তুমি যদি চাও,পর্ব – ৪,৫
রাজেশ্বরী দাস ( রাজী )
পর্ব-৪
নিজের ঘরে কিছু ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে গভীর মনযোগ সহকারে সেগুলোকে পর্যবেক্ষণ করছে শুভ্রাংশু , পাশে তার একজন টিমমেম্বার সৌম্য দাঁড়িয়ে আছে । সৌম্য মূলত এই দরকারী ফাইলটা তাকে দিতেই এসেছিল এখানে ।
” এইসমস্ত বেআইনি কাজ এদের দিয়ে করানো হচ্ছে । কিন্তু দেশের বিরুদ্ধে এদের দিয়ে এইসব কাজ ঠিক কে করাচ্ছে..?? এইসবের পেছনে মূল কলকাঠিটা কে নাড়ছে , মেইন কালপ্রিট এদের বস সেটা ঠিক কে ?? ওকে সৌম্য রাত হচ্ছে তুমি এখন আসতে পারো । আর ফাইলগুলো বাড়িতে পৌঁছে দেবার জন্য ধন্যবাদ । ”
” কি যে বলেন না স্যার এটা তো আমার ডিউটি ছিল । আচ্ছা আমি তবে আসছি । ”
” হুমম ”
সৌম্য চলে গেলে শুভ্রাংশু সোফায় বসল । হাতে থাকা সেই ফাইলগুলোকে পাশে রেখে ও সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজলো । তখনই ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা মেয়ের মায়াভরা সেই মুখ , সেই মেয়েটা হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির জলবিন্দুগুলোকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছে আর খিলখিলিয়ে হাসছে । শুভ্রাংশু সাথে সাথেই চোখ মেলে তাকালো আর নিজের মনেই হালকা হাসলো ।
.
.
.
কলেজের একটা ক্লাস শেষ করে আমি আর সুরভি
ক্লাসরুম থেকে বাইরে বেরোলাম , এখন আফাতত কোনো ক্লাস নেই তাই আমি ঠিক করলাম একটু কলেজের লাইব্রেরিতে যাব আজ এখন । অনেকদিন লাইব্রেরিতে যাওয়া হয়না ।
” সুরভি শোন তুই না হয় ক্যান্টিনে গিয়ে বস , আমি একটু লাইব্রেরির থেকে ঘুরে আসছি কেমন ?? ”
” আচ্ছা ঠিক আছে যা তবে তাড়াতাড়ি আসিস । ”
আমি লাইব্রেরীর পথে পা বাড়ালাম । লাইব্রেরীতে এসে কিছু বই খুঁজতে খুঁজতে যেই বইটা আমি খুঁজছিলাম সেটা পেলাম ঠিকই কিন্তু সেটা বেশ অনেকটা উচুঁতে রাখা আছে । আমি পাশে থাকা একটা স্টুল নিয়ে বুকশেলফের সামনে রেখে সেটাতে উঠলাম । স্টুলটি হালকা দুলছিল , আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে যেইনা আরেকটু পা উচুঁ করার চেষ্টা করে বইটা নামাতে গেলাম সেই ঘটলো বিপত্তি । স্টুল গেল উল্টে আর আমি গেলাম পরে তাও আবার কোনো এক ব্যক্তির ওপর এবং ঘটনাক্রমে সেই ব্যক্তির নরম ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করল আমার কপাল । সামনে সেই ব্যক্তির দিকে তাকাতে বুঝলাম সেই ব্যক্তি হলেন শুভ্রাংশুদা , আমি আজ আবারও তার ওপরেই পরেছি । আমি আর শুভ্রাংশুদা স্তব্ধ হয়ে একেওপরের দিকে তাকিয়ে আছি চোখদুটো বড় বড় করে , এইরকম কিছু হইতো আমরা কেউই আশা করিনি । আমাদের অবস্থার কথা বোধগম্য হতেই উনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন…
” তুমি কি সারাজীবন এভাবেই থাকার প্ল্যানিং করছো ?? ”
তার কথা শুনে আমার হুস ফিরল , আমি ওনার ওপর থেকে সরে এসে সোজাভাবে উঠে দাঁড়ালাম আর উনিও উঠে দাঁড়ালেন । আমি মাথা নামিয়ে রেখে বললাম…
” আব.. সরি । ”
পরক্ষণেই কিছু একটা মনে পড়তে আমি ভ্রু কুঁচকে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম….” আপনি…!! আপনি এখন এখানে কী করছেন ?? ”
” আমি তো দরকারে এসেছিলাম প্রিন্সিপালের পারমিশন নিয়েই এখানে । আমি আগে থেকে থোড়াই না জানলাম যে তুমি এসে আবার আমার ঘাড়ের ওপরেই পরবে..!! ”
” আমার কোন সখ নেই হ্যাঁ আপনার ওপর এসে পড়ার । ঐতো ওই স্টুল উল্টে গেল তাই জন্যই তো আমি পরে গেলাম আর ওই…আব…সরি..!! ”
” ইটস ওকে অ্যান্ড আমিও তখন বুঝতে পারিনি অমন কিছু হবে , সরি । আমার কাজ আছে আমি আসছি । ”
বলে উনি সেখান থেকে চলে গেলেন , বুঝলাম উনিও কিছুটা লজ্জা পেয়েছেন হইতো । আমি বই না নিয়েই লাইব্রেরী থেকে ক্যান্টিনের দিকে অগ্রসর হলাম । কিছুক্ষণ পূর্বের ঘটনাগুলোর কথা ভাবলেই কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে মনের মাঝে , বাবা দাদা ছাড়া কোন ছেলেকে আমি খুব একটা কাছে ঘেষতে দিইনি আর আজকে..!! ইশ..!! এইসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়েই ধীরে ধীরে ক্যান্টিনের দিকে এলাম । ক্যান্টিনের সামনা-সামনি আসতেই হটাৎ সুরভির দেওয়া হলকা ধাক্কা আর ওর কথায় আমি বাস্তবে ফিরে এলাম ।
” কী রে তখন থেকে ডাকছি তোকে কিন্তু কোন সাড়াশব্দই নেই , কী ভাবছিস বল তো এতো অন্যমনস্ক হয়ে ?? ”
” হ্যাঁ ?? না কিছুনা বাড়ি যাব আমি , আমার আজকে আর ক্লাস করতে ভালো লাগছেনা । ”
” আচ্ছা ঠিক আছে চল আমিও বাড়ি যায় , আসলে আমারও আজ ক্লাস করার ইচ্ছে ছিল না একেবারেই । ”
” এইযে সঙ্গীত…”
চলে যেতে গিয়েও আমি কারোর কণ্ঠস্বর শুনে থেমে গেলাম , ঘুরে তার দিকে তাকাতেই দেখলাম অর্ঘ্যদা , উনি আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন । আমি ওনার দিকে তাকিয়ে মুখে কিছুটা হাঁসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম ।
” আপনি এখানে ?? ”
” হ্যাঁ , একটু কাজ ছিল এসেছিলাম । তা তোমরা কি বাড়ি চলে যাচ্ছ নাকি ?? ”
” হ্যাঁ । ”
” ওহ , আমার কাছে তো গাড়ি আছে , আমি পৌঁছে দেবো তোমাদের ?? ”
” না না অর্ঘ্যদা তার কোন প্রয়োজন হবেনা , আমরা এমনিই চলে যেতে পারবো । ”
” আচ্ছা , ঠিক আছে তবে তোমার যা ইচ্ছে । ”
” হ্যাঁ আসছি তবে এখন । ”
আমরা চলে এলাম সেখান থেকে ।
অন্যদিকে , সঙ্গীতা আর সুরভি চলে গেলে অর্ঘ্য তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ।
বাড়ি ফেরার পথে সুরভি বলেই চলেছে এটা সেটা ।
” এই সঙ্গু জানিস ইনি হলেন শুভ্রাংশুদার বেস্ট ফ্রেন্ড অর্ঘ্যদা , দেখতে শুনতে ইনিও শুভ্রাংশুদার থেকে কম কিছু নন , অর্ঘ্যদা বর্তমানে নিজের বাবার বিজনেস সামলাচ্ছেন । কলেজে শুভ্রাংশুদার মতই অর্ঘ্যদাও বেশ ভালোই ফেমাস ছিলেন । ”
ও আরো কত কিছু বলেই চলেছে কিন্তু আমার মাথায় তো এখনও সেই লাইব্রেরীর ঘটনাটাই ঘুরপাক খাচ্ছে । এরই মাঝে সুরভি আমাকে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল…
” এই তুই আবার কী ভাবছিস বল তো ?? ”
” ঐতো কিস..”
” কী ?? ”
সুরভির দিকে তাকিয়ে দেখি ও আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । আমি এবার বুঝলাম অন্যমনস্ক হয়ে আমি ঠিক কী বলতে যাচ্ছিছিলাম ।
” মিশ , কিশমিশ…কিশমিশের কথা বলছি । ”
” কিশমিশ..!! কিন্তু এখানে কিশমিশ কোথা থেকে এলো ?? আর কিশমিশ নিয়ে এত কী ভাবছিস ?? ”
” আমার অনেক পছন্দের একটা জিনিস তাই ভাবছি । চুপ কর তো তুই , বাড়ি চল তাড়াতাড়ি । ”
” আচ্ছা । ”
.
.
.
এভাবেই কেটে গেল বেশকয়েকটা দিন , এর মাঝে শুভ্রাংশুদার সাথে আর দেখা হয়নি আমার ।
.
.
আজ আমি আর সুরভি শপিংমলে এসেছি । আজ ছুটির দিন কোথায় ভেবেছিলাম বিকেলে বেশ অনেকটা সময় ঘুম দেব কিন্তু না সুরভি আমার আরামের ঘুম হারাম করেই ছাড়লো । আর শেষে ওর জোরাজুরিতে আজ কিছু কেনাকাটা করতে ওর সাথে আসতেই হলো এই শপিংমলে । শপিংমলে এসে সুরভির কেনাকাটা শেষ করতে করতেই প্রায় অনেকটা দেরি হয়ে গেল । যদিওবা আমি তেমন কিছুই কিনিনি ।
আমরা দুজন শপিংমল থেকে বাইরে বেরোলাম , রাস্তায় রিক্সা বা সি.এন.জি চোখে না পরাই আমরা বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলাম । চারিপাশে সন্ধ্যে নেমে এসেছে বেশ কিছুসময় পূর্বেই । শপিংমল থেকে আমাদের দুজনের বাড়ি একই রাস্তায় হলেও সুরভির বাড়ি কাছেই আর তারপর আমার বাড়ি আরো বেশকিছুটা পথ দূরে , সুরভির বাড়ি থেকে বাকিটা রাস্তা আমাকে একাই যেতে হবে । সুরভির বাড়ির কাছাকাছি আসতেই আমি ওকে বললাম…” আচ্ছা তুই বাড়ি যা তবে আমি আসি । ”
” সঙ্গু বলছিলাম যে তুই একা যাবি এখন..!! বাড়ির কাউকে ডেকে নিলেও তো হয় রে । ”
” আরে কিছু হবেনা আমি একাই যেতে পারবো । ”
” ঠিক আছে তবে সাবধানে যাস । ”
” হুমম । ”
সুরভি নিজের বাড়ির দিকে চলে গেল আর আমি নিজের বাড়ির দিকে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলাম । তবে কিছুটা দূরে আসতেই লক্ষ্য করলাম রাস্তাটা একেবারেই ফাঁকা নিঃস্তব্ধ , তার ওপর আবার রাতও হয়ে এসেছে । আমি সেটা দেখে বাড়ির পথে দ্রুত গতিতে পা চালালাম । আরো কিছুটা পথ সামনে যেতেই দেখলাম রাস্তার ধরে চার-পাঁচজন ছেলে বসে আছে , ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে হাসাহাসি করছে । ছেলেগুলোকে দেখে খুব একটা সুবিধের মনে হচ্ছেনা । কেন জানি ওদের দেখে কোন এক অজানা ভয় উকি দিয়ে উঠল মনের মাঝে । তাও অনেকটা সাহস জুটিয়ে নিজের ওরনাটাকে গায়ে-মাথায় ঠিকভাবে জরিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে । কিন্তু ওদের কাছাকাছি আসতেই হটাৎ তাদের মধ্যে একজন সিটি বাজিয়ে উঠলো আর তারা সবাই একসাথে জোরে জোরে হেসে উঠলো বিশ্রীভাবে । আমি ওদের পাত্তা না দিয়ে এক পা সামনে বাড়াতে গেলেই তাদের মধ্যে একজন সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমার পথ আটকাল বাকিরাও এক এক করে আমাকে ঘিরে দাঁড়াল । তাদের মধ্যে একজন বলে উঠল.. ” এইযে ফুলটুসি মামনি একা একা কোথায় যাচ্ছ হ্যাঁ ?? ”
” কী চাই আপনাদের ?? এভাবে আমার পথ আটকেছেন কেন ?? ”
” আফাতত তোমাকে পেলেই চলবে , কী বলিস তোরা সবাই..!! ”
সবাই আবারও বিশ্রীভাবে হেসে উঠল , আমার বুকটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল , যে ভয়টা পাচ্ছিলাম সেটাই হল । ওদের মধ্যে একজন আমার হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নিল , সেখানেই আমার ফোন আর বাকিসবকিছু আছে ।
” দেখুন ভালো হবেনা কিন্তু আমার ব্যাগটা আমায় ফেরত দিন আর আমাকে যেতে দিন । ”
” যেতে তো দেবোই কিন্তু তার আগে আমাদের দিকটাও তো একটু দেখতে হবে নাকি…!! ”
বলে একজন আমার দিকে এগিয়ে আসতে নিল , এই মানুষরূপী পশুগুলোর হাত থেকে বাঁচার আর কোন পথ না পেয়ে সামনের একজনকে ধাক্কা দিয়ে আমি প্রাণপনে দৌঁড় দিলাম । দৌঁড়তে দৌঁড়তেই একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম ওরা আমার পিছুপিছুই আসছে । এতক্ষণ সাহস জুটিয়ে থাকলেও এবার ভয়ে আমার নিঃশ্বাস যেন আটকে আসছে , চোখ যেন ঝাঁপসা হয়ে আসছে । জানি না শেষপর্যন্ত নিজের সম্মান বাঁচাতে পারবো কিনা আমি । এইসব ভাবতে ভাবতেই হটাৎ কারোর সাথে ধাক্কা খেলাম আমি , তার মুখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম । সেই ব্যক্তিকে দেখে নিমিষেই ভয় দূর হয়ে গেল আমার , আর আমি….” শুভ্রাংশুদা “…. বলে ঢলে পরলাম তার বুকের ওপর । উনি আমাকে আগলে নিলেন , আমার শরীর ভয়ে কাঁপছে সোজা ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেও আর পারছি না আমি । উনি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন…
” এই এমন অবস্থা কেন তোমার ?? কী হয়েছে ?? ”
ওনার পাশে অর্ঘ্যদা ছিলেন তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন… ” সঙ্গীত ঠিক আছো তুমি..!! এই অংশু ওকে তো দেখে মনে হচ্ছে অনেক ভয় পেয়েছে কিন্তু এভাবে…”
বাকিটা বলার আগেই ওই ছেলেগুলোকে এসে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল । ওরা দুজন সেই ছেলেগুলোর দিকে তাকাল । তাদের মধ্যে একজনের হাতে একটা লেডিস ব্যাগ শুভ্রাংশুর আর বুঝতে বাকি রইলো না সঙ্গীতার এমন অবস্থার কারণ….
চলবে,….
তুমি যদি চাও
রাজেশ্বরী দাস ( রাজী )
পর্ব – ৫
শুভ্রাংশুর আর বুঝতে বাকি রইলো না সঙ্গীতার এমন অবস্থার কারণ । এরই মাঝে ছেলেগুলোর মধ্যে একজন বলে উঠলো….” এই কে রে তোরা ?? তোরা যেই হোস না কেন ওই মেয়েকে ভালোই ভালোই আমাদের হাতে তুলে দে । ”
শুভ্রাংশু সামনের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই অর্ঘ্যকে উদ্দেশ্য করে বলল….
” অর্ঘ্য তুই ওকে একটু সামলা , আমি দেখছি । ”
অর্ঘ্য আর কথা না বাড়িয়ে সঙ্গীতাকে ধরে দাঁড়ালো । সঙ্গীতা অর্ঘ্যর ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে । শুভ্রাংশু ওই ছেলেগুলোর দিকে এগিয়ে গেল , ওদের মাঝে একজন শুভ্রাংশুর দিকে এগিয়ে এসে বলে উঠলো…
” এইযে হিরো , বেশি হিরোগিরি দেখানোর সখ হয়েছে নাকি তোর এখন ?? হিরোগিরি অন্য জায়গাতে গিয়ে দেখাস , এখানে দেখাতে এলে না……
বাকি কথাটা বলার আগেই সেই ছেলেটা কিছুটা চাপা আর্তনাদ করে মাটিতে ছিটকে পরল । সব ছেলেরা কিছুটা ভীত চোখে তাকাল সেদিকে । আমি অর্ঘ্যদার ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থেকেই সামনে তাকানোর চেষ্টা করলাম । শুভ্রাংশুদা হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে রেখেছেন , রাগে তার ফর্সা মুখ যেন রক্তিমবর্ন ধারণ করেছে , কপালের রগগুলো ফুলে উঠেছে ।
সেই ছেলেগুলো একবার নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করল , তাদের মাঝে আরো দুজন শুভ্রাংশুর দিকে এগিয়ে আসতে নিল , শুভ্রাংশু তাদের মধ্যে একজনের পেট বরাবর দিল একটা জোরে ঘুষি সেও মাটিতে ছিটকে পরল । আরেকজনের হাত মুছরে ধরে কোমর বরাবর একটা জোরে কিক মারল ও এবং সেই ছেলেরা চাপা আর্তনাদ করে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল । ঠিক তখনই সাইরেনের শব্দ শোনা গেল আর সেখানে উপস্থিত হল একটি পুলিশ ভ্যান এবং কয়েকজন পুলিশ নেমে এলো সেখান থেকে । উনি ওই ছেলেগুলোকে আবার মারতে গিয়েও থেমে একবার আমার দিকে তাকালেন , তারপর ওই পুলিশ গুলোকে কিছু একটা ইশারা করলেন । ওরা ওই ছেলেগুলোকে অ্যারেস্ট করে পুলিশভ্যানে করে নিয়ে চলে গেল উনি হন্তদন্ত হয়ে আমার কাছে এসে খুব সাবধানে আমাকে নিজের কাছে আগলে নিলেন ।
” কিছু হয়নি , আমি আছি তো । এই তুমি কথা বলছো না কেন বলো তো । প্লীজ এভাবে চুপ করে থেকো না , এই কলিজা কথা কেন বলছো না তুমি ?? এই জান… ”
তার কথাগুলো আমার কানে আসলো ঠিকই কিন্তু তার পরিপ্রেক্ষিপ্তে আমি মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারলাম না । ধীরে ধীরে আমার চোখদুটো বুজে এলো , তার কথাগুলোও ধীরে ধীরে আবছা হতে লাগল এবং আমি জ্ঞান হারালাম ।
শুভ্রাংশু সঙ্গীতার মুখের দিকে দিকে তাকিয়ে দেখল ও জ্ঞান হারিয়েছে । অর্ঘ্য শুভ্রাংশুকে উদ্দেশ্য করে বলল…” ভাই অংশু , ও মনে হয় জ্ঞান হারিয়েছে ”
” হ..হ্যাঁ ওকে এখনই ডক্টরের কাছে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন । ”
শুভ্রাংশু হন্তদন্ত হয়ে সঙ্গীতাকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল , ও গাড়ির কাছে এসে ব্যকসিটে সঙ্গীতার মাথা নিজের বুকের ওপর রেখে ওকে ঠিকভাবে বসিয়ে দিল আর অর্ঘ্য গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি চালু করল ।
.
.
হাসপাতালের একটা বেডে চোখ বুজে শুয়ে আছে সঙ্গীতা , সেলাইন চলছে ওর । পাশে শুভ্রাংশু দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে একদৃষ্টে সঙ্গীতার দিকে তাকিয়ে । একজন ডাক্তার সঙ্গীতার চেক-আপ করছেন । অন্যদিকে অর্ঘ্য অবাক নয়নে চেয়ে আছে শুভ্রাংশুর দিকে , অনেক ছোট থেকেই ওরা একে অপরের বেস্ট ফ্রেন্ড । অর্ঘ্য আগে কখনও শুভ্রাংশুকে কারোর জন্য এতটা উতলা হয়ে উঠতে দেখেনি । অর্ঘ্য শুভ্রাংশুর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সঙ্গীতার মুখের দিকে তাকাল , কতই না মায়া জড়িয়ে আছে ওর এই মুখে । অর্ঘ্য সাথে সাথেই কিছু একটা ভেবে সঙ্গীতার দিক থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিল ।
ডাক্তার সঙ্গীতাকে চেক-আপ করা শেষে বললেন… ” চিন্তার কোন বিষয় নেই । আসলে অতিরিক্ত মানসিক চাপের জন্য উনি জ্ঞান হারিয়েছেন , কিছুক্ষণের মধ্যে তার জ্ঞান ফিরে আসবে । ”
কথাটা শুনে শুভ্রাংশু যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল , সাথে অর্ঘ্যও ।
” ধন্যবাদ ডক্টর ”
” তবে এইমুহূর্তে উনি কিছুটা দূর্বল তাই এখন সেলাইন চলবে আর কিছুক্ষণ পরে চাইলে সেটা খুলে ফেলতে পারেন । ”
” ওকে ”
কিছু ওষুধপত্র আর বাকি জিনিস সম্পর্কে বুঝিয়ে দিয়ে ডক্টর সেখান থেকে চলে গেলেন । অর্ঘ্য শুভ্রাংশুর পাশে এসে ওর কাধে এক হাত রাখল ।
” চিন্তা করিস না ও একদম ঠিক আছে কিন্তু সেইসময় আমরা যদি সেখানে না থাকতাম তবে যে কী হত…!! ”
” এত সহজে তো ওদের আমি ছাড়বো না , আমার জানের দিকে হাত বাড়াতে গিয়েছিল ওরা এর ফল তো ওদের ভোগ করতে হবেই । ”
.
.
.
আমার জ্ঞান ফিরতেই আমি হাতে হালকা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলাম । আমি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালাম । আশেপাশে এইমুহূর্তে কেও নেই । চারপাশে চোখ বুলাতে বুঝতে পারলাম আমি হাসপাতালের একটা বেডে শুয়ে আছি , আমার একহাতে ক্যানল ফুটানো , সেলাইন চলছে । অজ্ঞান হওয়ার পূর্বের ঘটনাগুলো মনে পড়তেই আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠলো । দরজার দিক থেকে কিছুজনের হালকা কণ্ঠস্বর ভেসে আসায় আমি সেদিকে তাকালাম , ঘরের দরজা ঠেলে আমার বাবা মা দাভাই আর সাথে আরো দুজন ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা ভেতরে এলেন । সেই ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলাকে আমি চিনি তো বলে তো আমার মনে হচ্ছেনা । আমি উঠতে গেলে বাবা আমাকে বাঁধা দিয়ে শুয়ে থাকতে বললেন তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দিলেন…” যাক জ্ঞান ফিরেছে তবে , কতটা চিন্তায় ছিলাম আমরা বল তো রে মা..!! ”
” তোর যখন শরীর খারাপ ছিল তো আজকে বাইরে যাওয়ার কী দরকার ছিল বল তো বুচি…!! রাস্তায় যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলি , তা কী কী ঘটতে পারতো কোন ধারণা আছে তোর…!! ”
দাভাই -এর কথা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পরলাম । আমি অবাক হয়ে তাকালাম ওদের দিকে আর আমার মা বলে উঠলেন…” কতবার বলেছি শাক-সবজি ঠিকভাবে খাবি , নিজের খেয়াল রাখবি কিন্তু না এই মেয়ে আমার কথা শুনলে তো । আর আজকে দেখ কীভাবে মাথা ঘুরে পরে গেলি রাস্তায় । এই সবকিছু হয়েছে তোমার জন্য , তুমি আদর দিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে মাথায় তুলেছ । বাপ-মেয়ে দুটোই হয়েছে সমান , কেও আমার একটাও কথা শুনে না । ”
” আহা..!! এর মাঝে আবার আমাকে টানছো কেন ?? আর ওকেই বা এখন বকাঝকা করছো কেন..!! দেখছো তো মেয়েটা অসুস্থ্য । ”
মা আর কিছু বললেন না , সেই ভদ্রমহিলাটি আমার কাছে এসে একগালে হাত রেখে মৃদু হেসে বললেন….” কী রে মা শরীর আগের থেকে ভালো লাগছে এখন…!! ” আমি ছোট্ট করে উত্তর দিলাম…” হ্যাঁ । ” সেই ভদ্রমহিলাটি সত্যিই খুব মিষ্টি দেখতে তবে চিনতে না পারাই কিছুটা বিস্মিত হয়ে একবার সেই ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে আমার বাবা মায়ের দিকে তাকালাম আমি । সেই ভদ্রলোকটি মুচকি হেসে বলে উঠলেন….” ও তো নিশ্চয় আমাদের চিনতে পারছে না । ”
আমার বাবা বললেন….” হ্যাঁ , মা রে শোন তবে… এইযে আঙ্কেলকে দেখছিস সে আর আমি খুব ভালো বন্ধু । ”
আমি অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালাম । তারা আমাকে পুরো কথাটা বললেন । তাদের পুরো কথা শুনে যা বুঝলাম তা হল… আমার বাবা এবং এই আঙ্কেল খুব ভালো বন্ধু । তবে ঘটনাচক্রে কলেজের পড়াশুনো শেষ হবার পরে উনি নিজের কাজের জন্য এই শহর ছেরে চলে যান । যোগাযোগ ব্যবস্থা তখন তেমন উন্নত ছিল না , তাই তাদের মধ্যে আর যোগাযোগ হয়ে উঠেনি । আর তাছাড়া আমার ঠাম্মি মারা যাবার পরে বাবাও তাদের আগের সেই বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন এখানে যেখানে বর্তমানে আমদের বসবাস । এই আন্টিটি হচ্ছেন এই আঙ্কেলেরই স্ত্রী । আঙ্কেল আন্টি এই শহরে বেশ কিছু বছর আগেই এসেছেন , এবং তাদের একটা ছেলেও আছে ।
” এখানে আমরা এসেছি বেশ কিছুবছর হয়েছে । আমি এখানে এসে তোর অনেক খোঁজ করেছিলাম কিন্তু পাইনি , আজকে এভাবে প্রায় ২৮ বছর পরে হুট করে তোদের খুঁজে পাবো তাও আবার এখানে আমি ভাবতেই পারিনি । ”
কথাটা বলেই সেই আঙ্কেল আর আমার বাবা একে-অপরকে জড়িয়ে ধরলেন । তাদের মুখের এই হাসিই বলে দিচ্ছে যে তারা আজ ঠিক কতটা খুশি । আমারও বেশ ভালো লাগছে বাবার মুখের এই হাসি দেখে আর এটা দেখে যে বাবা আজ এত বছর পর তার বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছেন ।
” সত্যিই একই শহরে এত কাছাকাছি থাকা সত্বেও আমরা একে-অপরকে খুঁজে পাইনি আর আজকে দেখ এভাবে হাসপাতালে এসে এভাবে তোকে পেয়ে গেলাম । ”
আমি তাদের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম । আন্টিটি আবারও একটু হেসে আমাকে বললেন….” এবার বুঝতে পেরেছো তো আমরা কে..?? ”
” হ্যাঁ আন্টি…। ”
” আন্টি…!! না না আন্টি কাকিমা ওইসব চলবে না , তুমি বরং আমাকে মামনি বলে ডাকবে কেমন ?? ”
” হুম আর আমাকে বাবাই বলে ডেকো ঠিক আছে মা..!! ”
” আচ্ছা ঠিক আছে তাই ডাকবো । ”
আমার মা মামনিকে উদ্দেশ্য করে বললেন….” দিদি বাবু কোথায় ?? ”
” ও তো একটু আগেই গেল বাড়ি থেকে ফ্রেশ হয়ে আসছি বলে , চলে আসবে হইতো এখনই আবার । ”
সেইমুহূর্তেই ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে আসলেন শুভ্রাংশুদা । তার পরণে ফুলহাতা একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার , চুলগুলো কেমন যেন অগোছালো এবং ভেজা । তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি সদ্য স্নান করে এসেছেন ।
” আরে এইতো অংশু চলে এসেছে…!! সঙ্গীতা মা দেখো এটা হচ্ছে আমাদের একমাত্র সন্তান শুভ্রাংশু ওরফে অংশু । ”
আমি মামনির কথা শুনে অবাকের সপ্তম পর্যায়ে গিয়ে হাঁ করে একবার শুভ্রাংশুদার দিকে তো একবার সেখানে উপস্থিত বাকি সবার দিকে তাকালাম । ওরা কিছুক্ষন আগে বাবু বলাই ভেবেছিলাম হইতো স্কুলে পড়া কোন ছোট ছেলে হবে , কিন্তু শেষে কিনা শুভ্রাংশুদা..!!
এরই মাঝে আমার মা বলে উঠলেন…” এইতো অংশু চলে এসেছে । ভাগ্যিস তুই আজকে রাস্তায় ওকে পেয়েছিলি , নাহলে কী যে….
চলবে,…….