#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_১০,১১
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
১০
১২.
ফাক-আদ ও তাহার মাতাপিতা সেদিনই চলে গেছে, যেদিন আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম। এক ঝামেলা থেকে মুক্তিলাভ করতে গিয়ে এমন একটা অঘটন ঘটে গেলো।
বিছানায় পা ছড়িয়ে চুপচাপ বসে আছি। আজকে কলেজ নেই। ফাহাদ নামক আপদ তার পরিবার সহিত বিদায় নিয়েছে এক সপ্তাহ হয়েছে। এই এক সপ্তাহ একদমই ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। সর্বক্ষণ পাখা ভাঙা পিপীলিকার মতো ঝটপট করেছি। এটা অবশ্যই ওই ফাকাদের জন্য নয়। এই অদু ভাই ব্যতীতও আমার চিন্তিত হওয়ার হাজারো কারণ নিহিত আছে।
আমি চিন্তায় বিহ্বল ছিলাম আমার সদ্য প্রাপ্ত বর ও তার বন্ধুবান্ধবদের দৌঁড়ানি খাওয়া ঘটনা নিয়ে। এক সপ্তাহ সারাক্ষণই মনে হতো এই বুঝি সে এলো। রাস্তায় বেরোলে পিছন থেকে আমাকে ঝাপ্পি মেরে ধরবে, কলেজ গেলে আমাকে পাঁজাকোলে নিয়ে উড়ন্ত প্রজাপতির মতো ঘুরবে কিংবা সোজা আমার বাসায় এসে আমার বাবাকে হুমকি মেরে বলবে, ‘শ্বশুর সাহেব, আমি বড়লোক হতে পারি। কিন্তু বউ ব্যতীত আমি গরীব। এই গরীবের ঘরে সবুজ বাতি আমি আমার হীরার টুকরো বউকে নিয়ে গিয়ে জ্বালাবো।’
কিন্তু সে আসেনি। বউ ছাড়া এতিমের ঘরে প্রবেশ করে তার ঘর আর প্রাচুর্যতায় পরিপূর্ণ করতেও পারলাম না, সবুজ বাতিও জ্বালাতে পারলাম না। আর এদিকে আমার জীবনে সবুজ বাতি তো দূর, হলুদ বাতিও নেই। লাল ফড়িংয়ের মতো পশ্চাদ্দেশে ঝুলানো এত্তো বড় লাল বাতি। সেই লাল বাতির দমকে টংয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে বিয়াত্তা হয়ে যাই, বান্ধবীরা বিয়ের মাংস খাওয়ার জন্য মুখ দিয়ে নাল ফেলে দেয়। কি এক পাপিষ্ঠ জীবন!
আচ্ছা, তার কি আমার কথা মনে পড়ে না? জীবনে যখন সত্যিকারের বিয়ে করবে তখন কি মনে পড়বে তার কয়েক ঘণ্টার জন্য একখান সুন্দরী বউ ছিল? যে দৌঁড়ানি খেয়ে আতা গাছের তোতাপাখি হয়ে গেছে। ডালিম গাছে মউ থাকলেও সে তার বিবাহিত বরকে পেলো না। মনে কি পড়বে?
আমি সজোরে ডানে-বামে মাথা ঝাঁকালাম। আর কতো ওভারথিংকিং করবো খোদা, আর কত! আচ্ছা, ওর কি আমার নাম মনে আছে? ওর নামটা তো এখনও জানি না। তার নাকের ডগায় একটা তিল দেখেছিলাম। ওটা সত্যি তিল ছিল তো।
আবার! ইয়া খোদা।
এক সপ্তাহ ধরে কোনো খাবার খেতে পারছি না। কোনো খাবারেই রুচি জাগে না। আম্মু আজকে মুরগির মাংস রান্না করেছে। তা-ও আবার আলু ছাড়া, শুধু রসুন-পেঁয়াজ বাটা ঠেসে দিয়ে। মুরগির গন্ধ পেয়ে যা-ই একটু খাওয়ার ইচ্ছে জেগেছিল, তা জানালা দিয়ে পালিয়ে গেলো।
আমার নাক কুঁচকানো দেখে আম্মু চোখ পাকিয়ে তাকালো।
বিয়ে হয়েছে বলে সোয়ামীর আদর বিহীন খাবারে সাধ জাগে না। আর আমার মা ভাবছে মুরগিতে আলু দেয়নি বলে আমার এমন সন্ন্যাসী শিষ্যদের মতো অবস্থা। এরপর জ্ঞান দিতে লাগলো। সবকিছু খেয়ে শিখতে হয়, শ্বশুরবাড়ি এই হতে পারে সেই হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি তখন উল্টো বললাম,
“আমার বড়লোকী মা আশি টাকার রসুন খাইয়ে অভ্যাস করার জন্য বলে। যেখানে আমি বিশ টাকা কেজি ভোটকা ভোটকা আলু খেয়ে অভ্যস্ত।”
আব্বু একটু পরপর বাটি হাতে আমাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। এবার এলো বাটি ভর্তি মুড়ি নিয়ে। নিজে খেতে খেতে আমাকে জিগ্যেস করলো,
“খাবে?”
আমি মুখ যথারীতি কালো করে জবাব দিলাম,
“জি, না।”
একটু পর আপেল নিয়ে এসে আবার সাধলো। আমি চোখ পাকিয়ে বললাম,
“জি, নট। এবার আমার রুম থেকে বিদায় হও। গেট লস্ট।”
আব্বু মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গিয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করলো। রান্নাঘরে তখন আম্মু কাজ করছে। গলা চওড়া করে আম্মুকে বললো,
“শুনেছো তোমার মেয়ে কি বলেছে? আমাকে বলে গেট আউট। কত বড় বেয়াদব হয়েছে দেখেছো?”
প্রত্যুত্তরে আম্মুর ঝাঁড়ি মারার গলা শোনা গেল,
“চুপ করো তো। এখান থেকে যাও। রান্না করছি দেখছো না? তোমার প্যানপ্যানের জন্য পরে লবণ দিতে গিয়ে চিনি দেব, আদা দিতে গিয়ে জিরা দেব। যাও যাও, বের হও। আর হলো তোমার এক নবাবী মেয়ে। পেঁয়াজ কুচি দিলে তরকারি খাবে না, আলু না দিলে মুরগি খাবে না। নবাবের জন্য এখন রাঁধো আরেক দফা!”
কিছুক্ষণ অবধি আব্বুর কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেলো না। বেচারা নিশ্চয়ই দুই জায়গা থেকে প্রত্যাখান পেয়ে ব্যথায় বিমর্ষ।
আব্বু হতাশার সঙ্গে বললো,
“আরে। মা-মেয়ে দুজনই পাষাণ। আমার বাড়ি, আমার ঘর এরপরও দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। মানবতা আজ মাটির তলায়।”
আমি আমার রুম থেকে চেঁচিয়ে বললাম,
“মাটির তলায় আগে ছিল। এরপর এনাব্যানা ব্যাকটেরিয়া খেয়ে ফেলেছে। তাই এখন আর নেই।”
আব্বু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে আমার রুমে এসে বসলো।
বিছানায় কালো রঙের একটা ছোট পোকা ঘোরাঘুরি করছিল। আব্বু হন্তদন্ত হয়ে একটা বই দিয়ে সেটাকে মারার চেষ্টা করলো। কয়েকবার বারি দিতে পোকাটি ফ্যানের বাতাসে নিচে পড়ে গেলো।
আমি তা দেখে আহত গলায় বললাম,
“দেখেছো? তোমার অত্যাচারে বেচারা পোকাও লাফ দিয়ে আত্নহত্যা করে। আর তুমি অন্য মানুষের কাছ থেকে মানবিকতা খুঁজো।”
“এটা কি পোকা জানো? গান্ধীপোকা।”
“ওই যে পাদ দেয়?”
“হ্যাঁ, গায়ে যেখানে বসে সেই জায়গা জ্বলে যায়।”
“পাদের এতো তেজ! অবশ্য তোমাকে দিলে তো কিছু হতো না। তোমার গোসল না করার গন্ধ আর গান্ধীর পাদের গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে নতুন সুগন্ধী সৃষ্টি করতো।”
আব্বু চোখ পাকিয়ে তাকালো। বিড়বিড় করে বললো,
“বেয়াদব লারকি।”
পরক্ষণে চোখ ছোটো করে হাত নাড়াতে নাড়াতে কিছু ভাবলো। এরপর বললো,
“তুমি কয়দিন কলেজ থেকে ছুটি নাও।”
আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম,
“কেন?”
আব্বু কাঁচুমাচু করে বললো,
“কত পড়াশোনা করো। একটু রিফ্রেশমেন্ট তো প্রয়োজন।”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
“তো রিফ্রেশমেন্ট কি আম্মুর সঙ্গে রান্নাঘরে সিংকের তলায় বসে নিতে বলছো?”
আব্বু অধৈর্য গলায় বললো,
“এই মেয়েটা.. ফাহাদের বড় ভাই ফায়াজের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। যেকোনো সময় কথা পাকা হয়ে যাবে।দশ-পনেরো দিনের জন্য যেতে হবে। যেতেই হবে। না গেলে তোমার চাচ্চু তো রাগ করবেন। তাই দুই সপ্তাহের জন্য কলেজ থেকে ছুটি দাও।”
বিয়ের কথা শুনে আমি বসা থেকে ওঠলাম। আহারে মরার বিয়ে। কারো বিয়ে দশ মিনিটে হয়ে যায়, আর কারো বিয়ে দশ দিনেও শেষ হয় না। বিয়ে হবে কোনো সমস্যা নেই, সমস্যা হলো ওই ফাকাদকে আবার দেখতে হবে।
আব্বুকে বললাম,
“আগে বিয়ে ঠিক হতে দাও। এরপর বলো।”
আব্বু বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো,
“তোমাকে তো এক মাস আগে থেকে বলে বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। বিশিষ্ট প্রধানমন্ত্রী ফাবলীহা, হুহ।”
এরপর সারাদিন বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে বিকেলে কোচিংয়ের উদ্দেশ্যে তৈরি হয়ে নিলাম। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলাম তুশিরা মেসেজ দিয়েছে।
“কোচিং কখন আসবি?”
আমি উত্তর দিলাম,
“দোস্ত আমি কল্পনা করছি। বিশাল তুফান ওঠেছে। তাই আজ আর কোচিংয়ে যেতে হবে না।”
“তুফান কই, তোর মনে?”
“আকাশে।”
“চুল ওঠবে। ঠ্যাডা পড়া রোদ। আরেকজন আসছে তুফান ওঠাতে।”
আমি অবাক হওয়ার ভান করে উত্তর দিলাম,
“আমাকে যে বাতাসের ঝাঁপটা ঘরের মধ্যেই পলিথিনের মতো উড়াচ্ছে। তবে কি তা বাংলাদেশের বাতাস না? রূপ নগরের বাতাস?”
“হ্যাঁ, ওটা তোমার ভূতলোকের বাতাস। তাড়াতাড়ি আয় এবার।”
কেউই আমার রূপকে পাত্তা দিচ্ছে না, আশ্চর্য! দুঃখ-কষ্টে পরিপূর্ণ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে হেলেদুলে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামলাম। গেটের বাহিরে দুই পা বের করে দাঁড়াতেই আমার মাথাটা চক্কর মেরে ওঠলো। বাতাসে উড়ে উড়ে রূপ নগরের রাজপুত্র চলে এলো নাকি! তবে কি সত্যিই আকাশের তুফান আমার মনে ওঠেছিল?
কনুই ভাজ করে ফর্সা, লম্বা দেখতে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। ঘর্মাক্ত দেহে ছাই রঙের শার্টটি ল্যাপ্টে আছে। ফলে তার দেহায়ব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। পেশীবহুল হৃষ্টপুষ্ট লোকটি ভাবলেশশূন্য দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার দিকেই তাকিয়ে আছে কি? আমি গেইটের কোণায় লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরার দিকে তাকালাম। এরপর উঁকি দিয়ে দারোয়ান আঙ্কেলের ঘরটা দেখার চেষ্টা করলাম। দরজা তালাবদ্ধ। অর্থাৎ আঙ্কেল নেই। তখন খুব কাছে কারও উপস্থিতি লক্ষ্য করলাম। সামনে তাকিয়ে দেখলাম লোকটি আমার ঠিক নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে আছে। আয় হায়, এখন আমার কি হবে! আব্বু যদি জানতে পারে কলেজ গিয়ে জামাই জুটিয়ে এসেছি, আমাকে তো গলায় গামছা বেঁধে কারখানায় কাজে লাগিয়ে দেবে। সেটা সমস্যা না। কিন্তু আম্মু খুব মারবে। এতোদিন অবধি মারের দাগ এখনও শরীরে ডিজাইন করা আছে। ভবিষ্যতে জামাইকে এই ট্যাটু কিভাবে দেখাবো সেই চিন্তাতেই আমার ঘুম আসে না।
লোকটি আমার হাত চেপে ধরলো। আমি ভীষণভাবে চমকে ওঠলাম। এরপর আমার হাতের তালু তার বুকে ঠেকালো। আশেপাশে আর কোনো লোকজনও নেই। কিছুক্ষণ পরপর শুধু কয়েটা রিকশা আর অটো যাওয়া-আসা করছে। সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার নাম উচ্চারণ করলো,
“ফাবলীহা..”
আমার তার চোখের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। হাত সরানোর জন্য মস্তিষ্ক তাড়া দিচ্ছে। মন বলছে আরেকটু থাকুক। আরেকটু বুকের উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করুক। হঠাৎ করেই আমার বুক ধকধক করতে শুরু করলো। কি হচ্ছে এসব!
লোকটি খানিক ঝুঁকে আমার দিকে এগিয়ে এলো। অনুচ্চ কণ্ঠে বললো,
“বিয়ে করে এভাবে বরকে ফেলে পালিয়ে আসা বড় অন্যায়। আমি কিন্তু তোমার নামে কেস করতে পারি। তুমি এরকম দায়িত্বহীন হলেও আমি হতে পারিনি। তাই বউয়ের বাসায় বউকে নিতে এলাম।”
তার তপ্ত নিঃশ্বাস আমার অভ্যন্তর সর্নভেদ করে প্রবেশ করতেই আমার হুশ এলো। আমি হাত দ্রুত সরিয়ে তার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালাম। তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। লোকটি কি চায়? আমাকে তুলে নিয়ে যেতে এসেছে না তো? আর আমার বাড়ির ঠিকানা কিভাবে জানলো?
আমি আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে জিগ্যেস করলাম,
“বউকে নিতে এসেছেন মানে কি! কিসের বউ। আমি কোথাও যাবো না।”
উনি ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর গলায় জিগ্যেস করলেন,
“আপনাকে কে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?”
“আপনি যে বললেন..”
উনি কণ্ঠস্বর আরও গুমোট করে জবাব দিলেন,
“আমি বলেছি, বিয়ে যেহেতু হয়েছে তার তো একটা সমাধান করা চাই। তাই আপনার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।”
এ লোক না এইমাত্র বললো সে বউকে নিতে এসেছে। আবার তুমি থেকে মূহুর্তে আপনি!
“এই যে আপু, কি ভাবছেন? আমার কাজ আছে। সারাক্ষণ আপনার সামনে পুতুল সেজে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না।”
আমি ভীত গলায় বললাম,
“আপনি আমার মা-বাবাকে দিয়ে কি করবেন?”
উনি বিরক্ত হওয়ার মতো অন্যদিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেললেন। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে বললেন,
“সবকিছুরই একটা নিয়ম-নীতি আছে। বিয়ে যেভাবে হোক হয়েছে তো? তাই বলে আমি তো আর এভাবে ঝুলে থাকতে পারি না। আমারও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে।”
আমার মাথা আবারও চক্কর মারছে।
“ঝুলে.. ভবিষ্যৎ.. মানে?”
ছেলেটি হঠাৎ চাপা স্বরে রাগান্বিত হয়ে বললো,
“মানে আপনি জোর করে একটা ছেলেকে বিয়ে করে রেখে এলেন। আমার ভবিষ্যৎ স্ত্রীর সামনে আমি কী মুখ নিয়ে দাঁড়াবো বলুন? কী মুখ নিয়ে দাঁড়াবো? আবার বিয়ে হলে যদি আপনি দাবী নিয়ে ওঠেন?”
এসব কি বলছে এই লোক? আমি কাকে জোর করে বিয়ে করেছি? এইদিকে আমারই জীবন-মরণ নিয়ে প্রশ্ন ঝুলন্ত অবস্থায় স্থাপিত।
উনি আমাকে তাড়া দিয়ে বললেন,
“চলুন, চলুন। আপনার জন্য আমি আমার সময় নষ্ট করতে পারবো না।”
উনি গেইটের ভিতর প্রবেশ করতে চাইলে আমি লাফিয়ে উঠে উনার সামনে দাঁড়ালাম,
“এক সেকেন্ড!”
“হোয়াট!”
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
“উই নিড অ্যা ডিসকাশন।”
উনি আবার কনুই ভাঁজ করে দাঁড়ালেন।
“ডিসকাশন?”
আমি মাথা নাড়লাম।
উনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। নিজের গালে হাত বুলিয়ে বললেন,
“ঠিক আছে। আপনার ফোন নম্বর দিন।”
নম্বর! আমি তো আর বড়লোকের এক লতা বেটি না যে নিজস্ব কোনো ফোন থাকবে। এখনও বাপের ফোন মানুষের কাছে নিজের বলে দাবি করি। ফোন চালানোর জন্য যে পিঠের উপর দুরুম দুরুম পড়ে তা তো আর মানুষ জানে না। এই লোককে নম্বর নেই বললেও তো বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। আর আম্মুর বা আব্বুর ফোন নম্বর দেওয়া তো অসম্ভব!
“কি হলো?”
আমি গলার সুর নিচু করে বললাম,
“আপনি আমাকে এফবিতে নক দেবেন।”
“আইডির নাম?”
“ফাবলীহার উপর ঠেডা পড়ছে।”
উনি এক মূহুর্তের জন্য অবাক হয়ে তাকালেন। পরক্ষণেই বিরক্ত গলায় জিগ্যেস করলেন,
“ডিপি কি দেওয়া?”
আমি এবার চোখ বন্ধ করে বললাম,
“কালো ছবিতে সাদা অক্ষরে লেখা, ‘ফাবলীহার জামাই প্রতিবন্ধী।’”
চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলাম উনি স্তব্ধ নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। উনার চোখ-মুখ লাল হয়ে ওঠলো।
“ঠিক আছে। নক দিলে যেনো পাই।”
এটা বলতেই আমি গেইটের ঢুকে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হলাম।
সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠছি। এই লোক কী করবে এখন? কী করবে আমার সাথে? আব্বু-আম্মুকে কি সত্যিই বলে দেবে?
আমি এক তলা অতিক্রম করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। যদি এখান থেকে নিচে পড়ে যাই, এরপর মাথার সব স্মৃতি মুছে যায়? তখন তো এই লোক আম্মু-আব্বুকে বললেও বিশ্বাস করাতে পারবে না।
“এর বিপরীতও হতে পারে।”
আমি চমকে উঠে নিচে তাকালাম। ওই লোক নিচে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে।
উনি আবার বললেন,
“ধরুন, ওখান থেকে আপনি পড়ে গেলেন। মাথায় আঘাত না খেয়ে নাকে আঘাত খেয়ে নাকটা চ্যাপ্টা হয়ে গেলো। দাঁতে আঘাত খেয়ে সবগুলো দাঁত পড়ে ফোকলা হয়ে গেলেন। তখন আপনার এই কার্টুনের মতো মুখ দেখে কে বিয়ে করবে বলুন? পরিশেষে তো আমার গলাতেই ঝুলে পড়বেন।”
বেটার কথায় লজিক আছে। তখন মনে পড়লো সিসিটিভিতে সব ওঠছে!
“আপনি এখানে কি করছেন? বললাম না আমরা আলোচনা করবো। আপনি যান!”
লোকটি হাসলো। এতক্ষণের মধ্যে এই প্রথম লোকটিকে হাসতে দেখলাম। হাসিটা একদম হর্নি টাইপ। তওবা, তওবা!
উনি চলে গেলেন। আমিও উপরে উঠে এলাম। বেল টিপার আগে মনে পড়লো আমার তো কোচিংয়ের যাওয়ার কথা ছিল। এখানে আমি কি করছি!
হতাশ হয়ে সিঁড়িতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। হাতের তালু দ্বারা নিজের কপালটা কিছুক্ষণ ঠুকলাম।
(চলবে)
#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_১১
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
১৩.
মোবাইল হাতে বসে আছি। আমার দুইপাশে আমার ভদ্র-নম্র, পূত-পবিত্র বান্ধবীগণ আসন নিয়ে আছে। কয়দিন ধরে মেসেঞ্জার থেকে এক দন্ডও নড়িনি। মনে হচ্ছিল এই বুঝি উনি নক দেবেন। কিন্তু শালা! এতো এতো অপেক্ষা। বর্তমানে হাতে চাঁদনীর ফোন। তার ফোনে আমার ফেসবুক আইডি লগইন করেছি।
“তুই এমন আবালের আবাল! বাদাইম্মাও তোর থেকে বুদ্ধিসম্পন্ন ছিল।”
আকস্মিক ধমকে আমি থতমত খেয়ে চাঁদনীর দিকে তাকালাম।
“মানে?”
চাঁদনী আমার মাথায় চাটি মেরে বললো,
“আরে মহিষের বাল। নিজের জামাইয়ের নাম এখনও জানস না। অথচ সিঁড়ির তলায় আইসা তোমারে চুমাচামি মাইরা জায়গা। বাচ্চারে বাপের নাম বলার জন্যও তো জাইনা রাখা দরকার।”
আমি তার বাহুতে সজোরে আঘাত করে বললাম,
“থাবড়া মেরে জিহ্বা গরুর জিহ্বার মতো চার ইঞ্চি লম্বা করে ফেলবো বেয়াদব। আমি তোদের এই কাহিনী শুনিয়েছি? উনি আমাকে চুমা দিয়েছে চুমা?”
তুশিরার চুল টেনে ধরে বললাম,
“তুই-ও ওর সাথে হাসিস কেন? আমি তোর মতো বয়ফ্রেন্ড পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ি?”
তুশিরা হাসিমুখ কালো করার চেষ্টা করে বললো,
“আমি চাঁদনীর উদ্ভ্রান্ত কথা শুনে হাসছি। আর তুই যে চুমু খাসনি তা আমি বিশ্বাস করেছি। হান্ড্রেড পার্সেন্ট বিশ্বাস করেছি।”
আমি দুজনকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে গুমোর মুখে বসে রইলাম।
চাঁদনী আমার দিকে খানিক সরে এসে বললো,
“দোস্ত একটা কথা কই। ছ্যাঁদ করে উঠিস না। তুই তোর জামাইয়ের কত নম্বর বউ?”
আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম।
বললাম,
“ওই লোকের কথা শুনে তো মনে হলো এক নম্বর বউ।”
তুশিরা বললো,
“ভবিষ্যৎ বউয়ের কথা উল্লেখ করেছে, তুই-ই বললি। এমনও হতে পারে ভবিষ্যৎ বউ আগে থেকেই ঠিক করা আছে। তাই কষ্ট করে তোকে বের করে ডিভোর্স দিতে চাইছে। এমন হ্যান্ডসাম একটা ছেলে, সিঙ্গেল তো অবশ্যই থাকবে না।”
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমি কি সুন্দর না? রূপবতী নই? আমার মতো কাউকে ব্যতীত এই সুদর্শন পুরুষকে আর কেউ আগলে রাখতে পারবে না। আমার সঙ্গে বিচ্ছেদ হলে কোন পাতিশিয়ালের পাল্লায় পড়বে কে জানে। না, না, না! বুকে বড় ব্যথা হচ্ছে।
আমি আমার বুক চেপে ধরে মৃদু আর্তনাদ করে বললাম,
“বুকে বড় জ্বালা।”
চাঁদনী চিন্তিত মুখে বললো,
“পাছায় ব্যথা করলে কইতাম পাইলস হইছে। এহন কি কইতাম?”
সঙ্গে সঙ্গে আমার বুক ব্যথা কমে গেলো।
সোজা হয়ে বসে বললাম,
“আল্লাহ কি বাস্তে, আপতত দোয়া-দরূদ পড়ে নিজের উপর রহমত আনয়ন কর।”
তখন মোবাইলে টুং করে শব্দ হলো। ফেসবুক নোটিফিকেশন এসেছে কোনো এক মহামান্য ব্যক্তি আমাকে তার সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক তৈরি করতে আহ্বান করছেন। তবে আমার ক্লাস আছে। আহ্বানে সাড়া দেওয়ার পূর্বে ডিজে টেকনোর মিউজিক লাগিয়ে বাজিয়ে নিই।
আইডির নাম দেওয়া আবরেশাম প্রিয়ল। আমি ঠোঁট উল্টালাম। ফেইক আইডি।
সবাই-ই আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়, আর আমার বিয়ে করা বর? প যোগ প ইজ ইকুয়েলস টু প্রতিবন্ধী পুরুষ।
চাঁদনী মোবাইলে উঁকি মেরে বললো,
“প্রোফাইল কালা কেরে? মরারগুলা ফেইক আইডিও খুলতে পারে না। এমনে খুলে ছাগলডি! খুললে খুলবো আমার মতো। নীলয় চৌধুরী। কাজ: সাইকোলজি স্টাডিং ইন ঢাকা মেডিকেল কলেজ।”
আমার চোয়াল ঝুলে গেলো।
কিছুদিন আগে একটা ছেলে আমাকে মেসেঞ্জারে খুব জালাচ্ছিল। ফাহাদ থাকাকালীন সময়ে। আহা, কি মিষ্টি মিষ্টি কবিতা! কি পেটের পৌষ্টিকতন্ত্র মোচড় দেওয়া ছন্দ! ফাহাদ না আসলে, তার উপর সন্দেহ জাগার মতো কোনো কর্ম সংঘটিত না হলে আমি তো সেই ছেলের সঙ্গেই কেল্লা ফতে করে দিতাম। সেই ছেলের আইডির নাম ছিল নীলয় চৌধুরী!
আমি কিছু বলার আগে তুশিরা মুখ খুললো,
“জুলেখা খাতুন বিপাশা!”
চাঁদনী তখন লজ্জা পেয়ে তুশিরার দিকে তাকালো। এরপর বড় করে ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢাকলো।
তুশিরা সটান উঠে দাঁড়িয়ে চাঁদনীকে উরাধুরা কিল-ঘুষি দিতে লাগলো। আমি কিছু বললাম না। তাদের বাধা প্রদানের চেষ্টা করলাম না। জীবনে অনেক দুঃখ। এখন একটু বিনোদন নেওয়া যাক।
তুশিরার মার খেয়েও চাঁদনী খেক খেক করে হাসছে।
তুশিরা কোমরে হাত রেখে চেঁচামেচি শুরু করলো,
“এই অসভ্য মেয়ে জানিস কি করেছে! আমাকে নক দিয়ে বলে নাহিয়ান তার বয়ফ্রেন্ড। তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ কিছু হয়েছে।”
আমি ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ বলে চেঁচিয়ে উঠলাম।
“তুশিরা আমাকে থামিয়ে বললো,
শুধু তাই না। সে বললো নাহিয়ানের অনেক সমস্যা আছে। বিবাহিত জীবন সুখকর চাইলে শ্রীঘ্রই তাকে যেনো গাইনি ডাক্তার দেখাই।”
আমি হেসে ওঠলাম।
“তুই হাসছিস!”
তুশিরা রাগ করে মুখ শক্ত করে আমার পাশে বসে পড়লো। চাঁদনী উঠে তুশিরার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে। আমি তাদের দেখে হেসে চলছি। তাদের কর্মকান্ড দেখতে দেখতে মেসেঞ্জারে মেসেজ রিকোয়েস্টে গেলাম। আবরেশাম প্রিয়ল নামক আইডি থেকে মেসেজ এসেছে।
আমি বললাম,
“তুশিরা শোন, এই ফেইক আইডিকে ইচ্ছেমত ধুয়ে দে। আমাকেও নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলবে নক দিয়েছে। ইচ্ছেমত গালাগালি কর। দেখবি রাগ পানিকা পানি, দুধকা দুধ হয়ে গেছে।”
তুশিরার বোধহয় আমার প্রস্তাব পছন্দ হলো। সে নীরব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
ফেইক আইডি থেকে কি মেসেজ এসেছে আমি তা চেইক করতে লাগলাম।
দুই মিনিট বাদে আমার হাত থেকে ফোন পড়ে গেলো। চাঁদনী আর্তচিৎকার দিয়ে ওঠলো,
“নেহিইই! মেরি ফোন! মেরি পেয়ারা সা, নান্না সা ফোন!”
চাঁদনী ফোন হাতে নিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে চিৎকারের স্বর মৃদু করলো।
মৃদু চিৎকার করতে করতে বলতে লাগলো,
“আসসালামুআলাইকুম, হ্যালো অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ আমার ফোন, হাই অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ, ফাবলীহা অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ, অনলাইন হলে জবাব দেবেন অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ, নাহলে অ্যাঁ অ্যাঁ বিয়ে করে জামাই অ্যাঁ অ্যাঁ..”
তুশিরা উঠে চাঁদনীর গালে ঠাশ করে থাপ্পড় মারলো।
“তুতলা কোথাকার! ভালোমতো পড় নাহলে দাঁত ফেলে দেব।”
তুশিরা চাঁদনীর হাত থেকে ফোন নিয়ে নিজেই পড়লো,
“নাহলে বিয়ে করে জামাই ফেলে রেখে আসার অপরাধে পুলিশ সহ আমি আমার শ্বশুরবাড়ি হানা দেব।”
তুশিরা কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। মূল কাহিনী মাথায় খেলে যেতে উত্তেজিত হয়ে বললো,
“দোস্ত এটা তোর স্বামী!”
এরপর ফোনটা আমার হাতে দিলো।
আমি কতক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। নিশ্চিত হতে পারছিলাম না এটা সে কি-না। হয়তো কোনো বন্ধু হবে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব অপসারণের উদ্দেশ্যে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করি। প্রোফাইলে দেওয়া বিবাহিত। যেদিন আমার সঙ্গে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেদিনেরই তারিখ দেওয়া আছে।
আইডি ঘাটাঘাটি করে বুঝলাম এটা আমার সদ্য প্রাপ্ত সোয়ামীই।
“দোস্ত দেহা দেহা, পোলা কিয়ে পড়ে, কোনায় কাম করে।”
চাঁদনী আর তুশিরা তার তথ্য সংগ্রহে ব্যস্ত। আর আমি অসুস্থ। আমার বুকটা ধক ধক করছে। শ্বাসও যেনো নিতে পারছি না।
চাঁদনী আমার হাতে ফোন দিয়ে বললো,
“এই ল কথা ক।”
নতুন মেসেজ এসেছে,
“কি ব্যাপার? সীন করে উত্তর দিচ্ছো না কেন?”
আমি কাঁপা কাঁপা হাতে লিখলাম,
“শিউর হতে পারছিলাম না এটা যে আপনিই। ভেবেছিলাম আপনার কোনো বন্ধু বা অন্য কেউ হলে..”
“না, এটা আমিই। তোমার একমাত্র স্বামী।”
আমি বারবার লেখাটিতে চোখ বুলাচ্ছিলাম, “তোমার একমাত্র স্বামী!”
চাঁদনী হা করে বললো,
“মা গো মা, লজ্জায় দেহি কাইত।”
আমি তাকে আমার কাঁধ দ্বারা মৃদু ধাক্কা মেরে বললাম,
“কিসের লজ্জা!”
চাঁদনী চোখ পাকিয়ে বললো,
“বেটা তোরে তুমি কয় করে? এরপরও কস সিঁড়ির নিচে দাঁড়াইয়া কিছু করস নাই?”
ওই পাশ থেকে মেসেজ এলো,
“তো আর কি খবর?”
আমি উত্তরে বললাম,
“খবর হলো আপনি আমাকে তুমি করে ডাকবেন না। আপনি ডাকবেন, আপনি! কয়দিন পর তো ছাড়াছাড়ি হয়েই যাচ্ছে। তাহলে এতো লুতুপুতু দেখানোর মানে কি?”
তৎক্ষণাৎ কোনো উত্তর এলো না।
দুই মিনিট পর উনি জবাবে লিখলেন,
“কিছু মানুষ আছে তাদের মুরদ ওই চ্যাটিং অবধিই। সামনাসামনি এলে জুতা খুলে দৌঁড় দেয়। সিঁড়ি থেকে ঝাঁপ দিয়ে স্মৃতিশক্তি নষ্ট করার পরিকল্পনা আঁটে। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর বদলে কাঁপাকাপি পা দিয়ে পিয়ানো বাজায়।”
আমি হতভম্ব হয়ে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
অপমানস!
তার থেকে শেষ বার্তাটি এলো,
“ঠিক আছে মিসেস আবরেশাম প্রিয়ল। যেই রেস্টুরেন্টে আপনার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে, কাল কলেজ শেষে সেখানে থাকবেন। অন্যথায়, আপনার বাসায় আমার পদচারণা পড়বে।”
(চলবে)