তুমি কে?,পর্বঃ ০৮
লেখকঃ আবির খান
রোহান দু’চোখ মেলে তুবার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে ছিল আর দুঃখ বিলাস করছিল। আসলে ও ভাবছিল কবে এই মিষ্টি ঠোঁটের পরম স্পর্শ পাবে৷ কিন্তু হঠাৎই এমন কিছু হলো যা রোহান স্বপ্নেও ভাবে নি। তুবা হঠাৎ করে রোহানের মুখের দিকে এগিয়ে আসে। আর এরপর ওদের মাঝে এমন কিছু হয়ে যায় যেটা হওয়ার কথাই ছিল না। রোহান তুবার নরম ঠোঁটের স্পর্শে হারিয়ে যায়। ওর মনে হয় তুবা ইচ্ছা করেই এমনটা করেছে। কারণ তুবার কাছ থেকে ভালোই রেস্পন্স পাওয়া যাচ্ছিল। রোহান আর কি করবে, বেচারার ইচ্ছাটা শেষমেশ পূরণ হলো। ও আর নিজেকে ধরে রাখে না। হারিয়ে যায় তুবার স্পর্শে। এভাবে কতক্ষণ ওরা একে অপরের মাঝে ডুবে ছিল তার কোন হিসাব নেই। অনেকটা সময় পর ওরা একে অপরকে ছেড়ে দেয়। দুজনই হাপিয়ে গিয়েছে। তুবা রোহানকে ছাড়া মাত্রই অন্যদিকে ফিরে শুয়ে থাকে। আর রোহান এখনো অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে ওর ঠোঁটে হাত দিয়ে তুবার ঘন কালো চুলের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না ওদের সম্পর্কটা মুহূর্তেই এতটা গভীর হয়ে গেল। ও মনে মনে ঠিক করে, ওর জীবন সঙ্গিনী যদি কেউ হয় তাহলে সেটা একমাত্র তুবা। আর কেউ না। এটা ভেবে রোহান মুচকি একটা হাসি দিয়ে উঠে পড়ে। আর এদিকে আমাদের তুবামনির অবস্থা তো বেজায় খারাপ। ও ওর ঠোঁটে হাত দিয়ে লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে মনে মনে বলছে,
~ হায়! হায়! এ আমি কি করেছি! কেন নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না? কেন? আমি কি ওনাকে ভালবেসে ফেলেছি তাহলে? ওনার প্রতি জমে থাকা মায়াগুলোই কি ওনাকে আমার কাছে এতটা আকৃষ্ট করেছে? ওনাকে ছাড়া আমার যে কিছুই ভালো লাগে না। ওনাকে এতটা কাছে পেয়ে নিজেকে আর ধরেই রাখতে পারলাম না। ওয়েট! দোষ শুধু আমার একার না৷ ওনারও দোষ আছে। ব্যটা লুচ্চা আমাকে কিভাবে জড়িয়ে আমার শরীর হাত দিয়ে বিচরণ করছিল। আসুক পারলে কিছু বলতে। আমিও তখন ওনাকে লজ্জা দিব। আমার লুচ্চা শয়তান। হিহি।
তুবা উলটা পালটা ভেবে অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসে। ও উঠতেই রোহান ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে আসে। ওদের দুজনের চোখাচোখি হয়। দুজনেই লজ্জায় এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। রোহান মনে মনে বলছে,
— সিট ওর দিকে তাকাতেই পারছি না। খুব লজ্জা করছে। ও যদি এখন রাগ করে। কারণ ওকে তো আমিই প্রথমে জড়িয়ে ধরে ছিলাম। উফফ! কি যে করি। তারচেয়ে নিচে চলে যাবো নাকি?
অন্যদিকে তুবা,
~ আল্লাহ, আমি বোধহয় লজ্জায় মরেই যাবো। এখন উনি যদি এসে আমাকে বকা দেয় আমি তো কিছুই বলতে পারবো না। কি যে করি? আল্লাহ মাটিটা যদি ফাঁকা হয়ে যেত তাহলে ঢুকে চুপটি মেরে বসে থাকতাম। উফফ!
রোহান আরও ভাবে,
— না না, আমার ওকে মোটেও অবহেলা করা ঠিক হবে না। তাহলে ও কষ্ট পাবে। আমাকে ভুল বুঝবে। হয়তো ভাববে, আমি ওকে খারাপ ভাবছি। তার চেয়ে একটু আগে যা হয়েছে সব ভুলে ওর সাথে নরমাল ভাবে কথা বলি। হ্যাঁ হ্যাঁ সেটাই ভালো হবে৷
রোহান এটা ভেবে তুবার কাছে এসে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলে,
— গুড মর্নিং। ঘুম ভাঙলো তবে? রাতে ঠিক মতো ঘুম হয়েছে তো?
তুবা অবাক হয়ে যায় রোহানের কথা শুনে। ও মনে মনে বলে,
~ একি! উনি তো পুরো স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। কিন্তু কেন? উনিকি সব ভুলে গেল নাকি? উহুম অসম্ভব! আমার ঠোঁটটা লাল করে ফেলছে শয়তানটায়। ভুলে যাবার তো কথা না৷ তাহলে নিশ্চয়ই আমি যেন লজ্জা না পাই তাই স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। উনিই একমাত্র ব্যক্তি যে আমার কথা সবার আগে ভাবে৷ এর জন্যই ত ওনাকে আমি… হিহি।
তুবাও মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে অনেক কষ্টে নিজেকে একদম স্বাভাবিক করে বলে,
~ গুড মর্নিং। জি খুব সুন্দর ঘুম হয়েছে। আপনি যে এত সুন্দর করে আমাকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন, ঘুম ভালো না হয়ে কি আর পারে?
কথাটা বলা মাত্রই রোহানের চোখগুলো ডিমের মতো বড়ো বড়ো হয়ে যায়। ও লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর এদিকে আমাদের দুষ্ট তুবামনি মুখে হাত দিয়ে বসে আছে। ও আবেগে ওর মনের কথাটা বলে ফেলেছে। আসলে হঠাৎ করে এত কিছু হয়ে যাওয়ায় তুবার মাথা ঠিক নেই। তাই উলটা পালটা বলে ফেলেছে। তুবা মুহূর্তেই বেড ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
~ সরি সরি। আমি ফ্রেশ হয়ে কফি নিয়ে আসছি। আপনি একটু অপেক্ষা করুন।
বলেই এক ভো দৌড় তুবা। আর রোহান ধপ করে বেডে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থেকে ও অট্টো হাসিতে ভেঙে পড়ে। হাসতে হাসতে বেডে উপর শুয়েই পড়ে। এরপর ও বারান্দায় চলে যায়। আজকে আর ও জিম করে না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের মনোরম পরিবেশটা অনুভব করে ও। কিছুক্ষণ পর তুবা লজ্জাসিক্ত মুখখানা নিয়ে কফি নিয়ে আসে। রোহান কফিটা নিয়ে তুবাকে বলে,
— আজ তোমার সাথে কফিটা ভাগাভাগি করে খেতে চাই। যদি কিছু মনে না করো আমার সাথে কফিটা ভাগাভাগি করে খাবে? জোর নেই কিন্তু। তুমি চাইলে নাও করতে পারো। কোন সমস্যা নেই।
তুবা একটা অসম্ভব সুন্দর হাসি দিয়ে বলে,
~ আপনার সাথে পুরো জীবনটা ভাগাভাগি করতে আমি রাজি আছি। এটা ত সামান্য কফি। আমি খুব খুশি হবো যদি আপনি আমাকে এই অধিকারটুকু দেন।
রোহান হাসি দিয়ে কফির মগটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
— কফিটাকে আরও মিষ্টি করে দেও তো।
তুবা লজ্জাসিক্ত মুখখানা নিয়ে কফির মগে এক চুমুক দিয়ে খেয়ে রোহানের দিকে এগিয়ে দেয়৷ রোহান সাথে সাথে যেখানটায় তুবা চুমুক দিয়েছে সেখানে চুমুক দিয়ে ও এক চুমুক খেয়ে বলে,
— আহ! অমৃত তুবা৷ আজকে কফির স্বাদটা যেন আরও অনেক বেড়ে গিয়েছে।
তুবা লজ্জায় হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বলে,
~ এএএ…আবার লজ্জা দিচ্ছেন আপনিইই।
— হাহা। আচ্ছা আচ্ছা আর দিব না৷ এবার তুমি খাও।
এবার ওরা দুজন মিলে কফিটা ভাগাভাগি করে খায়। আসলে ঠিক কফি না ওরা ওদের মাঝের সুপ্ত ভালবাসাটুকুকে ভাগাভাগি করেছে। প্রকৃত ভালবাসা সবসময় ভাগাভাগি করেই তার তৃপ্তি অনুভব করা যায়। যেটা ওরা করেছে। কফি খাওয়া হলে ওরা দুজন বাগাননের দিকে তাকিয়ে থাকে। তুবা আর রোহানের মাঝে এক হাত দূরত্ব ছিল। রোহানের সেটা ভালো লাগে না। ও আস্তে আস্তে কৌশলে তুবার একদম পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তুবা মুচকি হেসে রোহানের কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলে,
~ জানেন, আমার কাছে এ সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। আমি কখনো কল্পনাও করি নি আমার সাদাকালো জীবনটা হঠাৎ করে কেউ এভাবে রঙিন করে দিবে৷ আমাকে সবসময় ইটের শক্ত চার দেয়ালে বন্দি করে রাখা হতো। তখন মনে মনে ভাবতান, হয়তো কখনো ফেইরি টেলের সেই রাজপুত্র এসে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে৷ আমার জীবনের সব ইচ্ছাগুলো পূরণ করবে৷ আপনি না আমার জীবনের সেই রাজপুত্র হয়ে এসেছেন৷ যেন ম্যাজিক করে আমার সব কষ্টগুলোকে নিমিষেই শেষ করে দিয়েছে। জানি না কতদিন এভাবে আপনি আমার পাশে থাকবেন৷ তবে যতদিন থাকবেন আমি আমার সব কিছু দিয়ে আপনাকে খুশি করার চেষ্টা করবো। কারণ আমি আপনার কাছে অনেক ঋণি। সত্যিই অনেক।
রোহান তুবাকে ওর দিকে ঘুরিয়ে ওর গাল দুটো ধরে চোখে চোখ রেখে বলে,
— আমি তো তোমার সব কিছু চাই না তুবা। আমাকে যদি সত্যিই তুমি কিছু দিতে চাও, তবে তোমার মিষ্টি হাসিটা দিও। জানো তোমার হাসিটার সামনে আমি আজ পর্যন্ত তোমার জন্য যা করেছি তা সব মূল্যহীন। কারণ তোমার হাসিটা আমার কাছে অনেক অনেক বেশি দামী। আমি অনেক শান্তি পাই যখন তোমার এই মিষ্টি ঠোঁটে হাসির রেখাটা ফুটে উঠে। আমি সত্যিই অনেক শান্তি অনুভব করি। তোমাকে তা বুঝাতে পারবো না।
তুবা রোহানের কথা শুনে হেসে দেয়। আর বলে,
~ আপনি সত্যিই অনেক ভালো। আপনার প্রশংসা শুরু করলে কখনো তা শেষ করা যাবে না৷ আমি ভেবেছি আমার শরীরটাকে আপনি পছন্দ করেন৷ কিন্তু আমি ভুল। আপনি তো আমার..
— আমি তোমার তুমিটাকে ভালবাসি। শুধু তুমি। না তোমার দেহ না তোমার সৌন্দর্য। শুধু তুমি। তোমার অস্তিত্বটাকে।
তুবা চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে ভাবছে,
~ উনি কি আমাকে প্রপোজ করে দিল? আমি কি ঠিক শুনলাম? না না! আমি হয়তো ভুল শুনেছি। এতটা স্বাভাবিক ভাবে কেউ বলে নাকি ভালবাসি!
— কি হলো অবাক হয়ে আছো কেন?
~ না মানে আপনি কি একটু আগে বললেন আমাকে ভাল…
হঠাৎই রোহানের ফোনটা জোরে বেজে উঠে। রোহান তুবাকে একমিনিট বলে ফোনটা বের করে রিসিভ করে। অপর পাশ থেকে,
— এই বাস্টার্ড! তুই কি ভাবেছিস তুই আমার বোনকে তোর কাছে লুকিয়ে রাখবি আর আমি তা জানবো না? রোহান অনেক বড়ো ভুল করেছিস তুই।
— মুখ সামলে কথা বল। তুই তোর বোনকে বোন বলিস কোন মুখে! তোর বোন তোর ভয়ে বাসা থেকে পালিয়ে এসেছে।
— ওরে তো আমি মেরেই ফেলবো। ও কিভাবে আমাদের মান ইজ্জত সম্মান এভাবে মাটিতে মিশালো?
— আমি বেঁচে থাকতে তুই কোন দিন ওর গায়ে একটা টোকা পর্যন্ত দিতে পারবি না৷ সেই ক্ষমতা তোর নাই। তুই জানি না আমি কে।
— হাহা। তুই আমাকে এখনো চিনতে পারিস নি তাই এই কথা বলছিস। আমি তোর জীবনের সবচেয়ে বড়ো শত্রু। বলতো কে আমি?
— আহসান?
— হ্যাঁ। আহসান। দ্যা আহসান কোম্পানির মালিক আমি। আগামী ১২ ঘন্টার মধ্যে যদি তুই আমার বোনকে আমার কাছে নিয়ে না আসিস তাহলে তোকে এমন বেজ্জতি করবো তুই আর কাউকে কখনো মুখ দেখাতে পারবি না। শুধু তাই না তোর কোম্পানি রাতারাতি শেষ হয়ে যাবে। শুধু মাত্র তোর জন্য। বাই।
বলেই তুবার ভাই আহসান ফোন রেখে দেয়। রোহান ভীষণ বড়ো একটা ধাক্কা খায়। ও স্তব্ধ হয়ে আছে। একটু আগেও ত সব ভালো ছিল। হঠাৎ করে এটা কি হলো! এদিকে তুবা কাঁদতে কাঁদতে রোহানকে জিজ্ঞেস করে,
~ কি হয়েছে? কি হয়েছে? কে কল দিয়েছে? আমার ভাইয়া?
— তুবা তোমার ভাইয়ার নাম কি, আহসান? আহসান কোম্পানির মালিক সেই আহসান?
~ হ্যাঁ।
রোহান সাথে সাথে বিশাল বড়ো সক খায়। ও এখন কি করবে? কিভাবে তুবাকে বাঁচাবে? একদিকে তুবা অন্যদিকে ওর পুরো কোম্পানি। যেখানে হাজার হাজার শ্রমিক, কর্মজীবী মানুষের ভবিষ্যৎ। রোহান এখন কি করবে?
চলবে..?