#তুমি_এবং_তুমিই,পর্ব : ০১
লেখনী: #তাসমিয়াহ
বিরক্তি ভরা মুখ নিয়ে ট্রায়াল রুমের এক কোণে সোফায় বসে রয়েছে মিহির। হাতে শিফন জর্জেটের জরির কারুকার্যময় বেগুনি রঙের লেহেঙ্গা। সাজবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও এভাবে সাজগোজ করবার সিরিয়াল দিয়ে অপেক্ষা করতে মনে ক্ষোভ জমছে খুব।
বান্ধবী লিয়ার এংগেজমেন্ট আর সব বন্ধুবান্ধবদের গেট টুগেদার হবার জন্য নেহাৎ আসতে হল মিহিরকে। আসবার সময় এতটা বিরক্তি ছিল না। বরং বিরক্ত হবার কোনো উৎস-ও জানা ছিল না। অনেক দিন পর সব বন্ধুবান্ধবদের সাথে এক হওয়ার কথা ভেবে মনটা নেচে উঠেছিল ভীষণ। আর লিয়াকে প্রচণ্ড সাধুবাদ জানাতেও মন সম্মত ছিল খুব। একদম কিন্ডারগার্টেন থেকে কলেজ অব্ধি যতজনের সাথে পড়েছে, কেউ লিয়ার এংগেজমেন্ট পার্টির ইনভাইটেশন মিস করেনি। খুঁটে খুঁটে প্রত্যেকের সাথে যোগাযোগ করা, সবাইকে ঠিকঠাক দাওয়াত আর সুসংবাদ পৌঁছানো, এমনকি ওদের আসবার পাকা বন্দবস্ত-ও লিয়া করেছে নিজে। এতে অবশ্য উডবি হাজবেন্ড ইলহামের সম্পূর্ণ সাপোর্ট পেয়েছে লিয়া।
ইলহামের সাথে বিয়ে নির্ণীত হওয়ায় নিজেকে সৌভাগ্যবতী বলে থাকে লিয়া। বাবা মা প্রথম বিয়ের প্রস্তাব দিলে তা অগ্রাহ্য করে বসে লিয়া। মাত্র অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হয়ে এমন অবস্থায় বিয়ে, সংসার এসবে নিজেকে জড়াতে চায়নি সে। কিন্তু পরবর্তীতে ইলহামের সাথে পরিচিত হলে লিয়া মুগ্ধ হয় ইলহামের ব্যক্তিত্বের ওপর। ইলহামের প্রফুল্ল হৃদয়, প্রীতিকর চারিত্র্য, দায়িত্বশীলতা, আর সব ছাপিয়ে গিয়ে একটা মন্ত্রমুগ্ধ হাসির ঝলক সবসময় মুখাবয়বে ছড়িয়ে থাকা – সব কিছু লিয়াকে ইলহামের প্রতি আকৃষ্ট হতে বাধ্য করেছে। লিয়া বুঝতে পারে যে বাবা মা-র এই সিদ্ধান্ত তার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রকৃষ্ট। তাই খুশি মনে সব কিছু গ্রহণ করে নিত্য নতুন রঙিন স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়ে থাকে সে।
লিয়ার খুব কাছের বন্ধু হওয়ায় ওর নিত্য নতুন খুশির ফোয়ারা নজর কাড়ে মিহিরেরও। তবে মনে মনে এখনো সেই বাচ্চাদের মত অভিমানের একটা পাহাড় সাজিয়ে রেখেছে কোনো একজনের জন্য। যে কিনা ওর ভালোবাসাটাকে আবেগ বলে দমিয়ে দিতে তাকে মায়ের বকুনি অব্ধি খাইয়েছিল। আর নিজেও একদম নীরস পণ্ডিতের ন্যায় জ্ঞানের বিশাল ঝুড়ি মেলে বসেছিল মিহিরের সামনে। ভাবনার জগতে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে মিহির খুঁজে পেতে চায় সেই পছন্দের মানুষটাকে।
ফ্ল্যাশব্যাক ~~~
“আমাকে কেমন লাগছে রে সিনহা?” – (বেশ উৎসুক ভঙ্গিতে মিহির প্রশ্ন করে বসে তার সমবয়সী বান্ধবী সিনহাকে)
“ওমা, বেশ সেজেছিস তো তুই!” – (চোখ বড় বড় করে তাকায় সিনহা)
“আরে কেমন লাগছে তা বলবি তো?” – (খুব উত্তেজনাপ্রবণ হয়ে বসে মিহির)
“হু, ভালোই লাগছেরে…” – (চোখ সরু করে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে জবাব দেয় সিনহা)
“ইয়েয়য়!”
এবার খুশিতে চেঁচিয়ে নিজের দুই বেণী নাচিয়ে লাফিয়ে ওঠে মিহির। এতে সিনহা বেশ সন্দেহ নিয়ে তাকায় মিহিরের দিকে। সবেমাত্র কৈশোরে পা রাখা দুই কিশোরী একজন আরেকজনকে নিয়ে অভিশঙ্কা করবার ব্যাপারটা বেশ জমে যায়।
“এই থাম, তোর এত সাজ আর খুশির মতলবটা কী রে মিহির? সত্যি করে বল তো!”
এবার সিনহার প্রশ্নে নিরীক্ষণের আভাস পেয়ে চুপসে যায় মিহির। সিনহার পেটে কোনো কথা চাপা থাকে না বলে ওকে বলতে মন সায় দেয় না মিহিরের। তবে সিনহার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাওয়াও সম্ভব না। তাই আটকে পড়ে যায়। সিনহা তো কিছু আঁচ করতে পেরে জেরা শুরু করে দেয়। এতে মিহির পড়ে যায় মহা বিপাকে। মনে মনে নিজেকে গালাগাল করতে থাকে যে কেন সিনহা ওর অঙ্গ খাতাটা নিতে আসবার সময়ে সাজতে গেলো। আর সাজলেও ওর সামনে কেন-ইবা এত লাফালাফি করতে হবে!
সিনহার জেরার মুখে পড়বার সময় চোখে চোখ পড়ে যায় পাশের বাসার তুখোড় মেধাবী, বুদ্ধিমান, সুদর্শন কিন্তু খাপ্পা ছেলে সায়ানের সামনে। অবশ্য ছেলে বললে ভুল হবে, সাত বছরকার মত সিনিয়র হবে সায়ান। তাই অগত্যা ‘ভাইয়া’ সম্বোধন করতে হয়। দেখা হলে মুখ বুজে, মাথা নিচু করে সমঝে চলতে হয়। কিন্তু মন তো তাকে ভাইয়ার জায়গা নয়, বরং খুব খাস, অনুভূতিপ্রবণ জায়গাটা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু সে কি বুঝবে আদৌ?
সিনহা হুট করেই মিহিরকে ছেড়ে দিয়ে সায়ানের দিকে তাকালো। দেখলো সায়ান ওদের দুজনের দিকেই তাকিয়ে আছে গম্ভীরভাবে। আর সায়ানের পরনেও একটা বেগুনি রঙের টি শার্ট। খানিকক্ষণ ধ্যানমগ্ন হয়ে ভাবনা করবার পর চেঁচিয়ে বলে ওঠে সিনহা –
“মিহির, তোর আর সায়ান ভাইয়ার ড্রেসআপ একই রঙের!”
মিহির প্রায় কাঁদোকাঁদো ফেস নিয়ে তাকায় সিনহার দিকে। এই কথাটা বুঝে ফেলা কি খুব দরকার ছিল সিনহার। আর বুঝে নিলেও এত জোরে সায়ানের সামনে ফাঁস করতে হবে! সব জলে গেলো এবার। সায়ান কিছু বুঝতে পারলে কী হবে ওর?
সিনহার কথায় ভ্রু কুঁচকে সায়ান ভালো করে লক্ষ্য করল মিহিরকে। আর বেশ সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। সায়ানের এমন চাহনিতে মিহির যেন ছেঁড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। দরদরিয়ে ঘামছে। একইসাথে দুহাতে একবার নাক আরেকবার চোখ মুছছে। ভয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকা যেন সবচেয়ে ভয়ানক কাজ হয়ে ধরা দিচ্ছে। মনে মনে আফসোস করবার সাথে সাথে সিনহাকে চরম গালাগাল দিতে ইচ্ছে মিহিরের। ভালোলাগার মানুষকে সামনে দেখতে পেরেও কেটে পড়বার প্রবল আর্তনাদ যদি কেউ বুঝতো তাহলে কি আর এমন পরিস্থিতি দাঁড়াতো! সায়ান পূর্বলর চেয়ে ঢের রাশভারী ভাব টেনে মিহিরকে প্রশ্ন করল –
“বেগুনি রঙে সেজেছ কেনো? বেগুনি রঙ পছন্দ তোমার?”
সায়ানের প্রশ্ন শুনে মিহির শুকনো ঢোক গিলে। কী বলবে জবাবে তা নিয়ে আমতাআমতা করতে থাকে। বেগুনি রঙ ওর বিশেষ পছন্দ ছিল না কখনো। ছোটবেলায় ছিল বোধহয় এই রঙের দু একটা জামা। তবে যেদিন জানতে পেরেছে সায়ানের প্রিয় রঙ বেগুনি, সেদিন থেকে মনের মধ্যে সাজানো বাগানের মত ভাবনাগুলো বেগুনি আবেশে সাজিয়েছে বেশি। তাই ইদানীং প্রতিটা জিনিষ এমনি কেনে যাতে বেগুনির ছোঁয়া থাকে। এতে মনে হয় সায়ানের সান্নিধ্য মিশে রয়েছে। মানে কিশোরী মনের রঙিন ভাবনাগুলো মাঝেমধ্যে বড্ড বেয়ারা হয়ে পড়ে তার!
“কী হলো, জবাব দিতে পারছো না কেন? প্রিয় জিনিষ নিয়ে কিছু বলতে কারো এত দ্বিধা হতে পারে জানতাম না তো!”
সায়ানের কথায় মিহিরের ভেতর কেঁপে ওঠে ভয়ে। তবে তা প্রকাশ করতে না চাওয়ায় একটা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলবার চেষ্টা করে বলে –
“আপনারও কি বেগুনি রঙ প্রিয় সায়ান ভাইয়া?”
উত্তর জানা থাকলেও প্রশ্নটা ভয়ে ভয়ে হলেও করে বসলো মিহির। সায়ানের মুখের আবহ পরিবর্তন হয়ে গেল নিমিষে। আজও অজানা যে কেনো হয়েছিল এমন। সম্বোধন শুনে, নাকি কথার ওপর কথা বলে প্রশ্ন করা হয়েছিল বলে। তবে সেদিন যে অন্তরাত্মা প্রায় যাই যাই করছিল তা ভুলা সম্ভব নয় কখনো। হুট করে চেঁচিয়ে উঠে সায়ান বলে –
“প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করছো আমাকে? কী সাহস তোমার!”
“স-স-সরি ভাইয়া।” – (কাঁপা কাঁপা গলায় বলে মিহির)
“কী সরি হ্যাঁ?” – (শাসিয়ে ওঠে সায়ান)
সিনহা পরিস্থিতির আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারে না। মিহির কেন হুট করে ফুর্তি থেকে ফুঁপিয়ে উঠলো আর সায়ান কেন-ইবা এত রেগে কথা বলছে তার হিসাব মিলছে না ওর কাছে। কিন্তু পাল্টা কথা বলে ও যে মিহিরের কী পরিমাণ শত্রু হয়ে যায় তা ভাবনার বাহিরে পড়ে ছিল –
“মিহির, তোর আর সায়ান ভাইয়ার একই রঙ পছন্দ। তাই জন্য মনে হয় তুই এমন সেজেছিস তাই না? আগে বলবি তো! এটা আমি বুঝতে পারিনি বলেই…”
“সিনহা!”
সিনহাকে কথা শেষ করতে দেয় না মিহির। এক ধমকে ওকে চুপ করি দেয় প্রায়। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত ছাড়া আর লাভ হয় না। সায়ানও প্রকাণ্ড ভাবে চেঁচিয়ে ওঠে –
“মিহির, স্টপ ইট! কী ব্যবহার করছো নিজের বান্ধবীর সাথে! তুমি যে বেয়াদবি শিখেছ, ঝগড়ায় পারদর্শী, তা আন্টি জানে তো?”
সায়ানের এমন কথায় হতবাক মিহির। সায়ান ভাইয়া আমায় এমন করে বলতে পারলো!
চলবে…