তুমিময়_অসুখ
পর্ব-৯
#লেখিকা-ইশরাত জাহান ফারিয়া
১৮.
বেশ কিছুদিন এভাবে কেটে গেলো। খুবই সাধারণ ভাবে দিনগুলো কাটলো। তেমন কিছু হলো না। মাঝে মাঝে অভ্র ভাইয়ার কাছ থেকে ধমক খেয়ে রাগ করেছি, কান্না করেছি। কিন্তু সবই ওনার আড়ালে। আবার মাঝেমধ্যে আমিও রেগে ওনাকে দু-চার কথা শুনিয়ে দিয়েছি। রাফা আবারও হোস্টেলে ফিরে গিয়েছে। তবে এসবের মাঝে একটা ঘটনা আমার খুব ভালো লেগেছে। প্রতিদিন মামা অফিস থেকে যেকোনো সময় কাউকে না কাউকে দিয়ে খাবার পাঠাবেন, বিভিন্ন সুন্দর শো-পিস বা ফুলের গাছ পাঠাবেন, যেগুলো আমি পছন্দ করি। আর বাসার সবাই মিলে একসাথে সবকিছু উপভোগ করি। ওনার প্রতি একটু দুর্বল হয়ে পড়েছি বোধহয়। তাই সবকিছু কেমন রঙিন লাগে। ভালো লাগে সবকিছু। কিন্তু এর মধ্যে আমার এডমিশন টেষ্টের পড়া মোটেও আগাচ্ছিলো না, মনোযোগটাই হারিয়ে যাচ্ছিলো। তবুও প্রাণপণ চেষ্টা করে কিছুটা আয়ত্তে এনেছি। মামানি আমার পড়াশোনার এ অবস্থা দেখে বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে তোর পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে না বাবু!’
আমি চুপ করে রইলাম। মামানি বললেন, ‘তোর আম্মু বলছিলো তোর নাকি নিজের টেবিলে না বসলে পড়াশোনায় মনোযোগ বসে না?’
—“হুম! আসলে আমিতো এতদিন বাসার বাইরে থাকিনি, পড়তে বসলেই বাসার কথা মনে হয়!”
মামানি হেসে বললেন, ‘তুই বাচ্চাই রয়ে গেলি। আচ্ছা! অভ্র ফিরলে আমি তোকে ও বাসায় নিয়ে যেতে বলে দিবো।’
আমি অনেক খুশি হলাম। মামানিকে জড়িয়ে ধরে একটা ধন্যবাদ দিয়ে রুমে এসে কাপড়চোপড় গোছগাছ করে বোরকা পড়ে রেডি হলাম। অভ্র ভাইয়া বাসায় ফিরলো শেষ বিকেলের দিকে। মামানি ওনাকে বলে দিলো আমাকে বাসায় দিয়ে আসতে। ওনি গম্ভীরমুখে রুমে ঢুকে আমাকে খোটা মেরে বললেন, ‘বাসায় যাবার জন্য দেখি মুখিয়ে আছিস!’
আমি ভাব নিয়ে বললাম, ‘তাতে কারো সমস্যা হবার কথা নয়!’
ওনি রেগে বললেন, ‘বেশি পটরপটর শিখেছিস আজকাল!’
আমি ধমক খেয়ে আর কিছু বললাম না। বাসায় যাচ্ছি, এখন মুড খারাপ করার দরকার নেই। কথায় কথা বাড়ে, এরজন্য চুপ থাকাটাই শ্রেয়!
ওনি রাগে গজগজ করতে করতে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিলেন। বুঝলাম না এতো রাগের কি হলো। চুলগুলোতে ব্রাশ বুলিয়ে কি যেন একটা লাগিয়ে নিলেন তেলের মতো। দেখতে ওনাকে সুন্দরই লাগছে। হঠাৎ করে ওনাকে আমার কাছে এতো সুন্দর লাগছে কেন? নাহ! সুন্দর মানুষকে তো সুন্দরই লাগবে।
যাইহোক! আমাদের বাসা তো আর এখান থেকে বেশিদূর নয়। পাঁচমিনিটের পথ মাত্র। রাস্তা ঘুরে যেতে হয় তাই একটু দূরে মনে হয়। আর এটুকু পথের জন্য গাড়ি নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই বিধায় আমি জোর করে ওনাকে নিয়ে রিকশায় চেপে বসলাম। ওনি রেগে আগুন, বেচারা কিছু বলতেও পারছেনা। আমি মনে মনে হেসে কুটিকুটি হচ্ছি। আসার সময় দরজায় একটা বারিও খেলাম, ব্যথা হচ্ছে একটু একটু। কিন্তু ওনি সেসময় চুলে কি লাগিয়েছেন সেটা জানার দারুণ কৌতূহল হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলে না আবার ধমক দেয়, কে জানে!
১৯.
আমি হঠাৎ ওনার চুল টেনে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি চুলে কি নারিকেল তেল দিয়েছেন?’
অভ্র ভাইয়া অবাক হয়ে বললেন, ‘কিসব আবোলতাবোল বলছিস ইরাম? পাগল হয়ে গিয়েছিস নাকি মাথায় বারি খেয়ে মাথার সব তার ছিড়ে গেছে?’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কি সব আজব কথাবার্তা বলছেন আপনি? তেলতেলে চুল, জিজ্ঞেস করাতে কি আমার অন্যায় হয়েছে?
ওনি এক ধমক দিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে দিলেন। বললেন, ‘গাধী! এটা তেল না, এটা জেল!’
আমি বোকার মতো প্রশ্ন করে বসলাম, ‘জেলটা আবার কি?’
ওনি এবার প্রচন্ড রেগে গেলেন। মুখ রাগে থমথম করছে ওনার। আমি ঢোক গিলে বললাম, ‘ আসলে কি বলছি নিজেও জানিনা, হয়তো ওই বারি খেয়েই আমার মাথার সব তার উল্টোপাল্টা হয়ে গিয়েছে!’
আমি চুপ করে গেলাম।
আমার মনে হলো অভ্র ভাইয়া দৃষ্টি দিয়েই আমাকে ভস্ম করে দেবে। যতই হোক, ওনাকে অকারণে বিরক্ত করা পছন্দ করেন না। বাসায় পৌঁছে দরজার কলিংবেল বাজাতেই ইলহাম এসে দরজা খুলে দিলো। খুশিতে চেঁচিয়ে বাসার সবাইকে ডাকতে লাগলো আর আমার ভীষণ লজ্জ্বা করতে লাগলো। বিয়ের পর এই প্রথম আসলাম তো, সেজন্যই বোধহয়! আমি লজ্জ্বাবতী পেয়েছি নির্লজ্জ জামাই।
ভাইয়া এসে বললো, ‘কেমন আছো তোমরা?’
অভ্র ভাইয়া বললেন, ‘ভালো আছি।’
—“তুই কেমন আছিস বুড়ি?”
আমি খুশিতে গদগদ হয়ে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘ভালো!’
তারপর আমাদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। ভাইয়া আর ওনি মিলে কিসব বলছেন আর হাসছেন। বন্ধুগিরি ফলাচ্ছেন বেশ বুঝতে পারছি, যত্তসব! ড্রইংরুমের ভেতরে ঢুকেই দেখি সত্যি সত্যিই আব্বু-আম্মু সোফায় বসে কথা বলছে।আমি একছুটে গিয়ে আব্বুকে জড়িয়ে ধরলাম, আচমকা জড়িয়ে ধরাতে আব্বু চমকে উঠলো। আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘কি? কারেন্টের শক লাগলো?’
আব্বু হেসে বললেন, ‘হুম! ভালো আছিস মা?’
—“হুম!”
আম্মু বললেন, ‘বলে আসবি না? আমি তো ভাবতেই পারছি না!’
আমি মুখ গম্ভীর করে বললাম, ‘তোমার ভাইপুত্র তো সবসময় সবাইকে সারপ্রাইজড করতে পছন্দ করে, জানো না!’
রুমের সবাই হেসে উঠলো।
অভ্র ভাইয়া সোফায় আমার পাশে বসলো। বললো, ‘ফুপ্পি এটা কিন্তু তোমার মেয়ের প্ল্যান!’
আমি অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকালাম। কি সাবলীলভাবে মিথ্যা বলছেন, না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না যে উনি মিথ্যা বলতে পারেন।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলেন। কি ডেঞ্জারাস ছেলে, আমার নামেই মিথ্যা বলে।
জানো ফুপি তোমার মেয়ে আমাকে অফিস থেকে জরুরি তলব করে এনেছে। আমি বলেছি কাল নিয়ে আসবো, কিন্তু তোমার ডেঞ্জারাস মেয়ে আমাকে কি করলো জানো?
আম্মু রাগী গলায় বললো, ‘কি করলো?’
নাহ! এসব বলা মানায় না। বাদ দাও।
না তুই বল৷ আমার মেয়ে হয়ে কারো সাথে বেয়াদবি করবে সেটা আমি মানবো না, আমি ওর মা, পেটে ধরেছি আমি। তাই ওর সব কীর্তি আমার জানা দরকার।
অভ্র ভাইয়া ভাব নিয়ে বললেন, ‘ওকে! তুমি যখন জানতে চাইছো বলছি আমি। ও আমাকে এক ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দিয়েছে। বুঝেছো কি ডেঞ্জারাস হয়েছে?’
আব্বু, ভাইয়ারা যতটুকু না অবাক হলাম তার চেয়ে বেশি অবাক হলাম আমি। কারণ কখন, কিভাবে আমি ওনাকে আমাদের বাসায় আসার জন্য জোর করেছিলাম বা ধাক্কা দিয়েছিলাম সেটা আমি নিজেই জানিনা। জানবো কিভাবে? এরকম তো আমি করিইনি।
আম্মু আদিক্লামি করে বললো, ‘কেমন লাগছে এখন তোর? বেশি লাগেনি তো?’
ওনি আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ভাল আছি ফুপি। এখন একটু ঠিক লাগছে।’
আমি চুপ করে রইলাম। বসার ঘরের সবাই আমার দিকে বার বার তাকাচ্ছে। নিজের বাসায় নিজেকে এলিয়েন লাগছে। আম্মু ইশারায় আমাকে জানিয়ে দিলেন, ‘আমাকে উচিৎ শিক্ষা দিবে!’
আমি চুপচাপ নিজের ঘরে চলে এলাম। কতদিন পরে নিজের ঘরে এলাম। সবকিছু সাজানো গোছানো পরিপাটি। আম্মু সবসময় আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে, অগোছালো জিনিস আমার একদম পছন্দ না।
২০.
ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি আম্মু এসেছে রুমে। আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই তো এমন ছিলি না, তাহলে এমন পাগলামি করছিস কেন ছেলেটার সাথে?’
আমি আম্মুর পাশে বসলাম। অবাক হয়ে বললাম, ‘কি করেছি আমি আম্মু?’
—“কি করেছিস জানিস না? বেয়াদবি করিস আমার সাথে? অভ্র কি বললো তুই শুনিসনি?”
আমি বললাম, ‘আম্মু ওনি এসব মজা করে বলেছেন। আমি এমন কিছুই করিনি।’
আম্মু আবারও রেগে বললেন, ‘তাহলে কি ও মিথ্যা বলছে!’
আমি বলার আগেই অভ্র বেত্তমিজ রুমে ঢুকলো। আম্মুর কথা শুনে আমাদের থামিয়ে দেওয়ার জন্য বললো, ‘ছেড়ে দাও ফুপি। ও কি আর সব স্বীকার করবে, আমার সাথে যা যা করে?’
আমি এবার ওনার দিকে রেগে তাকালাম। ওনার এসব প্যাঁচানো কথাবার্তা আমার কোনোসময়ই বোধগম্য হয় না। বললাম, ‘আপনি এসব মিথ্যা কথা বলে আমাকে আম্মুর কাছ থেকে কেন বকা খাওয়াচ্ছেন?’
ওনি যেন কিছু করেননি এমন একটা ভাব করে বললেন, ‘মানে?’
আমাকে থামিয়ে দিয়ে আম্মু বললো,’ কি সব শুরু করেছিস তুই? ছেলেটা মাত্রই এলো রুমে আর তুই ওকে রেস্ট নিতে না দিয়ে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে চাচ্ছিস?’
—“আরে আম্মু! আগে তো সবটা শুনো তুমি?আমার এখানে কোনো দোষ নেই। ওনি আমার নামে মিছিমিছি নালিশ করছেন!”
আম্মু আমাকে ধমকে বেরিয়ে গেলো। একটা কথাও শুনলো না। আমি রাগে ফুঁসছি। আর ওনি মুচকি হেসে দরজা আটকে দিলেন।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে আমার কাছে এসে আমার গালে আর ঠোঁটে চুমু খেয়ে বসলেন। আর আমি অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে।
আচ্ছা, ওদের তো বিয়েই হলো দুদিন হয়েছে। তাহলে এত কম সময়ের মধ্যে একজনকে ভাই ডাকাটা কি পাল্টানো যায়? আর গল্পে ধর্মবিষয়ক কোনোকিছু বলা হয়নি। আর নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করেছে এটা ঠিক তবে ফ্যামিলির কথা ভেবেই না! তো সবকিছু পাল্টাতে কি একটু সময় লাগবে না? গল্প গল্পই। বাস্তবে এমন হলেও মানুষ নিজেকে পাল্টাতে একটু টাইম নেয়। গত পর্বে আমি এগুলো পেয়েছি মন্তব্য হিসেবে। আর কোনোকিছু জানার হলে বলবেন, ভুল হলে ঠিক করে নিবো। তাই গল্পটা হঠাৎ করে একটু এগিয়ে নিয়ে গিয়েছি। সবশেষে ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।
সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। ভালো কাটুক নতুন বছর আলহামদুলিল্লাহ।
?হে আল্লাহ্, আমরা পাপি। এতদিন আমরা অনেক গুনাহ করেছি আমরা অনুতপ্ত। আমাদের সকলের গুনাহসমুহ মাফ করে দিন এবং পরিপূর্ণ ভাবে আপনার ইবাদত করার তৌফিক দান করুন।আমিন
চলবে…..ইনশাআল্লাহ!