তুমি যদি চাও,পর্ব – ১২,১৩

0
2427

তুমি যদি চাও,পর্ব – ১২,১৩
রাজেশ্বরী দাস ( রাজী )
পর্ব – ১২

আমি , সুরভি , শুভ্রাংশুদা আর অর্ঘ্যদা ছাদে দাঁড়িয়ে আছি । শুভ্রাংশুদা এইমুহুর্তে নিজের দুঃখ প্রকাশ করে চলেছেন ।

” এটা কি মানা যায় ?? বিয়ে করা বউ থাকতেও নাকি ব্যাচেলরদের মত বউ ছাড়া একা থাকতে হবে । কোথায় আমার মাম্মা বাংলা সিরিয়ালের মায়েদের মত আদেশের সুরে বলবে যে খোকা এক বছরের মধ্যে আমরা আমি নাতি – নাতনির মুখ দেখতে চাই , তা না দেখো…”

গালে হাত দিয়ে তার এরূপ দুঃখপ্রকাশ শুনে চলেছি আমি , ওনার এরূপ দুঃখের কথা শুনে প্রচণ্ড রকমের হাসি পেলেও সেটা এইমুহূর্তে আটকে রাখাটাই শ্রেয় বলে মনে হচ্ছে আমার । অর্ঘ্যদা ওনার ঘাড়ে হাত রেখে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে একটা হাঁসি দিয়ে বললেন….” হ্যাঁ সেই কোথায় ভেবেছিলি বিয়ের পর বউকে নিয়ে একটু রোমান্স করবি , কিন্তু তা না দেখ সেই বউ ছাড়া থাকতে হবে এখন । ”

” তুই কি কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিচ্ছিস…!! ”

” তখন তোকে কে বলতে বলেছিল যে… আমি বিয়ে করতে পারবো না , একটু হলেই তো মনে হচ্ছিল এত কষ্ট করে যে সবাইকে রাজি করালাম সব বৃথা হয়ে যাবে হইতো । এবার বোঝো ঠ্যালা । ”

ওদের কথার মাঝে মৃদু হেসে আমি অর্ঘ্যদাকে বললাম….” অর্ঘ্যদা এবার আপনিও বরং একটা ভালো মিষ্টি মেয়ে দেখে চটজলদি বিয়েটা সেরে ফেলুন । ”

অর্ঘ্যদা আর শুভ্রাংশুদা কথাটা শুনে আমার দিকে তাকালেন , শুভ্রাংশুদা একটু হেসে অর্ঘ্যদার পিঠ চাপড়ে বললেন…” কথাটা কিন্তু মন্দ বলেনি কী বলিস অর্ঘ্য ?? ”

অর্ঘ্যদা কথাটা শুনে শুধু মৃদু হাসলেন । আমি কিছুসময় নিশ্চুপ থেকে সকলের উদ্দেশ্যেই বললাম….” আপনারা কফি খাবেন ?? ”

শুভ্রাংশুদা মুচকি হেঁসে বললেন….” এখন এক কাপ কফি পেলে যদিওবা মন্দ হয় না । ”

” আচ্ছা ঠিক আছে আপনারা কথা বলুন আমি কফি নিয়ে আসছি সবাই জন্য , সুরভি তুই আসবি আমার সাথে ?? ”

” হ্যাঁ চল ”

আমি আর সুরভি নীচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম ।
.
.
সঙ্গীতারা চলে গেলে শুভ্রাংশু আর অর্ঘ্য ওদের গন্তব্য পথের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকালো । শুভ্রাংশু কিছুক্ষন চুপ থেকে হঠাৎই বলে উঠলো….” অর্ঘ্য সঙ্গীতাকে ভালোবেসে ফেলেছিলি তুই তাই না ?? ”

অর্ঘ্য কথাটা শুনে কিছুটা চমকে শুভ্রাংশুর দিকে তাকালো ….” তুই…”

অন্যদিকে , আমিও কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে গেলাম । আমি প্রায় নীচে চলেই গিয়েছিলাম তখন আমার মনে পরলো আমি এটা জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছি ওদের যে ওরা কী কফি খাবে ? ব্ল্যাক কফি নাকি দুধ দেওয়া । সেটা জিজ্ঞাসা করার উদ্দেশ্যেই সুরভিকে নীচে যেতে বলে ওপরে আসি আমি কিন্তু সিড়িঘরের কাছে আসতেই তাদের কথা কানে আসে আমার । না চাওয়া সত্বেও সেখানেই দাঁড়িয়ে পরি আমি ।

শুভ্রাংশুদা মৃদু হেঁসে অর্ঘ্যদাকে উদ্দেশ্য করে বললেন….” তোর বেস্ট ফ্রেন্ড আমি , তোর মনের কথা আমি খুব ভালোভাবেই বুঝি অর্ঘ্য । তোর পছন্দ অপছন্দ আমি জানি খুব ভালোভাবেই । ”

অর্ঘ্যদা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন….” হুমম ও হইতো আমার পছন্দ ছিল , তবে কথায় আছে না যা হয় ভালোর জন্যই হয় , তাই হইতো সেই পছন্দ গভীর হওয়ার পূর্বেই আমি বুঝতে পারি যে ও তোর ভালোবাসা । আর সত্যিই তোর মত করে ওকে হইতো আর কেউই ভালোবাসতে পারবে না , আর ঔ তোকে খুব ভালোবাসে । তাই ভাবলাম তোদের মাঝে ঢুকে ভিলেনগীরি করে আর কী লাভ ? তার চেয়ে বরঙ তোদের এক হতে সাহায্য করি । দেখ অংশু এই বন্ধুত্বের দিক থেকে কিন্তু আমি জিতে গেলাম । ”

শুভ্রাংশুদার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন অর্ঘ্যদা , তিনি শুভ্রাংশুদার দুই ঘাড়ে হাত রেখে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও বললেন…” তবে হ্যাঁ বিয়ে অবশ্যই করবো । দেখিস একদিন হটাৎ করে সুন্দরী দেখে একটা মেয়েকে বিয়ে করে আনবো আর তোদের সবাইকে একদম চমকে দেবো আমি । ”

শুভ্রাংশুদা অর্ঘ্যদার কথায় হাসলেন । ওরা দুজনই একে অপরকে জড়িয়ে ধরল । অন্যদিকে , ওদের এমন বন্ধুত্ব দেখে নিজের অজান্তেই মুখে হাঁসি ফুটে উঠলো আমার , আর যেতে ইচ্ছে করলো না সেখানে তাই সোজা নীচে কিচেনের দিকেই এলাম । ঠিক করলাম সকলের জন্য নিজের পছন্দ মত কফি বানাবো ।

আমি নীচে কিচেনে আসতে দেখি সুরসুরি কিছু একটা নিয়ে ভাবছে খুব , কিন্তু এই মুহূর্তে আমার তাড়া আছে তাই আমি ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে কফি বানানোর কাজে মন দিলাম । সুরভি আমার কাছে এসে বলল….” এই সঙ্গু শোন না ”

” কী ?? ”

” অনেক জরুরি একটা কথা আছে ”

আমি ওর দিকে ঘুরে তাকালাম…” কী কথা ?? এই এই তুই আগে থেকেই জানতি তাই না যে আমার বিয়ে শুভ্রাংশুদার সাথে হচ্ছে তাও বলিসনি আমাকে…!! ”

” আরে বাবা আমি আগে থেকে থোড়াই না জানতাম , এখানে এসে জানলাম আর তারপর বলিনি তোকে ভাবলাম সারপ্রাইজ নষ্ট করে লাভ নেই । উফ..!! কিন্তু আমি সেটা বলছি না তো , অন্য কথা বলছি । তোকে সেই দুই দিন থেকে বলবো ভেবেও বলতে পারছি না আমি কথাটা । ”

” আচ্ছা থাম কফিটা ওদের দিয়ে আসি আগে তারপর শুনছি । ”

আমি ওদের দুজনের জন্য কফি নিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলাম ছাদের দিকে । ছাদে গিয়ে ওদের সামনে আমি ট্রেটা ধরলাম , ওরা দুজন কফির কাপদুটো তুলে নিল । শুভ্রাংশুদা কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললেন….” উম…, পারফেক্ট । ” আমি ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সেখান থেকে চলে আসলাম । আমি নীচে এসে সুরভির হাতে এক কাপ কফি ধরিয়ে দিয়ে নিজে একটা কফির কাপ হাতে নিয়ে বললাম….” এবার বল কী হয়েছে ?? কী গন্ডগোল পাকিয়েছিস আবার ?? ”

সুরভি মুখটা কেমন যেন কাচুমাচু করে বলল….” আরে বাবা আমি কিছু করিনি । বাবা মা পাত্র ঠিক করে ফেলেছে , ডক্টর আদিত্য সেনগুপ্ত । ওরা দেখতে এসেছিল , ওদের আর ওই ছেলের নাকি আমাকে খুব পছন্দ । তার সাথেই নাকি আমার বিয়ে দেবে । ”

আমি কফির কাপে চুমুক দিয়ে ভাবলেশহীনভাবেই বললাম….” তো ভালো কথা , বিয়ে করবি তাতে কী ? আর এতে এমন মুখ গোমড়া করে রাখার কী আছে ?? তোর কি কোন সমস্যা আছে ওই পাত্রকে নিয়ে ?? ”

” ইয়ে না মানে , সমস্যা নেই কোন তেমন । ”

” ওহ তাহলে আর কী ?? বিয়ে করে ফেল তাড়াতাড়ি । ”

আমি সুরভির দিক থেকে চোখ সরিয়ে আবারও কফির কাপে চুমুক দিলাম ।
.
.
.
.

কলেজ থেকে ক্লাস শেষ করে আমি আর সুরভি মাঠের দিকে এগিয়ে আসছিলাম তখনই হটাৎ সুরভি হাঁটা থামিয়ে দিল , আমি ওর দিকে তাকাতে বুঝলাম ও সামনে তাকিয়ে আছে । ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই দেখলাম একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে , আমি সুরভিকে হালকা ধাক্কা দিতে ও আমার দিকে তাকালো । আমি ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম…” ব্যাপার কী ?? ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন ?? ”

” ঐতো বলেছিলাম না তোকে সেদিন ডক্টর আদিত্য সেনগুপ্ত..!! ”

” ওহ.. ইনিই তোর হবু বর । ”

কথার মাঝেই উনি এদিকে এগিয়ে এলেন । উনি এদিকে এগিয়ে এসে মুচকি হেঁসে বললেন….” হ্যালো , তুমি নিশ্চয় ওর বন্ধু সঙ্গীতা তাই তো ?? ”

আমি হেঁসে বললাম….” হ্যাঁ , আপনি কীভাবে জানলেন ?? ”

” আব তোমার বান্ধবীর কাছে শুনেছি তোমার কথা , ও বলেছিল আমাকে । আমি ডক্টর আদিত্য সেনগুপ্ত , তুমি চাইলে আদি দা বলেও ডাকতে পারো । ”

আমি সুরভির দিকে সরু চোখে তাকালাম আর কানের কাছে বিড়বিড় করে বললাম….” আচ্ছা তো সুরসুরির বাচ্চা তলে তলে এতদূর…!! ”

ও আমাকে বিড়বিড় করে বলল…” আরে তেমন কিছু না । ”

” চুপ থাক তুই , বোঝা হয়ে গেছে আমার কেমন কিছু সেটা । ”

আমি সামনে আদি দার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছেন । আমি তাকে বললাম….” হ্যাঁ আদি দা ও আমাকেও বলেছিল আপনার সম্পর্কে । আপনার যা প্রশংসা করছিল ও , কী আর বলবো..!! ”

উনি অবাক হয়ে বললেন…” আমার…!! ”

” হ্যাঁ আপনার , তাই না সুরসুরি.. ”

সুরভির দিকে তাকাতে দেখলাম ও আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে । আমি সেটা দেখে মুখ টিপে হাসলাম ।

” সঙ্গীতা…”

হটাৎ শুভ্রাংশুদার গলা শুনে আমি পিছু ঘুরে তার দিকে তাকালাম , উনি আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন । উনি সামনে আদি দার দিকে একবার তাকিয়ে আমার দিকে তাকাতেই আমি বললাম….” উনি আদি দা , সুরভির হবু বর ”

সুরভি হেসে আদি দাকে উদ্দেশ্য করে বলল…” আর উনি শুভ্রাংশুদা , সঙ্গুর হাসবেন্ড উনি ”

ওরা দুজন হেসে একে ওপরের সাথে হাত মিলালো ।

” আচ্ছা তোমরা থাকো আমরা তবে এখন আসছি কেমন ?? ”

শুভ্রাংশুদা এই বলে আমার হাত ধরে বাইরের দিকে আসছিলেন তখনই থার্ড ইয়ারের একটা মেয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে ওনাকে উদ্দেশ্য করে বলল….” আরে শুভ্রাংশুদা আপনি..!! আপনাকে আমি দেখেছিলাম যখন আমি কলেজে প্রথম আসি তখন , আর তারপরও তো কলেজে আপনার কত নাম শুনেছি কলেজে । আপনি এই কলেজে এতদিন পরে…!! ”

” বউ -এর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম । কী হলো সোনা তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন ? চলো আমাদের দেরি হচ্ছে তো। ”

উনি আমার হাত ধরে সোজা বাইরে গাড়ির কাছে নিয়ে এলেন । মেয়েটার জন্য যে উনি বিরক্ত তা বেশ ভালো বুঝতে পারছি আমি । উনি আমাকে গাড়িতে উঠে বসতে বললেন আমি আর বেশি কথা না বাড়িয়ে উঠে বসলাম ।
.
.
.

উনি গাড়ি চালাচ্ছেন আর আমি মাঝে মাঝে আড়চোখে ওনার দিকে তাকাচ্ছি , উনি গাড়ি চালাতে চালাতেই হটাৎ বলে উঠলেন….” আরে ওভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার কী আছে ? আমি তো পুরোপুরি তোমারই , দেখতে হলে ঠিকভাবে দেখো আমাকে । ”

আমি ওনার কথা শুনে কিছুটা লজ্জা পেয়ে ওনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম । তারপর আমতা আমতা করে বললাম….” আ..আমার বয়েই গেছে আপনার দিকে তাকাতে । ”

উনি কথাটা শুনে ভ্রু কুচকে সরু চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবারও সামনে তাকালেন । গাড়ি এসে আমাদের বাড়ির সামনে থামতেই আমি গাড়ি থেকে নামতে গেলাম কিন্তু উনি আমার এক হাত ধরে আমাকে আটকে তার কিছুটা কাছে টেনে নিলেন । আমি ওনার এমন কান্ড দেখে চোখ বড় বড় করে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম….” শুভ্রাংশুদা ক..কী করছেন আপনি..!! ছাড়ুন , আমি বাড়ি যাবো তো নাকি..!! ”

কথাটা শুনে ওনার মুখে বিরক্তি ফুটে উঠলো , উনি আমাকে ধমক দিয়ে বললেন….” আমি তোমার কোন জন্মের দাদা হ্যাঁ ?? ”

” না মানে আমি তো…. ”

উনি ভ্রু কুচকে বললেন…” কী ?? আর যদি দাদা শুনেছি তো তোমার দুই গালে দুই থাপ্পড় বসিয়ে দেব আমি বুঝেছো । ”

” হুহ..!! বলবো না এবার তো ছাড়ুন । ”

” উহু ”

” কী উহু ?? আরে আমি যাবো তো নাকি ?? ”

” সবসময় এমন ছটফট করো কেন বলো তো তুমি..!! চুপ করে বসে থাকো তো একটু আর চোখ বন্ধ করো । ”

” কেন ? কেন ? চোখ বন্ধ করবো কেন ?? ”

” করো আগে তাহলেই বুঝবে ”

আমি ওনার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করলাম , উনি আমার হাত ছেড়ে দিলেন আমার গলায় হালকা কিছু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা অনুভব হতেই আমি চোখ মেলে তাকালাম । উনি আমার গলায় একটা চেইন পরিয়ে দিলেন চেইনের সাথে ছোট্ট একটা লকেট । আমি সেটার দিকে তাকিয়ে ওনার দিকে তাকালাম….” এটা তো অনেক সুন্দর , কিন্তু এখন এইসবের কী প্রয়োজন ছিল…!! ”

উনি মুচকি হেসে বললেন….” অবশ্যই প্রয়োজন ছিল , তুমি বেশি কথা বলো না তো । আর আমি আমার বউকে যা খুশি দিতেই পারি । ”

উনি কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে উঠলেন….” সঙ্গীপাখি শোনো আমাকে কিছু দরকারী কাজের জন্য যেতে হবে একটা জায়গায় , তোমার সাথে দুই তিন দিন হইতো আর কথা হবেনা আমার । মন খারাপ করবে না একদম কেমন ? নিজের খেয়াল রাখবে । ”

কথাটা শুনে কেন জানি আমার একটু মন খারাপ হল কিছু বললাম না । উনি সেটা বুঝে আমার দুই গালে হাত রেখে কপালে গভীরভাবে নিজের ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিয়ে বললেন….” ভালোবাসি জান । ”

আমি ওনার কথায় মৃদু হাঁসলাম , উনি আবারও বললেন….” খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো আমি জান , চিন্তা কোরো না । এখন যাও বাড়ির ভেতরে যাও । ”

” হুমম , আপনিও নিজের খেয়াল রাখবেন । ”

উনি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন , আমি ওনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে চলে এলাম ।

শুভ্রাংশু সঙ্গীতার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখান থেকে গাড়ি চালিয়ে চলে গেল ।
.
.
.

ঘুম থেকে উঠে ড্রয়িং রুমে আসলাম আমি , ড্রয়িং রুমে বাবা , মা , দাভাই সকলেই উপস্থিত আছেন । ওনার সাথে আমার সেই দুইদিন আগে কথা হয়েছে , তারপর আর কথা হয়নি ।

আমি ড্রয়িং রুমে গিয়ে সবার সাথে কথা বলছিলাম তখনই দাভাই -এর ফোনটা বেজে উঠলো । ও ফোন তুলে কানে ধরে হ্যালো বলল , অপরপাশের জন কী বলল শোনা গেল না কিন্তু হটাৎ দাভাই এর মুখ কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেল , ও ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে ফোনটা রেখে আমাদের দিকে তাকালো । আমরা সবাই ওর দিকে তাকালাম , আমি ওর মুখের এমন অবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা করলাম…..” দাভাই কী হয়েছে ?? ”

” ব.. বুচি…অংশু…”

” কী হয়েছে ওনার ?? ”

বাবা বলে উঠলেন….” আরে বলবি তো কী হয়েছে ?? তোর চোখ-মুখ দেখে এমন লাগছে কেন ?? ”

দাভাই কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন…” নদীর ধারে যে একটা বড় গোডাউন ছিল , সেখানে সাধারণত মানুষ খুব একটা যাওয়া আশা করে না জানোই তো । সেখানে অংশু আর ওর টিম গতকাল রাতে একটা মিশনের জন্য গিয়েছিল আর সেখানে কালকে আগুন লেগে যায় । আর সেই আগুনে অংশুর টিমের সকলে….”

কথাটা শুনে যেন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, দম যেন আটকে আসছে আমার । আমি অস্ফুট স্বরে বলে উঠি….” উনি…”

দাভাই কাপাকাপা গলায় বলে উঠলেন…” অংশু আর নেই বুচি ”

কথাটা শুনে আমার মাথা ঘুরে উঠলো…..

চলবে,….

তুমি যদি চাও
রাজেশ্বরী দাস ( রাজী )
পর্ব ১৩

দাভাই কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলেন…” অংশু আর নেই বুচি ”

কথাটা শুনে আমার মাথা ঘুরে উঠলো । মা মুখে আঁচল চেপে ধরলেন , বাবা দাভাইকে বললেন…” শান এইসব…. ”

” হ.হুমম বাবা সত্যি ”

আমি নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে দাভাই এর দুই হাত ধরে বললাম….” ত.তুই ক..কী বলছিস এইসব ?? ম..মজা করছিস তাই না আমার সাথে তুই ?? উনি বলেছেন তোকে এইসব আলতু ফালতু মজা করতে তাই তো ?? হ্যাঁ জানি আমি উনি বলেছেন , ওই বজ্জাতটাই বলেছে তাই না ?? খুব শয়তান হচ্ছে ছেলেটা দিন দিন । ”

দাভাই কী আমার দিকে তাকিয়ে আছে , ও বুঝতে পারছে না ঠিক কী বলবে ওর চোখ জ্বলজ্বল করছে ও আমার হাত ধরে আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল….” ব.বনু শোন আমার কথা শান্ত হো আগে । ”

এরই মাঝে বাড়ির কলিংবেলটা বেজে উঠলো , বাবা গিয়ে দরজা খুলে দিলেন , অর্ঘ্যদা বাবাই আর মামনি এসেছেন । তারা ভেতরে আসতেই আমি মামনির কাছে গিয়ে বললাম….” মামনি ও মামনি উনি কোথায় ?? বাবাই বলো না গো উনি কোথায় ?? দেখো না দাভাই কীসব বলছে উনি নাকি নেই , ম..মজা করছে আমার সাথে তাই না ?? উনি তো বলেছিলেন খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন ?? উ.উনি কোথায় ?? ”

মামনি কিছু না বলে মুখে আঁচল চেপে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলেন । অন্যদিকে বাকিদের মুখেও রয়েছে করুণতার ছাপ ।

” কী হলো তোমরা কিছু বলছো না কেন ?? উনি কোথায় ?? ”

এরই মাঝে সকলের চোখ গেল টিভির দিকে , সেই সময় সেখানে একটা খবর দেখানো হচ্ছে । সকলে তাকালো সেদিকে , আমিও সেদিকে ঘুরে টিভির দিকে তাকালাম । খবরে তখন বলা হচ্ছে যে….” নদীর ধারে থাকা বড় পরিত্যক্তপ্রায় গোডাউনটিতে গতকাল মাঝরাতে লেগে যায় আগুন , জানা গেছে সেই সময় সেখানে আমাদের দেশের সি.বি.আই টিমের কিছুজন উপস্থিত ছিলেন । তারা ঠিক কী কারণে সেখানে উপস্থিত ছিলেন সেটা যদিও জানা যায়নি । সেখানে আগুন লাগার মূল কারণ স্পষ্ট না হলেও ধরে নেওয়া হচ্ছে এই আগুন মূলত সেখানে হওয়া শর্টসার্কিটের জন্যই লেগেছিল এবং এটাও ধারণা করা হচ্ছে যে সেখানে উপস্থিত সকলেই নিহত হয়েছেন , সেই আগুনেই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে সকলে । তাদের মধ্যে একজন ছিলেন , সুনামধন্য বিজনেসম্যান সুব্রত চ্যাটার্জীর একমাত্র সন্তান অফিসার শুভ্রাংশু চ্যাটার্জী । ”

ওইটুকু শুনেই আমি পাথরের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সেখানেই , কিছু বলার যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছি আমি । অর্ঘ্যদা নিজেকে সামলে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে উঠলেন….” আমরা সেখান থেকেই আসছি এখন , অফিসার আর মিস্টার দত্তর সাথেও আমাদের কথা হয়েছে । ওরা জানিয়েছে যে গতকাল রাতে অংশু আর ওর টিম কোন এক জরুরি মিশনে সেখানে গেছিল , তারপর নাকি শর্টসার্কিটের কারণে ওখানে আগুন লেগে আর সেই আগুনে ওরা সবাই আর সাথে অংশুও…. ”

বাকিটা বলার আগেই আমি…” না….” বলে চিল্লিয়ে উঠলাম ।

” ন..না ন..না , এমনটা হতে পারেনা , কিছুতেই না ওনার কিছু হয়নি , কিছু হয়নি ওনার । উনি আমাকে বলেছিলেন উনি আসবেন , আসবেন উনি । কিছু হয়নি ওনার , কিছু না । ”

আমি এইসব আপন মনে আওড়াতে আওড়াতে ওপরে নিজের ঘরের দিকে ছুটে গেলাম । আমার মাথা যেন কাজ করছেনা , নিজেকে কেমন যেন পাগল পাগল মনে হচ্ছে আমার । কিছুতেই আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না আমি । ঘরে গিয়ে আগে আমি টেবিলের ওপর রাখা একটা ফুলদানী ছুড়ে ফেললাম , মেঝেতে বাড়ি খেয়ে সেটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল । তারপর ড্রেসিং টেবিলের সামনে যেতেই সেখানে থাকা সমস্ত কিছু ছুড়ে এলোমেলো করে মেঝেতে ফেলে দিলাম আমি ।
.
.
অন্যদিকে , সঙ্গীতার পিছু পিছু বাকিরাও এলো ওপরে , সবাই ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছে সঙ্গীতাকে । সঙ্গীতার মা আর মামনি তো সেই থেকে চোখের জল ফেলেই চলেছেন , বাকিদের মাঝেও রয়েছে করুণতার ছাপ । একদিকে শুভ্রাংশুর মৃত্যুর খবর অন্যদিকে সঙ্গীতার এমন অবস্থা , ওরা সঙ্গীতাকে এইমুহুর্তে ঠিক কীভাবে শান্ত করবে কিছুতেই বুঝতে পারছে না । অর্ঘ্য কিছুক্ষন চুপ থেকে এগিয়ে গেল সঙ্গীতার দিকে । অর্ঘ্য সঙ্গীতার পাশে দাঁড়িয়ে কম্পিত কণ্ঠে বলল….” সঙ্গীত…”

আমি অর্ঘ্যদার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললাম….” অর্ঘ্যদা , অর্ঘ্যদা উনি কোথায় ?? অর্ঘ্যদা আমাকে ওনার কাছে নিয়ে চলুন না , আমি ওনার কাছে যাবো । উনি কোথায় ?? চুপ করে আছেন কেন আপনি ?? আপনারা আমাকে বলছেন না কেন উনি কোথায় ?? বলুন না উনি কোথায় ?? ”

অর্ঘ্য সঙ্গীতার দুই হাত ধরে ঝাঁকিয়ে চিল্লিয়ে বলে উঠলো….” অংশু আর নেই সঙ্গীত , ও আর নেই । এটাই সত্যি , আর এটাই তোমাকে আর আমাদের সবাইকে মেনে নিতে হবে । ও আর নেই ”

আমি কথাটা শুনে পাথরের মূর্তির ন্যায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম , অর্ঘ্য কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল….” সঙ্গীত এমন কেন করছো তুমি ?? একবারও ভেবে দেখেছো বাড়ির বাকিদের কী অবস্থা ?? তুমি যদি এখন এমন করো তবে তাদের কী হবে ভেবে দেখেছো ?? শান্ত হও তুমি । ”

আমি কিছুই বললাম না , পরিবারের সকলের মুখের দিকে একবার তাকালাম আমি তারপর চোখ সরিয়ে মাথা নীচু করলাম । কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধপ করে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লাম আমি আর…” অংশু ” বলে চিল্লিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলাম ।
.
.

অন্যদিকে :-
……………

টিভির সামনে বসে শুভ্রাংশুর মৃত্যুর খবর দেখছে একজন ব্যক্তি , বয়স তাঁর পঁয়ত্রিশ থেকে ছত্রিশ ছুঁই ছুঁই , পরণে ব্ল্যাক শার্ট আর ব্ল্যাক প্যান্ট তার পাশে রয়েছে কালো পোশাক পরিহিত আরো কিছু লোক । সেই ব্যক্তিটি সেই খবরটা দেখে এক পায়ের ওপর আরেক পা তুলে বসে পৈশাচিক একটা হাঁসি দিয়ে বলল….” শুভ্রাংশু চ্যাটার্জী.. হাহ…!! মিস্টার এস.আর. এর সাথে লড়তে এসেছিলি তুই , আমার সাথে পাঙ্গা নেওয়ার ফল তো এটাই হয় সোনা । ফালতু ফালতু আমার সাথে পাঙ্গা নিতে এসেছিলি , দেখলি তো এইটুকু বয়সে নিজের প্রাণটা খোয়ালি তুই । ”

বলে আবারও হু হা করে হেসে উঠলো সেই লোকটি ।
.
.
.

ধীরে ধীরে কেটে গেল পাঁচ পাঁচটি দিন , সময় যে কারোর জন্যই থেমে থাকেনা সে নিজের ছন্দেই এগিয়ে চলে । ফ্লোরে হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে সঙ্গীতা , এই কটা দিনেও সঙ্গীতার তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি , চুপচাপ নিজের ঘরে বসে থাকে সবসময় , ও কারোর সাথে কথা বলেনা খুব একটা , খাওয়া দাওয়াও করেনা , ওকে দেখে অনেকটা জীবন্ত লাশের মত মনে হয় এখন । যার শুধু নিঃশ্বাসটুকু চলছে মাত্র । সঙ্গীতাকে ঘরের দরজার বাইরে থেকে দেখে দুই ফোঁটা চোখের জল ফেললেন দাসবাবু ( সঙ্গীতার বাবা ) , সেটা দেখে শান্তনু ( সঙ্গীতার দাভাই ) ওনার কাঁধে হাত রেখলো । দাসবাবু বলে উঠলেন…” মেয়েটাকে তো কিছুতেই সামলানো যাচ্ছেনা । ”

অর্ঘ্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল…” ওকে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে হইতো শুধু একজনই সামলাতে পারত কিন্তু সেই তো নেই…”
.
.

মাঝরাতে নিজের ঘরে একা ফ্লোরে বসে আছি আমি , নিজেকে বড্ড অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে আমার , বুকের মাঝে কষ্টগুলো যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে । চুপ থাকতে থাকতে এক সময় নিজের গলায় থাকা লকেটটা দুই হাত দিয়ে ধরে কেঁদে উঠলাম আমি ।

” কেন অংশু ?? কেন এমন করলেন আপনি আমার সাথে ?? আপনি তো বলেছিলেন সবসময় সাথে থাকবেন আমার , একসাথে জীবনের বাকিটা পথ চলবো আমরা , তবে কেন সবকিছু ঠিকভাবে শুরু হওয়ার আগেই সবকিছু শেষ করে দিয়ে আমাকে এভাবে একা ফেলে চলে গেলেন আপনি ?? বলুন না কেন করলেন এমন ?? আমার যে কষ্ট হচ্ছে অংশু প্লীজ এমন করবেন না আমার সাথে , আমি যে বাঁচতে পারবো না আপনাকে ছাড়া , আপনি কোথায় অংশু ?? প্লীজ ফিরে আসুন । ভালোবাসি আমি আপনাকে , খুব ভালোবাসি , আর কখনও কষ্ট দেবোনা আপনাকে আমি , আপনি যা বলবেন তাই করবো কখনও আপনার কোন কথার অবাধ্য হবো না আমি শুধু একটিবার ফিরে আসুন আমার কাছে । পরিবারের সকলে কষ্ট পাচ্ছে তোমার জন্য , প্লীজ ফিরে আসো । অংশু…”

বলে লকেটটা ধরে আবারও ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি , শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আমার , মনটা দুমড়ে মুচড়ে যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে । হটাৎ ঘরের ব্যালকনির দিক থেকে কিছু একটার আওয়াজ আমার কানে এল , আমি কান্না থামিয়ে ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সেদিকে দৃষ্টিপাত করলাম । কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে আমি কিছু একটা ভেবে অত্যন্ত ধীরপায়ে এগিয়ে গেলাম সেদিকে , তবে ব্যালকনিতে যেতে তেমন কিছুই সন্দেহজনক চোখে পড়লো না আমার । আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে সামনের দিকে কিছুটা এগিয়ে গেলাম তখনই হটাৎ কেও একজন পেছন থেকে এসে আমার মুখে রুমাল চেপে ধরলো , চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে আর কোন আওয়াজ বেরোলো না আমার । খুব তীব্র একটা গন্ধ নাকে এসে পৌঁছল আমার , ধীরে ধীরে আমার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল , চোখ দুটো বুজে এলো এবং আমি জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পরলাম ।

চলবে,…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here