তুমিময়_অসুখ
পর্ব-১২
#লেখিকা-ইশরাত জাহান ফারিয়া
২৩.
ভাবতেই পারছি না, এসব কি তবে স্বপ্ন ছিলো? স্বপ্ন কখনো এমন হয়না। আমি ওনার থেকে মাত্র একদিন দূরে থেকেই ওনার প্রতি আমার ভালোবাসা, টান সবকিছু বেড়ে গেলো। আবার ওনাকে বলেও ফেললাম, যে আমি ওনাকে ভালোবাসি! আসলেই, দূরে গেলেই ভালোবাসা টের পাওয়া যায়, আরও গভীর হয়।কাছাকাছি থাকলে ভালোবাসা বুঝতে যতটুকু সময় লাগে, দূরে গেলে মুহূর্তেই সেটা বোঝা হয়ে যায়।
সবকিছু কেমন হঠাৎ করে হয়ে গেলো। আমার জীবনটাই অদ্ভুত আর আমার সাথে যা কিছু হয়, সবসময় হঠাৎ করেই হয়ে যায়। ভাবনার রাজ্যে ঢুকলাম।
হঠাৎ একদিন ভিনদেশ থেকে অভ্র ভাইয়া এলো, আমি জানতে পারলাম আমাকে বিয়ে করার জন্য ওনি এসেছেন, কিন্তু আমি রাজি না হয়ে ওনাকে রিফিউজ করে দিলাম। কিন্তু হঠাৎ
ওনার পাল্টে যাওয়া আবারও সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। একদিন হুট করেই ওনার সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায় আর হঠাৎ করেই আমিও ওনার মতো তুমিময় অসুখে আক্রান্ত হয়ে ওনার ভালোবাসার গভীর জালে আটকা পড়ি! কি অদ্ভুত, তাই না?
ভালোবাসার কোনো সংজ্ঞা আমার জানা নেই। আর জানতেও চাইনা। সবকিছু জেনে গেলে জীবনের মোরাল বিষয়টাই অন্যরকম হয়ে যাবে, তার চেয়ে জীবনে টুইস্ট থাকা ভালো। আনন্দ, অনুভূতি, হাসি-কান্না নিয়ে জীবন কাটানোর মাঝেই সার্থকতা। সুখের পরেই যেমন দুঃখ আসে ঠিক তেমনই দুঃখের পর সুখ নামক পায়রাটিও আসে। এই মুহূর্তে আমি সবচেয়ে সুখী। এতোটা সারপ্রাইজড জীবনে কোনোদিন হইনি। অভ্র ভাইয়া আমার জন্য খুশিতে কান্না করেছেন, এটাই আমার জীবনের অন্যতম সেরা গিফট। ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে ‘ভালোবাসি’ শব্দটা শুনলে ঠিক কি অনুভূতি হয় সেটা আমি বোঝাতে পারবো না।
এইসবকিছু ভাবতে ভাবতে আমি ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালবেলা! ঘুম হঠাৎ ভেঙে গেলো, বুঝতে পারলাম আম্মু ডাকছে। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলাম। আম্মু রেগে বললো, ‘সারারাত না খেয়ে দরজা বন্ধ করে মরার মতো ঘুমাচ্ছিলি আর এতো সকাল হয়েছে এখনো উঠিসনি! পরীক্ষা যে আর এক সপ্তাহ পরে সে খেয়াল কি আপনার নেই?’
বুঝতে পারছি আম্মু এই মুহূর্তে কাঁচা গিলে ফেলা টাইপ রেগে আছে। সেজন্য বললাম, ‘আসলে সারারাত পড়েছি তো, তাই এত বেলা হয়ে গেলো।’
আম্মু সরু চোখে তাকালো। সন্দেহী গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই সারারাত পড়েছিস? এতো বদল কোনসময় হলো তোর?’
আমি বললাম, ‘বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েরা অনেক পাল্টে যায়, জানো না?’
—“কিহ?”
—“কিছুনা!”
—“সারারাত পড়াশোনা করেছিস ভালো কথা, না খেয়ে বসে ছিলি কিভাবে! আয়, খাবার দিচ্ছি।”
—“তুমি যাও, আসছি!”
—“আচ্ছা!”
আম্মু চলে গেলো। আর আমি ভাবছি মিথ্যা বলাটা ঠিক হয়নি, এমনিতেই সারাদিন কতশত গুনাহের কাজ করি। তার ওপর আবার মিথ্যা বললাম যাতে অস্বস্তিতে না পড়ি। নাহ, এভাবে মিথ্যা বলাটা ঠিক হয়নি। কিন্তু আমি যে সারারাত পড়াশোনা না করে অভ্র ভাইয়ার জন্য কান্না করেছি আর ওনার পাঠানো খাবারও খেয়েছি এটা বলতে তো আমার লজ্জ্বা লাগতো!
যাইহোক, আমার ওনিটা না জানি সকাল সকাল কি করছেন। এমনিতে ওনার সাথে থাকলে খুব সকালে আমাকে ঘুম থেকে তুলে উল্টাপাল্টা কথা বলে আমার সাথে ঝগড়া করার চেষ্টা করতেন। আমার হাসি পেলো, কিছুক্ষণ হেসে ফ্রেশ হতে গেলাম। আজ আবার নতুন টিচারও আসবে, এক সপ্তাহে সব নোট, বই সবকিছু ভালো করে রিভাইস করানোর জন্য।
২৪.
ব্রেকফাস্ট শেষে রুমে এসে আবারও পড়ায় মনোযোগী হলাম। অভ্র ভাইয়ার কথা মনে হতেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলাম, উনি অনেকক্ষণ আগে ম্যাসেজ করে রেখেছেন। আসলে ম্যাসেজিং করতে আমি কমফোর্ট ফিল করি, তাই।
ম্যাসেজে লেখা – ‘শোন তোর এক্সাম পর্যন্ত তোর আর আমার মাঝে কোনো বাইরের কথা হবে না, বুঝলি? যেটা হবে সেটা একমাত্র পড়াশোনা নিয়ে। তাও আবার সারাদিন মোবাইলে না, যখন আমার সময় হবে তখন। ভালো করে পড়াশোনা কর, যদি ভার্সিটিতে চান্স না হয় তাহলে দেখিস তোর কি হাল করি। গট ইট?? আর ভালোবাসার কথা, তোর বরের কথা এক্সাম পর্যন্ত ভুলে থাক। আমার ম্যাসেজ এখানেই শেষ, আর রিপ্লাই করতে হবেনা।”
আমার মনটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। এ কেমন মানুষ ওনি? হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে, নাহ! ওনি অদ্ভুত আর খুব বেশিই
অদ্ভুত। এটাকেই হয়তো রিভেঞ্জ বলে। ইট মারলে পাটকেলটি খেতে হয়। এতদিন আমি এভোয়েড করতাম। আর এখন যখন সবকিছু ভুলে ওনার সানিধ্যে থাকার চেষ্টায় রত, ঠিক তখনই এক্সামের দোহাই দিয়ে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ! কাঁদলাম আবারও। ইলহাম এসে আমাকে এভাবে হুদাই কাঁদতে দেখে সারাবাড়ি রটিয়ে দিলো যে, ‘আমি নাকি পড়াশোনা কিছু পারিনা, সেজন্য হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদছি!’
এ নাকি বোন! বোনের আর কি দোষ? নিজের বরই যদি এভাবে রিভেঞ্জ নেয়, তাহলে বোনের আর দোষ কোথায়? কথায় বলে, ‘হাতি কাদায় পড়লে ব্যাঙও লাথি মারে!’ আমার জীবনে এই কথাটি এই মুহূর্তে ১০০ ভাগ সত্যতা পেলো।
২৫.
একসময় ইলহাম এসে আমার রুমে ঢুকলো। মিটিমিটি হেসে আমাকে বললো,
—“আপ্পি তোমার স্যার এসেছে!”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
—“কোন স্যার? কিসের স্যার!”
—“তুমি গিয়েই দেখো!”
বলেই মিটিমিটি হেসে ইলহাম চলে গেলো। আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠলাম। ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে উঠে গেলাম স্টাডি রুমে। ওখানে ইরাদ ভাইয়া পড়াশোনা করে। গিয়ে দেখলাম, উল্টো ঘুরে আমার নতুন টিচার বসে আছেন। আম্মু ধমকে আমাকে বসতে বললো।
মুখ কালো করে চেয়ারে বসে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি অভ্র ভাইয়া! আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কাউকে গভীরভাবে ভালোবাসলে নাকি হ্যালুসিনেশিন হয় মাঝমাঝে, আমারও কি এরকম হচ্ছে? আমাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে অভ্র ভাইয়া রেগে এক ধমক দিলেন। আম্মু বললেন, ‘পড়াশোনাতে এ মেয়ের মন নেই, তুই কড়া করে পড়াবি বাবুটা। দরকার হলে বেত/লাঠি যা বলবি এনে দেবো। পড়া ভুল করলে পিটিয়ে ছাল ছাড়িয়ে নিবি বাবা! আমি আসি!’
আম্মু ভাষণ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি লজ্জ্বা পাচ্ছি, রাতের বেলার সব কথা আমার মনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। তখন তো মোবাইলে কথাবার্তা বলেছিলাম, কিন্তু এখন সামনা-সামনি ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। ওনি গর্জন করে বলে উঠলেন, ‘স্যারকে যে সম্মান দিতে হয়, জানিস না মেয়ে?’
আমি মাথা নিচু করে বললাম, ‘কিন্তু বর আবার স্যার হয় কিভাবে?’
ওনি রেগে বললেন, ‘আমি কি তোর সাথে প্রেমালাপ বসাতে এসেছি ডাফার?’
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আচ্ছা!’
—“কি আচ্ছা? আমি কি এখানে ‘আচ্ছা, আচ্ছা’ খেলতে এসেছি নাকি পড়াতে এসেছি?”
—“পড়াতে!”
—“তাহলে বইখাতা খুলছিস না কেন? তোর মাথায় কি চলছে বল তো! পড়াশোনা না করে কি ভিক্ষুক হতে চাস?”
—“পড়াশোনার সাথে ভিক্ষুক হবার কি সম্পর্ক?”
—“আমি কি তোকে এখন ‘সম্পর্ক’ বুঝাবো?”
আমি ধমক খেয়ে চুপ। দিনদুপুরে এমন নিরামিষ ব্যবহার করছে কেন আমার সাথে? একটা বেত্তমিজ লোক। যে ভয়ংকর ভাবে কথা বলছে এখন যদি দেখে আমি পড়াশোনায় মনোযোগী না, তাহলে মানসম্মান শেষ! নতুন নতুন বিয়ে করা বৌ যে হঠাৎ এমন অমনোযোগী ছাত্রী হয়ে গেলো আমার শিক্ষক বর কি আর তা বুঝবে?
ওনি রামধমক দিয়ে আমার ধ্যান ছুটালেন। আম্মু এসে অগ্নিচোখে আমাকে দেখলেন। বেতটা অভ্র ভাইয়ার হাতে দিয়ে আমাকে পড়াশোনায় মনোযোগী করে তুলতে বলে চলে গেলো। অভ্র ভাইয়া বাঁকা হাসি দিয়ে আমাকে বললো, ‘আমি তোকে বাংলা বাদে সবকিছু পড়াবো।’
—“আপনি বাংলা পারেন না?”
—“আমি কি বাংলা পড়েছি যে পারবো? বেশি পকপক না করে বইখাতা খুলে পড়া শুরু কর!”
—“বলছিলাম কি…!”
—“স্টপ ইট ডাফার! কোনো প্রশ্ন না করে পড়তে থাক। আটকে গেলে আমি হেল্প করে দিবো। বি রেডি!”
আমি বই খুলে পড়ায় মনোযোগ দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বিষাক্ত মনটা আড়চোখে ওনাকে দেখায় রত। অভ্র ভাইয়া যখন আমার পড়া ধরলেন, আমি কিছুই বলতে পারলাম না। অথচ আমি সেগুলো পারি। অভ্র ভাইয়া রেগে ঠাস ঠাস করে আমার হাতের উল্টো পিঠে চপাত চপাত দু’ঘা বেতের বারি বসিয়ে দিলো। আমার চোখে পানি এসে গেলো। সামনে বসা মানুষটাকে ভালোবাসি বলেই না পড়ায় একটু অমনোযোগী হয়ে গিয়েছিলাম। ওনার সুন্দর মুখ, চোখ, চুলের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের পড়ায় ফাঁকি দিলাম। আর সেই একটু কারণের জন্য ওনি আমায় মারলো? নির্দয় লোক! ওনার চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ওনি আমার ভাবনায় এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে আমার কপালে চুমু দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর আমি হতভম্ব হয়ে কপালে হাত দিয়ে বসে রইলাম। রিয়েকশন ঠিক কেমন হওয়া উচিত বুঝলাম না।
?”জমিনের মধ্যে এমন কোনো প্রাণী নেই,
যার রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহ নেননি”।
– (সূরা হুদ ১১:৬)
চলবে… ইনশাআল্লাহ! কি মনে হয়? আর কত পর্ব হতে পারে? গঠনমূলক মন্তব্য পেলে লিখার উৎসাহ বেড়ে যায়!