তুমি নামক যন্ত্রণা,পর্বঃ ০৪

0
6042

তুমি নামক যন্ত্রণা,পর্বঃ ০৪
লেখকঃ আবির খান

স্নিগ্ধ সকালের রোদের তাপে সবার আগে জান্নাতের ঘুম ভাঙে। ও চোখ মেলার আগে অনুভব করে ও কিছু একটার সাথে বেশ আষ্টেপৃষ্টে মিশে আছে। জান্নাত আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকিয়ে যা দেখে তা দেখার জন্য ও মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ও দেখে ও আবিরের একদম বুকের মাঝে এবং ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। শুধু তাই না আবিরও একই কাজ করেছে। মুহূর্তেই জান্নাতের চোখ দুটো ডিমের মতো বড়ো বড়ো হয়ে যায়। লজ্জায় পুরো মুখ লাল হয়ে যায়। ও বুঝতেই পারছে না কি থেকে কি হলো। তবে ধারণা করা যায়, রাতে ঘুমের মাঝে নিশ্চিত ওরা এক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কে আগে কার আছে গিয়েছে এটাই এখন মূখ্য প্রশ্ন। জান্নাত একটু পিছনে তাকিয়ে জিহবায় কামড় দেয়। ওর পিছনে অনেকটা জায়গায় পড়ে আছে। তারমানে ওই আবিরের কাছে এসেছে। ইসস! কি লজ্জায়ই টা না পাচ্ছে এখন জান্নাত। আবির নিশ্চিত ওকে আর সাথে নিয়ে ঘুমাবে না। এরকম পঁচা মেয়েকে কেই বা সাথে নিবে আর। লজ্জায় আর ক্ষোভে জান্নাত অস্থির হয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু… হ্যাঁ একটা কিন্তুর সৃষ্টি হয়েছে এখানে৷ এখানে বলতে আবির আর জান্নাতের মধ্যে। সকল লজ্জা কিংবা খারাপ লাগা একদিকে আর অন্যদিকে আবিরের স্পর্শ। জান্নাতের কাছে কেন জানি এই স্পর্শটা খুব ভালো লাগছে। আবিরকে ও খুব কাছ থেকে এখন ফিল করতে পারছে। ও মনে মনে ভাবছে, লোকটা এখন পর্যন্ত শুধু ওর সাহায্যই করে যাচ্ছে। সে সামনে থেকে খারাপ হওয়ার অভিনয় করলেও ভিতরে ভিতরে সে অনেক ভালো। থাকা খাওয়ার কিছুই ছিল না জান্নাতের। কিন্তু আবিরের জন্য এত বড়ো একটা বাড়িতে শুধু তাই না আবিরের সাথে আবিরের পাশে ওর ঠাই মিলেছে। জান্নাত কখনো কল্পনাও করে নি এরকম দিনও ও দেখতে পারবে। ওর মনে হচ্ছে এটা কোন স্বপ্ন। ও কি আসলেই এতকিছুর যোগ্য? আর আবির কেনই বা ওর জন্য এত কিছু করছে? ও তো একরাতের নিশিকন্যা ছিল আবিরের কাছে। আবির হয়তো ওকে এখনো তাই ভাবে। ওকে হয়তো একটা মেয়ে বলে আবির ভাবেই না। জান্নাতের চোখ দুটো ভিজে আসে। খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। এত কষ্ট নিয়ে ও কিভাবে বেঁচে আছে ও নিজেই জানে না। একটা মেয়ে যে কতটা অসহায় তা জান্নাতকে দেখলে বুঝা যায়। জান্নাত অজান্তেই কাঁদতে শুরু করে। ওর কান্নার আওয়াজ আবিরের কানে পৌঁছানো মাত্রই সেকেন্ডের ভিতর ও চোখ মেলে তাকায়। দেখে জান্নাত ওর বুকের মাঝে শুয়ে কাঁদছে। আবির অনেকটা অস্থির হয়ে জান্নাতের মুখ বের করে জিজ্ঞেস করে,

– এই বোকা কাঁদছো কেন? কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?

জান্নাতের আবিরের দিকে তাকিয়ে আরও কান্না বাড়িয়ে দেয়। আবির তো মহা বিপদে পড়ে যায়। ও যাই জিজ্ঞেস করে,যাই বলে জান্নাত কিছু না বলে শুধু কাঁদে। আবির বুঝতেই পারছে না কিভাবে জান্নাতের কান্না থামাবে। জান্নাত চোখ বন্ধ করে শুধু কান্না করছে। ওর মিষ্টি গোলাপি ঠোঁটটা আবিরের দিকেই করা ছিল। আবির আর কোন উপায় না পেয়ে জান্নাতকে ওর পরম মধুর স্পর্শে ভরিয়ে দেয়। জান্নাত ওর নরম ঠোঁটটাকে কারো দখলে দেখে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে এটা আবিরের কাজ। ওর কান্না অজান্তেই থেমে যায়। আবির ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকে। জান্নাত এবার লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ কাউকে ছাড়ছে না৷ জান্নাতের জীবনে প্রথম এবং শেষ পুরুষ আবির৷ দ্বিতীয় কারো কাছে জান্নাত জীবনেও যাবে না। কারণ আবির ওকে কিনে নিয়েছে। আর ওর ইচ্ছাও নেই যাওয়ার। এতটা খারাপও ও না৷ লাগলে সারাজীবন আবিরের গোলাম হয়েই ও থাকবে৷ জান্নাত অজান্তেই আবিরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কেন জানি আজ আবিরকে ছাড়তেই মন চাচ্ছে না। আবিরের উষ্ণতা, স্পর্শ আর গরম নিঃশ্বাস ওকে পাগল করে দিচ্ছে৷ ওর বিবেক ওর চিন্তা ওর সবকিছুকে থামিয়ে দিচ্ছে। শুধু মন বলছে, আবিরকে ছাড়া যাবে না। এদিকে আবিরও যেন মনের সুখে জান্নাতের স্বাদ নিয়েই যাচ্ছে৷ ওর মনে হচ্ছে ও এভাবে জান্নাতের সব কষ্ট নিয়ে নিবে৷ তাই ও ছাড়ছে না। আবির ধীরে ধীরে জান্নাতের চরম নেশায় পড়ে যায়৷ নিজের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলে। ও যে কি করতে যাচ্ছে তা ও নিজেই বুঝতে পারছে না। জান্নাতও ওকে থামাচ্ছে না৷ আবির ঘোরের মধ্যে থাকায় কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু হঠাৎই অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু হওয়ার আগেই আবিরের মাথার কাছে রাখা ফোনটায় টুং করে দুই তিনটা ম্যাসেজ একসাথে আসে। ফলে আবিরের নেশা কিংবা ঘোর সাথে সাথে কেটে যায়। আবির নিজেকে এভাবে দেখে ভীষণ লজ্জা পায়৷ ও হাত সরিয়ে আস্তে আস্তে জান্নাতকে ছাড়ে। দুজনেই হাপাচ্ছে৷ দুজনের ঠোঁট লাল হয়ে আছে৷ জান্নাত আবিরের বুকে মাথা লুকিয়ে আছে। আবির মনে মনে নিজেকে গালাগালি করছে। ও এটা কি করতে যাচ্ছিল! কিভাবে নিজের কন্ট্রোল ও হারালো। আবির জান্নাতের দিকে তাকিয়ে ওর চোখটা মুছে দেয়। জান্নাত লজ্জায় আবিরের বুকের দিকেই তাকিয়ে আছে। আবির হাসি দিয়ে জান্নাতকে শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে ওর মাথার পিছনে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

– সরি…প্লিজ কিছু মনে করো না। আমার মাথা ঠিক ছিল না তাই সীমালঙ্ঘন করে ফেলেছি। আর এমন হবে না৷ তুমি এভাবে কাঁদছিলে আমার ভালো লাগছিল না। তাই তোমাকে থামানোর জন্য এই পথ বেছে নি। সরি…

জান্নাত কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে ইশারায় না না বলে। আবির আবার বলে,

– একটা কথা বলি, জানি তোমার বিশ্বাস হবে না। তাও শোনো, তুমি আমার জীবনের প্রথম নারী। এর আগে কখনো আমি কারো কাছে যাই নি। কারো সাথে এতটা ঘনিষ্ঠ হই নি। তাই হয়তো নিজেকে… সরি।

জান্নাত খুব অবাক হয়ে আবিরের দিকে তাকায়। আবির আবার বলে উঠে,

– সত্যিই বলছি তুমিই প্রথম। তুমি আমাকে যেমনটা লুচ্চা টাইপ ভাবো আমি কিন্তু একদম ওমন না। বিলিভ মি।

জান্নাত আবিরের কথা শুনে না হেসে আর পারে না। একটু হেসে আস্তে করে বলে,

~ আপনি যদি হাজারটা মেয়ের সাথে আগে থাকেনও তাও আমি কিছু বলতে পারবো না। কারণ আমার সে অধিকার নেই। আমার সব তো আপনাকে আগেই দিয়ে দিয়েছি। সরি বলতে হবে না। আপনি যে সাহায্য করছেন তার সামনে আমার শরীরটা কিছুই না। একটা আশ্রয়হীন ক্ষুধার্ত অসহায় মেয়েকে আপনি আকাশচুম্বি জায়গা দিয়েছেন৷ এরচেয়ে বড়ো আর কি হতে পারে? আমি ত সামান্য একটা মেয়ে। আমার সাথে কিছু করলেও তেমন কিছু হবে না। আপনি আর সরি বলবেন না৷ প্লিজ।

আবির জান্নাতের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। কিছু বলছে না। ওর খুব রাগ হচ্ছে জান্নাতের উপর। জান্নাত সবসময় যা মন চায় তাই বলে দেয়। আবিরকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জান্নাত বুঝে যায় ও আবিরকে রাগীয়েছে। এবার ও শেষ। তাই মাথা নিচু করে বলে,

~ সরি….
– আচ্ছা তুমি নিজেকে এত মূল্যহীন মনে করো কেন? আমার কাছে তোমার মূল্য কত তোমার কোন ধারণা আছে? যখন যা মন চায় তাই বলে দেও। এতটা স্বস্তা তুমি না। অন্তত আমার কাছে না।
~ সরি সরি। প্লিজ রাগ করবেন না৷ আমি জাস্ট বাস্তবতাটা বললাম।
– বাস্তবতা না? দাঁড়াও একটু অপেক্ষা করো বাস্তবতা তোমাকে বুঝাবো আমি।
~ কি করবেন? আমাকে বাসা থেকে বের করে দিবেন? দেন, কিন্তু আমার ভাইটাকে বাঁচিয়েন?

আবির এবার সত্যিই খুব রাগ করে। মন তো চাচ্ছিল জান্নাতকে মেরে আলুভর্তা বানিয়ে ফেলুক। কিন্তু সেটা ও করতে পারবে না। তাই ও বেড ছেড়ে উঠে খপ করে জান্নাতকে কোলে তুলে নেয়৷ জান্নাত যেমন অবাক হয় তেমন ভয়ও পায়। তারপর ওকে নিয়ে সোজা বারান্দায় চলে যায়৷ গিয়ে রাগী ভাবে বলে,

– বলো আর ওসব কথা বলবা নাকি এখান থেকে নিচে ফেলে দিব? দিব দিব?
~ ওরে বাবা রে না না। সরিইইইই সরিইই। আল্লাহ বাঁচাও। আমি আর কিছু বলবো না। প্লিজ আমাকে ফেলে দিয়েন না৷ আমার ভাইটাকে আমি দেখতে চাইইইই।

আবিরের গলা জড়িয়ে ধরে ভয়ে চোখ বন্ধ করে বলল। আবির হাসতে হাসতে জান্নাতকে নিয়ে ঘুরতে থাকে। এরপর ওকে সাবধানে রেলিং এর উপর বসিয়ে দেয়। জান্নাত খুব ভয় পাচ্ছে। ও আবিরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছে। আর আবির হাসতে হাসতে শেষ। জান্নাত এখন মুগ্ধ হয়ে আবিরের হাসি দেখছে। আবির জান্নাতের নরম কোলে মাথা রাখে। জান্নাত ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে হঠাৎই ওর মনে একটা প্রশ্ন আসে। জান্নাত জিজ্ঞেস করে,

~ আপনার বাবা-মা ভাই বোন কই? এত সকাল হলো কাউকে দেখলাম না। মানে একবার ডাকলোও না। তারা কোথায়?

জান্নাতের প্রশ্নটা শেষ হতে না হতেই আবিরের মুখ থেকে হাসিটা হারিয়ে যায়। ও মাথা তুলে জান্নাতকে ধরে নিচে নামিয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

– তুমি আর হাসান আঙ্কেল ছাড়া আমার আপাতত আর কেউ নেই। আসো ফ্রেশ হবে৷

বলেই আবির ভিতরে চলে যায়। জান্নাত আবিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এত বড়ো ধনী একজন ব্যক্তির, ও আর আঙ্কেল ছাড়া কেউ নেই! জান্নাত হিসাবটা মিলাতে পারে না। এ কি করে সম্ভব! বাবা-মা ছাড়া কেউ এতদূর আসতে পারে? জান্নাতকে এর উত্তর জানতে হবে৷ কিন্তু কোন অধিকারে আবিরকে প্রশ্ন করবে ও? ও তো একটা গোলাম। কিংবা চাহিদা মেটানোর পাত্র মাত্র। জান্নাতের মুখটা মলিন হয়ে আসে। আবির আবার এসে ওর হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে আসে। এসে ওকে নিয়ে সোজা ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে বলে,

– যাও দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসো নাস্তা খাবো। তারপর অনেক কাজ আছে আজকে। তোমার ভাইয়ের অপারেশন আজকে মনে আছে?
~ হ্যাঁ হ্যাঁ আছে। যাচ্ছি।
– হুম যাও। (হাসি দিয়ে)

জান্নাতের এই প্রথম মনে হলো আবিরের হাসিটা মিথ্যে। এই হাসির পিছনে মানুষটা অন্যরকম। এটা আসল আবির না৷ এটা মুখোশধারী ভালো থাকার অভিনয় করা আবির। জান্নাত এটুকু বুঝে। ও আবিরকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে ফ্রেশ হতে চলে যায়। এই ফাঁকে আবির কয়েকটা কল দিয়ে কথা বলে নেয়। আজকের কাজের সিডিউলটা ঠিক করে। জান্নাত বের হলে আবির চলে যায় ফ্রেশ হতে। জান্নাত দেখে এবার আবির তোয়ালেটা রেখে গিয়েছে। তাই ও আবিরের মতো তোয়ালেটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর ভাবে, কি এমন হয়েছে আবিরের সাথে যে বাবা-মা ভাই বোনের কথা বলতেই আবিরের মুখের হাসি নিমিষেই নাই হয়ে গেল! জান্নাত ভাবতে ভাবতে আবির বের হয়৷ ও দ্রুত তোয়ালেটা আবিরের দিকে এগিয়ে দেয়। আমি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে,

– এদিক আসো।

আবির বেডে বসে বলে,

– তুমি আমার মুখটা মুছে চুলটা সুন্দর করে সেট করে দেও তো।
~ আমিই?
– হ্যাঁ তুমিই। দেও।
~ আচ্ছা৷

আবির লক্ষ্মী বালকের মতো চুপচাপ বসে থাকে। জান্নাত খুব আদর মিশ্রিত ভাবে আবিরের মুখখানা মুছে দিয়ে ওর ঘন কালো সিল্কি চুলটা আঁচড়ে দেয়। কাজ শেষ হলে আবির জান্নাতের কোমড় জড়িয়ে ধরে থাকে কিছুক্ষণ। জান্নাতের কাছে আবিরকে এখন একটা ছোট বাচ্চার মতো লাগছে। ও আবিরের কাঁধে হাত রাখে৷ আবির কিছুক্ষণ পর ওকে ছেড়ে মুখে একরাশ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে জান্নাতের গাল দুটো ধরে বলে,

– থ্যাঙ্কিউ।

বলে ওর কপালে এক চুমু দেয়৷ জান্নাত অবাক হয়ে চোখ বন্ধ করে সেটা গ্রহণ করে। আবিরকে সত্যিই বুঝা অনেক মুশকিল। কখন যে কি করে তা ধারণার বাইরে৷ আবির জান্নাতকে দেখে নিজের থুতনিতে হাত রেখে ভাবতে ভাবতে বলে,

– ওয়েট তোমার তো জামা কাপড় নেই। সেই কাল রাত থেকে একটা জামাই পরে আছো। চলো নাস্তা খেয়ে আগে শপিং এ যাই৷
~ থাক না এসব লাগবে না।

আবির চোখ গরম করে জান্নাতের দিকে তাকায়। জান্নাত মুহূর্তেই বেলুনের মতো চুপসে যায়। আবির গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

– আমি যা বলবো তাই হবে৷
~ আচ্ছা৷

এরপর ওরা নিচে চলে আসে। হাসান আঙ্কেল ওদের দেখে বলেন,

– গুড মর্নিং।
– গুড মর্নিং আঙ্কেল। নাস্তা করেছেন?
– না বাবা। তোমাকে ছাড়া আমি খাই বলো?
– তাহলে আসেন একসাথে খাই৷ জান্নাত আসো।

আবির, জান্নাত আর হাসান আঙ্কেল একসাথে নাস্তা করতে বসেন। আবির জান্নাতকে নিজ হাতে খাবার বেরে দিতে দিতে বলে,

– হাসান আঙ্কেল আমার সবচেয়ে কাছের একজন। তিনি না থাকলে হয়তো আমি আজ এখানে থাকতাম না। উনি আমার বাবা-মা সব৷ ওনাকে সবসময় রেস্পেক্ট দিয়ে কথা বলবে। উনি যা বলবে তাই করবে। ঠিক আছে?
~ আচ্ছা।
– আরে মা ওর কথায় কান দিবে না৷ ও একটা পাগল। তুমি তোমার মতো করে থাকবে। যা লাগবে আমাকে বইলো।
~ না না আঙ্কেল সমস্যা নেই৷

এরপর আবির হাসান আঙ্কেলের সাথে অনেক কথা জুড়ে বসে৷ অন্যদিকে জান্নাত মনে মনে ভাবে, যে হাসান আঙ্কেলই বলতে পারবে কেন আবিরের বাবা-মা নেই। কেন ওর বাবা-মার কথা শুনলে ওর হাসি হারিয়ে যায়৷ জান্নাত একটা সুযোগ খুঁজছে হাসান আঙ্কেলের সাথে কথা বলার জন্য। এরপরে ওদের নাস্তা শেষ হলে আবির রেডি হয়ে সোজা শপিং মলে চলে যায় জান্নাতকে নিয়ে৷ আবির ওর পরিচিত একটা দোকানে গিয়ে জান্নাতকে অনেকগুলো ড্রেস কিনে দেয়। জান্নাত একটা কথাও বলতে পারে নি। আবিরের যা পছন্দ হয় তাই কিনে দিয়েছে। ও শুধু পুতুলের মতো বসে ছিল। আবির একটা ড্রেস ওর হাতে দিয়ে বলে,

– যাও এটা পরে আসো। আমরা এখান থেকে হাসপাতালে যাবো। ডক্টর মাইকেল চলে আসছেন।
~ আচ্ছা।

জান্নাত দ্রুত ড্রেসটা পরে আসে। আবির ওকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। সাথে উপস্থিত সবাইও। সবাই জান্নাতকে দেখে বলছে, অনেক সুন্দর লাগছে। আবির শুধু মুচকি হাসছে। আর জান্নাত ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে। জামা, জুতা আর অনেক মেকাপ কিট কিনে দেয় আবির। জান্নাত যা জীবনেও দেখেনি তা ওকে কিনে দেয়৷ আবিরের লোকেরা ওদের শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে বাসায় চলে যায়৷ এখন ঘড়িতে প্রায় দুপুর ৩ টা বাজে। তাই আবির আর জান্নাত একটা বড়ো রেস্টুরেন্টে ঢুকে দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়। তারপর দ্রুত হাসপাতালে যায়৷ সবার আগে মাইকেলের সাথে আবির অনেকক্ষণ কথা বলে। বিকেল ৫ টায় অপারেশন শুরু করবে৷ জান্নাতের খুব ভয় করছে৷ ও চুপচাপ বসে আল্লাহকে ডাকছে। আবির ডক্টর মাইকেলের সাথে কথা বলে জান্নাতের পাশে এসে বসে। জান্নাত আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,

~ কত টাকা দিতে হয়েছে এই ডক্টরকে?
– তোমার জানতে হবে না।
~ প্লিজ বলেন। প্লিজ।
– বাদ দেও না।
~ প্লিজ। (আবিরের হাতে হাত রেখে)
– ৬০ হাজার ডলার। মানে ৫০ লক্ষ টাকা।

জান্নাতের মাথাটা নিচু হয়ে যায়৷ ও অসহায় কণ্ঠে বলে,

~ কোথায় মাত্র ৫ লক্ষ টাকার সাহায্য চেয়েছিলাম। আর এখন একজন ডাক্তারকেই ৫০ লক্ষ টাকা দিতে হচ্ছে৷ আমার জীবন দিলেও তো….
– আহ! জান্নাত! থামবে? একটা মানুষের জীবন বাঁচানোর থেকে কি টাকা বড়ো? মানুষ টাকা কেন ইনকাম করে? বেঁচে থাকার জন্য। আমার টাকার বিনিময়ে যদি কেই বেঁচে যায় তাহলে আমার জীবনটা স্বার্থক হবে৷ আমি সেটা ভেবেই সাহায্য করছি। আর আমি কিন্তু ফ্রীতে কিছু করিনি৷ এই যে তোমাকে পুরো আমার করে নিয়েছি। তোমার সামনে তো এই ৫০ লক্ষ টাকা ৫ পয়সার চেয়েও কম। (জান্নাতকে আঁকড়ে ধরে)

আবিরের কথা শুনে জান্নাত মুগ্ধ হয়ে যায়৷ এরকম মানুষ আজকাল খুব কমই পাওয়া যায়। আবির সত্যিই খুব ভালো। কিন্তু একটা রহস্য একটা চাপা কষ্ট আবিরের মাঝে লুকিয়ে আছে৷ জান্নাত সেটা জানতে চায়৷ আর কেনই বা আবির ওকে ওর জীবনে জড়ালো? কেন? ও জানতে চায়।

দেখতে দেখতে বিকেল পাঁচটা বেজে যায়। আবির আর জান্নাত আইসিইউর সামনে বসে আছে৷ অপারেশনটা খুব ক্রিটিকাল। একটু ভুল হলে সব শেষ। জান্নাত খুব ভয় পাচ্ছে। মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে। আবির ওর পাশে ওর হাত ধরে বসে আছে৷ হয়তো আবির না থাকলে ও এত সাহস পেতো না৷ আবিরের অস্তিত্ব ওকে অনেকটা সাহসী করে তুলেছে। বিকেল ৫ টায় অপারেশন শুরু হয়৷ টানা দুই ঘণ্টা পর হঠাৎই কয়েকজন নার্স আইসিইউ থেকে দ্রুত বের হয়ে যায় কি যেন আনতে৷ আবির আর জান্নাত ভয় পেয়ে যায়। তারা কিছুক্ষণ পর ব্লাড নিয়ে আসলে আবির দ্রুত একজনকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। নার্স বলে, রোগীর প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তাই রক্ত দিতে হবে৷ তারা আবার ভিতরে চলে যায়৷ জান্নাত এ কথা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। আবিরও অনেকটা ভয় পেয়ে যায়৷ কারণ নার্সদের অনেক চিন্তিত মনে হচ্ছিল। আবির জান্নাতকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু বোন তো, কান্না থামে না৷ এভাবে আরও দুই ঘণ্টা কেটে গেলে ডক্টর মাইকেল বের হয়৷ আবির আর জান্নাত ভীষণ চিন্তিত মুখ নিয়ে তার কাছে যান৷ ওদেরকে দেখে ডক্টর মাইকেল প্রশ্ন করেন,

– আপনাদের এ অবস্থা কেন? শোনেন, সুখবর আছে। অপারেশন সাকসেসফুল। রোগী এখন একদম সুস্থ। আর কোন চিন্তা নেই৷ আগামী ২ মাসের মধ্যে রোগী একদম সুস্থ হয়ে যাবে। আর কোন ভয় নেই।

আবির প্রচন্ড খুশি হয়ে ডক্টর মাইকেলকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানায়৷ তারপর জান্নাতের দিকে ফিরে বলে,

– শুনেছো জান্নাত ডক্টর কি বলেছে? তোমার ভাই এখন একদম সুস্থ। আর কোন চিন্তা নেই তোমার। এবার তো একটু হাসো।

ডক্টর মাইকেল হাসি দিয়ে চলে যান৷ জান্নাত আবিরের দিকে তাকিয়ে খুশিতে অঝোরে কান্না করতে করতে ওকে জড়িয়ে ধরে। আবিরও জান্নাতকে বুকের মাঝে নিয়ে সবার আড়ালে ওর চোখটা মুছে নেয়৷ জান্নাত কাঁদতে কাঁদতে বলে,

~ মহান আল্লাহ আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। সত্যিই আমি অনেক ধন্য। আজ আপনি না থাকলে আমাদের দুই ভাই বোনের জীবনটা শেষ হয়ে যেত। অসংখ্য ধন্যবাদ ওই মহান আল্লাহকে আর আপনাকেও।

আবির জান্নাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আর একটা জিনিস ভাবতে থাকে। আবির জান্নাতকে ছেড়ে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,

– তুমি এখানে একটু বসো আমি একটা কল করে আসি।
~ আচ্ছা। (অবাক স্বরে)

জান্নাত আইসিইউর গ্লাস দিয়ে ওর ভাইটাকে দেখছিল। আর আবির কাকে যেন কল দিতে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলে,

– চলো বাসায় যাই। এখানে থেকে লাভ নেই। তোমার ভাইয়ের জ্ঞান আসলে আমাদের জানাবেনে। আর হাসপাতালে বেশিক্ষণ থাকা ভালো না চলো।
~ ঠিক আছে৷ আপনি যা বলবেন তাই হবে। চলুন।
– গুড গার্ল। এখন না লাইনে এসেছো তুমি। আচ্ছা ওয়েট, আমি যা বলবো তাই হবে? সত্যি?
~ হুম।
– বুইঝো কিন্তু… পরে না করতে পারবা না? (শয়তানী হাসি দিয়ে)

জান্নাত চিন্তায় পড়ে যায়৷ তাও ও সাহস করে বলে,

~ করবো না৷
– ওকে ওকে তাহলে বাসায় চলো।
~ আচ্ছা৷

আবির কেমন জানি মিটমিট করে হাসছে৷ জান্নাত কিছুটা হলেও বুঝছে আজ রাতে মনে হয় আবির ওকে আর ছাড়বে না। কারণ আবিরকে অনেক হাসিখুশি দেখাচ্ছে। জান্নাত গাড়িতে উঠে মনে মনে ভাবে,

~ আবির যদি আমাকে এখন ভোগও করে তাও আমার কোন কষ্ট নেই। কারণ সে আমার ভাইকে বাচিঁয়েছে। আমার আর কোন চাওয়া পাওয়া নেই। কিন্তু আল্লাহর কাছে আমি দোষী হচ্ছি। পাপ করছি আমি। এভাবে একটা পরপুরুষের সাথে থাকা কখনোই ঠিক না। সেখানে আমি…

জান্নাতের খুব খারাপ লাগে। কিন্তু ও মেনে নেয়। হয়তো এটাই ওর ভাগ্যে ছিল। দেখতে দেখতে ওরা বাসায় চলে আসে। আবিরের ভিতরে কেমন জানি এক অস্থিরতা খেয়াল করছে জান্নাত। আবির গাড়ি পার্ক করে জান্নাতকে নিয়ে বাসায় যায়। ওদের রমে এসে জান্নাতকে বসিয়ে আলমারি থেকে একটা নীল কাজ করা শাড়ি বের করে দিয়ে বলে,

– যাও মন ভরে সাওয়ার নিয়ে এটা পরে আসো।

জান্নাত খুব অবাক হয়। ওর মনে একটা প্রশ্ন জাগে কিন্তু আবিরের হাস্যজ্জ্বল মুখখানা দেখে জান্নাতও হাসি দিয়ে আবিরের কথা মতো চলে যায়। কারণ আবিরের এই হাসিটা রিয়েল ছিল। জান্নাত আধা ঘণ্টা পর বের হয়। আবিরও ফ্রেশ হয়ে বসে আছে৷ জান্নাত বাইরে এসে দেখে আবির কালো একটা পাঞ্জাবি পরে আছে। জান্নাত আশ্চর্য হয়। এই রাত ১০ টায় আবির পাঞ্জাবি কেন পরলো? অন্যদিকে আবির জান্নাতকে দেখে খুশিতে ওর কাছে এসে ওকে দেখে বলে,

– ওয়াও জান্নাত ওয়াও। একদম আমার মনের মতো লাগছে৷ উফফফ! কারো নজর না লাগুক।

জান্নাত আমতা আমতা করে বলে,

~ আচ্ছা এই রাতে আপনি পাঞ্জাবি কেন পরেছেন? কোথাও যাবেন?
– ওহ! তোমাকে তো বলা হয় নি…
~ কি?
– নিচে কাজী এসে বসে আছে। আমরা এখন বিয়ে করবো। চলো। (হাসি দিয়ে বলল)

জান্নাত যেন মিলি সেকেন্ড এর ভিতর পাথর হয়ে গেল। ও কি সঠিক শুনলো নাকি ভুল? জান্নাত নিজেকে একবার চিমটি কেটে আবার জিজ্ঞেস করে,

~ আমি বোধহয় ভুল কিছু শুনেছি। আবার একটু বলনেন কি বলেছেন?

আবির হাসতে হাসতে ওর সামনে এসে ওর গাল দুটো ধরে কপালে কপাল লাগিয়ে বলে,

– আমরা এখন এই মুহূর্তে বিয়ে করবো। নিচে কাজী এসে অপেক্ষা করছে চলো।

জান্নাতের চোখ ইয়া বড়ো বড়ো হয়ে যায়। এটা স্বপ্ন না সত্যি। আবির ওকে বিয়ে করবে? এখন? কিভাবে কি? জান্নাতের কোন ভাবেই বিশ্বাস হচ্ছে না। ও ভীতু চিন্তিত স্বরে বলে,

~ আপনি মজা করছেন তাই না? প্লিজ বলেন মজা করছেন? কারণ এটা তো অসম্ভব। আমার মতো মেয়েকে আপনি কেন বিয়ে করবেন! না না আপনি নিশ্চয়ই মজা করছেন। (কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে)

আবির একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে জান্নাতের ওড়নাটা সুন্দর করে পরিয়ে দিয়ে ওকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে নিচে আসতে থাকে। জান্নাতের ভিতরে এখন কি যে হচ্ছে তা বলার বাইরে। ওর হার্টবিট যে এখন কত বেশি তা ও ছাড়া আর কেউ জানে না। মনে হয় হার্টটা বেড়িয়ে আসবে৷ ওর কোন ভাবেই বিশ্বাস হচ্ছে না আবির ওকে এখন বিয়ে করবে৷ জান্নাত আবিরের সাথে যেই নিচে আসে দেখে কয়েকজন লোক বসে আছে। তার মাঝে সত্যি সত্যি একজন কাজী বসে আছে!৷ জান্নাত হা করে তাকিয়ে আছে। তাহলে কি আবির সত্যিই ওকে বিয়ে করতে যাচ্ছে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here