তুমি যদি চাও,পর্ব-৩
রাজেশ্বরী দাস ( রাজী )
” এই তুই চুপ থাকবি..!! কী যা তা বকছিস বল তো তুই..বললেই হলো রাস্টিগেট করবে…!! তোর এইসমস্ত উরো ভাবনাকে পাবনায় পাঠা তো আর বেশি আলতু ফালতু কথা না বলে তুই চুপ থাক চিন্তা করিস না , আমি দেখছি তো ঠিক ব্যাপারটা…। ”
যদিও এমন নয় যে আমার একদমই ভয় করছেনা , একটু ভয় তো আমারও করছে কিন্তু এইমুহুর্তে সেটা প্রকাশ না করাটাকেই শ্রেয় বলে মনে হচ্ছে আমার । আমি সুরভির দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে দৃষ্টিপাত করলাম তবে প্রিন্সিপাল স্যার সেইমুহুর্তেই কথা বলা শেষ করে হালকা হেসে এই জাতির ক্রাস মিস্টার শুভ্রাংশু চ্যাটার্জীর পিঠ হালকা চাপড়ে কিছু একটা বলে সেখান থেকে চলে গেলেন আর মিস্টার শুভ্রাংশু চ্যাটার্জী সামনে তাকাতেই লক্ষ্য করলেন আমাদেরকে । আমরা এখনও ওখানেই দাঁড়িয়ে আছি , উনি কিছু একটা ভেবে আমার দিকে তাকিয়ে হালকা বাঁকা হেসে এদিকেই পা বাড়ালেন , সুরভি এখনও আমার একহাত জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে বেচারীর মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখন একটু কিছু হলেই শুরু হবে তার কান্না । সুরভি আমার কানের কাছে এসে ধীরকণ্ঠেই বলল… ” সঙ্গুরে সোনা মোনা জানু বন্ধু আমার প্লীজ আজকে আবার আলতু ফালতু কিছু বলিস না । ”
আমি কোন উত্তর দিলাম না চুপ করেই রইলাম । উনি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন , উনি কিছু বলবেন তখনই হটাৎ একটা ছেলে…” শুভ্রাংশু..!! ” বলে ডাক দিল , উনি ভ্রু কুঁচকে কিছুটা ঘাড় বাঁকিয়ে তার দিকে তাকালেন সরু চোখে সেই ছেলের দিকে । সেই ছেলেটা মুখে মুচকি হাঁসি টেনে তার পাশে এসে দাঁড়াল । উনি তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে আবারও আমার দিকে তাকালেন আর বললেন…” কি সৌভাগ্য আমার তুমি এখানেও , তা মিস…. উম.. নাম কী তোমার..?? ”
আমি তার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই উত্তর দিলাম…” সঙ্গীতা , সঙ্গীতা দাস । ” সেটা শুনে উনি হালকা হেসে বললেন…” স.ঙ্গী.তা. নট ব্যাড । তো তোমার নাম সঙ্গীতা মানে বলা যেতে পারে সঙ্গীত রাইট ?? সঙ্গীত তো বিভিন্ন ধরনের হয় , তা তুমি ঠিক কী ধরনের সঙ্গীত বলো তো ?? ”
কথাটা বলে উনি হালকা হাঁসলেন , পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছেলেটিও হাঁসলো । আমার নাম নিয়ে মজা করাই আমার একটু রাগ হলো কিন্তু আমি দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ সংবরণ করে রাখলাম , কারণ আমি চাইনা রাগের বশে আবার কোনো ভুল কাজ করে নতুন করে ঝেমেলা বাড়াতে ।
উনি একটু চুপ থেকে বললেন.. ” আর তুমি , তোমার নাম কী ?? ”
সুরভিকে নাম জিজ্ঞাসা করলে ও মুখে হাঁসি টানার চেষ্টা করে বলল..” সুরভি ”
” বাহ..!! বেশ সুন্দর নাম তো তোমার । তা সুরভি একটা কথা বলো তো আমাকে.. তোমার এই বান্ধবী কি আগাগোড়াই এমন মানে এই ধরো রাস্তায় যার তার ঘাড়ে পরে যায় আর আবার তাকেই উল্টে কথা শুনিয়ে দেয় । ”
” না মানে , সেরকম কিছুই না । ”
সুরভি আমার দিকে তাকালো আমি এখনও কিছু না বলে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছি । তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছেলেটা কিছুক্ষন আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল… ” এই মেয়েটা সেই…, ” বাকিটা বলার আগেই উনি আমার দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই তাকে বললেন… ” হুমম ”
” আরে বন্ধু বাদ দে না , বাচ্চা একটা মেয়ে মেয়ে না বুঝে কী বলতে কী বলে ফেলেছে তার ঠিক নেই ছেরে দে । ”
এরপর উনি বাঁকা হেসে আমার দিকে তাঁকিয়ে কিছু বলবেন তার আগেই আমি চোখ বন্ধ করে মাথা নামিয়ে এক নিঃশ্বাসে বললাম….
” সরি দাদা , আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি । আমারই ভুল ছিল কালকে । না বুঝে ওইসব বলা আমার একদমই ঠিক হয়নি । আই অ্যাম সো সো সো সরি । ”
কথার পরিপ্রেক্ষিতে সামনে থেকে কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না , তাই আমিই চোখ খুলে মাথা উচুঁ করে তার দিকে তাকালাম । উনি শান্তদৃষ্টে আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে শান্তকণ্ঠে ছোট্ট করে শুধু বললেন…
” ইটস ওকে । ”
আমি কথাটা শুনে অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম , উনি এতো সহজেই আমাকে ক্ষমা করে দিবেন আমি একদমই আশা করিনি । আমি তো ভেবেছিলাম আগে হইতো উনি বকাঝকা করবেন কিন্তু না আমার ভাবনা পুরো ভুল বলেই প্রমাণিত হল । উনি আরো বললেন…
” পরশু রাস্তায় ভুলবশত যে ধাক্কাটা লেগেছিল তার জন্য আই অ্যাম সরি । আসলে জানো তো ভুল মানুষ মাত্রই হয় , তবে ভুল করলে সেটা অবশ্যই স্বীকার করতে হয় , নিজের ভুল অন্যের ঘাড়ে কখনই চাপাতে নেই । আশা করি তুমি বুঝতে পারছো ব্যপারটা । অর্ঘ্য চল এখন তবে যাওয়া যাক । ”
” হুমম চল । ”
উনি কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থেমে তারপর দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ঘুরে উল্টোপথে পা বাড়ালেন । তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছেলেটি আমাদের দিকে তাকিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল…
” আব আমি অর্ঘ্য তুমিও আমাকে সেই নামেই ডাকতে পারো , ও আসলে এমনই একটু কিন্তু খুবই ভালো মনের মানুষ , সত্যি বলতে ওর মত ছেলে খুব কমই আছে । আর ও আগে কী বলেছে না বলছে সেগুলোর জন্য কিছু মনে কোরো না কেমন..!! ”
” হুমম ”
” অর্ঘ্য..!! তুই কি আসবি না..!! ” বেশ কিছুটা দূর থেকে শুভ্রাংশুদা কিছুটা জোরেই কথাটা বললেন ।
” হ্যাঁ হ্যাঁ আসছি । ”
অর্ঘ্যদা আর দেরি না করে…” আসছি ” বলে সেদিকে পা বাড়ালো ।
.
.
কলেজের ক্যান্টিনে বসে বসে ডোন্টকেয়ার ভাব নিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছি আমি আর আমার সামনে সুরভি তার শ্রদ্ধেয় শুভ্রাংশুদার সুনামের পুরো গোডাউন খুলে বসেছে । একে তো আমার মাথা যন্ত্রণায় ফেঁটে যাচ্ছে , উপর থেকে কানের কাছে এর ভ্যান ভ্যান , উফ..!! কি বিরক্তিকর ব্যাপার স্যাপার রে বাবা…!!
” তোকে বলেছিলাম না শুভ্রাংশুদা খুব ভালো মানুষ , দেখ কত সহজে ক্ষমা করে দিল আসলেই ওনার মতো আর মানুষই হয়না । তোর সাথেও কোনো ঝেমেলা হতো না , নেহাত তুই ওনাকে কালকে ওইসব শুনিয়ে দিয়েছিলি তাই নাহলে এমন কখনই হতো না । ”
” বোন আমার এবার তুই থামবি প্লীজ..!! উফ..!! এমনিতেই মাথা ব্যাথা করছে আমার আর তুই..!! তুই তো তার সুনাম করে পুরো সুনামি এনে তবেই ছাড়বি মনে হচ্ছে এবার । ”
” যাহ বাবা..!! এমন কী বললাম ?? ”
” আচ্ছা বাড়ি চল এমনিতেও আর কোন ক্লাস নেই আমাদের আজকে । ”
” আচ্ছা চল তবে । ”
কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে এসে আমি সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে এলাম আর নিজের রুমের বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিলাম অনেক ক্লান্ত লাগছে আজকে । তবে একটা কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে , সত্যিই যতটা খারাপ ভেবেছিলাম অতটাও খারাপ শুভ্রাংশুদা না , গতকালকে ঠিক যে পরিমাণে রাগী বলে মনে হয়েছিল তাকে দেখে , ঠিক ততটাও রাগী উনি না । সে যায় হোক কিন্তু তার কথা আমি ভাবছি কেন ?? হ্যাঁ.. প্রথমে তাকে দেখে ক্রাস খেলেও সেইমুহূর্তেই সেই ক্রাস নামক বস্তুটিকে হজম করে ফেলেছিলাম আমি । ওই ধলাবিলাই টাইপ হাজারো মেয়ের ক্রাসের কথা ভেবে আমার আর কোন কাজ নেই । তাই আফাতত নিজের এইসমস্ত ভাবনাগুলোকে সরিয়ে রেখে আমি চোখ বুজলাম , আজ সাথে সাথেই ঘুমদেবী আমার ওপর তার কৃপাবর্ষণ করলেন আর আমার চোখে নেমে এলো গভীর ঘুম এবং আমি তলিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে ।
.
.
.
কিছুক্ষণ আগেই ঘুম ভেঙেছে আমার এখনও মাথা যেন কেমন ভার হয়ে আছে , এইমুহূর্তে এক কাপ কড়া করে বানানো ব্ল্যাক কফি খেলে মন্দ হয়না তাহলে মাথা ভারিভাবটাও কেটে যাবে অনেকাংশেই । যেই ভাবা সেই কাজ , আমি বিছানা থেকে নেমে উঠে দাঁড়িয়ে সোজা গেলাম নীচে রান্নাঘরের দিকে আর নিজেই নিজের পছন্দমতো এককাপ কফি বানিয়ে রুমে ফিরে এলাম । আমি রুমের ব্যালকনিতে গিয়ে রেলিঙের গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম আর কফির কাপে চুমুক দিলাম । এখনও ঠিকভাবে সূর্য অস্ত যায়নি , তবে সূর্য যেন মেঘের আড়ালে তার মুখ লুকিয়েছে । আকাশে মেঘ থাকায় চারিপাশ বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে । মৃদুমন্দ ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে , মেঘ দেখে মনে হচ্ছে এখনই হইতো জলবিন্দুগুলো টুপ-টাপ ঝড়ে পড়বে মেঘ থেকে বৃষ্টিরূপে । ভাবতে না ভাবতেই শুরু হলো মেঘের জলবর্ষণ , আমার মুখে ফুটে উঠলো একরাশ হাসি । এই মুহূর্তে বৃষ্টির জলের ফোঁটাগুলোকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার এক প্রবল ইচ্ছে উকি-ঝুঁকি দিয়ে উঠলো আমায় মনের মাঝে । তাই আমি বাচ্চাদের মত খিলখিল করে হেঁসে উঠে , নিজের এক হাত বাড়িয়ে দিলাম একটু বাইরের দিকে , বৃষ্টির জলবিন্দুগুলো এসে আমার হাতে পড়ছে আমি , আহা কী সুন্দর অনুভূতি..!!
অন্যদিকে একজন মুগ্ধ-নয়নে চেয়ে আছে সঙ্গীতার দিকে সেদিকে সঙ্গীতার কোন খেয়ালই নেই , সে যে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিবিলাসেই মত্ত রয়েছে আর ওপরজন ব্যস্ত তার বৃষ্টিবিলাসিনিকে দেখতে । কিন্তু সেটার জন্য যে সে নিজে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে সেই দিকে তার কোন হুসই নেই । হটাৎ সেইসময় সঙ্গীতা কিছু একটা ভেবে আশেপাশে চোখ বুলালো , তবে সেই ব্যক্তিকে চোখে পড়ার আগেই সেই ব্যক্তিটি আড়ালে লুকিয়ে পরলো ।
হটাৎ , কেন জানি আমার মনে হলো কেও আমাকে দেখছে তাই আমি আশেপাশে তাকালাম , কিন্তু না সন্দেহজনক তেমন কাউকে আমার চোখে পড়লো না তবে হইতো আমারই মনের ভুল । এইসব ভাবতে না ভাবতেই বৃষ্টির বেগ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো আর নীচ থেকে আমার মায়ের কণ্ঠস্বর শোনা গেল , মা ডাকছেন হইতো আমাকে তাই আমি আর বেশি না ভেবে ব্যালকনি থেকে চলে এলাম ।
চলবে ,…..