#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_১৪,১৫
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
১৪
১৭.
প্রায় এক মাস হতে চললো, প্রিয়ল আমার অসভ্য স্বামী হওয়ার তোড়জোড় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার দুষ্ট চাহনি, মিষ্টি ছোঁয়া আমাকে বিরক্ত করে তা প্রকাশের চেষ্টা করে বারংবার ব্যর্থ হই। আমার ঠোঁটের শুভ্ররাঙা হাসি বারবার তার কাছে ধরা পড়িয়ে দেয়। সে বুঝে, তার কর্তৃত্ব যে আমার ভালো লাগে। কিন্তু হৃদয় জুড়ে যে সে ইতিমধ্যে স্থান দখল করে নিয়েছে তা জানতে দেইনি।
চাঁদনী আর তুশিরার সঙ্গে তাকে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা, আমাকে চক্কর মেরে তাদের হৈ-হুল্লোড় করে বলা, “দুলাভাই জিতছে, দুলাভাই জিতছে,” কিছুই বলা হয়নি।
এখন আমরা টিএসসি বসে আছি।হাতে আমার ফুচকার প্ল্যাট। গায়ে আমার গাঢ় নীল রঙের গাউন। হেলেদুলে ফুচকা মুখে পুরার তালে তালে খসে পড়া ওড়নাটা সে আলতো হাতে ধরে আমার মাথায় প্যাঁচিয়ে দিচ্ছে। ওড়নার কার্ণিশ ধরে মনোযোগী ভঙ্গিতে ঠোঁট কামড়ে কোথায় গুঁজে দিলে তার উথলে ওঠা হৃদয়ের মতো ওড়নাটা দিশেহারা ছুটে যাবে না তা ভাবছে।
মাথায় ভালোমতো প্যাঁচিয়ে শেষ অংশটুকু আমার কানের ভাঁজে স্থাপন করে শান্ত হয়ে বসলো। আমি খাওয়া বাদ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
কালো রঙের চেক শার্টে তাকিয়ে কেমন লাগছে বলতে ইচ্ছে করছে না। বলতে গেলেই ক্লান্ত হয়ে পড়বো, কিন্তু তার শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের বর্ণনার আর সমাপণ ঘটবে না।
প্রিয়ল আমার ফুচকার প্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কি ছাঁইপাশ খাও। দুইদিন পর দেখবে ভালো খাবারও পেটে সইছে না। ভাতের গন্ধ নাকে লাগলেও পেট চেপে বাথরুমে দৌঁড় দিচ্ছো।”
আপনি থেকে তুমিতে প্রিয়ল আমাদের বিশেষ আলোচনা সম্মেলনের পরের দিন থেকেই এসেছে। তুমি তুমি বললে নাকি তার অভ্যন্তরীণ দুষ্ট সত্তা দ্রুত জেগে ওঠে। আমার সঙ্গে সৎভাবে অসভ্যতা করতেও মনে সাহস সঞ্চিত হয়। সে তো অত্যধিক ভালো মানুষ। মেয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে যে কি তার বাঁধে!
আমি একটা ফুচকা তুলে তার এগিয়ে দিয়ে বললাম,
“তাহলে চলুন ভাগাভাগি করে খাই। দুঃখ-কষ্ট ভাগাভাগি করে নিলে যেমন মনের চাপ কমে, তেমন অস্বাস্থ্যকর খাবার ভাগাভাগি করে খেলে পেটের চাপ কমে।”
প্রিয়ল হেসে বললো,
“পেটের জ্বালা আমি একদম নিতে পারি না ফাবলীহা। আমাকে ইন্সট্যান্ট জায়গায় বসেই হালকা হতে হয়। তাই তো খাবার নিয়ে আমি এতো সচেতন।”
আমি খিলখিল করে হেসে ওঠলাম।
“আরে সুন্দরী। এখানে সেখানে বসে রঙলীলা দেখানো হচ্ছে।”
আমার হাসি থেমে গেলো। ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করে সামনে তাকাতেই রিজওয়ানের বিশালাকার দেহ নজরে পড়লো। তার সঙ্গে তিনজন ছ্যাচামো স্বভাবের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তবে এরা আগের বার দেখা ছেলেদের মধ্যে কেউ নয়।
“আজ দেখি নতুন কাস্টমার। আগের জন কোথায়? আমাকেও তো এক দুপুরের জন্য তোমার কাস্টমার বানাতে পারো।”
রিজওয়ানের বিচ্ছিরি ভঙ্গির হাসিতে রাগের দমকে আমার শরীর কেঁপে ওঠলো। দিগ্বিদিক হারিয়ে ফুচকার প্ল্যাটটা আমি দূরে ছুঁড়ে মারলাম। সঙ্গে সঙ্গে রিজওয়ান কাগজের প্ল্যানের মতো উড়ে দূরে গিয়ে পড়লো। চোখে তার হতবিহ্বল দৃষ্টি।
আমি পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয়লের তাকিয়ে দেখলাম তার মুখ পুরো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।
আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এ হলো আজকে তোমার কাস্টমার। আমি কুচি কুচি করে কিমা বানাবো, তুমি তা রান্না করে খাবে।”
আমি বোকার মতো হেসে মাথা নাড়ালাম। আর কিছু বলার পূর্বে প্রিয়ল ঝড়ের গতিতে রিজওয়ানের নিকট গিয়ে দাঁড়ালো। তার পিছন পিছন রিজওয়ানের যেই ছাও-পোনা আছে প্রিয়লের পিছনে ধাবিত হলো। তিনজনের ছিয়াত্তরের মমন্বন্তরের মতো ক্ষুদ্রাকার দেহ, আর একজনের শিমুল তোলার মতো মাংসবিশিষ্ট অবয়ব প্রিয়লের পেশীবহুল দেহের তাগড়াই শক্তির সঙ্গে পেরে উঠতে পারছে না।
আশেপাশের মানুষজন জড় হয়ে যাচ্ছে।
প্রিয়লের ফোনটা ঢালাই বাঁধা সিমেন্টের বেঞ্চের উপর পরে ছিল। আমি তাড়াতাড়ি তার ফোন হাতে নিয়ে মাহিম ভাইকে মেসেজ করলাম।
কিছুক্ষণ বাদে মাহিম ভাইয়ের সঙ্গে আরও দুজন কোথা থেকে যেন ছুটে এলো। তারা প্রিয়লের নিকটে দাঁড়াতে রিজওয়ানের বন্ধুরা প্রিয়লের বগলদাবা থেকে ছুটে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু সফল হলো না। প্রিয়ল তার বন্ধুদের হাতে রিজওয়ানের গ্রুপকে হস্তান্তর করে শ্বাস টেনে দুই কদম পিছনে এসে দাঁড়ালো। আমি ধীরে তার দিকে এগিয়ে গেলাম।
প্রিয়ল রিজওয়ানকে ইঙ্গিত করে কুপিত কণ্ঠে মাহিম ভাইকে বললো,
“এই ছেলের জামা-প্যান্ট যা আছে সব টেনে খোল।”
বলেই সে আগের জায়গায় গিয়ে বসলো।
আমি আঁতকে ওঠলাম। ওহ শিট! জামাইয়ের কিছু দেখার সৌভাগ্য হলো না, আর এই ভুটকুকে দেখে আমার চোখ নষ্ট করতে হবে!
মাহিম ভাই অতোটাও নির্দয় হলেন না। রিজওয়ানের পরনের লাল রঙের চাড্ডি অবশিষ্ট রাখলেন। তা পুষিয়ে নিলো রিজওয়ানের বন্ধুবান্ধব দিয়ে।প্রিয়লের বন্ধুরা রিজওয়ানের বন্ধুদের শুধু চাড্ডি পরিয়ে দাঁড় করে রাখলেন।
তুশিরা, চাঁদনী থাকলে সেই হতো! কেন যে বেচারিদের ফাঁকি দিয়ে জামাইয়ের চুমু খেতে এসেছিলাম। তারা সামনে থাকলে রিজওয়ান আরও লজ্জা পেতো। ভাবতে ভাবতে রিজওয়ান ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলো। এরপর করুণ সুরে বলে ওঠলো,
“আম্মুউউ!”
আমিও অনুচ্চ গলায় দন্তবিকাশ করে সুর তুললাম,
“আঁ, আহা আহা।”
প্রিয়ল তার জায়গা থেকে উঠে এসে আমাকে টেনে আগের জায়গায় নিয়ে এলো।
তার কাছে এনে আমি ঘুরিয়ে দাঁড় করিয়ে বললো,
“তোমাকে এসব দেখতে হবে না। তুমি দেখলে শুধু আমাকে দেখবে।”
আমি তাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে বললাম,
“কিন্তু আমি তো আপনার চাড্ডি দেখতে পাচ্ছি না।”
প্রিয়ল ফিচলে হেসে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“আচ্ছা! দেখতে চান ম্যাডাম?”
আমি যে যা তা বলছিলাম, আমার খেয়াল হলো। আমি লজ্জা পেয়ে তার বুকে মাথা লুকালাম। আবার মিস্টেক!
দ্রুত ভুল উপলব্ধি হতে আমি প্রিয়ল থেকে সরে কয়েক ইঞ্চি দূরে দাঁড়ালাম। পিছন থেকে ভেসে হাচ্ছে মাহিম ভাইদের মারের দমকে রিজওয়ানদের আহ-উহ করা আর্তচিৎকার।
(চলবে)
#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_১৫
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
১৮.
কোচিংয়ের সামনের রাস্তার ফুটপাতে কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছি। মুখে আমার বিগলিত হাসি। সামনে রিজওয়ান কাচুমুচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
“কিরে রিজুয়াইন্না। এদিকে তাকা ভোটকা।”
রিজওয়ান ডানে-বামে মাথা নাড়লো। অস্ফুট স্বরে বললো,
“মাফ করেন বোইন। যাইতে দেন।”
তুশিরা রাস্তার অপর পাশ থেকে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসেছিল। হেই দোস্তো বলে মাঝ রাস্তায় স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। রাস্তার মাঝখানে দামড়া মেয়ের এমন উদ্ভট ভঙ্গিতে দাঁড়ানো দেখে অটোর সারি একের পর এক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে স্থির হয়ে গেলো। কিছু পথচারী আর সবজি দোকানদারেরা হোল্লা করে ওঠলো,
“এই মাইয়া সরো! মরবা নাকি!”
আমি মাথায় হাত দিয়ে তুশিরা অভিমুখে দৌঁড়ে গেলাম। তাকে দুই গালে আলতো করে দুইটা থাপ্পড় মেরে হাত ধরে ফুটপাতে টেনে নিয়ে এলাম।
রিজওয়ান আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে সে আবার মাথা নিচু করে ফেললো।
তুশিরার চকিত মুখায়ব আরও বিস্ময়করতায় পতিত করতে আমি বলে ওঠলাম,
“তো রিজুয়াইন্না, আসা যাওয়ার সময় সালাম না দিয়ে যাস কেন? মাইর চিনিস?”
রিজওয়ান ভীত কণ্ঠে হাত জোর করার মতো ভঙ্গি করে বললো,
“মাফ করেন আপা। আর এমন হবে না।”
আমি বিরক্ত দেখিয়ে বললাম,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার তাহলে তুই ফুট। যা ভাগ!”
রিজওয়ান কোচিংয়ের অভিমুখে হাঁটা শুরু করলে তার চলার পথে তুশিরার ঘাড় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে গেলো।
আমি তার মাথায় চাটি মেরে বললাম,
“কিছু তো লজ্জা অবশিষ্ট রাখ দোস্ত। শেষমেশ এই রিজুয়াইন্নাকে এভাবে ডাগর ডাগর চোখ মেলে মায়াবী নজরে দেখিস না।”
তুশিরা অবাক কণ্ঠে বললো,
“রিজুয়াইন্না! এই ক্ষ্যাপা হাতিকে তুই বশে কিভাবে এনেছিস দোস্ত? পানি পড়া ছিটিয়ে দিয়েছিস কি?”
আমি হাসতে হাসতে বললাম,
“আয় ক্যাফেতে গিয়ে বসি। আজকে আর কোচিং করবো না। চাঁদনীকে ভিডিও কল দে তো। দুজনকে একসঙ্গে কাহিনী বলি।”
ক্যাফেতে বসে তুশিরা আর চাঁদনীকে রিজওয়ানের চাড্ডি পরিহিত বেহাল অবস্থার কথা বললাম। চাঁদনী হাসতে হাসতে ফোন এদিক সেদিক ছুঁড়ে মারছিল। ভূতে আক্রান্ত বস্তু!
আমি আর তুশিরা নিজেদের হাসি থামিয়ে ধৈর্য ধরে চাঁদনীর হাসি দেখে চলছিলাম।
দেখা শেষ হয়ে গেলে আমি বললাম,
“বিদায় হ। আমি এখন আমার সোয়ামীর সঙ্গে কথা বলবো।”
চাঁদনী হাসি থামানোর চেষ্টা করে বললো,
“না প্লিজ দোস্ত। একটু হাইসা লই।”
সে আর হাসলো না। নিজ দায়িত্বে হাসি থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালো।
“এই ছেরি, তুই তোর জামাইয়ের লগে একা একা ঘুরতে চাস। মা গো মা! নিজের কইলজা ট্রান্সপ্লান্ট করাইয়া কি দুলাভাইটা লাগাইছোস?”
আমি হেসে উঠে বললাম,
“তোমাদের সামনে স্বামীর সঙ্গে প্রেম করতে আমার বুঝি শরম করে না? এবার যাও, তুমি ফুটো।”
চাঁদনী মুখ বাঁকালো।
আমি তখন মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললাম,
“ও শোন, তোর ফাকাদের বড় ভাইয়ের বিবাহ। তাই কলেজে আমি আট থেকে দশদিন আসবো না।”
চাঁদনী সবগুলো দাঁত দেখিয়ে বললো,
“আমাদের নিবি না?”
তুশিরাও আগ্রহী কণ্ঠে বলে ওঠলো,
“হ্যাঁ দোস্ত, অনেক মজা হবে। এর আগেরবার ফাহাদ আমাদের ভড়কে দিয়েছে। এবার আমরা এমন খেল দেখাবা বেচারার সত্যি সত্যি টয়লেট কষা হয়ে যাবে।”
আমি হতাশ গলায় বললাম,
“অসম্ভব। অসম্ভব মানে অসম্ভব। তোদের নিলি..”
চাঁদনী হাউ-কাউ শব্দ তুলে কান্না করে দিলো। মোবাইল টি-টেবিলে রেখে ফ্লোরে মোচড়া-মুচড়ি করে বিলাপ শুরু করেছে, আর বলছে,
“তুই কেন বললি না! ফাহাদের বিবাহযোগ্য ভাই আছে! কেন কইলি না!”
ভাগ্যিস আমি আর তুশিরা কানে ইয়ারফোন গুঁজে চিরিয়াখানার এই অদ্ভুত প্রাণীটির সঙ্গে কথা বলি। নাহলে আমাদের মান-সম্মান ওর মতোই হাত-পা ছড়িয়ে ফ্লোরে গড়াগড়ি করতো।
“হয়েছে বাপ। এবার উনার সঙ্গে একটু কথা বলি। অনেক দিন দেখা হবে না। ফোন ধরারও সুযোগ পাবো কি-না কে জানে।”
বাসায় আম্মুর ফোন দিয়ে প্রিয়লের সঙ্গে একটানা দশ মিনিটও কথা বলতে পারি না। আমার আব্বাজানের একটু পরপর পুচ্ছ নাড়িয়ে উঁকিঝুঁকি, আর আম্মাজানের চোখে আগুন জ্বালিয়ে তা দিয়ে আমায় ভষ্ম করার যন্ত্রণায় তার সঙ্গে মধুর আলাপ হুট করেই করলায় রূপান্তরিত হয়। তাই একমাত্র ভরসা তুশিরা আর চাঁদনীর ফোন। কলেজে থাকাকালীন চাঁদনীর ফোনে লগইন করে প্রিয়লের সঙ্গে কথা হয়। তবে তা খুব কমই হয়েছে। বেশিরভাগই তাড়াতাড়ি কোচিংয়ে আসার অযুহাতে তুশিরার ফোন দিয়ে কথা হয়।
আমি প্রিয়লকে নক করলাম। সে সঙ্গে সঙ্গেই প্রত্যুত্তরে বললো,
“কি ব্যাপার ম্যাডাম, আপনার তো কোচিং শুরু হয়ে যাওয়ার কথা।”
আমি দুষ্টুমি করে লিখলাম,
“আজকে যাইনি। আজকের আবহাওয়াটা মিষ্টি মিষ্টি অনুভূতি সৃষ্টিকারী আবহাওয়া। এমন মিষ্টি আবহাওয়ায় জটিল সংখ্যার উৎকট আর্গুমেন্ট গলাধঃকরণ করার কোনো মানে হয় না।”
“তাই নাকি? আরও প্রবল মিষ্টি অনুভূতি জাগাতে সাহায্য করতে আসবো?”
“অতীব প্রবল মিষ্টিতে আমার ডায়াবেটিস।”
উনি হাসলেন।
আমি খানিক সময় নিয়ে বললাম,
“শুনুন।”
“বলো।”
আমি কিছু লিখার পূর্বেই উনি লিখলেন,
“তোমার খাঁটো হওয়ার দরকার ছিল।”
“মানে?”
“খাটো হলে দুইহাতে জড়িয়ে কোলে নিয়ে আমার সমান করতে পারতাম। এখন! খাম্বার মতো লম্বা। সামনে দাঁড়ালে মনে হয় আমার ছয় ফুট উচ্চতাকেও ভেদ করে উড়াল দেবে।”
আমি অবাক হয়ে বসে রইলাম। মানুষটা সবসময় তার অবাধ অভিলাষ অক্লেশে আগ্নেয়গিরির মতো প্রকাশ করে বসে। আমি যে এতে ভীষণ লজ্জা পাই তা কি উনি বুঝে না! সবসময় দুষ্ট চিন্তা। কোলে নিতে পারছে না বলে এখন আমার লম্বা হওয়া দোষ।
উনি লিখলেন,
“এবার তুমি বলো।”
“কিছুদিনের জন্য আমার এক চাচ্চুর বাসায় যাচ্ছি। এক-দেড় সপ্তাহ দেখা হবে না।”
উনি প্রত্যুত্তরে কিছু লিখলেন না। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আমিই লিখলাম,
“আপনি এখন আসবেন?”
উনি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন,
“না জান। তুমি আসো।”
“মন খারাপ?”
“না।”
উনার উত্তর প্রদানের এমন সংক্ষেপণে আমি কথা হারিয়ে ফেললাম। হুট করে আমার মনটাও খারাপ হয়ে গেলো। মেসেঞ্জার থেকে বের হয়ে এলাম। তখন নোটিফিকেশন টুং শব্দে মোবাইলের পর্দায় ভেসে ওঠলো,
“ভালোবাসি।”
আমি কেমন কেঁপে ওঠলাম। মন খারাপ ভাবটা যেন আরও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠলো। অকপটে ভালোবাসা বহিঃপ্রকাশের আশাতীত চাওয়াতে মন খারাপ হওয়া মানায় না। কিন্তু আমার মনে অমাবস্যার নিষ্কলুষ আকাশ বিশদ হয়ে ওঠলো। ঋণশূণ্য অকলঙ্কিত আকাশ কলঙ্ক লেপা চন্দ্রকে হারিয়ে কাকচক্ষুর মতো জাজ্জ্বল্যমান ব্যথা আমায় দান করলো। বাস্তবতার অনেক সিদ্ধ নিয়ম ধীরে ধীরে ঘটে টোকা মেরে যায় বলেই আজকাল এমন সময়ে-অসময়ে মন খারাপ হয়।
উনি জিগ্যেস করলেন,
“এই ফাবলীহা, তুমি আমার ফোনের পাসওয়ার্ড জানলে কিভাবে?”
আমি প্রত্যুত্তরে বললাম,
“আমি তো জানি না।”
“তবে যে ওই দিন মাহিমকে খবর দিয়ে আনলে, কিভাবে ম্যাডাম?”
“আমি একটা আর্টিকেলে পড়েছি। সদ্য প্রেমে পড়া পাগল প্রেমিক সব জায়গায় তার প্রেমিকার সংস্পর্শ ঘটাতে চায়। ফোনের গ্যালারি ভর্তি থাকে তার অজানায় তোলা নানা নিদর্শন, ওয়ালেটের ভাঁজে থাকে মুদ্রিত নিভাঁজ ছবি, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম সব জায়গায় তার নাম সম্বলিত পাসওয়ার্ড। আর্টিকেলে দেওয়া ছবিটির সঙ্গে আপনার চেহারার অনেক মিল আছে। একটু পার্থক্য হলো, একজন পাগল প্রেমিক, একজন পাগল স্বামী।”
“আমার বোধহয় এক্ষনই তোমার কাছে আসা উচিত ফাবলীহা। এক সপ্তাহের অসভ্যতা আজকে সেরে না নিলে আমার দেড় সপ্তাহ নির্ঘুম রাত কাটাতে হবে। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে যাবে। তুমি তো নিশ্চয়ই চাইবে না তোমার জন্য সুন্দর একটা ছেলে যুবক বয়সেই অসুন্দর হয়ে সুন্দরী স্ত্রীর আদর থেকে বঞ্চিত হোক?”
আমি হেসে ওঠলাম। তুশিরাও আমার পাশে থেকে আমাকে দেখে মিটিমিটি হাসছে।
“আসি?”
আমি প্রিয়লের প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। তার বদলে বললাম,
“ইচ্ছে ছিল তোমার ওয়ালেটে জায়গা যেনো পাই। তুমি তো কায়দা করে তোমার হৃদমাঝারেই আমাকে আবদ্ধ করে নিলে। নিজের হৃদয়কে ছেদ করে, ঠকে যাওয়ার আংশকা ফু দিয়ে উড়িয়ে আমাকে রাজত্ব করতে দেওয়ার নথিপত্র প্রদান করার জন্য ধন্যবাদ। অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা রইলো প্রিয়। অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা।
বাণীতে —রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”
“দুষ্টু! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনেও এই কথা বলেননি! কেন স্বীকার করো না ফাবলীহা নামক রাজকন্যাটি প্রিয়ল নামক বিষাদগ্রস্ত প্রেমিক প্রজার প্রণয়ে সীমাবদ্ধ?”
হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমার মন খারাপের বিন্দুমাত্র রেশ অবশিষ্ট নেই। কারণ প্রেমিক প্রজা তার সৌহার্দ্যপূর্ণ অনুভূতি দ্বারা রাজকন্যার রাজপুত্র হয়ে ওঠেছে।
(চলবে)