তুমিই_আমার_পূর্ণতা,পর্ব ৮

0
1518

#তুমিই_আমার_পূর্ণতা,পর্ব ৮
#মেহরাফ_মুন (ছদ্মনাম )

মহামায়া লেক একটি প্রাকৃতিক লেক। বিশাল এলাকা জুড়ে পাহাড়ি লেকের পানি দিয়ে এই এলাকা গঠিত। এখানে রয়েছে পাহাড়ি গোহা, রাবার ড্যাম এবং ঝরনা। মুহুরি নদী ফেনী জেলা এবং নোয়াকালী জেলা থেকে এটিকে আলাদা করেছে। এটিকে চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বারও বলা যায়।

কিছুক্ষনই হলো আদ্রাফরা এসে পৌঁছেছে। গাড়ি থেকে নেমেই গেট থেকে ইকো পার্কের টিকেট কেটে ঢুকে পড়লো ওরা সবাই।
ইকো পার্ক থেকে সরু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে দশ মিনিট হাটতেই সেই কাংক্ষিত জায়গা মহামায়া লেকে পৌঁছালো ওরা সবাই।

———————————

আমাদের গাড়ি মাত্রই এসে পৌঁছালো সেই কাংক্ষিত জায়গায়। অবশ্য গাড়ি পুরোপুরি মহামায়া লেকে যায় না, একটা পার্ক থেকেই দশ মিনিট হাটতেই মহামায়া লেকে পৌঁছা যায়।
আমরা গাড়ি থেকে নামতেই ইকো পার্কে ঢুকলাম। ইকো পার্কে ঢুকতেই চারপাশের সবুজ নিপোবনে নিজেকে আবিষ্কার করে এক স্বর্গীয় মতন অনুভূতি অনুভব করলাম। আশেপাশে মাঝারি উচ্চতার পাহাড়, মাঝখানে দিয়ে চলে গিয়েছে মহামায়া লেকে যাবার রাস্তাটি। আমরাও সেই রাস্তা অনুযায়ী চলতে লাগলাম। রাস্তা ধরে দশ মিনিট হাটতেই মহামায়া লেকে পৌঁছে গেলাম।

মহামায়া লেক! এক অপূর্ব সুন্দর জায়গা। যেটি নিজের চোখে না দেখলে এর সৌন্দর্য কোনোদিনও বোঝা সম্ভব না। যেন কোনো শিল্পীর সুনিপুন হাতের রঙ তুলিতে আঁকা কোনো ছবি। এতটাই সুন্দর চারদিকে। হালকা সবুজাভ স্বচ্ছ পানি,পানির ওপর চারদিকের সবুজ পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি, অসাধারণ প্রতিটি দৃশ্য, বর্ণাতীত সেই অনুভূতি। লেকের পাড়ের নির্মল বাতাস আমার শরীর ও মনকে মুহূর্তের মধ্যেই সতেজ করে তুললো।

মহামায়া লেকের আরেকটি মূল আকর্ষণ হলো কায়াকিং। পাহাড়ে ঘেরা লেকে কায়াকিং করার মজাটা একদম মিস করা যাবে না।
কায়াকিং করার সময় লেকের ঠিক মাঝে গিয়ে চোখ বন্ধ করে দু’হাত পাখির মত মেলে কিছুক্ষনের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছে যেন সময়টা থেমে যাবে, মস্তিস্ক হয়ে যাবে ভারশূন্য। প্রকৃতির ভয়ানক স্নিগ্ধতা যেন গ্রাস করেছে। প্রকৃতি যে কতটা রহস্যময়, সেটার কিছুটা হলেও হয়তো উপলব্ধি করতে পেরেছি।

সেই সময়ই আদ্রাফরা কায়াকিং করে নেমেছে মাত্র। হঠাৎ মনে হলো ওই দূরের ভোটটাতে পাখির মত ডানা মেলে মুনের মত কেউ একজন বসে আছে। অবশ্য পুরোটা চেহেরাই অস্পষ্ট। আদ্রাফ নিজেই নিজের মাথায় বারি দিল, মস্তিষ্কের সাথে সাথে চোখগুলোও হয়তো গিয়েছে। মুনের কথা ভাবতে ভাবতে যাকে তাঁকে মুনের মত মনে হচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতেই আদ্রাফরা ঝর্ণার পথ ধরে হাঁটা ধরল।
.
.
কায়াকিং শেষ করে এখানে একটা ঝর্ণা আছে। ওই ঝর্ণা অনুসারে হাটতে লাগলাম আমি, মিম আর দিমান আর পিছনে আরও কিছু একই ক্লাসের শিক্ষার্থীও আসছে।
আমরা হাটতে হাটতে ঝর্ণার ধারে চলে আসলাম। পাশেই একটা ছোট-খাটো কূপড়ি টাইপ দোকান আছে।
মুন, মিম আর দিমানরা বাদাম চিলতে চিলতে খেতে খেতেই গল্প করছিলো। কথা বলার মাঝখানেই মিমের কাশি উঠে যাওয়ার কারণে মুন মিমের কাছে দিমানকে রেখেই ওই দোকান থেকে পানি আনতে গেল। পানির বোতল নিয়ে আসার সময়ই কেউ একজনের সাথে ধাক্কা খেয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে দুঃখিত বলেই তাড়াহুড়ো করে মিমের কাছে এসে পানি খাওয়ানোর পরই একটু সুস্থবোধ করল মিম।


আর এদিকে আদ্রাফ যেন স্তব্ধ। এটা কী ওর ভ্রম না-কি সত্যিই মুন ছিল এটা। কিন্তু ভ্রম কীভাবে হবে এটা স্পষ্ট মুনেরই কণ্ঠ ছিল। এত মাস ধরে যাকে খুঁজে চলেছে সেই আজ এখানে, ওরই চোখের সামনে দিয়ে গেল। আদ্রাফ যেন বাকহারা। কী করবে ও ভেবে পাচ্ছে না। এটা সত্যিই মুন? আদ্রাফ দ্রুত পিছন ফিরেই দেখল কেউ নেই ওখানে। কিন্তু ও দেখেছে মুনকে স্পষ্ট দেখেছে। আদ্রাফ যেন একটা ঘোরের মাঝে আছে। ওও আসছিলো পানির বোতলের জন্য দোকানে। যে কাজের জন্য আসছিলো ঐটা না নিয়েই ও আবার বন্ধু-মহলে ফেরত গেল। আদ্রাফকে এত তাড়াতাড়ি আর খালি হাতে ফিরে আসতে দেখেই শুভ্র বলে উঠলো,

-‘কীরে, এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি যে আর পানির বোতল-ই বা কই? আমি তো নিজেই গিয়ে আনতে চেয়েছিলাম, তুইই তো আমাকে যেতে না দিয়ে নিজে গেলি, এখন খালি হাতে ক্যান?’

আদ্রাফ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলো,

-‘মুনকে দেখেছি।’

-‘ কী? কোন মুন?…. ও মুননন! তুই সত্যি বলছিস? আরে দূর এটাও হয়তো তোর ভ্রমই হবে। এই দুইবছরে তুই প্রতি জায়গায় মুনকে দেখিস কিন্তু সামনা-সামনি এটা অন্য কেউ। এবারই এমন কিছু দেখছিস। আদ্রাফ এই সবকিছুই তোর ভ্রম।’

-‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, মুন এই জায়গায় আছে এটা।’

শুভ্রর এবার আদ্রাফকে সিরিয়াসভাবে নিল। তাই শুভ্র আদ্রাফকে বলল,

-‘কোন জায়গায় দেখেছিস? চল।’

আদ্রাফ ওকে দোকানের সামনে যেই জায়গায় মুন ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে চেয়েছিল সেই জায়গায় নিয়ে আসলো। নিয়ে এসেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব বলল। আদ্রাফ দোকানে আসতেই মেয়ে একটা তাড়াহুড়ো করে বের হতে গিয়ে হাতের পানির বোতলটা নিচে পড়ে গিয়েছিল এরপর আদ্রাফকে দুঃখিত বলে খেয়াল না করেই চলে গিয়েছিল আদ্রাফ প্রথমে ভ্রম মনে করে দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু এরপর যখন পিছনে ফিরল তখন না-কি আর দেখেনি মেয়েটাকে।

শুভ্র আদ্রাফের মুখ থেকে এসব শুনেও বিশ্বাস করতে পারলো না কারণ গত দুই বছর ধরেই আদ্রাফ মুনের মত মেয়ে দেখেই চলেছে কিন্তু একবারও সত্যি হয়নি এটা। শুভ্রর মাঝে মাঝে অনেক আপসোস হয় যে তার এই ভাইয়ের মত বন্ধুটা মানসিকভাবে এতটা বিপর্যস্ত কীভাবে হলো? পুরো বিসনেস এর সবাই আদ্রাফকে প্রচুর সম্মান করে শ্রদ্ধার চোখে দেখে কিন্তু তারা তো শুধু বাইরের আদ্রাফকে দেখছে ভিতরের আদ্রাফকে তো কেউ দেখছে না, বাইরে যতটাই শক্ত, গম্ভীর থাকুক না কেন এই মানুষটা ভেতরে অনেক নরম মনের। এই দুইটা বছর তো মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙে পড়েছে আদ্রাফ কিন্তু বাইরে একদম শক্ত থাকে শুধু শুভ্রর সামনেই ভেঙে পড়ে। শুভ্রর অনেক খারাপ লাগে, যদি এই ভাই সমান মানুষটার জন্য কিছু করতে পারতো? যদি পারতো মুনকে আদ্রাফের সামনে এনে ওর ভুলগুলো ভাঙিয়ে দিতে! তাই এবারও শুভ্র এটা আদ্রাফের ভ্রম বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু অদূরেই কেউ একজনকে দেখে তার চোখ আটকে গেল। তাহলে কী আদ্রাফ সত্যিই বলেছিলো এবার? এটা সত্যিই মুন! তাঁর মানে মুন কী আদ্রাফ থেকে লুকিয়ে চট্টগ্রামেই চলে এসেছিলো। এখন এসব ভাবার সময় নয়, শুভ্র দ্রুতই ঐদিকে হাঁটা লাগালো। আদ্রাফ মনে করল প্রতিবারের ন্যয় এবারও শুভ্র আদ্রাফের এই কথাটাকে ভ্রম মনে করে গ্রাহ্য না করে হাঁটা লাগালো। তাই আদ্রাফও শুভ্রকে পিছনদিকে ফেলে উল্টো পথ ধরে বন্ধুমহলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।

শুভ্র সামনে গিয়েই দেখতে পেলো মুন আর আরেকটা মেয়ে আর ছেলে। ওর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে নাহ ও আদ্রাফের মুনকে দেখছে, মুনকে সত্যিকারে এখন দেখলে আদ্রাফের কী রিএক্ট হবে! শুভ্রর এই প্রথম মনে হলো ও আদ্রাফের জন্য কিছু একটা করতে পারবে। শুভ্র ওদের সামনে গিয়েই বলল,’ হাই, আমি শুভ্র। আপনি কী মুন?’

মুন পিছন ফিরে শুভ্রকে দেখেই ভুত দেখার মত চমকে উঠলো। দুই-বছর আগে শুভ্রকে সে দেখেছিলো, যদি এখন নাম না বলতো তাহলে চিনতো না কোনোদিনও। মুন কোনোমতে বলে উঠলো, ‘আপনি?’

-‘হ্যাঁ আমি। চিনতে পেরেছো তাহলে! আসলে এখানে আমি তোমাকে দেখিনি আদ্রাফই তোমাকে বোতল আনার সময় দেখেছিলো। ও গিয়েই আমাকে বলেছিলো কিন্তু আমিই ভ্রম বলে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কারণ কী জানো এই দুইবছর আদ্রাফ প্রতি জায়গাতেই না কি তোমার মত কাওকে দেখতো। ও মানসিকভাবে অনেক ভেঙে পড়েছে।’

মুন আদ্রাফ এখানে শুনেই স্তব্ধ। মানুষটাকে ও এখনো ভুলতে পারেনি। কতদিন পর এই নাম কেউ বলল। কেমন আছে মানুষটা? হয়তো বিয়ে করে পরিবার নিয়েই আসছে এখানে। কিন্তু মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে মানে! আর ভ্রমই বা কেন হবে? মুনের মনে অনেক প্রশ্ন এসে জমা হয়েছে এই সব প্রশ্নের উত্তর এখন সামনে থাকা ব্যক্তি শুভ্রই দিতে পারবে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here