তুমিময়_অসুখ পর্ব-৪

0
4540

তুমিময়_অসুখ
পর্ব-৪
#লেখিকা-ইশরাত জাহান ফারিয়া

৮.
সকালবেলা ছাদে বসে খাচ্ছি আর পাশের বাসার ছাদে লাগানো ফুলগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখছি।ফুল গুলো ছেঁড়ার প্রচন্ড ইচ্ছে হলেও আমি কখনোই ফুল ছিঁড়িনা। ঠিক তখনই অভ্র ভাইয়ার ম্যাসেজের কথা আমার মনে হলো, আর রাগও পেলো। বোনকে কেউ এসব ম্যাসেজ পাঠায়?উনার নাকি অসুখ হয়েছে, তাও আবার কি নাম! তুমিময় অসুখ!

আমি রোদে বসে আছি। তখন আব্বু এলো ছাদে। প্রতিদিন আমাদের ফুলের গাছগুলোতে পানি দেওয়ার দায়িত্ব আব্বুর উপর। অন্যের গাছের ফুল ছেঁড়ার ইচ্ছে থাকলেও কখনো নিজের গাছের ফুল আমি ছিঁড়ি না। মায়া হয়!

আব্বু এসে আমাকে বললেন, ‘সকাল সকাল ছাদে বসে কি করো?’

আমি ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলাম, ‘প্রেম করি!’

আব্বু সন্দেহী গলায় বললো, ‘কার সাথে?’

—“পাশের বাসার ছেলের সাথে!”

—“দেখাও কোন ছেলে!”

—“আরে আব্বু, দেখো! পাশের ছাদেই আছে। খোঁজে দেখো।”

আব্বু পাশের কয়েকটা বাসার ছাদে উঁকি দিয়ে কি যেন দেখে আসলেন। আমার কাছে এসে হু হা করে হেসে বললেন, ‘ভালো তো। যাক! অবশেষে মেয়ের মতি ঠিক হলো।’

বলেই আব্বু চলে গেলো। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, ‘আব্বু এসব কি বলে গেলো? আমি তো জাস্ট আব্বুর সাথে মজা করলাম। আব্বু কি সিরিয়াস ভাবে নিয়েছে? পাশের বাসার ছাদে আবার কোন আপদ? দেখতে হবে তো!’

ওঠে দাঁড়ালাম। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার ইচ্ছে করছে এই তিনতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে যাই। কয়েকটা বাসা পেরিয়ে একটু দূরের একটা ছাদে খালি গায়ে হাফপ্যান্ট আর লুপার পায়ে দিয়ে অভ্র ভাইয়া জিম করছেন। তিনি হয়তো আমাকে দেখেননি। একমনে পুশ আপ দিচ্ছেন। আমি উনাকে দেখে সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। আব্বু তাহলে উনাকেই দেখেছে? ভেবেছে আমি উনার সাথে প্রেম করছি? ওফ, এই লোকের জন্য আমার শান্তি সব মনে হচ্ছে বিনষ্ট হবে। আমি রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছি আর পাশ থেকে ভাইয়া এসে জোরে চিৎকার করে অভ্র ভাইয়াকে ডাক দিয়ে বললো, ‘কি করছো?’

আমি আচমকা চমকে ওঠে পাশে তাকাতেই দেখলাম ভাইয়া কফি খাচ্ছে। হাতে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে অভ্র ভাইয়াকে আবারও ডাক দিলেন। দ্বিতীয় বার ডাকায় অভ্র ভাইয়া এবার শুনতে পেলো। হাত নাড়িয়ে জবাব দিলো, ‘হাই!’

তারপর ভাইয়া আর উনি কথা বলতে লাগলেন এ ছাদ থেকে ওই ছাদে। আমি ভাইয়ার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। আর খেয়াল করে দেখলাম, উনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন না। আমার কেমন অদ্ভুত লাগলো। উনি কি আমাকে দেখতে পাননি নাকি? অথচ না দেখার ও কোনো অপশন নেই, তাহলে? যাক, আমি আবার এমন উতলা হচ্ছি কেন? যত্তসব!

৯.
দুপুরবেলা বসে বসে মোবাইল ঘাটছি এমন সময় আম্মু এসে বললো, ‘তোর নানু ফোন করেছে।’

—“কেন?”

—“তুই নাকি একবারও ওই বাসায় যাসনি?”

—“না।”

—“কেন যাসনি?”

—“এমনিই!”

—“আচ্ছা, তুই কি আমাকে অবিশ্বাস করিস?”

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন এমন মনে হলো?’

—“না তুই কি বিয়ের ব্যাপারটার জন্য যেতে চাইছিস না?”

—“তেমনটা নয় আম্মু।”

—“দেখ, এমনটা কখনো নয় যে তোকে আমরা জোর করে বিয়ে দেবো। তোর যেখানে বিয়ে হবার সেখানে অবশ্যই হবে। কিন্তু প্লিজ এখন তুই একটু ও বাসায় যা।”

আমি আম্মুকে সন্দেহী গলায় বললাম, ‘কোনো সিরিয়াস বিষয় আছে আম্মু?’

আম্মু চিন্তিত গলায় বললেন, ‘বাসার সবাই দলবল বেঁধে শহর ঘুরে দেখতে গিয়েছে। সাথে তোর নানুকেও নিয়ে গিয়েছে। এখন তোর মামা ফোন করে জানালো যে, ওদের সাথে অভ্র যায়নি। বাসায় রয়ে গিয়েছে। আর দুপুরের খাবার তৈরি করা হয়নি। এখন অভ্র যদি দুপুরে খালি পেটে থাকে তো ওর সমস্যা হবে। আমি যেতে পারবো না, তাই তুই খাবারটা নিয়ে দিয়ে আয়।’

আমি আম্মুর কথা শুনে অবাক হয়ে বললাম, ‘কখনো না। খালি বাসায় কিভাবে যাবো আমি?’

—“খালি বাসা কোথায়? অভ্র আছে। তুই যা আমি খাবার রেডি করে দিচ্ছি।”

—“তুমিও তো যেতে পারো আম্মু।”

—“আমিই যেতাম, কিন্তু তোর আব্বুর অফিসে যেতে হবে।”

—“কেন?”

—“জানিনা। তোর আব্বু ফোন করে বললো ইলহামকে নিয়ে অফিসে যেতে। ব্যাংকে কিসব কাজ আছে।”

আমি হতাশ হয়ে বললাম, ‘আচ্ছা দাও।’

আম্মু সব খাবার রেডি করে দিলেন। উনার জন্য খাবার নিয়ে যাওয়ার কি আছে বুঝলাম না। আমাদের বাসায় এসে খেয়ে নিলেই পারতো, কিন্তু তা না। উনার বেশ ইগো। কারো বাসায় গিয়ে কিছু খাবেন না, উনার খাবারের ধরণ আলাদা। স্পাইসি, ঝাল, তৈলাক্ত খাবার তিনি খান না। বিদেশে বড় হলে যা হয় আরকি। আর আমরা! যা পাই তা খাই, কি ভাজাপোড়া, কি তৈলাক্ত সব খেতে হয়। খাওয়া ছাড়া এ দুনিয়াতে আছেটা কি? তাও এ লোকের ঢং।

আম্মুও উনার জন্য আলাদা কিসব রান্না করে দিয়েছেন। আমি পড়নের জামা পড়েই রওনা দিলাম উনার বাসায়, পাঁচ মিনিটের দূরত্ব।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেল বাজাচ্ছি অনেকক্ষণ যাবৎ,কিন্তু কেউ খুলছে না। এরপর রেগে দিলাম একটা লাথি, নিজের লাথির শব্দ শুনে আমি নিজেই কেঁপে উঠলাম। দেখলাম, অভ্র ভাইয়া শরীরে টাওয়াল জড়িয়ে ভেজা গায়ে এসে দরজা খুললেন। আমাকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে বললেন, ‘তুই? আমার বাসায় কি করিস?’

আমি মাথা নিচু করে ভদ্র সেজে বললাম, ‘আম্মু আপনার জন্য খাবার পাঠিয়েছে।’

উনি কিছু না বলে তাড়াতাড়ি করে রুমে ঢুকে গেলেন। আমিও পেছন পেছন ঢুকলাম। অভ্র ভাইয়া উনার রুমে ঢুকে আচমকা দরজা লাগিয়ে দিলেন। আমি বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম দরজার বাইরে। বেশ খানিকক্ষণ পরে অভ্র ভাইয়া রুম থেকে বেরুলেন। গায়ে টি-শার্ট আর পরণে শর্ট জিন্স। আমাকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গম্ভীর গলায় ধমক দিয়ে বললেন, ‘এখানে অভদ্রের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

আমি কাঁপা গলায় বললাম, ‘তাহলে কোথায় দাঁড়াবো?’

—“যেখানে ইচ্ছা সেখানে দাঁড়াবি। আমার দরজার বাইরে দাঁড়ানোর পারমিশন আমি তোকে দিইনি। এখান থেকে শত হাত দূরে থাকবি। গট ইট?”

বলেই ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসলেন। গম্ভীর গলায় আবারও বললেন, ‘নে! খাবার রেডি কর। আর তাড়াতাড়ি বিদেয় হ!’

আর আমি উনার ব্যবহারে অবাকের সপ্তম আকাশে পৌঁছলাম। উনি এমন রুড বিহেভ করছেন কেন আমার সঙ্গে? আমার চোখে চোখ রেখে পর্যন্ত কথা বলছেন না। গম্ভীরমুখে বসে আছে, আর আমাকে হুকুম দিচ্ছেন।আমি কি কাজের লোক? যেভাবে বলছে তাতে তো এটাই বোঝা যাচ্ছে।

আমি এসব ভাবছি আর উনি আবারও আমাকে ধমকে বললেন, ‘দেখ! তোর যদি খাবার দেওয়ার ইচ্ছে হয়, তাহলে দে। নয়তো আমি ওঠে যাচ্ছি। তোর মতো এতো সময় আমার নেই।’

আমি শুকনো গলায় বললাম, ‘জ্বি, দিচ্ছি।’

উনাকে আম্মুর রান্না করা খাবার রেডি করে দিলাম। উনি চামচ দিয়ে খাচ্ছেন আর চোখমুখ কুঁচকাচ্ছেন। কিন্তু কিছু বললেন না। আমি সোফায় বসে বসে দেখছি আর অবাক হচ্ছি। কি হলো উনার হঠাৎ? সেদিন বাসাভরা লোকের সামনে কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলছিলেন আর আজ আমাকে খালি বাসায় পেয়েও কিছু বলছেন না, ক্ষ্যাপাচ্ছেন না। ভাবার বিষয়।

উনি কোনোমতে খাবার খেয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন ঠাস করে। আমি সবকিছু গুছিয়ে উনার দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললাম, ‘ভাইয়া! আমি চলে যাচ্ছি।’

কোনো সাড়াশব্দ এলো না ভেতর থেকে। আমি আবারও বললাম। এবার বলার সাথে সাথেই দরজা খুলে গেলো। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার হাত টেনে নিয়ে গেলো ভেতরে। উনার দিকে তাকিয়ে দেখি, ওনি রক্তলাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, ওনার হাত দুটো গরম হয়ে আছে। আমি হঠাৎ করে উনার কপালে হাত রাখতেই বুঝতে পারলাম, জ্বরে উনার গা পুড়ে যাচ্ছে। আমি কিছু বলতে গেলেই উনি আমাকে চুপ করিয়ে দিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘সবকিছুর জন্য দায়ী তুই।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আমি কিসের জন্য দায়ী?’

উনি ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলেন, ‘তুই আমার অসুখের জন্য দায়ী। তুই নিজেকে কি ভাবিস? তুই মহান? তাহলে ভুল ভাবছিস! তুই আমার আঘাতের কারণ, আমার অসুখ সৃষ্টি করার কারণ!’

হে আল্লাহ!
তুমি আমাকে উওমরূপে সৃষ্টি করেছে,
এবং আমার চরিত্রকেও তুমি উওম করো।

-হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)
-মিশকাতুল মাসাবীহ -৫০৯৯

চলবে….ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here