তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান পর্ব_১৬,১৭

0
220

#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_১৬,১৭
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
১৬

১৯.
মামা’স গার্ল এবং পাপা’স প্রিন্সেস হয়ে ভদ্র-নম্র চেহারা নিয়ে ফাহাদের বাসায় উপস্থিত হলাম। আত্মীয়-স্বজন সবে আসতে শুরু করেছে। বিয়ের আরও অনেক দিন বাকি আছে। তবে যারা কাছের, তাদেরকে মোজাম্মেল চাচ্চু আগেই আসার জন্য জোরজবরদস্তি করেছেন।
এখন মনে হচ্ছে মানুষগুলো ওতোটাও খারাপ নয়। আমি তো মাশাল্লাহ অনেক ভালো মেয়ে। আমাকে পুত্রবধূ করতে চেয়ে একটু তোড়জোড় চেষ্টা চালিয়েছিল, এই তো। আমি এসবে এখন আর কিছু মনে করছি না। পরিষ্কার মনে সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম। এখন তো ফাবলীহা মানেই প্রিয়ল, প্রিয়ল মানেই ফাবলীহা। প্রিয়লকে পাঠানো শেষ বার্তাটির কথাটি মনে পড়লো।

আমি কি তার অন্ধ ভালোবাসায় মত্ত? ভালোবাসি বোধহয়, অন্ধ তো নই। একটা মেয়ে তো বুঝতে পারে কোন ছেলেটার সঙ্গ তার জন্য নিরাপদ, কোন ছেলের বাহু তার জন্য নিশ্চিন্ত নির্ভয়ের বেড়ি। আমি তো প্রিয়লকে সেভাবেই বিশ্লেষণ করে তার নিকটে গিয়েছি। সে কি মৃদু অভিমান করবে তাকে প্রথমেই সব পুরুষের কাতারে ফেলে পরীক্ষা করার জন্য? করতে পারে। আমিও করতাম। কিন্তু কিছু হয়তো করার নেই। সব মেয়েকেই তার অস্বিত্ব, সত্তা রক্ষায় সচেতনতার তীর নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হয়।

সেই সময় ফাহাদকে দেখলাম হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, ফাহাদকে দেখেও তো আমার ভালো লাগতে পারতো। প্রেমে না পড়ি, নূন্যতম ভালো লাগাটা তো কাজ করতে পারতো।
পরক্ষণেই ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠলো। প্রিয়ল। তার নামের অর্থের মতোই সে আমার প্রিয় মানুষ। তার প্রেমে পড়বো বলেই বোধহয় ফাহাদ আসার পর ভালো লাগার ফাংশন আমার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নিজে নিজে হেসে ওঠলাম।

ফাহাদ আমার সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করলো,
“কেমন আছো ফাবলীহা? একা একা হাসছো যে।”
“আমি ভালো আছি ফাহাদ ভাই। তুমি কেমন আছো? দিন দিন দেখি আরও শুকিয়ে কাঠি হয়ে যাচ্ছো। ফু দিলেই উড়ে যাবে।”
আমার সহজ-স্বাভাবিক কথা বলার ভঙ্গিতে সে বোধহয় চমকে ওঠলো। প্রত্যুত্তরে বিস্ময় ভাব কাটিয়ে বললো,
“তাই? তাহলে ফু দাও। না উড়লে খবর আছে।”
আমি মুখ ফুলিয়ে ফু দিলাম। ফাহাদ দুই কদম পিছিয়ে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গি করে বুক হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো।
“আল্লাহ বাঁচিয়েছে! আরেকটু হলে তো মরেই যেতাম। তখন আমার বউ আমাকে কোথায় খোঁজে পেতো!”
আমি হেসে ওঠলাম। ফাহাদও আমার সঙ্গে সঙ্গে হাসলো।

খানিক দূরে ফাহাদের মা দাঁড়িয়ে ছিলেন।
উনি আমাদের নিকটে কাছে এসে মুখে হাসি উদয় করে জিগ্যেস করলেন,
“হাসছো কি নিয়ে তোমরা?”
ফাহাদ বললো,
“এমনেই হাসছি। কিছু বলবে?”
আন্টি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ, ফাবলীহা এসে এখনও কিছু মুখে দেয়নি। আমার সঙ্গে আসো মা কিছু খেয়ে নাও।”
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
“এখন খাবো না আন্টি।”
এরপর উৎফুল্ল হয়ে বললাম,
“আপনারা না পিঠা বানাচ্ছেন আন্টি? আমিও বানাবো।”
আন্টি হেসে বললেন,
“ঠিক আছে মা। আসো, আমার সঙ্গে রান্নাঘরে এসো।”
আমি আন্টির সঙ্গে রান্নাঘরের অভিমুখে গেলাম। উনি আমাকে পিঠা বানানোর পদ্ধতি, মেহমানদের বিলি বণ্টন করা, ফায়াজ ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি, মেয়ে দেখতে কেমন– নানা কথা মন ভরে বলতে লাগলেন। আমিও হাসিমুখে মন দিয়ে সবটুকু শুনে যাচ্ছিলাম।

২০.
ফাহাদের বাড়িটা এক তলাই তবে মাটির ভিত্তি থেকে খানিক উঁচু করে তোলা। ফলে বাড়ির সদরস্থ দরজা অতিক্রম করতে হলে কয়েক ধাপের প্রশস্ত সিঁড়ি পাড়ি দিতে হয়। তার দুইপাশে গ্রীল ব্যতীত বারান্দা। ফ্লোরে ফ্লোরালের জমকালো টাইলস স্থাপন করা।
বাম দিকের বারান্দায় চেয়ার পেতে পা ঝুলিয়ে বসে আছি। খোলামেলা বারান্দা হওয়াতে শেষ বিকেলের মৃদু তপ্ত দেওয়া ময়ূখমালীর সঙ্গে বায়ুপ্রবাহ একাকার হয়ে আমায় উচ্ছল কিশোরীর মতো উড়িয়ে নিয়ে চাইছিল। মৃদু হেসে প্রকৃতির পানে প্রশ্রয়পূর্ণ চাহনি দিয়ে বুঝালাম, আমি যে কিশোরীটিই রয়েছি। উত্তাল হাওয়ার টানে দিগ্বিদিক ছুটে না চললেও কারও চার প্রকোষ্ঠের হৃদয়ভাঁজে লুকোতে মন আপনাআপনি দোয়েল পাখির মতো নেচে ওঠে।
সামনে জায়গাজুড়ে সারি বিহীন এলোমেলো বিছানো ফুল গাছের চারা।
তার শেষ প্রান্তে আমার মা-বাবা, মোজাম্মেল চাচ্চু ও চাচী এবং মোজাম্মেল চাচ্চুর বোন তথা ফাহাদের ফুফু গোল হয়ে বসে গল্প করছেন। ফাহাদ কোথা থেকে লাফ ঝাঁপ মেরে এসে হাজির হলো। গায়ে তার ঘামে জবজবে হওয়া টি-শার্ট। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার সময় আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সে ফিরে এলো। আমার পাশে দাঁড়িয়ে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে জিগ্যেস করলো,
“কি খবর?”
আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম,
“কিছু না। বিকাল হওয়া দেখছি।”
সে তখন আমার পাশ থেকে সরে বারান্দা অতিক্রম করে বাইরে গেলো।

বাগানে ফুল ফুটেছে। পতুর্লিকারা ঝাঁকে ঝাঁকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু কিছু অভিমানে চোখ বুজে ফেলার পথে।
ফাহাদ কয়েকটা ছিঁড়ে নিলো। আমার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলো,
“ফুল লাগবে?”
আমি উৎসাহী চোখে তাকিয়ে জোরে জোরে মাথা নাড়লাম। সে খুব সাবধানে গাছকে ব্যথা না দেওয়ার চেষ্টা করে বৃন্ত থেকে ফুল বিচ্ছিন্ন করছিল। দুই মুঠো ভর্তির হয়ে গেলে আমার নিকটে দৌঁড়ে আসে। ঝুঁপ করে আমার কোল ভর্তি করে আবার দৌঁড়ে যায়। এবার যায় কোণায় মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বড় কাঠগোলাপ গাছটির দিকে। উঁচু ডাল থেকে লাফ মেরে ফুল আনতে যায়। হাতে ফুলের সংস্পর্শ হওয়ার আগে সে মাটির সংস্পর্শ পায়। ফাহাদের এমন বেকায়দায় পরে যাওয়া দেখে আমি খিলখিল করে হেসে ওঠি। হাসতে হাসতে আমি সেইদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। সামনে ভেসে উঠে প্রিয়লের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা।

রৌদ্রদগ্ধ এক দুপুরে প্রিয়ল আমার কোচিংয়ের সামনে এসে উপস্থিত হয়। কোচিং থেকে বের হয়ে তাকে দেখে আমি থতমত খেয়ে যাই। রোদের শক্তিমত্তায় তার নাক গাল রক্তিম হয়ে ওঠে। তার নাকের ডগার তিলটা আরও স্পষ্ট হয়ে দৃষ্টিগোচর হয়। আমি ব্যস্ত ভঙ্গিতে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। কখন এলো, কেন এলো, কি চাই এতো এতো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে সে প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসি খোঁজে পেলো। আমার হাত টেনে ধরে তার বুকে ঠেকায়। আমি ভীত চোখে মাথা ঘুরিয়ে কোচিংয়ের গেইটে তাকাই। এখনই সবাই বের হয়ে আসবে।
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তুশিরার সঙ্গে চোখে চোখে কথা সেরে আমি প্রিয়লকে তাড়া দেই। তার বুঝি হুশ এলো। পাশ কেটে চলে যাওয়া রিকশা মামাকে ডেকে দাঁড় করিয়ে ঝটপট গিয়ে ওঠলো। হুডি নামিয়ে আমি তার দিকে দৃষ্টি স্থাপন করি। তার মুখে তখনও বিস্তৃত হাসি। আমি ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলাম,
“কি ব্যাপার? এতো হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন?”
সে হেসে জবাব দিলো,
“দুপুরে স্বপ্ন দেখলাম আমার বর্তমান বউটা তার একমাত্র স্বামীর জন্য কেঁদে কেটে দুনিয়া ডুবাচ্ছে। সবাইকে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে ছুটে এলাম।”
তিনি হাত দুটো দুই দিকে প্রসারিত করে বললেন,
“আমি এসে গেছি। এবার আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার বুক ভাসাও তো দেখি। আমার বুকে অনেক জায়গা। তোমার লবণাক্ত অশ্রু ধারণ করার জন্য কেটে-ঝেঁটে জায়গা সংরক্ষণ করেছি।”
আমি কনুই ভাঁজ করে বললাম,
“আচ্ছা। অনেক জায়গা? অনেক জায়গা অবশিষ্ট থাকার ফলে আমার পরিচয় বর্তমান বউ। কয়দিন পর হবো প্রাক্তন বউ। আসতে যেতে রাস্তাঘাটে দেখা হলে বড় করে সালাম দিয়ে বললেন, আসসালামুআলাইকুম আপা। ভালো আছেন?”
প্রিয়ল ফিক করে হেসে ওঠলো। আর আমি মুখ গুমর করে বসে রইলাম।

“দাঁড়ান দাঁড়ান মামা! একটু থামেন।”
প্রিয়ল রিকশা থামাল। আমার দিকে খানিক ঝুঁকে হাত দিয়ে কিছু ইশারা করলো।
এরপর মুখে বললো,
“এই পিচ্চি এদিকে এসো।”
আমি পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলাম একটা মেয়ে বালতিতে ফুল নিয়ে এগিয়ে আসছে। তাকেই প্রিয়ল ইশারা করে ডাকছিল।
কাছে আসতে প্রিয়ল বালতিতে উঁকি দিয়ে আমাকে জিগ্যেস করলো,
“কোনটা নেবে? বেলী না গন্ধরাজ?”
আমি কাঠগোলাপের গাজরাটি ইশারা করলাম। প্রিয়ল চোখ-মুখ কুঁচকে আমার দিকে তাকালো। পরক্ষণেই হাসিমুখে কিনে নিলো।
রিকশা আবার চলতে শুরু করলে সে কাঠগোলাপের গাজরা হাতে নিয়ে মুখ অন্ধকার করে বসে রইলো।
বাচ্চারা যেমন কোনো কিছুর প্রতি আকুল আবেদন করে না পেয়ে বিশাল অভিমানের নথি হাতে নিয়ে বসে, আর থাকে চোখের ঝলঝল স্ফটিকের মতো চাহনি; প্রিয়লও তেমন ছলাকলাহীন অভিমানী চাহনি নিয়ে গাজরাটির দিকে তাকিয়ে ছিল।
আমি শান্ত গলায় জিগ্যেস করলাম,
“কাঠগোলাপ পছন্দ নয়? কেউ রিজেক্ট করেছিল বুঝি? ”
প্রিয়ল ফুঁসে উঠে বললো,
“এটা কাঠগোলাপ না। নাগচম্পা, নাগ! নাগের মতোই এর আচরণবিধি। যে এর আশেপাশে থাকে তাকেই ছোবল মারে।”
আমি হতবুদ্ধি হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
প্রিয়ল বলতে থাকলো,
“শুনো কি হয়েছে। সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে পিলখানায় নূর কলেজে একটা ফেস্ট হয়েছিল। তখন তো আমি ঢাকা কলেজে পড়ি। দশ-পনেরজন আমরা গাড়ি ভাড়া করে ফেস্টে যাই। অনেক ইভেন্টে অংশগ্রহণও করেছিলাম। সেখানে তো অনেক নাগচম্পার গাছ। অনেক সুন্দর তার রূপ। তিন বন্ধু আমরা নাগচম্পা ছিঁড়তে গিয়ে বিজিবির কবলে পড়ি। অসভ্য লোকটা কি করেছে জানো? আমাদের তিনজনকে তাড়া করে দৌঁড়। শেষে বলদটা নিজেও পড়ে যায়, আমিও যাই। আর কিছু না পেয়ে আমার প্যান্টের শেষ অংশ টেনে ধরে থাকে। প্যান্টের চেইন খোলে সেটাকে সেখানেই বিসর্জন দিয়ে আসি। যাহ শালা, তুই আমার প্যান্ট পেলেও দেহ পাবি না। ভাগ্যিস ফেস্টের পর ক্রিকেট খেলার জন্য ভেতরে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে গিয়েছিলাম। অন্যথায় ভাবতে পারছো! তোমার স্বামীর ইজ্জত সেই বিজিবির হাতেই খোয়া যেতো।”
প্রিয়লের হা-হুতাশ আর শুনতে পারছিলাম না। শরীর কাঁপিয়ে ঝংকার তুলে হেসে চলছিলাম। চিবুকে গরম স্পর্শে আমার মুখের হাসি থেমে গেলো। কিন্তু চোখের হাসি বহমান রইলো। প্রিয়ল যত্ন করে আমাকে কাঠগোলাপের গাজরাটি হাতে পড়িয়ে দেয়। এই কাঠগোলাপই তার নাগচম্পা। তার জীবনের নাগ!

আমি মুচকি হাসলাম।
“কি ব্যাপার ফাবলীহা, এভাবে তাকিয়ে হাসছো যে?”
ফাহাদের প্রশ্ন শুনে আমি থতমত খেলাম। স্তব্ধ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ফাহাদ হেসে বললো,
“এভাবে তাকিয়ে থেকো না।”
সে নিজে হেসে আমার কোলে আরও কিছু কাঠগোলাপ গুঁজে দিলো।
“কাঠগোলাপ তোমার পছন্দ? মেয়েদের দেখি কাঠগোলাপ অনেক পছন্দ করে। আমার কাছে কিন্তু লাল গোলাপই সবচেয়ে ভালো লাগে। এটার সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনাই হয় না।”

যেখানে প্রিয়লের নিকট কাঠগোলাপ নাগ, সেখানে আমার তা পছন্দ হতেই পারে না।
তাই আমি হেসে বললাম,
“কাঠগোলাপ আমার চূড়ান্ত অপছন্দ। এটার আরেক নাম নাগচম্পা জানো তো?”
ফাহাদ অবাক হওয়া চাহনি দিয়ে বললো,
“আমারও চূড়ান্ত অপছন্দ। সাকেরার জন্য লাগিয়েছি। গাছটি বেশিদিন হয়নি, একবছরের মতো হয়েছে। সাকেরা তো..”
এরপর আমাদের মধ্যে কিছুক্ষণ ফুল নিয়ে আলাপ-আলোচনা চললো।

অদূরে বসে থাকা উভয়পক্ষের মা-বাবা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো। ফাহাদের মা তার ননাশকে বললেন,
“ওর কথাই বলছিলাম। আল্লাহ রাখলে ওকে ফাহাদকে দিয়ে আমাদের ঘরে আনবো।”
ফুফু হাসি প্রশস্ত করে বললেন,
“মেয়ে মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর। পরীর মতো চেহারা।”
একটু ফিসফিসিয়ে বললেন,
“তাড়াতাড়ি শুভ কাম সারো। সুন্দর মানুষ। কতজনের নজর পড়বো। ফায়াজের কাম শেষ হলেই এদিকের কাম সেরে আনো।”
আবার বিগলিত হেসে বললেন,
“নাকি দুই ভাইয়ের একসাথে কাজ সেরে ফেলবা?”
আবারও উভয়পক্ষের মা-বাবা মুগ্ধ হয়ে বিস্তর হাসলেন।

(চলবে)

#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_১৭
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

২১.
ফায়াজের শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়ের বড় মামা আর চাচা এসেছেন। ছেলেকে ফার্নিচার দেবে। কাঠের দেবে নাকি অন্যকিছু, ম্যাট্রিক্সের মাপজোক নিয়ে কথা বলতে এসেছেন।
বাড়ির মূল ফটক অতিক্রম করে বৈঠকখানার মতো মোটামুটি বড় জায়গায় সোফার সেট বিছানো। পাশে ডাইনিং টেবিল। ডাইনিং টেবিলে বসে আমি পানি গিলছিলাম আর তাদের কিচ্ছা কাহিনী শুনছিলাম।

বিরক্ত হয়ে ভেতরের দিকে চলে গেলাম। আমার জন্য বরাদ্দ রাখা রুমে আম্মু আসতেই শাসানো গলায় বললাম,
“এইজন্য এই মহিলাকে আমি দেখতে পারি না। মেয়ের বাড়ি থেকে জিনিসপত্র পাওয়ার জন্য জিহ্বা চার হাত বের হয়ে আছে। ছোটলোক!”
আম্মু জিহ্বায় কামড় দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। দরজাটা সন্তর্পণে আটকিয়ে আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন।
“তুই বেশি পাকনামো করিস। বেয়াদব মেয়ে। মেয়েরা নিজেরাই দিতে চাইছে। না জেনে এডভান্স কথা বলবি না।”

আমার মায়ের এক সমস্যা। ছোটলোকের সঙ্গে থেকে ছোটলোকী মন-মানসিকতা নিজের মধ্যে ধারণ করতে চায়। কিন্তু আমার তো মেজাজ বিগড়ে গেলো। আমাকে এডভান্স কথা বলতে নিষেধ করা, বেয়াদব সম্বোধন করা তরতর করে রক্ত যেন শরীর নাড়া দিয়ে ওঠলো। কিছুক্ষণ স্থির নয়নে আম্মুর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আম্মু তেতে উঠে জিগ্যেস করলেন,
“কি? কি সমস্যা?”
আমি আম্মুর চোখের দিকে চোখ রেখে বললাম,
“ভবিষ্যতে যদি আমার মেয়ে হয়, আর সেই মেয়েকে যদি জিনিসপত্রের বিনিময়ে বিয়ে দিতে হয়; আগে নিজের মাথা কুড়াল দিয়ে কাটবো, পরে বেঁচে থাকলে নিজের মেয়েকে কুচি কুচি করে কাটবো।”
আম্মু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে চলে গেলো।

বড় হচ্ছি? আসলেই বোধহয় হচ্ছি। আজকাল অনেক কিছু নিয়ে আম্মু কিংবা আব্বুর সঙ্গে আমার শান্ত কিন্তু জোরালো ঝগড়া সংঘটিত হয়। কেউ জানে না, কেউ শুনে মাঝেমধ্যে আমার শিরায় শিরায় কেমন আগুন ধরে। সেইসময় প্রিয়লের সঙ্গে আমার অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ের কথা মনে পড়ে যায়। ফাহাদের পরিবারের ফায়াজ ভাইয়ের হবুর মতো আমাকে বৈধভাবে বিক্রির আয়োজন না করলে এসব হতো না। হলেও তো তাদের জানাতাম। কিন্তু কি করছি? না জানিয়ে অজানা একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করছি। তাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে মনপ্রাণ উজাড় করে দিয়েছি। আর তার কাছ থেকেই আমার হৃদয়ের সকল ব্যথার ঔষধ সংগ্রহ করছি।

সাকেরা খোলা দরজা দিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে প্রবেশ করলো। আমাকে রাগান্বিত মুখায়বে বসে থাকতে দেখে খানিক মাথা ঝুঁকিয়ে জিগ্যেস করলো,
“ভাবি তোমার কি মন খারাপ?”
আমার রাগ কমে গেলো। বিস্ময় নিয়ে তাকালাম। সাকেরা ফের আমার সঙ্গে ভাবি-ভাবি খেলা খেলে দুষ্টুমি করছে।
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার ভঙ্গি করে মুখ বিকৃত করে বললাম,
“আসতাগফিরুল্লাহ! আপামণি কি বলেন এসব?”
আমার রাগ নেই আন্দাজ করে সাকেরা তার সর্বজনীন দুষ্টমাখা হাসি নিয়ে কোমরে হাত রেখে দাঁড়ালো।
ঠোঁট গোল করে বললো,
“ওপস!”
আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম। সে আমার পাশ ঘেঁষে বললো,
“কেন জানি তোমাকে দেখলে বারবার ভাবি চলে আসে। মুখটাকে স্কচটেপ দিয়ে আটকে রাখতে চাইলেও পারি না।”
চকিত হয়ে গালে হাত ঠেকিয়ে বললো,
“এটা কোনো ইঙ্গিত নয় তো! ফায়াজ ভাইয়ার তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তবে কি ফাহা.. ”
“তবে রে!”
আমি সাকেরার কান মলে দিতে তার পিছন পিছন ছুটলাম।
এসব বার্তা যে ফাহাদের শেখানো, আর আমার কাছে পৌঁছানোর ষড়যন্ত্র আমি তা খুব ভালো করেই জানি।

সাকেরা চুপটি করে তার বাবার পাশে সোফায় গিয়ে বসলো। আড়চোখে আমাকে দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো।

মোজাম্মেল চাচ্চু সামনে বসে থাকা মাঝ বয়সী লোকটার উদ্দেশ্যে প্রসন্ন হাসি দিয়ে বললো,
“মকবুল সাহেব, আপনার মেয়ে আমার মেয়ের মতোই থাকবে।”
পাশ থেকে আন্টি বললেন,
“হ্যাঁ ভাই, আপনার মেয়েকে এনে কয়দিন আরেক মেয়েকে আনবো। তিনজন মেয়ে নিয়ে হবে আমার সোনার সংসার।”
পরের কথাটুকু না বললে তো আমি ধরেই নিচ্ছিলাম যে, ফায়াজের জন্য তার মাতা আরেকটা মেয়ে আনবে। কথার কি ছিরি! মকবুল সাহেবের চেহারাও এক মুহূর্তের জন্য ফ্যাকাশে হয়ে ওঠেছিল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর তাদের কথাবার্তায় বুঝলাম উনিই ফায়াজ ভাইয়ার হবু শ্বশুর। মেয়ের বড় মামা আর চাচাকে পাঠানোর পর তিনি নিজেই এলেন।

মোজাম্মেল চাচ্চু আমাকে লক্ষ্য করে কাছে ডাকলেন।
আমি গেলাম। আমার আব্বুকে ইঙ্গিত করে বললেন,
“ও হলো এই ভাইয়ের মেয়ে। আমার আরেক মেয়ে।”
টিপ্পনি ভঙ্গির কথা শুনে আমি চোয়াল শক্ত করে রইলাম।
মকবুল সাহেব উৎফুল্ল গলায় বললেন,
“ওহ আচ্ছা, আচ্ছা। এটা তাহলে আপনার আরেক মেয়ে? মাশাল্লাহ। মা এদিকে আসো তো।”
আমাকে উনার পাশে বসতে ইশারা করলেন।
আমিও শান্তভাবে ভদ্র মেয়ে হয়ে বসলাম।
উনি নমনীয় গলায় জিগ্যেস করলেন,
“ভালো আছো মা?”
সবার আধো আধো, খাপছাড়া, বেখেয়ালীর বেখাপ্পা টুকরো টুকরো বাণীতে বুঝলাম আমার কথা এই বাড়িতে এবং এই বাড়ির মানুষের আত্নীয়দের সঙ্গে বিস্তর আলোচনা করা হয়েছে।
মাথার থিতিয়ে থাকা রাগটা অনুমতি নিয়ে বাড়তে চাইলো। অনুমতি দিলাম না, টোকা মেরে ডাস্টবিনে পাঠালাম।
আমি হাঁটুতে দুই হাতের করতল স্তুপাকারে স্থাপন করে ফায়াজ ভাইয়ার হবু শ্বশুরের দিকে তাকালাম।
মিষ্টি হাসি ঠোঁটে অঙ্কন করে জিগ্যেস করলাম,
“ভাইয়াকে নাকি অনেক কিছু দিচ্ছেন? খাট ফার্নিচার?”
আমার বোকা প্রশ্নে আমার মা ছাড়া সবাই হাসলো। আম্মু প্রথমে চমকে উঠে তাকালো। নিজের জায়গা ছেড়ে খানিক নড়েচড়ে কাছে এলো। পরক্ষণেই দৃষ্টি সরিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে স্থির রইলো।
আমি বলতে শুরু করলাম,
“এগুলো কি আঙ্কেল-আন্টি চেয়েছে? বায়না করেছে নাকি নিজ দায়িত্বে প্রদান করছেন?”
আমার কথার সুরে বুঝে যাওয়ার কথা এবড়োখেবড়ো বাণী আমি ছুড়িনি। ভেবেচিন্তেই করেছি এবং স্বচ্ছ সোজা উত্তর দাবি করে করছি। মকবুল সাহেব নেহাত ভালো মানুষ। খেঁকিয়ে উঠলেন না।
বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে বললেন,
“অনেকটা মিউচুয়াল। মানে এটা তো অনেকটা প্রচলিত ব্যাপার। আমার দেওয়ার সামর্থ্য আছে, আর ছেলের মা-বাবা.. মানে সমস্যা তো নেই?”
“সমস্যা তো আছে আঙ্কেল। আমি যখন প্রথমে ব্যাপারটা শুনলাম, একটা শব্দ প্রথমেই মাথায় এলো। ছোটলোক! ছোট শব্দ, কিন্তু কত নিকৃষ্ট। অভাব নেই ঠিক আছে; কিন্তু মানুষ ভাবলে তো এমনই বলবে। এতে চাচ্চু এবং ফায়াজ ভাইয়ারও সম্মানহানি।”
আঙ্কেল হেসে বললেন,
“আমি তোমার কনসার্ন বুঝতে পারছি মা। যৌতুক বিরোধী তুমি। কিন্তু এখানে ঠিক তা হচ্ছে না। আর লোকের কথায় কান না দেওয়াটাও একটা বিচক্ষণতা।”
আমি শীতল ভঙ্গিতে বললাম,
“লোকের কথা আমি কানে নেই না আঙ্কেল। কিন্তু প্রচলিত শব্দ প্রয়োগের সঙ্গে সুষ্ঠু সম্পর্ক গঠনের পন্থা হিসেবে রাজকীয় ফার্নিচার আদানপ্রদান কর্মকে একজন বিচক্ষণই ছোটলোকী বলবে। আমি কখনো এক ছোটলোককে আরেক ছোটলোকের কর্মের উপর নাক ছিটিয়ে সমালোচনা করতে দেখিনি। যৌতুক বিরোধীও হতে দেখিনি। দেখছি কড়ায় গন্ডায় জিনিসপত্র না দিলে তাদের দৃষ্টিকটু অঙ্গভঙ্গি ও মুখের বুলি। সর্বশেষে, তাদের জন্যই কুসংস্কার হলো প্রচলিত এবং ঐতিহ্যের ধারক-বাহক।”
মকবুল সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
ফাহাদের মা হতবিহ্বলতা নিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে গলা চওড়া করলেন। আমাকে মৃদু ধমকে বললেন,
“তুমি এখান থেকে যাও।”
আমি চোখ ফিরিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। অনেকটা ফিসফিসানি লোমহর্ষক গলায় জিগ্যেস করলাম,
“কোথায় যাবো?”
উনি থমকালেন, আর আমি তা-ই চাইলাম।
মকবুল সাহেব আমাকে জিগ্যেস করলেন,
“যৌতুক দেব না?”
আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম।
উনি মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“তুমি ঠিকই বলেছো আম্মু। জিনিসপত্র দেওয়া যৌতুকের অন্তর্ভুক্তই। উপরন্তু আমাদের মতো মানুষ এটাকে বেশি প্রশ্রয় দেয় প্রচলিত অভিহিত করে। এমন তো না যৌতুক না দিলে মোজাম্মেল ভাই আমার মেয়েকে মেরে ফেলবেন। কি ভাই, তখন আর মেয়ের মতো রাখবেন না?”
চাচ্চু নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমার আব্বু তখন বললো,
“কেন রাখবে না ভাই? মেয়ে তো মেয়েই।”
তখন মোজাম্মেল চাচ্চু হেসে মাথা নাড়লেন।
মকবুল সাহেব বললেন,
“ঠিক আছে। তাহলে যে টাকা ছেলে বাড়ি খরচ করবো বলে রেখেছিলাম তা গরীব মিসকীনদের আলাদাভাবে দেওয়ার আয়োজন করবো। বিয়ের দিন বা গায়ের হলুদের দিন।”
নতুন আলোচনায়, নতুন সিদ্ধান্তে মোটামুটি সবার মুখেই হাসি ফুঁটে ওঠলো। বিয়ে বাড়ি উৎসব মুখরিত পরিবেশ নতুন আনন্দের ছাউনিতে সজ্জিত হলো।
শুধু একজন ব্যতীত সবাই তা উপভোগ করলো। আর তিনি হলেন ফাক-আদের আম্মাজান।

তখন থেকে উনি সারাদিন আমার সঙ্গে কথা বলেন না। থমথমে মুখ নিয়ে থাকেন। আর আমি ফাবলীহা এসবে অনেক পাত্তা দেই। ঠেঙ্গা দেই, ঠেঙ্গা!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here