তুমিময়_প্রেম❤ PART_23,24

0
1480

তুমিময়_প্রেম❤
PART_23,24
FABIYAH_MOMO

.
আকাশে আজ সূর্য নেই! অদ্ভুত বিষন্নতার প্রভাব ছেয়ে আছে চারপাশে! গুমোট আবহাওয়ার পূর্বাভাস! যেনো কিছু খারাপ ঘটতে চলেছে! মুগ্ধ এনে কাজির সামনে বসিয়েছে আমায়! আমার হাত এমন কঠিনভাবে ধরেছে একসেকেন্ডের জন্যও সেই হাত ছাড়েনি! কাজি দোয়া পড়তে শুরু করেছেন! আমি হাত ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলেও মুগ্ধ নামক তুখোড় শক্তির কাছে হেরেই যাচ্ছি!! ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে আমি হাল ছেড়ে দিয়ে শান্ত হয়ে বসলে মুগ্ধ কানের কাছে মুখ এগিয়ে বলে উটে,

— শক্তি খরচ করে কি লাভ হলো? গাধা একটা! বাসররাতে এখন আড্ডা কিভাবে দিবো?
আমি ভ্রুকুচকে অবাকচোখে তাকাতেই মুগ্ধ চোখ টিপ মেরে ঘায়েল করা এক মুচকি হাসি দিলো! জেনি হলে বলতো, মুগ্ধ প্লিজ এভাবে লুক দিবেনা। আমি অসুস্থ হয়ে পড়বো! ‘বাসররাতের আড্ডার’ সাথে আমার ব্যর্থ ধস্তাধস্তির মর্ম কি বুঝালো? শক্তির খরচ আবার মিনে বুঝালো? উল্টাপাল্টা কিছু? জানি না!

কাজি চোখের চশমা খুলে টেবিলের উপর রাখলো। হালকা কেশে বলে উঠলো,
— গার্ডিয়ান কই? গার্ডিয়ান ছাড়া বিয়া করাই না। আগে বাপ মা আনেন।

মুগ্ধ ভয়ংকর দৃষ্টিতে কাজির দিকে তাকালো! পারলে এখনই আছাড় মেরে মুখ থেতলে দিবে ও! মুগ্ধ জোর গলায় বললো,
— যাদের গার্ডিয়ান নেই তারা কি বিয়ে করেনা? নতুন কাহিনি করছেন? শুরু করুন! মনে করবেন গার্ডিয়ান নেই!ব্যস!
— গার্ডিয়ান ছাড়া বিয়া করনের নিয়ম নাই। আমি বিয়া পড়াইতে পারমু না।
মুগ্ধ ধামম.. করে টেবিলের উপর একটা ঘুষি মারলো! কাজি ভয়ে চমকে উঠলো। বেচারা ঢোকের পর ঢোক গিলছে। মুগ্ধ রাগে জর্জরিত হয়ে তর্জনী তুলে কঠিন কিছু বলবে তার আগেই কাজি ভয়ে তটস্থ হয়ে হাসি ঠেলে বললো,
— পড়াইতাছি পড়াইতাছি…আমি তো মজাক করতাছিলাম।। মজা পাইছেন না কন? মজা না?

মুগ্ধ হাসলো না। কাজি চটপট হাতে আমাদের সামনে স্ট্যাপলার করা তিনটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে ‘সাইন’ করতে বললেন। মুগ্ধ নির্বিকার ভঙ্গিতে কলম ঘুরিয়ে ফটাফট সাইন করে আমার হাতে কলম গুজিয়ে বললো, ‘সাইন প্লিজ!’। আমি কলম হাতে নাড়াচাড়া করতেই ওর দিকে একবার তাকালাম। মুগ্ধ চোখ দিয়ে কাগজের দিকে ইশারা করছে। অর্থ এই, ‘আমার দিকে না তাকিয়ে সাইন করো!’ চোখের সামনে পরপর স্মৃতিগুলো ভেসে আসছে আমার! এই স্মৃতিগুলোর সাথে আমার অদ্ভুত রকমের ঘনিষ্ঠতা জড়িয়ে আছে তা কেউ জানেনা। এক. আব্বু, আম্মু ও ভাই নামক অদৃশ্য জন্মসূত্রের আকৃষ্টতা! দুই. ছোট থেকে দেখা স্বপ্ন ও ক্যারিয়ারকে নিজহাতে খুন করা! তিন. মধ্যবিত্ত মেয়ে হিসেবে ইচ্ছাগুলো মাটিচাপা দেওয়া! কতো ইচ্ছা ছিলো নিজের কষ্টের টাকায় আব্বুকে একটা ফোন কিনে দিবো! আব্বুর মুখে সেই বুকভরা হাসিটা দেখবো! ‘আব্বু’ নামক মানুষটার কাছে প্রতিটা মেয়ে খুবই ঋণী। মেয়েরা কখনো জানবেও না বাবা নামক মানুষটার উপর কতো ভারী দায়িত্ব থাকে।। ইচ্ছে ছিলো, পরিবারের ছোটখাটো অর্থ সমস্যায় আমি পাশে থাকবো! নিজের ইচ্ছাগুলোকে সঙ্গী করে বড় পর্যায়ে উঠবো! কিন্তু শেষে কি হলো? আত্মবিসর্জন দিয়ে ইচ্ছেপুরিকে সমুদ্রের অতল গভীরে তলিয়ে দিতে হলো! এই দিন দেখার জন্য হাড়ভাঙ্গা কষ্ট করেছিলাম? কি অদ্ভুত! মানুষের এতোখানি জীবনে সবাই চায় একটু আশা! অথচ সেই আশার ভঙ্গ হলে, পুরো জীবনটাই লাগে হতাশা! হায়রে এই অদ্ভুত দুনিয়া…

কলমটা নিয়ে চিন্তার দেয়ালে আকিঁবুকি করছিলাম। হঠাৎ পাশ থেকে মুগ্ধ বলে উঠলো,
— কি ভাবছো? সাইনটা করো!
আমি কাগজে কলম বসাতে গিয়েও বসালাম না। কলমটা রেখে মুগ্ধের উদ্দেশ্য বলে উঠলাম,
— জরুরি কথা বলতে চাই। সময় দিবে? প্লিজ? খুবই জরুরি!
মুগ্ধ কিছুক্ষণ চুপটি থেকে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। অর্থাৎ, সে কথা বলবে। আমি উঠে একটা রুমে ঢুকে চুপচাপ মুগ্ধের জন্য দাড়ালাম। মুগ্ধ ঢুকলো এবং দরজাটা হালকা ঠেলে আমার কাছে এসে বললো,
— কি কথা? প্লিজ এখন ‘বিয়ে করবেনা’ টাইপ কথা নিয়ে গলাবাজি করো না!
— আমি বিয়ে করবো!
— তাহলে চলো। সাইন করো।
— কিন্তু শর্ত আছে!
— হ্যাঁ আমি প্রস্তুত! প্লিজ চলো! সাইন করবে।
— শর্ত শুনে রাখা ভালো জনাব রাদিফ মুগ্ধ! ফিউচারে আপনার ঝামেলার হতে পারে।
— বলো কি শর্ত? আর কিসব ঝামেলার ইন্ডিকেট করছো?
— আমি আপনাকে বিয়ে করবো বাট! আপনার সাথে থাকবো না! আপনি আমাকে সমাজের সামনে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনোদিন স্ত্রী বলে পরিচয় দিবেন না! না আমি আপনার কেউ! না আপনি আমার কেউ! কথাটা লাইনে লাইনে মাথায় ঢুকাবেন! শুধুমাত্র এই বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে এই কথাটা লুকায়িত থাকবে! আপনার সব চাকর-বাকর ও রিলেটিভদের আমার এবং আমাদের বিয়ে সম্বন্ধে কিছু বলতে যাবেন না! কাগজের সই শেষে কাজিকে আশপাশের চারটা জেলা থেকে বিদায় দিবেন! আপনার গ্যাংয়ের সবকয়টাকে বলবেন, বিয়েটিয়ে হয়নি! এমনেই হুমকিধামকি ছিলো! রাজি?

আকাশ চরম অন্ধকার করে বিকট একটা বাজ পড়লো। শরীরের অঙ্গপ্রতঙ্গসহ শিরা-উপশিয়ায় রক্তের স্রোত অদম্যভাবে ছুটছে। মুগ্ধ নিজেকে সামাল দেওয়ার জন্যে পলকহীন চোখদুটোকে নিচে নামালো। নিচের ঠোঁটটা দাতেঁ কামড়ে অতি কষ্টে গলায় ঢোক গিললো। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ঘরের সমস্ত জিনিস উপড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে! ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে! ভাঙচুর করতে ইচ্ছে করছে! মুগ্ধ চোখ উঠালো না। শান্ত সুরে বলে উঠলো,
— আমি রাজি। তুমি সাইন কর। আমি আসছি..

.
.

ঘড়ির কাটা ন’টার সময় শেষ করে দশটার ঘরে থেমেছে। আমি বাথরুমের দরজায় কান পেতে বসে আছি রুমে কেউ আসছে নাকি! ‘বাসররাতের আড্ডা’ — শব্দটা মৌমাছির মতো কানের চর্তুপাশে ভন ভন করছে! কি সর্বনাশ করবে কে জানে? আমি একটুও রিস্ক নিতে চাচ্ছিনা! কাজি যাওয়ার পরপরই বাথরুমে অবস্থান করছি! কেননা, রুমের দরজা খোলা মুগ্ধের জন্য ম্যাচ দিয়ে আগুন ধরানোর মতো সোজা! কাজেই বাথরুমে আর যাই করুক মরে গেলেও ঢুকতে পারবেনা! হঠাৎ কারোর পায়ের শব্দ শোনা গেলো! আমি চোখবন্ধ করে বলে দিতে পারি এটা মুগ্ধের শব্দ! দ্যাট মিন্স, রুমের দরজা খুলা শেষ! নিশ্চয়ই রুমের কোণায় কোণায় আমাকে খুজছে!! না পেলে? ইশশ..না পেলে এদিকেই আসবে! পরে যদি দরজা ভাঙ্গে? নো, কান্ট হেপেন্ড! হঠাৎ দরজায় ঠকঠক করে কড়া দিলো!

— তুমি কি পালানোর আর জায়গা পেলে না? এই বাথরুমে! ইয়াক! বের হও!
— আমি বের হবো না! নির্ঘাত আমার ঘাড় মটকে দিবেন! সিউর সিউর!!
— বোকার মতো কথা বলো না! ঘাড় কেনো মটকাবো? বের হও জলদি! বের…
মুগ্ধকে বলতে না দিয়ে মম বললো,
— বাড়িতে কি আর বাথরুম নেই! এক নাম্বার পেলে ওখানে যান! আমি দরজা খুলবো না!
— পাগল নাকি ..
মম আবার মুগ্ধকে কেটে বললো,
— পেট খারাপ? আমাশয় হয়েছে? বাথরুমে আসার জন্য এতো উতলা কেনো? হ্যাঁ!
— কেমন মেয়েরে বাবা! কথাই বলতে দিচ্ছে না!
— সরি.. সরি। বলুন।।
— ফার্স্ট কথা বাথরুম থেকে বের হও। বাথরুমে কেউ লুকায়? তোমার মতো ম্যাচিউর মেয়ে এইসব বাচ্চার মতো বিহেভ!
— যা বলার বলুন! আমি বের হবো না!
— ওকে ফাইন! বের হওয়া লাগবেনা! আমিও দরজার কাছে বসে থাকবো!..ইটস ডান!

দরজার এপাশে মুগ্ধ ওপাশে মম। মাঝে শুধু একটুখানি দূরত্ব। মুগ্ধ দরজায় পিঠ লাগিয়ে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। দরজার বিপরীত পাশে মম হাটুতে মাথা লাগিয়ে ফ্লোরে বসে আছে। বেশ সময়কাল ধরে নিরবতা চলছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই রুমে। মুগ্ধ সাদা শার্টটার উপরের দুটো বোতাম খুলে ফেললো। চুলগুলোতে আঙ্গুল চালিয়ে পিছনে ঠেলে দিলো। বন্ধ চোখে জোরে জোরে নিশ্বাস ছাড়ছে মুগ্ধ। খানিকটা সময় চুপটি থেকে অশান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

— আমার ভালো লাগছেনা। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। একটাবার দরজা খুলো?প্রচন্ড অস্বস্তি লাগছে! প্রচন্ড।। বিশ্বাস করো দম বন্ধ হবার উপক্রম হচ্ছে। মম তুমি কি একটাবারো আমার দিকে তাকিয়ে দেখেছো? চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল গুলো চোখে পড়েনি? আমার মুখের বির্বণতা তোমার দৃষ্টি এড়ায়নি?গলার দৃঢ়তা কেমন নরম হয়ে যাচ্ছে?? আমার মধ্যে সবকিছু কেমন খারাপভাবে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে জানার চেষ্টা করেছো? তুমি স্বার্থপর কেনো? কেনো তুমি বুঝতে পারছো না আমি মারা যাবো! প্লিজ দরজাটা খুলো। প্লিজ…পায়ে ধরতেও রাজি আছি। প্লিজ।

মুগ্ধের কথায় হাটু থেকে মাথা উঠালো মম। দরজার দিকে মুখ করে বসতেই মুগ্ধ একটু থেমে আবার বলে উঠলো,

— ওপাশ থেকে একটা জবাব দাও? তুমি আমার বিয়ে করা বউ!
— আমি আপনার কেউ না! আমি ওই দুইটুকরা কাগজকে বিশ্বাস করিনা!
— আমি বিশ্বাস করি! আমি এটাও বিশ্বাস করি একদিন না একদিন তুমিও স্বীকার করবে উই আর ম্যারিড!
— বেচেঁ থাকতে জীবনেও না! যেখানে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে হবে সেখানে আমি কখনোই বিশ্বাস স্থাপন করবো না।
— দোয়া করো যেনো তাড়াতাড়ি মরে যাই। মরে গেলে তোমার কষ্ট পেতে হবেনা। তুমিও রেহাই পাবে। আর সত্যও কখনো বাইরে আসবেনা।

শেষ কথাটা শুনে গা শিউরে উঠলো মমর! এই ফালতু কথাটা বললো কেন? ইচ্ছে করছে এক্ষুনি দরজা খুলে মুগ্ধের গালে দুটো চড় বসাতে! কলারটা টেনে ভয়াবহ গালি দিতে! মম এই কথাটা শুনলে প্রচুর ভয় পায়! মুগ্ধ কি এটা জানেনা? কিভাবে উচ্চারন করলো এই ভয়ংকর শব্দগুলো? মম হাসফাস করতে থাকলে একপর্যায়ে হাতের তালু দিয়ে দরজায় সজোরে ধাক্কা মারে। মুগ্ধ ওপাশ থেকে চমকে উঠে দরজার দিকে মুখ করে বলে
— তুমি ব্যথা পেলে নাকি? দেখি দরজা খুলো! অনেক হইছে এইবার দরজা খুলো!তোমাকে ভেতরে থাকতে দেওয়াটাই ভুল! আমি দরজা ভাঙ্গবো! না ভালোমেয়ের মতো বের হবা!

ভেতর থেকে কোনো জবাব আসলো না দেখে মুগ্ধ দরজা ভাঙতে উদ্যত হলে খট করে দরজাটা খুলে গেলো। দরজার সরু ফাক দিয়ে একজোড়া চোখ তাকে দেখছে। মুগ্ধ তা দেখে হাতভাজ করে বলে উঠলো,
— আপনার পদধূলি দিয়ে এই রুমকেও একটু ধন্য করুন ম্যাম। অত্যন্ত বিগলিত হয়ে আপ্রাণ রূপে খুশি হবো!

মুগ্ধ কুর্নিশ ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে স্বাগত জানাতেই মম তড়িঘড়ি করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। মাথা থেকে পা পযর্ন্ত কাথা দিয়ে ঢাকতেই দরজায় একটা টোকা পড়লো। মুগ্ধ মমর দিকে একপলক দেখে দরজা খুলতেই সার্ভেন্ট মোখলেস ভেতরে ঢুকে খাবারটা টেবিলে রাখলো। মুগ্ধ এখনো হাতভাজ করে আছে। দাতঁ কিড়মিড় করে কিছু একটা ভেবে মুচকি মুচকি হাসছে।। মোখলেশ কাজ শেষে যাওয়ার জন্য পা ফেলতেই মুগ্ধ মোখলেসকে থামিয়ে বললো,

— মোখলেস? দাড়াও তো একটু!

মোখলেস সুলভ ভঙ্গিতে বললো,
— জ্বী স্যার বলেন।

মুগ্ধ আবারো মমর দিকে তাকিয়ে দেখলো। মম নড়চড় করছে! তার মানে মেয়েটা ঘুমায়নি! মুগ্ধের মন খুশিতে কুপোকাত! এদিকে কাথার নিচে কান সজাগ করে আছে মম। মুগ্ধ যদি সার্ভেন্টকে দিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু আনাতে বলে এক্ষুনি একটা সাংঘাতিক কারবার ঘটিয়ে ফেলবে ! মনেমনে খিচ মেরে দুরুদ শরীফ জপছে মম! ‘প্লিজ আল্লাহ্ বাচাঁও!এই মুগ্ধ যেনো কিছু না করে!’

মুগ্ধ হালকা কেশে গলা পরিস্কার করলো! কাশির শব্দে মমর বুকে ধ্বক ধ্বকানি বাড়ায়ে দিচ্ছে। যদি উটকো কিছু আনতে বলে? যদি ও সত্যি সত্যি কিছু করতে আসে? মম কাথাটা আস্তে আস্তে মাথা থেকে সরিয়ে দুইহাত দিয়ে নাক পর্যন্ত ঢেকে চোখদুটো বের করলো। যদি ঝড়ের আভাস দেখে ওমনেই মম কাথাটা দিয়ে মুগ্ধকে রোল বানিয়ে পালিয়ে যাবে! মুগ্ধ আড়চোখে মমর ভর্য়াত চাহনি দেখলো। মনেমনে একটু হাসলো এবং দুলতে দুলতে মোখলেসকে বলে উঠলো,

— আচ্ছা মোখলেস? তোমাদের ইন্ডিয়াতে পুরোনো আমলে বাথরুমকে কি বলতো?আই মিন হিন্দিতে কি বলতো?

— “দেবীও কি হাগনকুঠি”

মুগ্ধ ফিক করে হেসে দেয়! মম ঝটকা মেরে থেকে কাথা পুরোটা সরিয়ে বিছানায় বসে পড়তেই দেখে হো হো করে অট্টহাসিতে রুম কাপিয়ে হাসছে মুগ্ধ! মোখলেশ বোকার মতো মাথা চুলকাতে চুলকাতে প্রস্থান! মুগ্ধ পেট ফাটানো হাসিতে হাসতে হাসতে বলে উঠলো,

— দেবীও কি হাগনকুঠি ছেড়ে কেনো বাইরে আসতে ইচ্ছে করে না

-চলবে❤

ফাবিয়াহ্_মম

#তুমিময়_প্রেম❤
#PART_24
#FABIYAH_MOMO

ক্যাম্পাসে যাবো! রেডি হচ্ছি! মুগ্ধ গাড়িতে বসে নিচ থেকে হর্ণ বাজাচ্ছেন! আমি ফাইজাকে বিদায় জানিয়ে তাড়াহুড়ো পায়ে গাড়িতে যেয়ে উঠলাম! মুগ্ধ তার পাশের সিটের দরজাটা খুলে স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কখন এসে তার পাশের সিটটায় বসবো! আমি মুগ্ধের ইচ্ছাটা জলে ডুবিয়ে পেছনের সিটে গিয়ে বসলাম! মুগ্ধ বিষ্মিত চোখে আমাকে দেখছে! আমি কোলের ব্যাগটা সিটে রেখে ওর উদ্দেশ্য বললাম,
– সামনে তাকাও! পিছনে কি?
মুগ্ধ অসহায় বাচ্চার মতো মুখটা ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো! মনে আনন্দ লাগছে! কেন লাগছে? ব্যাপারটা বলি, শুনুন! যখন কেউ আপনাকে নিয়ে উচ্চমানের এক্সপেকটেশন রাখে সেটাকে ধুলিসাৎ করতে অন্যরকম শান্তি লাগে! এতে ওই ব্যক্তি কষ্ট পায় আর আপনি পান চরমভাবে শান্তি!

আমার আব্বু আম্মুকে নিয়ে মুগ্ধ যে ফুলপ্রুফ করেছে এখন সেটা আপনাদের বলি! মুগ্ধ আমার পরিবারের কাউকে অবশ্য কিডন্যাপ করেনি। উনারা আমার মামার বাসা মিরপুর-১১তে গিয়েছেন। মামীর ডেলিভারী ছিলো এবং একটা মামাতো বোন হয়েছে আমার। মামা মিরপুরে একা একটা ফ্ল্যাটে থাকেন বিধায় মামীর লেবার পেইনে মামা আব্বু আম্মুকে ওখানে আর্জেন্ট ডাকেন। আব্বু, আম্মু আমাকে একহাজারটা কল হয়তো করেছিলো বাট নবীন বরন অনুষ্ঠানে আমার সাথে যেই হলরুমের ঘটনাটি ঘটেছিলো ফোনটা ওখানেই ফেলে আসি। এরপর মুগ্ধের ট্র‍্যাপে ফাসি। শেষমেশ যখন আমি বাড়ি ফিরি তখন আব্বু আম্মু ও ছোট ভাই বাসায় ছিলো না। তারা হসপিটালে মামীর কাছে ছিলো। এখনো উনারা ওখানেই আছেন মামীর অবস্থা ভালো না। বেবি নাকি পজিশন বিগড়ে উল্টে আছে। গতকাল রাত সাড়ে তিনটা পযর্ন্ত রাদিফ মুগ্ধের কাছ থেকে সবটা দু’কানে শুনি এবং এটাও জানতে পারি আব্বু আম্মু আজ বিকেলের দিকে আমার খোঁজ নিতে নারায়ণগঞ্জ ফিরবেন। কেন আমি ফোন ধরছিনা, কোথায় গেলাম, গুম হলাম কিনা…সব চেক দিতে আব্বু আসবেন। গাড়ির জানালাটা একটু খুলে বাইরের বাতাসটা মুখে মাখছি। চোখ খুলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কারন মুগ্ধ প্রচুর স্পিড দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। এই বান্দা আজীবন তাড়াহুড়োতে থাকে! ‘ধৈর্য্য, সবর, অপেক্ষা’ এই তিনটি জিনিসের সাথে তার সংযোগ নেই। জানালার উপর ডানহাতটা মেলে দিয়ে তাতে থুতনি বসিয়ে ভাবছি। মুগ্ধ খুব চালাক পার্সোনালিটির। মাথায় এতো বুদ্ধি গিজগিজ করে আগে জানতাম না। ওকে সবাই কেনো এতো মান্য করে এখন বুঝলাম। তুড়ি বাজাতেই যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে এই চতুর বান্দা।

মুগ্ধ গাড়িটা রাস্তার মোড়ে থামালো। আমি হাত থেকে থুতনি উঠিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বসতেই মনে কিছু প্রশ্নের দাগ কাটলো। প্রথম প্রশ্ন, ও গাড়িটা এখানে কেনো থামালো? দ্বিতীয়, আজ এতো চুপচাপ? সর্বশেষ, আবার কোনো নতুন প্ল্যান করছে? কিছুক্ষন গাড়িতে নিরবতা চললো! মুগ্ধ মাথাটা আমার দিকে না ঘুরিয়ে বাঁ কাধ বরাবর করলো।

— গাড়ি থেকে নামো!
ভ্রুকুচকে এলো আমার!
— গাড়ি থেকে নামবো মানে? রাস্তার মোড় কি তোমার কাছে ক্যাম্পাসের গেট লাগছে? এটা ক্যাম্পাস!!
— ক্যাম্পাসের গেট পযর্ন্ত হেঁটে যাও। আমি তোমাকে নিজের গাড়ি করে ক্যাম্পাসে যেতে পারবো না। ভালো হবে তুমি এখানেই নামো।
— আশ্চর্য কিসিমের লোক তো! তন্ময় আমাকে ওর গাড়িতে করে ক্যাম্পাসের ভেতর পযর্ন্ত নিয়ে গেছে! আর তুমি এখানে নাটক করছো?
— তন্ময় তো আর স্বামী না।

তন্ময় আমার স্বামী না মানে? কি বুঝালো? ও স্বামী দেখে আমাকে গাড়ি থেকে রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিবে?শান্তমুখে কথাটা বলে সিটবেল্ট খুলে বাইরে গেল মুগ্ধ। পিছনে এসে আমার সিটের কাছে দরজা খুলে বেরুতে আজ্ঞা করলো। আমি হতভম্বের মতো ওর দিকে তাকিয়ে আছি! ‘বের হও মম, কেউ দেখলে সিনক্রিয়েট হবে ‘ – কথাটা কানে পৌছাতেই মস্তিষ্ক বাইরে যাওয়ার জন্য আগে পা বাড়াতে সংকেত দিলো। আমি বের হতেই মুগ্ধ দরজা লাগিয়ে ওর ড্রাইভিং সিটে যেয়ে বসলো। সিটবেল্ট লাগাতেই আমার হকচকিত মুখের পানে কথার ঝুড়ি ফেলে বললো,

— চিন্তা করো না ক্যাম্পাসে তোমার হাসবেন্ড বলে পরিচয় দিবো না। আমার বাসা থেকে তোমার আমার যাত্রা এটুকুই থাকবে। সামনে আগানোর চেষ্টা করবো না। ক্লাস শেষে তুমি বাসায় যেতে পারো। ফাইজা ভাইয়ার কাছে যাবে। কিছুদিন ওখানেই থাকবে। ও আসলে পরে জানাবো। টেক কেয়ার।

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো। এখনো গাড়িটার যাওয়ার দিকে দৃষ্টি স্থির করে আছি। ব্যাগটার বাদামী ফিতা আকড়ে হাটা দিয়েছি আমি। কবজি ঘুরিয়ে হাতঘড়িতে সময়টা দেখলাম। আরো পচিঁশ মিনিট সময় আছে ক্লাস শুরু হতে। যেতে লাগবৌ দশমিনিট। মুগ্ধের আচরণে খারাপ লাগছেনা। বরঞ্চ ওর বুদ্ধি দেখে সাব্বাশি দেওয়া লাগে! আসলেই ঠিক করেছে। আমাদের সমাজের মানুষ কতো গুণধর তা সবাই জানে। ক্যাম্পাসের ভেতরে শতশত শিক্ষার্থীর সামনে ওয়েল সোসাইটির মুগ্ধ সাহেবের গাড়ি থেকে নামলে সবাই নানারকম ধারনা করতো সিউর! ইতিবাচক ধারনার চাইতে নেতিবাচক ধারনাটা প্রাধান্য পেতো বেশি! সেদিন তন্ময়ের গাড়ি থেকে কি নেমেছি!! তাতেই মানুষ বলে ফেলেছে ‘আমি তন্ময়ের গার্লফ্রেন্ড নাকি?’ আজ মুগ্ধের গাড়ি থেকে নামলে নির্ঘাত স্ট্যাপ লাগতো ‘বারোভাতারী’! মুগ্ধ আসলেই একটা জিনিয়াস পাবলিক! মারাত্মক জিনিয়াস!

তিনটা লেকচার পরপর এটেন্ড করলাম। এখন গা গুলিয়ে বিরক্ত লাগছে। কলেজে উঠার পর থেকে আগের মতো টানা ক্লাস করার ইচ্ছাশক্তি নেই বলতে গেলে। এখন মনেহয় বড় হয়ে গেছি। ওসব লাগাতার ক্লাস বাচ্চারা করে।কারন, ভার্সিটি মানেই ক্লাস ড্রপ এবং পরীক্ষার রাতে পড়া এবং ফুলটাইম আনলিমিটেড আড্ডা দেওয়া! বই খাতা নিয়ে কাধে ব্যাগের ফিতাটা ঝুলিয়ে নজরুল চত্বরে গিয়ে বসলাম। চত্বরটা আজ ফাকা ফাকা। সবাই মাঠের আনাচে-কানাচে গোল হয়ে বসেছে। একটু দূরে শহীদ মিনারের সিড়িতে জেনি, রিমি, তন্ময়, নাসিফ ও মুগ্ধ বসে আড্ডা দিচ্ছে। সবার মন ফুরফুরে দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত রামিমের অবস্থা এখন ভালো। আমি নোটখাতায় আজকের ইর্ম্পট্যান্ট টপিক টুকে লিখছি। জগতের সমগ্র জিনিস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গভীর নিমগ্নে কলম চালাচ্ছি।

— ‘বেবি কি লিখছিস?’
চোখ তুলে প্রশ্নকারীর দিকে তাকালাম। দেখি ইসরাত আর অর্পিতা দাড়িয়ে। অর্পিতা হাসিমুখে আমার বামপাশে বসলো এবং ইসু বসলো বসলো ডানপাশে। জবাব না দিয়ে আমি খাতায় কলম ঘুরাচ্ছি। অর্পিতা খচখচ শব্দ করে কিছু একটা ছিড়তেই বলে উঠলো,

— মম কি লিখছিস? নোট নাকি? আচ্ছা ক্লাসে তোর কি হয়েছিলো বলতো? তুই আলাদা হয়ে পিছনে বসলি কেনো?
ইসুও অর্পিতার সাথে যোগ দিয়ে বললো,
— তোর আজ কি হয়েছে রে? একা বসলি! একা ক্লাস করলি! এখন এখানেও একা আছিস! কি হয়েছে খোলাখুলি বলবি?

আমি বিরস মুখে বলে উঠলাম,
— প্লিজ ডিস্টার্ব করিস না। কাজ করছি। পারলে তোরা এখান থেকে যা।
অর্পিতা চোখে কাঠিন্য ভাব এনে ছোঁ মেরে হাত থেকে খাতাটা নিয়ে নিলো। আমি বিরক্ত মুখে চেতে উঠি!
— উফ অর্পিতা! আমার পড়াশোনা দেখে তোদের ভালো লাগছেনা!
— না ভালো লাগছেনা! তোর লোক দেখানো পড়াশোনা অন্যের সামনে দেখাবি। আমার সামনে না! তুই যদি কি হয়েছে না বলিস এক্ষুনি তোর খাতাটা কুটিকুটি করে ফেলবো!
— তুই আমাকে শান্তি দিবি? বল শান্তি দিবি?
— চড় দিবো!তুই শেয়ার না করা পযর্ন্ত তোর পিছু ছাড়বোনা বুঝছিস! এখন পটাপট উগলে দে কি হয়েছে!
ইসু পাশ থেকে অনুযোগের সুরে বলে উঠলো,
— তুই আমার বেস্টু! তুই কথা শেয়ার না করলে আমার ভালো লাগবে?

হঠাৎ মস্তিষ্কের রিনরিন শব্দটা বেজে উঠলো! মুগ্ধ বলেছিলো, আমার ব্যাপারে যতপ্রকার কুটনামি সব এই ইসু করেছিলো! পুরো ক্যাম্পাসে আমার নামে মুখরোচক দুর্নাম গেয়েছে!তবে মুগ্ধ ও আমার বিয়ের কথাটা কি শেয়ার করা ঠিক হবে? মন বলছে ‘না’! করা ঠিক হবেনা! অর্পিতা আমার হাতটা ধরে বলে উঠলো,
— কথাগুলো বলে মনটা হালকা কর মেয়ে। এভাবে চুপ করে থাকলে মন ভারী হয়ে কান্না বসে যাবে।

অর্পিতাকে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ হিসেবে মস্তিষ্ক সাইরেন দিচ্ছে। কিন্তু ইসুকে নিয়ে নাহ্। কাজেই বুদ্ধি করে ইসুকে দূরে পাঠিয়ে তবেই অর্পিতাকে সব কথা বলা যাবে। নাহলে সত্যি দমবন্ধ হয়ে আমি মারা যাবো! ইসুকে ক্যান্টিন থেকে নুডলস আনতে পাঠিয়ে দিলাম। ওর আসতে কমপক্ষে বিশ মিনিট লাগবে! ততক্ষণে আমি অর্পিতাকে হাসঁফাসঁ করতে করতে সব বলে দিলাম। অর্পিতা চোয়াল ধুলিয়ে দূরে ছিটকে গিয়ে বসলো। চোখেমুখে ব্যাপক আশ্চর্যের ঝলক! অর্পিতা কাপাঁ কাপাঁ হাতে ব্যাগের চেইন খুলে পানির বোতল নিয়ে ঢকঢক করে পানি খাচ্ছে। বেশিরভাগ পানি ওর জামার উপর পড়লো। আমি ঝাট দিয়ে দিয়ে অবশিষ্ট পানি ফেলতেই অর্পিতা বোতলটা না লাগিয়ে পাশে পাটাতনের উপর রাখলো।

— অর্পি তোকে কথাগুলো বললাম প্লিজ আর কাউকে বলিস না। ইভেন ইসুকেও না। তোকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে তাই আগেভাগে না ভেবে বলে দিলাম।
অর্পি চুপ করে আছে। কিছুটা শান্তবোধ হলে আমার দিকে সম্পূর্ণ তাকিয়ে বলে উঠলো,
— তোর বিয়ের খবর শুনে আমার আত্মা কাপছিলো জানিস? থাক গে, ওগুলা মাথা বাদ। কথা শোন আমার! মন দিয়ে চুপচাপ শুনবি! একদম চুপ করে শুনবি! ওকে?
— হু।
— মুগ্ধ ভাই তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে। এন্ড নাও, তুই না চাইলেও উনার ওয়াইফ! আবার তুই বললি উনার ফ্যামিলি কেউ নাই। উনি একা একটা ফ্ল্যাটের মধ্যে থাকেন। তুই জানিস একা থাকাটা কত কষ্টকর? আমি জানি! বাবা – মা কেউ নাইতো মুগ্ধ ভাইয়ার অবস্থাটা বুঝি। আর একটু আগে বললি না?মুগ্ধ ভাই তোকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিছে? ক্যাম্পাসে তোকে সাথে আনেনি! তুই যে আজাইরা মার্কা শর্ত দিছোস না? ওইটার জন্য বেচারা এমন করছে! উনার কি দোষ দিবি তুই? তুই তো নিজেই একটা দোষী!
— তুই আমাকে লেকচার দেয়ার জন্য চুপ থাকতে বলছিস?
— জীবনেও না। এগুলা তোর কাছে লেকচার লাগে? আমি অর্পিতা যা যা বলি সব সত্য! একটাও মাটিতে ফালানোর মতো কথা না! আরেকটা কথা ‘ইসু ইসু’ করে যে জানটা দিয়ে দেস না? সাবধানে থাকিস। এই মেয়ে বড়মাপের চালবাজ! তোর এই কথা শুনলে ইজ্জত কিভাবে হালুয়া করে টের পাবি।
— জানিস?সবাই বলে ইসু দুমুখো! বাট আদৌ আমি ধরতে পারলামনা।
— তুই তন্ময়ের গফ! কথাটা কিন্তু ইসুই ছড়াইছে! মুগ্ধ ভাই পরে সব কথা কিভাবে ঠিক করছে কে জানে? মুগ্ধ ভাইকে ভুলেও হাতছাড়া করিস না! পস্তাতে পস্তাতে মরে যাবি!
— অর্পি, আমি ওকে পছন্দ করিনা। যেখানে পছন্দ শব্দই আসেনা সেখানে আবার ভালোবাসা কিসের? ভালোবাসা কি পুতুলনাচ? যে দেখলে মজা পেলে ভালোবাসা হয়ে যাবে?
— মনের অনুভূতি বলার জন্য মুখের শব্দ লাগেনা বোকা। একটা মেয়ের চোখেই সব স্পষ্টভাবে লেখা থাকে। যে পড়তে পারে সে মোক্ষমভাবে ভালোবাসতেও জানে! লিমিট ক্রস করে পাগলামি করে! আমি ওই পাগলামি মিন করিনাই! যেটা এই যুগের বফ,গফ হাত পা কেটে প্রমাণ করে! ওইটা বালপাকনা ছ্যাঁচড়ামি ছাড়া কিছুই না! মুগ্ধ ভাইকে ডাক দে, তোকে এখনই হাতেনাতে প্রমাণ দেই!
— কিহ্! দলবল নিয়ে বসে আছে আর আমি এখান থেকে ডাক দিবো?অসম্ভব!
— তুই না দিলে আমি দেই। মুগ্ধ ভাই? এইযে ভাইয়া? হ্যাঁ আমি ডাকছি। একটু আসবেন এখানে? একটু? দরকার আছে তো…

ডাক দিলো মুগ্ধকে! কিন্তু সঙ্গে আসলো তন্ময়,নাসিফ! মুগ্ধ অর্পিতার ডাকে আমাদের সামনে এসে দাড়ালো। লম্বাটে হাইট, কালো কুচকুচে শার্ট, অফ হোয়াইটের গ্যাবার্ডিন প্যান্ট, হাতাটা মোটা করে গোটানো, ছিমছাম দেহের আর্কষনীয় মুখটা নিয়ে চুপ করে দাড়িয়ে আছে। অর্পিতা কনুই মেরে আমাকে তাকাতে বললো! আমি দুলিয়ে আকাশ দেখছি। বাপাশ থেকে লাগাতার কনুইয়ের গুতায় ঝাঝড়া হয়ে যাচ্ছে। উঠে একটা থাপ্পরও দিতে পারছিনা!

— ভাইয়া মাইন্ড করবেন না। আমি আপনার বোনের মতো। আপনাকে একটা কোয়েশ্চ্যান দিবো প্লিজ সল্ভ করে দিবেন? শুনেছি আপনার ব্রেন খুব চালু! প্লিজ ভাইয়া না করবেন না। ছোট্টবোনের অনুরোধ..

মুগ্ধ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক বোঝালো। তন্ময় নাসিফের ব্যাপারটা ঘাপলা লাগছে। তাই তারা চোখাচোখি করে বিনা শব্দে কথা বলছে। অর্পিতা আমার খাতা থেকে একটা পেজ ছিড়ে কলম নিয়ে কিছু একটা লিখলো এবং কাগজটা মুগ্ধের দিকে বাড়িয়ে দিতেই মুগ্ধ নিয়ে দেখতে লাগলো। তন্ময় ও নাসিফ দেখল, কাগজে সাংকেতিক ভাষায় কিছু লেখা,

‘m mmmm mmm mmmm’

মুগ্ধ লোয়ার লিপটা আলতো করে দাঁতে চেপে ভাবছে। মম আড়চোখে তিনজনের অবস্থা দেখে মনেই মন হাসলো! কারন, তারা এসব পারবেনা! মুগ্ধ তো আরো আগে না যতই সে বুদ্ধিমান হোক! নাসিফ কাগজটায় চোখ বুলিয়ে কপাল কুচকে আছে। তন্ময় কাগজটার একটা কোণা ধরে বিষ্ময়সূচকে বললো,

— দোস্ত ধরতে পারছিস কেউ? এটা কিসের ইকুয়েশন? ম্যাথ না ফিজিক্সের?
অর্পিতা হালকা কেশে বললো,
— ভাইয়া এটা নরমাল প্রবলেম। যাদের আইকিউ(IQ) ভালো তারা পারবে। যাদের নেই তারা কলম কামড়াবে।
— এই মেয়ে! কাদের গাধা বলছো! র‍্যাগ দিবো নাকি!
— ভাইয়া..
মুগ্ধ অর্পিতাকে থামিয়ে বলে উঠলো,
— আহ্ তন্ময়। পারছিস না চুপ থাক! থ্রেট কেন দিচ্ছিস!
— সরি ডুড।

ঠিক দুই মিনিট পেরুতেই মুগ্ধ বললো গলা ঝেড়ে বললো,
— তন্ময়? নাসিফ? চল! জুনিয়রদের কাহিনি নিয়ে মাথা নষ্ট করার সময় নেই। নিজেরা বুঝেনা ! আমাদের দিয়ে করায়!

তন্ময় নাসিফ মুখ গম্ভীর করে চলে যেতে লাগলো। অর্পিতা হাতে হাত ডলে উশখুশ করছে! ওদের না-ও করতে পারছেনা! আবার আটকাতেও পারছেনা! মুগ্ধ কাগজটা দুই ভাজঁ করে অর্পিতার হাত টেনে হাতে ধরিয়ে দিতেই স্বর খাদে ঢেলে স্পষ্ট বাক্যে বললো!

— ওয়ান ‘এম’, ডাবল ‘এম’ ডাবল ‘এম’, ট্রিপ্যাল ‘এম’, ডাবল ‘এম’ ডাবল ‘এম’… ইকুয়েল টু(=) ‘আই লাভ ইউ মম’ ! গিভ দিস টু ইউর ফ্রেন্ড, এন্ড স্যা টু হার, সাম লাভ ওয়ার্ডস ফ্রম রাদিফ মুগ্ধ!

বাকাঁ হাসি উপহার দিয়ে প্রস্থান করলো মুগ্ধ! আমার ও অর্পিতার দুজনের অবস্থা পুরোপুরি জবানবন্দ!

.
.

বাসায় ফিরলাম! একগাদা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে আব্বুকে শান্ত ভাবে ট্যাকেল করেছি। আব্বু আজ বাসায় থেকে কাল সকালে আবার রওনা দিবেন আম্মুকে আনতে। আজ আম্মু আসেনি, কাল আসবে। রাতের খাবার হিসেবে গরম ও ডিম ভাজা ছাড়া উপায় নেই। ঘরে বাজার নেই! আবার রাত করে বাজার খোলাও থাকেনা। পেয়াঁজ, মরিচ কাটছি। ডিম কাপে নিয়ে চামচ দিয়ে ফেটছি। দ্রুত হাত চালাতেই দরজায় বেল পড়লো! ঘড়ির দিকে দেখলাম! সাড়ে দশটা! এই রাতে কে আসলো?

— আব্বু? আব্বু শুনছো? দরজাটা একটু খুলে দেখো তো কে এসেছে।।

খট করে কিছু খুলার শব্দ পেলাম। আব্বু বাথরুমের দরজা ধরে উকি দিয়ে বলছেন,
— আমি বাথরুমে। তুমি দরজাটা খুলে দেখো!

ডিমের কাপ চুলার কাছে রেখে দরজা খুলতে গেলাম। দারোয়ান একটা সাদা ব্যাগ এগিয়ে বলছেন পার্সেলটা নাকি আমার নামে এসেছে! আমি কিছুটা অবাক। দরজা লাগিয়ে পার্সেল নিয়ে টেবিলের উপর রাখতেই আব্বু বাথরুম থেকে গলা উচিয়ে বললো,

— মম? কে এসেছে?
আমি পার্সেল খুলতে খুলতে বললাম, ‘পার্সেল দিছে আব্বু!’ ব্যাগটা খুলে দেখি খাবারের ঘ্রাণ আসছে। স্ট্যাপলার দেয়া কাগজের ব্যাগটা ছিড়ে দেখি দুটো সাদা প্যাকেট! ভুরভুর করে বিরিয়ানীর গন্ধ আসছে। প্যাকেটে সত্যি সত্যি বিরিয়ানী! একদফা চমকে আছি! এটা নিশ্চয়ই মুগ্ধের কাজ! ও ছাড়া কেউ এই আকাম করতে যাবেনা! দৌড়ে রুমে গিয়ে ওকে কল করছি! আজ মনের মাধুরী মিশিয়ে একচোট খারাপ ভাষায় গালি দিবোই! ফোন বাজতেই ও রিসিভ!

— হ্যালো,
— ভাই একটা কথা বলবা? ছেলেদের লজ্জা শরম কি কম থাকে? এইযে জঘন্য ভাষায় অপমান করি! গায়ে কি ছিটেফোঁটাও লাগেনা?
— আরে! আমি করেছিটা কি? আমাকে ভাই বলছো কেনো? এটা কোন ধরনের অসভ্যতা?
— অসভ্যতার এখনো করিনি! তাই ভালো করে জিজ্ঞেস করছি! খাবার পাঠাতে বলছিলো কে? আমি?
— খাবার? আমাকে পাগল কুকুর কামড়ায় না বুঝছো! আমি তোমার বাসায় খাবার পাঠাইনি।
— তাহলে কে পাঠাইছে? কে জানছে আমার বাসার অবস্থা?
— তা আমি কি করে বলবো?
— তুমি পাঠাওনি?
— না,
— সিউর!
— ফাইজার কসম!

ফোন কেটে দিলাম। অনবরত ভাবছি কে কাজটা করলো? খাবারের কথা মুগ্ধ ছাড়া কে জানবে? উহু, বিষয়টা সোজা ঠেকছেনা! মোটেও সোজা ঠেকছে না! খাওয়া পর্ব শেষে রুমে এসে রামিমের খোঁজ নিতে জেনিকে কল দিলাম। যদিও জেনিকে আমার সহ্য না! জেনি কলটা ধরে বলে উঠলো,

— তুমি আমার ফোনে কল দিয়েছে কেনো!
— তোর ফোন কি গ্রিনিজের মাল? ফোন দেওয়া যাবেনা?
— মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ!
— আমি বাংলাতেই কথা বলছি! তুইও ইংলিশ ভাষা সাইড পকেটে ঢুকা! আর বল রামিম কেমন আছে? জ্ঞান ফিরেছে?
— সেটা তোমাকে কোন শখে বলতে যাবো!
— আহহা! তুই আমাকে শখের ডেফিনেশন না দিয়ে রামিমের খবর বল! এক্সট্রা কথা বলবি আরেক কল সোজা মুগ্ধের ফোনে বাজবে!
— রামিম সুস্থ আছে। জ্ঞান ফিরেছে।
— গুড! এরপর বল ওর উপর এ্যাটাক কে করেছে জানা গেছে?
— না। তন্ময় ও নাসিফ বলেছে ব্যাপারটা ওরা দেখবে।
— কেনো? মুগ্ধ জানে?
— কেউ জানিনা। মুগ্ধকে বলবো ভেবেছি ও আমাদের কারোর সাথে কেনো জানি কথাই বলছেনা।
— আচ্ছা। এখন কোথায় তুই?
— রামিমের কেবিনে।
— ও কি ঘুমে?
— না।
— একটা কাজ কর। ফোনটা ওর পাশে রেখে কেবিন থেকে বাইরে যা।
— হোয়াট?
— যা বলছি তাই কর! কথা না শুনলে..
— যাচ্ছি..

‘রামিম মম তোর সাথে কথা বলবে! তুই পারবি?’
‘হ্যাঁ জেনি পারবো’

উপরোক্ত দুইটি বাক্য শেষে কিছুক্ষণ সময় পেরুলো। রামিম ভাঙ্গা গলায় বলে উঠলো,

— হহ্যালো..
— রামিম? কেমন আছো? কি অবস্থা? শরীর কি এখনো প্রচুর খারাপ?
— ননা ভাবি..
— আমি তোমার ভাবি না রামিম।
— আআপনার সসাথে বসের বিয়ে হইছে ভভাবি। আমি সসব জজানি।
— কিভাবে? কি করে?
— ভভাবি ওওসব কথা বাদদ দদেন, আপনি আআমার ককথা শুনেন.. তন্ময় খুখুব খখারাপ..আপনি এএকা থাককবেন না..ওওরা গুরুততর প্ল্যানন বানাইছে ভভাবি, ওওরা জানে বিয়ের বব্যাপারে..

এটুকু বলেই খুকখুক করে কাশতে শুরু করলো রামিম। কাশতে কাশতে দম বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা! মম বিচলিত হয়ে ফোনের মধ্যেই চেচাতে লাগলো,

— রামিম! তুই ঠিক আছো! রামিম? রামিম জবাব দাও! তুমি অসম্পূর্ণ কথা বলতে পারো না! সব বলো প্লিজ!

কাশতে কাশতে রামিম গলা পরিস্কার করে প্রতিটা শব্দ থেমে থেমে বললো,
— আপনার উপর প্রতিশোধ নিতে চায়…এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চায়…আপনাকে শেষ কইরা বসকে হাত করার নীনীল নকশা ককরছে..

-চলবে

ফাবিয়াহ্_মম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here