কে জানে…”
চাঁদনী হাত উঁচিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
“তোমরা সবাই ব্যবস্থা নাও। এই মহিলার সঙ্গে এর সাঙ্গো-পাঙ্গোদেরও ধরো।”
আন্টির দল পুরো হতভম্ব।
এই মহিলাকে আগেও আমি দেখেছি ঘটকালি করতে। একজন স্টুডেন্টের মা। কিন্তু কলেজে এসে উনার আত্নীয়-স্বজনদের বংশবৃদ্ধির জন্য উৎস খুঁজে। আজ চাঁদনী না ধরলে আমিই একদিন ধরে ছ্যাঁচা দিতাম।
মেয়েগুলো উঠে ওই মহিলাদের ঘিরে ধরে। ছোটোখাটো একটা জটলা সৃষ্টি হয়ে যায়। কলেজ গেইট থেকে দারোয়ান তা দেখে ক্যান্টিনে দৌঁড়ে আসে।
“এই অসভ্য মহিলাকে সবাই ধরে লাথি-উস্টা মার। সবগুলোকেই মার। আর কখনো যেন এখানে না আসে।”
চাঁদনী বলতেই টানাটানি করে ধরে সবাই প্রিন্সিপালের কাছে গেলো।
আরেকজন মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বলছেন,
“আমি এই মহিলার সঙ্গে নাই আম্মুরা। আমি চুপচাপ বসে থাকতাম। ভয়ে কিছু বলতাম না আম্মুরা।”
চাঁদনী তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলো। পাশ দিয়ে একটা ছেলে যাচ্ছিল। চাঁদনী হঠাৎ তাকে খপ করে ধরে বসে।
“এই ছেড়া, কিয়ে পড়ছ তুই?”
ছেলেটি হতচকিত হয়ে উত্তর দিলো,
“ইলেভেনে।”
চাঁদনী অবাক হয়ে দুই গালে হাত দিয়ে জিগ্যেস করলো,
“কি কইলি? ইলেভেনে?”
ছেলেটির গাল টেনে বললো,
“এই তোরে কেডারে কলেজে উঠতে দিছে। এখনও দেখতে ফিডার খাওয়া ছুইটকাদের মতো। ফিডার খাস তুই?”
“না আপু।”
“এই তুই আমারে আপু কইলি কেরে? ব্যাচ দেখছ না? তোর সমবয়সী। তুই কইরা ডাকবি।”
ছেলেটির মুখ বিস্ময়ে বিহ্বল। উল্টো ঘুরে দৌঁড় লাগাতে যাবে, চাঁদনী তখনও ছোট্ট দেহের বেচারাকে বল ক্যাচ ধরার মতো ধরে ফেললো।
“কই যাস? পছন্দ হয় নাই আমারে? এই আমি কী তোরে বিয়া করতে কইছি যে ডরাস?”
ছেলেটির ছোট্ট দেহটি চাঁদনী বগলদাবা করে দোকানে নিয়ে গেলো। সেখান থেকে দুটো কোক কিনে তাকে নিয়ে খেতে শুরু করলো। আর কি হাসাহাসি! ছেলেটিও এখন হাসছে। আর আমি আবেগে আপ্লুত। এই শুল্কপক্ষের চাঁদ এতোদিন কিসের চিপায় মুখ ডুবিয়ে ছিলো? আগে কেন দেখা হলো না? কি চমৎকার একটা মেয়ে। মুহূর্তে সবাইকে কাচির মতো কাট কাট করে সাইজে নিয়ে আসে। এই মেয়েই পারবে ফাকাদ ও তার পরিবারকে আলুর চাপ বানিয়ে আমাকে রক্ষা করতে।
ছেলেটিকে বিদায় দিয়ে সে এদিকে এগিয়ে আসলে আমি ক্যাঙ্গারুর মতো দুটো লাফ দিয়ে তার বাহুতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সে-ও আমাকে গলায় ঝুলাতে ঝুলাতে চেয়ারে এসে বসলো।
“তুই এতোদিন কই ছিলি আমার চাঁদ?”
ও লাজুক হেসে জিগ্যেস করলো,
“পছন্দ হয়েছে?”
আমিও লাজুক ভঙ্গিতে বললাম,
“হুম হুম।”
পছন্দ হওয়ার কারণ হিসেবে সে আমার ভাইয়ের কথা জিগ্যেস করলো,
“তোর ভাই কি করে?”
“আপাতত কিছু করে না। শুধু বর্তমানে একটা বউ খুঁজছে রোমান্স করার জন্য।”
“যাহ দুষ্টু।”
বলেই মুখ ঢাকলো।
আমি আর তুশিরা একসঙ্গে খিলখিল করে হেসে ওঠলাম।
(চলবে)